দুটো সাইকেল ভাড়া করা হয়েছে, কানু আর পিকলু ত্রিকূট পাহাড়ে বেড়াতে যাবে। এ বিষয়ে বিশ্বনাথের সঙ্গে তাদের একটা ষড়যন্ত্র হয়েছে আগেই। প্রতাপকে জানানো হবে না। কারণ প্রতাপ শুধু ওদের দু’জনকে অতদূর যেতে দিতে আপত্তি করতে পারেন, আর বাবলুকেও সঙ্গে নেওয়া হবে না, কারণ সে সাইকেল চালাতে জানে না।

বিশ্বনাথ খুব তাল দিয়েছেন ওদের। চোখ পাকিয়ে ফিস ফিস করে বলেছেন, তোরা খুব ভোরে উঠে চলে যাবি, বুঝলি! কাক-পক্ষীতেও যেন টের না পায়। পিকলু, তোর বাবাকে আমি পরে ঠিক ম্যানেজ করে দেবো। সে বেশি রাগারাগি করলে আমার হাতে একটা মোক্ষম যুক্তি আছে।

ক’দিন ধরেই বাড়ির সকলে মিলে টাঙ্গা ভাড়া করে ত্রিকূট আর তপোবন বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব উঠছিল, কিন্তু মমতার শরীরটা ভালো নেই বলে যাওয়া হচ্ছে না। কিন্তু ছেলেদের অত ধৈর্য নেই, পাহাড়ের নাম শুনে তারা উতলা হয়ে উঠেছে।

বিশ্বনাথ শেষ রাতে অন্ধকার থাকতে থাকতেই ডেকে দিলেন কানু আর পিকলুকে। ওরা তৈরি হয়ে নিল চটপট। বিশ্বনাথ একটা ছোট চুবড়িতে পাঁউরুটি, মাখন, কলা আর গোটা দশেক পাড়া সাজিয়ে দিলেন, বয়েসকালের ছেলে, ওদের যখন-তখন খিদে পাবে।

যাত্রার ঠিক আগে বাবলু বাইরে বেরিয়ে এলো। ঘুম চোখেও সে ব্যাপারটা বুঝে নিল এক মুহূর্তে, দৌড়ে গিয়ে সে একটা সাইকেল চেপে ধরে রইলো শক্তভাবে। তাকে আর কিছুতেই ছাড়ানো যায় না। বেশি জোর করতে গেলে সে তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, না, আমি যাবো! আমি যাবো!

বিশ্বনাথ বললেন, এই রে, এবার তো সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে। এই বিচ্ছুটা ছাড়বে না। কানু, তুই ডাল ক্যারি করতে পারবি না?

কানুর ভুরু কুঁচকে গেছে। অনেকখানি রাস্তা। তার তো প্রত্যেকদিন সাইকেল চালানো। অভ্যেস নেই। কিন্তু বাবলুটা যা জেদী ছেলে তাকে এড়ানো যে সম্ভব হবে না, তাও কানু বুঝে গেছে। সে ধমকের সুরে বললো, যা, সোয়েটার নিয়ে আয়।

পিকলু বললো, জুতোর সঙ্গে মোজা পরবি। না হলে তোকে নেবো না!

অন্যসময় বাবলু গরম জামা পরতে চায় না, আর জুতোর সঙ্গে কিছুতেই মোজা পরতে রাজি হয় না। এখন সব কিছুতেই রাজি। বিশ্বনাথ ওদের গেটের বাইরে খানিকটা এগিয়ে দিয়ে। এলেন।

সকালে চা খাওয়ার সময় প্রতাপ ছেলেদের অনুপস্থিতি লক্ষ করলেন না। দু’দিন ধরে বেশ জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। বাগানে চেয়ার পেতে রোদ্দুরে বসে দু’তিন কাপ চা খেয়েও আশ মেটে না। তারপর প্রতাপ বাজার করতে বেরিয়ে পড়েন। রোজ রোজ মুর্গীর মাংস তাঁর রোচে না, একটু মাছ না হলে যেন ভাত খাওয়ার আনন্দটাই মাটি। প্রতাপ আবিষ্কার করেছেন যে বম্পাস টাউনে এক জায়গায় টাটকা মাছ বিক্রি হয়, তবে যেতে হয় সকাল নটার মধ্যে।

একটা বেশ ভালো কাতলা মাছ পেয়ে প্রতাপ প্রসন্ন হয়েছিলেন, কিন্তু একটু পরেই তাঁর মেজাজ বিগড়ে গেল। ফেরার পথে তিনি দশ পয়সা দিয়ে একটি আনন্দবাজার কাগজ কিনলেন। আগের দিনের ডাক সংস্করণ। প্রথম পৃষ্ঠায় অ্যামেরিকান প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ারের নিষ্ঠুর হাসিমাখা মুখের ছবি। রাশিয়ার উদ্দেশে তিনি কয়েকটি কটুক্তি বর্ষণ করেছেন। এক বছর আগে স্টালিন সাহেবের মৃত্যুর পর আইসেনহাওয়ার-চার্চিলের ধারণা হয়েছে যে এবার রাশিয়াকে বাগে পাওয়া গেছে। ঠাণ্ডা লড়াইটা এবার বুঝি গরম হয়ে উঠবে।

