এলাহাবাদ থেকে উদ্দেশ্যহীনভাবে পদব্রজে, জনতার স্রোতের সঙ্গে মিশে তিনদিন পর ভরত বিন্ধ্যাচলে পৌঁছল। এমন এক অদ্ভুত উদাসীনতা তাকে পেয়ে বসেছে যে, তার ক্ষুধা-তৃষ্ণা-নিদ্রা বোধেরও সঙ্গতি নেই। সারাদিন হয়তো আহারের কথা মনেই পড়ে না, আবার মধ্য রাতে হঠাৎ সে উদরের জ্বালায় জ্বলতে থাকে।

একটানা পথ চলার পর পা দুটি প্রায় অবশ হয়ে এসেছে, বিন্ধ্যবাসিনীর মন্দিরের সিঁড়িতে অনেকক্ষণ বসে রইল ভরত। শরীর ক্লান্ত, কিন্তু মনের নিবৃত্তি নেই। মন আকাশ থেকে পাতালে পরিভ্রমণ করে। আবার এমনও হয়, মানুষ নিজে কী যে চিন্তা করছে, সেটাই সে মনে রাখে না।

মন্দিরের চত্বরে বহু মানুষের ভিড়, ভরত অলস মনে সে দিকে চেয়ে আছে, বিশেষ কারুকে দেখছে না। এক জায়গায় একদল লোক গোল হয়ে ঘিরে বসে একটা গান গাইছে। ভরত সে গানের প্রতিও মনোযোগ দেয় নি, তীর্থযাত্রীদের সব গান প্রায় একই রকম হয়, সুরেরও বৈচিত্র্য থাকে না। হঠাৎ তার খটকা লাগল, এরা কী ভাষায় গাইছে?

শ্রী মধুদ্বিষ ঈশ্বরের কীর্তন মঙ্গল নিরন্তর
        যিটো ভূমিভাগে শুদ্ধরূপে হোয়ে জাত
        তার ধুলি যিটো শিরে ধরে, নিশ্চয়ে জানিবা সিটো নরে
        কৃষ্ণের পরম বল্লভ হোয়ে সাক্ষাত।

খানিকটা বাংলার মতন শুনতে লাগলেও উচ্চারণ বাঙালিদের মতন নয়। ভরত ওড়িয়া ভাষা মোটামুটি শিখে নিয়েছিল, ওড়িয়াদের উচ্চারণও অন্যরকম। বাংলার বিভিন্ন জেলায় বাগভঙ্গি বিভিন্ন, ভরতের সঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজে কিছু সিলেট ও কুমিল্লার ছাত্র ছিল, তারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তার সময় কিছুই প্রায় বোঝা যেত না। লিখিতভাবে বাংলা, কিন্তু উচ্চারণ শুনে মনে হয় অন্য ভাষা।

ওরা যে ভাষাতেই গান করুক, তাতে ভরতের কিছু আসে যায় না। তবু সে একটা অকারণ কৌতূহল বোধ করল। মন দিয়ে শুনতে লাগল সেই গান।

একটু পরে এদের মধ্যে থেকে একজন ব্যক্তি, এই শীতেও খালি গায়ে শুধু একটা নামাবলি জড়ানো, তার মুণ্ডিত মস্তকে মস্ত বড় শিখা, এসে বসল ভরতের কাছাকাছি। ভরত তার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, আপনারা বাংলাদেশের কোন জেলা থেকে এসেছেন?

লোকটি হঠাৎ ক্রোধে অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। রুদ্র চক্ষে বলল, সবই আপনাদের বাংলা? কেন, মানুষের অন্য কোনও ভাষা নেই? আমরা আসাম থেকে এসেছি, আমাদের ভাষা অহমিয়া।

ভরত খানিকটা কুঁকড়ে গেল। অকারণে তাকে এই ধমক খেতে হল। কার ভাষা বাংলা, কার ভাষা অহমিয়া, তা জেনে তার কী দরকার!

তারপর তার একটু হাসি পেল। তার মা ছিলেন আসামের কন্যা। সেই হিসেবে অহমিয়া তো ভরতেরও মাতৃভাষা! মা। শুধু একটা শব্দ মাত্র, মায়ের মুখখানা কেমন ছিল, তাও সে জানে না। সে কখনও আসামে যায়নি, সে সেখানকার ভাষা শিখবে কী করে? তবু এই লোকটিকে তার আত্মীয়ের মতন মানে হল।

সে বিনীতভাবে লোকটিকে বলল, গানটি শুনতে ভাল লাগছিল। আপনারা অনেক দূর থেকে এসেছেন, ফিতে ফিরতে অনেক দিন লেগে যাবে, তাই না?

লোকটি এবারে একটু নরম হয়ে বলল, আমরা এক বৎসবের জন্য তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়েছি। আসছি সেই শিবসাগর থেকে। আসামের মানুষ বেশি দূর যায় না, আমি প্রতি বৎসর দশ-বারোজনের একটি দল নিয়ে কাশী-প্রয়াগ মথুবা বৃন্দাবন পর্যন্ত ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। আমি নিজে সতীমার পীঠস্থান অনেকগুলি ঘুরেছি। বিন্ধ্যাচল বাকি ছিল, এখানে সতীমায়ের বাম পায়ের আঙুল পড়েছিল জানেন বোধ করি? মহাশয়ের নিবাস কোথায়?

