ভরতকে কেন্দ্র করে শশিভূষণ ও রাধারমণের মধ্যে জোর বিবাদ ঘটে গেল। আচম্বিতে এরকম একটা অস্বাভাবিক অবস্থায় ভরতকে দেখে শশিভূষণ শুধু বিস্মিত নন, ক্রমান্বয়ে স্তম্ভিত, ক্রুদ্ধ এবং বেদনার্ত। রাধারমণের কোনও ভাবান্তর নেই। শশিভূষণ জননীর মতন যত্নে ভরতের শরীরের কাঁদা ধুইয়ে দিলেন, পরিষ্কার ধুতি পরালেন, জোর করে চিড়ে-গুড়-কলা মেখে খাইয়ে দিলেন নিজের হাতে। রাধারমণ নীরবে সব লক্ষ করে যেতে লাগলেন, তারপর যখন নৌকো ছাড়ার সময় হল, তিনি গম্ভীরভাবে বললেন, ওকে ঘাটে নামিয়ে দাও, শশী। ওকে সঙ্গে নেওয়া যাবে না।

রাধারমণ কোনও অবস্থাতেই বিচলিত বা বিস্মিত হন না। তাঁর মুখ দেখে মনের ভাব বোঝা অতি দুষ্কর। মৃতপ্রায়, উন্মাদদশাগ্ৰস্ত ভরতকে এই গঞ্জের হাটে খুঁজে পাওয়ার মধ্যে যেন অসাধারণত্ব কিছু নেই, ভরতের সঙ্গে তিনি এ পর্যন্ত একটা কথাও বলার চেষ্টা করেননি, তার এই অবস্থান্তর সম্পর্কে কোনও কৌতূহল দেখাননি।

শশিভূষণ অপলকভাবে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, আপনি কি বলছেন ঘোষমশাই। ভরতকে এখানে ফেলে যাব?

রাধারমণ বললেন, উপায় নেই। আমাদের আসার সময় উপেন্দ্র ও আরও দু’জন রাজকুমার কলকাতা বেড়াবার জন্য বায়না ধরেছিল। মহারাজ কড়াভাবে নিষেধ করেছেন। আমি একটি গোপন উদ্দেশ্য নিয়ে যাচ্ছি। এ অবস্থায় ভরতকে সঙ্গে নেওয়া কোনোক্রমে সম্ভব নয়।

শশিভূষণ জোর দিয়ে বললেন, ওকে এই অবস্থায় দেখেও কোনও মানুষ ফেলে যেতে পারে? মহারাজ নিজেই তো শুনলে বলবেন-

দাঁড়ি-মাঝিরা শুনতে পাবে বলে রাধারমণ ঘাটে নেমে একটু দূরে সুরে গেলেন। এখানে একটি বৃহৎ অশ্বথ গাছ জুল পর্যন্ত শিকড় ছড়িয়ে আছে। রাধারমণ শশিভূষণকে সেখানে হাতছানি দিয়ে ডেকে বললেন, উত্তেজিত হয়েও না, শশী। গোটা দশেক টাকা দিচ্ছি, ভরতের টাঁকে গুঁজে দাও। তারপর ওর নিয়তি ওকে যেখানে নিয়ে যায় যাক। তুমি কি জোর করে কারুর ভাগ্য বদলাতে পারবে? ভরত নামে ওই ছেলেটি একটি বর্জনীয় পদার্থ!

শশিভূষণ বললেন, তার মানে?

রাধারমণ শশিভূষণের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ত্রিপুরার সঙ্গে ওর সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। ভরত নিরুদ্দেশ হবার পর অনেক খোঁজাখোঁজি করা হয়েছিল। এ খবর মহারাজেরও কানেও যায়। তিনি একটা অদ্ভুত মন্তব্য করেছিলেন। তিনি একটুও উদ্বিগ্ন হননি, বরং উদাসীনভাবে বলেছিলেন, যেখানে গেছে যাক! কুকুরের পেটে কি আর ঘি সহ্য হয়! তখনই আমি বুঝেছিলাম, ভরতের দিন ফুরিয়েছে।

শশিভূষণ তবু কিছু বুঝতে না পেরে বললেন, কিন্তু কেন? ভরত কী দোষ করেছে? অতি নিরীহ, শান্ত ছেলে।