মূল খবরের চেয়েও পাতার নিচের দিকের কয়েকটি সংবাদে প্রতাপ বেশি আকৃষ্ট হলেন। ধানবাদের কাছে একটি ছোট জায়গায় বাঙালীদের সঙ্গে বিহারীদের মারামারি হয়েছে। বিহারে বাঙালী-বিরোধী মনোভাব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার পাশের খবরটিই পূর্ব পাকিস্তানের, সেটাও দাঙ্গার খবর। ফজলুল হক মন্ত্রী সভা পতনের পর ওদিকে ছোটখাটো দাঙ্গা লেগে থাকছে, দলে দলে হিন্দুরা সীমান্ত পার হয়ে চলে আসছে ভারতে। আর একটি ছোট থব কলকাতার উপকণ্ঠে কাশীপুরে একটি বাগানবাড়ি উদ্বাস্তুরা জবরদখল করতে গেলে হাঙ্গামা হয়, পুলিশ উদ্বাস্তুদের ওপর গুলি চালিয়েছে।

প্রতাপের চোয়াল কঠিন হয়ে গেল, তিনি ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলতে লাগলেন।

বাড়ি ফিরে তিনি দেখলেন বিশ্বনাথ প্রবল উৎসাহে গানের ইস্কুল চালাচ্ছেন। প্রত্যেক একই গান শুনতে প্রতাপের ভালো লাগে না, তিনি উঠে গেলেন ছাদে। খানিকক্ষণ গল্প করলেন মায়ের সঙ্গে।

বেলা বাড়ার পর প্রতাপ নিচে এসে দেখলেন বিশ্বনাথ আর মমতা ঠিক যেন একটি নাটকের দৃশ্য অভিনয় করছেন। মমতার মুখোনিতে দারুণ উদ্বেগ মাখা আর বিশ্বনাথের মুখে খানিকটা উদাসীনতা, খানিকটা কৌতুক। বিশ্বনাথের এক হাতে জ্বলন্ত চুরুট, অন্য হাত দিয়ে তিনি দাড়ি মুচড়োচ্ছেন।

মমতা স্বামীকে দেখে আর্তভাবে বললেন, বাবলু-পিকলুরা কোথায় গেল? সকাল থেকে দুধ খায় নি, কিছু খাবার খায় নি!

বিশ্বনাথ হাসিমুখে বললেন, গেছে কোথাও খেলতে। ওরা কি সর্বক্ষণ বাড়িতে বসে থাকতে পারে?

মমতা বললেন, তা বলে এতক্ষণ? ঘুম থেকে উঠে আমি তো ওদের দেখিইনি! বাবলুটা দুধ না খেয়ে থাকতেই পারে না!

বিশ্বনাথ উত্তর না দিয়ে চুরুট ফুঁকতে লাগলেন। প্রতাপের মনের মধ্যে খানিকটা উদ্বেগের সৃষ্টি হলেও তিনি স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে কোনো কথা বললেন না। তিনি প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য বললেন, আসবে, ওরা এসে পড়বে, তুমি ততক্ষণ আমাদের আর একটু চা খাওয়াতে পারো?

একটু পরে মমতা শান্তিকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন। শান্তি কী করে যেন জেনে ফেলেছেন যে ছেলেরা বেরিয়েছে ভাড়া করা সাইকেলে এবং বিশ্বনাথই তাদের উস্কানিদাতা।

ঘটনাটি ফাঁস হয়ে যাওয়াতেও একটুও বিচলিত না হয়ে বিশ্বনাথ উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, আরে, এই ওরা একটু ত্রিকূট পাহাড়ের দিকে গেছে, কোনো চিন্তা নেই, সঙ্গে অনেক খাবার-দাবার নিয়ে গেছে!

দুই নারী এবারে বিশ্বনাথের উদ্দেশে প্রভূত অনুযোগ ও গঞ্জনা বর্ষণ করতে লাগলেন। বিশ্বনাথ মৃদু মৃদু হাসিমুখে প্রথমে কিছুক্ষণ শুনলেন, তারপর ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললেন, এই চুপ! মা শুনতে পেলে একটা হুলুস্থুলু বাঁধাবেন, তোমরা কি তাই চাও? ওদের বলে দিয়েছি বিকেল পাঁচটার মধ্যে ফিরবে, ততক্ষণ ধৈর্য ধরে থাকো না!

