সেই বয়স মানুষ খুব দ্রুত হারিয়ে ফেলে, যে বয়সে প্রত্যেকটি সকালকেই মনে হয় নতুন। ঘুম ভাঙার পর চোখে খানিকটা বিস্ময়ের ঘোর লেগে থাকে। শরীরে ভর করে না পৃথিবীতে দীর্ঘকাল বসবাসের অবসাদ। বিছানা থেকে তড়াক করে লাফিয়ে নেমে বাইরে ছুটে যাওয়া যায়।

বাদল তার মায়ের থেকেও আগে ওঠে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটু একটু পিচুটি লেগে থাকা চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে তাদের বাড়ির সামনের চওড়া রাস্তার দিকে। কিছু কিছু দৃশ্য, কিছু মানুষকে সে প্রত্যেক দিন দেখে। যেন এদের সঙ্গে তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, দেখা না করলে চলবে না। প্রথমেই সে দেখে দু’জন মানুষকে, তারা রাস্তার চাপাকলের সঙ্গে লম্বা হোসপাইপ লাগিয়ে জল ছড়ায়। হোসপাইপটা নেতিয়ে পড়ে থাকে, তার মধ্যে জল ঢুকলেই সেটি আস্তে আস্তে সাপের মতন জীবন্ত হয়ে ওঠে, নিজে নিজেই নড়েচড়ে। একজন লোক সেটা হাতে তুলে নিয়ে জল ছড়ায়– তখন ফট ফট করে আওয়াজ হয় কত দূর পর্যন্ত যায় জল, হঠাৎ মনে হয় রাস্তার সব.. পথিককে ভিজিয়ে দেবে কিন্তু কারওর গায়ে কোনও দিন জল লাগেনি, ঠিক পায়ের কাছে এসে থেমে যায়। বাদলের মনে হয়, এটা একটা খেলা।

সাতসক্কালেই পথে অনেক মানুষ থাকে। অধিকাংশই গঙ্গাস্নান যাত্রী, কেউ কেউ শীতের জড়তা কাটাবার জন্য গান গাইতে গাইতে যায়। মহিলারা যান রিকশায়–অনেক ঠুং ঠুং শব্দ পরস্পরকে পাল্লা দেয়। একজন বৃদ্ধ মাড়োয়ারি গিরিশ পার্কের সামনে রোজ পায়রাদের গম খাওয়ান। ছড়িয়ে দেন মুঠো মুঠো গম-ঝক ঝক পায়রা এসে বসে রাস্তার মাঝখানে দূর থেকে তাদের মনে হয় চঞ্চল ফুলের মতন। একটু বাদেই একটা বিশাল চেহারার ষাঁড় এসে ঢুকে পড়ে পায়রার ঝাকের মধ্যে। পায়রাদের খাবারে সে। ভাগ বসাতে যায়। বৃদ্ধ মাড়োয়ারিটি পরম স্নেহে ষাঁড়টির গায়ে হাত বুলিয়ে বলেন, আয়, বেটা চুঃ চুঃ–

একটা লোক কলাপাতায় মুড়ে মাখন বিক্রি করে। সাদা ও হলদে দু’রকম মাখন– নুন ছাড়া ও নুন মেশানো–ছোট ছোট কলাপাতার প্যাকেট দাম দু পয়সা। লোকটি বাদলদের বারান্দার তলায় এসে রোজ মুখ তুলে বলে, মাখন চাই নাকি, খখাকাবাবু? মাখন?