– সব সময় কি নিজের দোষে ভাগ্য বিপর্যয় হয়? নিয়তি দেবী অলক্ষ্যে থেকে কলকাঠি নাড়েন।

– আমি ওসব নিয়তি ফিয়তিতে বিশ্বাস করি না।

– তুমি বিশ্বাস না করলেই কি সব উল্টে যাবে? ভরত তোমার ভালো ছাত্র ছিল, তুমি দুঃখ পেয়েছ তা বুঝি। ছেলেটিকে আমিও পছন্দ করতাম। কিন্তু ও বেচারা দুর্ভাগ্য নিয়েই জন্মেছে।

— মহারাজ ওর ওপর বিরক্ত হবেন কেন? আমি খুব ভালো করেই জানি, ও ছেলে কোনও রকম সাতে পাঁচে থাকে না।

— ও না থাকলে কী হবে, অন্য কেউ ওর ওপর নজর দিয়েছিল। আমি মহারাজের একটা ইঙ্গিত থেকেই বুঝেছি, মহারাজ শিগগিরই আর একটি বিয়ে করতে চলেছেন।

– অ্যাঁ, কী বললেন? মহারানী ভানুমতীর মৃত্যু হয়েছে, এখনও দু’ সপ্তাহও কাটেনি, এর মধ্যে মহারাজ আর একটি বিয়ের চিন্তা করছেন, এ কখনও সম্ভব?

— সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়, তবে রাজা-মহারাজাদের কথা আলাদা। মনোমোহিনী মহারাজের জন্য মনোনীতা হয়ে আছে।

— মনোমোহিনী, মানে সেই ফচকে মেয়েটি? আপনি কী বলছেন, ঘোষ মশাই? মহারাজের বয়েস কত, অন্তত পঞ্চাশ হবেই, তিনি বিয়ে করবেন ওই বাচ্চা মেয়েটিকে? ছিঃ ছিঃ ছিঃ! আপনি এটা সমর্থন করবেন? শ্যালিকার মেয়ে, মনোমোহিনী তো মহারাজের কন্যার মতন।

— ওই যে বললাম, আমাদের নীতিবোধ রাজা-মহারাজাদের ক্ষেত্রে খাটে না।

– কেন খাটবে না? তারা কি মহামানব নাকি? আমরা আজও মধ্যযুগে পড়ে থাকব? এ কখনও হতে পারে না!

— চেঁচিয়ো না, শশী, চেঁচিয়ে কোনও লাভ হবে না।

— তার মানে আপনি বলতে চান, মহারাজ নিজেই ভরতকে সরিয়ে দিয়েছেন।

— তা জানি না। মণিপুরিরা, মনোমোহিনীর বাপ-জ্যাঠারাও সরিয়ে দিতে পারে, মোটকথা তাতে মহারাজের অসম্মতি নেই বোঝা যায়। অন্তঃপুরে যে রানী হয়ে থাকবে, তার সঙ্গে অন্য কোনও পুরুষের দহরম মহরম তিনি মেনে নেবেন কী করে? তুমি রাজনীতি বোঝে না শশী! রানী ভানুমতী মারা গেছেন, কুমার সমরেন্দ্রকে যুবরাজ করা হয়নি, এই অবস্থায় মণিপুরিরা ক্ষেপে আছে, তাদের শান্ত করাও মনোমোহিনীকে বিবাহের অন্যতম কারণ। ম্যারেজ অফ কনভিনিয়েন্স যাকে বলে!

— আমি এমন নোংরা রাজনীতি বুঝতেও চাই না।

— তা হলে অন্তত এইটুকু বোঝো, মহারাজ নিজের সন্তান হলেও যাকে কুকুরের মতন বিদায় করতে চেয়েছেন, আমরা রাজকর্মচারী হয়ে তাকে গ্ৰহণ করি কী করে? ছেড়ে দাও ওকে, ও ছোঁড়ার যদি কপালের জোর থাকে তা হলে ও নিজে নিজেই বাঁচবে।

