গ্রিনরুম থেকে বেরিয়ে ধীর পায়ে মঞ্চের পেছনে হলুদ রঙের দেওয়ান্সের সামনে এসে দাঁড়ালেন গিরিশচন্দ্র। সেই দেওয়ালে ঝুলছে গিরিশচন্দ্রের গুরু রামকৃষ্ণদেবের একটি আবক্ষ প্রতিকৃতি। ফটোগ্রাফ দেখিয়ে এক ইংরেজ চিত্রকরকে দিয়ে সেই ছবি আঁকানো হয়েছে, চক্ষু দুটি যেন একেবারে জীবন্ত। ছবির রামকৃষ্ণদেব চেয়ে আছেন তাঁর এই প্রিয় শিষের দিকে। গিরিশ হাত জোড় করে, চক্ষু বুজে বেশ কিছুক্ষণ ধ্যানমগ্ন হয়ে রইলেন সেই ছবির সামনে।

গিরিশচন্দ্রের পায়ে ফিতে বাঁধা জুতো, ভেলভেটের ট্রাউজার্স, পুরো হাতা সাদা জামা, তার দুই কবজির কাছে কুচি দেওয়া, বুকের কাছে লেস বসানো, টাক মাথা ঢাকা পরচুলায়, কুঞ্চিত কেশ ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। কাঁচা-পাকা গোঁফ রং মাখিয়ে কুচকুচে কালো করা হয়েছে, মুখে গোলাপি আভা, একেবারে পাক্কা সাহেব। কোমরবন্ধে তলোয়ার। প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়েসে পৌঁছে গিরিশচন্দ্রকে আবার এক অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

গিরিশচন্দ্র মঞ্চে অভিনয় বন্ধ করে দিয়েছিলেন অনেক দিন। নতুন দর্শকরা অভিনেতা হিসেবে তাঁকে চেনেই না। তিনি নাট্যকার, অভিনয় শিক্ষক ও ম্যানেজার। এইজন্যই বিভিন্ন থিয়েটার কোম্পানি তাঁকে টানাটানি করে। কিন্তু এতদিন পর তিনি বাধ্য হয়ে আবার মঞ্চে অবতরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এক কঠিন ভূমিকায়। এ নাটক দর্শকরা কেমনভাবে গ্রহণ করবে তার ঠিক নেই। হঠাৎ দুযোগের মতন, এ নাটকের নায়িকা হিসেবে বেশ কয়েক মাস ধরে গিরিশচন্দ্র যাকে পাখি-পড়ার মতন সব কিছু শিখিয়েছেন, সে দু’দিন আগে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এমনই ভেদ বমি যে শয্যা থেকে ওঠারই ক্ষমতা নেই তার। বিশিষ্ট জ্ঞানী-গুণী নাগরিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, এখন অভিনয় বন্ধ করে দেওয়াও যায় না, তাই শেষ মুহূর্তে নায়িকা বদল করতে হয়েছে। তিনকড়ি পাসী নামের মেয়েটির অল্প বয়েস, শরীরে রোগব্যাধির চিহ্ন নেই, সে যে অকস্মাৎ পীড়িত হয়ে পড়তে পারে, এমন আশঙ্কাই মনে জাগেনি, তাই দ্বিতীয় কারুকে নায়িকা হিসেবে তৈরি করা হয়নি। এখন এই দুদিনের মধ্যে অন্য ভূমিকার একটি মেয়েকে দেওয়া হয়েছে প্রধানা নারীচরিত্র। আজ সত্যিই এক অগ্নিপরীক্ষা।

তিনকডিকে যখন আর শয্যা থেকে তোলা যাবে না নিশ্চিত জানা গেল, তখন দু-একজন বলেছিল, এত অল্প সময়ে লেডি ম্যাকবেথের ভূমিকা মুখস্থ করে মঞ্চে উতরে দেবার ক্ষমতা বঙ্গের একমাত্র একজন অভিনেত্রীরই আছে, সেই বিনোদিনীকেই ডাকা হোক না। নতুন রঙ্গমঞ্চ, নতুন মালিক, অর্থব্যয় হচ্ছে অকাতরে, সুতরাং বিনোদিনীর কাছে একবার প্রস্তাব পাঠানো যেতে পারে। মালিকও রাজি, কিন্তু বেঁকে বসেছিলেন গিরিশচন্দ্র। না, বিনোদিনীকে তিনি আর ডাক পাঠাবেন না। বিনোদিনী মঞ্চের মর্যাদা রাখেনি, নাট্য শিল্পকলার চেয়ে তার আত্মাভিমান বেশি হয়ে গেছে। এখন বাধ্য হয়ে, কৃপাপ্রার্থীর মতন আবার বিনোদিনীর দ্বারস্থ হতে হবে? গিরিশচন্দ্র নিজেই তা হলে থিয়েটার ছেড়ে চলে যাবেন।