ভরত একটু ইতস্তত করে বলল, আমার বাড়ি পুরী, জগন্নাথধাম।

লোকটি কপালে দু হাত ঠেকিয়ে বলল, ওঃ, সে তো মহাতীর্থ। দু’বার দর্শন করে এসেছি। আপনি তা হলে বাঙালি নন, বাংলায় কথা বলছিলেন।

ভরত বলল, কাজের জন্য শিখতে হয়েছে।

লোকটি বলল, আমাদের ইস্কুলেও বাংলা পড়তে হয়। আমাদের স্ত্রীলোকেরা মেখলা ছেড়ে শাড়ি পরা শুধু করেছে। ছোকবাবা বাঙালিদের কায়দায় চুলে টেবি কাটে। এ সব আমার দু’চক্ষের বিষ।

ভরত কোনও বিতর্কে জড়াতে চায় না। সে লোকটির মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলল, আমার খুব আসামে যেতে ইচ্ছে করে। একবার অন্তত সেই দেশটা দেখতে চাই।

লোকটি উৎসাহিত হয়ে বলল, এ আর এমন কী কথা, আমাদের সঙ্গেই যেতে পারেন। আমার নাম লক্ষ্মীনাথ ফুকন, শিবসাগরে ছড়িদার হিসেবে আমাকে সকলে এক ডাকে চেনে। কোনও অসুবিধে হবে না। ওখানে আমার বাড়িতে থাকবেন। রাহা খরচ দিতে পারবেন তো?

ভরত মাথা ঝুকিয়ে সম্মতি জানাল।

লোকটি বটুয়া থেকে একটা কাঁচা সুপুরি বার করে এগিয়ে দিয়ে বলল, এই নিন, গুয়া খান।

এটা বন্ধুত্বের চিহ্ন। সরলভাবে ভরত সেটা মুখে পুরে দিল।

বৎসরখানেক ধরে ভরত স্রোতের শ্যাওলার মতন ভেসে বেড়াচ্ছে। তার জীবন এখন সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যহীন। কোনও জায়গাতেই সে দু’ একদিনের বেশি থাকে না। এক জায়গা ছেড়ে অন্য কোথায় যাবে, তাও সে ভাবে না আগে থেকে। অথচ সে সন্ন্যাসী হয়নি, নাস্তিকও হয়নি।

মহিলামণির কঠিন অসুখের সময় সে বিভিন্ন দেবালয়ে গিয়ে ধর্না দিয়েছে, সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান মেনে সে পূজা দিয়েছে শুদ্ধ ভাবে, একান্ত মনে। সাধক পুরুষদের কাছে কৃপা ভিক্ষা করেছে। মহিলামণি তবু বাঁচল না, তার সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে গেল।

ছাত্র বয়সে সে দেব-দ্বিজে অবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিল, নিরাকার পরমেশ্বরের প্রতি ভক্তি ছিল না। মহিলামণিকে বিবাহের সময় সে কটকে কবি রবীন্দ্রবাবুর অনুপ্রেরণায় ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা নেয়। মহিলামণির যখন জীবন-সংশয় হয় তখন যে-কোনও বিশ্বাসের মূল্যে সে তাকে বাঁচাতে চেয়েছিল। নিরাকার ব্রহ্মের কাছে কিছু প্রার্থনা করা সহজ নয়, চোখ বুজে যার কোনও রূপ কল্পনা করা যায় না, তাঁর কাছে কি কিছু চাওয়া যায়? বরং হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তিগুলির রূপ মানুষেরই মতন, মানুষের দুঃখে তাঁদের প্রাণ কাঁদতে পারে। ভরত তাই জগন্নাথদেব, শিব, দুর্গা, কালী, কোনও দেবতাকেই ডাকতে বাকি রাখেনি। যে যা বলেছে, তাগা-তাবিজ, জড়ি বুটি, চরণামৃত সব মেনেছে। তবু মহিলামণিকে রাখা গেল না।

এর ফলে ভরত যদি আবার কঠোর নাস্তিক ও অবিশ্বাসী হয়ে উঠত, ঠাকুর-দেবতাদের গালমন্দ করত, তা হলে তা খুব অস্বাভাবিক মনে হত না। ক্রোধ-অভিমান ব্যর্থতার হাহাকারে সে ধর্ম-বিমুখও হতে পারত। মহিলামণির শেষ শয্যায় সে তার হাত ধরে বসেছিল শিয়রের কাছে, বারবার বলছিল যেতে দেব না, তোমাকে চলে যেতে দেব না। মানুষের পক্ষে যতদূর সম্ভব চেষ্টা করে সে তার স্ত্রীকে ধরে রাখতে চেয়েছিল, তবু আকাশের দেবতারা তাকে কেড়ে নিলেন। ঈশ্বরের এ কী লীলা, কে জানে!

মহিলামণি শেষ নিশ্বাস ফেলার পর ভরত হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। সে ক্রোধে জ্বলে ওঠেনি, শোকে ভেঙে পড়েনি। অদ্ভুত এক অবসাদে ভরে গিয়েছিল তার মন। সে নিজের ভাগ্যকেই দায়ি করেছিল। এ জীবনে সে সুখ পাবে না, এটাই তার নিয়তি। মৃত্যু বারবার তার সামনে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু মৃত্যুর দেবতা কেন চুড়ান্ত ভাবে তাকে টেনে নিচ্ছেন না? মহিলামণির তো কোনও দোষ ছিল না।

সংসারের পাট চুকিয়ে, জিনিসপত্র সব বেচে দিয়ে, সন্তানকে শ্বশুরালয়ে রেখে ভরত এখন যে ভ্রাম্যমাণ, তার গতিপথের কোনও আপাতত ছক নেই, তবু নিজের অজ্ঞাতেই যেন সে তীর্থস্থানগুলিতেই ঘুরছে। প্রতিটি মন্দিরের বিগ্রহ সে দর্শন করে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে, এখন আর তার কিছু চাইবার নেই, শুধু যেন জানতে চায় কেন এমন হল? সে যখনই এক বুক আশা নিয়ে একটা সুস্থির জীবন পেতে চায়, তখনই সব কিছু তছনছ হয়ে যায় কেন?

