থাকোমণিকে খুব সহজে স্থানচ্যুত করা গেল না। একেই তো গ্ৰাম্য রমণীর জেদ, তার ওপর ভয়ে ও পরাজয়ে সে একেবারে মরীয়া হয়ে উঠেছে। দেখতে দেখতে কৌতূহলী পথচারীদের ভিড় বাড়তে লাগলো, ওলাবিবির শিকার দেখে কেউ অবশ্য খুব কাছে আসছে না, কিন্তু তাদের কথাবার্তা ক্রমেই উচ্চগ্রামে উঠছে। কেউ বলছে, এই মাগী উঠে আয়! কোথায় বসিচিস খেয়াল নেই! এখুনি কোৎকা খাবি! কেউ বলছে, মুদ্দোফরাস ডেকে এখুনি সাফ করে দাও, নইলে সাহেবরা দারুণ ক্ষেপে উঠবে। কেউ বলছে, মত্তে আর জায়গা পেলে না। এখন মহল্লা সুন্ধু রোগ ছড়াবে। কেউ এক মুঠো কড়ি ছুঁড়ে দিয়ে বললো, রক্ষে করে মা, ওলাবিবি, রক্ষে করো!

সব ভিড়ের মধ্যেই একজন আলাদা মানুষ থাকে। সে বললো, আহা রে, ছেলেটারও মুখ শুকিয়ে গ্যাচে, ওকেও রোগে ধরলো বোধহয়। এই ছেলে, পালা, এখনো পালা!

দুলালচন্দ্র এত লোক দেখে ঘাবড়ে গিয়ে তার মায়ের হাঁটু ধরে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে।

ঝমাঝম শব্দে বড় ঝাঁটার আওয়াজ করতে করতে এগিয়ে এলো দুজন ঝাড়ুদার। তাদের পেছনে পেছনে গাঁজাখের চৌকিদার। সেই চৌকিদার শেষ রাতে ফিরে তার ঝুপড়িতে ঘুমিয়ে ছিল, কিছুই টের পায়নি। এখন সে শুরু করে দিল দারুণ হল্লা।

সুপ্রিম কোর্টের বারান্দায় এরকম একটা নোংরা ঘটনা অকল্পনীয় হলেও কী করে যেন ঘটে গেছে। চতুর্দিকে চিঁড়ে, গুড়, ছেড়া কাপড় আর বমি ছড়ানো, তার মধ্যে এক মৃত বালিকা।

—এই নিকালো, আভি নিকালো। কাঁহা কা বেহুদা।

জঙ্গল থেকে লোকালয়ে ছিটকে আসা কোনো বন্যপ্ৰাণী যেমন এক কোণে বসে ফ্যাস ফ্যাস করে, থাকোমণিও সেই রকম রোঁয়া ফুলিয়ে রইলো। বুকের ওপর শক্ত করে চেপে ধরে আছে তার মরা মেয়েকে।

ঝাড়ুদারদ্বয় সিঁড়ির ওপর দু চার ধাপ উঠে আবার হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে একটি নীতিগত আপত্তি তুললো। তারা মুদা ছোবে না, তাদের কাজ শুধু ঝাড়ু দেওয়া। তাছাড়া কোন না কোন জাতের মড়া তার কি কোনো ঠিক আছে? তারা থাকোমণি এবং তার দুই বাচ্চা সমেত খানিকটা জায়গা বাদ দিয়ে ঝাঁটা চালিয়ে প্রস্থান করলো।

মুদ্দোফরাসকে খবর দিয়ে নিয়ে আসতে আসতে অনেক দেরি হয়ে যাবে, তাই চৌকিদার দৌড়ে গিয়ে দুজন মেথরানীকে ধরে আনলো। এই মেথরানীরা এ শহরে রীতিমতন প্রতাপশালিনী। এদের মধ্যে যারা সাহেবপাড়ায় শৌচাগার পরিচ্ছন্ন রাখার ভার পেয়েছে, তাদের উপার্জন বেশ ভালোই। সকালে সন্ধ্যায় এরা সাহেবদের পুরীষের পাত্ৰ মাথায় করে বয়ে নিয়ে গিয়ে পুণ্যসলিলা গঙ্গায় ঢেলে ফেলে দিয়ে আসে। বাকি সময়টা এদের ছুটি। এরা রঙীন ড়ুরে শাড়ি পরতে ভালোবাসে। এদের সরু কোমর, ভারী বুক এবং জিভগুলি ছুরির মতন। এদের জিভকে ভয় পায় না। এমন মানুষ মেলা দুষ্কর। এরা পথেঘাটে নোংরা বইবার সময় মানুষজনকে ছুঁয়ে দিলেও, এবং প্রায়ই দেয়, তার কোনো সুরাহা নেই।