এই কথায় কাজ হলো। একথা ঠিক যে সুহাসিনী জানতে পারলে এমনই হা-হুঁতাশ শুরু করবেন যে মনে হবে যেন ছেলে তিনটি মরেই গেছে। তখন সুহাসিনীকে সামলানোই এক বিরাট সমস্যা হবে। মমতা ও শান্তি আরও একটুক্ষণ গুঞ্জন করে চলে গেলেন ভেতরে।

প্রতাপ যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন, জেগে উঠলেন সহসা। তাঁর দুই ছেলে সকাল থেকে নিরুদ্দেশ, তবু তিনি এতক্ষণ ভাবছিলেন বুলার কথা। এখানে এসে এ পর্যন্ত বুলার সঙ্গে তাঁর একটিও বাক্য বিনিময় হয় নি, তবু যেন বুলার সঙ্গে তাঁর মনে মনে একটা সংলাপ চলছে, বুলা ঠিকই বুঝতে পারছে, প্রয়োজনের সময় বুলা প্রতাপের কাছে ডাক পাঠাবেন। প্রতাপকে দেখলেই যেন বুলার নাক আর কানের ডগা লাল হয়ে ওঠে।

প্রতাপ এবারে বিশ্বনাথকে বললেন, ওস্তাদজী, আপনি ছেলেগুলোকে অতদূর পাঠিয়ে দিলেন? আজকের কাগজ পড়েছেন?

বিশ্বনাথ বললেন, না, পড়িনি। কী আছে?

–বিহারে বাঙালীদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে। বাঙালীরা যখন তখন মার খাচ্ছে! বিশ্বনাথ হা-হা করে হেসে বললেন, আরে দূর! ওরকম কত কী লেখে খবরের কাগজে আমাদের দেওঘরে ওসব কিছু হবে না!

প্রতাপ নিজের বাঁ দিকের জুলপি টানতে টানতে বললেন, কাগজে কিন্তু এরকম খবর প্রায়ই দেখছি। বিহারীরা বাঙালীদের সহ্য করতে পারছে না।

–শোনো, ব্রাদার, বাঙালী এখন কাদায় পড়েছে, সবাই তাকে লাথি মারবে! ঐ বঙ্গ-ভঙ্গটাই মেনে নেওয়া তোমাদের একটা গুরুতর ভুল হয়েছে। তখন এদিকটা চিন্তা করো নি?

–আরে, বঙ্গভঙ্গর জন্য কি আমি দায়ী নাকি! আমি মেনে নিয়েছি কে বললো?

–কথার কথা বলছি। এত লাখ লাখ উদ্বাস্তু, এর ভার কি পশ্চিমবঙ্গ একা নিতে পারবে? বিহার, আসাম, উড়িষ্যা এইসব প্রভিন্সে কিছু কিছু ছড়িয়ে পড়বেই। তাই নিয়ে খানিকটা, গণ্ডগোল তো শুরু হবেই এইসব জায়গায়। গণ্ডগোল, গণ্ডগোল, বুঝলে ব্রাদ্রার, এখন গণ্ডগোলই চলবে! পূর্ববঙ্গ থেকে হিন্দুদের ভাগাবার চেষ্টা করেও কি সেখানকার বাঙালী মুসলমানরা সুখে আছে? ভাবগতিক দেখে তো মনে হচ্ছে, ওটাও একটা কলোনি, রাজ্যপাট যা কিছু চালাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানীরা!

–এ বাংলারও বেশ কিছু মুসলমান রিফিউজি গেছে ওদিকে। তাদের তো ওরা দূর ছাই। করে না! আমাদের এদিকে, কাশীপুরে রিফিউজিদের ওপর পুলিশ গুলি চালিয়েছে। এই অসহায় মানুষগুলোকে থাকবার জায়গা দিতে পারছে না সরকার, তার ওপর আবার গুলি। চালাবে; ভাবলেই আমার রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে!

বিশ্বনাথ বেশিক্ষণ রাজনৈতিক আলোচনা বা তিক্ত বিষয় নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসেন। তিনি গুনগুন করে গান ধরলেন। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রতাপ বললেন, ওস্তাদজী, ছেলেগুলোকে অত দূর পাঠানো বোধ হয় ঠিক হয় নি। বাবলুটা ভীষণ দুরন্ত…

গান থামিয়ে বিশ্বনাথ প্রতাপের মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন। তারপর অপ্রত্যাশিতভাবে বললেন, তুমি ঘোর সংসারী হয়ে পড়েছো!

প্রতাপ বললেন, স্বেচ্ছায় নয়। সংসারটা আমার কাঁধের ওপর চেপে বসেছে, বাবা চলে গেলেন, দেশের বাড়িটা চলে গেল…

–শোনো ব্রাদার, দেওঘরের এই বাড়িটা যখন কেনা হয়, তখন তোমার বয়েস কত ছিল? এই পিকলুরই বয়েসী হবে! সবাই মিলে এক সঙ্গে আসা হয়েছিল। এক দিন তুমি আর আমি

সাইকেলে ত্রিকূট পাহাড় বেড়াতে গেলাম মনে নেই? তোমার বাবাকে কিছু না জানিয়ে—

প্রতাপ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, তখন দিনকাল অন্যরকম ছিল!

–দিনকাল তো নিজের নিয়মে বদলাবেই। সময় কি থেমে থাকে? কিন্তু যে বয়েসের যা, তা তো চলবেই। ওরা একটু অ্যাডভেঞ্চার করতে গেছে, অত ঘাবড়াচ্ছো কেন?

.

