ভোর বেলা রেডিয়োতে প্রথম আজানের সুর বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ভরত গুপ্তর ঘুম ভাঙে। ঘুম ভাঙার পর চোখ মেলে কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে থাকেন তিনি। কোনোদিন ধড়ফড় করে উঠে বসেননি।

বিশাল ঘর, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত। তাঁর শোওয়ার খাটটিও প্রকান্ড, অন্তত ছ-জন লোক স্বচ্ছন্দে ঘুমোতে পারে, কিন্তু ভরত গুপ্তর একা ঘুমোনো অভ্যেস। তাঁর মাথার বালিশ দু-টি এবং পাশ বালিশ চারটি, বিছানার ধপধপে সাদা চাদর। ঘরের দেয়ালের রংও সাদা। এত বড়ো ঘরখানির কোনো দেয়ালে একটিও ছবি বা ক্যালেণ্ডার নেই। আয়নাও নেই।

জেগে উঠে প্রায় পনেরো মিনিট নিথরভাবে চিৎ হয়ে শুয়ে রইলেন ভরত গুপ্ত। বড়ো বড়ো নিশ্বাস নিতে লাগলেন। তিনি শবাসন করছেন।

তারপর তিনি উঠে বসলেন। হাত দু-খানি দু-পাশে ছড়ালেন, তুললেন মাথার ওপরে। ঘুম থেকে ওঠার পর মুহূর্ত থেকেই তাঁর মুখখানিতে দারুণ আত্মবিশ্বাসের ছাপ আঁকা। এই পৃথিবীতে অধিবাস সম্পর্কে তাঁর কোনো দুশ্চিন্তা নেই।

ভরত গুপ্ত দরজা খোলা মাত্র একজন চাকর ছুটে এল বারান্দা থেকে। তার হাতে পেয়ালা-পিরিচ। সে অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করে আছে। যদিও তখন সকাল সাড়ে ছটা, প্রত্যেকদিন ভরত গুপ্ত ঠিক একই সময় ঘুম থেকে ওঠেন, তবু ভৃত্যটি অনেক আগে থেকেই তৈরি হয়ে থাকে। ভৃত্যটির বয়েস পঞ্চাশের কাছাকাছি। প্রভু ও ভৃত্য সমবয়েসি। তফাতের মধ্যে এই, ভৃত্যটি বোবা। ভরত গুপ্ত ঘুম থেকে ওঠার পর এক ঘণ্টা কারুর সঙ্গে কথা বলেন না, কারুর কথা শুনতেও চান না।

পেয়ালা ভরতি চিরতার জল ছিল, ভরত গুপ্ত একটুও মুখ-বিকৃতি না ঘটিয়ে সেটুকু পান করলেন। শূন্য পেয়ালা নিয়ে ভৃত্যটি আবার ছুটে গেল বারান্দার কোণে। সেখানে ওটা রেখে আবার একটা রূপোর রেকাবি নিয়ে ফিরে এল। এতে রাখা আছে কল-ওঠা ভিজে ছোলা এবং আখের গুড়।

খানিকটা ছোলা ও গুড় মুখে দিলেন ভরত গুপ্ত, তারপর তার শোওয়ার ঘরের বিপরীত দিকের বাথরুমে ঢুকলেন।

বাথরুমটি প্রায় শোওয়ার ঘরের মতনই বড়ো। ঝকঝকে তকতকে। সাদা রঙের টালি বসানো। খাঁটি পর্সিলিনের বিরাট একটা বাথ টাব। অন্তত ছ-খানা ধপধপে সাদা বিভিন্ন আকারের তোয়ালে, অনেক রকমের শিশি ও কৌটোতে প্রসাধন দ্রব্য সাজানো রয়েছে, কিন্তু টুথ পেস্ট ও টুথ ব্রাস নেই। তার বদলে রাখা আছে আজই সকালে কেটে আনা টাটকা নিমগাছের ডাল। তাই দিয়ে তিনি দাঁতন শুরু করলেন।