বাদল ঘাড় নেড়ে না’ জানায়। লোকটি একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে দু-চার বার যেন বাদলকেই শোনাবার জন্য দু’-তিন রকম সুরে মাখন, মাখন, মাখন হাঁক ছাড়ে। বাদল কোনও দিন কেনেনি, তবু লোকটা বিরক্ত হয় না।

পর পর ধামা মাথায় করে আসে আর একটি লোক, সে ঠোঁটদুটোকে গোল করে বলে, মুড়ির চাক, ছোলার চাক, চিঁড়ের চাক চাই-ই! বাদল বেশ কিছুদিন, এই লোকটি কী বলে যে চাঁচায়, তা বুঝতেই পারেনি! সেই জন্যই মায়ের কাছে ঝুলোঝুলি করে এই লোকটিকে একদিন ডেকেছিল। ওমা, এই লোকটি মোয়া বিক্রি করে। তবে চিড়ের মোয়াগুলো গোল নয় চ্যাপটা। আর ভোলার মোয়া বাদল আগে কখনও দেখেনি। কিন্তু মুড়ির মোয়াকে এ কেন মুড়ির চাক বলে, বাদল তা বুঝতে পারে না।

হঠাৎ ঝনঝন আর কপ কপ শব্দে চতুর্দিক সচকিত হয়ে যায়। রাস্তা ছেড়ে দেয় লোকজন। সেই ঘোড়ার গাড়িটি আসছে। দুটি বিশাল অশ্ব টেনে আনছে একটা কালো রঙের চকচকে গাড়ি, কী সুন্দর তার পালিশ-ঝকমক করে। গাড়ির ওপরে উর্দি-পরা কোচোয়ান বসে থাকে চাবুক হাতে নিয়ে–পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে আর একজন উর্দি-পরা লোক, সে একটা পেতলের জিনিসে ঝনঝন আওয়াজ করে। গাড়িখানা দেখলেই সম্ভ্রম হয় কিন্তু গাড়িটার দুটি দরজাই বন্ধ, ভেতরে কে আছে বোঝা যায় না। বাদল কোনও দিনই জানতে পারেনি, ওই সুদৃশ্য গাড়ির রহস্যময় অতিথি প্রতিদিন ভোরে কোথায় যায়।

আর একটু পরেই মা হাতে খানিকটা ছাই নিয়ে এসে বলেন, এই নে। সড়ে ছ’টা বেজে গেছে কখন, আর তুই এখনও দাঁড়িয়ে আছিস!

ছাই দিয়ে দাঁত মেজে ফেলে বাদল, মুখ নিজেই ঘোয়, কিন্তু চোখ ধুইয়ে দেন মা নিজে। মা চোখে জলের ঝাঁপটা দিয়ে ভালো ভাবে পরিষ্কার করে দেন। একবার জ্বরে ভোগার পর বাদলকে সরষের তেল আর নুন দিয়ে দাঁত মাজতে হয়েছিল, কিন্তু তার চেয়ে ছাই দিয়ে মাজাই তার পছন্দ হয়।

মুখ ধুয়ে এসে চট করে দুধ মুড়ি খেয়ে নেয়, তার পরেই জামা-প্যান্ট বদলে মাথা আঁচড়ানো। বাদলকে পড়তে হয় সকালের ইস্কুলে। বাদলের দুই দিদি সান্ত্বনা আর। শ্রীলেখার ইস্কুলও সকালে, বাদল তাদের সঙ্গে যায়। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে বাদল দেখতে পায় একতলায় বসবার ঘরে খবরের কাগজ সামনে মেলে বসে আছেন বড়বাবু, হাতে সিগারেট। বড়বাবু কখনও চোখ তুলে তাকান ওদের দিকে, কোনও কোনও দিন একটাও কথা বলেন না। আবার কোনও কোনওদিন বাদলকে হাতছানি দিয়ে কাছে। ডেকেই দু’হাতে তাকে শূন্যে উঁচু করে তোলেন, কী রকম লেখাপড়া শিখছিস, দেখি! বল তো, পিপীলিকা বানান কী?