বাবলুকে নিয়ে কানু একবার আছাড় খেয়েছে। আগে সে বাবলুকে পেছনের ক্যারিয়ারে নিয়েছিল, এবারে সামনের রডের ওপর বসালো, তাতে সুবিধে হয়। বাবলু অবিরাম বক বক করে যাচ্ছে।

কানু তার জন্ম থেকেই মামার বাড়িতে থাকতো বলে তাকে পিকলুবাবলুরা ছোটবেলায় দেখেনি বিশেষ। কানু তাদের কাছে নতুন মানুষ। ছিপছিপে চেহারা কানুর, বয়স্কদের সামনে সে প্রায় কোনো কথাই বলে না, বিনীত ভাব করে থাকে, আসলে সে বয়স্কদের শাসনের অধিকার একেবারেই অগ্রাহ্য করে মনে মনে।

বাবলু একবার জিজ্ঞেস করলো, কানু কাকা, তুমি তো আমার বাবার ভাই, তা হলে আমার। ঠাকুমা তোমার মা নয় কেন?

কানু বললো, তোর ঠাকুমা আমার বড় মা। আমার নিজের মা ছোট মা।

–তোমার নিজের মা কোথায়?

–স্বর্গে গেছেন।

বাবলু একবার আকাশের দিকে তাকালো। শীতের নির্মেঘ, নীল আকাশ। সেই আকাশের। এক প্রান্তে হেলান দিয়ে আছে দূরের গম্ভীর পাহাড়। বহু উঁচু দিয়ে দুটি চিল ছুটে যাচ্ছে বিদ্যুৎবেগে।

–কানুকাকা, তোমার মাকে দেখতে ইচ্ছে করে না?

–নাঃ।

বাবলু বেশ অবাক হয়ে যায়। কানুকাকার থেকে বাবা কত বড়, অথচ বাবার নিজের মা। আছে। কানুকাকার নেই। কিন্তু বাবা একদিন কানুকাকাকে মেরেছিল, তখন কানুকাকা চেঁচিয়ে কেঁদেছিল; ও মা, মা গো, তুমি আমায় কেন ফেলে রেখে গেলে!

-–কানুকাকা, তোমার স্বর্গে যেতে ইচ্ছে করে না?

–এক থাপ্পড় খাবি এবার। কেন রে আমি এত তাড়াতাড়ি সেখানে যাবো?

–আমি একটু নামবো। আমার হিসি পেয়েছে।

–এই জন্য তোকে নিয়ে আসতে চাই নি!

পিকলু এগিয়ে যাচ্ছিল, তাকে ডেকে থামালো কানু। তারপর একটা গাছতলায় নেমে সিগারেট ধরালো। কয়েকটা টান দিয়ে সেটা পিকলুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, নে।

বাবলু বড় বড় চোখ করে দাদার দিকে তাকালো। পিকলু লজ্জিতভাবে ঘাড় নেড়ে বললো, না।

কানু বললো, নে না। এই ঠাণ্ডার মধ্যে ভালো লাগবে। এখন তুই কলেজে উঠেছিস, লজ্জা কী?

পিকলুর ফসা মুখোনি লাল হয়ে উঠেছে। প্রতুল নামে তার এক সহপাঠীর প্ররোচনায় এর মধ্যেই সে দু একবার সিগারেট টেনে দেখেছে, তার খারাপ লাগে নি। কিন্তু বাবলু জানে না। বাবলু নিঘাত মাকে বলে দেবে। সে কানুর কাছ থেকে সিগারেট নিল না।

পিকলু সামনের মেঘবর্ণ পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। কয়েকটা বক উড়ে যাচ্ছে পাহাড়ের বুক লক্ষ করে। দূর থেকে কয়েকজন আদিবাসী রমণী হেঁটে আসছে, মাথায় মাটির হাঁড়ি নিয়ে। একটা কুকুর ছুটছে তাদের সামনে সামনে। হঠাৎ সব কিছু মিলিয়ে পিকলুর দারুণ ভালো লাগলো। এ রকম ভালো লাগার মুহূর্তে তার বুকটা একটু ব্যথা ব্যথা করে। সে আপন মনে বলে উঠলো, সুন্দর তুমি এসেছিলে এই প্রাতে/অরুণ বরুণ পারিজাত লয়ে হাতে।

কানু জিজ্ঞেস করলো, পদ্যটা তুই নিজে বানালি?

পিকলু দু দিকে মাথা নাড়লো। কানুকাকাটা কিছু বোঝে না।

বাবলু বললো, দাদা সব সময় চয়নিকা বলে একটা পদ্যর বই পড়ে। এখানেও নিয়ে এসেছে। সেই বইটা।

পিকলু বললো, তোকেও তো, কতবার পড়তে বলি।

বাবলু বললো, এঃ! আমার ইস্কুলের পড়ার বই আছে, তার ওপরে আবার পদ্যর বই পড়বো কেন?

ওরা ত্রিকূট পাহাড়ের গোড়ায় এসে একটা ঝনা দেখতে পেয়ে খাবারদাবার খুলে বসেছে, তার একটু পরেই সেখানে একটি জিপ গাড়ি এসে থামলো। তার থেকে প্রথমে নামলেন, সত্যেন, তারপর তাঁর বাড়ির অন্য অনেকে।

পিকলুদের দেখতে পেয়ে সত্যেন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আর সবাই কোথায়?