বাথরুমে আলো জ্বলছিল, সেটা নিভিয়ে দিতে একটু যেন অন্ধকার বোধ হল। ভরত গুপ্ত বিরক্ত হয়ে ভুরু কোঁচকালেন। বাথরুমটা এমনভাবে তৈরি, যাতে এখানে পর্যাপ্ত আলো আসে। মুখোমুখি দু-টি বিশাল জানালায় অস্বচ্ছ কাচ বসানো, কিন্তু ওপর দিকে চার দেয়ালে আটখানা ঘুলঘুলি। অন্য দিন সেই সব ঘুলঘুলি দিয়ে বাঁকা সূর্যরশ্মি এসে সাদা মেঝেতে ঠিকরে পড়ে। ভরত গুপ্ত একবার ভাবলেন, তিনি কি চোখে কম দেখতে শুরু করলেন! দু হাতে চোখ ঘষলেন। তারপর খুলে দিলেন একটা জানলা। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন।

সকাল বেলা মেঘলা আকাশ দেখলে ভরত গুপ্তর মেজাজ অত্যন্ত খারাপ হয়ে যায়। তাঁর পরিচিত পৃথিবীতে সব কিছুই তাঁর ইচ্ছে মতন চলে। ঘুম ভাঙার পর প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যে কেউ যদি তাঁর সঙ্গে কথা বলে কিংবা তাঁর প্রয়োজনীয় কোনো একটা জিনিস যদি হাতের কাছে পাওয়া না যায়, তা হলে সঙ্গে সঙ্গেই দু-তিনজন কর্মচারীর চাকরি যাবে। কিন্তু সকালে বাথরুমে সূর্যকিরণ না আসার জন্য কারুকে শাস্তি দিতে না পেরে তিনি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। বাথরুমে প্রমাণাকারের আয়নার সামনে প্রতিফলিত হল তাঁর ক্রুদ্ধ মুখ।

বাড়িখানি তিনতলা হলেও ঘরের সংখ্যা সাতাশ। বাথরুমের সংখ্যা আট। বাড়িটির সামনে-পেছনে দু-রকমের বাগান। সামনের দিকে কেয়ারি করে সাজানো দুর্লভ জাতের ফুলের গাছ, প্রধান গেটের দু-পাশে দু-টি বিরাট ইউক্যালিপটাস। পেছন দিকটা অনেকটা শিশু উদ্যানের মতন। রয়েছে ছোটো নকল পাহাড় ও ঝরনা, শিরীষ গাছের ডাল থেকে ঝোলানো দোলনা, পুরু কার্পেটের মতন সবুজ ঘাস, এককোণে মেহেদির বেড়া দিয়ে ঘেরা খানিকটা আলাদা জায়গা, সেখানে কৃত্রিম বরফ জমিয়ে স্কেটিং রিঙ্ক তৈরির ব্যবস্থা আছে। পেছন দিকের বাগানে দু-টি ছেলে-মেয়েকে নিয়ে খেলা করছে একটি যুবতী মেমসাহেব। শিশু দুটি যমজ, চার বছর বয়েস।

বাগানের চার পাশ ঘিরে দেড় মানুষ সমান উঁচু প্রাচীর, তার ওপরে কাঁটাতার। বাড়িটির সমগ্র এলাকা সাড়ে তিন বিঘে। কলকাতা শহর।

একতলায় সবই অফিসঘর বা কর্মচারীদের বাসস্থান। তিনতলায় থাকেন ভরত গুপ্তর স্ত্রী স্বরূপা দেবী। স্বরূপা দেবীর চেহারা অত্যন্ত কুৎসিত, ছোট্টখাট্ট, অনেকটা বানরীর মতন। তবু তাঁর গর্ভে পাঁচটি বেশ সুন্দর চেহারার ছেলে-মেয়ে জন্মেছে। ইদানীং স্বরূপা দেবীর সঙ্গে তাঁর স্বামীর সারাদিনে একবারও দেখা হয় কিনা সন্দেহ। চার বছর আগে, তাঁর ইহজীবনের মতন স্বামী-সহবাস শেষ হয়ে গেছে, এখন তিনি পুজো-আচ্চায় মন দিয়েছেন। তাঁর স্বামী এখন শুধু প্রতি রবিবার দুপুর বেলা তিনতলায় এসে স্ত্রীর সামনে বসে আহার করেন। স্বরূপা দেবীর নিজের হাতের রান্না, মাত্র দু-তিনটি পদ, ওই দিন ভরত গুপ্ত নিরামিষ খান।