মেথরানী দুজন সিঁড়ির ওপর উঠে পযায়ক্রমে থাকোমণি, জনতা এবং চৌকিদারকে উদ্দেশ করে দুর্বোধ্য ভাষায় ঝড়ের বেগে কী যেন বলে গেল। যেন ওরা সবাইকে ধমকাচ্ছে। সেই সঙ্গে তাদের রভীন শরীরে খেলে যাচ্ছে নানা তরঙ্গ। এমতপ্রকার রমণীদের কণ্ঠের ঝাল-বাক্যও দূর থেকে বেশ উপভোগ্য হয়। তাই বেশ কৌতুক পেয়ে গেল। জনতা। থাকোমণি এবং তার মৃত শিশুর বদলে মেথরানী দুটিই তখন প্ৰধান লক্ষ্যবস্তু হলো।

হঠাৎ সকলের কণ্ঠ আবার থেমে গেল একসঙ্গে। পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে এক সাহেব। ইনি এই আদালতের প্রধান বেইলিফ, খুব কাছেই থাকেন। এর নাম অ্যাভূজ, কিন্তু সাধারণ নেটিভরা এঁকে ইদুস সাহেব বলে ডাকে। ইনি নিষ্ঠুরতার জন্য বিখ্যাত। যে সব সাহেব নেটিভদের ঘৃণায় স্পর্শ করেন না, ইনি তাঁদের দলের নন। ঐর হাতের চড়-চাপড় অনেকেই খেয়েছে। একবার নিজের বাগানের মালির পেটে ইনি এমন লাথি মরেছিলেন যে, সে লোকটি পরে দেড়দিন ধরে রক্ত বমি করেছিল। সেবার সকলেই খুব প্রশংসা করেছিল। ইদুস সাহেবের পায়ের জোরের।

ইদ্রুস সাহেবকে একটি কথাও খসাতে হলো না, তাঁর কটমট চক্ষুতেই কাজ হলো।

মেথরানী দুজন এবার তড়িৎগতিতে ছুটে গিয়ে একজন খপ করে ধরলো থাকোমণির মাথার চুল, অন্যজন মৃত কন্যাটিকে কেড়ে নিতে গেল। শুরু হয়ে গেল ঝটাপটি। তার স্বামী ফিরে না এলে থাকোমণি যে কিছুতেই এখান থেকে উঠতে পারে না, সে কথা কেউ বুঝলো না।

মাতৃস্নেহের শক্তি মেথরানীদের সবল বাহুর তুলনায় কিছুই নয়। অবিলম্বেই তাদের একজন থাকোমণির কোল থেকে মৃত কন্যাটি কেড়ে নিতে সমর্থ হলো এবং দৌড় লাগালো। মেয়েটি যে মারা গেছে সে বোধই এখনো হয়নি থাকোমণির। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। এ কেমন জায়গা, যেখানে স্বামী জল আনতে গেলে আর ফেরে না, অচেনা লোকেরা দূরে দাঁড়িয়ে হাসে আর ডাকিনী যোগিনীরা এসে কোলের সন্তান কেড়ে নিয়ে যায়!

থাকোমণিও ছুটলো সেই মেথরানীর পিছু পিছু। তার পায়ে পায়ে লেগে রইলো দুলালচন্দ্র। এরপর এক একবার থাকোমণি সেই মেথরানীর কাছ থেকে মেয়েকে কেড়ে নেয়, আর মেথরানী ছিনিয়ে নেয় তার কাছ থেকে। পথের লোক এই দৃশ্য দেখছে, কেউ একটি কথাও উচ্চারণ করছে না। কয়লাঘাটা অঞ্চল পেরিয়ে তারা চলে এলো গঙ্গার ধারে। তিন চারবার কড়াকড়ির পর মেথরানীটি এক সময় মৃত শিশুটিকে জোরে আঁকড়ে ধরে খুব দ্রুত দৌড়ে শেষে ঝপাস করে সেটিকে ফেলে দিল নদীতে।

থাকোমণি সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আবার তাকে তুলে নিয়ে এলো। এবং এবার সে নিজেই ভয় পেয়ে ছুটতে লাগলো বিপরীত দিকে। যেন এইভাবেই ছুটতে ছুটতে এই শহর ছেড়ে সে ফিরে যাবে নিজের গ্রামে।