খুব বেশিক্ষণ কোনও মন্দিরের বিগ্রহের দিকে চেয়ে বসে থাকলে একটা ভয়ের ব্যাপার হয়। ভরত মন্ত্র তন্ত্র জানে না, গানের গলাও নেই তার, কিন্তু সে ফিসফিস করে বলতে থাকে, পাখিসব করে রব রাতি পোহাইল, পাখিসব করে রব রাতি পোহাইল… ক্ৰমে খুব দ্রুত ভাবে মাথা নেড়ে নেড়ে বলে, পাখি সব, পাখি সব, পাখি সব…। যেন তার বুক পর্যন্তু মাটির মধ্যে গাঁথা, শুধু মুণ্ডুটা বেরিয়ে আছে, সে প্রাণপণে চেতনা বজায় রাখছে। আশে-পাশের লোকজন সভয়ে তার দিকে তাকায়। তখন কেউ না কেউ তাকে একটা ঠেলা মারলে সে হঠাৎ সজাগ হয়, শীতের মধ্যেও ঘামে ভরে যায় তার মুখমণ্ডল, সে এক লাফ দিয়ে উঠে দৌড়ে চলে যায়, দৌড়াতে দৌড়াতে ভাবে, আমি কি উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি? না, না, আমি উন্মাদ-দশা চাই না, আমি ভরত সিংহ, আমি লেখাপড়া শিখেছি, ইংরেজি-অঙ্ক-লজিক জানি…।

এই সব দিনে ভরত কাছাকাছি কোনও নদীতে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে, পেট ভরে নানান রকম মুখরোচক দ্রব্য খায়, কোনও সরাইখানায় ঘর ভাড়া নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ঘুমোয়। তারপর সুস্থ বোধ করে।

লক্ষ্মীনাথ ফুকনের নেতৃত্বে সে আসামের দলটিতে ভিড়ে গেল। লক্ষ্মীনাথ ও ভৃগু নামে একটি অল্পবয়েসী যুবক ছাড়া এ দলের আর সকলেই প্রৌঢ়ত্ব পার করে দিয়েছে। এরা রেলগাড়িতে চড়ে, গরুর গাড়ি বা একা ভাড়া করে না। দিনের পর দিন হাঁটে। পায়ে হেঁটে তীর্থস্থানগুলি দর্শন করলে নাকি বেশি পুণ্য হয়।

এদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ভরতের বেশ ভালই লাগছে। এই তো এখন তার জীবনে একটা উদ্দেশ্য পাওয়া গেল। সে তার মাতৃভূমি দর্শন করতে চায়, সেই পথেই চলেছে, হয়তো আসামের মানুষজনের সঙ্গে সে একাত্মতা বোধ করবে। শুধু একটা ব্যাপার সে ঠিক মেনে নিতে পারছে না। ফেরার পথে এরা কলকাতা শহরে দিন সাতেক থেকে বিশ্রাম নেবে। সেখানে কিছু কিছু কেনাকাটিও আছে। কলকাতার নাম শুনলেই ভরতের কেমন যেন বিরাগ জন্মে যায়। যেন সে কারুর কাছে। শপথ করেছে, কলকাতা শহরে সে ইহজীবনে আর কখনও পা দেবে না। সত্যি সত্যি এমন শপথে সে বদ্ধ নয় কারুর কাছে, তবু তার মনে হয়।

ভৃগু নামে চব্বিশ-পঁচিশ বছরের ছেলেটি বেশ দুরন্তু প্রকৃতির। বোঝাই যায়, তাকে জোর করে এই দলের সঙ্গে আনা হয়েছে। তার প্রতি লক্ষ্মীনাথের ব্যবহার পালিত পুত্রের মতন, লক্ষ্মীনাথ একটুক্ষণের জন্যও তাকে নজর-ছাড়া করতে চায় না। কিন্তু শুধু বুড়ো বুড়িদের সঙ্গ সর্বক্ষণ তার ভাল লাগবে কেন? মাঝে মধ্যেই সে ছিটকে কোথাও চলে যায়। তীর্থস্থান পূজো-অর্চনায় পুণ্য অর্জনের বদলে সে যুবতী তীর্থযাত্রিণী দেখলে তাদের কাছাকাছি ঘুরঘুর করে। তীর্থক্ষেত্রে রমণীরা আব্রু রক্ষা করে না। উত্তর ভারতের রমণীদের স্বাস্থ্য মজবুত হয়, অনেকেই আসে সন্তানকামনায়, এক একটা মন্দিরের সামনে তারা উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। রূপমুগ্ধ যুবার মতন ভৃগু সেই স্থান থেকে নড়তে চায় না, কখনও সে গিয়ে বসে থাকে স্নানের ঘাটে। যাত্রা শুরু করার সময় অন্য কেউ ডাকতে গেলেও সে আসে না, শেষ পর্যন্ত লক্ষ্মীনাথ গিয়ে তাকে হিড়হিড় করে টেনে আনে।

চুনাবে ভৃগু একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলল। একজন রমণীকে অনেকক্ষণ একা একা দেখে সে ধারণা করে নিয়েছিল, ওর সঙ্গে বুঝি কোনও পুরুষ সঙ্গী নেই। ভৃগুর চেহারাটি রমণী-মোহন, সে দৃষ্টি তরল করে বেশ মিটিমিটি হাসি দিতে পারে। অনেক স্ত্রীলোকই তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকায়, দৃষ্টি ফেরাতে চায় না। তীর্থস্থানগুলিতে নারী-হরণ বা ব্যাভিচার এমন কিছুই অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। অনেক বাঁজা রমণী দেবতার আশীর্বাদের বদলে পরপুরুষ দ্বারা স্পর্শিত হয়ে সন্তানবতী অবস্থায় ঘরে ফেলে। ভৃগু অত্যুৎসাহী হয়ে সেই রাজস্থানী রমণীটিকে নিভৃতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল, হঠাৎ যমদূতের মতন যেন মাটি খুঁড়ে এক পুরুষের উদয় হল। সে ওই রমণীটির স্বামী।

দৌড়ে আত্মরক্ষা করতে গিয়েও ভৃগু পার পেল না। সেই লোকটি তাকে ধরে মাটিতে ফেলে দিয়ে কিল ও লাথি মারতে লাগল অনবরত। ভৃগু বাবা রে মা রে বলে চিৎকার করছে, প্রতিরোধের চেষ্টা নেই বিন্দুমাত্র। একজন স্বামী তার অধিকার প্রয়োগ করছে মারের সঙ্গে সঙ্গে বীভৎস সব গালাগালি উচ্চারণ করে, অন্য কেউ তাকে বাধা দিতে যাচ্ছে না, যাবেই বা কেন!

