কাশিয়াবাগানে জানকীনাথ ঘোষালের বাড়িতে সান্ধ্য চায়ের আসর বেশ বিখ্যাত। এই চায়ের আসরে আমন্ত্রণ পাওয়াই সামাজিকভাবে বিশেষ গৌরবের ব্যাপার।

বড় হলঘরটা সুদৃশ্য সোফাসেটি দিয়ে সাজানো। মাঝখানে একটি নিচু, গোল কাশ্মীরি টেবিল। এক দিকের দেয়ালে একটি এক মানুষ-সমান বিশাল ঘড়ি, তার ঘণ্টাধ্বনি গিজার ঘণ্টার মতন সুগম্ভীর। অন্য দিকে একটি পিয়ানো। এ ছাড়া দেয়ালে ঝোলানো রয়েছে বিলাতি চিত্রকরদের কয়েকটি বাঁধানো ছবি। ঝুলন্ত ঝাড়লণ্ঠনটিতে পৌঁষট্টিটি বাতি জ্বলে। এ বাড়িতে টানা পাখার ব্যবস্থা নেই, লেস দিয়ে মোড়া অনেকগুলি হাত-পাখা থাকে অতিথিদের জন। অতিথির সংখ্যা সাত-আটজনের বেশি নয়, সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। সাহিত্য, শিল্প, রাজনীতি বিষয়ে কথাবার্তা হয়, রসিকতা-হাসিঠাট্টাও চুলে, সঙ্গীতও চা-জলপানের অঙ্গ, কিন্তু পরনিন্দা-পরচর্চা বা নিছক লঘু কথা কেউ বললে অন্যরা ভুরু তুলে থামিয়ে দেয়।

এই চায়ের আসরে মহিলারাও পুরুষদের সঙ্গে সমানভাবে অংশগ্রহণ করেন, এই বৈশিষ্ট্যটি অন্যান্য অভিজাত গৃহে দেখা যায় না। পরিবেশটি অনেকটা বিলিতি ধরনের হলেও মানসিকতায় এরা খুবই স্বদেশি। এই পরিবারটিই দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ।

আসরের মধ্যমণি জানকীনাথ নিজে নন, তাঁর স্ত্রী স্বর্ণকুমারী। অনেকে বলে মহারানি ভিকটোরিয়ার ভাবভঙ্গির সঙ্গে স্বর্ণকুমারীর মিল আছে। ব্রিটিশ রাজত্বে এখন যেমন রাজা নে মহারানির শাসন চলছে, সেইরকমই এই ঘোষাল পরিবারের সব কিছু চলে স্বর্ণকুমারীর অভিপ্রায় অনুসারে। জানকীনাথ একটু আড়ালে থাকতে ভালবাসেন। তাঁর স্বভাবটিই এরকম, বহু জনহিতকর কাজের সঙ্গে তিনি যুক্ত, কিন্তু নিজের প্রচার চান না। গত সাত-আট বছর ধরে যে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিভিন্ন শহরে, তার পেছনে জানকীনাথের উদ্যোগ ও অর্থসাহায্য অনেকখানি, কিন্তু তিনি সহজে মঞ্চের ওপর বসতে রাজি হন না। তাঁর সাহিত্যজ্ঞান যথেষ্ট, তবু নিজে কলম ধরেন না, তিনি চান তাঁর স্ত্রী ও কন্যার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ক। নিঃশব্দে তিনি আরও এমন কিছু সমাজসংস্কারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, যা অনেকের কাছে। অকল্পনীয়। জমিদার-তনয় হয়েও জানকীনাথ কোনও রকম জাতিভেদ বা দুর্গ মানেন না। মেথর বা চণ্ডালের হাতের রান্নাও তিনি অম্লানবদনে খেতে পারেন। এ শুধু কথার কথা নয়, সমাজের একেবারে অন্ত্যজ শ্রেণীর লোকদের বাড়িতে চাকরি দিয়ে তাদের রান্নাবান্না ও অন্যান্য কাজকর্ম শিখিয়ে দেওয়া হয়, এ বাড়ির সর্বত্র তাদের অবাধ গতি।

আজ অবশ্য তাদের সরিয়ে দিয়ে একজন খাঁটি ব্রাহ্মণকে দিয়ে সমস্ত আহার্য প্রস্তুত করানো হয়েছে। সেই ব্রাহ্মণটির খালি গা, মাথায় টিকি, গলায় সাদা ধপধপে মোটা পৈতে, অর্থাৎ তার ব্রাহ্মণত্ব প্রকটভাবে দৃশ্যমান। আজ বোম্বাই থেকে একজন অতিথি আসবেন, যাঁর দুগ্ম সম্পর্কে নানান কাহিনী প্রচলিত।

অতিথিরা আসবেন সাড়ে ছটার সময়, স্বর্ণকুমারী ও সরলা ঘরটির সাজসজা শেষবারের মতন তদারকি করে নিচ্ছে। প্রত্যেকটি সোফার সামনে ছোট ছোট চুল পাতা, তাতে রাখা হয়েছে জলের গেলাম, চুরুটের বাক্স ও দেশলাই। চুরুটের বাক্সগুলি সব রুপোর, আর পেতলের লম্বা লম্বা ছাইদানগুলি সোনার মতন ঝকঝকে। স্বর্ণকুমারী দেয়ালের একটা বাঁকা ছবি সোজা করে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন, আজ কী গান গাইবি ঠিক করেছিস?