পিকলু বললো, আর কেউ আসে নি।

ওরা তিনজনে মিলে দুটি সাইকেলে চেপে এসেছে শুনে সত্যেন এতখানি ভুরু তুললেন যেন যতা একটা মহা বিস্ময়কর ব্যাপার। তিনি নিজের স্ত্রী ও বুলাকে ডেকে বললেন, শোনো, শোনো, পিকলুরা এতখানি রাস্তা সাইকেলে এসেছে! কম দূর নাকি?

বুলা প্রথমে ওদের দেখেও অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন, এবারে কাছে এসে জিজ্ঞেস রলেন, পিকলু, তোমার মা আসেননি?

পিকলুর বদলে কানু উত্তর দিল, বৌদির জ্বর হয়েছে।

–কথার কথা বলছি। এত লাখ লাখ উদ্বাস্তু, এর ভার কি পশ্চিমবঙ্গ একা নিতে পারবে? বিহার, আসাম, উড়িষ্যা এইসব প্রভিন্সে কিছু কিছু ছড়িয়ে পড়বেই। তাই নিয়ে খানিকটা গণ্ডগোল তো শুরু হবেই এইসব জায়গায়। গণ্ডগোল, গণ্ডগোল, বুঝলে ব্ৰাদ্রার, এখন গণ্ডগোলই চলবে! পূর্ববঙ্গ থেকে হিন্দুদের ভাগাবার চেষ্টা করেও কি সেখানকার বাঙালী মুসলমানরা সুখে আছে? ভাবগতিক দেখে তো মনে হচ্ছে, ওটাও একটা কলোনি, রাজ্যপাট যা কিছু চালাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানীরা!

–এ বাংলারও বেশ কিছু মুসলমান রিফিউজি গেছে ওদিকে। তাদের তো ওরা দূর ছাই করে না! আমাদের এদিকে, কাশীপুরে রিফিউজিদের ওপর পুলিশ গুলি চালিয়েছে। এই অসহায় মানুষগুলোকে থাকবার জায়গা দিতে পারছে না সরকার, তার ওপর আবার গুলি চালাবে; ভাবলেই আমার রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে!

বিশ্বনাথ বেশিক্ষণ রাজনৈতিক আলোচনা বা তিক্ত বিষয় নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসেন না। তিনি গুনগুন করে গান ধরলেন। একটুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রতাপ বললেন, ওস্তাদজী, ছেলেগুলোকে অত দূর পাঠানো বোধ হয় ঠিক হয় নি। বাবলুটা ভীষণ দুরন্ত…

গান থামিয়ে বিশ্বনাথ প্রতাপের মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন। তারপর অপ্রত্যাশিতভাবে বললেন, তুমি ঘোর সংসারী হয়ে পড়েছো!

প্রতাপ বললেন, স্বেচ্ছায় নয়। সংসারটা আমার কাঁধের ওপর চেপে বসেছে, বাবা চলে গেলেন, দেশের বাড়িটা চলে গেল…

–শোনো ব্রাদার, দেওঘরের এই বাড়িটা যখন কেনা হয়, তখন তোমার বয়েস কত ছিল? এই পিকলুরই বয়েসী হবে! সবাই মিলে এক সঙ্গে আসা হয়েছিল। এক দিন তুমি আর আমি। সাইকেলে ত্রিকূট পাহাড় বেড়াতে গেলাম মনে নেই? তোমার বাবাকে কিছু না জানিয়ে—

প্রতাপ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, তখন দিনকাল অন্যরকম ছিল!

–দিনকাল তো নিজের নিয়মে বদলাবেই। সময় কি থেমে থাকে? কিন্তু যে বয়েসের যা, তা তো চলবেই। ওরা একটু অ্যাডভেঞ্চার করতে গেছে, অত ঘাবড়াচ্ছো কেন?

.

বাবলুকে নিয়ে কানু একবার আছাড় খেয়েছে। আগে সে বাবলুকে পেছনের ক্যারিয়ারে। নিয়েছিল, এবারে সামনের রডের ওপর বসালো, তাতে সুবিধে হয়। বাবলু অবিরাম বক বক করে যাচ্ছে।

কানু তার জন্ম থেকেই মামার বাড়িতে থাকতো বলে তাকে পিকলু বাবলুরা ছোটবেলায় দেখেনি বিশেষ। কানু তাদের কাছে নতুন মানুষ। ছিপছিপে চেহারা কানুর, বয়স্কদের সামনে সে প্রায় কোনো কথাই বলে না, বিনীত ভাব করে থাকে, আসলে সে বয়স্কদের শাসনের অধিকার একেবারেই অগ্রাহ্য করে মনে মনে।

বাবলু একবার জিজ্ঞেস করলো, কানু কাকা, তুমি তো আমার বাবার ভাই, তা হলে আমার ঠাকুমা তোমার মা নয় কেন?

কানু বললো, তোর ঠাকুমা আমার বড় মা। আমার নিজের মা ছোট মা।

–তোমার নিজের মা কোথায়?