আসামের অধিকাংশ মানুষই শান্তিপ্রিয় হয়, লড়াই-হাঙ্গামার মতন স্থূল ব্যাপারে জড়াতে চায় না। এই দলটির সঙ্গে কোনও অস্ত্র নেই, এমনকী একটা লাঠি পর্যন্ত নেই। পথে কোনও দস্যু-তস্করের দ্বারা আক্রান্ত হলে প্রতিরোধ করার কোনও ব্যবস্থা রাখেনি, অর্থ-বস্ত্র-অলঙ্কার সবই লুণ্ঠনকারীদের হাতে তুলে দিতে হবে। বাহুবলের বদলে ভক্তিই যাদের সম্বল, তাদেরও একটি অস্ত্র থাকে, তার নাম কান্না।

ভৃগুর ওই দশা দেখে পুরো দলটি এক সঙ্গে কান্না জুড়ে দিল। তাও দূরে বসে। যেন সমবেত মড়াকান্না। একমাত্র লক্ষ্মীনাথ সেই রাজপুতের কাছে গিয়ে কাকুতি মিনতি জানাতে লাগল আকুলি বিকুলি ভাবে কেঁদে কেঁদে, সেও দু’চারটি চড়-চাপড় খেল।

ভরত বসে আছে খানিক দূরে মন্দিরের চাতালে। সে দেখছে দৃশ্যটি, কিন্তু তার কোনও প্রতিক্রিয়াই হচ্ছে না। ভৃগুর নারী-ঘটিত দুর্বলতা সে আগে লক্ষ করেছে দু’একবার। এবারে সে ধরা পড়ে গেছে, ক্রুদ্ধ স্বামীটি শাস্তি দিচ্ছে তাকে, স্ত্রীটি দাঁড়িয়ে আছে একটি স্তম্ভের আড়ালে, গলা পর্যন্ত অবগুণ্ঠিতা, তবে অর্ধেক বক্রভাবে দাঁড়াবার ভঙ্গিতে বোঝা যায়, সূক্ষ্ম বস্ত্রের মধ্য দিয়ে সে দেখছে সব কিছু। হয়তো ভৃগুকে সে কিছুটা প্রশ্রয় দিয়ে কাছে টেনেছিল, এখন তার স্বামীর বীরত্বও উপভোগ করছে।

বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে উৎসাহ দিচ্ছে স্বামীটিকে। মুখে মুখে ঘটনাটি প্রচারিত হয়ে, সকলেই বিচারক সেজে যেন ভৃগুকে চরম দণ্ডাজ্ঞা দিয়েছে, পূজা-প্রার্থনা বা তীর্থের অন্য আকর্ষণের চেয়ে এই রিরংসা ও হিংসার ঘটনাটিই এখন প্রধান আকর্ষণ।

ভৃগুর আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছে ভরত, তবু সে একটুও বিচলিত বোধ করছে না। প্রায় সময়ই তার মন এমন অসাড় হয়ে থাকে, যে বাইরের কোনও ঘটনার প্রতিক্রিয়াই হয় না তার। আবার কখনও কখনও হঠাৎ সে সমসাময়িক বাস্তবতার মধ্যে ফিরে আসে।

বাজপুতটি এখন ভৃগুর গলা টিপে ধরেছে, অন্যরা তাকে এমনই উৎসাহ জোগাচ্ছে যে শেষ পর্যন্ত সে বুঝি ভৃগুকে খুনই করে ফেলবে। স্বামীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটা খুন কিছুই না।

এই সময় ভরত নিজেকেই প্রশ্ন করল, একজন লোক আর একজনকে মেরে ফেলছে, আমি কেন চুপ করে বসে আছি?

নিজেই উত্তর দিল, একজন আর একজনকে শাস্তি দিচ্ছে, এর মধ্যে তুমি মাথা গলাতে যাবে কেন?

লঘু পাপে গুরু দণ্ড হয়ে যাচ্ছে নাকি? ছোকরাটি একটু রসস্থ হয়ে পড়েছিল, তার জন্য তাকে প্রাণ দিতে হবে?

তোমাকে বিচারক সাজতে কে বলেছে? স্ত্রীলোক-ঘটিত ব্যাপার, এর মীমাংসা শুধু যুক্তি-তর্ক দিয়ে হয় না।

তবু একটা প্রাণ, মানুষের প্রাণ বিপন্ন দেখেও আমি সাড়া দেব না?

তুমি একা কী করবে? দেখছ না, কতগুলো লোক ওকে শাস্তি দেবার পক্ষে? তুমি নিজের মনে বেশ তো বসেছিলে, ও সব তুচ্ছ ব্যাপারে জড়াতে যাবে কেন?

কখনও কখনও কি মানুষকে একাও দাঁড়াতে হয় না?

ভরতের কাছে সবসময় একটি পাকা বাঁশের লাঠি থাকে। একবার একটি জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আসার পথে একটি নেকড়ে বাঘের পাল্লায় পড়েছিল, সেবার এই লাঠিই তাকে রক্ষা করেছে। ভরতের সুগঠিত দীর্ঘ শরীর, মুখমণ্ডল দাড়ি গোঁফে ঢাকা, তাকে ভ্রাম্যমাণ সাধুর মতনই দেখায়।

ভরত দ্রুত পদে সেই ভিড় ঠেলে গিয়ে লাঠিটা তুলে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ওকে ছেড়ে দাও।

রাজপূত প্রথমটায় অগ্রাহ্য করলে ভরত তার লাঠির অগ্রভাগ লোকটির কপালে ঠেকিয়ে আদেশের সুরে বলল, উঠে দাঁড়াও!