সরলা বলল, রবিমামার দুখানি গান গাইব। তুমি আমাকে বেশি গাইতে বোলো না।

স্বর্ণকুমারী বললেন, বাংলা গান তো মিস্টার তিলক বুঝবেন না। তুই আজ একটা সংস্কৃত গান গাইলে পারিস।

সরলা ইংরিজি, বাংলা, সংস্কৃত, ফরাসি, হিন্দি এমনকী কণাটকি গানও জানে, তবু সে বলল, আমি বাংলা গানই গাইব। ওরা বুঝতে শিখুক। আমরা হিন্দি গান গাই, ওরা কেন বাংলা শুনবে না?

স্বর্ণকুমারী বললেন, সংস্কৃত গান গাইলে কী হবে জানিস তো, ওরা মনে করে, বাঙালিরা সংস্কৃত ভাল জানে না, তুই দেখিয়ে দিবি, আমাদের মেয়েরাও কত ভাগ সংস্কৃত জানে।

সরলা ঠোঁট উল্টে বলল, ওদের কাছে আমি অত নিজেকে জাহির করতে চাই না! স্বর্ণকুমারী খানিকটা আদেশের সুরে বললেন, এত করে সংস্কৃত শেখা হচ্ছে, একটা গান শোনাতে কী আছে? অন্তত বঙ্কিমবাবুর ওই বন্দেমাতরম গানটা…

মায়ের সঙ্গে সরলার প্রায়ই মতবিরোধ হয়। তবু পারিবারিক সহবত অনুযায়ী কেউ গলা চড়িয়ে কথা বলে না। গুরুজনদের কথার প্রতিবাদেরও একটা সীমারেখা আছে। আপত্তি চেপে রেখে সরলা বলল, আচ্ছা গাইব।

সরলা অনেক ব্যাপারেই বিদ্রোহিনী। কলেজে ভর্তি হবার সময় সে হঠাৎ ঠিক করেছিল, সে একটা বিজ্ঞানের বিষয় নেবে। তাও আবার পদার্থবিদ্যা, ফিজিক্স! মেয়েরা পড়বে ফিজি, এ লে পাগলামি! বেথুন কলেজে তো ফিজিক্স পড়াবার কোনও ব্যবস্থাই নেই। বড় জোর বটানি পড়া যেতে পারে, তাতে বিশেষ যন্ত্রপাতি লাগে না। সকলের নিষেধ সত্ত্বেও জেদ ধরে রইল সরলা। কলেজে ব্যবস্থা না থাকলেও মহেন্দ্রলাল সরকারের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট ফর দা কালটিভেশান সায়েন্স-এর সান্ধ্য লেকচার শুনে পরীক্ষা দেওয়া যায়। কিন্তু সেখানে তো শুধু পুরুষরা যায়। অতগুলি বয়স্ক ছাত্রদের মধ্যে একা একটি মেয়ে গিয়ে বসতে পারে নাকি? কিন্তু অনেক প্রথাই তো ভাঙছে একটু একটু করে। সরলা ডাক্তারি পড়তে রাজি হয়নি বলে মহেন্দ্রলাল কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, এবার সে বিজ্ঞান পড়তে আগ্রহী শুনে তিনি উৎফুল্ল হয়ে বলেছিলেন, হ্যাঁ, ব্যবস্থা হবে, আলবাৎ ব্যবস্থা হবে। ছেলেগুলো কি বাঘ নাকি যে খেয়ে ফেলবে মেয়েটাকে?

তবে, সন্ধেবেলা একা একা সরলাকে বিজ্ঞান ভবনে গিয়ে ক্লাস করতে হল না অবশ্য। লেকচার শুরু হবার আগে সরলা গিয়ে বসে থাকত মহেন্দ্রলাল ও ফাদার লাফের চেম্বারে। তারপর তার দুই দাদা তাকে সঙ্গে নিয়ে আসত বক্তৃতা কক্ষে, তাদের জন্য সামনের দিকে পাতা থাকত আলাদা তিনটি চেয়ার। দাদাদের সঙ্গে আসবার সময় ছাত্ররা চাপা টিটকিরি দিয়ে বলত, বডি গার্ড, বডি গার্ড।

সসম্মানে ফিজিক্স পাস করে রুপোর মেডেল পেয়েছিল সরলা। বি এ পরীক্ষাও সে অনার্স নিয়ে পাস করেছে। এখন তার প্রধান কাজ ভারতী পত্রিকার দেখাশুনো করা এবং বিবাহেন্দু প্রেমিকদের দূরে সরিয়ে রাখা। না, বিয়ে করে কোনও বাড়ির বউ সেজে বসে থাকার একটুও ইচ্ছে নেই তার। জীবন তার কাছে এর চেয়ে অনেক বড়। মা-বাবাও অবশ্য বিয়ের জন্য চাপ দেন না সরলাকে।

এর মধ্যে সরলা আবার ঠিক করেছে, সে সংস্কৃতে এম এ পরীক্ষা দেবে। এক বেদান্তবাগীশ পণ্ডিতের কাছে শুরু করল পড়াশুনো। সংস্কৃত কলেজের এক অধ্যাপক তা জানতে পেরে বললেন, উঁঃ, অত সোজা নাকি? বাড়িতে পড়ে এম এ পরীক্ষা? এ আর অন্য কোনও বিষয় নয়, সংস্কৃত, কী করে পাস করে দেখব! সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে সরলা, দিনরাত সংস্কৃত পড়ছে। তার পণ্ডিত বলেছেন, হাতিবাগানের দত্তদের বাড়ির ছেলে হীরেন্দ্র, সত্যিকারের হিরের টুকরো, আর এই সরলা, এমন আর দেখিনি।