বাড়ির চাকর সঙ্গে সঙ্গে আসে, কিন্তু বাদল দিদিদের হাত ধরে যায়। শ্রীলেখাদির কাছে পয়সা থাকে, বাদল এক এক দিন আবদার বায়না করে শ্রীলেখাদিকে দিয়ে লাঠি লজেঞ্জুস কেনায়। তারপর দিদিরা তাকে ইস্কুলের দরজায় পৌঁছে দিয়ে নিজেদের ইস্কুলে চলে যায়।

বাদলদের ইস্কুলের নাম যদু পণ্ডিত বিদ্যালয় কিন্তু লোকের মুখে মুখে এর নাম যদু পণ্ডিতের পাঠশালা। এই ইস্কুল ক্লাস সিক্স পর্যন্ত, সুতরাং ছাত্ররা সবাই শিশু। সকালবেলার গাছ-ভরতি পাখির মতন গোটা স্কুল বাড়িটা জুড়ে শিশু কণ্ঠের রিনিরিনি আওয়াজ। ঠিক সাতটার সময় ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজলেই সব আওয়াজ থেমে যায়। সবাই ক্লাসঘর ছেড়ে বারান্দায় দাঁড়ায়। দোতলায় সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে প্রকাণ্ড টাকওয়ালা হেডমাস্টারমশাই দু’হাত উঁচু করে বলেন, রেডি! ওয়ান টু থ্রি–

সবাই একসঙ্গে গান শুরু করে:

জয় ভগবান
সর্ব শক্তিমান
জয় জয় ভবপতি…ইত্যাদি।

গান শেষ হওয়া মাত্রই ছেলেরা দৌড়োয় যে-যার ক্লাসঘরের দিকে। যে আগে যাবে সে সামনে বসবে।

ইস্কুলে বাদলের মন ভালো থাকে না। তখনও অন্যান্য ছেলেদের সঙ্গে তার ভাব হয়নি। একেই সে লাজুক, তার ওপরে বাঙাল উচ্চারণের জন্য সে কথাই বলতে চায় না। সহজে। অন্যান্য ছেলেরা মাস্টারমশাইকে লুকিয়ে কাটাকুটি খেলে স্লেটে, ছুরি দিয়ে কাঠের ডেস্কে নাম খোদাই করে বাদল আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকে। পরিতোষ বলে একটা ছেলে মাঝে মাঝেই নিজের পকেটে হাত ঢোকায়, তারপর সেই হাতটা মুখের কাছে এনে ভেতরে একটা কিছু পুরে দেয়, খুট খুট করে চিবোয়। বাদল সেই দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে বলে একদিন সে বাদলকে বলল, খাবি?

বাদল কিছু উত্তর দেবার আগেই পরিতোষ তার মুঠোকরা হাতটা এনে বাদলের মুখের কাছে চেপে ধরল। খেয়েও বাদল বুঝতে পারছে না, জিজ্ঞেস করল, কী? পরিতোষ বলল, মশলা!

দুপুরে ভাত খাবার পর বাদল তার বাবা-জ্যাঠাকে মশলা চিবোতে দেখেছে বটে। কিন্তু এমনি এমনি কেউ বসে বসে মশলা খায়–এটা তার ধারণাই ছিল না। তাও ওইটুকু ছেলে।

দিদিদের ছুটি হবার আধ ঘণ্টা আগেই বাদলের ছুটি হয়ে যায়। সেই সময়টা তাকে একলা একলা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় গেটের কাছে। অন্য ছেলেরা দল বেঁধে চলে যায়, কেউ কেউ তাকে ডাকে–তবু বাদল যেতে পারে না। বাদলের ওপর কড়া হুকুম, কক্ষনও সে একলা একলা রাস্তা দিয়ে হাঁটবে না। কলকাতায় ছেলেধরা আছে, তারা একলা বাচ্চা ছেলে পেলেই ছালায় (বস্তায়) ভরে নিয়ে চলে যায় তারপর তাদের হাত-পা কেটে ভিখিরি বানিয়ে দেয়। বাদল বাড়ির রাস্তা চেনে, তার ইচ্ছে করে এক ছুটে বাড়ি চলে যেতে–কিন্তু হুকুম অমান্য করার সাহস সঞ্চয় করতে পারে না।

স্কুলের অন্যান্য ছেলেরা আলুকাবলি কিংবা হজমি কিনে খায়, কিন্তু বাদলের হাতে পয়সা দেওয়া হয় না। সবচেয়ে লোভনীয় হচ্ছে ‘বুড়ির মাথায় পাকা চুল’–লাল তুলোর মতন মিষ্টি জিনিস–এই জিনিসটা বাদলের বাড়ির কাছে কেন যে পাওয়া যায় না!