– ঘোষমশাই, একটা অসহায় ছেলেকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে যদি যাই, তা হলে আমার শিক্ষা-দীক্ষা সব বৃথা। চাকরি যায় যাবে। ভরতকে আমি ফেলতে পারব না। আপনি যদি সঙ্গে নিতে না চান, তা হলে আমরা অন্য নৌকোয় যাব।

একটুখানি হেসে শশিভূষণের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন রাধারমণ। তারপর বললেন, তাই যাও। তোমার এই মহানুভবতার আমি প্রশংসা করি শশী। কিন্তু আমার নৌকোয় ভরতের স্থান নেই। তুমি যদি ওকে আঁকড়ে থাকতে চাও, তোমারও স্থান নেই। সাবধানে যেও, ভালো দেখে নৌকো ভাড়া করো। আমি আর দেরি করতে পারছি না।

রাধারমণের আদেশে মাঝিরা ঘুমন্ত ভরতকে ধরাধরি করে নৌকো থেকে নামিয়ে দিল ঘাটে। তারপর নৌকো ছেড়ে গেল। রাধারমণ হুঁকো হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন ছইয়ে ভর দিয়ে। একটু বাদেই সে নৌকো দিগন্তে মিলিয়ে গেল।

শশিভূষণ ভরতকে নিয়ে সেই গঞ্জেই একটা ভাতের হোটেলের বিশ্ৰী নোংরা ঘরে থেকে গেলেন একরাত। খুঁজে পেতে এক কবিরাজকে ধরে ভরতের চিকিৎসা করালেন। তারপর একটা নৌকো ঠিক করে নিরাপদেই পৌঁছলেন কুষ্টিয়ায়। সেখান থেকে ট্রেনে কলকাতা। শিয়ালদা স্টেশন থেকে একটা ছ্যাকড়া গাড়িতে চেপে ভবানীপুরের বাড়িতে পৌঁছলেন একেবারে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত অবস্থায়।

ভরত মাথা নাড়া ও বিড়বিড় করা বন্ধ করেছে বটে, কিন্তু কোনও কথা বলে না। হাজার প্রশ্ন করলেও উত্তর দেয় না। শুধু অপলকভাবে চেয়ে থাকে, তার কৈশরের লাবণ্যমাখা মুখখানিতে ভরের আঁকিবুঁকি। তাকে একটি পৃথক ঘর দেওয়া হয়েছে, সেখানে খাট বিছানা আছে, জানলা দিয়ে প্রচুর গাছপালা দেখা যায়, এই অঞ্চলে দালান কোঠার সংখ্যা কম। পরদিন শশিভূষণ তার খবর নিতে এসে তাকে দেখতে পান না, উদ্বিগ্ন হয়ে ডাকাডাকি করার পর আবিষ্কৃত হয়, সে খাটের নীচে অন্ধকারে বসে আছে। যেন যে একটা তাড়া খাওয়া ভয়ার্ত জন্তু।

শশিভূষণদের ভবানীপুরের এই বাড়িটা দু’মহলা। একান্নবর্তী পরিবার, তার দুই দাদা জমিদারি বিক্রি করে দিয়ে পাটের ব্যবসা করেন, ইদানীং বিদেশে প্রচুর পরিমাণে পাট রফতানি হচ্ছে…বলে ব্যবসা বেশ ভালোই জমে উঠেছে। মধ্যম ভ্রাতা মণিভূষণ একজন আর্মেনিয়ানের সঙ্গে অংশীদারত্বে নৈহাটি অঞ্চলে একটি চটকল খোলারও উদ্যোগ নিয়েছেন। শশিভূষণ যে কেন ত্রিপুরার স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছেন, তা এ বাড়ির কেউ বোঝে না।

মা এবং বাবা দু’জনেই গত হয়েছেন। দুই বৌদি অনেকদিন পরে এই খামখেয়ালি দেবরটিকে পেয়ে খাতির যত্ন করার প্রতিযোগিতায় যেতে উঠলেন। শশিভূষণকে ছবি তোলার সরঞ্জাম কেনাকটি করতে হবে, মহারাজেরও কিছু নির্দেশ আছে, এছাড়া ক্যানিং লাইব্রেরী ও প্রেস বুক ডিপোজিটারি থেকেও নতুন বই পত্রও সংগ্রহ করা দরকার, কিন্তু তিনি বাড়ি থেকে বেরুতেই পারছেন না। বাড়ির সবাই ত্রিপুরার গল্প শুনতে চায়, সে দেশ সম্পর্কে কেউ কিছুই জানে না, পাহাড় ঘেরা সেই দেশ যেন রহস্য ও রোমাঞ্চ দিয়ে ঘেরা। একটা ক্যাংলা চেহারার পাগল ছেলেকেই বা সেখান থেকে কেন নিয়ে এলেন শশিভূষণ?

