জেগে উঠে মানবেন্দ্র দেখলেন, অনেক বেলা হয়ে গেছে। কাল রাত্রে তিনি দরজা-জানলা কিছুই বন্ধ করেননি। রোদ লুটোচ্ছে ঘরের মধ্যে।

প্রথমেই তার মনে হল, যাক, ওরা চলে গেছে।

কিন্তু তিনি শুনতে পেলেন বাইরে শিশুদের কোলাহল। অন্য কোনও দল এসেছে। বিছানা ছেড়ে দরজার কাছে এসে দেখলেন, না, ওরাই। যাবার জন্য সেজেগুজে তৈরি, ভোর-ভোর বেরুতে পারেনি।

মানবেন্দ্র মুখ-হাত ধুয়ে দাড়ি কামিয়ে তৈরি হয়ে নিয়ে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। খুব খিদে পেয়েছে। সোজা এসে বসলেন খাবার ঘরের টেবিলে।

ওদের মালপত্র এনে রাখা হয়েছে বারান্দায়। পুরুষ তিন জনই গাড়ির কাছে। বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে বাগানে। মানসী ওদের কী যেন খাওয়াতে গিয়ে খুব ব্যতিব্যস্ত। দৌড়ে দৌড়ে পালাচ্ছে ওরা। এখান থেকে মানবেন্দ্র সব দেখতে পাচ্ছেন।

অনুরাধা বারান্দার একটা রেলিং ধরে তাকিয়ে আছে উদাসীন ভাবে দূরের দিকে। মানবেন্দ্র মানসীর দিকেই চোখ রেখেছেন। স্নান সেরে নিয়েছে মানসী, ভিজে চুল, আজ পরেছে একটা সাদা সিল্কের শাড়ি, মস্ত চওড়া কালো পাড়। আজ সকালে তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে। মানবেন্দ্র মনে মনে বললেন, এ পৃথিবীর নয়, অন্য কোনও গ্রহ থেকে বেড়াতে এসেছে।

মানসী নানা কাজে ব্যস্ত। ঘরের মধ্যে যাচ্ছে বার বার, কখনও বেতের বাস্কেটে কিছু ঢোকাচ্ছে কিংবা কিছু বার করছে তার থেকে। আবার ওরই মধ্যে ছেলে-মেয়েদের মুখে পুরে দিচ্ছে চামচে করে কোনও খাবার। এই ব্যস্ততাটুকই সৌন্দর্য।

মানবেন্দ্রর মনে হল, আজ সকালবেলা তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে, এই কথাটা, এই কথাটা মানসীকে এক্ষুনি বলা দরকার। চলে যাবার আগে মানসীকে এই কথাটা জানাতে না পারলে যেন মানবেন্দ্রর সারা জীবনটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে।

মানবেন্দ্র ভাবলেন, এক্ষুনি উঠে গিয়ে বলে আসব? যদি পরে আর সময় না পাওয়া যায়! অনুরাধা খুব কাছাকাছিই দাঁড়িয়ে। কী করে বলা যাবে কথাটা? অথচ বলতেই যে হবে। মানবেন্দ্র এমনই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন যে, তার শরীরে রোমাঞ্চ হতে লাগল। খাড়া হয়ে গেল হাতের লোম।

তিনি বিড় বিড় করে অসংখ্যবার বলতে লাগলেন ওই এক কথা এবং সর্বক্ষণ চোখ দিয়ে অনুসরণ করছেন মানসীকে।

একবার উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে। অন্যদের সামনেই বলে আসবেন কথাটা, তাতে যা হয় হোক। সেই সময়ই মানসী একটি বাচ্চার হাত ধরে এগিয়ে আসতে লাগল খাবার ঘরের দিকে। মানবেন্দ্রকে দেখে পরিচয়সূচক হাসি দিয়ে বেসিনের কল খুলল। বাচ্চাটার মুখ ধোওয়াবে।

মানবেন্দ্র ভাবলেন, আমি কি চিৎকার করে কথাটা ওকে জানাব? না, কাছে গিয়ে? শিশুটির সামনে? না, আলাদা? তিনি এক দৃষ্টে চেয়ে রইলেন মানসীর দিকে, যদি সে আবার তাকায়।

বাচ্চাটার মুখ ধোয়া হতেই এক ছুটে পালাল। মানবেন্দ্র এগিয়ে এলেন বেসিনের দিকে। মানসী একটা বাটি আর তিনটে চামচ ধুচ্ছে।

মানবেন্দ্রকে দেখে মুখ তুলে মানসী বলল, আপনি হাত ধোবেন? আমার এক্ষুনি হয়ে যাবে।

মানবেন্দ্র ভূতগ্রস্ত মানুষের মতো মানসীর দিকে চেয়ে থেকে বললেন, আজ সকালে—

 পুরো কথাটা বলা হল না। দরজার কাছ থেকে অনুরাধা বলল, এই ফ্লাস্কে গরম জল নিয়েছিস?

গভীর দুঃখে মানবেন্দ্রর মুখটা কুঁচকে গেল। দুই নারীর পরস্পরের কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। যদি অনুরাধা চলে যায়, মানসী থাকে। যদি এক মিনিটের জন্যও তাকে একা পাওয়া যায়। একটা তো মাত্র বাক্য।

কিন্তু অনুরাধা গেল না। তার পাশে আবার হিরম্ময় এসে দাঁড়াল। তারপর অনুরাধার উদ্দেশে বলল, আপনাদের বেরুতে তো অনেক দেরি হয়ে গেল।

অনুরাধা বলল, গাড়িটা কী যেন গোলমাল করছে। আমরা তো সব তৈরি।

কথা বলতে বলতে ওরাও এসে ঢুকল খাবার ঘরে। মানবেন্দ্র তখনও মানসীর পাশে দাঁড়ানো। একটু সঙ্কুচিত বোধ করলেন। হিরন্ময় সিগারেট বাড়িয়ে দিতেই সেটা নেবার ছলে তিনি একটু সরে গেলেন দূরে। আর একবার কাতর দৃষ্টিপাত করলেন মানসীর মুখে, যে-মুখ আজ সকালবেলা অনেক বেশি সুন্দর।

কয়েকটা সামান্য কথা বলে মানবেন্দ্র চলে এলেন নিজের ঘরে। মুখে রীতিমতো রাগী ভাব। এ পৃথিবীটা আমার ইচ্ছে মতো চলছে না। আমি কেন মানসীকে ঠিক সময়ে ঠিক কথাটা বলতে পারলাম না?

ওরা যে-কোনও সময়ে চলে যাবে। প্রবাসে দুদিনের জন্য দেখা, যাবার সময় কিছু ভদ্রতা বিনিময় ছাড়া আর তো কিছু করণীয় নেই।

হুটোপুটি করতে করতে দুটো বাচ্চা ঢুকে পড়ল ঘরে। মানবেন্দ্রকে অগ্রাহ্য করেই তারা খাটের চারপাশে দৌড়দৌড়ি করে আবার বেরিয়ে গেল।

মানবেন্দ্র ডাকলেন, রিনি, একটু শোন।

খেলা ছেড়ে রিনি এখন কথা শুনতে আসবে না। সাড়া না দিয়ে সে চলে গেল অন্য দিকে।

 মানবেন্দ্র উঠে গিয়ে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে চন্দ্রমল্লিকা ফুলটিকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছ?

 ফুলটি বলল, তুমি তো আমার কথা ভুলেই গেছ।

 মানবেন্দ্র দেখলেন, ফুলটার ওপর একটা কাগজের টুকরো পড়ে আছে। কাল রাত্তিরে তিনি প্যাডের পাতাটা কুচিকুচি করে জানালা দিয়ে ফেলেছিলেন, তার একটা টুকরো।

মানবেন্দ্র টুকরোটা তুলে নিয়ে দেখলেন, তাতে লেখা আছে সর্বনাশের। তার হাসি পেল। আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়–এই লাইনটা তা হলে ফুলটির ক্ষেত্রেই সত্য।

তিনি দাড়ি কামাবার ব্লেডটা এনে অনেকখানি বোঁটাসুদ্ধ ফুলটাকে কুচ করে কেটে নিলেন। তারপর বললেন, তোমাকে আমি মানসীর হাতে তুলে দেব।

ফুলটা বলল, তুমি আমাকে মেরে ফেললে?

মানবেন্দ্র বললেন, সব সুন্দরের সঙ্গেই কিছু কিছু নিষ্ঠুরতা থাকে। তুমি তো তাজমহল কিংবা খাজুরাহো মন্দিরের সৃষ্টির ইতিহাস পড়োনি!

পেছন ফিরেই মানবেন্দ্র দেখলেন, দরজার কাছে মানসী। মানবেন্দ্রর বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ শব্দ হতে লাগল, ফুল সমেত হাতটা কেঁপে গেল।

মানসী বললেন, ইস, ফুলটা ছিঁড়ে ফেললেন?

অন্যায় করে ধরা পড়ে যাওয়া শিশুর মতো মানবেন্দ্র লজ্জা পেলেন প্রথমটায়। তারপর হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, তোমার জন্য।

মানসী বলল, এত বড় একটা ফুল নিয়ে আমি কী করব?

 কিছু না! ফুল দিয়ে আবার কেউ কিছু করে নাকি?

মানসী এক পা ঢুকে এল ঘরের মধ্যে। মানবেন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, যাবার সময় হয়ে গেছে?

কী জানি! গাড়িটা বোধহয় গোলমাল করছে।

মানসী ফুলটা হাতে নিয়ে মুখের কাছে নিয়ে এল। মানবেন্দ্র দেখতে পেলেন, মানসীর হাতে গিয়ে ফুলটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মানসী ফুলটা টেবিলের ওপর রাখার পর তিনি সে-দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন।

আপনি আমাকে তখন কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন?

 এমন কিছু নয়।

বলতে বলতে থেমে গেলেন কেন?

এমনিই।

মানবেন্দ্র সেই কথাটা বলতে এখনও দ্বিধা করলেন, কারণ আবার যদি বাধা পড়ে? যদি সম্পূর্ণ বাক্যটা শেষ করা না যায়!

আপনার ধরনধারণ কীরকম যেন অদ্ভুত!

আজ সকালবেলা তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে!

 কী?

মানবেন্দ্র এমন বিচলিত ভাবে তাড়াতাড়ি কথাটা বললেন যে, সত্যিই সবটা বোঝা যায়নি। কিন্তু এক কথা দ্বিতীয় বার বলা আরও কঠিন। মানসী এখন বুঝতে না পারলেও পরে ঠিকই পারবে।

মানসী কিন্তু চা বাগানে যাবার জন্য মানবেন্দ্রকে একবারও বলেনি। মানবেন্দ্র প্রতি মুহূর্তে আশা করছিলেন। এবার বুঝে গেলেন, ও বলবে না। এটাই ওর কায়দা।

মানসী জিজ্ঞেস করল, এখান থেকে ফিরে গিয়ে নতুন কী লিখবেন?

কী জানি!

আপনার লেখা যখন পড়ি–।

লেখার কথা থাক।

আপনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আপনার লেখার কথা মনে পড়েই।

মানসী, আর বেশি সময় নেই। সংক্ষেপে দু-একটা কথা আমাকে বলতে দাও! লেখক হিসেবে আমার ব্যর্থতা আমি জানি। যা লিখতে চাই, তার কিছুই লিখতে পারিনি। আমার একটিও লেখা পুরোপুরি সার্থক হয়ে ওঠেনি। এই ব্যর্থতা আমাকে সাঙ্ঘাতিক কষ্ট দেয়। আমি আস্তে আস্তে বোধহয় অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছি। আমি কিছুতেই আর সব দিক সামলে চলতে পারি না। তুমি আমাকে একটু সাহায্য করবে?

কী সাহায্য?

 তুমি আমাকে বাঁচাবে?

মানসী এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল মানবেন্দ্রর চোখের দিকে। মানবেন্দ্র দেখলেন একটা বিশাল জলাশয়। কুচকুচে কালো রঙের জল। তার মাঝখান দিয়ে একটা ধপধপে রাজহাঁস সোজা এগিয়ে আসছে, চিরে যাচ্ছে জল। এই দৃশ্যটা মানবেন্দ্রকে এমনই মুগ্ধ করল যে, তিনি কয়েক মুহূর্তের জন্য ভুলে গেলেন মানসীর কথা।

মানসী বলল, এসব আপনি কী বলছেন?

আমি তোমার কাছে অসম্ভব ঋণী।

তার মানে? আমি কী করেছি?

 তুমি যে তুমিই, সেটাই তোমার ঋণ।

এ তো রবীন্দ্রনাথের কবিতা।

হ্যাঁ। কদিন ধরে রবীন্দ্রনাথের ভূত আমার ঘাড়ে চেপে বসেছে, আমার চিন্তাগুলো বেরিয়ে আসছে ওঁর ভাষায়।

রবীন্দ্রনাথের ভূত আবার কী? ছিঃ, এ-রকম ভাবে বলতে নেই।

ওটা আদরের কথা। রাগের নয়। থাক, শুধু শুধু দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি তোমার সাহায্য চাই। আমি তোমাকে–।

আমি কিছুই মানে বুঝতে পারছি না আপনার কথার।

তুমি এত সুন্দর, তোমাকে আমার দারুণ প্রয়োজন। আমি তোমাকে চাই—

একথা অন্য কেউ বললে –।

তুমি তাকে খুব খারাপ লোক ভাবতে!

না, তা নয়। অন্য কেউ বললে, তাকে উত্তর দেওয়া সহজ হত। কিন্তু আপনাকে উত্তর দেওয়া কঠিন।

মানসী পেছন ফিরে বাইরের দিকে একবার তাকাল। যেন সে দেখে নিল সংসারটা। তারপর বলল, আপনি আমাকে ভুল চোখে দেখেছেন। আপনাকে সাহায্য করার কোনও ক্ষমতা নেই আমার।

আছে।

আমি তো নিজে জানি, আমি কত সাধারণ।

তোমার জন্য একটা বেদি তৈরি করে দেব। তুমি তার ওপরে উঠে দাঁড়ালেই অসাধারণ হয়ে যাবে।

এ-সব কথা কবিতার মত, বাস্তব জীবনের নয়।

জীবনটা তো ইচ্ছে মতো তৈরি করে নেওয়া যায়।

আমি কি ইচ্ছে মতো সব কিছু করতে পারি? মেয়েরা পারে?

মানবেন্দ্ৰ অধীর হয়ে উঠলেন। কথাবার্তা অন্য দিকে চলে যাচ্ছে। আর তো বেশি সময় নেই।

মানবেন্দ্র নিজের বুকের ওপর হাত রেখে বললেন, তোমাকে দেখলেই আমার বুকের মধ্যে দুপ দুপ শব্দ হয়। আমার সারা শরীর কাঁপে কেন? তুমি এর উত্তর দাও? এ-রকম তো আর কখনও হয়নি?