দোতলায় সাতখানি ঘরের মধ্যে চারখানিই ভরত গুপ্তর নিজস্ব, এর মধ্যে দু-টি ঘরে তিনি নিজে ছাড়া আর কেউ কখনো ঢোকে না। একটি ঘরে থাকেন তাঁর বৃদ্ধ কাকা। পাশের ঘরে কাকার দেহরক্ষী একজন অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান। আর একটি ঘর অনেকটা বৈঠকখানার মতন, সেটি ব্যবহার করে তার ছেলে-মেয়েরা, বিশেষ করে তাঁর ছোটো মেয়ে উজ্জয়িনী। অবশ্য ছেলে-মেয়েরা সেই সময়েই ঘরটা ব্যবহার করে, যখন ভরত গুপ্ত বাড়িতে থাকেন না।

এক ঘণ্টা পরে প্রাতঃকৃত্য সেরে ভরত গুপ্ত ধুতি ও পাঞ্জাবি পরে একতলায় নেমে আসতে লাগলেন। দোতলার বারান্দার মুখে কোলাপসিবল গেট, তালা বন্ধ। গেটের বাইরে একজন লোক অপেক্ষা করছিল, তিনি এসে দাঁড়ানো মাত্র সে প্রথমে লম্বা স্যালুট দিয়ে তারপর অতিদ্রুত তালা খুলে দিল।

একতলায় এসেও ভরত গুপ্ত প্রথমেই অফিস ঘরে ঢুকলেন না। বাইরে বাগানে এসে দাঁড়িয়ে মেঘলা আকাশের দিকে তাকালেন। ছেড়া ছেড়া মেঘ নয়, সিসের মতন রং। বাগানে ফুলগাছগুলোর অনেক ফুলের পাপড়ি মাটিতে ঝরে পড়ে আছে।

একতলাতেও ভরত গুপ্তর নিজস্ব ব্যবহার্য অফিসঘর দুটি। একটিতে বসে তিনি তাঁর কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলেন। অন্যটিতে বসেন বাইরে থেকে কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তি এলে।

এখন ঢুকলেন প্রথম ঘরটিতে। সেখানে তিনখানা খবরের কাগজ হাতে নিয়ে বসে আছেন একজন অর্থনীতির অধ্যাপক। ইনি প্রতিদিন এক ঘণ্টা ভরত গুপ্তকে সংবাদপত্র পড়ে শোনান।

ভরত গুপ্ত নিরক্ষর নন, দৃষ্টিশক্তিও ভালোই আছে, বহু দলিলপত্র তাঁকে পড়তে হয়, শুধু খবরের কাগজ তিনি নিজে পড়েন না। তার বদলে সাত-শো টাকা মাইনে দিয়ে এই অধ্যাপককে রেখেছেন। এই অধ্যাপক তাঁকে বিশেষ বিশেষ খবরগুলি পড়ে শোনান, সেই সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজার এবং ভারতের শিল্প-বাণিজ্যের প্রতিদিনকার অবস্থা ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হয়। তবে, এ আর কোনো রকমে ক্লাসের ছাত্রদের বোঝানো নয়, ভরত গুপ্ত অত্যন্ত তীক্ষ্ণধী, মাঝে মাঝে এমন জেরা করেন যে অধ্যাপককেও নাজেহাল হয়ে যেতে হয় মাঝে মাঝে।

অধ্যাপকের নাম জয়ন্ত দাশগুপ্ত। ভরত গুপ্ত এঁকে শুধু সাত-শো টাকা মাইনেই দেন-না, আরও কিছু দেন। বছরে দু-বার বম্বে ও দিল্লিতে বেড়াতে যাবার খরচ। কিছুদিন আগে অধ্যাপকের বিয়েতে তিনি দু-হাজার টাকা দামের গয়না পাঠিয়েছেন। কলেজ থেকে অধ্যাপক যা মাইনে পান, তার থেকেও সকালে এই এক ঘণ্টা কাজের জন্য তাঁর আয় বেশি।

ভরত গুপ্ত আজ ঘরে ঢুকেই বললেন, প্রফেসার, দেখো তো আজ আবহাওয়ার খবর কী? বৃষ্টি হবে?