রাজপুতটি ভৃগুকে ছেড়ে উঠল বটে, রক্ত চক্ষে তাকাল ভরতের দিকে। একবার সে নিজের কোমরে হাত দিল, যেন সে তলোয়ার খুঁজছে। একালের রাজপুতরা তরবারির শক্তি থেকে একেবারে বঞ্চিত হলেও মাঝে মাঝে পূর্ব গৌরবের স্মৃতি চাগিয়ে ওঠে।

দর্শকরা এই আকস্মিক বিঘ্ন একেবারেই পছন্দ করল না। বেশ রঙ্গ জমেছিল, এর মধ্যেই শেষ হতে দেওয়া যায় না। তারা মনে করল, ভরত বুঝি পূর্ব বৃত্তান্তটি জানে না, তাই সমস্বরে বলতে লাগল, মহারাজ ওই বদমাশটা কী করেছে জানেন, এক সতী সাধ্বী কুল রমণীর…। এই রকম সময়ে অনেকেরই গুপ্ত লালসা প্রকাশিত হয়ে পড়ে, রসালো ভাষায় তা উপভোগ করে। ভৃগু এই রমণীকে যতটুকু স্পর্শ করেছে তার চেয়ে অনেক বেশি ভাবে দর্শকরা অনেকে দৃষ্টি দিয়ে তাকে চাটছে।

ভরত অন্যদের কথায় কর্ণপাত করল না, লাঠি উঁচিয়ে এক দৃষ্টিতে সেই রাজপুতের দিকে চেয়ে রইল।

দর্শকদের মধ্য থেকে একজন একটা লাঠি ছুঁড়ে দিল রাজপুতটির দিকে। সে লাঠিটি লুফে নিয়ে পিছিয়ে গেল কয়েক পা, কোমরের কষি দৃঢ় করতে লাগল।

জনতা হর্ষধ্বনি দিয়ে উঠল। এবার অন্যরকম মজা হবে। এক সাধুর সঙ্গে একজন স্ত্রীর ইজ্জত রক্ষাকারী স্বামীর লড়াই। কে জেতে, কে হারে।

ভরত অবশ্য এরকম নাটকে অংশগ্রহণ করতে চায় না। ভৃগু হ্যাঁচোর প্যাঁচোর করে খানিকটা দূরে সরে গেছে। লাঠি নামিয়ে ভরত দু’হাত জোড় করে স্বামীটিকে শান্ত, ধীর কণ্ঠে বলল, যথেষ্ট শাস্তি দিয়েছেন, এবার ওকে ক্ষমা করে দিন। আমি আপনার সঙ্গে লড়াই করতে আসিনি, ক্ষমা চাইতে এসেছি। আমিও ওর হয়ে ক্ষমা চাইছি। ওর যা শাস্তি প্রাপ্য ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছে।

জনতার অধিকাংশ মানুষই রক্তলোলুপ, তারা এমন সমাধান চায় না। তারা রাজপুতটিকে আরও প্ররোচনা দিতে লাগল। সে লোকটিও ভাবল, শান্তির প্রস্তাব মেনে নেওয়া মানে কাপুরুষতা। রাজপুত জাতির ঐতিহ্য ও সম্মান রক্ষার দায়িত্ব এখন তার ওপর।

একটা কুৎসিত গালাগালি উচ্চারণ করে সে ভরতের মস্তকটি বিদীর্ণ করার জন্য লাঠি চালাল প্রচণ্ড জোরে। ভরতও যথাসময়ে ক্ষিপ্র ভাবে নিজের লাঠি তুলে তাকে আটকাল। পরমুহূর্তেই সে নিজের লাঠি ফেলে দিয়ে লোকটিকে দৃঢ় আলিঙ্গনে বেঁধে ফেলল, সেই অবস্থায় তাকে ঠেলতে ঠেলতে বলল, আমাকে মেরে ফেললে তোমার কোনও লাভ হবে না, আমিও তোমার গায়ে আঘাত করতে চাই না। আমি সকলের সামনে আবার ক্ষমা চাইব। ওই ছেলেটি তোমার পত্নীর পা ছুয়ে মা বলে ডাকবে, তাতেই তোমার সম্মান রক্ষা হবে। আমরা কেউ কারুর শত্রু নই।

এই ঘটনার পর ভরত আবার আত্মসমীক্ষা শুরু করল।

এক বছর ধরে তার মন বিকল হয়েছিল, বিশেষ কোনও ভাল লাগা, মন্দ লাগা ছিল না। নারী জাতির সংস্পর্শ সে সন্তর্পণে এড়িয়ে যেত। নারীরা তার জীবনে শুধু বিড়ম্বনাই ডেকে আনে, তারাও বিড়ম্বিত হয়। সংসার সম্পর্কেও তার মোহ ভেঙে গেছে। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনও পরিকল্পনার ছায়ামাত্র নেই। কোনও মানুষের সঙ্গেই সে নৈকট্য বোধ করে না, অন্য কারুর আনন্দ-দুঃখে তার কিছু যায় আসে না। সমাজের সঙ্গে সে সম্পর্ক-শূন্য। তা হলে ভৃগু-রাজপুত ঘটনার সঙ্গে সে নিজেকে জড়াতে গেল কেন? ওদিককার গোলযোগ শুনে সে অন্যদিকে উঠে চলে যেতে পারত। ভিড়ের মধ্যে প্রবেশ করার মুহূর্তেও সে ঘুণাক্ষরে ভাবেনি যে সে ওই লোকটির সঙ্গে লাঠি খেলায় প্রবৃত্ত হবে। তা হলে নিজেকে সে সমাজ-ছাড়া মনে করলেও সমাজ তাকে ছাড়বে না? অবচেতনে সমাজ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে? প্রকৃত সন্ন্যাসীরাই সংসারত্যাগী হয়, সে ভেক ধরেছে মাত্র, সন্ন্যাসী হতে পারেনি। তার কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। তবু কি মনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাব সুপ্ত আছে? নিজের ক্ষমতার ওপর বিশ্বাস না থাকলে কি সে একটি অচেনা লোকের সামনে লাঠি তুলে দাঁড়াতে পারত? কিন্তু ক্ষমতার প্রকাশ তা সে চায় না। এই পৃথিবীর কাছে তার কোনও প্রত্যাশা নেই।