 মানসীর মুখে একটা দুঃখের রেখা ফুটে উঠল। মানবেন্দ্র সেটা লক্ষ্য করে তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, আমি কিন্তু তোমাকে মিথ্যে কথা বলছি না। তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে, একথা আমি অন্য কোনও মেয়েকে কখনও বলিনি।

মানসী বলল, আপনি আমাকে বিপদ ফেলে দিচ্ছেন। আমার নিজেরই অনেক সমস্যা আছে, ভেবেছিলাম আপনার কাছ থেকে সাহায্য চাইব।

তোমার কোনও বিষাদ নেই। তোমার কোনও সমস্যা নেই।

আমি কি রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ নই?

ছিলে এক সময়। এখন তার চেয়েও উঁচুতে।

আমার ভয় করছে এ-সব কথা শুনে। আমি চলে যাচ্ছি।

 দাঁড়াও।

মানসীর মুখে লালচে রঙ ধরেছে। সেখানে মিশে আছে খানিকটা লজ্জা ও কাতরতা। অসহায় ভাবে বলল, আপনাকে আমার ভাল লাগে। কিন্তু আপনাকে যে সাহায্য করতে পারবে, আমি সে নই।

তুমিই।

আপনি আমাকে ভুল ভেবেছেন।

তুমি একটি বিবাহিতা মেয়ে, তোমাকে এ-রকম কথা বলা হয়তো অন্যায় মনে হতে পারে। তুমি কি অপমানিত বোধ করছ আমার কথায়?

না, আমি সে-সব কিছু ভাবছি না। আসলে আমার মনের মধ্যে– ।

লোকে যাকে বলে অবৈধ প্রেম, আমি তোমার কাছে ঠিক তা চাই না। তাছাড়া আমাকে প্রেমিক হিসেবে একদম মানায় না, আমি চাই পূজারি হতে। তুমিই একমাত্র আমাকে সুস্থতা দিতে পার। বিশ্বাস করো, আমি তোমাকে অপমান করতে চাইনি কোনও রকম ভাবে।

না, আমি জানি। তাছাড়া অনেক দেরি হয়ে গেছে।

দেরি হয়নি, এই তো সময়।

আপনাকে আমি বোঝাতে পারব না। আমি ভেবেছিলাম, একটা ব্যাপারেই আমি আপনার কাছে সাহায্য চাইব। কিন্তু তা আর হবে না। আমি খুব অসহায়। আমি যাই?

সেই সময় রিনি দরজার কাছে এসে লাফাতে লাফাতে বলতে লাগল, আমাদের আজ যাওয়া হবে, আমাদের আজ যাওয়া হবে না!

মানসী ঘুরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন?

 রিনি আনন্দের সঙ্গে বলল, গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে।

মানবেন্দ্রর সঙ্গে আর একটাও কথা না বলে মানসী মেয়ের হাত ধরে চলে গেল। ফুলটা সে নেয়নি।

এরপর ঘটনা বদলে গেল। সত্যিই ওদের সেদিন যাওয়া হবে না। গাড়িটাতে বেশ গোলমাল দেখা দিয়েছে। গাড়ির মিস্ত্রি এসে বলেছে, ইঞ্জিন নামাতে হবে, সারা দিনের কাজ।

মানবেন্দ্র কিন্তু এটা একটুও পছন্দ করলেন না। তার নিজের সুবিধের জন্য পুরো দলটিকেই এক দিন আটকে রাখতে তো তিনি চাননি। এরকম অবিবেচক তিনি নন। তাছাড়া, শিল্পের দিক থেকে এ রকম ব্যাপারের যুক্তি নেই। শিল্পের মানসীরা সাধারণত এই সময় ঠিকই চলে যায়। বিচ্ছেদই এই ধরনের ঘটনার নিয়তি। মানবেন্দ্রও ধরে নিয়েছিলেন মানসী চলে যাবে। গাড়ি খারাপ হওয়াটা একটা অত্যন্ত স্থূল ব্যাপার।

হিরন্ময়কে সে-দিন ফিরতেই হবে। সে যাবে ট্রেনে। মাইল সাতেক দূরে রেল স্টেশন। ওরা সবাই গেল হিরন্ময়কে স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসতে। গৌতম একা রইল গাড়ির তদারকিতে।

একটু বাদেই টুরিস্ট লজে আরও দুটি গাড়ি-ভর্তি লোকজন এসে হাজির। এক গাড়িতে বাঙালি। রীতিমতো একটা সোরগোল পড়ে গেল। ঘরের মধ্যে শুয়ে শুয়ে শান্তিতে বই পড়া অসম্ভব। মানবেন্দ্র বেরিয়ে পড়লেন। মন্দিরটা দেখা হয়নি, এইবেলা সেরে ফেলা যাক।

মন্দিরের কাছে গোটা দু-এক হোটেল আছে। অনেক লোকজনের ভিড় তাজা রোদ উঠেছে বলে, দিনটা বেশ আরামদায়ক। মানবেন্দ্র চত্বরে ঘুরতে লাগলেন নিজের খেয়ালে। একটা কথা বার বার তার মনে ঝিলিক দিতে লাগল। কয়েকটা ডিনামাইট এনে মন্দিরটা একেবারে উড়িয়ে দিলে কেমন হয়? প্রচণ্ড শব্দে সব কিছু হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে, আঃ, কী চমৎকার দৃশ্য। যে-কারণে মানবেন্দ্র একবার লাইব্রেরিতে আগুন লাগাতে চেয়েছিলেন, সেই কারণে তিনি এই মন্দিরটাকে ধ্বংস করতে চাইছেন। তিনি যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন বড় বড় পাথরের টুকরে ছিটকে যাচ্ছে চারদিকে।

মন্দিরের দেয়ালে দেয়ালে শারীরিক আনন্দের প্রদর্শনী। নারী ও পুরুষ পরস্পরকে ভোগ করছে। কয়েকটা মূর্তি দেখার পরই মানবেন্দ্র শরীরে বেশ যৌন উত্তেজনা বোধ করলেন। যাক, তাহলে আর সন্দেহ নেই যে এগুলি শিল্প। নগ্ন নারীর চিত্র দেখলেও যদি মনে মহৎ ভাব জাগে, তাহলেই সেগুলো শিল্প হবে-এ-কথা বলত আগেকার সমালোচকরা। যত সব গাঁজাখুরি কথা। নগ্ন মূর্তি দেখে যার উত্তেজনা হয় না, সে তো শিল্পের কিছু বোঝেইনা। তাকে নপুংসকই বলতে হবে। র‍দ্যাঁ যেমন ছিলেন এক জন নীতিহীন দৈত্য, তাই সৃষ্টি করতে পেরেছেন।

মন্দিরের গায়ে কেন এই সম্ভোগ চিত্র? উত্তরের জন্য সমালোচকরা মাথা খুঁড়ে মরুক। আমার দেখতে ভাল লাগছে, সেটাই যথেষ্ট। এটা শুধু একটা মন্দির হলে আমি দেখতে আসতাম না। মন্দিরের ভেতরে কাল্পনিক মূর্তি, বাইরে নারী-পুরুষের শরীরে পূজা। ব্যাপারটা বেশ মজার।

মন্দিরের চত্বরে প্রচুর মানুষজনের মধ্যে দুটো গাধাও চড়ে বেড়াচ্ছে অনাবশ্যক ভাবে। সে দুটিকে দেখে মানবেন্দ্র বেশ কৌতুক বোধ করলেন। ওদের এখানে কে পাঠিয়েছে? সেই যে পৃথিবীতে কোথাও একটা কার্যকারণের হেড অফিস আছে, সেখান থেকেই নাকি? হতেও পারে। কেননা, কোনও কোনও সন্ন্যাসী শরীরের তুলনা দিয়েছেন গাধার সঙ্গে। শরীরটা একটা গাধা!

মানবেন্দ্র একটা গাধার গায়ে হাত রাখলেন। নিরীহ প্রাণীটি সেই জায়গার চামড়াটা বার বার কোঁচকায়।

মানবেন্দ্র বললেন, ওহে, অ্যাসিসিতে ফ্রান্সিস বলে এক জন সাহেব সাধু ছিল। সে তোমাদের খুব সম্মান করেছে। জানো না বোধহয়! আর এক জন নোবেল প্রাইজ পাওয়া কবি, হিমেনেথ, কবিতা লিখেছেন তোমাদের এক জনকে নিয়ে। সুতরাং তোমাদের দিকেও লোক আছে।

একটা গাধা হঠাৎ এমন ভাবে ডেকে উঠল যে, মানবেন্দ্র চমকে তিন পা পিছিয়ে গেলেন। কাছাকাছি কয়েকটা বাচ্চা ছেলে হেসে উঠল। মানবেন্দ্র গাধা দুটির উদ্দেশ্যে বললেন, আমি কিন্তু তোমাদের দিকে নই। আমি ওই মন্দিরের দেয়ালের দিকে।

গাধাটাকে ছোঁয়ার জন্য হাতটা একুট নোংরা-নোংরা লাগছে। অদূরে বটগাছের তলায় একটা জলের কল। মানবেন্দ্র সেখানে এলেন হাত ধুতে। পাশেই কাঠের বেঞ্চে বসে আছে এক জোড়া বিদেশি। পুরুষটি প্রায় সত্যজিৎ রায়ের মতো দীর্ঘকায় এবং সুদর্শন। এই শীতের মধ্যেও মেয়েটি পরে আছে মিনি স্কার্ট; সে সুন্দরী নয়, কিন্তু তার স্বাস্থ্য এমনই চমৎকার যে শরীর থেকে একটা শোভা বিচ্ছুরিত হচ্ছে।

মানবেন্দ্র তিনবার তাকালেন মেমটির দিকে। তারপর মনে মনে বললেন, অ্যাসিসির সন্ত ফ্রান্সিস কি এই রকম একটা শরীরকেও গাধা বলতে চেয়েছিলেন। সন্তফ্রান্সিস, আপনি হেরে গেছেন। যেমন হেরে গেছেন যিশু ও গৌতম বুদ্ধ। পৃথিবীটা ওঁদের মত অনুযায়ী চলেনি। খ্রিস্টান আর বৌদ্ধরা মাঝে মাঝে পৃথিবী জুড়ে কী মারপিটই না শুরু করে।

ভারতীয় গাইডটি সাহেব-মেমের জন্য একটা ম্যাপ-বই জোগাড় করে আনতে গিয়েছিল। অবিলম্বে সে হতদন্ত হয়ে ফিরে এল, এবং গদ গদ কণ্ঠে নানা কথা বলতে লাগল। তার ভাঙা ইংরেজি থেকে মানবেন্দ্র এইটুকু সংগ্রহ করতে পারলেন যে, ওই দীর্ঘকায় পুরুষটি হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক। নিঃসন্দেহে এক জন জ্ঞানী লোক। তার সঙ্গে ওই মেয়েটি কে? এই ধরনের মেয়েদের মার্কিন ইংরেজিতে বলে ডল। সত্যি, রক্তমাংসের একটি চিত্তহারী জ্যান্ত খেলনা।

অত বড় এক জন পণ্ডিতও একটি সুন্দর খেলনা নিয়ে এত দূর বেড়াতে এসেছেন। আর মানবেন্দ্র তার অসুস্থতার চিকিৎসার জন্যও মানসীকে পেতে পারেন না?

ডাকবাংলোতে ফিরতে মানবেন্দ্রর বেশ দেরি হল। ততক্ষণে মানসী-অসীমরা ফিরে এসেছে, খাওয়া-দাওয়াও হয়ে গেছে। বিছানায় শুয়ে, সকালবেলা মানসীকে তিনি যা যা বলেছিলেন, তার প্রত্যেকটি কথা আবার উচ্চারণ করতে লাগলেন, যাচাই করে দেখছেন, তার কোনও ভুল হয়েছে কি না। ভুল বা ঠিক যাই হোক, সব ব্যাপারটাই স্বতঃস্ফূর্ত। এ ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না।

মানসী কি আবার তার সঙ্গে দেখা করতে আসবে? একা? মানসীর উত্তরগুলো ঠিক যেন বোঝা যায়না।

তার চোখ জুড়ে ভেসে উঠল মানসীর মুখ। এই মেয়েটির দৃষ্টিতে এমন কিছু আছে, যা মানবেন্দ্র কিছুতেই ঠিক অনুধাবন করতে পারছেন না। ও যেন কিছু বলতে চায়। মানসী বলেছিল, ওরও কিছু গোপন কথা আছে। গোপন কথা মানে কি দুঃখ?

মানসী, আমি তোমাকে দেবতার আসনে বসাব। তোমাকে পুজো করতে না পারলে আমার নিস্তার নেই। আমি কোনও দিন কোনও ঠাকুর-দেবতার পায়ে ফুল দিইনি। তোমার পায়ের পাতায় আমি চুম্বন দেব। তোমাকেই, শুধু তোমাকে, আর কারুকে নয়। তুমি তো সেই জন্যই এসেছ। নইলে হঠাৎ এই সময়, কলকাতা ছেড়ে এত দূরে এই মন্দিরে দেখতে আসার মানে কী? ঘটনাটি এই নয় যে, আমি ডাকবাংলোতে হঠাৎ একটি মেয়েকে দেখে আকৃষ্ট হয়েছি। আমাকে যে আকর্ষণ করবে, সেই রকম একটি মেয়েই ঠিক এই সময়ে এসেছে। তোমার স্বামী আছে, দুটি সন্তান আছে, তাতে কোনও ক্ষতি নেই। তোমাকে যথেষ্ট দিলেও তোমার কিছুই কমবে না এক তিলও। কোনও রকম মালিন্য ছুঁতে পারে না তোমাকে।

একটি মেয়েকে পুজো করা আবার কী ব্যাপার? যে কেউ শুনলেই বলবে পাগলামি। হ্যাঁ তাই। বৃহত্তর পাগলামি থেকে বাঁচবার জন্য এই সব ছোটখাটো পাগলামি আমার দরকার। আমি এই রকম ধাতুতে গড়া।

বিকেলবেলা মানবেন্দ্র ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলেন, মানসী-অনুরাধারা সবাই একটা সিনেমায় যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। শহরের মধ্যে বাজারের কাছে একটি রিকেটি চেহারার সিনেমা হল আছে, সেখানে বহুকালের পুরনো হিন্দি ছবি দেখানো হয়। সেই ছবি দেখার জন্য ওদের উৎসাহ। মধ্যবিত্ত বাঙালিদের সাংস্কৃতিক জীবনটা বড্ড গোলমেলে। যারা রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখে, তারাও হিন্দি সিনেমা দেখে নিয়মিত। অবশ্য, বাইরে বেড়াতে এসে যে-কোনও একটা সিনেমা দেখার উৎসাহ অন্য রকম।

মানবেন্দ্র চেষ্টা করলেন মানসীর চোখে চোখ ফেলতে। তুমি কি আমাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছ? না, সেটা সম্ভব নয়, পৃথিবীর শেষ প্রান্তেও আমি তোমাকে তাড়া করে যাব। সব মানুষই বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। আমাকেও বাঁচতে হবে তো!