জয়ন্ত দাশগুপ্ত তাড়াতাড়ি দেখতে গিয়ে আবহাওয়া সংবাদটা খুঁজে পেতে আরও দেরি করে ফেললেন। তারপর বললেন, হ্যাঁ, তাই তো লিখেছে। বিকেলের দিকে কয়েক পশলা বৃষ্টি–

না বৃষ্টি হবে না!

আকাশেও বেশ মেঘ রয়েছে।

না, বৃষ্টি হবে না।

অর্থনীতির অধ্যাপক হয়ে জয়ন্ত দাশগুপ্ত এইটুকু বুঝেছেন যে, চাকরি রাখতে গেলে মালিকের সঙ্গে তর্ক করতে নেই। এবং এটুকুও জানেন যে, খোশামোদ করলে খুশি হবে না এমন মালিক দুনিয়া খুঁজে পাওয়া যাবে না। সোজাসুজি, না হয় ঘুরিয়ে।

জয়ন্ত দাশগুপ্ত হেসে বললেন, কাগজে আবহাওয়া সংবাদ যা লেখে, ঠিক তার উলটো হয়। কাগজে বৃষ্টি হবার কথা লিখেছে বলেই আজ মেঘ পালিয়ে যাবে।

ভরত গুপ্ত সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, এপ্রিল মাসে মেঘ জমলেই কথায় কথায় বৃষ্টি হয় না। কাল কোনো জায়গায় বৃষ্টি হয়েছে? সারাভারতে?

কাগজ না দেখেই জয়ন্ত দাশগুপ্ত বললেন, না।

ভরত গুপ্ত চেয়ারে এসে বসলেন।

অধ্যাপক কাগজ নিয়ে পড়া শুরু করতে যাচ্ছিলেন, ভরত গুপ্ত হাত উঠিয়ে বললেন, একটু দাঁড়াও।

ভরত গুপ্ত সাদা রঙের টেলিফোনটা তুলে বললেন, আত্মারাম।

এ বাড়িতে পি বি এক্স বসানো আছে। ভরত গুপ্তকে ডায়াল করতে হয় না। একটু বাদেই টেলিফোন ঝনঝন করে বেজে ওঠে। একজনের গলা শোনা যায়, স্যার, আত্মারামজি লাইনে আছেন।

ভরত গুপ্ত বললেন, আত্মারাম, রাতে ঘুম ভালো হয়েছিল?

কে, ভরতজি? সকালেই টেলিফোন। কী সৌভাগ্য আমার। রাম রাম!

রাম রাম! ভালো ঘুম হয়েছিল?

ঘুমের দাওয়াই খেয়েছিলাম। দাওয়াই-এর জোরে ঠিক পাঁচ ঘণ্টা ঘুম হল।

তোমায় ঘুমের দাওয়াই খেতে হয়। আমার কিছু লাগে না।

আপনি ভাগ্যবান লোক।

কতবার তোমাকে বলেছি, মন্ডা-মেঠাই খাওয়া একটু কমাও; এই বয়েসে বেশি মিষ্টি খাওয়া ভালো না! যাই হোক, তারপর সব খবর ভালো?

আপনাদের পাঁচজনের দয়ায় এই একরকম।

আকাশের অবস্থা দেখেছ?

আকাশ? কেন, কী হয়েছে?

দেখোনি?

একটুক্ষণের নীরবতা। বোঝা গেল, আত্মারাম টেলিফোন ছেড়ে আকাশ দেখতে গেছে। ফিরে এসে বলল, মেঘ জমেছে, সেই কথা বলছেন? আমি ভাবলাম বুঝি পাকিস্তানিরা কিংবা চীনেরা বোম ফেলতে এল! বৃষ্টি হবে আজ।

মেঘ হলেই কি বৃষ্টি হয়?

আমাদের আলিপুরের এখানে খুব মেঘ জমেছে।

হাওয়া অফিসের কাছে তো, তাই সব মেঘ বুঝি ওদিকে যায়?

বৃষ্টি আজ হবেই।

না, বৃষ্টি হবে না।

কত?

দশ হাজার।

একেবারে দশ? পাঁচে থাকুন।

তুমি পাঁচ আমি দশ।

ঠিক আছে, আমিও দশেই রইলাম। কতক্ষণ সময়?

রাত বারোটা পর্যন্ত। ক্যাশ?