–স্বর্গে গেছেন।

বাবলু একবার আকাশের দিকে তাকালো। শীতের নির্মেঘ, নীল আকাশ। সেই আকাশে এক প্রান্তে হেলান দিয়ে আছে দূরের গম্ভীর পাহাড়। বহু উঁচু দিয়ে দুটি চিল ছুটে যাচ্ছে। বেগে।

–কানুকাকা, তোমার মাকে দেখতে ইচ্ছে করে না?  

–নাঃ।

বাবলু বেশ অবাক হয়ে যায়। কানুকাকার থেকে বাবা কত বড়, অথচ বাবার নিজের মা। আছে। কানুকাকার নেই। কিন্তু বাবা একদিন কানুকাকাকে মেরেছিল, তখন কানুকাকা চেঁচিয়ে কেঁদেছিল; ও মা, মা গো, তুমি আমায় কেন ফেলে রেখে গেলে!

–কানুকাকা, তোমার স্বর্গে যেতে ইচ্ছে করে না?

–এক থাপ্পড় খাবি এবার। কেন রে আমি এত তাড়াতাড়ি সেখানে যাবো?

–আমি একটু নামবো। আমার হিসি পেয়েছে।

–এই জন্য তোকে নিয়ে আসতে চাই নি!

পিকলু এগিয়ে যাচ্ছিল, তাকে ডেকে থামালো কানু। তারপর একটা গাছতলায় নেমে সিগারেট ধরালো। কয়েকটা টান দিয়ে সেটা পিকলুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, নে।

বাবলু বড় বড় চোখ করে দাদার দিকে তাকালো। পিকলু লজ্জিতভাবে ঘাড় নেড়ে বললো, না।

কানু বললো, নে না। এই ঠাণ্ডার মধ্যে ভালো লাগবে। এখন তুই কলেজে উঠেছিস, লজ্জা কী?

পিকলুর ফর্সা মুখোনি লাল হয়ে উঠেছে। প্রতুল নামে তার এক সহপাঠীর প্ররোচনায় এর মধ্যেই সে দু একবার সিগারেট টেনে দেখেছে, তার খারাপ লাগে নি। কিন্তু বাবলু জানে না। বাবলু নিঘাত মাকে বলে দেবে। সে কানুর কাছ থেকে সিগারেট নিল না।

পিকলু সামনের মেঘবর্ণ পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। কয়েকটা বক উড়ে যাচ্ছে পাহাড়ের বুক লক্ষ করে। দূর থেকে কয়েকজন আদিবাসী রমণী হেঁটে আসছে, মাথায় মাটির হাঁড়ি নিয়ে। একটা কুকুর ছুটছে তাদের সামনে সামনে। হঠাৎ সব কিছু মিলিয়ে পিকলুর দারুণ ভালো লাগলো। এ রকম ভালো লাগার মুহূর্তে তার বুকটা একটু ব্যথা ব্যথা করে। সে আপন মনে বলে উঠলো, সুন্দর তুমি এসেছিলে এই প্রাতে/অরুণ বরুণ পারিজাত লয়ে হাতে।

কানু জিজ্ঞেস করলো, পদ্যটা তুই নিজে বানালি?

পিকলু দু দিকে মাথা নাড়লো। কানুকাকাটা কিছু বোঝে না।

বাবলু বললো, দাদা সব সময় চয়নিকা বলে একটা পদ্যর বই পড়ে। এখানেও নিয়ে এসেছে। সেই বইটা।

পিকলু বললো, তোকেও তো, কতবার পড়তে বলি।

বাবলু বললো, এঃ! আমার ইস্কুলের পড়ার বই আছে, তার ওপরে আবার পদ্যর বই পড়বো কেন?

ওরা ত্রিকূট পাহাড়ের গোড়ায় এসে একটা ঝনা দেখতে পেয়ে খাবারদাবার খুলে বসেছে, তার একটু পরেই সেখানে একটি জিপ গাড়ি এসে থামলো। তার থেকে প্রথমে নামলেন, সত্যেন, তারপর তাঁর বাড়ির অন্য অনেকে।

পিকলুদের দেখতে পেয়ে সত্যেন এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আর সবাই কোথায়?

পিকলু বললো, আর কেউ আসে নি।

ওরা তিনজনে মিলে দুটি সাইকেলে চেপে এসেছে শুনে সত্যেন এতখানি ভুরু তুললেন যেন এটা একটা মহা বিস্ময়কর ব্যাপার। তিনি নিজের স্ত্রী ও বুলাকে ডেকে বললেন, শোনো, শোনো, পিকলুরা এতখানি রাস্তা সাইকেলে এসেছে! কম দূর নাকি?

বুলা প্রথমে ওদের দেখেও অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন, এবারে কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, পিকলু, তোমার মা আসেননি?

পিকলুর বদলে কানু উত্তর দিল, বৌদির জ্বর হয়েছে।

সত্যেন বললেন, তা হলে তো আর গাইডের দরকার নেই। তোমরা খানিকটা ওপরে যাবে তো ওদের সঙ্গেই ঘুরে এসো। আমি বাপু ওপরে উঠছি না!

বিভাবতী বললেন, এই তো এখান থেকেই বেশ পাহাড় দেখা যায়। আর ওপরে ওঠার দরকার কী!