গত সাত বছর ধরে বিনোদিনীর কোনও সংশ্রব নেই থিয়েটারের সঙ্গে। ‘বেল্লিক বাজার’-এর পর “রূপ-সনাতন”-এর মহড়া যখন চলছিল স্টার থিয়েটারে, তখনই একদিন বিনোদিনী অন্য অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে কলহ শুরু করায় তাকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর ডাকা হয়নি তাকে। যে স্টার থিয়েটারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন থেকে সার্থকতার মূলে বিনোদিনীর অনেকখানি স্বার্থত্যাগ ও অভিনয়প্রতিভা, সেই স্টার থেকেই কার্যত বিতাড়িত হলেন বিনোদিনী। এমনই হয় বুঝি রঙ্গজগতের মানুষদের নিয়তি! কে কাকে দোষ দেবে, স্টার থিয়েটারের পরিচালকবর্গের নির্দয়তা না বিনোদিনীর অহমিকা? নারীচরিত্রও কী বিষম দুর্বোধ্য। থিয়েটারকে ভালবেসে, থিয়েটারের মানুষজনকেই পরম আপনজন জ্ঞান করে যে-বিনদিনী একসময় এক দুশ্চরিত্র যুবকের খেয়াল চরিতার্থ করার জন্য তার শয্যাসঙ্গিনী হতে বাধ্য হয়েছিল, সেই বিনোদিনীই যখন সার্থকতার শীর্ষে, দর্শকরা যখন তাকে ধন্য ধন্য করে, যখন সে স্বয়ং রামকৃষ্ণদেবের আশীর্বাদ পেয়েছিল, যখন তার অর্থের অভাব ছিল না, তখনই সে থিয়েটারের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে আবার এক ধনীর রক্ষিতা হয়েছিল স্বেচ্ছায়। এতে দারুণ আঘাত পেয়েছিলেন গিরিশচন্দ্র। অভিমানভরে তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন, যে-মঞ্চের সঙ্গে তিনি যুক্ত থাকবেন, সে মঞ্চে আর বিনোদিনীর স্থান নেই।

মাত্র চব্বিশ বছর বয়েসে, যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, তখনই বিনোদিনীকে বিদায় নিতে হয় থিয়েটারের জগৎ থেকে। সে অবশ্য বলে যে সে নিজেই সরে এসেছে, কিন্তু কোনও মঞ্চ থেকেই তাকে আর কেউ সাধতে যায় না। এখন তার একত্রিশ বছর বয়েস, রূপ-যৌবন কিছুই স্নান হয়নি, তবু তাকে ফিরিয়ে আনতে গিরিশচন্দ্র কিছুতেই রাজি নন।

বিনোদিনীর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ হবার পর গিরিশচন্দ্রের জীবনে এবং থিয়েটার জগতেও অনেক অভাবনীয় কাণ্ড ঘটে গেছে। আলোর টানে যেমন পতঙ্গ ছুটে আসে, সেখানেই মৃত্যুবরণ করে, তেমনি রঙ্গমঞ্চের পাদপ্রদীপের আলোও অনেককে টেনে এনে ভূপাতিত করে দেয়। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় বন্ধুত্বের সম্পর্ক, ফুৎকারে উড়ে যায় ভালবাসা, লকলক করে ওঠে ঈর্ষা ও স্বার্থ। আজ যার সঙ্গে গলাগলি ভাব, কাল হঠাৎ সে গলা টিপে ধরতে চায়। একের পর এক আকস্মিক আঘাতে গিরিশ একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন।

‘চৈতন্যলীলা’, ‘বিল্বমঙ্গল’, ‘বেল্লিক বাজার’-এ যখন স্টার থিয়েটারের রমরমা অবস্থা, অন্য থিয়েটারগুলি যখন একেবারে কহিল, ঠিক সেই সময় একদিন বিনা মেঘে বজ্রপাত হল। একদিন এক উকিল এসে গিরিশচন্দ্রকে বলল, ওহে ঘোষজা, তোমাদের তোে এবার এখান থেকে পাট ওঠাতে হয়। আমার মক্কেল এ ভূমি কিনে নিয়েছেন!

গিরিশ ও তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা প্রথমে একথা বিশ্বাসই করতে পারেনি, হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই সি মিলিয়ে গেল। স্টার রঙ্গমঞ্চটি তাদের নিজস্ব হলেও জমিটি লিজ নেওয়া। প্রখ্যাত ধনকুবের মতিলাল শীলের পৌত্র গোপালগাল শীল সেই জমি কিনে নিয়েছেন গোপনে। গোপাললালের কানে তার মোসাহেবেরা কুমন্ত্রণা দিয়েছে, মশাই, থিয়েটারের ব্যবসা এখন খুব ভাল চলছে, আপনি নিজে একটা থিয়েটার খুলুন না। তাতে বেশ দু পয়সা আসবে, আবার ফুর্তিফার্তাও হবে।

গোপাললাল রাজি হয়ে গেলেন তো বটেই, তাঁর বাবসাবুদ্ধি থেকে বুঝলেন, নতুন থিয়েটার খোলার আগে স্টার থিয়েটারকে কুপোকাত করা দরকার। তাই নতুন জমি কিনে রঙ্গমঞ্চ বানাবার বদলে ওই স্টারের জমিটাই তাঁর চাই।