ক্যাশ। রাম রাম!

জয়ন্ত দাশগুপ্ত মুখ ফস্কে বলে ফেললেন, আপনি দশ হাজার টাকা বাজি ফেললেন?

টেলিফোন নামিয়ে রেখে, জয়ন্ত দাশগুপ্তর কথায় উত্তর না দিয়ে ভরত গুপ্ত বললেন, পড়ো!

জয়ন্ত দাশগুপ্ত তটস্থ হয়ে প্রথমে ইংরেজি কাগজ একখানা মেলে ধরলেন চোখের সামনে। হেড লাইনগুলো শুধু পড়ে যেতে লাগলেন দ্রুত। যে-খবরটা ভরত গুপ্তর পছন্দ হবে, সেটা পুরোটা শোনাবেন।

ভরত গুপ্ত আজ যেন একটু অন্যমনস্ক। বড়ো বড়ো খবরের দিকেও তাঁর আগ্রহ নেই। ইংরেজি কাগজ পড়া শেষ হয়ে গেল। এবার বাংলা কাগজ। এরপর মুব্বাই-এর ইকনমিক টাইমস বাকি আছে।

বাংলা কাগজের একটি অকিঞ্চিৎকর খবর শুনে ভরত গুপ্ত হঠাৎ বললেন, আবার পড়ো।

জয়ন্ত দাশগুপ্ত অবাক না হয়ে পারলেন না। এই খবরে ভরত গুপ্তর মতন মানুষের কোনো আগ্রহ থাকারই কথা নয়। তিনি পড়লেন, গৌহাটি, তেরোই এপ্রিল। বাংলা চলচ্চিত্র প্রদর্শনের দাবিতে বিক্ষোভ। আজ অপরাহ্ েএখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এক জমায়েতে আসামে বাংলা চলচ্চিত্র পুনঃপ্রদর্শনের দাবি জানানো হয়। গত বছরের গোলযোগের পর থেকে আসামের সর্বত্র বাংলা সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ আছে, সমস্ত হলে হিন্দি সিনেমা আসর জাঁকিয়ে বসেছে। স্থানীয় যুবসমাজ এর প্রতিবাদ জানান। এই সভায় বাঙালিদের সঙ্গে বহু অসমীয়া বুদ্ধিজীবী ও ছাত্রও উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে তাঁরা পথ পরিক্রমা করার পর জেলাশাসকের হাতে একটি স্মারকপত্র দিয়ে আসেন। খবরে প্রকাশ…

ভরত গুপ্ত প্রশ্ন করলেন, ঠিক খবর দিয়েছে, না বানিয়ে লিখেছে?

বলছে তো নিজস্ব সংবাদদাতা!

বাংলা কাগজে অনেক কিছু বানিয়ে লেখে। দেখো তো, স্টেটসম্যান-এ ওই খবরটা আছে কিনা?

জয়ন্ত তন্নতন্ন করে খুঁজেও ইংরেজিতে সেই খবরটা পেলেন না। ভরত গুপ্ত আর কোনো মন্তব্য না করে বললেন, ঠিক আছে, এবার খুঁজে দেখো তো, নদিয়া আর মুর্শিদাবাদে কেরোসিনের অবস্থা সম্পর্কে কিছু লিখেছে কিনা?

না, দেখছি না তো!

এরা খালি আমেরিকা, রাশিয়ার খবর দিতে জানে। ইকনমিক টাইমস-এ দেখো, সিমেন্টের উৎপাদন নিয়ে ওরা কী বলেছে।

জয়ন্ত দাশগুপ্ত আবার পড়তে লাগলেন। এক ঘণ্টা প্রায় হয়ে এসেছে। ভরত গুপ্তর একটা গুণ আছে, ঠিক এক ঘণ্টা হয়ে গেলেই ছুটি দিয়ে দেন। দেয়ালে বড়ো ঘড়ি টিক টিক করছে।

ভরত গুপ্ত আবার তাঁকে বাধা দিয়ে টেলিফোন তুললেন। আত্মারামকে আবার দাও তো! স্যার, আত্মারাম লাইনে আছেন। কে, আত্মারাম? ব্যস্ত ছিলে?