মানবেন্দ্র কাছাকাছি এসে পড়ার পর মানসী লঘু গলায় জিজ্ঞেস করল, আপনিও যাবেন আমাদের সঙ্গে?

মানবেন্দ্র মাথা নেড়ে বললেন, না!

অসীম বলল, যাঃ, ওনাকে কী এই সব আজেবাজে সিনেমা দেখতে বলছ! আমরা যাচ্ছি নেহাত তোমাদের পাল্লায় পড়ে।

অনুরাধা বলল, মোটেই বাজে না। এটা দিলীপকুমারের প্রথম ছবি!

ওদের আগেই মানবেন্দ্র বেরিয়ে এলেন টুরিস্ট লজ থেকে। মুখে অস্বস্তির চিহ্ন। মানসীকে না বলার পর মানবেন্দ্রর একবার মনে হয়েছিল, রাজি হলে ক্ষতি ছিল কী! কত আজেবাজে লোকের সঙ্গে মিশতে হয়। কত বিরক্তিকর সভা-সমিতিতে বসে থাকতে হয়, কিন্তু সেই তুলনায় ঘণ্টা তিনেক যে-কোনও একটা সিনেমা দেখলে এমন কী ক্ষতি ছিল! এমনকী, তিনি হয়তো মানসীর পাশে বসার সুযোগ পেলেও পেয়ে যেতে পারতেন। পাশে না বসলেও কাছাকাছি তো। মানসীর শরীরে সুগন্ধ, তার মুখের পার্শ্বচিত্র—এ-ও তো অনেকখানি পাওয়া।

তবু মানবেন্দ্র একটুখানি চিন্তা না করেই না বলেছিলেন মানসীকে। এ-রকম তার স্বভাব। কোনও একটি জিনিস পাওয়ার চেয়ে না পাওয়ার দিকেই যেন তার ঝোঁক বেশি। প্রথম জীবনে, যখন তার চাকরি পাওয়ার খুব দরকার ছিল, ঘুরতে হয়েছিল অনেক দরজায় তখনও এমন হয়েছে, কোনও এক জন বিশিষ্ট লোকের বাড়িতে গেলে চাকরির সুরাহা হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা, তবু মানবেন্দ্র সেই লোকটির বাড়ির কাছে এসেও ফিরে গেছেন। অন্য লোকের সঙ্গে এলে, সেই বাড়ির দরজায় আঘাত দেবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত ভেবেছেন, উনি যেন এখন বাড়িতে না থাকেন!

সত্যিই বাড়িতে না থাকলে মানবেন্দ্র ভেবেছেন, যাক বাঁচা গেল! পরক্ষণেই দুঃখ হয়েছে, ইস, এবারেও চাকরিটা হল না।

নারীদের ক্ষেত্রেও হয়েছে এ-রকম। প্রথম যে-মেয়েটির জন্য পাগল হয়েছিলেন মানবেন্দ্র, সেই শ্রাবন্তীকেও তিনি প্রায় স্বেচ্ছায় চলে যেতে দিলেন হিরন্ময়ের কাছে। শ্রাবন্তীকে অসম্ভব ভালবাসতেন অল্পবয়েসি যুবক মানবেন্দ্র, কিন্তু যখন তিনি দেখছিলেন হিবণ্ময় আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে শ্রাবন্তীর দিকে, তখনও তিনি বাধা দেননি। অথচ একটিমাত্র কথা বললেই হত। হিরন্ময় খুব ভদ্র, সে কখনও জোর করত না। আর, শ্রাবন্তীকে শুধু বুঝিয়ে দেওয়া দরকার ছিল, মানবেন্দ্র তাকে কতখানি চান। প্রত্যেক দিন এ-জন্য মানবেন্দ্র নিজেকে তৈরি করে রাখতেন আগে থেকেই। অথচ শ্রাবন্তীর বাড়ির কাছে এসে ভেবেছেন, আজ না, কাল বলব। তারপর এক দিন যখন চৌরঙ্গিতে চায়ের দোকানে শ্রাবন্তী জানাল, আমি হিরন্ময়কে বিয়ে করছি, জানি না, ভুল করছি কি না, তখন মানবেন্দ্র নিশ্চিত বোধ করেছিলেন। যাক, সময় পেরিয়ে গেছে। আর কিছু বলতে হবে না।

পরবর্তী কালে অন্তত দুখানি উপন্যাস ও পনেরোটি কবিতায় তিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রকাশ করেছেন শ্রাবন্তীকের না-পাওয়ার বেদনা।

মানবেন্দ্র অস্ফুটভাবে বললেন, মানসী, তুমি আমাকে ময়নাগুড়ির চা বাগানে যাবার জন্য নেমন্তন্ন করোনি, আজ শুধু একটা সিনেমায় যাবার জন্য বললে! আমি এত সহজে ভুলি না।

মানবেন্দ্র হাঁটতে হাঁটতে এসে সেই উঁচু পাথরটায় বসলেন। নিচে ঢালু জমিতে সেই বস্তি। কনকনে হাওয়া দিচ্ছে আজ। শালটা ভাল করে মুড়ি দিয়ে বসলেও শীত কমে না। এই শীতের মধ্যে একা বাইরে বসে থাকা উপভোগ্য নয়। তবু মানবেন্দ্র উঠে গেলেন না।

মুনিয়ার মা কিংবা মুনিয়াকে দেখা যাচ্ছে না। কালকে রাত্তিরে ঘোরের মাথায় মানবেন্দ্র ওই বস্তিতে নেমে যাচ্ছিলেন আর একটু হলে। একটা বিশ্রী ব্যাপার হত। কেউ বুঝতে পারত না আসল ব্যাপারটা। বোঝারও তো কিছু নেই।

আজ আকাশ, প্রান্তর, দিগন্ত বা সূর্যাস্ত –কোনওদিকেই তার চোখ যাচ্ছে না। ক্ষুধার্ত লোক যেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে না, সেই রকম মানবেন্দ্রও শুধু মানসীর কথা চিন্তা করছেন। এই অবৈধ চিন্তাটিতে তিনি রীতিমতো উত্তেজনা বোধ করছেন, শরীরটা একেবারে সৈনিকের মতো সুস্থ।

কিন্তু এরই মধ্যে এক সময় তিনি মানসীর মুখটা ভুলে গেলেন। খুব চেষ্টা করেও মনে করতে পারছেন না। অন্যান্য পরিচিত মেয়েদের মুখ এসে ভিড় করছে। দীপা, শ্রাবন্তী, নন্দিনী, রেণু, মনীষা–এমনকী খুব অল্প অল্প চেনা যেসব মেয়ে, যেমন দীপ্তি, সান্ত্বনা –আর মানসী, যাকে তিনি একটু আগেও দেখেছেন, তার মুখটাই মনে পড়ে না! এ কীরকম?

মানবেন্দ্র মাথার চুল চেপে ধরলেন। নিজেকে প্রচণ্ড কিছু শাস্তি দেওয়া দরকার। এই পাথরের ওপর থেকে নিচের বস্তিটার দিকে লাফিয়ে পড়লে কেমন হয়? উল্লুক, শেষ করে দেব তোমাকে। দাও, মানসীকে ফিরিয়ে দাও, এক্ষুনি!

মানসীর গলার আওয়াজ, হাঁটার ভঙ্গি সবই স্মরণ আছে। শুধু তিনি ওর মুখটা দেখতে পাচ্ছেন না। সব চেয়ে বেশি করে যাকে চাই, না-পাওয়া তাকেই জড়িয়ে থাকে। মানুষ যা মনে রাখতে চায় না, শুধু সেটাই নাকি ভুলে যায়। আমি মানসীকে মনে রাখতে চাই না?

অসম্ভব রাগী মানুষের মতো মানবেন্দ্র নিজের স্মৃতিকে বললেন, আমি তোমাকে দশ পর্যন্ত গোনার সময় দিলাম।

চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গুনতে লাগলেন, এক, দুই, তিন –।

দশ গোনার পরেও মানসীর মুখচ্ছবি ফিরে এল না।

মানবেন্দ্র পাথরটার ওপর দাঁড়িয়ে উঠে নিচের দিকে এক লাফ দিলেন।

ধুতি পরে না থাকলে ওই সময়েই তার মৃত্যু ঘটা বিচিত্র কিছু ছিল না। কিন্তু ধুতিতে পা জড়িয়ে যাওয়ায় লম্ফটি বিশেষ সুবিধের হয়নি। তবু নিচে পড়ে মানবেন্দ্র বেশ খানিকটা গড়িয়ে গেলেন। হ্যাঁচোড়-প্যাচোড় করে কোনও রকমে সামলে নিলেন নিজেকে।

ডান পায়ের হাঁটুর কাছে অনেকখানি কেটে গেছে। রক্তে ভিজে যাচ্ছে ধুতি। তবু মানবেন্দ্র প্রথমেই চারদিকটা একবার দেখে নিলেন। অন্য কেউ দেখে ফেলেনি তো! দেখলে ব্যাপারটা হাস্যকর হত। তারা ভাবত, এক জন জলজ্যান্ত পূর্ণ বয়স্ক লোক পাথর থেকে আপনা আপনি পড়ে গেছে।

খানিকটা ঘাস ছিঁড়ে থেঁতো করে তিনি সেই কাটা জায়গাটায় লাগালেন। জায়গাটায় বেশ জ্বালা জ্বালা করছে। শরীরে এ-রকম কোথাও কেটে গেলে তখনই আবার নতুন করে বোঝা যায়, শরীরটা কত প্রিয়। হাঁটতে গিয়ে তাকে একটু একটু খোঁড়াতে হল। আর কোথাও মচকে-টচকে যায়নি তো!

এই সময় মানবেন্দ্র দেখলেন, বস্তির দিক থেকে মুনিয়া উঠে আসছে ওপরের দিকে। মানবেন্দ্র সোজা হয়ে ঠিকঠাক পা ফেলে হাঁটতে লাগলেন। ধুতিতে রক্তটা বেশ বোঝা যাচ্ছে, এটা এক্ষুনি বদলানো দরকার।

একটুখানি হেঁটে আসার পর মানবেন্দ্রর মনে পড়ল, মুনিয়ার কাছে তার কিছু ঋণ আছে। তিনি পিছন ফিরে মুনিয়াকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন।

মুনিয়া কাছে আসতেই তিনি পকেট থেকে পাঁচটা টাকা বার করে ওর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। মুনিয়া অবাক হয়ে তাকাতেই তিনি বললেন, এমনিই, তুমি কিছু কিনেটিনে খেয়ো।

মুনিয়া তবু দাঁড়িয়ে রইল। মানবেন্দ্রর এটা পছন্দ হল না। ও এখন চলে গেলেই তো পারে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কী অসুখ?

মেয়েটি বলল, কিছু না।

ঠিক আছে, যাও। তোমার মাকে বলল, দুধ কিনে দিতে।

পরক্ষণেই তার মনে পড়ল, তিনি মুনিয়াকে পাঁচ টাকা ঠকাচ্ছেন। কাল রাত্তিরে তিনি ওর উদ্দেশে দশ টাকার নোট ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। আর আজ সুস্থ অবস্থায় এরই মধ্যে পাঁচ টাকা বাঁচাবার চেষ্টা। একবার দিয়ে আবার নিয়ে নিলে কালীঘাটের কুকুর হয় না!

তিনি পকেট থেকে আরও পাঁচটা টাকা একটু অনিচ্ছা সত্ত্বেও বার করে আবার এগিয়ে দিলেন মুনিয়ার দিকে। বললেন, এই নাও, এটা ভুলে গিয়েছিলাম।

মুনিয়া বলল, কী করব? মাকে দেব?

হ্যাঁ।

মুনিয়া দৌড়ে চলে গেল। একটু বাদেই শোনা গেল মুনিয়ার মায়ের গলা। এই দিকেই যেন আসছে।

মানবেন্দ্র ভয় পেয়ে গেলেন। মুনিয়ার মা বেশ দজ্জাল ধরনের স্ত্রীলোক। এই টাকা দেওয়ার ব্যাপরটার সে যদি অন্য কোনও মানে করে? অনেকসময় গরিবদেরও আত্মসম্মান বোধ থাকে। সেটা আবার এক অস্বস্তিকর ব্যাপার।

হন হন করে তক্ষুনি পা চালিয়ে, প্রায় দৌড়ে মানবেন্দ্র রওনা হলেন টুরিস্ট লজের দিকে। শেষ পর্যন্ত মুনিয়ার মা তাকে ধরতে পারেনি।

টুরিস্ট লজের গেটে পা দেবার পর মানবেন্দ্রর মনে পড়ল, মানসীর মুখখানা মনে পড়ছে না বলে নিজেকে শাস্তি দেবার জন্য তিনি পাথর থেকে লাফ দিয়েছিলেন। কিন্তু পা কাটার পর এতক্ষণের মধ্যে আর একবারও তিনি মানসীর কথা ভাবেননি। এটাও অদ্ভুত নয়? মানুষের জীবনে যে কত মজার ব্যাপার আছে।

.

০৮.