আসামের দলটির মধ্যে ভরতের খাতির এত বেড়ে গেল যে তাতেও সে বিব্রত বোধ করতে লাগল। তাকে বেশি বেশি খাবার দেওয়া হয়, তার শয়নের জন্য বেছে নেওয়া হয় সবচেয়ে ভাল স্থানটি। ভরত প্রথম আপত্তি করলেও ওরা শোনে না। ভৃগু এখন তার পদসেবাকারী হয়ে পড়েছে। আর কোনও স্ত্রীলোকের দিকে সে ভুলেও চায় না। সব সময় ছায়ার মতন ভরতের পাশে পাশে থাকে। লক্ষ্মীনাথ বারবার ঘোষণা করেছে, শিবসাগরে পৌঁছে সে ভরতকে তিন বিঘে জমি দেবে, তাকে আর ছাড়বে না।

বারাণসী পোঁছবার ঠিক আগের রাতে ভরত ওদের সঙ্গ পরিত্যাগ করে চুপি চুপি সরে পড়ল। একে তো ওদের অত আদিখ্যেতা তার সহ্য হচ্ছিল না, তা ছাড়া সে চিন্তা করে দেখল, কেন সে আসামে যাবে? মাতৃভূমি না ছাই। মাকে যে চেনে না, তার আবার মাতৃভূমি থাকে নাকি? সারা হিন্দুস্থানের সব জায়গাই তার কাছে সমান।

ভরত আবার চলতে লাগল বিপরীত দিকে। তার কাছে যা অর্থ আছে, তাতে বৎসর দুয়েকের খরচ চলে যেতে পারে, তারপর যা হয় দেখা যাবে। কলকাতায় সে যাবে না, পুরী কটকের দিকেও সে যেতে চায় না, ওই সব জায়গা থেকে যত দূরে যাওয়া যায়। তাই সে যাবে।

একদিন তার দ্বারিকার কথা মনে পড়ল। দ্বারিকা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল এক সময়, প্রয়াগে দ্বারিকাকে দেখে সে খুশি হতে পারল না কেন? কেমন যেন জড়ের মতন হয়ে গিয়েছিল সে, কিছুতেই মন খুলতে পারেনি। দ্বারিকা নয়, বসন্তমঞ্জরীকে দেখেই কি তার অমন হয়েছিল? অনেককাল আগে, মাত্র একদিন কিছুক্ষণের জন্য সে বসন্তমঞ্জরীকে দেখছিল, তবু মুখখানি স্পষ্ট মনে আছে। এই মুখটি মনে পড়লেই কেমন যেন গা ছমছম করে। দ্বারিকা মেয়েটিকে বিবাহ করে স্ত্রীর সম্মান দিয়েছে, এটা একটা অসাধারণ ঘটনা। সাহস আছে দ্বারিকার। ওরা সুখী। হ্যাঁ, ওরা সুখী হোক, সেই জন্যই ভরতের সরে আসাটা ঠিক হয়েছে। কোনও সুখী পরিবারের সংস্পর্শে তার থাকা উচিত নয়, তাতে ওদেরই অশান্তি হতে পারে। সাংসারিক সুখ আর ভরত, এ যেন পরস্পরের বিপরীত

একটা বড় রকমের হোঁচট খাওয়ার পর বুড়ো আঙুলে একটা ক্ষত হয়ে গেছে ভরতের। হাঁটতে কষ্ট হয়। সে রেলে চেপে ঘুরতে লাগল। পাহাড়ের দিকে গেল না, ট্রেন বদল করতে করতে সে এগোতে লাগল পশ্চিম ভারতের দিকে। সহযাত্রীদের কথাবার্তা শুনে সে বুঝতে পারে যে ভাষা বদলাচ্ছে। সে অবশ্য কারুর সঙ্গে মেশে না, পাশে বসা যাত্রীটির সঙ্গেও বাক্যালাপ করে না। নীরবতাই যেন তার ধ্যান। সে নিজের মনের গভীর গহনে প্রবেশ করতে চায়। সেখানে যেন একটা অন্ধকার, দীর্ঘ সুড়ঙ্গ। ভরত সে সুড়ঙ্গ থেকে মুক্তি পাবার জন্য ব্যাকুল নয়, সে অদৃশ্য দেয়ালে মুষ্ঠাঘাত করে জানতে চায়, আমি কী চাই, আমি কী চাই?

শুধু একটি চাওয়ার কথা ভরত নিশ্চিত জানে। তার মৃত্যুবাসনা নেই, আত্মহত্যা করতে কখনও ইচ্ছে করে না। সে বেঁচে থাকতেই চায়। কিন্তু কীসের জন্য বাঁচা?

পায়ের ক্ষতটির যন্ত্রণা ক্রমশই বাড়ছে। ভরত যখন পুরী শহরে একটি ব্যাঙ্কের শাখা-পরিচালক ছিল, সাহেবি-পোশাক পরিধান করত, তখন এরকম কিছু হলে কোনও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হত অবশ্যই। এখন ভরতের জীর্ণ বেশবাস, চিকিৎসকের কথা তার মনেই পড়ে না। ব্যথা যখন খুব বাড়ে, তখন সে সেই পা মুখের কাছে এনে ফু দেয়।

ঘুরতে ঘুরতে নাগপুর রেল স্টেশনে নেমে সে অনুভব করল, এবার একটু বিশ্রাম দরকার।

টাঙ্গাওয়ালাদের কাছে জেনে, একটি টাঙ্গা ভাড়া করে সে চলে এল সীতাবলদিতে একটি ধর্মশালায়। দৈনিক আট আনা ভাড়ায় এখানে রাত্রিবাস করা যায়। পৃথক ঘর নয়, বড় বড় এক একটি কক্ষ, তাতে আট-দশজনের শয্যা পাতা যায়। একখানা হোগলার চাটাই, একটি বালিশ ও একটি কম্বলের জন্য আরও চারআনা অতিরিক্ত ভাড়া লাগে। ভরত এক কোণের দেয়াল ঘেঁষা স্থান পেয়ে বেশ খুশি হল। সন্ধে হতে না হতেই সেই শয্যায় শুয়ে সে নিদ্রাভিভূত হয়ে রইল একটানা কুড়ি ঘণ্টা।