ভরতজি? রাম রাম। এত ঘন ঘন তলব, কী সৌভাগ্য আমার।

আত্মারাম, আমি ভেবে দেখলাম, আজ বৃষ্টি হতেই পারে না।

একটা হুকুম দিয়ে মেঘগুলো সরিয়ে দিন না।

 মেঘ থাকলেও বৃষ্টি হবে না।

বেশ তো, রাত সাড়ে বারোটার মধ্যে টাকা আপনার কাছে পৌঁছে যাবে।

অত কম টাকায় আমার পোষাবে না। ওটা যদি এক লাখ করি?

এক লাখ?

হ্যাঁ। আপত্তি আছে?

না, না, আপনি যখন বলছেন। ঠিক আছে, এক লাখই রইল। রাত বারোটা পর্যন্ত। ক্যাশ?

ক্যাশ। ঠিক আছে, রাম রাম!

জয়ন্ত দাশগুপ্তর চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে এসেছে। বৃষ্টি পড়বে কি পড়বে না, তার জন্য এক লাখ টাকা বাজি! টাকা কি এদের কাছে খোলামকুচি? আর, এই শালা ভরত গুপ্তটা যে এত মাথা মোটা তা তো জানা ছিল না। আকাশ যেরকম কালো হয়ে এসেছে, তাতে আজ বৃষ্টি হবেই।

জয়ন্ত দাশগুপ্তর মুখের ভেতরটা নিশপিশ করছে। তিনি আজ ভরত গুপ্তর সঙ্গে বাজি ধরলে এক লাখ টাকা জিতে নিতে পারতেন অনায়াসে। ওঃ, এক লাখ টাকা পেলে কত কী করা যায়। বলে ফেলবেন নাকি মুখ ফুটে কথাটা?

না, অত ঝুঁকি নিয়ে দরকার নেই। তাঁর নিজের এক লাখ তো দূরের কথা, এক হাজার টাকাও ক্যাশ দেবার সাধ্য নেই। যার টাকা থাকে না, সে কি বাজি ফেলতে পারে? জয় অবধারিত হলেও ওরা মানবে না, বলবে, আগে তোমার টাকা দেখাও! এ-রকম ঔদ্ধত্য দেখাতে গেলে যদি চাকরিটাই যায়।

মুখ তুলে জয়ন্ত দাশগুপ্ত চমকে উঠলেন। ভরত গুপ্ত তার মুখের দিকেই এক দৃষ্টে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন। লোকটা কি মনের কথা বুঝতে পারে নাকি?

ভরত গুপ্ত বললেন, প্রফেসার, তুমি অবাক হচ্ছ? কিন্তু বাজি ফেলাই তো আমার পেশা। আমার সতেরোরকম ব্যাবসা আছে, সব জায়গাতেই তো আমি বাজির খেলা খেলছি।

জয়ন্ত দাশগুপ্ত কানের পাশটা চুলকোতে চুলকোতে বললেন, আজ্ঞে, মানে, শেয়ার মার্কেট কিংবা সাপ্লাই বিজনেসে স্পেকুলেশানের একটা মানে বুঝি, কিন্তু বৃষ্টি পড়বে কী পড়বে না–

ভরত গুপ্ত এবার হা-হা করে হাসলেন। তাঁর হাসির শব্দ অত্যন্ত জোরালো এবং তার মধ্যে একটা নিষ্ঠুরতার ভাব আছে। হাসির সময় সাধারণত মানুষের চোখ ছোটো হয়ে আসে। এঁর চোখ বেশি উজ্জ্বল হয়।

হাসতে হাসতে তিনি বললেন, বৃষ্টি পড়লে আমি হারব, এই তো? তাতেও আমার কোনো ক্ষতি হবে না। আত্মারামকে আমার লাখখানেক টাকা ঘুষ দেওয়ার দরকার আছে। সেটা এইভাবে দেওয়া যাবে। আর একটা কথাও তোমরা জান না। জুয়া খেলায় হারার ক্ষমতা যার আছে, ক্ষমতা, মনে রেখো, সে-ই শেষপর্যন্ত জেতে। আচ্ছা, আজ এই পর্যন্ত—

জয়ন্ত দাশগুপ্ত উঠে পড়লেন। কেন যেন আজ নিজেকে খুব হীন মনে হচ্ছে তাঁর। ঠোঁটের কাছটা তেতো লাগছে।