ধুতিটা বদলে একটা প্যান্ট পরে মানবেন্দ্র একটা চেয়ার টেনে বসলেন বারান্দায়। ওরা কেউ এখনও ফেরেনি। কিন্তু মানবেন্দ্রর এখন ঘরের মধ্যে থাকতে ইচ্ছে করছে না। তিনি নিজেই এখন মানুষের সঙ্গ পাবার জন্য ব্যাকুল।

মানসীরা ফিরল বেশ রাত্তির করে। বাইরে থেকেই খেয়ে এসেছে। জিনিসপত্রও কেনাকাটি করেছে অনেক কিছু, সিনেমা হলের পাশেই হাট বসেছিল। অনেক ঘোরাঘুরি করে এসে সবাই খুব ক্লান্ত।

আজও দেখা গেল, অসীম বেশ নেশা করেছে। তার চোখ লাল, পা টলছে, যদিও কথাবার্তা বলছে না একেবারেই, মনে হল সবাই যেন অসীমকে নিয়ে একটু বিব্রত। অসীমের এই পরিচয়টা প্রথম দিকে বোঝা যায়নি। এত ভদ্র ও বিনীত যুবক, সুন্দরী স্ত্রীর স্বামী। দুটি ফুটফুটে বাচ্চা, সব ব্যাপারেই অসীম বেশ দায়িত্ববান, তবু তার এ-রকম নেশা করার ঝোঁক কেন? মানসী আর গৌতম অসীমকে ধরাধরি করে ঘরের মধ্যে নিয়ে গেল।

আজ আর আড্ডা জমল না। বারান্দায় দাঁড়িয়েই কিছুক্ষণ কথাবার্তা হল। তাছাড়া বাগানে আজ বসবার জায়গাও নেই, নতুন যাত্রীরা সব কটা চেয়ার দখল করে নিয়েছে।

গৌতম গাড়িটাকে মোটামুটি চালু করেছে, কিন্তু পুরো ঠিক হয়নি। এই অবস্থায় গাড়ি নিয়ে দীর্ঘপথ পাড়ি দেওয়া যাবে না। ওদের পরিকল্পনা একটু বদলেছে। কাল ভোরেই বেরিয়ে পড়বে, কাছাকাছি একটা বড় শহরে গিয়ে গাড়িটাকে আবার ভাল করে দেখাতে হবে। অসীমরাও এবার বোধহয় আর ময়নাগুড়ি চা বাগানে যাবে না, কলকাতার ট্রেন ধরবে। কলকাতায় কী যেন একটা জরুরি কাজের কথা মনে পড়ে গেছে। কিংবা অন্য কোনও কারণও থাকতে পারে।

একটু বাদেই যে-যার ঘরে চলে গেল।

ওরা একটা অতিরিক্ত দিন থাকার ফলে মনে হয়েছিল যেন অনেকরকম নতুন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটবে। কিন্তু কিছুই ঘটল না। সারাটা দিন এলেবেলে ভাবে কেটে গেল। তাহলে ওদের গাড়ি খারাপ হল কেন? কেন আর একটা দিন থাকতে হল? কার্যকারণের হেড অফিসের এটা একটা সাঙ্ঘাতিক ভুল। বাকি আছে শুধু রাত্তিরটা।

মানবেন্দ্র ক্ষুব্ধভাবে ফিরে এলেন নিজের ঘরে। এরই মধ্যে শুয়ে পড়ার ইচ্ছে নেই তাঁর, কিন্তু আর কী-ই বা করার আছে। ওরা এত তাড়াতাড়ি তাকে ছেড়ে চলে গেল! গৌতম আর অসীমও যদি আসত! এখন আর বই পড়ার মেজাজ নেই, এত রাত্তিরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া যায় না, হাঁটুতে ব্যথা হয়েছে।

বাগানে নতুন লোকদের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। কাল ভোরে মানসীরা চলে যাবে। হয়তো এই নতুন লোকদের কারুর সঙ্গে মানবেন্দ্রর আলাপ হবে। আবার অন্য রকম কথাবার্তা। নতুন যারা এসেছে তাদের মধ্যেও এক জন রূপসী নারী ও দুটি সুশ্রী কিশোরী রয়েছে, কিন্তু মানবেন্দ্র কোনও আগ্রহ বোধ করেননি। একটা ব্যাপারে তিনি নিশ্চিন্ত হয়েছেন যে, শুধু রূপের জন্য মানসী তাকে এমন ভাবে উতলা করেনি। মানসীর মধ্যে এমন কিছু আছে, যা রূপের চেয়ে বেশি।

মানবেন্দ্র এখানে এসেছিলেন, কারুর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় না করে শুধু চুপচাপ একা কাটাবার জন্য। কিন্তু এখন, ওরা তার সঙ্গে আর একটুক্ষণ কথা না বলে শুতে চলে গেল বলে তিনি অপমানিত বোধ করছেন।

এর আগে, কখনও এরকম একা কোনও জায়গায় বেশি দিন থাকেননি মানবেন্দ্র। ডাকবাংলো বা টুরিস্ট লজে অনেক বার এসেছেন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে, নিজেরাই হই-হল্লা ও উদ্দামতায় এমন ভাবে মেতে থাকতেন যে, সময় পার হয়ে যেত আলোর চেয়েও দ্রুতগতিতে। অন্য কারুর দিকে নজর দেবার মতো অবস্থা থাকত না। এবার তিনি টের পাচ্ছেন, একা একা থাকা কত শক্ত। মানসীরা যদি এখানে না আসত, তাহলে কি এ-রকম অস্থিরতা জাগত?

হাতের বইখানা মেঝেতে ছুঁড়ে দিয়ে মানবেন্দ্র বললেন, মানসীকে আমার চাই! আমি আর কোনও কথা শুনতে চাই না, চাই, চাই, আজ রাত্রেই, ও চলে যাবার আগেই।

মানবেন্দ্ৰ ক্রুদ্ধভাবে পায়চারি করতে লাগলেন ঘরের মধ্যে। বাইরে বেরুবার উপায় নেই, সেখানে নতুন লোকরা বসে আছে এখনও। যদি ওরা আলাপ করতে চায়! এখন মানসী ছাড়া আর কোনও প্রাণীর সঙ্গে তিনি কথা বলতে চান না।

এক একবার থমকে দাঁড়িয়ে তিনি চিন্তা করতে লাগলেন, আজ সন্ধের পর থেকে মানসী তার সঙ্গে ঠিক কটা কথা বলেছে। বেশিনয়, সামান্যই। মানবেন্দ্র জিজ্ঞেস করেছিলেন, ফিরতে এত দেরি হল? মানসী বলেছিল, কাল তো চলে যেতেই হবে, তাই জায়গাটা আবার ভাল করে ঘুরে দেখে এলাম।

অর্থাৎ চলে যেতে হবে বলে মানসী জায়গাটাকে আবার দেখছে। এখানকার মানুষদের শেষবার দেখে যেতে চায়নি। মানবেন্দ্র দুঃখিত হয়েছিলেন। এর পরেই মানসী বলেছিল, আপনার কাছ থেকে কয়েক লাইন লিখিয়ে নেবার ইচ্ছে ছিল, কলকাতায় গিয়ে অন্যদের দেখাতাম।

মানবেন্দ্র বলেছিলেন, আচ্ছা, লিখে দেব।

কিন্তু মানসী সেটা কখন লিখিয়ে নেবে, কাল ভোরবেলা? তখন কি সময় হবে? মানবেন্দ্রর যদি তখন ঘুম না ভাঙে!

মানসী বলেছিল, কলকাতায় আমাদের বাড়িতে আসবেন? আপনি তো খুব ব্যস্ত?

অথচ মানসী কলকাতায় তাদের বাড়ির ঠিকানা বলেনি। হয়তো ভেবেছে, সেটা অসীমই জানিয়ে দিয়েছে।

যাই হোক, এ-সব খুবই সাধারণ। অথবা বলা যায়, কথার কথা। রাত্তিরে এই কথা নিয়ে বার বার চিন্তা করার কিছু নেই। তবে মানসী যে-কোনও কথা বলার সময়েই চোখের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে থাকে। অনেকেই চোখের দিকে স্পষ্টভাবে তাকাতে পারে না। মানসী যখন চেয়ে থাকে, তখন মনে হয় সে যেন আরও কিছু বলতে চাইছে। মানবেন্দ্র চোখের ভাষা বুঝতে পারেন না। এই জন্য তিনি জীবনে অনেক বার পরাজিত হয়েছেন। তিনি খুব ভাল করে চেনেন স্পর্শের ভাষা। মানসী যদি একটা আঙুল দিয়েও তাকে একবার ছুঁয়ে দিত।

মানসীকে আমার চাই! আমি ওকে পুজো করব। আমি ওর সর্বনাশ করব! ও কেন এখানে এসেছে? ও কেন আমাকে চেনে? কেন ওকে দেখলে আমার বুক কাঁপে? এর মূল্য ওকে দিতেই হবে। আমি যেমন ওর কাছে ঋণী, তেমনি মানসীও ঋণী আমার কাছে। পূজারির কাছে দেবতাও কি ঋণী থাকে না?

পায়চারি করতে করতে মানবেন্দ্র মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়ে দেখছেন বাইরে। নতুন লোকেরা তখনও বসে আছে সেখানে। এত শীতের মধ্যেও ওরা কেন এতক্ষণ বসে থাকতে চায় বাগানে? মানবেন্দ্র পাগল সেজে ওদের ভয় দেখিয়ে আসবেন?

এই চিন্তাটা মানবেন্দ্রকে বেশ আকৃষ্ট করল। আধা পাগলের পক্ষে পুরো পাগল সাজা খুবই সহজ। পাগল দেখলে সবাই ভয় পায়। ওদের এমন ভয় দেখাতে হবে যাতে এক্ষুনি পালিয়ে যায়।

মানবেন্দ্র সত্যিই চাদরটা মাথায় পাগড়ির মতো করে বাঁধলেন, প্যান্টের পা দুটো গুটিয়ে নিলেন অনেকটা, তারপর খোলা খিলটা হাতে নিয়ে নিলেন। বাথরুমের আয়নায় দেখতে গেলেন, তাকে কী রকম দেখাচ্ছে।

নিজের চেহারা দেখে নিজেরই হাসি পেল তার। আরও ভয়ঙ্কর করবার জন্য আয়নার সামনে কয়েক বার লাফিয়ে নাচানাচি করলেন। হাতে লাঠি, মাথায় পাগড়ি এই চেহারায় আয়নার সামনে নাচানাচি করার একটা নেশা লেগে গেল। এবং একবার ঝোঁকের মাথায় লাঠিটা ঠক করে ঠুকে গেল আয়নায়।

আয়না জিনিসটা ভঙ্গুর, কিন্তু এত ফঙ্গবেনে হবার কোনও মানে হয় না। এই সামান্য আঘাতেই আয়নাটার মাঝখান থেকে চিড়ে গেল অনেকটা। টাকার চিন্তায় পাগলামিও সাময়িক ভাবে কেটে যায়। কত গুনাগার দিতে হবে? মানবেন্দ্র আয়নার দাম জানেন না, তবু মনে মনে ভাবলেন, অন্তত তিন-চারশো টাকা নিশ্চয়ই। একবার চিন্তা করে নিলেন, এই টাকাটা দিলেও তার চলবে কিনা।

লাঠিটা নামিয়ে রেখে ফাটা আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখলেন আবার। পাগড়িটা খুলে ফেললেন। এবার বেশ চেনা যাচ্ছে এক জন হেরে যাওয়া মানুষকে। এক জন সার্থক হেরে যাওয়া মানুষ।

দেয়াল থেকে কেউ বলল, ঠিক ঠিক ঠিক।

মানবেন্দ্র তাকিয়ে দেখলেন, মাফিয়া এসে বাথরুমের দেয়ালে আশ্রয় নিয়েছে। ড্যাবডেবে চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

মানবেন্দ্র লাঠিটা আবার তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি বুঝি সব জায়গায় জিতে যাও।

 টিকটিকিটা বলল, আমি যা চাই, তা ঠিকই পাই।

মানবেন্দ্র শান্তভাবে বললেন, তোমাকে আমি এক্ষুনি খুন করতে পারি। তুমি কি মৃত্যু চেয়েছিলে?

 মৃত্যুচিন্তা আছে তোমার। আমরা ও-সব কথা ভাবিই না।

তুমি সুখী?

 নিশ্চয়ই। তোমরাই তো দুঃখ তৈরি করো।

আচ্ছা, তাহলে দেখো, মরতে কেমন লাগে।

মানবেন্দ্র বিদ্যুৎ বেগে লাঠিটা দিয়ে আঘাত করলেন ওকে। কিন্তু মাফিয়া তার চেয়েও দ্রুতগতিতে সরে গেছে। ঠাস করে লাঠির শব্দ হল দেয়ালে। সে কিন্তু প্রাণভয়ে একেবারে পালাল না। খানিকটা দূরে গিয়ে আবার ঘাড় তুলে তাকিয়ে রইল।

মানবেন্দ্র আবার মারতে গেলেন তাকে। কিছুক্ষণ এই রকম খেলা হল। শেষ পর্যন্ত মাফিয়া যেন অনেকটা বিরক্ত হয়েই ঢুকে গেল ঘুলঘুলির মধ্যে। যাবার আগে মানবেন্দ্রকে একটা অবজ্ঞার দৃষ্টি দিয়ে গেল।

মানবেন্দ্র বাথরুম থেকে ঘরে এসে চিতপাত হয়ে শুয়ে পড়লেন বিছানায়। টিকটিকিটার চিন্তা মন থেকে তাড়াবার জন্য তিনি একটা সিগারেট ধরালেন।

তখন তার মনে হল, টুরিস্ট লজে এখনও কয়েকটা ঘর খালি আছে। অনেক সময় সেই ঘরগুলোর দরজা খোলাই থাকে। এক সময় চুপি চুপি সেই রকম খালি ঘরের বাথরুমে ঢুকে সেখানে এই ভাঙা আয়নাটা রেখে ভাল আয়নাটা নিয়ে এলেই হবে। তাহলে কেউ আর তাকে দোষ দিতে পারবে না।

মানবেন্দ্র এটা ভাবলেন বটে, কিন্তু করা হয়ে উঠবেনা। একটা ভাঙা আয়না হাতে নিয়ে তিনি চুপি চুপি অন্য ঘরে ঢুকেছেন, এ দৃশ্যটা অবাস্তব। সমস্ত চিন্তাকেই কার্যে পরিণত করতে পারে শুধু পৃথিবীর কর্মী পুরুষরা। মানবেন্দ্র সে-দলে পড়েন না।

সিগারেটটা শেষ হবার আগেই মানবেন্দ্র ঘুমিয়ে পড়লেন। জ্বলন্ত সিগারেটটা হাত থেকে খসে পড়ল নিচে চটি জুতোর ওপর, সেটাকে খানিকটা পুড়িয়ে তারপর নিভল।

ঘুমন্ত মানবেন্দ্রর চিবুকে ও ওষ্ঠে দুঃখের লেখা। অতৃপ্তি ও ক্লান্তির চিহ্ন ছোট ছোট রেখায় ছড়িয়ে আছে তার সারা মুখে। শিশুর মতন হাত দুটো গুটিয়ে আছে বুকের কাছে।

ঘণ্টা দেড়েক বাদে, শীত করার জন্যই হোক বা চোখের ওপর আলোর জন্যই হোক, মানবেন্দ্রর ঘুম ভেঙে গেল। তিনি ধড়মড় করে উঠে বসে বিভ্রান্তের মতো তাকালেন চারদিকে। একটু আগেকার কোনও কথা মনে করতে পারলেন না।

প্রথমেই আলোটা নিভিয়ে দিলেন। সেই সময় একটি এরোপ্লেনের বিশাল গম্ভীর শব্দ তাকে খানিকটা সচেতন করে দিল। পায়ে চটি লাগিয়ে তিনি এলেন দরজার কাছে।

এর মধ্যে টুরিস্ট লজ একেবারে নিস্তব্ধ। বাইরের সমস্ত আলো নিভে গেছে। কিন্তু আকাশে আজ জ্যোৎস্না আছে। সেই জ্যোৎস্নায় তিনি দেখলেন, বাগানের এলোমলো ছড়ানো চেয়ারগুলোর মধ্যে একটি মাত্র চেয়ারে এক জন কেউ বসে আছে।

প্রথমে মানবেন্দ্র ভাবলেন, ওখানে বসে আছেন তিনি নিজেই। যেমন মানসীর সঙ্গে দেখা হওয়ার প্রথম রাত্তিরে বসেছিলেন। তাছাড়া আর কে থাকবে! দরজার কাছে যে দাঁড়িয়ে আছে, সে আর কেউ নয়, সে অবাস্তব। কিংবা, আমি একই সঙ্গে বাগানের চেয়ারে বসে আছি এবং এখানে দাঁড়িয়ে আছি।