দুপুরবেলা ষোড়শ ব্যঞ্জনের ভোজনপর্ব সেরে শশিভূষণ বাইরে বেরুবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, এমন সময় তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃজায়া কৃষ্ণভামিনী এসে দাঁড়ালেন দরজার ধারে। হাতে একটা রূপোর রেকাবিতে দু’খিলি পান। তার নিজের দু’গালও পানে ঠাসা, ঠোঁট দুটি টুসটুসে লাল। বয়েস হয়েছে কৃষ্ণভামিনীর, শরীরে মেদ জমেছে। দলা দলা সিঁদুর ব্যবহার করার জন্য সিঁথির কাছটায় ফাঁকা হয়ে গেছে চুল কিন্তু মুখখানি হাসিখুশি। কোনও রকম ভূমিকা না করেই তিনি বললেন, হ্যাঁ গা, তুমি কি আর বিয়ে থা করবে না? লোকের কাছে যে মুখ দেখাতে পারি না!

শশিভূষণ অবাক হয়ে বললেন, যে কি গো, বউদিদিমণি, আমি বিয়ে করছি না বলে তোমরা মুখ দেখাতে পারবে না কেন?

কৃষ্ণভামিনী অনেকখানি ভুরু তুলে বললেন, ওমা, শোনো ছেলের কথা! সোমথ পুরুষ মানুষ, লেখাপড়া  শিখেছে, তার বউ থাকবে না। ত্রিপুরার কী রাঁড় রেখছ নাকি গো!

শশিভূষণ বললেন, ছি, বউদিমণি, আমাকে তুমি এমন ভাব?

কৃষ্ণভামিনী এই ভৎসনায় একটুও লজ্জা না পেয়ে বললেন, আমিও তো তাই বলি। আমাদের ঠাকুরপো হীরের টুকরো ছেলে। গায়ে ময়লা ধরে না। শোনো, তোমার কোনও আপত্তি শুনছি না। আমার এক পিসতুতো বোন আছে, তার সঙ্গে তোমার সম্বন্ধ করছি, একবার দেখ, দেখলেই তোমার পছন্দ হবে, একেবারে সাক্ষাৎ লক্ষ্ণী প্রতিমা!

শশিভূষণ হাসলেন। আগের সন্ধ্যেবেলা একটু ফাঁকা পেয়ে মণিভুষণের শ্রী সুহাসিনীও তার কোনও এক মাসতুতো বোনের সঙ্গে শশিভূষণের বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন। এমনকি এ বাড়িতে গ্রাম সম্পর্কে এক আশ্রিতা পিসি আছেন, তিনিও পাত্রী ঠিক করে ফেলেছেন তাঁর জন্যে। সুস্থ শরীর, উপার্জনশীল কোনও পুরুষকে বিবাহ বন্ধনে বাঁধতে না পারলে মেয়েরা স্বস্তি বোধ করে না। আশ্চর্যের ব্যাপার, প্রত্যেকেরই পাত্রী একেবারে লক্ষী প্রতিমার মতন। বাংলা দেশে এত লক্ষ্মীর ছড়াছড়ি …!