ওঁদের সঙ্গে নীনা আর কাজরী নামে দুটি কিশোরী আর মলয় নামে পিকলুর বয়েসী একটি ছেলে রয়েছে, তারা প্রায় এক সঙ্গেই বলে উঠলো, না, না, আমরা ওপরে উঠবো, টপে যাবো!

দ্বিতীয় দলটির সঙ্গে অনেক ভালো ভালো খাবার আছে। জিলিপি, ডিম সেদ্ধ, লুচি-আলুর দম। সেই খাবারের ভাগ দেওয়া হলো পিকলুদের। কিছু খাবার টিফিন কেরিয়ারে সঙ্গে নেওয়া হলো, পাহাড়ের চূড়ায় বসে খাওয়া হবে।

বুলা পিকলুকে বললেন, আমি কিন্তু উপরে উঠতে চাই। আমাকে তোমরা নেবে তো?

পিকলু বললো, নিশ্চয়ই। আমি আপনার পাশে পাশে থাকবো।

কানু একটা ভোজালি এনেছে। সেটা দিয়ে সে একটা গাছের ডাল কেটে নিয়ে লাঠি বানালো। তারপর সেই লাঠি দিয়ে সামনের ঝোঁপঝাড়ের ওপর বাড়ি মারতে মারতে বললো, সবাই আমার পেছন পেছন চলে এসো।

বাবলু এই দ্বিতীয় দলটিকে গোড়া থেকেই অপছন্দ করেছে। তার সমবয়েসী কেউ নেই, সে জন্য তার সঙ্গে কেউ বিশেষ কথা বলছে না, আর মেয়েরা রয়েছে বলে ভালো করে পাহাড়ে চড়াও হবে না। নীনা আর কাজরী মাঝে মাঝেই কানে কানে কী সব বলছে আর হেসে গড়িয়ে পড়ছে যেন। ঐ রকম করলে কী পাহাড়ে ওঠা যায়! কাজরী তো একবার পড়েই যাচ্ছিল পা পিছলে, এমন জোর উঃ করে চেঁচিয়ে উঠলো যে সবাই ভাবলো বুঝি অ্যাকসিডেন্ট হয়ে গেছে। কানু খানিকটা নেমে এসে কাজরীর হাত চেপে ধরে বললো, তুমি আমার সঙ্গে থাকো। মলয়, তুমি হাত ধরে থাকো নীনার।

ওরা কোনো বাঁধা পথ ধরেনি, তাই এক একটা পাথর ডিঙিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে বেশ। বুলা কিন্তু এখনো বেশ সাবলীল, তাঁর কোনো সাহায্যের দরকার হয় না। একবার একটা উঁচু পাথরের সামনে তিনি থমকে দাঁড়ালে পিকলু তাঁকে ধরার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল। তিনি হেসে বললেন, না, না, আমায় ধরতে হবে না। আমি চটি দুটো এখানে খুলে রেখে যাই বরং।

চটি খোলার সময় বুলার কালো রঙের শায়া দেখতে পাওয়া গেল একটুখানি। তারপর তিনি। বড় পাথরটায় ওঠবার জন্য পা তুললেন, তাঁর ফর্সা পায়ের গোড়ালির ওপর আরও খানিকটা বেরিয়ে পড়লো, সে দিক থেকে চট করে চোখ ফিরিয়ে নিল পিকলু। তার মাথা ঝিম ঝিম করছে।

বুলার দিকে এমনিতেই ভালো করে তাকাতে পারে না পিকলু। বুলা প্রায় তার মায়ের বয়েসী কিন্তু বুলাকে মা বা মাসিদের মতন একটুও মনে হয় না তার। বুলাকে সে বুলা মাসি বলেও ডাকে না, পারতপক্ষে কিছুই ডাকে না। বুলা তার সঙ্গে সস্নেহ মিষ্টি ব্যবহার করেন কিন্তু পিকলুর বুকটা ছমছম করে।

বুলা ওপরের পাথরটায় উঠে এসে বললেন, বাব্বাঃ! হাঁপিয়ে গেছি, পিকলু একটু দাঁড়াও!

তারপর মুখ তুলে চারদিক দেখে বললেন, কী সুন্দর, না? দ্যাখো, নিচের দিকে দ্যাখো, আমরা অনেকটা উঠে এসেছি।

কানুরা আরও উঁচুতে উঠে গেছে, তাদের গলার আওয়াজে টের পাওয়া যাচ্ছে। কাজরীর হাসির আওয়াজটা অনেকটা টিয়া পাখির ডাকের মতন। পিকলু শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করলো, আপনি আর ওপরে উঠবেন?