লাল পাগড়ি মাথায় একজন জমকালো চেহারার পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকে বাদলদের ইস্কুলের কাছেই। কলকাতার রাস্তার পুলিশ সে-সময় বেশ একটা আকর্ষণীয় ব্যাপার। ছেলেরা পুলিশটিকে দেখলেই চেঁচিয়ে বলে, পুলিশ, সেলাম! পুলিশ, সেলাম!

পুলিশটি উত্তর না দিয়ে মৃদু হাসে। কয়েকটা দুষ্টু ছেলে অবশ্য একটু দূরে গিয়ে চেঁচিয়ে বলে,

বন্দে মাতরম
পুলিশের মাথা গরম!

বলেই তারা দৌড়োয়।

এ রকম ভাবেই ছেলেরা পাগলা হাবু’কে খ্যাপায়। পাগলা হাবু অত্যন্ত ভালোমানুষ পাগল। মোটাসোটা চেহারা, খালি গা। সারা পিঠ জুড়ে কালসিটে পড়ে গেছে। সে একখানা মোটা লাঠি নিয়ে নিজের পিঠে নিজেই মারে–আর কী যেন চাচায়। আগে বাদলের মনে হত, ও বলছে বাংলা কাবু। পরে মনোযোগ দিয়ে শুনে বুঝেছে, ও বলে, পাগলা হাবু। যেন নিজের পাগলামির জন্য নিজেকেই শাস্তি দেয় সে।

কিন্তু কৈশোরে অধিকাংশ মানুষই নিষ্ঠুর। অমন যে নিরীহ পাগলা হাবু তাকেও ছেলেরা নিষ্কৃতি দেয় না। যেহেতু পাগলা হাবু নিজেকে ছাড়া আর কারওকে কখনও মারে না–তাই ছেলেরা নির্ভয়ে তার কাছে গিয়ে চিলুবিলু করে তাকে খোঁচায়, চিমটি কাটে, কেউ কেউ ইটের টুকরো ছুঁড়ে মারে। পাগলা হাবু তখন কাঁদে ভেউ ভেউ করে। . সপ্তাহে একদিন বাদল মাকে নিয়ে গঙ্গায় যায়। আগে মা আর জ্যাঠামশাই দু’জনে মিলে যেতেন–ইদানীং জ্যাঠামশাই বাতে শয্যাশায়ী হওয়াতে মাকে একাই যেতে হয়, তিনি বাদলকে সঙ্গে নেন।

রিকশা করে গিয়ে ঘাট থেকে একটু দূরে নামতে হয়। পথের দু পাশে বসে থাকে। অসংখ্য ভিখিরি। পুণ্য অর্জনের জন্য লোকেরা তাদের একপয়সা বা আধলা দেয়। কেউ কেউ বাড়ি থেকে চাল নিয়ে আসে। কেউ কেউ আবার অধিকতর পুণ্য অর্জনের জন্য ভিখিরিদের পয়সা না দিয়ে সেই পয়সা গঙ্গায় ছুঁড়ে দেয়। বাদল শুনেছে, গঙ্গার জলে ডুব দিলেই সব পাপ চলে যায়। জলে ডুব দিয়ে থাকলে পাপগুলো শরীর ছেড়ে অদৃশ্য ফড়িঙের মতন জলের ওপর অপেক্ষা করে, মাথা তুললেই আবার চেপে বসে। বার বার ডুব দিলে, পাপগুলো হয়তো বিরক্ত হয়ে অন্য কোথাও চলে যেতে পারে। সেই জন্যই অনেককে মরার একটু আগে গঙ্গার কিনারায় নিয়ে আসা হয়–গঙ্গার জল ছুঁয়ে থেকে মরতে পারলে তার আর কোনও পাপ সঙ্গে নিয়ে যেতে হয় না। এইসব শোনার পর বাদল একদিন গঙ্গায় স্নান করতে নেমে জলের মধ্যেই পেচ্ছাপ করে ফেলেছিল তখন তার কী ভয়! কিন্তু বাদলের যে কোনও উপায় ছিল না–ঠান্ডা জলে নামামাত্রই তার এমন পেচ্ছাপ পেল কিছুতেই সে আটকাতে পারেনি–কেউ দেখেনি অবশ্য, মা-ও কিছু জানতে পারেননি কিন্তু ঠাকুর দেবতারা যে সব টের পেয়ে যান।