ঘরের বাইরে এক পা ফেলে তিনি বুঝলেন, না, অন্য কেউ। আমি নয়। মানবেন্দ্র চমকে উঠলেন। পুরুষ না নারী? সাদা পোশাক। মানবেন্দ্র কোনও শব্দ না করে বাইরে বেরিয়ে এলেন। মূর্তিটা তার দিকে পেছন ফিরে বসা। মানবেন্দ্রর চিনতে অসুবিধে হল না, সাদা প্যান্ট-শার্ট পরে বসে আছে গৌতম।

চেয়ারে এক দিকে কাত হয়ে গৌতমের বসে-থাকা মূর্তিটা দেখে একবার মনে হয়, ও বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু একটু বাদেই তার ঝুলন্ত ডান হাতটা ওপরে উঠল, সেই হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।

মানবেন্দ্ৰ গৌতমকে ডাকলেন না। আজ সারা দিনই গৌতম খানিকটা গম্ভীর ছিল। হঠাৎ গাড়ি খারাপ হবার জন্য তো প্রোগ্রাম ওলোট-পালোট হয়ে যাবার জন্য তার মেজাজ খারাপ থাকতে পারে। সকালে-বিকেলে গৌতম ওদের দলের সঙ্গে বেরোয়নি, গাড়ির পেছনে লেগে ছিল। সন্ধেবেলা মানবেন্দ্র যখন বারান্দায় বসে ছিলেন, তখন গৌতম গাড়ি নিয়ে ফিরল একা। মানবেন্দ্রকে সে লক্ষ্য করেনি, সোজা ঢুকে গেল নিজের ঘরে। খানিকটা বাদে মানবেন্দ্র একবার ওর ঘরের সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়েছিলেন। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন, গৌতমের হাতে একটা ড্রিঙ্কসের গ্লাস, সে গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা বই পড়ছে।

মানবেন্দ্র ওকে ডাকেননি। নিজে থেকে কারুর ঘরে যাওয়া কিংবা ডাকা তার স্বভাবে একেবারেই নেই। তিনি আস্তে আস্তে সেখান থেকে চলে এসেছিলেন। গৌতমও আর তার খোঁজ করতে আসেনি আগের দিনের মতো।

গৌতম ছেলেটি মোটেই সাধারণ নয়। সে একটা গল্পই সারা জীবনে বার বার লিখছে। চা বাগানের ম্যানেজারকে খুব খাটতে হয় নিশ্চয়ই, তবু সে বই পড়ে। সার্থক মানুষদের মতো ছটফটানি নেই তার চরিত্রে।

মানবেন্দ্র দাঁড়িয়েই রইলেন বারন্দায়। কুয়াশায় মতো জ্যোৎস্না। তারাগুলি আজ অনেক পরিষ্কার। চোখ তুললেই দেখা যায় কালপুরুষকে। তিনি এই গ্রহটিকে পাহারা দিচ্ছেন কোমরবন্ধে তলোয়ার এঁটে।

মানবেন্দ্র অস্ফুট স্বরে কালপুরুষকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি পাব কি পাব না?

কালপুরুষ বললেন, তুমি পাবে না।

মানবেন্দ্র একটু ভর্তসনার সঙ্গে বললেন, একটু ভেবে-চিন্তে উত্তর দিতে হয়। হাউ ক্যান ইউ বি সো সিওর?

কালপুরুষ বললেন, আমার এক মুহূর্তই তো অনন্তকাল। অনন্তের মধ্যে কোনও ভুলের জায়গা নেই।

ড্যাম ইয়োর অনন্তকাল! আমার কাছে ছোট ছোট ক্ষণিক মুহূর্তগুলোই সত্য।

 তুমি ওকে পাবে না।

আপনাকে বলে দিচ্ছি, জীবনে আর কিছু পাই বা না পাই, এই নারীকে আমি পাবই।

কালপুরুষ চোখের ইঙ্গিতে বললেন, ওই দ্যাখো ।

এত আস্তে দরজা খোলার আওয়াজ হয়েছিল যে, মানবেন্দ্র টেরও পাননি। গৌতমকে উঠে দাঁড়াতে দেখেই তিনি সচকিত হলেন। দেখতে পেলেন, একটি ঘর থেকে বেরিয়ে অন্ধকার বারান্দা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে একটি নারীমূর্তি।

মানবেন্দ্র প্রথমে ভেবেছিলেন অনুরাধা। জ্যোৎস্নার বাগানে মেয়েটি পা দিতেই তিনি চিনতে পারলেন। মানসী ছাড়া আর কে হবে?

গৌতম এত রাত্রে নিজের স্ত্রীর জন্য বাইরে অপেক্ষা করবে কেন? এ-রকম কোনও নিয়ম আছে নাকি?

মানবেন্দ্র শরীরে একটা শিহরণ বোধ করলেন। সহসা কোনও উপলব্ধিতে এ-রকম হয়। চিবুকটা চেপে ধরে তিনি ভাবলেন, আমি কি এই কদিন অন্ধ হয়ে ছিলাম। প্রথম থেকেই তো বোঝা উচিত ছিল, গৌতম আর মানসীর মধ্যে বাল্যপ্রণয়। অনুরাধা যে গল্পটা বলেছিল, সেটা আসলে মানসীর গল্প।

মানবেন্দ্র নিজেকে গোপন করলেন স্তম্ভের আড়ালে। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। স্বামীর কাছ থেকে তার স্ত্রীকে কিছু সময়ের জন্য অন্তত সরিয়ে আনা যায়, কিন্তু প্রেমিকের কাছ থেকে এক মুহূর্তের জন্যও ছিনিয়ে আনা যায় না। মানসী আমার জন্য নয়।

মানবেন্দ্র কালপুরুষের দিকে তাকিয়ে আবার ভর্ৎসনার সুরে বললেন, এত সত্যবাদী না হলেও তোমার চলত। এমন কিছু অপবাদ রটত না।

গৌতম এগিয়ে এসে মানসীর হাত ধরল। মানসী ছাড়িয়ে নিল হাত। গৌতম তখন দুহাতে মানসীর কাধ আঁকড়ে ধরে চুম্বন করল তাকে। কী অসম্ভব আবেগময় সেই চুম্বন, গৌতম যেন মানসীকে মিশিয়ে দিচ্ছে তার শরীরের সঙ্গে, মানবেন্দ্র দেখতে পেলেন, মানসীর গোড়ালি দুটি উঁচু উঠছে।

তিনি ভাবলেন, খুব সাহস তো ওদের। দুটি ঘরের দরজা খোলা, তার মধ্যে শুয়ে আছে এক জনের স্ত্রী, এক জনের স্বামী। যে-কোনও মুহূর্তেই । মানবেন্দ্র নিজেও এ-রকম সাহস দেখিয়েছেন অনেক বার, কিন্তু তিনি ভাবতেন, পৃথিবীতে এ ব্যাপারে তিনিই সব চেয়ে সাহসী।

দীর্ঘকাল পরে চুম্বনটি শেষ হবার পর মানসী হাত দিল নিজের মুখে। তারপর কিছু বলল, এত দূর থেকে শোনা যায় না। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়, সে গৌতমকে মিনতি করছে।

লেখক হিসেবে মানবেন্দ্র সহজেই অনুমান করতে পারলেন যে, মানসী এখন গৌতমকে কী কথা বলছে। সে বকছে গৌতমকে। সে বলছে, কেন গৌতম পাগলের মতো বাইরে বসে আছে। বার বার ঘুম থেকে উঠে উঠে মানসী জানলা দিয়ে গৌতমকে ওইভাবে বসে থাকতে দেখে আর স্থির থাকতে পারেনি। সে বেরিয়ে এসেছে, গৌতমকে ঘরে ফিরে যেতে বলার জন্য।

মানবেন্দ্রও এক দিন আগে ওই রকম ভাবে বসেছিলেন। মানসী টের পায়নি।

গৌতম মানসীর হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাইরের দিকে। মানসী হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করছে, কাকুতি-মিনতি করছে, কিন্তু গৌতম ছাড়বে না। সে মানসীকে নিয়ে গেল টুরিস্ট লজের বাইরে।

মানবেন্দ্র স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। এখন যদি অসীম বা অনুরাধা ওঠে? কী আর হবে? দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মধ্যে এক জন যদি আর এক জনের স্ত্রীর সঙ্গে মাঝরাতে একটু বেড়াতে যায়, তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। পৃথিবী এখন অনেক বদলে গেছে। অনেক হালকা হয়ে গেছে পাপ পুণ্য সম্পর্কে ধারণা। অনুরাধা কিছু কিছু জানে, তবু প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারে না। অসীমরা আর গৌতমরা দুজায়গায় থাকে এখন, হয়তো বছরে একবার দুবার দেখা হয়। তাতে সমাজ-সংসার উলটে যায় না।

তবু, ঘুমন্ত স্বামীর পাশ থেকে উঠে কোনও নারী কি অন্য পুরুষের সঙ্গে দেখা করতে যায়? মানসী তো বাঙালি ঘরের মেয়ে। রাধা এ-রকম ভাবে স্বামীকে ছেড়ে যেত। কিন্তু রাধা বাঙালি নয়।

এমনও হতে পারে, অসীম নেশাগ্রস্ত হয়েছে বলেই মানসী জানে, সে আর সারা রাতে জাগবে না। স্ত্রীরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারে। কিন্তু অনুরাধা তো নেশা করেনি। সে যদি হঠাৎ জেগে উঠে স্বামীকে পাশে না দেখে? কিংবা অনুরাধা কি জানে ব্যাপারটা? মুহূর্তে অনুরাধাকে অনেক মহান মনে হল। অসীমও কি জানে? নিজের বাল্যবন্ধুর এই দুর্বলতা সে ক্ষমা করে দেয়? মানসী বলেছিল, তারও একটা সমস্যা আছে, তা হলে এটাই? 

মানবেন্দ্র চোখের সামনে দেখলেন এক বিশাল শূন্যতা। এই অন্ধকার পৃথিবীর থেকেও তা বড়। মানসী নেই। এত সহজে কী তাকে চোখের আড়াল করা যায়।

চটি খুলে রেখে মানবেন্দ্র খালি পায়ে দ্রুত অনুসরণ করলেন ওদের। টুরিস্ট লজ থেকে বেরিয়ে ওরা ডান দিকের রাস্তাটা ধরেছে। জ্যোৎস্নায় পাতলা হয়ে যাওয়া অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে ওদের শরীরের রেখাচিত্র। মাঝে মাঝে দুটি শরীর এক হয়ে যাচ্ছে।

বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে মানবেন্দ্র পথের পাশ ঘেঁষে এগোতে লাগলেন। এদিকে রাস্তায় বাড়িঘর নেই, আর কোনও মানুষজন নেই। ওরা দুজনে নিশ্চিন্তভাবে হাঁটছে। শুধু মানবেন্দ্রর ভাবভঙ্গিই চোরের মতো। যদি ধরা পড়ে যান ওদের কাছে! ওরা ধরা পড়বে না, তিনিই ধরা পড়বেন। বুকের ভেতরটা এমন ফাঁকা, যেন এক জন সর্বহারা মানুষ।

মানবেন্দ্র বেশি কাছে যেতে সাহস পাচ্ছেন না। যদিও তার খুব ইচ্ছে করছে ওদের কথাবার্তা শুনতে। মানসীর জীবনের গল্পটার সমস্ত খুঁটিনাটি তিনি জানতে চান। কিন্তু তার উপায় নেই। কাল রাত্রে এই রাস্তাতেই মানবেন্দ্র পাগলের মতো দৌড়েছিলেন, আর আজ ওরা কত সুখের সঙ্গে হাঁটছে সেই রাস্তা দিয়ে।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা এগিয়ে গেল সেই উঁচু পাথরটার দিকে, যেটা মানবেন্দ্রর খুব প্রিয় জায়গা। ওরা পাথরটার ওপর বসবার পর মানবেন্দ্র একটা গাছের তলায় থমকে দাঁড়ালেন। একটা জিনিস অনুভব করে তিনি একটু অবাক হলেন, এখন তো তার চিন্তায় বা ব্যবহারে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই। এখন তিনি পাগল নন। কী জন্য এ-রকম হল? রাগ কিংবা দুঃখবোধও তো নেই। ঈর্ষা আছে? না, না, না-

 মানবেন্দ্র তাকালেন ওদের দিকে। ওরা পাথরে পা ঝুলিয়ে বসেছে। কী সুন্দর এই দৃশ্য। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাওয়া আকাশের নিচে বসে আছে দুজন নারী-পুরুষ, যেন ওরা ভাসমান। পুরুষটির ভঙ্গির মধ্যে আছে ব্যাকুলতা। মেয়েটির মধ্যে স্বভাবব্রীড়া এবং অনেকখানি কুণ্ঠা। তবু মাঝে মাঝে মুখচুম্বন করছে ওরা। যেন এর পূরবী ওর বিভাসকে আশীর্বাদ করছে।

দ্বিধা কেটে গিয়ে মানবেন্দ্র মনটা নির্মল হয়ে গেল। ওদের দুজনের এই বসে থাকার দৃশ্যটাই এত সুন্দর যে, তার ওপরে আর কথা নেই। এখানে তৃতীয় ব্যক্তিকে মানায় না। এর আগে এক দিন মানবেন্দ্র যখন এখানে বসেছিলেন, তখন কোথা থেকে একটা কুকুরও অকারণে এসে বসেছিল তার মুখের দিকে চেয়ে। মানবেন্দ্রর নিজেকে এখন সেই কুকুরটার মতো অবান্তর মনে হল।

এখন এই জ্যোত্সার আকাশ, নির্জন পৃথিবী, পাহাড় জোড়া দিগন্ত এবং সুগন্ধ বাতাস –শুধু ওদের মনে পড়ে দুজনেরই প্রাপ্য।

মানবেন্দ্রর হঠাৎ মনে পড়ে গেল একটা গানের লাইন। এই যে ধরণী চেয়ে বসে আছে, ইহার মাধুরী বাড়াও হে–। ওরা দুজনেই এই ধরণীর মাধুরী বাড়িয়েছে। সামাজিক সাংসারিক হিসেবে মেলে না, তবু তিনি টের পেলেন সেই মাধুরী।

ওদের সেখানেই রেখে মানবেন্দ্র ফেরার পথ ধরলেন। তার আত্মপরীক্ষার কাল শেষ হয়ে গেল। এখন ওষুধ ছাড়া অসুখ সারবে না। এক জন হেরে-খাওয়া মানুষ যদি আবার হারে —

কয়েক পা গিয়েই মানবেন্দ্র শুনতে পেলেন একটা অস্ফুট শব্দ। বেশ ধ্বনিময়। তিনি প্রথমে ভাবলেন গান। মানসী গান গাইছে। মুখ ফিরিয়ে একটু মনোযোগ দিয়ে শুনেই বুঝতে পারলেন, গান নয়, কান্না। মানসী কাঁদছে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। এখানে এ সময় এই কান্না কেন?