বাস্তব সত্যটা উপলব্ধি করার পর গিরিশ ও অমৃতলালরা মাথায় হাত দিয়ে বসলেন। জমি একজনের, তার ওপরের বাড়ির মালিক অন্যজন। অন্য কেউ জমিটা কিনে নিলেও কি বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হবে স্টারের দল? এ নিয়ে মামলা মোকদ্দমা করা যায়। কিন্তু গোপাঙ্গলাল বিপুল ধনী, তার সঙ্গে মামলায় কি টক্কর দেওয়া যাবে? যার বেশি টাকা, আইন তার পক্ষেই যায়। তা ছাড়া, ধনীদের পক্ষেই থাকে তার দল। এটাই চিরকালের নিয়ম। গোপাললালের দলবঙ্গ হমলা শুরু করলে এখানে থিয়েটার চালানো সম্ভব হবে না।

শেষ পর্যন্ত আদালতের বাইরেই একটা রফা হল। গোপাললাল তিরিশ হাজার টাকায় রঙ্গমঞ্চটাও কিনে নিলেন, কিন্তু স্টার’ নামটা তিনি পাবেন না। স্টারের দল হাতিবাগানে জমি কিনে নতুন রঙ্গমঞ্চ প্রস্তুত করতে লাগল, আরও টাকা তোলার জন্য তারা ঢাকা শহরে চলে গেল অভিনয় করতে।

বিডন স্ট্রিটের সেই প্রাক্তন স্টার রঙ্গমঞ্চের নতুন নাম হল এমারাভ। নতুনভাবে সব কিছু সাজিয়ে গোপালান্স পাণ্ডব নির্বাসন’ পালা নামালেন। প্রচুর অর্থ ব্যয়, প্রচুর আলো, অর্ধেন্দুশেখর, মহেন্দ্রলাল বসু, বনবিহারিণী, কুসুমকুমারীর মতন নট-নটী, তবু নাটক জমে না। চাকচিক্যের অভাব নেই, কিন্তু কেমন যেন প্রাণহীন! এ যেন শশধর বিহীন রাত্রির আকাশ। চাঁদ না উঠলে কি আর অন্য তারকাদের ঔজ্জ্বল্য প্রকাশ পায়? এ যেন শিবহীন যজ্ঞ।

মোসাহেবরা গোপাললালকে আবার বোঝাল, থিয়েটার মানেই এখন গিরিশচাঁদ। ও ব্যাটাকে ধরে আনন। গিরিশের হাতের সুতোর টান না পড়লে মঞ্চের এই পুতুলগুলো ঠিকমতন নাচবে না।

গোপালগাল গিরিশের কাছে দূত পাঠালেন। দশ হাজার টাকা নগদ বোনাস, আড়াইশো টাকা মাসিক ভাতা, নাট্যকার ও ম্যানেক্সার হিসেবে গিরিশকে তাঁর চাই। গিরিশচন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। স্টার থিয়েটার তাঁর প্রাণ। এখানে কোনও ব্যক্তিগত মালিকানা নেই, মালিকের ব্যক্তিগত খেয়ালখুশি অনুযায়ী কিছু চলে না। থিয়েটারের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত কয়েকজনের এক কমিটি স্টার চালায়। এখানকার ড্রেসার-প্রমটার থেকে শুরু করে নায়ক-নায়িকা পর্যন্ত সবাই তাঁর হাতে গড়া।

পরদিন আবার দৃত এল, নগদ বোনাস পনেরো হাজার, মাসিক ভাতা তিন শো। এবারেও গিরিশ হাত জোড় করে বললেন, শীলমশাইকে আমার নমস্কার ও ধন্যবাদ জানাবেন, আমি স্টার থিয়েটার ছেড়ে কোথাও যাব না।

আবার প্রদিন এল দূত। উকিলবাবুটি শুধু একা নন, সঙ্গে দুজন বন্দুকধারী পেয়াদা। উকিলবাবুটি কথা বলতে লাগলেন, গোঁফে তা দিতে লাগল পেয়াদ দুটি।

উকিলবাবু বললেন, নগদ বোনাস কুড়ি হাজার আর মাসিক ভাতা সাড়ে তিন শো। মশাই, লাটসাহেবের পর আর এত টাকা কে রোজগার করে বলুন দেখি। জলে বাস করে কি কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করতে চান? গোপাললাল শীলের মাথায় খেয়াল চেপেছে আপনাকে মাইনে দিয়ে চাকর করে রাখবে, তা মান্য না করলে আপনি এই কলকাতা শহরে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেন। টাকা ছাড়িয়ে তিনি আপনার দলের সবকটাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে যাবেন, আপনাদের এই স্টার-এর বাড়িও কোনওদিন শেষ হবে না।

এই স্টার-এর জন্য একদিন বিনোদিনীকে দেহ বিক্রয় করতে হয়েছিল, আজ গিরিশচন্দ্রকে মস্তিষ্ক বিক্রয় করতে হবে।