বেশির ভাগ দিনই অবশ্য বাদল স্নান করে না। বাদলের কাজ হল মায়ের কাপড়চোপড় পাহারা দেওয়া। এখানে খুব চোরের উপদ্রব। গঙ্গায় শুধু লোক পুণ্য করতেই আসে না, এখানে পাপ করতেও অনেকে আসে। মায়ের কাপড়জামা বুকে চেপে ধরে বাদল দাঁড়িয়ে থাকে। একজায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে না অবশ্য। এখন তার আট বছর বয়স, এখন আস্তে আস্তে তার সাহস বাড়ছে। মায়ের স্নান সেরে আসার মোটামুটি সময়টা তার জানা। সেই সময়টুকু সে এদিক-ওদিক ঘুরে আসে।

মানুষ গিসগিস করছে চার দিকে। গঙ্গায় বুকজলে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ স্তোত্র পাঠ করে। কোনও কোনও দুঃসাহসী সাঁতরে ভাসমান বয়ার কাছে চলে যায়। দুরন্ত স্রোত। এক একটা স্টিমার চলে গেলে বড় বড় ঢেউ এসে বাঁধানো ঘাটে আছড়ায়। স্টিমারের গম্ভীর বিষণ্ণ ভোঁ অনেকক্ষণ কানে লেগে থাকে।

ঘাটলায় ছোট ছোট কাঠের চৌকি পাতা। সেইখানে উপুড় হয়ে শুয়ে মোটাসোটা লোকেরা সারা শরীরে তেল মাখায় পয়সা দিয়ে। তাদের ঘাড়ের ওপর, পিঠের ওপর চড়ে তৈলমর্দনকারীরা প্রচণ্ড শব্দে চপেটাঘাত করে, গুম গুম করে কিল মারে–আর নীচের লোকটি মহানন্দে পড়ে আছে। বাদল হাঁ করে এই দৃশ্য দেখে।

পাশেই শ্মশান। বাদল একবার মাত্র মায়ের সঙ্গে শ্মশানে ঢুকেছিল, তারপর থেকে একা একা প্রত্যেক দিন যায়। মা জানতে পেরে বারণ করেছিলেন, বাদল তবু যায়। এটা তার নেশার মতন। সবসময় দু-তিনটে চিতা জ্বলে, মানুষ আছড়ে-পিছড়ে কাঁদে বাদল চুপটি করে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে। আগে তার ধারণা ছিল, কোনও যুক্তি নেই এ ধারণার, যে মানুষ বুঝি শুধু রাত্তিরবেলাই মরে, রাত্তির বেলাই তাদের পোড়ানো হয়। কিন্তু গঙ্গার ঘাটে এসে সে কোনওদিন সবকটা নেবানো চুল্লি দেখেনি।