ভরত গুপ্ত চেয়ারে হেলান দিয়ে বসতেই তিন চারজন লোক ঘরে ঢুকল। এরা তাঁর নানা স্তরের কর্মচারী। এরা কেউ কেউ হুকুম শুনতে এসেছে, কেউ এনেছে কাজের ফিরিস্তি। ভরত গুপ্ত কলকাতা শহরে তাঁর চারখানা অফিস বাড়ির কোনোটাতেই নিয়মিত যান না। এখান থেকে বোতাম টিপে তাঁর অধিকাংশ কাজ সারেন। এই লোকগুলি তাঁর বোতাম।

এদের মধ্যে রয়েছে ভরত গুপ্তর সবচেয়ে বিশ্বস্ত, একান্ত সচিব গণেশলাল। লোকটি রোগা, লম্বা এবং সামান্য ট্যারা।

গণেশলাল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ভরত গুপ্ত তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আসামের লোকেরা নাকি বাংলা সিনেমা দেখতে চায়? এটা কি সত্যি?

গণেশলাল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কী উত্তর দেবে খুঁজে পেল না।

ভরত গুপ্ত আবার বললেন, হুঁ, সিনেমা না দেখে বুঝি বাঁচা যায় না। ঠিক আছে, তুমি গৌহাটি আর ডিব্রুগড়ের দু-জন ম্যানেজারকে ট্রাঙ্ক-কল করো। বলো, এ মাসেই যেন ওদের হলে বাংলা সিনেমা দেখাবার ব্যবস্থা করে।

গণেশলাল বলল, কিন্তু স্যার, আসাম-মেঘালয়-মণিপুরের হিন্দি সিনেমা ডিস্ট্রিবিউশানের রাইট আমরা নিয়েছি।

কথার মাঝখানে কথা বোলো না। ম্যানেজারদের বলবে, ভালো করে যেন বিজ্ঞাপন করে। নতুন করে বাংলা বই শুরু হচ্ছে বলে ফুল দিয়ে যেন সাজায়। খবরের কাগজের লোকদের ফ্রি পাস দিয়ে নেমন্তন্ন করবে। এই মাসেই হওয়া চাই।

আচ্ছা।

আর অর্জন সিংকে একটা কল বুক করো। ওকে বলবে, সেইদিন যেন আট-দশটা ছেলেকে পাঠায় ওখানে। অসমীয়া ভাষায় শ্লোগান দেবে। কয়েক বোতল মদ খাইয়ে পাঠাতে বলো, তা হলে ভালো পারবে।

বুঝেছি। স্যার, মারামারি—গন্ডগোল যদি হয়?

—জখম করলেই হবে, খুন করার দরকার নেই। একটা-দুটো মেয়ের শাড়ি ধরে টানবে। তবে, অর্জন সিংকে বোললা, এ কাজের জন্য সে দু-হাজার টাকার বেশি পাবে না। ওর খাঁই দিন দিন বাড়ছে।

কাজটা হয়ে যাক, তারপর ক্যাপ্টেন নিমপোকে বলে ওকে একটু ধাতানি দিতে হবে!

তাই দিও। আর, আর, আর একটা কি যেন—আচ্ছা, শ্রীবাস্তবকে খবর দাও, সে যেন যত পারে সিমেন্টের পারমিট কিনে যায়—এখন এক টনও বাজারে ছাড়বে না। কত টন জমা আছে, তার হিসেবটা পাঠাতে বলো।

হিসেবে আমার কাছেই আছে।

আমাকে দেখাবে। ও হ্যাঁ, নদিয়া-মুর্শিদাবাদের দিকে যে লরি ধর্মঘটের কথা ছিল, তার কোনো খবর পাচ্ছি না তো?

স্যার, অনেক চেষ্টা করেও রিয়াজুদ্দিনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। রিয়াজুদ্দিনও তো এই সব করে।

ভরত গুপ্ত কঠোর চোখে তাকালেন গণেশলালের দিকে। চুপ করে রইলেন এক মিনিট। গণেশলাল চোখে চোখ রাখতে পারে না, মুখ নীচু করে।

ভরত গুপ্ত বললেন, গণেশ, রিয়াজুদ্দিন যদি জাহান্নামেও গিয়ে থাকে, তবু তাকে খুঁজে বার করতে হবে। কাজে অবহেলা আমি একটুও পছন্দ করি না। আমি চাই, দু-দিনের মধ্যে লরি ধর্মঘট। একটা লরিও যেন মুর্শিদাবাদ বা নদিয়ায় না ঢোকে। ওখানে যে কেরোসিন জমে গেছে, সেটা কি আমি জলের দরে বিক্রি করব?