বাইরে ঘোড়ারগাড়ির শব্দ হতেই স্বর্ণকুমারী দ্রুত অন্দরমহলে চলে গেলেন। অতিথিরা হঠাৎ এসে অপ্রস্তুত অবস্থায় তাঁকে দেখে ফেলবে, এরকম কখনও হয় না। অতিথিরা সবাই এসে আসন গ্রহণ করবেন, ভূতেরা প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি দিয়ে যাবে, পারস্পরিক কথাবার্তা শুরু হবে, তারপর একসময় নাটকীয়ভাবে গৃহকর্তীর আবির্ভাব, রাজসভায় রাজেন্দ্রাণীর প্রবেশের মতন।

সরলা অবশ্য সাজপোশাক বা আদরকায়দা নিয়ে মাথা ঘামায় না। সাদা সিল্কের শাড়ি তার পছন্দ, বা কাঁধের কাছে একটি বড় রক্তিম চুনি বসানো ব্রোচ, এ ছাড়া অন্য কোনও অলংকার সে পরেনি। সে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। ওর থেকে নেমে এলেন জানকীনাথ, কন্যার দিকে চেয়ে সৰ্কেীতুকে বললেন, আজকের পার্টিতে কোনও ব্যাচিলর নেই, তোকে কেউ বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে জ্বালাতন করবে না।

প্রথম দু’জন অতিথিই সরলার অপরিচিত। বাগবাজারের শিশিরকুমার ঘোষের ছোট ভাই মতিলাল একজন বিখ্যাত সাংবাদিক। শিশিরকুমার এখন বৈষ্ণব ধর্ম নিয়ে খুব মেতেছেন, মতিলালই ওদের অমৃতবাজার পত্রিকা প্রধানত দেখাশুনো করেন, কিছুকাল আগে এই পত্রিকাটি তাঁরই চেষ্টায় সাপ্তাহিক থেকে দৈনিক হয়েছে। মতিলাল জাতীয় কংগ্রেসেরও একঞ্জন উৎসাহী সংগঠক। মতিলালের সঙ্গীটিও একজন বিখ্যাত সাংবাদিক, ইনি বোম্বাইয়ের কেশরী নামে একটি পত্রিকার সম্পাদক এবং মারাঠা পত্রিকার অন্যতম পরিচালক ও লেখক। ইংরিজি ও মারাঠি এই দুই ভাষাতেই লেখেন, এঁর নাম বালগঙ্গাধর তিলক।

বালগঙ্গাধর তিলকের বয়েস ছত্রিশ-সাইত্রিশের মতন, সুগঠিত, ব্যায়ামপুষ্ট শরীর, উজ্বল গৌরবর্ণ মুখখানিতে চাপা অহংকারের চিহ্ন। ইনি চিৎপাওন ব্রাহ্মণ। মহারাষ্ট্রের এই চিৎপাওন ব্রাহ্মণরা মনে করে, এরাই ভারতের শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ। এমন জনশ্রুতি আছে যে, বিদেশি একটি জাহাজ আরব সাগরে ডুবে গেলে তার যাত্রীরা ভাসতে ভাসতে এসে ঠেকে কোন উপকুলে। স্থানীয় মানুষরা এদের সবাইকে মৃত ভেবে চিতায় চড়িয়ে দেয়, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠার পর সেই প্রত্যেকটি মৃতকল্প মানুষ উঠে বসে। জ্বলন্ত চিতা থেকে পুনর্জীবিত হয় বলেই এদের নাম চিৎপাওন। এক সময় মহারাষ্ট্র তথা ভারতের অনেকখানি অংশেরই শাসনক্ষমতা দখল করেছিল এই চিৎপাওন ব্রাহ্মণরা, ছত্রপতি শিবাজীর উত্তরাধিকারী পেশোয়াগণ ছিলেন এই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।

বালগঙ্গাধর উচ্চ শিক্ষিত মানুষ, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তাঁর বেশ কিছু মতামত অত্যন্ত সংস্কারাচ্ছন্ন ও প্রাচীনপন্থী। মহারাষ্ট্রে পাশ্চাত্য ধারায় শিক্ষা বিস্তারে তিনি অগ্রণী অথচ বিধবাবিবাহের বিরোধী। জাতি-ভেদ প্রথার সমর্থক। এই কিছুদিন আগে সহবাস-সম্মতি আইন নিয়ে কত হইচই হয়ে গেল তাতেও এর ভূমিকা ছিল বিচিত্র! বাল্যবিবাহ প্রথার দরুন পাঁচ ই বছর বয়েসের মেয়েদের ওপর স্বামীরা ধর্ষণ করে, ভয়ে ও যন্ত্রণায় কত বালিকা মারাই যায়, এতকাল তা গোপনই থাকত, এখন সংবাদপত্রে সে রকম কিছু কিছু ঘটনা মুদ্রিত হয় প্রায়ই। সেইজন্য ইংরেজ সরকার একটা আইন প্রণয়ন করতে চাইলেন। বিবাহ যে-বয়েসেই হোক, স্ত্রীর বয়স বারো বছর পূর্ণ হবার আগে কোনও স্বামী তার সঙ্গে সহবাস করতে পারবে না। বারো বছরের কম বয়েসী বধুর সঙ্গে কোনও স্বামী জোর করে মিলিত হতে চাইলে সেটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে। বিবাহ একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সে ব্যাপারে কোনও বিধিনিষেধ আরোপ করতে ইংরেজ সরকার সাহস পায় না। কিন্তু যেখানে বালিকাদের ওপর ধর্ষণে প্রাণনাশের সম্ভাবনা, সেখানে তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়াই তো সঙ্গত। দেশের অধিকাংশ শিক্ষিত, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই এই আইনকে সমর্থন জানিয়েছিলেন, কিন্তু মহারাষ্ট্রের এই বিশিষ্ট ব্যক্তিটি তীব্র ভাষায় এর প্রতিবাদ করে গেছেন।