সহকর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ করে গিরিশচন্দ্র বুঝলেন, এ ছাড়া আর পথ নেই। এখন সবচেয়ে বড় কথা, হাতিবাগানে এই নতুন স্টার মঞ্চটি গড়ে তোলা। তার জন্য টাকা ধার করতে হচ্ছে। কুড়ি হাজার টাকা থেকে যোলো হাজার টাকাই তিনি এই মঞ্চ নির্মাণের জন্য নিঃস্বার্থভাবে দান করে দিলেন। অমৃতলালের হাত ধরে বলেন, আমার একটাই শর্ত রইল, এই থিয়েটারে যারা যোগ দেবে, সবাইকে ভদ্র সন্তান বলে গণ্য করবে। আর দেখো, এখানে যেন কারুর কোনও অপমান না হয়।

এমারাল্ডে এসে যোগ দিলেন গিরিশ, নতুন নাটক লিখলেন ‘পূর্ণচন্দ্র’, খুব ধুমধাম করে তার উদ্বোধন হল। কিন্তু গিরিশের মন পড়ে থাকে স্টারে। একজন শিল্পীর মনটাই যে আসল, তা ক’জন বোঝে? গোপাললাল নানান চুক্তিতে বেঁধে ফেলেছেন গিরিশকে, প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে তিনি মঞ্চে অজিরা দেন, যথাসাধ্য পরিশ্রম করে তিনি নাটকের সুষ্ঠু উপস্থাপনার ব্যবস্থা করেন, তবু যে ভেতরে ভেতরে তিনি উদাসীন, গোপাললাল তা জানেন না।

স্টারের বন্ধুরা গোপনে গোপনে দেখা করতে আসে। হাতিবাগানে মঞ্চ প্রস্তুত হয়ে গেছে, কিন্তু একখানা নতুন নাটক দিয়ে শুরু না করলে দর্শকরা আকৃষ্ট হবে কেন? পর্ণচন্দ্র নাটকটাই কি স্টার-এর প্রাপ্য ছিল না? স্টার-এর জন্য নতুন নাটক কে লিখে দেবে?

গোপাললালের সঙ্গে চুক্তি আছে যে গিরিশচন্দ্র অন্য কোনও থিয়েটারের জন্য নাটক লিখে দিতে পারবেন না, স্টারকে সাহায্য করার তো প্রশ্নই ওঠে না। অথচ স্টার-এর প্রতি গিরিশের প্রাণের টান। তাঁর লেখা নতুন নাটক দিয়েই শুরু করতে হবে স্টার-এর জয়যাত্রা।

একটু-আধটু সুরা পান না করলে গিরিশের হাত খোলে না, ভাল ভাল সংলাপ মনে আসে না। গান রচনার সময় আরও দু’ পান্তুর চড়াতে হয়। ইদানীং তিনি নিজের হাতে কিছু লিখতে পারেন না, নেশার সময় তাঁর হাত কাঁপে, তিনি নাটক রচনা করেন অবিনাশ নামে একটি ছেলেকে ভিকটেশান দিয়ে। বাড়িতে বসে সে রকমভাবে লেখা সম্ভব নয়, অহরহ এমারাল্ড-এর দৃত আসে, তাঁর গতিবিধির ওপরেও নজর রাখা হয়।

একদিন গিরিশচন্দ্র শাড়ি পরে রমণী সেজে বাড়ি থেকে বেরুলেন। পথের কোনও লোক তাঁকে পুরুষ বলে সন্দেহ করল না। তিনি পাকা অভিনেতা, নারীর ভূমিকাই বা পারবেন না কেন, শুধু গোঁফটা লুকোবার জন্য ঘোমটায় মুখের অনেকখানি ঢেকে রাখতে হয়। গিরিশ বেশ মজা পেয়ে গেলেন। স্ত্রীলোক সেজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এক বন্ধুর গৃহে গিয়ে নাটক ডিকটেশন দিতে লাগলেন। রচিত হল ‘নসীরাম’, সেটা স্টারে যখন মঞ্চস্থ হল, তখন নাট্যকারের নাম কেউ জানল না, বিজ্ঞাপনে দেওয়া হল রচয়িতার নাম ‘সেবক’। নাটক শুরু হবার আগে প্রস্তাবনা হিসেবে পাঠ করা হয় আত্মগোপনকারী নাট্যকারের এক কবিতা।

হে সজ্জন, পদে নিবেদন
নির্বাসিত মনোদুঃখে বঞ্চিলাম অধোমুখে
বঞ্চিত বাঞ্ছিত তব চরণ বন্দন…

দুটি মঞ্চেই অভিনীত হতে লাগল গিরিশচন্দ্রের নাটক। দুই দলে তীব্র প্রতিযোগিতা, এক দিকে গিরিশ, অন্য দিকে তাঁরই শিষ্য সম্প্রদায়। এমারাল্ড-এর চেয়ে স্টার-এর টিকিট যেদিন বেশি বিক্রি হয়, সে সংবাদ পেয়ে গিরিশ বেশি পুলকিত হন। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে গিরিশ একদিন শুনতে পেলেন একজন পথিক আর একজনকে বলছে, ওরে ভাই, স্টারের নতুন পালাটা দেখেছিস? কে একটা নতুন লোক নাটক লিখেছে, খোদ গিরিশবাবুকেও দুয়ো দিয়ে দিয়েছে।