সেদিন কী যেন একটা বিশেষ তিথি। ভিড়ে ভিড়াক্কার। কিন্তু বাদল এখানে অনেক বার এসেছে বলে এখন সবাকছু চেনে। তার ভয় করে না। মেয়েদের কাপড় ছাড়ার জায়গাটার পাশেই সে দাঁড়িয়ে ছিল মায়ের অপেক্ষায়। এত ভিড় যে ভলানটিয়াররা অনেক চেষ্টা করেও সামলাতে পারছে না। বিভিন্ন গেটে ঠেলাঠেলি পড়ে গেছে। এত ভিড়ের মধ্যেই আবার কোনও একজন গণ্যমান্য লোকের মৃতদেহ নিয়ে এসেছে একটি দল। মস্ত বড় পালঙ্ক, ফুলে ফুলে ছয়লাপ, মৃতদেহ দেখাই যায় না, সেটা বয়ে নিয়ে আসছে যারা তারা এই ভিড়ের মধ্যে.হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে একজন আবার খইয়ের সঙ্গে পয়সা ছড়াচ্ছে তার ফলে কাঙালিদের হুটোপুটি।

মা এসে কাপড় ছেড়ে নিলেন, তারপর বাদলকে বললেন, শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরে থাকবি। বড়রাস্তা পর্যন্ত না গেলে রিকশা পাওয়া যাবে না।

ভিড় ঠেলে এগোচ্ছে ওরা। একটা জায়গায় গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনেক লোক, তাদের এড়িয়ে এগোনো যায় না। চুক চুক আওয়াজ করছে-বাইরে থেকে কৌতূহলী মানুষরা ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করছে, কী হয়েছে? এখানে কী হয়েছে?

একটি বাচ্চা মেয়ে হারিয়ে গেছে। অনেকক্ষণ ধরে সে এখানে দাঁড়িয়ে একা একা কাঁদছে। চেহারা ও পোশাক দেখলে মনে হয় সম্ভ্রান্ত বাড়ির মেয়ে। ফুটফুটে রং, মাথাভরতি কঁকড়া চুল।

একজন মাতব্বর ধরনের লোক হেঁড়ে গলায় জিজ্ঞেস করছে, ও খুকি, তোমার নাম কী? নাম জানো না?

মেয়েটি কিছুই বলছে না, শুধু কাঁদছে ফুলে ফুলে। এত মানুষ দেখে তার মাথার ঠিক নেই।

তোমার বাবার নাম জানো না?

তুমি কোথায় থাকো?

কার সঙ্গে এসেছ?

মেয়েটি একটা কথাও বলতে পারছে না। কয়েকজন সখেদে মন্তব্য করল, এ মেয়েকে তো এখানে ফেলেও যাওয়া যায় না। কোন চোর-জোচ্চোরের খপ্পরে পড়বে! কলকাতা শহর যা জায়গা–

বাদলের মা বললেন, আহা রে, ওই মেয়েটার মা-বাবার মন এখন কী রকম আকুলিবিকুলি করছে। ওইটুকু মেয়ে–

সেই সময় ভিড়ের ফ্লাক দিয়ে বাদল একঝলক দেখতে পেল মেয়েটিকে। সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত উত্তেজিত ভাবে বলল, মা, ওকে আমি চিনি!

মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুই চিনিস? কী করে চিনলি? কে?

বেশি উত্তেজিত হয়ে গেলে বাদলের দম বন্ধ হয়ে আসে, কথা বলতে পারে না। কোনওক্রমে বলল, বড়বাবুর সঙ্গে সেই যে গিয়েছিলাম,…ভবানীপুরে…সেই বাড়িতে।

মা বললেন, যাঃ, সেই ভবানীপুর থেকে এত দূর আসবে কী করে? যাঃ!

ভবানীপুর নয়, ওরা হাতিবাগানে থাকে।

কী নাম ওর?

ওর নাম রেণু।

মা তার পার্শ্ববর্তী একজন স্থূলকায় মহিলাকে বললেন, আমাকে একটু মেয়েটির কাছে যেতে দেবেন? আমি ওকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব।

ভিড় সরিয়ে মাকে কাছে যাবার ব্যবস্থা করে দেওয়া হল। মা জিজ্ঞেস করলেন, খুকি, তোমার নাম কি রেণু? তুমি কি হাতিবাগানে থাকো?

মেয়েটি বড় বড় চোখ মেলে মায়ের দিকে তাকাল। তারপর ছুটে এসে মায়ের হাত চেপে ধরল শক্ত করে।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়