বালগঙ্গাধর তিলক যদি শুধু একজন গোঁড়া, প্রাচীনপন্থী মানুষ হতেন, তা হলে তাঁকে আমল না দিলেই চলত। কিন্তু ইনি একজন প্রবল দেশপ্রেমিক, ছাত্র অবস্থাতেই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে কোনওদিন ইংরেজ সরকারের অধীনে চাকরি গ্রহণ করবেন না। দেশের মানুষের চেতনা জাগ্রত করা এর ব্রত, জাতীয় কংগ্রেসে ক্রমশই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন, নেতৃত্ব দেবার সমস্ত গুণ রয়েছে এর মধ্যে। এরকম মানুষকে কোনওক্রমেই অগ্রাহ্য করা যায় না।

জানকীনাথ এই দুই অতিথিকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে এলেন ভেতরে। ধুতির ওপর গায়ে ধু একটা সিঙ্কের চাদর জড়িয়ে আছেন তিলক। আসন গ্রহণ করার আগে তিনি জুতো খুলে পা ধুতে চাইলেন। সরলা নিজে তিলককে বাইরের উঠোনে নিয়ে গিয়ে জল ঢেলে দিল তাঁর পায়ে। তিলক এই যুবতীর সঙ্গে কোনও কথা বললেন না।

একে একে অন্য অতিথিরা এসে উপস্থিত হলেন। স্বর্ণকুমারী মাঝখানে এসে বসার পর নিজের হাতে এক একটি পিরিচে খাবার সাজাতে লাগলেন। নবীন ময়রার দোকান থেকে আলাদাভাবে রসগোল্লা বানিয়ে আনা হয়েছে, বাড়িতে তৈরি হয়েছে মালপোয়া, সন্দেশ, নিমকি, লুচি, মোহনভোগ। তিলকের কথা চিন্তা করে সমস্ত আহার্যই আজ নিরামিষ, পেঁয়াজ কিংবা ডিমের ছোঁয়া পর্যন্ত নেই।

মতিলাল স্বর্ণকুমারীর দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ওঁকে কিছু দেবেন না।

স্বর্ণকুমারী বিস্মিত হয়ে বললেন, সবই তো ব্রাহ্মণের হাতে তৈরি। তাও উনি খাবেন না? কিছুই খাবেন না?

মতিলাল বাংলায় বললেন, উনি তো আমার বাড়িতে এসে উঠেছেন। আমি রান্নার বামুন ঠিক করে রেখেছিলাম। কিন্তু উনি নিজে বোম্বাই থেকে একজন রান্নার ঠাকুর সঙ্গে করে এনেছেন। বাঙালি বামুনদের ওপর ওঁদের ভক্তিশ্রদ্ধা নেই।

স্বর্ণকুমারী খুবই আহত বোধ করলেন।

তিলক বাংলা বোঝেন না। তবু ওদের কথাবার্তার মর্ম খানিকটা হৃদয়ঙ্গম করে ইংরিজিতে বললেন, আমি শুধু চা খাব। চা, দুধ, চিনি আলাদা করে রাখুন, আমি নিজে মিশিয়ে নেব।

মতিলাল সকৌতুকে বললেন, চা খেতে রাজি হয়েছেন? সেও তো এক সৌভাগ্যের ব্যাপার! আপনার একবাব চা খাওয়া নিয়ে কী কাণ্ড ঘটে গেছে, সে কথা এদের বলতে পারি, বালগঙ্গাধর?

তিলক সোফাতে বসে আছেন শিরদাঁড়া সোজা করে, গম্ভীর মুখ, আয়ত চক্ষু দুটি যেন ঝকঝক করছে। মুখে কিছু না বলে সামান্য ঘাড় হেলিয়ে তিনি সম্মতি জানালেন।

মতিলাল বললেন, একবার হয়েছিল কী, পুণায় এক পাদ্রি আর তার বোন একটা বক্তৃতা সভায় সেখানকার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ডেকেছিলেন। বক্তৃতা-টক্তৃতা তো হয়ে গেল, তারপর চা আর বিস্কুট পরিবেশন করা হল। তিলক, রানাড়ে, গোখলে এরা সবাই নিলেন। আর ছিল যোশী নামে একজন নেটিভ ক্রিশ্চান। সে লোকটা উৎসাহ করে চায়ের কাপ, বিস্কুট এগিয়ে দিচ্ছিল। তারপর সে-ই একটা খববের কাগজকে জানিয়ে দিল যে এইসব ব্যক্তিরা এক বিধর্মী মিশনারির বাড়িতে চা খেয়েছে। তাই নিয়ে গোলমাল পাকিয়ে উঠল, শঙ্করাচার্যের মঠে বিচার সভায় তিলকদের জাতিচ্যুত করার বিধান দেওয়া হল। তখন তিলক নানা শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বোঝালেন যে এই লঘু পাপে প্রায়শ্চিত্ত কবলেই নিস্তার পাওয়া যায়। তিলক কিছু অর্থ জরিমানা দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করলেন। তারপর থেকে আর তিনি যেখানে সেখানে চা খান না। উপস্থিত অতিথিদের মধ্যে একটা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল।