কৃষ্ণভামিনীকে কোনও রকমে এড়িয়ে বাড়ি থেকে নির্গত হলেন শশিভূষণ। তার মাথায় একটা নতুন চিন্তা জাগল। বৌদিরা সব সময় এরকম জ্বালাতন করলে এ বাড়িতে বেশিদিন টেকা যাবে না। রাধারমণের সঙ্গে ঝগড়ার ফলে সম্ভবত আর ফেরা যাবে না ত্রিপুরার। কলকাতাতেও থাকতে ইচ্ছে করে না তার। একটা কিছু ব্যবস্থা করতে হবে।

পরদিন সকালেই অবশ্য এ সমস্যার অনেকটা সমাধান হয়ে গেল।

এক হাতে ধুতির কোঁচা, অন্য হাতে রুপো বাধানো ছড়ি নিয়ে এ বাড়ির দরজার সামনে এসে ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামলেন রাধারমণ। শান্ত মুখমণ্ডল, শশিভূষণের সঙ্গে ঝগড়া করে তাকে যে মাঝপথে বিদায় করে দিয়েছেন, সে জন্য কোনও পরিতাপের চিহ্নও নেই তার ব্যবহারে। অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছ, শশী? তোমরা করে পৌঁছলে? সে… ছেঁড়াটা কেমন আছে, তার চিকিৎসার কিছু ব্যবস্থা করেছ? সে ওই গঞ্জের ঘাটে এসে ঠেকলো কী করে?

ভরতকে তিনি দেখতে এলেন দোতলার ঘরে। রাধারমণকে দেখে আরও ভয় পেয়ে গেল ভরত, সে খাটের নীচে ঢুকে বসে রইল। কিছুতেই বাইরে আসতে চায় না। শশিভূষণ জোর করে টেনে এনে তাকে দাড় করালেন, সে আবার মাথা ঝাঁকাতে শুরু করেছে।

রাধামরণ বললেন, এই ভরত, তাকা আমার দিকে। কে তোকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল মনে আছে? কোথায় নিয়ে গিয়েছিল? মাথা ন্যাড়া করে দিল কে? এসব কিছু তোর মনে আছে?

ভরত সজোরে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলতে লাগল, পাখি সব, পাখি সব, পাখি সব করে রব ।

রাধারমণ বললেন, এখনও বায়ু চড়ে আছে। একবার ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারকে দেখাও। উনি ধন্বন্তরি । ঠিক হয়ে যাবে।

তারপর ভরতের মাথায় সস্নেহ হাত রেখে বললেন, তোর ভয় নেই। তুই একজন মহান ব্যক্তির হাতে পড়েছিস। আবার তোর ভাগ্য খুলে যাবে।

এরপর নীচে নেমে এসে বৈঠকখানায় বলে তিনি বললেন, পান তামাক খাওয়াও, শশী, তোমার বাড়িতে প্রথম এসেছি। তোমার সঙ্গে কথা আছে।

শশিভূষণ অনুভব করলেন, রাধারমণের ব্যক্তিত্বের কাছে তিনি নত হয়ে যাচ্ছেন। তিনি ঠিক করেছিলেন, এই হৃদয়হীন লোকটির সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক রাখবেন না। কিন্তু রাধারমণ মানী লোক হয়েও নিজেই দেখা করতে এসেছেন এবং এখন তাকে ততটা হৃদয়হীনও মনে হচ্ছে না।

রাধারমণ জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী ঠিক করলে, শশী? তুমি যদি ত্রিপুরায় ফিরে যেতে চাও, আমার কোনও আপত্তি নেই। তবে বুঝতেই পারছ, ভরতকে সেখানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া তার পক্ষেই শুভ হবে না। সিমলে পাড়ায় আমার চেনা এক ব্যক্তি নিজের বাড়িতে মফঃস্বলের ছেলেদের রেখে লেখাপড়া শেখায়। খাওয়া-দাওয়াও সেখানেই। মাসে আঠেরো টাকা করে নেয়, সেখানে রেখে দিলে ছেলেটা মানুষ হতে পারবে। মাসিক আঠেরো টাকা তুমি আর আমি ভাগ করে দেব। রাজার তহবিল নয়। আমি নিজের থেকে দিতে পারি দশ টাকা। এ প্রস্তাবটা তোমার কেমন মনে হয়?

শশিভূষণ বললেন, ভালোই তো মনে হচ্ছে। তবে একটু ভেবে দেখি।

রাধারমণ বললেন, ভাব! ত্রিপুরায় আবার যাবে কি যাবে না?