বছর দু-এক এইভাবে কাটল, তারপর গোপাললাল শীল একদিন ম্যানেজারের ঘরে এসে মুখ ভেটকে বললেন, দুর দুর, থিয়েটার চালানো কি মানী বংশের কাজ? আট আনা এক টাকার টিকিট কেটে আসে পাঁচপেঁচি লোকেরা, তাদের মন জুগিয়ে চলতে হবে আমাকে। কাল থেকে সব বন্ধ করে দাও।

বড়লোকের খেয়াল, বেশি দিন তারা এক ব্যাপারে স্থির থাকতে পারে না। গোপাঙ্গলালের শখ মিটে গেছে, তিনি রঙ্গমঞ্চ ভাড়া দিয়ে দিলেন অন্য লোকদের। তারাও থিয়েটারই চালাবে, কিন্তু তাদের সঙ্গে গিরিশের কোনও চুক্তি নেই। তিনি খুশিতে ডগোমগো হয়ে ফিরে এলেন স্টারে, তাঁর স্বভূমিতে।

কয়েক বছরের মধ্যেই গিরিশচন্দ্র তাঁর জীবনের কঠিনতম আঘাতটি পেলেন এই স্টারেই বন্ধু, সহকর্মী ও শিষ্যদের কাছ থেকে।

‘নসীরাম’ ছাড়া আর কোনও নাটক এই দু বছরে স্টারের জন্য লিখে দিতে পারেননি গিরিশচন্দ্র। তখন ম্যানেজার অমৃতলাল বসু সরলা’ নামে একখানি নাটক নামিয়ে দিল। তারক গঙ্গোপাধ্যায়ের স্বর্ণলতা উপন্যাসটির নাট্যরূপ, সাদামাঠা সামাজিক কাহিনী, তাও কিন্তু খুবই বাহবা পেল দর্শকদের কাছ থেকে। তারপর অমৃতলাল নিজেই লিখলেন ‘তাজ্জব ব্যাপার, তাও বেশ জমজমাট।

গিরিশচন্দ্র ফিরে এলে অমৃতলালের বদলে তাঁকেই আবার ম্যানেজার করা হল। অমৃতসালের পক্ষে সেটা খুশি মনে মেনে নেওয়া সম্ভব কী? অমৃতলাঙ্গ ইতিমধ্যে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে। অমৃতলাল গিরিশের শিষ্য বটে, কিন্তু শিষ্য কি চিরকাল পায়ের তলায় পড়ে থাকবে, তারও কি বড় হওয়ার সাধ জাগে না? গিরিশেরও ভুল হল, তিনি নজর করলেন না শিষ্যের ক্ষোভ।

স্টার-এর জন্য গিরিশ লিখতে লাগলেন একের পর এক মঞ্চ-সফল নাটক। প্রফুল্ল’, ‘হানিধি, ‘চণ্ড’। স্টারের জনপ্রিয়তার তুলনায় অন্য সব থিয়েটার স্নান। নতুন নাটক লেখার পর গিরিশ প্রথম দু-চারদিন মহড়ার সময় সবাইকে দেখিয়ে শুনিয়ে দেন, তারপর শিষ্য অমৃতলালকে বলে দেন, ওরে, এর পর তুই গড়েপিটে নিস!

এখন আর গিরিশ নিয়মিত মহড়ায় আসার প্রয়োজন বোধ করেন না, শিষ্যের ওপর তাঁর যথেষ্ট ভরসা আছে। অমৃতলালকে খাটতে হয় প্রচুর, সমস্ত খুঁটিনাটির দিকে তাঁকে নজর দিতে হয়। তারপর নাটক যখন জমজমাট হয়, পত্রপত্রিকার বিজ্ঞ সমালোচকরা লেখেন, “গিরিশচন্দ্র ঘোষ মহোদয় বর্তমান সমাজের বাস্তব চিত্র অঙ্কিত করিয়া একটি উচ্চাঙ্গের নতুন নাটক উপহার দিয়াছেন তো বটেই, তাঁহার নিপুণ পরিচালনা ও শিক্ষাগুণে অভিনয়ও অতি উচ্চমানের হইয়াছে।’ গিরিশ ম্যানেজার, পরিচালনার সব কৃতিত্ব তাঁরই, অমৃতলালের নাম উল্লেখ থাকে না। গিরিশ মনে করেন, গুরুর গৌরবেই শিষ্যের গৌরব।

এই সময় গিরিশ পারিবারিকভাবেও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় পত্রী দীর্ঘদিন রোগভোগের পর দেহরক্ষা করেছেন। এই পক্ষে তাঁর দুটি কন্যা ও একটি পুত্র জন্মেছি। কন্যা দুটিরই অকালমৃত্যু ঘটেছে, মাতৃহারা শিশুপুত্রটি গিরিশের চক্ষের মণি। মাতাল অবস্থায় গিরিশ প্রায়ই তাঁর গুরু রামকৃষ্ণদেবকে বলতেন, তুমি আমার ছেলে হও! এখন গিরিশের ধারণা হল, সত্যিই রামকৃষ্ণদেব তাঁর এই পুত্ররূপ ধরে এসেছেন। ছেলেটির মধ্যে অনেক অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপার তিনি দেখতে পান।