মানবেন্দ্র আর অপেক্ষা করলেন না। কান্নারও অনেক মানে হয়, এই কান্নাও ওদের দুজনের নিজস্ব।

টুরিস্ট লজে ফিরে এসে মানবেন্দ্র দেখলেন, দুটি ঘরে কোনওটিরই আলো জ্বলেনি।

তিনি নিশ্চিন্ত হলেন। মানসী আর গৌতম কোনও ক্রমে ধরা পড়ে যাক, এটা তিনি চান না। ওদের ব্যাপারটা গোপন থাক। অসীম আর অনুরাধা এখন ঘুমিয়ে থাকুক। এতে বিশ্বসংসারের কোনও ক্ষতি হবে না।

নিজের খাটের ওপর অনেকক্ষণ সিধে হয়ে বসে রইলেন মানবেন্দ্র। মেরুদণ্ডটা টন টন করছে, তবু শুয়ে পড়ছেন না। মনটা নির্মল হয়ে গেছে। মানসীর জন্য সেই সাংঘাতিক ব্যাকুলতাটা আর বোধ করছেন না একটুও।

মানবেন্দ্র এক সময় অস্ফুট স্বরে বললেন, গৌতম আর মানসীও সুখী নয়, ওরাও দুঃখী। গোপন কথা মানে দুঃখ।

.

০৯.

কী রে মানু, অনেক দিন পর দেখছি।

কলকাতায় ছিলাম না।

রঙটা কালচে হয়ে গেছে। কোথায় গিয়েছিলি?

নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ালাম।

তাপস মুখার্জি একটা চেয়ার টেনে মানবেন্দ্রর উলটো দিকে বসলেন। টুসকি দিয়ে বেয়ারাকে ডেকে বললেন, আমাকেও একটা হুইস্কি দাও। বিলটা এই বাবুকে দেবে।

তাপস মুখার্জি সিগারেট এগিয়ে দিলেন মানবেন্দ্রর দিকে। মানবেন্দ্র বিনাবাক্য ব্যয়ে একটা সিগারেট নিয়ে ধরালেন। তিনি প্রতীক্ষা করছেন, তাপস মুখার্জি কোন দিক থেকে তাকে আক্রমণ করবেন।

তাপস মুখার্জির বিশাল চেহারা। গলার আওয়াজ গমগমে। এঁর প্রবল উৎসাহী ভঙ্গি দেখলে মনে হয়, বেঁচে থাকা একেই বলে। ইনি মানবেন্দ্রর প্রায় বাল্যবন্ধু, এখন বিখ্যাত প্যাথোলজিস্ট, অতি ব্যস্ত ও সার্থকপুরুষ, কিন্তু এরইমধ্যে হিমালয় ভ্রমণ বিষয়ে একটি চমৎকার বই লিখেছেন, তাই সাহিত্যিকদের কাছে অপরিচিত নন। তাপস মুখার্জি পেশাগত ভাবে খুবই পরিব্যাপ্ত লোক হলেও কাজের কাছে সম্পূর্ণ ধরা দেননি। মনের মধ্যে ছুটি লুকিয়ে আছে। খুব কাজের মধ্যে থেকেও হঠাৎ এক-এক দিন বেরিয়ে পড়েন, ঘুরে বেড়ান উদ্দেশ্যহীন ভাবে। বারে, রেস্তোরাঁয় এসে খোঁজ করেন পুরনো বন্ধুদের।

তাপস আর মানবেন্দ্রর জীবন-দর্শন আলাদা। তাপসের জীবনে কোনও দ্বিধা নেই, তিনি জানেন, জীবনটা কীরকম ভাবে চলবে বা চলা উচিত। সেই জন্যই মানবেন্দ্রর প্রতি ব্যাপারেই ইতস্তত ভঙ্গি তার পছন্দ হয় না।

তাপস আকস্মিক ভাবে বললেন, তোকে জেলে আটকে রাখা উচিত। আমি যদি চিফ মিনিস্টার হতাম, তাহলে তোকে ডি আই আর-এ গ্রেপ্তার করে রাখতাম।

মানবেন্দ্র হাসিমুখে জিজ্ঞেসে করলেন, কেন? আমি কী দোষ করেছি।

কারণ, তোর লেখা খারাপ হচ্ছে। গত দু-তিন বছর ধরে কিচ্ছু ভাল লিখতে পারিসনি। যারা খাবারের কিংবা ওষুধে ভেজাল দিচ্ছে, তারা যেমন দেশের ক্ষতি করছে, সেই রকম যেসব রাইটার ভাল লেখে না তারাও সমান দোষী। সমাজ থেকে তাদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তোমাদের আর কিছু করতে হবে না বাপু, তোমার শুধু মন দিয়ে ভালো করে কবিতা লেখো, কিংবা উপন্যাস লেখো, গান গাও, ছবি আঁকো– তোমাদের তো কারখানায় গিয়ে হাতুড়ি ধরতে বলছি না, কিংবা দশটা-পাঁচটার অফিস করতে বলছি না? ময়দানে গিয়ে পলিটিক্যাল মিটিংও করতে বলছিনা।

মানবেন্দ্র সবটা মন দিয়ে শুনে বললেন, তাপস, তোরই চিফ মিনিস্টার হওয়া উচিত ছিল।

কি, আমি বেঠিক কথা বলছি?

না। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশগুলো যারা শাসন করে, তারা একথা বলে না।

তাপস ধমক দিয়ে বললেন, আস্তে আস্তে খাচ্ছিস কেন? ভাল করে খা। যখন মদ খাবি, তখন সেটাও ভাল করে খাবি। যখন যেটা করবি, প্রত্যেকটাই ফার্স্ট রেট হওয়া দরকার।

তিনি হুঙ্কার ছেড়ে বেয়ারাকে ডেকে বললেন, শিগগির আরও দুপেগ নিয়ে এসো। সব বিল এই বাবুকে দেবে, আমাকে না।

মানবেন্দ্র লক্ষ্য করলেন, তাপসের চোয়াল অন্য অনেকের চেয়ে বেশি চওড়া। এই রকম মুখ যাদের তারা বেশি সাহসী হয়। তারা অন্যদের ওপর হুকুম করে কথা বলতে পারে।

তাপস তার গেলাসে লম্বা চুমুক দিয়ে বললেন, দেশের কোনও খবর রাখিস? তোকে আমি দুটো খবর দিই। পরশু দিন ক্যানিং-এর দিকে গিয়েছিলাম। দেখলাম, গ্রামের লোক ঘাস-পাতা কচু-ঘেঁচু খাচ্ছে। যাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের মধ্যে শতকরা আশি জনই সাত দিনের মধ্যে এক দিন ভাত খায়। কী বুঝলি এতে?

মানবেন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, দ্বিতীয় খবর কী?

পরে বলছি। তুই টেন ডেইজ দ্যাট শুক দা ওয়ার্ল্ড বইটা পড়েছিস তো? এ-দেশের অবস্থাও সেই দশ দিনের আগের দিনগুলোর মতো ঠিক। তবু এ-দেশে বিপ্লব হচ্ছে না। হবেও না। এই দেশে কিস্যু হবে না।

তুই আজ একটু বেশি উত্তেজিত আছিস মনে হচ্ছে? এমনকী তোর তুলনাতেও একটু বেশি।

হবে না? এইসব শুনে তোর রক্ত টগবগ করে ফোটে না? ইচ্ছে হয় না, সব শালাকে গুলি কবে মেরে ফেলি?

দ্বিতীয় খবরটা তো এখনও বললি না?

দ্বিতীয় খবর হচ্ছে এই, দেশে যখন এ-রকম অবস্থা, সেইসময় তুই আর আমি এখানে বসে মদ খাচ্ছি। কী বুঝলি এতে?

অনেক কিছু বোঝার আছে, তাইনা?

হ্যাঁ, বোঝার আছে। আমি বলছিনা, অন্যরা খেতে পাচ্ছে না বলে আমরাও খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেব। আমার ডিম্যান্ড হচ্ছে, আমরা যেমন খাচ্ছি, অন্যরাও সে-রকম খেতে পাক। আমি ওই গরিবদের মতো হতে চাই না। গরিবরা আমার মতো হোক। ঠিক কি না?

ঠিক।

চল, তুই আর আমি এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ি। দুটো রাইফেল জোগাড় করে সব ব্যাটা বদমাসের খতম করে দিই। কী, পারব না?

আমি কখনও রাইফেল ছোঁড়া শিখিনি।

খাঁটি কথা। যার যেটা কাজ। আমিই ভুল বলছিলাম। আমাদের দিয়ে হবে না। সোলজার চাই। সোলজার ছাড়া বিপ্লব হয় না, কোনও দেশে হয়নি।

তাপস, তুই একটু আস্তে কথা বল। বড্ড জোরে চ্যাঁচাচ্ছিস!

মানু, তোর জন্য আমার কষ্ট।

আমার জন্য? এত গরিব থাকতে আবার আমার জন্য কষ্ট কেন?

রাইটারদের ব্যাপার কি আমি বুঝি না। তারা সব ব্যাপারই ফিল করে, মনে মনে কষ্ট পায়, কাজে কিছু করতে পারে না। আমি যা পারব, তুইতা-ও পারবি না। আমি তবু গ্রামে গিয়ে ওষুধ বিলি করতে পারি। তুই কী করবি? লিখে কি হবে না। লেখা-ফেখা ছেড়ে দে।

যখন-তখন প্রসঙ্গে বদলান তাপস। বহুকথারই উত্তর আশা করেন না। নিজের মন থেকে কথাটা বার করে দিয়েই খুশি। কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে বললেন, ও, তোকে একটা ঘটনার কথা তো এ এখনও বলিনি রে?

মানবেন্দ্র বললেন, আমি জানি তোর সে-ঘটনা আরও বেশি চমকাবার মতো হবে।

তুই বাণীশঙ্করের খবর শুনেছিস? কত বয়েস এখন? তিয়াত্তরনা চুয়াত্তর। উনি আজকাল একটা সতের-আঠারো বছরের মেয়ের সঙ্গে–।

এটা কি একটা খবর?

আরে শোন না! এই জন্য লোকে ওঁকে নিন্দে করছে। আমি একটু আগেও এক জায়গায় আলোচনা শুনে এলাম। কিন্তু নিন্দে করার কী আছে এর মধ্যে? আসলে বেশির ভাগ লোকই হিংসুটে। তারা ভাবছে এই একম একটা বুড়ো একটা কচি মেয়েকে পেয়ে গেল, আর আমরা পেলুম না! আরে বাবা, তোরা জোগাড় করে নে না, কে বারণ করছে? তা না, শুধু শুধু হিংসে। তাছাড়া, উনি আর্টিস্ট। তোদের যদি সেরকম ট্যালেন্ট থাকে।

মানবেন্দ্র পকেটে হাত দিতেই তাপস তার হাতটা চেপে ধরলেন। আবার ধমক দিয়ে বললেন, চালাকি করিস না চুপ করে বসে থাক। আমি সব বিল মেটাব। আজ একটা মাড়োয়ারিকে বধ করে আড়াইশো টাকা পেয়েছি!

মানবেন্দ্র বললেন, আমি কিন্তু এবার উঠব!

কোথায় যাবি?

বাড়ি।

বাড়ি! বাড়িতে কে আছে? তোর আবার বাড়ির ওপর এত টান হল কবে থেকে?

এখন পৃথিবীতে সব চেয়ে ভাল লাগে নিজের বিছানায় নিজের বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকতে।

তাহলে এখানে এসেছিলি কেন?

এখন বুঝতে পারছি, এসে ভুল করেছি। মাঝে মাঝে মনে হয় মানুষজনের সঙ্গে না মিশলে আমি পাগল হয়ে যাব। আবার মানুষজন কাছে এলে…।

ও-সব ছাড়। তুই এখন আমার সঙ্গে যাবি।

আমি কোথায় যাব?

একটা পার্টি আছে, চল তোর ভাল লাগবে।

মানবেন্দ্ৰ কখনও কোনও উৎসব বা নিমন্ত্রণ বাড়িতে যান না। অনেক পার্টির নেমন্তন্ন গ্রহণ করেও কথা রাখেন না শেষ পর্যন্ত। অনাহুত ভাবে কোনও অচেনা জায়গায় যাবার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু তাপসের হাত থেকে নিস্তার নেই। কোনও রকম যুক্তি-আপত্তি শুনবেন না তাপস।

জোর করে টেনে নিয়ে গেলেন। গাড়িতে মানবেন্দ্রকে পাশে বসিয়ে তাপস বললেন, তুই বড় একলা হয়ে যাচ্ছিস দিন দিন। আমি যেখানে যাচ্ছি, সেখানে তোকে নিয়ে যাওয়া উচিত না। অনেক মেয়েটেয়ে থাকবে সেখানে, মেয়েদের কাছে তোর যা ফিল্ড আছে, আমি আর পাত্তাই পাব না।

তবু কেন নিয়ে যাচ্ছিস!

ওই তো মজা। নিজের ক্ষতি হবে জেনেও মানুষ অনেক কাজ কি করে না?

সান্ত্বনা কেমন আছে?

ভালই আছে। তুই আমাদের বাড়িতে আসিস না কেন? সান্ত্বনা মনে মনে তোকে খুব পছন্দ করে, জানিস তো? আমি যখন বাড়ি থাকব না, সেই সময় গিয়ে তুই ওর সঙ্গে প্রেম করতে পারিস।

যাব। তুই কোন কোন সময় বাড়ি থাকিস না?

পুরো দুপুরটা। সন্ধে সাড়ে সাতটা আটটার আগে তো কোনও দিন বাড়ি ফিরি না। ছেলে স্কুল থেকে ফেরে চারটের সময়, তার আগে বেচারা একলাই থাকে, কিছুই করার নেই। তোর মতো এক জন লাভার-টাভার যদি পায়, মন ভাল থাকবে।

মানবেন্দ্র অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। একটা সাদা রঙের দোতলা বাড়ি। সেই বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে মানসী। একটা স্কুলবাস এসে থামল। দুটি ছেলেমেয়ে নামছে।

তাপসের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, জীবনটা আবার নতুন ভাবে শুরু করা যায় না? কোনও উপায় নেই? না। আর সময় নেই। যে-জীবন শালিকের, দোয়েলের, তার সঙ্গে আর দেখা হবে না।

তাপস তখনও বলে চলেছেন, জানিস তো, সান্ত্বনার স্বাস্থ্য বেশ ভাল হয়েছে। আমি ফিল করি, ওর এখন একজন প্রেমিক দরকার। সব ম্যারেড মেয়েদেরই, বিয়ের সাত-আট বছর বাদে এক জন আলগা ধরনের প্রেমিক থাকা ভাল–

মানবেন্দ্র বললেন, তাপস, তুই কীসে মরবি জানিস?

 তাপস এক মুহূর্তও চিন্তা না করে বললেন, হ্যাঁ। অ্যাকসিডেন্টে। আর তুই?