শশিভূষণ বললেন, আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমারও আপত্তি নেই।

রাধারমণ বসলেন, উত্তম, অতি উত্তম। শুধু ভরতের প্রসঙ্গটা মহারাজের কানে না তুললেই হল। আমি ভরতকে দেখিনি, ভরত কোথায় আছে জানি না। মহারাজ সহসা এ বিষয়ে তোমাকে কিছু জিজ্ঞাসাও করবেন না। ওকে সিমলে পাড়ায় পাঠিয়ে দিলে ওর সঙ্গে তোমার কোনও যোগাযোগও নির্ণয় করা যাবে না।

শশিভূষণ চুপ করে রইলেন। রাধারমণের প্রত্যেকটি কথায় অকাট্য যুক্তি আছে।

রাধারমণ বললেন, শশী, তা হলে তুমি ত্রিপুরায় রাজকর্মচারীই রইলে। এবারে তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ আছে। আমি যে কাজে এসেছি তা সার্থক হয়েছে, আশাতীত ফল পেয়েছি। শুধু আর একটি ছোট কাজ বাকি আছে। একবার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে যেতে হবে। মহারাজ তরুণ কবি রবীন্দ্রের জন্য একটি মানপত্র ও কিছু উপহার পাঠিয়েছেন, সে সব দিয়ে আসতে হবে, তুমি আমার সঙ্গে গেলে আমি বড় উপকৃত হব। তোমার আপত্তি আছে?

শশিভূষণ বললেন, এতে আপত্তির কোনও কারণ নেই। রবীন্দ্রবাবুকে দেখার কৌতূহল আছে আমারও।

রাধামরণ সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাড়িয়ে বললেন, বাঃ, তা হলে আর বিলম্বে কাজ কী? চলো, এখনই যাই, গাড়ি রেডি আছে।

জোড়াসাঁকোর দিকে এই প্রথম এলেন শশিভূষণ। তাঁদের ভবানীপুরে দিকটা ফাঁকা ফাকা, এখনও অনেকে ভবানীপুরকে রসাপাগলা গ্রাম বলে, সেই তুলনায় জোড়াসাঁকোর মানুষের ভিড়ে গমগম করে। কেরাঞ্চি গাড়ি, ছ্যাকড়া গাড়ি ছুটছে অনবরত, মাঝে মাঝে সুদৃশ্য বগি গাড়ি ও ল্যান্ডো, তারই ফাঁকে ফাকে এঁকেবেকে যাচ্ছে ঝাঁকামুটে, ফেরিওয়ালা।

গলির মুখে ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামলেন রাধারমণ ও শশিভূষণ।  কোচোয়ানের  পাশে বসেছিল একজন আর্দালি, সে উপহার দ্রব্যের দুটি বান্ডিল বয়ে নিয়ে চলল। দেউড়িতে চার পাঁচজন দারোয়ান গুলতানি করছে, তারা এঁদের দিকে ভ্রুক্ষেপও করল না। এঁরাও কিছু জিজ্ঞেস করলেন না, অনেক যাতায়াত করছে অনবরত।

দেউড়ির পরে অনেকখানি ফাঁকা চত্বর। এক পাশে রয়েছে গোটা পাঁচেক জুড়ি গাড়ি, ঘোড়াগুলির দলাই মলাই চলছে, কাছেই সার দিয়ে বসে আছে কয়েকটা ফেরিওয়ালা । ঠাকুরবাড়িটি যে এত বিশাল, সে সম্পর্কে এঁদের দু’জনেরই সঠিক ধারণা ছিল না। দু’দিকে ছড়িয়ে আছে… অনেকখানি, তারপরেও কর্মচারী-দাস দাসীদের ছোট ছোট বাড়ি ঘর। পেছন দিক থেকে মাথা তুলে আছে একটা মত বট গাছ। কিছু  স্ত্রীলোক কাঁখে কলসি নিয়ে সেদিকে যাচ্ছে দেখে বোঝা যায় একটা পুকুরও আছে।

ত্রিপুরার রাজবাড়ির চেয়ে এই প্রাসাদ অনেক বেশি সরগরম । রাধারমণ অনুভব করলেন, তার মনিবদের থেকে ঠাকুরদের ঐশ্বর্যও বেশি ।