জেগে ওঠার পর সে দেখল, তার পা বেশ ফুলে গেছে, হাঁটার ক্ষমতাই যেন আর নেই। শরীরে জ্বর জ্বর ভাব। কিন্তু এতখানি ঘুমোবার পর তার মন বেশ প্রফুল্ল হয়েছে, ক্ষুধাও বোধ করছে। উঠে বসে সে পায়ের ক্ষততে ফুঁ দিল কিছুক্ষণ।

তার পাশের শয্যায় একটি বেশ হৃষ্টপুষ্ট যুবক শুয়ে আছে, তারও অঙ্গে গেরুয়া এবং মুখময় দাড়ি গোঁফ, সে কৌতূহলী হয়ে ভরতের ফুঁ দেওয়া দেখতে দেখতে কী যেন জিজ্ঞেস করল। তার ভাষা হিন্দি নয়, অন্য কিছু, ভরতের কানে দুর্বোধ্য শোনাল। ভরত এমনিতেই কারুর সঙ্গে হৃদ্যতা করতে চায় না, এই লোকটির প্রশ্নের উত্তরও সে দিতে পারবে না, সে শুধু মাথা নাড়ল দুদিকে।

কিছু পরে, ক্ষুধার তাড়নায় সে উঠে দাঁড়াল। ধরমশালা তো সরাইখানা বা হোটেল নয় যে চাইলে খাবার পাওয়া যাবে। তাকে যেতেই হবে বাইরে। এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে দোতলার সিঁড়ি দিয়ে সে নেমে এল নীচে। সৌভাগ্যবশত তাকে বেশিদূর যেতে হল না, পাশেই একটি দোকানে ডালপুরি ভাজা হচ্ছে।

নাগপুর বেশ বড় শহর, এই দ্বিপ্রহরে রাজপথে লোকজন, গাড়ি-ঘোড়ার বেশ ব্যস্ততা রয়েছে। এক ধরনের এক্কাগাড়ি দেখা গেল, যা ঘোড়ার বদলে উট দিয়ে টানানো হচ্ছে। হাতির পিঠেও যাচ্ছে কেউ কেউ। কাছাকাছি দোকান-পাট অনেক, একটি ডাক্তারখানার ইংরেজি সাইনবোর্ডও ভরতের চোখে পড়ল। পথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ডালপুরি ও লাড্ডু খেতে খেতে ভরত ভাবল, পায়ের এই ক্ষতের জন্য চিকিৎসকের কাছে যেতেই হবে? না গেলে কী হয়?

ক্ষতটা আরও বাড়বে, আঙুলটা খসে পড়বে? কিংবা চিরতরে একটা পা পঙ্গু হয়ে যাবে? তাতেই বা কী এমন ক্ষতি? পৃথিবীতে কত পঙ্গু মানুষ আছে, তারাও দিব্যি বেঁচে থাকে, ভরতকে যে দুটি পা-ই অক্ষত রাখতে হবে, তার কী মানে আছে? ব্যথা হচ্ছে খুবই, তবে ব্যথাও যেন একটা নেশা, ভরত সেটা উপভোগও করছে খানিকটা। পুরোপুরি সুস্থতা নিয়ে সে কী করবে? সুস্থ মানুষের অনেক রকমের ব্যস্ততা থাকে, তার তো কিছুই নেই।

আবার সে এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে এল। এবারেও পাশের শয্যার যুবকটি কিছু জিজ্ঞেস করল তাকে, ভরত ভাষা বুঝতে পারল না, মাথা নাড়ল দু দিকে।

ভরত একটা সিকি দিয়ে ডালপুরি আর লাড্ডু কিনেছিল। অনেক কিনেছে, সবটা সে শেষ করতে পারেনি। নিয়ে এসেছে শালপাতায় মুড়ে। কী ভেবে সে শালপাতার ঠোঙাটি এগিয়ে দিল যুবকটির দিকে। যুবকটি লুব্ধ ভাবে সেটি নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে খেতে শুরু করে দিল। তারপর সে গায়ের কাপড় সরিয়ে পেটে চাপড় মেরে এবং আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল যে, সে খুবই ক্ষুধার্ত এবং তার কাছে পয়সা নেই।

একজন মানুষের সঙ্গে খাদ্য ভাগাভাগিতে ভরতের কোনও আপত্তি নেই, কথাবার্তা বলতে না হলেই সে খুশি। এই যুবকটির ভাষা মারাঠি, ভরত তা একবর্ণ বুঝছে না। নাগপুর যদিও সেন্ট্রাল প্রভিন্সের অন্তর্গত, কিন্তু এখানে মারাঠি অধিবাসীর সংখ্যা অনেক। কিছুকাল আগেও এ অঞ্চল ভোঁসলেদের অধিকারে ছিল।

ভরত জানে না, সম্প্রতি এই এলাকায় হুলুস্থুলু চলছে। অল্পবয়েসী যুবকেরা সব সন্ত্রস্ত, তারা শহর ছেড়ে পালাচ্ছে গ্রামে, লুকিয়ে থাকছে বনে জঙ্গলে। পুলিশের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ ব্যতিব্যস্ত, বিশেষ করে মারাঠিদের মহল্লাগুলিতে পুলিশবাহিনী যখন তখন হানা দিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে, তছনছ করে দিচ্ছে বাড়িঘর।