ব্যারিস্টার আশুতোষ চৌধুরী বললেন, মিস্টার তিলক, একটা প্রশ্ন করতে পারি? আপনি প্রায়শ্চিত্ত করতে রাজি হলেন কেন? আপনি কি সত্যি মনে করেন, ক্রিশ্চান হোক বা যাই-ই হোক, কারুর বাড়িতে চা পান করা দোষের? তিলক দু’দিকে মস্তিষ্ক সঞ্চালন করে বললেন, না।

আশুতোষ চৌধুরী বললেন, তা হলে আপনি জরিমানা দিলেন কেন? আমরা তো কত সাহেব-মেমেব হাতে চা খেয়েছি, হোটেলে গিয়েও চা খাই, আমাদের তো জাত যায় না।

তিলক এবার জলদম স্বরে বললেন, বাংলায় আপনারা অনেক সামাজিক নিয়ম ভাঙতে পারেন, বদলাতে পারেন, কারণ বাংলায় সে রকম সুদৃঢ় সমাজবন্ধন নেই। শঙ্করাচার্যের মতন ধর্মগুরু নেই। আমি জানি, চা-পাতার রস, একটু দুধ ও একটু চিনি মিশ্রিত পানীয়টি নিদোষ, তাতে জাত যায় না। কিন্তু আমাদের দেশের কোটি কোটি অশিক্ষিত মানুষ এখনও মনে করে, বিধর্মীর হাতে কিছু খেলে জাত যায়। যতদিন না তাদের এই মনোভাবের বদল ঘটছে, ততদিন আমি বাড়াবাড়ি করতে চাই না। শঙ্করাচার্য যদি আমাকে জাতিচ্যুত করতেন, তা হলে সাধারণ মানুষ আর আমার কোনও কথা শুনতেই চাইত না। ব্রাত্যদের সবাই অবজ্ঞা করে, তাই আমি প্রায়শ্চিত্ত মেনে নিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছি, আমি ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মূল ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত। আপনারা মনে করেন, আগে সমাজসংস্কার, তারপর রাজনীতি। আমি মনে করি, আগে রাজনীতি, তারপর সমাজসংস্কার।

তিলকের বক্তৃতাটি শেষ হতেই সরলা ফস করে জিজ্ঞেস করল, আপনি নাকি বিধবাবিবাহেরও বিরোধী?

তিলক স্পষ্ট গলায় বললেন, হ্যাঁ।

সরলাও খানিকটা অভিযোগের সুরে বলল, কেন? বালবিধবাদের যে কত কষ্টের জীবন কাটাতে হয় তা আপনি জানেন না? কখনও দেখেননি?

তিলক বললেন, দেখেছি, জানি। বিধবাদের উচিত সেই কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করেও পরিবারের সবার সেবা করে যাওয়া। তাতে মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে। নইলে সমাজে অসংযম বাড়বে।

সরলা বলল, বাঃ, বেশ কথা বললেন। মেয়েরাই শুধু কষ্ট স্বীকার করবে। আর পুরুষরা একটার পর একটা বিয়ে করে যাবে।

তিলক বললেন, কন্যা, তুমি আমার পুরো মতামত জানো না। আমি যেমন বিধবাদের বিয়ে মানি, তেমনই বলেছি, বিপত্নীকরাও আর দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারবে না।

আসরে একটা মৃদু হাসরোল উঠল। এমন অদ্ভুত প্রস্তাব কেউ কখনও শোনেনি।

জানকীনাথ একটা প্রশ্ন করার জন্য উসখুস করছিলেন। কিন্তু তিনি গৃহস্বামী, অতিথি বিরক্ত হতে পারেন এমন কোনও কথাই তাঁর বলা উচিত নয়। মনে মনে ভাবলেন, ভাগ্যিস আজ ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারকে নেমন্তন্ন করা হয়নি। তা হলে তিনি বোম্বাইয়ের এই নেতাটিকে ধমকে শেষ করে দিতেন।

তিনি ফিসফিস করে আনন্দমোহন বসুকে বললেন, সহবাস সম্মতি বিলের কথা একবার জিজ্ঞেস করো না।

আনন্দমোহন বললেন, মিস্টার তিলক, আপনি সহবাস সম্মতি বিলের এত ঘোর বিরোধী কেন, তা আমরা কিছুতেই বুঝতে পাবিনি। বাচ্চা মেয়েদের ওপর স্বামীরা অত্যাচার করুক, এটা আপনি মেনে নেবেন?

এই প্রসঙ্গটি ওঠা মাত্র সরলা ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেল। সহবাস শব্দটি অন্য পুরুষদের সামনে শোনাও উচিত নয় কোনও কুমারী মেয়ের।

তিলক বললেন, সে রকম কোনও স্বামীরূপী পশুকে চোখের সামনে দেখলেই আমি জুতো পেটা করব!