দু’জনেরই দিশাহারা বোধ করলেন খানিকটা। কাকে দিয়ে ভেতরে খবর পাঠানো যায় বোঝা যাচ্ছে না, দাস দাসী কর্মচারী সকলেরই ব্যস্ত ভঙ্গি, কেউ ভ্রুক্ষেপ করছে না এই আগন্তুকদের দিকে।

শশিভূষণ একটা ঘরে উঁকি মেরে দেখলেন, সেখানে অনেকগুলি চৌকির ওপর ফরাস পাতা, দেওয়ালের ধারে গোছা গোছা লাল কাপড়ের মলাট দেওয়া খেরোর খাতা ও অন্য কাগজপত্র ছড়ানো। দুটি লোক সেখানে বসে পাতায় কিছু লেখালেখি করছে। এটা বৈঠকখানা নয়, সেরেস্তা ধরনের, অগত্যা শশিভূষণ সে ঘরে ঢুকেই লোকদুটির উদ্দেশে বললেন, নমস্কার, আমরা ত্রিপুরার রাজদরবার থেকে আসছি, একবার রবীন্দ্রবাবুকে খবর দেওয়া যেতে পারে কি?

একজন সেরেস্তাদার মুখ তুলে তাকাল। ত্রিপুরা দরৰারের কথা শুনে যে তেমন গুরুত্ব দিল না, চিন্তিতভাবে বলল, রবীন্দ্রৰাবু? কোন রবীন্দ্রবাবু?

শশিভূষণ বললেন, দেবেন্দ্রবাবু ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র, যার কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে ‘ভগ্নহৃদয়’-

লোকটি বলল, অ, রোববাবু! তিনি কি আছেন এখানে? বসুন আপনারা, আমি খবর পাঠাচ্ছি।

সে ভেতরের দরজার দিকে উঠে গিয়ে হেঁকে বলল, হরিচরণ, ও হরিচরণ, দেখ তো …রোববাবুমশাই আছেন কি না, কারা তাঁকে ডাকতে এয়েছেন-

ভেতর থেকে একটা অদৃশ্য কণ্ঠ আর একজনের উদ্দেশ্যে বলল, রসকে, রসকে, তিনতলায় রোববাবুমশাইকে গিয়ে বল…

মনে হল যেন সেই লোকটিও আবার অন্য একজনকে দায়িত্ব হস্তান্তরিত করল, এই বার্তা প্ৰতিধ্বনিত হয়ে উঠতে লাগল উপরের দিকে।

রাধারমণ শশিভূষণের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। সেরেস্তাদারটি অনুরোধ করাতেও তিনি ফরাসের ওপর বসলেন না, ঘরে… কোনও চেয়ার নেই। দু’জনে দাঁড়িয়েই রইলেন। সময় কাটতে লাগল, ভেতর থেকে কোনও উত্তর আসে না। রাধারমণ ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হচ্ছেন, আগে থেকে লোক মারফত খবর পাঠিয়ে আসা উচিত ছিল, কিন্তু তাঁর হাতে যে সময়… নেই। প্রথম কয়েকদিন সাহেব কোম্পানির সঙ্গে আলাপ আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন,কার্য উদ্ধার হয়েছে, কালই তাকে আবার ত্রিপুরার দিকে রওনা দিতে হবে।

সেরেস্তাদার দু’জন কাজে ব্যস্ত, একজন এক সময় মুখ তুলে বলল, জ্যোতিবাবু মশাই আর নতুন বউঠান এখন চন্দননগরে রয়েছেন।

হঠাৎ এই অপ্রাসঙ্গিক খবরটির কী তাৎপর্য তা রাধারমণ বা শশিভূষণ বুঝলেন না। মহারাজের উপহার রবি ঠাকুরের হাতে হাতে দেওয়ার নির্দেশ আছে, সেইজন্য শশিভূষণ বলল, আমরা রবীন্দ্রবাবুর সঙ্গেই দেখা করতে এসেছি-

আরও কয়েক মিনিট পরে একজন উকি দিয়ে বলে গেল, রোববাবুর ঘর তালাবন্ধ, তিনি কলকাতার বাইরে।

শশিভূষণ ও রাধারমণ পরস্পরের দিকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাবে তাকালেন।

এই সময় এক ছিপছিপে, সুদৰ্শন যুবক হনহনিয়ে এ ঘরে ঢুকে বলল, ভুজঙ্গধর, আমার মাসহারা থেক কুড়িতে টাকা দাও তো। রাস্তার কুকুরদের খাওয়াব!