 পাগলা গারদে।

গোটা দুনিয়াটাই তো।

না, সেরকম অর্থে নয়।

 তবে সেখানেই মর। যেখানে খুশি মরলেই হল। তবে, বেশির ভাগ লোকই ভাল করে মরতে জানে না। পুরো ব্যাপারটা ক্লামজি করে ফেলে।

তাপস অ্যাকসিলারেটরে চাপ দিয়ে গাড়ির গতি অনেক বাড়িয়ে ফেললেন হঠাৎ। যেন এক্ষুনি একটা অ্যাকসিডেন্ট করার খুব ইচ্ছে তার। মানবেন্দ্র স্থির হয়ে বসে রইলেন।

.

বাড়িটি এক ডাক্তারের। সেখানে পনেরো-কুড়ি জন নারী-পুরুষ উপস্থিত। তাপসের সঙ্গে মানবেন্দ্রকে দেখে অনেকেই অবাক। অনেকেই মানবেন্দ্রর খ্যাতির কথা শুনেছে, বই না পড়লেও নাম জানে। সেই রকম এক জন মানুষ বিনা আমন্ত্রণে উপস্থিত। অতিরিক্ত খাতির-যত্ন করে তারা আরও অস্বস্তিতে ফেলল মানবেন্দ্রকে।

প্রচুর পানীয়, আনন্দ, মুরগি, সুন্দরী নারী। তাপস মানবেন্দ্রকে অন্যদের হাত থেকে উদ্ধার করে এনে বসিয়ে দিলেন দুজন মহিলার পাশে, সরবে বললেন, এরা দুজন তোর অনেক বই পড়েছে, খুব ভক্ত।

মানবেন্দ্র লাজুক, মুখচোরা হয়ে গেলেন। মহিলা দুটি মানবেন্দ্রর কোনও লেখাই পড়েনি। বই পড়ার স্বভাব নেই। ভদ্রতা দেখিয়ে কথা বলতে লাগল মানবেন্দ্রর সঙ্গে। এসব তাপসের দুষ্টুমি।

তাপস দুটো হইস্কির গেলাস হাতে করে এনে মহিলা দুটিকে বললেন, জানেন তো, ওর পরের নভেলে আপনারা দুজনেই নায়িকা হয়ে যাচ্ছেন।

মহিলাদের মধ্যে এক জন সুশ্রী ভুরু তুলে বললেন, দুজনেই?

মানবেন্দ্র তাপসের হাত থেকে হুইস্কির একটা গেলাস নিয়ে এক চুমুকে অনেকটা খেয়ে ফেললেন। তৃষ্ণার্ত মানুষের মতো। তারপর তার ইচ্ছে হল, গেলাসটা মাটিতে ছুঁড়ে ভেঙে ফেলতে।

সেই ভঙ্গিতে গেলাসটা ধরে তিনি কঠোর ভাবে তাকালেন তাপসের দিকে। তাপস এক জন উল্লসিত সুখী মানুষ। মানুষের জন্য দুঃখ বোধ করার মতো অনুভূতি আছে, আবার নিজের জীবনে আনন্দ খুঁজে নিতে জানেন। তিনি মানবেন্দ্রকে বললেন, তুই গম্ভীর হয়ে আছিস কেন? মানুষের সঙ্গে না মিশলে তাদের কথা লিখবি কী করে?

পাশ থেকে এক জন লোক মানবেন্দ্রর কাঁধে টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, আপনি কি অনিরুদ্ধ মুখার্জিকে চেনেন? ওঁর স্ত্রী সুজাতা মুখার্জি এক দিন বলছিলেন।

মানবেন্দ্র বিড় বিড় করে বললেন, পুরুষ মানুষের স্পর্শ আমি একদম পছন্দ করি না।

 লোকটি তা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, কী বললেন?

হ্যাঁ চিনি। আমি যখন খেতে পেতাম না, তখন এক কাপ চা ও বিস্কুটের লোভে ওদের বাড়িতে যেতাম মাঝে মাঝে।

যেন দারুণ একটা হাসির কথা, এই ভঙ্গিতে হেসে উঠলে লোকটি।

তাপস বললেন, সুজাতা তো আমাদের ক্লাসমেট ছিল। আর অনিরুদ্ধটা তো একটা গ্রেট বাস্টার্ড।

মহিলাদের সামনে এই কথাটা উচ্চারণ করেও একটুও লজ্জা পেলেন না তাপস। পাশের লোকটি বলল, অনিরুদ্ধ আমার পিসতুতো ভাই।

মানবেন্দ্র মনে হল, এই ঘরটার কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই। এখানকার লোকজন, কথাবার্তা, সবই যেন দারুণ দুর্বোধ্য। কোনও কিছুরই মানে হয় না। আমি এখানে কেন?

ঘরের অন্য কোণ থেকে একটি কুমারী মেয়ে মানবেন্দ্রর সামনে এসে বলল, আমি কিন্তু আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। আপনি বিরক্ত হবেন না তো?

তাপস মানবেন্দ্রর দিকে চোখের চটুল ইশারা করে বললেন, বলেছিলাম না!

অন্য দুটি মহিলা সরে গিয়ে এই নতুন মেয়েটিকে বসার জায়গা করে দিল। মেয়েটি বলল, আমি আপনার সব বই পড়েছি। এর মধ্যে একটা বই আপনি আমাকে নিয়ে লিখেছেন। আপনি কী করে আমার কথা জানলেন?

মানবেন্দ্র মনে মনে বললেন, আই ওয়ান্ট টু শ্লিপ উইথ ইউ। আমি একা ঘরে থাকি। তুমি আজ রাত্তিরেই আমার সঙ্গে সেখানে যাবে?

মেয়েটির ছোট্টখাট্টো চেহারা। গলার আওয়াজটা বেশ মিষ্টি। একে বুকে জড়িয়ে ধরলে বুকের অনেকটা জায়গা ফাঁকা থেকে যাবে। যেন একটা সুন্দর পাখি।

মানবেন্দ্র বললেন, এবার সেই বইটার দ্বিতীয় খণ্ড লিখব।

ঠিক লিখবেন? লিখুন তো, দেখি, পরেরটুকুও মেলে কিনা।

পরের সব ঘটনা এখনও ঘটেনি। কিছু কিছু বাকি আছে না?

 আপনি যে এক জায়গায় লিখেছেন– ।

মানবেন্দ্র ভাবলেন, আমি পর পর তিন দিন বাড়ি থেকে একেবারেই বেরোইনি। অসহ্য লাগছিল। মানুষের মুখ দেখার জন্য তাই সন্ধেবেলা বেরিয়েছিলাম। সেখান থেকে তাপস টেনে এনেছে এখানে। একে বলে ঘটনার পরম্পরা। এর পর কী হবে?

সুস্থ থাকতে হলে, আমার দরকার কাজ। লেখালেখি ছাড়াও আরও নানা রকম প্রচণ্ড কাজের মধ্যে নিজেকে যদি ব্যস্ত রাখা যায়। আর দরকার নারী। এই যে মেয়েটি এসে বসেছে।

ঘরের অন্য সকলে তখন দেশের দুর্দিন বিষয়ে আলোচনা করছে।

মানবেন্দ্র একটু হাসলেন। এই মেয়েটি যদি জানতে পারত, তার শ্রদ্ধেয় লেখক মনে মনে কী ভাবছে। মানবেন্দ্র ভাবলেন, এখান থেকে উঠে গিয়ে মেয়েটির সঙ্গে নিরিবিলিতে এক জায়গায় কথা বলবেন। সেখানে দু-একটা অসভ্য কথা শোনাবেন ওকে। এখন একটু আদর করা ও ফস্টিনস্টি করারই তো সময়।

সেই মুহূর্তেই তার মনে হল, একটু দূরেই মানসী বসে আছে। চমকে তাকালেন। মানসীই তো। মানসী ভ্রূভঙ্গি করছে তার দিকে। মানসী অসভ্য কথা বলা একদম পছন্দ করে না। আবার দেখলেন, না। মানসী না। যে-মহিলা কথা বলার সময় ভুরু তোলে তাকে মানসী ভেবেছিলেন। অথচ এর সঙ্গে মানসীর কোনও মিল নেই।

মানবেন্দ্র একটু শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। আবার রোগের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে নাকি?

অন্যমনস্ক হবার জন্য তিনি এ-পাশের মেয়েটির দিকে ফিরে বললেন, তোমাকে আমার খুব ভালো লাগছে। আমার সৌভাগ্য যে তোমার সঙ্গে দেখা হল।

এ কী বলছেন? সৌভাগ্য তো আমারই।

পাশ থেকে মানসী বলল, সে তো অনেক দিন আগেকার কথা!

মানবেন্দ্র আবার চমকে তাকালেন। সত্যিই তো মানসী। এতক্ষণ তিনি মানসীকে দেখতে পাননি? সেই সাদা সিল্কের শাড়ি পরা।

মানসী যেই এ-পাশে মুখ ফেরাল অমনি সে আবার সেই ভুরু-তোলা মহিলা হয়ে গেল।

 মানবেন্দ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

 নতুন মেয়েটিকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নামটাই জানা হয়নি।

মেয়েটি বলল, আমার নাম নিশি। নিশি লাহিড়ী।

নিশি? এ-রকম নাম কখনও শুনিনি। নিশীথ ছেলেদের নাম হয়।

কিন্তু রাত্রি মেয়েদের নাম হয়। নিশি কেন হবে না?

মেয়েটির নাম শুনেই মানবেন্দ্রর আবার মনে হল, আজকে পুরো সন্ধেটাই অবাস্তব। এই ঘটনার অস্তিত্ব নেই, এই মানুষজনের অস্তিত্ব নেই, তিনি এখন কোনও অনূঢ়ার সঙ্গে কথা বলছেন না। এটা একটা মায়া-দৃশ্য।

তিনি মনে মনে বললেন, এরা আমার কেউ নয়। আমি এদের কেউ নেই।

অথচ বাঁচতে হলে মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে। চাই কাজ। চাই প্রেম, সহানুভূতি, ছোট ছোট সুখ। সব কিছু সম্পর্কে একটা দায়িত্ব বোধ।

মানবেন্দ্র নিশিকে জিজ্ঞেস করলেন, ভালবাসা কাকে বলে?

এ কথা আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করছেন?

 আমি জনি না। সত্যিই জানি না।

একথা বলার সময় মানবেন্দ্রর মুখখানা এমন করুণ হয়ে গেল যে, নিশি বেশ চমকে গেল। তার বয়েস কম। ভালবাসা শব্দটা শুনেই তার মুখে একটা অরুণ আভা ফুটেছে।

 মানবেন্দ্র ভাবলেন, আমি যদি এক্ষুনি আড়ালে গিয়ে নিশিকে চুম্বন করি, যদি তার বুকের আঁচল সরিয়ে– তা হলে সেটাকে নিশ্চয়ই কেউ ভালবাসা বলবে না। অথচ আমার মনে সেই রকম একটা ইচ্ছে জাগছে।

কে যেন কাঁদছে? স্পষ্ট কান্নার শব্দ শুনে মানবেন্দ্র জান পাশে তাকালেন। দেয়ালের পাশে একা বসে আছে মানসী। ব্যাখ্যা করা যায় না এমন একটা দুঃখে সে কাঁদছে। সেই বাইরে, টুরিস্ট লজ থেকে খানিকটা দূরে বড় পাথরটার ওপর মধ্যরাত্রে গৌতমের পাশে বসে যেমন ভাবে সে কাঁদছিল।

মানবেন্দ্র আর সব কিছু ভুলে গেলেন। এক দৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন সেই কান্না। তার বুকের মধ্যে দুপ দুপ শব্দ হচ্ছে, হাত কাঁপছে।

তিনি অস্ফুট গলায় বললেন, মানসী —

এর মধ্যেই ভুলে গেলেন, আমার নাম নিশি, মানসী নয় ।

মানবেন্দ্র শুনতে পেলেন, কী একটা হাসির কথায় ঘরের সবাই একসঙ্গে হাসছে। মানসী অদৃশ্য হয়ে গেছে।

মানবেন্দ্র উঠে দাঁড়িয়ে নিশিকে বললেন, আমি একটু আসছি।

কয়েক পা এগোবার পরেই তাপস তার হাত চেপে ধরে বললেন, কোথায় যাচ্ছিস?

তাপসের পাশেই এক জন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন, মানবেন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, সেই জায়গাটা কোথায়?

তাপস বললেন, ওই তো দরজা থেকেই বেরিয়ে ডান দিকে। আলাপ করিয়ে দিই। এঁর নাম মানসী চ্যাটার্জি। অ্যাসট্রো ফিজিক্স নিয়ে রিসার্চ করছেন।

মানবেন্দ্র একটুও চমকালেন না। মানসী একটা বহু প্রচলিত নাম। তিনি নিজেই আরও দুজন মানসীকে চেনেন। মহিলার মুখের দিকে ভাল করে না তাকিয়েই তিনি একটা নমস্কার করে বললেন, আমি এক্ষুনি আসছি।

বাথরুমে ঢুকে মানবেন্দ্র টলে পড়ে যাচ্ছিলেন, দেয়ালে হাত দিয়ে কোনওক্রমে দাঁড়ালেন। ভয় করছে। বাঁচতে হবে। আমি এদের কেউ নই, এরা আমার কেউ নয়। এই বাথরুম থেকে বেরুতে পারব তো?

বাথরুমটা মস্ত বড়। ঝকঝকে মার্বেল পাথর দিয়ে বাঁধানো। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। একটা দেয়াল-তাকে নানা রকম সুদৃশ্য শিশি-বোতল-টিউব।

আবার পা টলে গেল কেন? আমার কি বেশি নেশা হয়েছে? সে-রকম তো হবার কথা নয়। এখনও আমার পা কাঁপছে।

মানবেন্দ্র চুলের মুঠি আঁকড়ে ধরে বললেন, এ-রকম করলে চলবে না। আমি কেন এত চোখে ভুল দেখছি! এত স্বপ্ন নিয়ে জীবন কাটানো যায় না। সামাজিক হও, দায়িত্ববান হও, মানুষের কথা ভাবো–

বেসিনের কাছে এসে মানবেন্দ্র ভাল করে চোখে মুখে জল দিয়ে খানিকটা সুস্থ বোধ করলেন। আরও ঝাপটা দিলেন কয়েক বার। মুকে খানিকটা জল দিয়ে কুলকুচি করতেই ঠকাস করে একটা শব্দ হল। মানবেন্দ্রর মনে হল, তার একটা দাঁত খুলে গেল। বেসিনে নয়, মাটিতে।

মানবেন্দ্র ভুরু কুঁচকে দাঁতটা খুঁজতে লাগলেন। এ আবার কী ব্যাপার! হঠাৎ একটা দাঁত ভেঙে পড়বে কেন!

খোঁজাখুঁজি করে সেটা পাওয়া গেল না। বেসিনে মাথা ঠুকে গেল একবার। তবু মানবেন্দ্রর জেদ চেপে গেছে, জিনিসটা কী দেখতেই হবে।

আমি খুঁজে দিচ্ছি।

মানবেন্দ্র তাকিয়ে দেখলেন, গৌতম এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। একটু অবাক হয়ে ভাবলেন, গৌতম কী করে এল? তিনি কী বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলেন?