সকলেই বিস্মিত। এ যে সম্পূর্ণ বিপরীত কথা।

আনন্দমোহন বললেন, কী আশ্চর্য, আমরা যে একেবারে অন্যরকম শুনেছি। এই বিল পাস হবার আগে আপনি তীব্র ভাষায় এর বিরুদ্ধে লিখেছেন, এর বিরুদ্ধে সই সংগ্রহ করেছেন। একথাও শুনেছি, পুণার ক্রীড়াভবনে ডাক্তার ভাণ্ডারকর এই বিলের সমর্থনে একটা মিটিং ডেকেছিলেন, আপনি দলবল নিয়ে জোর করে সেখানে ঢুকে মিটিং ভেঙে দিয়েছেন, খানিকটা মারামারিও হয়েছিল!

তিলক বক্রভাবে বললেন, মিটিং-এ জোর করে ঢুকতে হয় কেন? মিটিং কি সবার জন্য নয়? যারা বাধা দিয়েছিল, আমার সঙ্গীদের সঙ্গে তাদের ধাক্কাধাক্কি তো হতেই পারে।

আনন্দমোহন বললেন, আপনি এই বিল পাশের ঘোর বিরোধিতা করেছেন, অথচ এখানে বলছেন, বাচ্চা মেয়েদের ওপর অত্যাচার করা অন্যায়। তিলক বললেন, বিরোধী তো বটেই। এই বিল পাস হওয়া খুবই অনুচিত হয়েছে।

তারপর হঠাৎ রেগে উঠে বললেন, শুনুন, আপনাদের কতকগুলো স্পষ্ট কথা বলি। আমার ব্যক্তিগত মত এই, বালাবিবাহ অতি ক্ষতিকর প্রথা। মেয়েদের যোলো আর ছেলেদের কুড়ি বহুর বয়েসের আগে বিয়ে দেওয়া একেবারেই উচিত নয়। আমাদের হিন্দু ধর্মের এরকম সংস্কার হওয়া প্রয়োজন। সে আমরা যখন পারব করব। ইংরেজ সরকার মাথা গলাতে যাবে কেন? আপনার বাঙালিরা, নিজেরা কিছু করতে পারেন না, এক একটা সমাজসংস্কারের প্রস্তাব তুঙ্গে সরকারের কাছে ফেলে দেন, সরকার তা নিয়ে আইন পাস করলে মনে করেন, একটা দারুণ কীর্তি হল! আমরা চাইছি, সরকারের কাছ থেকে কিছু কিছু ক্ষমতা নিয়ে নিতে, আর আপনারা সরকারের হাতে আরও বেশি ক্ষমতা তুলে দিচ্ছেন। আমাদের ধর্মীয় ব্যাপারে ইংরেজ সরস্পরকে মাথা গলাতে দিলে ক্রমেই তো তারা পেয়ে বসবে! সেই জন্যই আমি এইসব সরকারি আইনের বিরোধী!

আনন্দমোহন বললেন, আপনি যা বললেন, আমাদের বাংলাতেও অনেকে এই মতে বিশ্বাসী। এখানকার কিছু রক্ষণশীল পত্রিকা সহবাস সম্মতি বিল সমর্থন করেনি। কিন্তু অন্য একটা দিক ভেবে দেখেছেন? আইন প্রয়োগ না করলে কি অনেক অনাচার বন্ধ করা যায়? আইন পাস হলে সতীদাহ বন্ধ হত? ক্রীতদাস প্রথা রদ হত? পরাধীন জাতি নিজেদের সমাজ বদলাতে পারে না। আপনার যুক্তি অনুযায়ী, কবে আমাদের সমাজের কিছু কিছু বীভৎস প্রথা নিজেরাই বদলাবে সেই অপেক্ষায় বসে থাকলে এখনও শত শত নারী স্বামীর সঙ্গে চিতায় পুড়ে মরত, হাটে বাজারে গরু-ছাগলের মতন মানুষও কেনা-বেচা চলত!

জানকীনাথ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আর একবার চা?

মতিলাল বললেন, একটু গান হোক না। সরলা মাকে ডাকুন, গান শুনি।

সরলা এসে পিয়ানোয় বসল।

পরপর তিনটি গান শোনালো সে, অন্য সকলে বাহবা দিলেও তিলকের কোনও ভাবের অভিব্যক্তি দেখা গেল না।

স্বর্ণকুমারী তাঁর রচিত দু’খানি বই এই মহারাষ্ট্রীয় অতিথিকে উপহার দিলেন। চায়ের আসরের শুধু বিশেষ বিশেষ অতিথিদেরই তিনি বই উপহার দেন। তিলক বাংলা পড়তে পারেন না। বই দুটি উল্টেপাটে পাশে সরিয়ে রাখলেন, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, বঙ্গদেশীয় বন্ধুগণ, আপনাদের কাছে একটা বিশেষ প্রস্তাব জানাবার জন্যই আমি এবার কলকাতায় এসেছি।