প্লেগ কমিশনের প্রধান র‍্যান্ড এবং আয়ার্স্ট নামে দুজন বিশিষ্ট ইংরেজ রাজপুরুষের হত্যাকারীরা এখনও ধরা পড়েনি। পুণার কয়েকটি মারাঠি যুবকই যে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তা মোটামুটি জানা গেলেও তাদের গতিবিধির সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। চতুর্দিকে অসম্ভব রকমের গুজবের অন্ত নেই। দামোর, বালকৃষ্ণ আর বাসুদেও এই তিন ভাই এবং তাদের দুই বন্ধু রানাভে আর সাঠে যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। কোনওদিন শোনা যায়, দামোদর আর বালকৃষ্ণকে দেখা গেছে কোলাপুরে, আবার সেদিনই নাকি তারা ঔরঙ্গাবাদে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পলায়ন করেছে।

ইংরেজ সরকারের মানসম্মান বিপন্ন, এই হঠকারী যুবকদের চরম শাস্তি দিতে না পারলে এ দেশের মানুষের কাছে রাজশক্তির দুর্বলতা প্রকট হয়ে পড়বে। অস্ত্র-আইন কঠোরভাবে প্রযুক্ত, তবু কোথা থেকে ওই যুবকেরা রিভলবার সংগ্রহ করল? ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তোলার সাহসই বা তারা পেল কী করে? এরকম রাজনৈতিক হত্যা ইংরেজ আমলে আগে কখনও হয়নি। আন্দামানে এক গভর্নর জেনারেল খুন হয়েছিলেন বটে, কিন্তু সে তো এক ধর্মান্ধ মুসলমানের কাজ। ধর্মের জন্য মুসলমানরা প্রাণ দিতে বা নিতে কুণ্ঠিত হয় না। পুণা হত্যাকাণ্ড যেন ইংরেজের যথেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে সারা দেশের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ।

ইংরেজ শাসকরা এই হঠকারীদের খুঁজে বার করে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে সকলের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চায়। যাতে আর কেউ কোনও রাজপুরুষের কেশাগ্র স্পর্শ করতে সাহস না করে। পুলিশ বাহিনী এখন হানা দিচ্ছে সর্বত্র।

ভরত এসব কিছুই জানে না। সে বুঝতেও পারল না যে, তার পাশের শয্যার যুবকটি ওই পাঁচজনের একজন, ওর নাম রানাডে। ওরা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েছে, কোথাও নিরাপদ আশ্রয় পাওয়ার উপায় নেই। শুধু পুলিশের ভয় নয়, তার চেয়েও বেশি বিশ্বাসঘাতকদের চোখে পড়ার ভয়। চতুর্দিকে গুপ্তচর। এদেশের বহু মানুষেরই এখনও স্বাধীনতা-পরাধীনতার বোধ নেই। রাজশক্তিকে তারা শুধু ভয় পায় না, ভক্তিও করে। শাসকরা এদেশি না বিদেশি, তা নিয়েও তারা মাথা ঘামায় না। বিশ্বাসঘাতকতা যেন অধর্ম নয়, সামান্য পাঁচ-দশ টাকার জন্য নিজের বন্ধু বা আত্মীয়কেও পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া যায়।

দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রানাডে তাড়া খাওয়া কুকুরের মতন পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তার কাছে পয়সাকড়ি কিছু নেই, তার শরীরে প্রচণ্ড জ্বর, তবু সে স্থান বদল করছে অনবরত।

আরও একটা দিন কাটার পর, মাঝরাত্রে ভরতের ঘুম ভাঙল শরীরে প্রচণ্ড আঘাতে। কেউ তার পিঠে সজোরে এক লাথি কষিয়েছে। চোখ মেলে সে দেখল, ঠিক তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে একজন বলশালী ব্যক্তি, তার হাতে দাউ দাউ করে জ্বলছে মশাল। সে উৎকট মুখভঙ্গি করে কী যেন বলছে তাকে।

ভরতের মুখে মর্মবেদনার ছায়া পড়ল। মানুষ কেন এমন হয়। এই অচেনা লোকটি কেন তাকে লাথি মেরে, গালাগালি করছে? সে তো এই লোকটির কোনও ক্ষতি করেনি, জ্ঞানত সে কারুর প্রতিই কোনও দোষ করেনি। যদি কোনও কারণে তাকে ডাকার প্রয়োজন হয়, পদাঘাত না করে, আস্তে ডাকা যেত না?

সেই লোকটি এবার ঝুঁকে ভরতের চুলের মুঠি ধরে তুলতে চাইল।

সঙ্গে সঙ্গে ক্রোধে বিস্ফারিত হয়ে গেল তার চক্ষু, মাথায় চড়ে গেল রক্ত। অহং বোধ মানুষের কিছুতেই যায় না। সে এক রাজবাড়িতে প্রতিপালিত হয়েছে, কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে পাঠ গ্রহণ করেছে, উচ্চ পদে চাকুরি করেছে, সাধারণ একটা পথের ভিখারির মতন সে এরকম অন্যায় অত্যাচার সহ্য করবে কেন? সে তার পোশাক, পরিবেশ ও অবস্থান ভুলে গিয়ে হয়ে উঠল পূর্বতন ভরত সিংহ।

এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সে ইংরিজিতে হুংকারের মতন বলে উঠল, হাউ ডেয়ার ইউ টাচ মি!

ভরতের পদাঘাতকারী একজন পুলিশ তো বটেই, তার সঙ্গে আরও পাঁচজন পুলিশ রয়েছে, তাদের মধ্যে একজন শ্বেতাঙ্গ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। ভরতের পাশে রানাডে কম্বলে মুখ ঢাকা দিয়ে কাঁপছে।

ভবতের মুখে ইংরিজি শুনে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পুলিশটি এগিয়ে এসে বলল, হু ইজ দিস বাস্টার্ড?

তারপর সে ভরতের টুটি টিপে ধরতে যেতেই ভরত ক্রোধান্ধ ও দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে প্রচণ্ড এক ঘুষি কষাল তার মুখে।

এরপর ভরতকে মারতে মারতে ওরা আধমরা করে ফেলল। রানাডেকে চিনিয়ে দিল এক গুপ্তচর। সেই কক্ষের মোট এগারো জনকেই হাতে পায়ে বেড়ি দিয়ে, টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হল কোতোয়ালিতে। ভরত তখনও জানল না যে সে কী অপরাধ করেছে।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়