সেরেস্তাদারটি বলল, আজ্ঞে আপনার মাসোহারার সব টাকা দেওয়া হয়ে গেছে।

যুবকটি ধমক দিয়ে বলল, তা বলে কি কুকুরগুলো না খেয়ে থাকবে? দাও দাও, আগাম লিখে দাও

কথা বলতে বলতে সে শশিভূষণদের উপস্থিতি টের পেয়ে থেমে গিয়ে কৌতূহলী হয়ে চেয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর জিজ্ঞেস করল, মশাইদের কোথা থেকে আসা হচ্ছে?

শশিভূষণ বললেন, আমরা আসছি ত্রিপুরার মহারাজের কাছ থেকে।

যুবকটি খুবই বিস্মিত হয়ে বলল, ত্রিপুরা? সে তো পাহাড়ের কোলে লুকিয়ে থাকে, কেউ দেখতে পায় না। সেখানকার রাজারা মুক্তাভষ্ম, হীরেভষ্ম খায়, তাই না! কিন্তু বাবুমশাই আলমোরায় গেছেন, তার সঙ্গে তো দেখা হবে না।

শশিভূষণ বললেন, আমরা রবীন্দ্ৰবাবুর জন্য একটা চিঠি নিয়ে এসেছি।

যুবকটি বলল, রবি? রবি তো বাচ্চা ছেলে। তার সঙ্গে আপনাদের কী দরকার? সে বিলেত থেকে পালিয়ে এসে এখন লুকিয়ে আছে, তা জানেন না?

শশিভূষণ বললেন, তিনি একটি কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন।

তাকে থামিয়ে দিয়ে যুবকটি বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, রবি কবিতা লেখে, বেশ তোফা লেখে, আমরাই ওর বই ছাপিয়ে দিই। বিক্রি হয় না মোটে। আমি কে জানেন? আমি হচ্ছি রবির দাদা, সোম। কী বিশ্বাস হচ্ছে না। এই ভুজঙ্গধরকে জিজ্ঞেস করুন। ওহে ভুজঙ্গ, আমি সোমবাবু নাই?

লোকটি বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ।

এবার যুবকটি এক গাল হেসে বলল, আমিও কবিতা লিখতে পারি। রবি গান গায়। আমি তার চেয়েও ভালো গান গাই। শুনবেন আমার গান?

এবার সে দু’হাত তুলে বেশ চেঁচিয়ে গান ধরল, ‘দেখিতে তরঙ্গময় ভব পারাবার- ’

তরঙ্গ বোঝাবার জন্য দু’হাত কাপিয়ে নাচের ভঙ্গি করল। ক্রমশ সে নৃত্য উদ্দাম হল। নাচতে নাচতে রাধারমণের হাত চেপে ধরে বলল, অমন গোমড়া মুখে দাঁড়িয়ে কেন? আপনিও নাচুন আমার সঙ্গে। নাচলে মন ভালো হয়ে যায়—

একজন হৃষ্টপুষ্ট, গৌরবর্ণ, সুদৰ্শন পুরুষ দ্রুত ঘরে ঢুকে এসে সোমের কাঁধ ধরে বললেন, এ কী সোম, কী করছ? বাইরে থেকে ভদ্ৰলোকেরা এসেছেন।

সোম সরল ভাবে বলল, কিছু করিনি তো, ওঁদের গান শোনাচ্ছিলাম। রবির থেকে আমি ভালো গাই কি না বল? ওঁদের নাচতে বলছিলাম আমার সঙ্গে। নাচলে মন ভালো হয় না, গুণও দাদা?

গুণেন্দ্ৰনাথ স্নেহের সঙ্গে বললেন, না, সেমা, সবার সামনে এমন হঠাৎ নাচতে নেই। চলো এখন ভেতরে চলো, লক্ষ্মী ভাইটি আমরা-

আর একজন ভৃত্যও এসে গেছে। দু’জনে সোমের দু’কাঁধ ধরে আস্তে আস্তে টেনে নিয়ে গেল অন্দরমহলে।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়