সকলেই কৌতূহলী হয়ে তাকালেন তিলকের দিকে।

তিলক বললেন, আমরা বছরে একবার ভারতের কোনও শহরে জাতীয় কংগ্রেসের সম্মেলনে মিলিত হই, তারপর সারা বছর আর দেখা-সাক্ষাৎ হয় না, আমাদের মধ্যে আর কোনও যোগাযোগ থাকে না। কংগ্রেসের সভায় আমরা বক্তৃতার বন্যা ছোটাই, অবশ্যই ইংরেজিতে, তাতে আমাদের ভাষণ-পটুতার প্রমাণ হয় বটে, কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে তাতে কি একটুও দাগ কাটে? এতকাল পরে আমরা ভারতীয় জাতিত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হতে চাইছি, কিন্তু আপামর জনসাধারণের মধ্যে আর কি কোনও প্রভাব দেখা দিয়েছে এ পর্যন্ত। এতকালের বিদেশি শাসনে থেকে আমরা কুপমণ্ডুক হয়ে গেছি। বেশির ভাগ মানুষ নিজের এলাকার বাইরে যায় না, নিজের নিজের গোষ্ঠীর বাইরের মানুষদের চেনেই না। এক সঙ্গে অনেকে মিলে কোনও কাজ করতে আমরা জানিই না। শুধু বক্তৃতা দিয়ে আর সভা-সমিতি করে বেশি মানুষকে কাছাকাছি আনাও যাবে না। আমাদের কোনও জাতীয় উৎসব নেই। সেই জন্যই আমার প্রস্তাব, এরকম কিছু কিছু উৎসবের প্রবর্তন করা হোক, যাতে অজানা-অচেনা মানুষরাও কাছাকাছি এসে অংশগ্রহণ করতে পারে। মহারাষ্ট্রে আমরা গণেশ উৎসব শুরু করেছি। ভারতীয়রা ধর্মীয় উৎসব করে নিজের নিজের বাড়িতে, কখনও মন্দিরে গিয়ে। ধর্মের নামে পথে পথে মিছিল করতে ভারতীয়রা ভুলেই গিয়েছিল কয়েক শশা বছর ধরে। গণেশ উৎসবে আমরা ভাল সাড়া পেয়েছি, প্রতি বছরই বেশি সংখ্যক মানুষ উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে যোগ দিচ্ছেন। উপলক্ষ যা-ই হোক, এক সঙ্গে এত মানুষ পথে নামার বিশেষ তাৎপর্য আছে। আপনারা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে এরকম কোনও উৎসব চালু করতে পারেন না?

অন্যান্য অতিথিরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলেন। জাতীয় উৎসব মানে গণেশ উৎসব? এ যে এক উদ্ভট কথা!

সরলার হাসি পেয়ে গেল। পেট মোর্ট, শুড়ওয়ালা ওই কিম্ভুতকিমাকার দেবতাটি সম্পর্কে সে অনেক ঠাট্টা-ইয়ার্কি শুনেছে। তাকে নিয়ে উৎসব?

একজন অতিথি বললেন, মিস্টার তিলক, আপনি বললেন, ভারতীয়দের মধ্যে প্রকাশ্য উৎসবের চল নেই? কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে তো আছে। মহরমের সময় সারা দেশেই তারা জিয়া নিয়ে বিরাট মিছিল করে।

তিলক বললেন, সেটা কি ভারতীয় উৎসব, না আরবি উৎসব? সে যাই হোক, মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, তা ঠিক। কিন্তু হিন্দুরা কি ভারতীয় নয়? তারা চিরকাল বিচ্ছিন্ন, কুপমণ্ডুক হয়ে থাকবে? তাদের ঐক্যবদ্ধ হবার প্রয়োজন নেই? ওরা যদি সারা দেশে মহরমের মিছিল করে, আমরাই বা সারা দেশে কেন গণেশ উৎসব উপলক্ষে মিলিত হতে পারব না? সিদ্ধিদাতা গণেশ সমস্ত হিন্দুদের কাছেই গ্রহণীয়!

মতিলাল এবার ঈষৎ শ্লেষের সঙ্গে বললেন, ওহে তিলক, তুমি যাঁদের সামনে এই কথাগুলি বলছ, কংগ্রেসের অধিবেশনে বাংলা থেকে যাঁরা প্রতিনিধিত্ব করেন, তাঁরা অধিকাংশই যে ব্রাহ্ম! ব্রাহ্মরাই এখানকার সমাজের শীর্ষস্থানে বসে আছেন। তাঁরা মূর্তিপূজায় ঘোরর বিরোধী, হিন্দু মন্দিরের পাশ দিয়ে যাবার সময় চোখ বুজে পার হয়ে যান, তাঁরা আবার নতুন করে গণেশ পূজার প্রচলন করবেন? না হে না, তোমার এ প্রস্তাব এঁদের কাছে কল্কে পাবে না।

তিলক একটুক্ষণ চুপ করে রইলেন।

তারপর বললেন, বেশ, আপনারা বাঙালিরা উচ্চস্তরের মানুষ, ধর্মীয় উৎসব মানেন না। তা হলে অন্য কোনও উৎসবের কথা ভাবা যাক। আমরা কি বীর পূজার কথা চিন্তা করতে পারি? ইংরেজরা মনে করে, আমরা শক্তিহীন, দুর্বল, কাপুরুষ! অতীতে কি আমাদের দেশে ধীর যোদ্ধা ছিল না? কাছাকাছি ইতিহাস থেকে সেরকম কোনও বীর দেশপ্রেমিক যোদ্ধাকে যদি আমরা আদর্শ হিসেবে স্থাপিত করি, তাকে কেন্দ্র করে উৎসব শুরু হবে, সেই উপলক্ষে আবার ব্যায়ামচা, অস্ত্র অনুশীলনও হতে থাকবে, তা হলে আবার আমরা একটা শক্তিশালী জাতিতে পরিণত হব, আমাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হবে। সে রকম একজন বীরপুরুষের নাম ঠিক করুন, আপনাদের বাঙালিদের মধ্যে যদি কেউ থাকেন, তাঁকে নিয়েই সর্ব ভারতে উৎসব প্রচলিত হবে, মহারাষ্ট্রের দায়িত্ব আমি নিজে নেব।