এই ছেলেটি জন্ম থেকেই রুগণ। এর চিকিৎসার জন্য গিরিশ সবরকম চিকিৎসকদের দ্বারস্থ হয়েছেন, নিমেষের জন্যও ছেলেকে কাছছাড়া করেন না। স্টার-এর জন্য নতুন নাটক দরকার হলে অবিনাশকে ডেকে ডিকটেশন দিয়ে একটা কিছু লিখে পাঠিয়ে দেন। রঙ্গমঞ্চের ধারেকাছে যাওয়া একেবারে বন্ধ। মলিনা বিকাশ’ আর ‘মহাপূজা’ নাটক দুটি হল দায়সারা গোছের।

এদিকে অমৃতলাল ও অন্য কয়েকজনের মধ্যে অসন্তোষ ধূমায়িত হচ্ছে। গিরিশচন্দ্র স্টারের কর্তৃত্বভার কখনও নেননি, তিনি বেতনভুক মানেজার হিসেবে থাকাটাই পছন্দ করতেন। ব্যবসায়িক কাজকর্ম দেখা তাঁর ধাতে পোষায় না। বাইরের সকলে জানে গিরিশবাবুই স্টারের সর্বেসবা, আসলে কিন্তু তিনি লাভ-লোকসান নিয়ে মাথা ঘামান না।

অমৃতলাল ও আরও কয়েকজন বলাবলি করতে লাগল, গিরিশচন্দ্র মাসের পর মাস মানেজারের মাইনে নিয়ে যান, কিন্তু নাটক লেখা ছাড়া তো আর কিছুই করেন না। নাটক তো অন্য কেউও লিখতে পারে। অমৃতোল নিজেই এখন নাট্যকার হয়েছে, তার ‘সরলা’ গিরিশের ‘নসীরাম’-এর চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়নি? নাট্যশিক্ষক হিসেবেও তার কৃতিত্ব সবাই স্বীকার করে।

গিরিশের সঙ্গে এদের খিটিমিটি শুরু হয়ে গেল। তিনি থিয়েটার ভবনে যান না, থিয়েটারের লোকেরা তাঁর বাড়িতে ডাকতে এলেও গিরিশ তাদের পাত্তা দেন না বিশেষ। তার নামেই স্টার থিয়েটারে দর্শক আসবে, সেটাই কি যথেষ্ট নয়?

একদিন তর্কাতর্কির সময় উত্তেজনা বেশ বৃদ্ধি পেলে গর্বিত গিরিশচন্দ্র বললেন, আমি মাইনে নিই বলে তোমাদের গাত্রদাহ? ঠিক আছে আমি বেতন চাই না, নাটকও আর লিখে দেব না, তোমরা যা খুশি করো।

গিরিশচন্দ্র নিশ্চিত ধরে নিয়েছিলেন, দু-একদিনের মধ্যেই অমৃতলালরা অনুতপ্ত হয়ে তাঁর কাছে ক্ষমা চাইতে আসবে, পায়ে ধরে তাঁকে স্টারে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু কেউ এল না। তাঁকে বাদ দিয়েই স্টার দিব্যি চলতে লাগল।

পুত্রের অবস্থার দিন দিন অবনতি হচ্ছে, গিরিশ এখন থিয়েটার নিয়ে মাথা ঘামাতেও পারছেন। ডাক্তারের পরামর্শে ছেলেকে নিয়ে হাওয়া পরিবর্তনের জন্য মধুপুর যাবেন ঠিক করেছেন। হাতে বিশেষ টাকা নেই। এই সময় নীলমাধব চক্রবর্তী নামে একজন বীণা থিয়েটার ভাড়া নিয়ে সেখানে সিটি থিয়েটার নামে নতুন থিয়েটার খুলে গিরিশচন্ত্রের বিল্বমঙ্গল, বুদ্ধদেরচরিত, বেল্লিক বাজার—এই সব পুরনো নাটক নামাতে চাইছে, গিরিশকে তারা কিছু টাকাও দিয়ে গেল।

মধুপুরে একটি বাড়ি ভাড়া করে গিরিশ ছেলেকে প্রায় বুকে করে রইলেন। মধুপুরে তরিতরকারি খুব টাটকা, বাস নির্মল, ডিম-মাংস ইত্যাদি অবিশ্বাস্য রকমের সন্তা। পুত্র একটু একটু আরাগ্যের পথে এগোচ্ছে, গিরিশেরও স্বাস্থ্যের বেশ উন্নতি হচ্ছে। মদ্যপান খুব কমিয়ে দিয়েছেন; এই সময় আচম্বিতে এক দুঃসংবাদ এল। স্টার থিয়েটার তাঁকে ম্যানেজার হিসেবে বরখাস্ত করেছে, এবং তারা নীলমাধবের নামে একটি মামলাও দায়ের করেছে। স্টার থিয়েটারের জন্য তিনি যে সব নাটক লিখেছেন, বেতনভোগী ম্যানেজার হিসেবেই লিখেছেন, ওই সব পুরনো নাটক স্টারেরই সম্পত্তি, অন্য নাট্যদলকে তিনি অনুমতি দিতে পারেন না।