মানবেন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কী খুঁজবেন?

আপনার দাঁতটা!

আমার দাঁত? তার মানে? আমার কি বাঁধানো দাঁত নাকি? এই দেখুন, আমার সব দাঁত ঠিক আছে। কোনও দিন দাঁত-টাত ভাঙেনি আমার।

মানবেন্দ্র ঠোঁট ফাঁক করে নিজের দুপাটি দাঁত দেখালেন গৌতমকে।

গৌতম জিজ্ঞেস করল, আপনি তাহলে কী খুঁজছিলেন?

কী জানি। জানি না তো!

এই দেখুন, আমার দুটো দাঁত ভাঙা, আপনি সে-দিন এত জোরে আমাকে মেরেছিলেন!

মানবেন্দ্র স্তম্ভিত ভাবে বললেন, আমি মেরেছি? আপনাকে? তা কখনও হতে পারে?

সে-দিন আপনি খুব রেগে গিয়েছিলেন।

মানবেন্দ্র চিৎকার করে বলেন, অসম্ভব! অসম্ভব।

গৌতম ভদ্র ও বিনীত ভাবে বলল, মানসীকে আমি খুব ছেলেবেলা থেকে চিনি। আমরা কেউ কারুকে চাই না। আমি চাই না আমার বন্ধু অসীমকে ঠকাতে। আমি চাই না অনুরাধাকে দুঃখ দিতে। মানসীও চায় না অসীমকে দুঃখ দিতে, অনুরাধাকে দুঃখ দিতে। মানুষের এমনিতেই তো কত দুঃখ আছে। আমরা চাই না আড়ালে দেখা করতে। তবু মানসী আমাকে চুম্বকের মতো টানে। ও যেন আমারই আর একটা সত্তা।

এ-সবই তো আমি জানি।

আপনি মানসীকে চেয়েছিলেন?

 সে অন্য রকম চাওয়া।

আমি মানসীকে রাত্তিরবেলা নিয়ে গিয়েছিলাম বলে আপনি এমন রেগে উঠলেন।

মানবেন্দ্র আবার চেঁচিয়ে বললেন, এ-সব কী হচ্ছে কী? আমি পাগলের মতো একা একা বক বক করছি। কোথায় গৌতম! বন্ধ বাথরুমের মধ্যে কী কবে আসবে?

মানবেন্দ্র আবার চোখে জলের ঝাপটা দিলেন। চোখ পরিষ্কার হয়ে গেল। বাথরুমে আর কেউ নেই। তিনি নিজের গালে একটা রাম চিমটি কেটে বললেন, আমি মাঝে মাঝেই নানা রকম কাল্পনিক দৃশ্য দেখি বটে। কিন্তু মানুষ মনে মনে যা চায়, সেই রকমই তো স্বপ্ন কিংবা দিবাস্বপ্ন দেখে। তাহলে এ-রকম দেখলাম কেন? আমি কি গৌতমকে মারতে চেয়েছি? কক্ষনও না। গৌতম চমৎকার ছেলে! কারুকে মেরে দাঁত ভেঙে দেওয়া তো একটি উদ্ভট ব্যাপার।

তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে মানবেন্দ্র বেরুবেন ঠিক করছিলেন, আবার মনে পড়ে গেল দাঁতটার কথা। দাঁত বা যাই হোক, মুখ থেকে কী যে একটা ঠক করে পড়ল। কী হতে পারে? সেটা না জানতে পারলে রাত্তিরে ঘুম হবে না। মানবেন্দ্র আবার সেটা খুঁজতে লাগলেন।

খুঁজতে খুঁজতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন মাটিতে। তারপর আবার দেখলেন, গৌতম এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। মানবেন্দ্র মনের একটা স্তরে বুঝতে পারলেন, এটা চোখের ভুল, এটা কল্পনা। আর একটা স্তরে প্রশ্ন করলেন, আমার কল্পনায় আমি গৌতমকে এখানে দেখতে পাচ্ছি কেন?

মানবেন্দ্র হাত জোড় করে অত্যন্ত কাতর ভাবে বললেন, গৌতম, বিশ্বাস করো, আমি তোমার ওপর একটুও রাগ করিনি! আমি যদি ভুলেও তোমাকে কোনও কষ্ট দিয়ে থাকি, আমাকে ক্ষমা করো।

মানবেন্দ্রবাবু, আপনি এ কী করছেন? আপনি উঠুন! আপনি পৃথিবীতে যা চান, সবই আপনাকে দিতে পারি, শুধু মানসীকে ছাড়া। আমরা পরস্পরের সঙ্গে বাঁধা, তবু যদি আপনি রাগ করে থাকেন আমার ওপরে– ।

না, আমি রাগ করিনি! রাগ করিনি!

আপনি অসীমকে অপছন্দ করেন না, তার ওপর আপনার রাগ নেই, কিন্তু আপনি আমাকে ঘৃণা করেন।

না না।

আপনি সত্যি কথা বলছেন না।

গৌতম, কী করে তোমাকে বিশ্বাস করাব।

আপনি উঠুন।

না, উঠব না। আগে বলো, তুমি আমাকে ভুল বুঝবে না!

আপনি উঠুন, শিগগির উঠুন।

আমি উঠতে পারছি না। আমার পা এখানে গেঁথে গেছে।

কে যেন দরজায় দুম দুম করে ধাক্কা দিচ্ছে। আর সময় নেই। এর মধ্যে গৌতমকে বোঝাতেই হবে। মানবেন্দ্র কেঁদে ফেললেন। হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন, গৌতম, আমি রাগ করিনি। তুমি আমাকে ভুল বুঝো না, আমাকে ক্ষমা করো।

মানবেন্দ্রকে অনেকক্ষণ অনুপস্থিত দেখে তাপস ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। বাথরুমের দরজায় অনেক ধাক্কা দিতেও মানবেন্দ্র খোলেননি। সকলে তখন ভয় পেয়ে যায়। দরজার ওপরে, স্কাইলাইট সরিয়ে সেখান থেকে দেখতে পাওয়া গেল মানবেন্দ্র মেঝের ওপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন!

দরজা খুলে মানবেন্দ্রকে ধরাধরি করে আনা হল বাইরে। সেখানে বেশ কয়েক জন ডাক্তার। অনেক রকম পরীক্ষা ও বিভিন্ন উপদেশ। মানবেন্দ্রর গুরুতর কিছুই হয়নি। অতিরিক্ত মদ্যপান কিংবা অতিরিক্ত ক্লান্তি বলে ধরে নেওয়া হল।

একটি ইঞ্জেকশন দেবার পরই মানবেন্দ্রর জ্ঞান ফিরে এল। তাপস তাকে পৌঁছে দিতে এলেন বাড়িতে।

বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নেমে মানবেন্দ্র বললেন, ঠিক আছে, তোকে আর আসতে হবে না। আমার এমনিই হঠাৎ মাথা ঘুরে গিয়েছিল।

তাপস তবু এলেন ওপরে। তালা খোলার পর ঘরে ঢুকে তাপস আশ্চর্য হয়ে গেলেন।

ঘরটা একেবারে শুন্য। আগে এই ঘর বই ও জিনিসপত্তরে ঠাসা ছিল। এখন একটাও বই বা আলমারি বা চেয়ার-টেবিল কিচ্ছু না! শুধু মাঝখানে একটা খাট পাতা। সাদা চাদর ও বালিশ। বালিশের পাশে একটা লেখার প্যাড আর কলম। প্যাডের প্রথম পাতাটা খোলা, সেখানে একটা আঁচড় পড়েনি।

তাপস জিজ্ঞেস করলেন, এ কী?

মানবেন্দ্র শান্তভাবে বললেন, একটা নতুন কিছু লিখব ভাবছি, কিছুতেই শুরুটা মাথায় আসছে না।

 ঘরের সব জিনিস কোথায় গেল?

 বিক্রি করে দিয়েছি।

কেন?

এমনিই।

 তুই কি বাড়ি বদলাবি নাকি?

হয়তো।

 তাপস এবার মানবেন্দ্রর কাঁধে হাত রেখে গাঢ়স্বরে বললেন, মানু, আমি তোর পুরনো বন্ধু।

মানবেন্দ্র বললেন, চঞ্চল আমাকে ভুলে গেছে।

চঞ্চলের কথা জানিনা, তবে আমার মনের মধ্যে তোর জন্য একটা নরম জায়গা আছে। তোর কী হয়েছে আমাকে বলবি না?

তাপস, আমি আস্তে আস্তে পাগল হয়ে যাচ্ছি।

কী আজেবাজে কথা বলছিস?

 আমি ঠাট্টা-ইয়ার্কির সময়েও মিথ্যে কথা বলি না তোকে।

তাপস এবার এক ধমক দিয়ে বললেন, তোর মাথায় বুঝি এই সব ঢুকেছে। এসব শিল্পীদের খামখেয়ালিপনা। মনটাকে শক্ত কর।

আমার মন কোথায় আমি জানি না।

ডোন্ট বি অ্যান অ্যাস। শোন, আমি ডাক্তার হিসেবে বলছি। এখন চুপ করে ঘুমিয়ে থাকবি। কাল সকালে কোথাও বেরুবিনা। আমি কাল নিজে এসে তোকে আমার ইনস্টিটিউটে নিয়ে যাব। দেখবি, দুটো-চারটে ইঞ্জেকশান ফুঁড়লেই মনটা চাঙ্গা হয়ে যাবে!

আচ্ছা।

আচ্ছা মানে কী? আমার সব কথা শুনে চলতে হবে তোকে এখন থেকে।

শান্ত ছেলের মতো মানবেন্দ্র বললেন, শুনব।

এখন ঘুমো। তোর ভাল করে ঘুম দরকার।

তাপস চলে যাবার পরও মানবেন্দ্র খাটের পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। একটু পরে বললেন, ইস, মানুষের ঈর্ষা এত সাঙ্ঘাতিক হয়! নিজের চোখে আজ দেখলাম।

খুব ব্যস্তভাবে মানবেন্দ্র আবার বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। বাথরুমে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর জামা-প্যান্ট ভিজে গিয়েছিল, সেগুলো বদলাবার কথাও মনে পড়ল না। তালা না লাগিয়েই নেমে গেলেন সিঁড়ি দিয়ে। তাপসের গাড়ি কাছাকাছি নেই। বেশ রাত হয়েছে, রাস্তা জনশূন্য। মানবেন্দ্র হাঁটতে লাগলেন হন হন করে।

প্রায় দেড় ঘণ্টা হেঁটে আসার পর মানবেন্দ্র থামলেন একটা সাদা রঙের দোতলা বাড়ির সামনে। অন্তত একশো বার এই বাড়ির সামনে দিয়ে মানবেন্দ্র পারাপার করেছেন, কখনও ভেতরে ঢোকেননি।

মানসী আসতে বলেছিল, অসীম ঠিকানা দিয়েছিল, তবু আসেননি মানবেন্দ্র। মনের মধ্যে কোথাও তো একটা শক্ত জায়গা থাকা দরকার। মানসীর সামনে আবার দাঁড়াতে গেলে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক মানুষের মতোই যেতে হবে।

বড় রাস্তার ওপর দুটো ঠ্যালা গাড়ির ওপরে ঘুমোচ্ছ তাদের চালকরা। নিচে দুটো কুকুর। কাছেই একটা দুধের গুমটি। একটা ট্যাক্সি ছুটে গেল ভয়-পাওয়া গতিতে।

মানবেন্দ্র একটা সিগারেট ধরাতে গিয়ে টের পেলেন, তার বুক কাঁপছে, হাত কাঁপছে। ফিস ফিস করে বললেন, মানসী, আমি এসেছি!

সাদা বাড়িটার সবকটি ঘরই অন্ধকার। ওপর তলার বাঁ-দিকের একটি ঘরের সব কটা জানলা খোলা। মানবেন্দ্র জানেন, ওই ঘরে মানসী শোয়।

উলটো দিকের ফুটপাথে একটা বন্ধ দোকানঘরের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন মানবেন্দ্র। তাকিয়ে রইলেন সেই জানলা-খোলা ঘরটির দিকে।

একটু বাদে মানবেন্দ্র বুঝতে পারলেন, তার মন শান্ত হয়েছে। তিনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। তিনি নিম্নস্বরে বললেন, আমি বুঝতে পারিনি, আমার ভেতরে এতটা ঈর্ষা ছিল। আজ টের পেয়েছি বলেই সব পরিষ্কার হয়ে গেছে। আমি অত্যন্ত পছন্দ করি অসীম আর গৌতম দুজনকেই। তোমাকে যেমন ভালবাসি, তেমনি ভালবাসি ওদেরও। আমি ভালবাসি তোমার ভালবাসাকে। আমি সমাজের প্রভু নই। তোমার আর গৌতমের ভালবাসার বিচার করার ভার আমার ওপরে নয়।

সিগারেটের টুকরোটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে মানবেন্দ্র বললেন, এই যে রাত্রির আকাশ, এটা আমার নয়। তবু আমি একে ভালবাসতে পারি। তুমিও সেই রকম।

একটা বিড়াল গুটি গুটি পায়ে মানবেন্দ্রর অদূরে থমকে দাঁড়াল। বেশ তুলতুলে চেহারা বেড়ালটির। মানবেন্দ্র জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী?

বেড়ালটি বলল, ইডিপাশ।

 মানবেন্দ্র বললেন, ও হ্যাঁ, তাই তো! আচ্ছা, তুমি কি মানসীকে বলে দিতে পারবে যে আমি এসেছিলাম?

বেড়ালটি বলল, ওই তো মানসী, জানলায়।

মানবেন্দ্র চোখ তুলে তাকালেন। না, জানলায় কেউ নেই। মানবেন্দ্র চোখে ভুলও দেখলেন না। তিনি বললেন, আমি যদি পাগল হতাম, তাহলে ও-বাড়ির দরজায় ধাক্কা দিয়ে মানসীকে এক্ষুনি ডাকতাম। এই রাত-দুপুরে ওর সামনে হাজির হয়ে বলতাম, আমার সেই যে পূজা বাকি ছিল–। অসীমকে বলতাম, আমি কিছুই চুরি করতে আসিনি কিংবা আমি সেরকম কিছুই করিনি। এর চেয়ে আনন্দের কথা আর কী হতে পারে!

মানবেন্দ্র আবার হাঁটতে লাগলেন উলটো দিকে। বাড়ি ফিরতে হবে। নতুন লেখাটা শুরু করতে হবে এবার। আজই। মানবেন্দ্রর হাঁটার মধ্যে এখন আর ব্যস্ততা নেই। একটুক্ষণ হাঁটার পর তিনি খেয়াল করলেন, রাস্তায় আর একটাও জনপ্রাণী নেই। এত বড় একটা রাস্তায় মাত্র এক জন মানুষ থাকলে মনে হয় যেন এই রাস্তাটা তারই নিজস্ব। কিংবা, এই পথটাও যেন তার নিজের মনগড়া।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়