সহসা কেউ কোনও উত্তর দিতে পারলেন না। বাঙালি বীরপুরুষ? বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন, বাংলার ইতিহাস নাই। অস্পষ্ট ইতিহাস থেকে সে রকম মহান কোনও বীর যোদ্ধাকে কি খুঁজে বার করা যাবে, যাঁকে ভারতের সমস্ত প্রান্তে মোটামুটি চিনবে?

একজন বললেন, বাঙালিই যে হতে হবে, তার কোনও অর্থ নেই। ভারতের যে কোনও অঞ্চল থেকে একজনকে বেছে নেওয়া যেতে পারে। ধরা যাক আকবর? হ্যাঁ, সম্রাট আকবর হতে পারেন না?

অমনি আরও কয়েকজন বললেন, হ্যাঁ, আকবর! আকবরকে সকলেই মেনে নেবে।

তিলক এঁদের প্রত্যেকের মুখপানে দৃষ্টি সঞ্চালন করলেন। তারপর জিহায় তলোয়ারের ধার এনে বললেন, আকবর? আকববের ব্যক্তিগত বীরত্বের কোনও প্রসিদ্ধি আছে বুঝি? এদেশেরই বিভিন্ন সুলতান ও রাজাদের তিনি দমন করেছেন, তাঁর দৃষ্টান্তে আজকের কেউ প্রেরণা পাবে?

একটু থেমে তিনি আবার বললেন, আকবর কি ভারতীয়? সেও তো বিদেশি শাসক। আমি যতটুকু ইতিহাস জানি, ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে বাবর জয়ী হয়ে ভারত দখল করে। এই বাবর পিতা ও মাতার দিক দিয়ে তৈমুর আর চেঙ্গিস খানের বংশধর, দুজনেই কুখ্যাত সুটেরা। বদেশি বাবর ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসন কেড়ে নেয়। আর আকবর সেই সংহাসনে বসে তেরো বছর বয়েসে, ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে। মাত্র তিরিশ বছরেই এই বিদেশি রাজশক্তি ভারতীয় হয়ে গেল? ইংরেজরা পলাশীর যুদ্ধ জয় করার পর ১৩৫ বছর কেটে গেছে, তাহলে ইংরেজরাই বা কী করে বিদেশি শক্তি হবে?

একজন বললেন, মুঘলরা শেষ পর্যন্ত ভারতেই থেকে গিয়েছিল, এ দেশেই বিয়ে-শাদি করে ভারতীয় হয়ে গিয়েছিল!

তিলক বললেন, তা হলে আমরা এবারেও আরও দু-তিনশো বছর পরাধীন থেকে দেখি ইংরেজরাও পুরোপুরি ভারতীয় হয়ে যায় কি না। তবে আর আন্দোলন করে লাভ কী? দাসত্ব করতেই আমরা অভ্যস্ত!

এর পর আকবরের পক্ষে বিপক্ষে তর্ক শুরু হয়ে গেল। কেউ বললেন, আকবর হিন্দু মুসলমানকে মেলাবার চেষ্টা করেছিলেন, সেটাই একটা আদর্শ হতে পারে। আর একজন বললেন, অনেক মুসলমানের কাছে সেই জনাই আকবর ঠিক গ্রহণীয় নন, তাঁকে খাঁটি মুসলমান বলে মনে করা হয় না। তিনি হিন্দু রমণীদের অন্তঃপুরে স্থান দিয়েছেন। অন্য একজন বললেন, আকবর বেছে বেছে হিন্দু রাজকন্যাদের বিয়ে করতেন, কিন্তু নিজের পরিবারের কোনও মেয়েকে কি হিন্দু রাজার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন? আর একজন বললেন, আকবরের ছবি নিয়ে উৎসব করতে গেলে সব মুসলমানরাই আপত্তি জানাবে, কোনও মানুষের ছবি কিংবা মূর্তিপূজাও তাদের কাছে নিষিদ্ধ।

তখন অন্য কোনও বীর খোঁজা হতে লাগল। কেউ বলল, আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে লড়েছিল, সেই পুরু? অমনি অন্য একজন জিজ্ঞেস করল, কেমন দেখতে ছিল তাঁকে? কেউ বলল, সংগ্রাম সিংহ; কেউ বলল, রাজা শশাঙ্ক; কেউ বলল, নানা সাহেব; কেউ বলল, গুরুগগাবিন্দ সিং…

এইসব পরস্পরবিরোধী মতামতের সময় চুপ করে রইলেন তিলক। তাঁর কঠিন মুখভঙ্গি দেখলে মনে হয়, এঁদের কোনও প্রস্তাবই তিনি গ্রাহ্যের উপযুক্ত বোধ করছেন না।

এক সময় তিনি মৃদু অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, শিবাজী। ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়