বুলা বললেন, হ্যাঁ। এর মধ্যেই নামবো নাকি! এখানকার বাতাসে কী চমৎকার গন্ধ। জানো, পিকলু, এক জায়গায় দেখলুম কয়েকটা আমলকী গাছ। মাটিতে আমলকী পড়ে আছে। আমাদের দেশের বাড়িতে দুটো আমলকী গাছ ছিল।

আবার খানিকটা ওঠার পর বুলা দম নেবার জন্য পিকলুর কাঁধে হাত রাখলেন। পিকলুর দু কানের নিচের জায়গায় জ্বালা করতে লাগলো। শুধু তাই নয়, তার পুরুষাঙ্গ নড়াচড়া করতে শুরু করেছে। প্রথম যখন বুলা মাসি পাহাড়ে ওঠার কথা বললেন, তখনও এই রকম হয়েছিল। নীনা বা কাজরীকে দেখে তো এ রকম হয় না। পিকলু তখন মনে মনে চাইছিল বুলা মাসিই যেন তার সঙ্গে আসেন। এ রকম পরিপূর্ণ নারী সে আগে কখনো দেখেনি।

নিজের ওপর খুব রাগ হচ্ছে পিকলুর, খানিকটা ভয় ভয়ও করছে, যদি কেউ টের পেয়ে যায়, যদি বুলা মাসি বুঝতে পারেন যে পিকলুর মনটা খুব খারাপ। সে প্রায় ভূতগ্রস্তের মতন বিহ্বল মুখে বুলার দিকে তাকালো, বুলা অন্য দিকে চেয়ে আছেন, চোখাচোখি হলো না। পিকলুর ইচ্ছে করলো বুলা মাসিকে ছেড়ে দৌড়ে কোথাও চলে যেতে।

ওপর থেকে কানু ডাকলো, এই পিকলু, তোরা কোথায় গেলি রে? আমরা টপে উঠে এসেছি!

দূর থেকে মনে হয় একটিই পাহাড়, কিন্তু খানিকটা ওপরে এলে বোঝা যায় সমুদ্রের তরঙ্গের মতন, পাহাড়ের পর পাহাড়ের গুচ্ছ। একটা চূড়ায় উঠলেও দেখা যায় সামনে দেয়ালের মতন অন্য পাহাড় উঠে গেছে, আকাশ ছোঁয়া চূড়াগুলো অনেক দূরে।

বুলাকে নিয়ে পিকলু ওপরে উঠে আসা মাত্র কানু জিজ্ঞেস করলো, বাবলু কোথায়?

মলয় আর নীনা বললো, খানিকটা আগে দেখলাম দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছে!

তিনজন পুরুষ তিনজন নারীকে নিয়ে ব্যস্ত ছিল, বাবলুর কথা কেউ খেয়াল করেনি, বাবলু কারু সঙ্গে আসেওনি। কানু পিকলুকে বললো, আমি তো ভাবছি, বাবলু তোর সঙ্গেই আছে।

পিকলুও ভেবেছিল বাবলু আছে কানুকাকার সঙ্গে। তার সাঙ্ঘাতিক অপরাধ বোধ হলো। কী হবে? বাবলু যদি হারিয়ে যায়? যেরকম দুরন্ত ছেলে! সে চিৎকার করে ডেকে উঠলো, বাবলু! বাবলু!

সবাই মিলে এক সঙ্গে ডাকাডাকি করেও কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। দুশ্চিন্তায় বুলার মুখও শুকিয়ে গেছে। এত বড় পাহাড়ে বাবলুকে কোথায় খোঁজা হবে? পা পিছলে যদি কোনো খাদে পড়ে গিয়ে থাকে?

পিকলুর ক্ষীণ ধারণা, বাবলুটা দুষ্টুমি করে কাছেই কোথাও লুকিয়ে আছে, ইচ্ছে করে সাড়া দিচ্ছে না। সে এবারে চেঁচিয়ে বললো, বাবলু, আমরা ফিরে যাচ্ছি কিন্তু। সবাই চলে যাচ্ছি। এ পাহাড়ে ভাল্লুক আছে।

তাও কোনো সাড়া নেই।

কাজরী হঠাৎ আঙুল তুলে বললো, অই যে! ওখানে অই যে যাচ্ছে, কে? বাবলু না?

সেদিকে তাকিয়ে পিকলুর বুক হিম হয়ে গেল। পাশের পাহাড়টার গা বেয়ে বাঁদরের মতন, তরতর করে কেউ একজন উঠে যাচ্ছে। বাবলু বলে এমনিতে চেনার উপায় ছিল না, কিন্তু তার হলুদ সোয়েটারটা চকচক করছে রোদে।

সবাই এক সঙ্গে ডেকে উঠলো বাবলুর নাম ধরে। কিন্তু বাবলু এত দূরে আর উঁচুতে যে এই ডাক বোধ হয় সেখানে পৌঁছোবে না। এদের এত চিৎকারেও বাবলু একবারও পেছন ফিরে তাকালো না।

একটু পরে সে গাছপালার আড়ালে ঢাকা পড়ে গেল। সবাই অপেক্ষা করতে লাগলো ধ্বস্বাসে। বুলার চোখে জল ছল ছল করছে। এখান থেকে কারু পক্ষে দৌড়ে গিয়ে বাবলুকে ধরারও উপায় নেই।

এক সময় দেখা গেল, সেই দ্বিতীয় পাহাড়ের চূড়ায় একটা ছোট্ট স্প্রিংয়ের পুতুলের মতন বাবলু লাফাচ্ছে। বাবলু নিশ্চিত ওদের দেখতে পাচ্ছে না। সে নাচছে একা একা, মনের আনন্দে।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়