গিরিশ প্রথমে সংবাদটি বিশ্বাসই করতে পারলেন না। স্টার-এর কর্তৃপক্ষ তাঁর সঙ্গে এমন ব্যবহার করতে পারে? স্টার তো তাঁরই সন্তান। স্টারের জন্য তিনি কী না করেছেন? শুধু মেধা ও পরিশ্রম নয়, অনেকবার অনেক টাকা তিনি বিনা শর্তে ব্যয় করেননি এই থিয়েটারের জন্য? হাতিবাগানের রঙ্গমঞ্চ গড়ার জন্য ভুক্ষেপ মাত্র না করে দিয়ে দেননি যোলো হাজার টাকা? এই তো সেদিনও কংগ্রেসের অধিবেশন উপলক্ষে লেখা ‘মহাপূজা’ নাটকের অভিনয় দেখে মহারাজ কালীকৃষ্ণ ঠাকুর তাঁকে এক হাজার টাকা পুরস্কার দিয়েছিলেন, সেই টাকা গিরিশ নিজে না নিয়ে বিলিয়ে দিয়েছেন সব অভিনেতা-অভিনেন্ত্রীদের মধ্যে।

সেই স্টার একজন সামান্য কর্মচারীর মতন তাঁকে বরখাস্ত করে? মামলা আনে তার নামে? এ জগতে কি কৃতজ্ঞতা বলে কিছু নেই?

কিন্তু মানুষ অতীত নিয়ে বাঁচে না, বর্তমানই রূঢ় সত্য। কৃতজ্ঞতার বোঝাও বেশি দিন বইতে চায় না কেউ। হ্যাঁ, আগে স্টারের জন্য অনেক কিছু করেছেন তিনি, কিন্তু এখন যে মাসের পর মাস গর্বিত বচন ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না তাঁর কাছ থেকে। বিনোদিনীও তো স্টারের জন্য শরীর বিক্রয় করেছেন পর্যন্ত। সেই বিনোদিনীকেও সরে যেতে হয়নি স্টার থেকে?

গিরিশ ব্যস্ত হয়ে ফিরে এলেন কলকাতায়।

ফিরে এসে দেখলেন, স্টারের কর্মকর্তাদের মনোভাব বেশ কঠোর। নট-নটীদের মধ্যেও তাঁর সমর্থক বিশেষ কেউ নেই। মামলা ওরা চালাবেই। দলচ্যুত নীলমাধবের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তাকে অন্য নাট্যদল খোলায় সাহায্য করেছেন, এজন্য লোকচক্ষে গিরিশকে হেয় করা হবে। মামলা মোকদ্দমা গিরিশ চিরকাল এড়িয়ে যেতে চান, আজ তাঁর কপালেই সেই বিড়ম্বনা!

অমৃতলাল আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়লেও প্রকাশ্যে কখনও প্রাক্তন গুরুর মুখের ওপর কটু বাক্য বলে না। একদিন সে নিরিবিলিতে এসে গিরিশের সঙ্গে দেখা করল।

খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল দুজনেই। গিরিশের বুকে উত্তাল অভিমান। এই অমৃতলালকে তিনি কত অল্প বয়েস থেকে দেখেছেন, কত সুখদুঃখের সে সঙ্গী ছিল, গুরুকে প্রণাম না জানিয়ে সে কখনও গুরুর সামনে মদের গেলাসে হাত দেয়নি, কতবার গিরিশ একেবারে বেসামাল হয়ে পড়লে সে তাঁকে প্রায় কাঁধে করে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে, সেই অমৃতলাল আজ শত্রুপক্ষের প্রতিনিধি : মানুষের জীবনের কী বিচিত্র লীলা!

একটু ইতস্তত করে অমৃতলাল বলল, গুরুদেব, যদি কিছু মনে না করেন, গুটিকতক কথা বলব? যদি রাগ কবেন, আমাকে শাস্তি দিতে চান, দেবেন। আগে কথাগুলি শুনুন। অনেক বন্ধুর হল, আপনি আর ধড়াচূড়ো পরে রং মেখে মঞ্চে নামেন না। আপনি নিজেই বারবার আমাদের বলেছেন, অভিনয় করতে আপনার আর ভাল লাগে না। নতুন ছেলেমেয়েগুলোকে শেখানো-পড়ানোতেও আপনার মন নেই। শেখাতে চাইলে আপনিই যে সর্বশ্রেষ্ঠ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু মহড়ার সময় বেশিক্ষণ আপনি বসতেই চান না, আমাদের মতন কারুর ওপর ভার দিয়ে দেন। কিছুদিন ধরেই তাই আমাদের মনে হচ্ছিল, থিয়েটারের ওপর থেকে আপনার টান চলে গেছে, আপনার মনপ্রাণ আর এ জগতে নেই।

গিরিশ শ্লেষের সঙ্গে বললেন, থিয়েটারের ওপর আমার টান নেই? কোন দিন বলবে, জলের মাছের জলের প্রতি টান নেই! আকাশের পাখির আকাশের ওপর টান নেই! আমার আর কীসের ওপর টান আছে?