না স্যার, আজই ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

ভরত গুপ্ত চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। তিনি কিছু চিন্তা করছেন। অন্যরা চুপ। চিন্তা করার সময় ভরত গুপ্তর চোখের মণি দুটো নড়াচড়া করে।

তিনি হঠাৎ আবার জিজ্ঞেস করলেন, সেই লোকটিকে খুঁজে পেয়েছেন?

এখনো ঠিক…

লোক লাগানো হয়েছে তো?

দশজন লোক লাগিয়েছি। কিন্তু আপনি যেমনটি বলেছেন, ঠিক সেইরকম কারুকেই তো–মানে, সেরকম কি কেউ আছে?

নিশ্চয়ই আছে। ভালো করে খুঁজুন। তাকে আমার দরকার।

তিনজনকে মোটামুটি বাছা হয়েছে। এখনো পরীক্ষা বাকি আছে। তবে, শেষ পর্যন্ত কেউই তো পাস করে না। আপনার কাছে নিয়ে আসব?

আমার কাছে আনবার আগে আপনারা ভালো করে পরীক্ষা করুন। এ জন্য যত টাকাপয়সা খরচ করতে হয় করবেন। এবারে আপনাদের কাজের ফিরিস্তি বলুন।

গণেশলাল ছাড়া বাকি তিনজন লোক এতক্ষণ নিথর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন এবার এগিয়ে এসে বলল, স্যার, সেন্ট্রালের একজন মিনিস্টার আসছেন আজ, তিনি আপনার সঙ্গে একবার দেখা করতে চান।

অবজ্ঞায় ভরত গুপ্তর মুখখানা কুঁচকে গেল। তিনি রুক্ষভাবে বললেন, আমার সঙ্গে? কেন?

তা জানি না, তিনি খবর পাঠিয়েছেন।

শ্রীবাস্তবের সঙ্গে কথা বলতে বললো। আমার সময় হবে না।

আর একজন তোক বলল, স্যার, কাল আমাদের আলিপুরের গোডাউনে পুলিশ রেড করেছিল। পাড়ার ছেলেরাও চেঁচামেচি করেছে। মনে হয়, আত্মারামজির লোকই ওদের লেলিয়ে দিয়েছে।

ভরত গুপ্ত প্রসন্নভাবে হাসলেন। বললেন, তাই নাকি? ঠিক আছে, আত্মারামের চন্দননগরের গোডাউন লুঠ করিয়ে দাও। পুলিশ-টুলিশের ঝামেলায় যেও না।

এইরকমভাবে ভরত গুপ্ত ব্যাবসার কথাবার্তায় ব্যস্ত হয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। ওদিকে অধ্যাপক জয়ন্ত দাশগুপ্ত ওবাড়ি থেকে হেঁটে বড়ো রাস্তায় এসে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন বাসের জন্য। এর মধ্যেই দারুণ ভিড় শুরু হয়ে গেছে। একটা ট্যাক্সি নেবেন কি নেবেন না, এই নিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। এমন সময় টপ করে এক ফোঁটা জল পড়ল তাঁর হাতে। তিনি দারুণ চমকে গিয়ে তাকালেন, ওপরের দিকে। আরও কয়েক ফোঁটা জল। বৃষ্টি নেমেছে।আপন মনে পাগলের মতন হেসে উঠলেন অধ্যাপক জয়ন্ত দাশগুপ্ত। এই বৃষ্টির দাম এক লাখ টাকা। ওরে বাবারে বাবা! এই বৃষ্টির মধ্যে নাচতে ইচ্ছে হয়। অন্য সময় বৃষ্টি শুরু হলেই জয়ন্ত দাশগুপ্ত অতিদ্রুত আশ্রয় নিতেন কোনো গাড়ি বারান্দায়। এখন বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে লাগলেন হাসিমুখে।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়