অমৃতলাল বলল, আপনার টান গেছে পরমেশ্বরের দিকে। যেদিন থেকে রামকৃষ্ণ ঠাকুর আপনাকে কাছে টেনে নিলেন, সেইদিন থেকেই কি আপনার মনে এক বিরাট পরিবর্তন আসেনি? মনে করে দেখুন, গুরুদেব, আগে যখন আপনার স্ত্রীর রোগ হত, আপনার পত্র দানি একবার খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, আপনি নিজে যখন পেটের ব্যামোয় কষ্ট পেতেন, তখনও কি আপনি একদিনের জন্যও থিয়েটারে অনুপস্থিত থাকতেন কিন্তু রামকৃষ্ণ ঠাকুর যখন ব্যাধিগ্রস্ত হলেন তখন আপনি থিয়েটার উপেক্ষা করে বারবার কাশীপুরের বাগানবাড়িতে ছুটে যেতেন না?

গিরিশ সহসা উত্তর না দিতে পেরে চুপ করে রইলেন।

অমৃতলাল বলল, আমাদের থিয়েটারই ধ্যানজ্ঞান। আমরা নাটকে ভক্তিপ্রেমের বন্যা দুটিয়ে দিই, কিন্তু অন্তরে তেমন ভক্তি নেই। পরমেশ্বর আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমার নাট্যগুরু আপনি। আর কোনও গুরু ধরিনি। টিকিট বিক্রি, মঞ্চ সাজানো, চকরি, এতগুলি লোকের প্রতি মাসের বেতন, এইসব তুচ্ছ জিনিস নিয়ে আমাদের মাথা ঘামাতে হয়। আপনি এ সবের উর্ধ্বে উঠে গেছেন। আপনি মুক্ত পুরুষ। এখন আর থিয়েটারের খুঁটিনাটির সঙ্গে আপনার নাম জড়িয়ে রাখার কোনও মানে হয় না। গিরিশ বললেন, থিয়েটারের সঙ্গে আমি আর কোনও সম্পর্ক রাখব না বলতে চাও?

অমৃতলাল বলল, আপনি নিজেই তো আর সম্পর্ক রাখছেন না। শুধু নাটক লিখছেন। তাই লিখবেন, শুধু একটা যদি দয়া করেন, নতুন নাটক যা লিখবেন, তা শুধু স্টারকেই দেবেন, অন্য কোনও দলকে দেবেন না। শুধু এটুকু হলেই আমি অন্য অংশীদারদের বলে আপনার নামে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য রাজি করাতে পারি।

গিরিশচন্দ্র শুকনো হাস্য করে বললেন, অমৃত্তির, তুই কী বলতে চাস তা কি আমি বুঝিনি? তোর এখন ডানা গজিয়েছে। নাটক লিখছিস, নাট্যাচার্য হয়েছি। আমাকে সরিয়ে দিয়ে তুই এখন স্টারের সর্বেসর্বা হতে চাস? তাই-ই হ তবে! গুরু মারা বিদ্যেতে তুই যশস্বী হ, আমি আশীবাদ করছি!

এর পর স্টারের পরিচালকরা একটা চুক্তিপত্র নিয়ে এল। গিরিশচন্দ্রর নামে তারা মোকদ্দমা তুলে নেবে। কিন্তু স্টার রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে তাঁর আর কোনও সম্পর্ক থাকবে না। অন্য কোনও থিয়েটার দলকেও তিনি প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্যভাবে সাহায্য করতে পারবেন না। এমনকী স্ত্রীলোকের ছদ্মবেশেও অন্য দলের হয়ে নাটক লিখে দিয়ে আসতে পারবেন না। নাটক লিখলে স্টারকেই দিতে হবে, স্টার তা ন্যায্য মূল্য দিয়ে কিনে নেবে। যদি গিরিশের কোনও নাটক স্টারের অপছন্দ হয়, তা হলে সে নাটক তিনি অন্য দলকে দিতে পারেন, কিন্তু অভিনয় শেখাতে পারবেন না। মোট কথা, দর্শকের আসন ছাড়া আর কোনও মঞ্চে তাঁর প্রবেশ নিষেধ হয়ে গেল।

স্টার থিয়েটারের প্রতি তাঁর যত দান ও সাহায্য ছিল এককালে, তার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি যতদিন বাঁচবেন, তাঁকে মাসিক এক শো টাকা করে পেনশন দেওয়া হবে।

সেই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে করতে গিরিশচন্দ্র তাচ্ছিন্সের সঙ্গে বললেন, যা আমি আর নাটকও লিখব না! থিয়েটারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঘুচে গেল। আমি আর কোনওদিন ওদিকের পথও মাড়াব না। তাতে তোরা খুশি তো?

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়