গঙ্গার পর জুড়ে একটানা শ্মশান। সাধারণ গরীবগুবো লোকেরা মৃতদেহ দাহ করে না, জলে ফেলে দেয়। প্রতিদিন নদীর বুকে এরকম অসংখ্য মৃতদেহ ভাসে। অনেকে যথেষ্ট কাঠের অভাবে মৃতদেহ অর্ধদগ্ধ অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যায়। সেইজন্যই এখানে হাড়গিলে আর শকুনির রাজত্ব। পরিত্যক্ত মৃতদেহ দেখলেই ওরা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিশাল বিশাল হাড়গিলেগুলো মাটির ওপর দিয়ে খপাৎ খপাৎ করে লাফিয়ে চলে। এক এক সময় শকুনির দলের সঙ্গে হাড়গিলেদের লড়াই বেঁধে যায়। সে এক রোমহর্ষক দৃশ্য। আর মাঝে মোঝ কেল্লা থেকে যে সময়সূচক তোপ দাগ হয়, সেই শব্দে তারা ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য কালো করে দেয় আকাশ।

চতুর্দিকে মানুষের হাড় আর করোটি ছড়ানো। এখান দিয়ে হাঁটতে গেলে পায়ে হাড় বিধে যায় অনেক সময়। মাঝে মাঝে একটুখানি জায়গা সাফ-সুতরো করে স্নানের ঘাটে যাবার পথ বানানো হয়েছে। সেই সব পথেও অনেক সময় পড়ে থাকতে দেখা যায় মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ।

গঙ্গার বুকে অসংখ্য জাহাজ। অধিকাংশই কাঠের তৈরি। অতি সম্প্রতি দু একটি কলের জাহাজ আসতে শুরু করেছে। জাহাজের আনাগোনায় এই জলপথ এখন সদা ব্যস্ত। মাঝে মাঝে জাহাজে জাহাজে ঠোকাঠুকি লাগে, কিংবা ঝড়বাদলের জন্যও, এক একটা জাহাজ হঠাৎ উল্টে যায়। তখন সেই ড়ুবে যাওয়া জাহাজ সমস্ত মালপত্ৰ সমেত নিলাম হয়, সেই নিলামে ডাক দেবার জন্য বেনীয়া আর শিপ-সরকাররা ভিড় করে জাহাজঘাটায়।

ভিজে কাপড়ে দৌড়তে দৌড়তে থাকে।মণিও এক সময় ক্লান্ত হলো। দুলালচন্দ্রও অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। সুতরাং এক জায়গায় বসে পড়ে মা ও ছেলেতে গলা জড়াজড়ি করে কাঁদতে লাগলো।

কাছাকাছি এত শ্মশান, এখানে কারুর কান্নাই বিসদৃশ লাগে না। থাকোমণি বসে আছে একটি স্নানঘাটের পথের পাশে। সে পথ দিয়ে যাবার সময় কিছু কিছু লোক দুটো চারটে কড়ি বা একটা আধলা ছুড় দিয়ে যাচ্ছে থাকোমণির কোলে। এসব দয়ার দান নয়, স্বৰ্গলোভীদের পারানি।

মৃত সন্তানকে কোলে নিয়ে শ্মশানে বসে কাঁদছে থাকোমণি, চিৎকার করে আহ্বান জানাচ্ছে তার নিরুদ্দিষ্ট স্বামীর উদ্দেশ্যে। এ যেন হরিশ্চন্দ্ৰ পালার এক দৃশ্য। কিন্তু চণ্ডালবেশী ত্ৰিলোচন দাস হঠাৎ দেখা দিল না, বরং অপরাপর চণ্ডালরা থাকোমণির প্রতি কুদৃষ্টি দিতে লাগলো।

একটু পরেই হুমহাম করে একটি চার বেহারির পালকি এসে থামলো সেখানে। পালকির দু ধারেই পদ। ফেলা। বেহারারা পালকি একটু মাটিতে রাখতেই এক ধারের পদ একটু ফাঁক হলো। সেখান থেকে একটি শিশুকে কোলে করে নেমে এলো একজন দাসী।

পালকির মধ্যে বসে রয়েছেন বিম্ববতী। পূর্ণিমা-অমাবস্যায় তাঁর গঙ্গাস্নানে আসা চাই-ই। ইদানীং তিনি ছেলেকেও সঙ্গে নিয়ে আসেন। মাত্র দু বছর বয়েস পেরিয়েছে নবীনকুমার, কিন্তু এর মধ্যেই তার দুরন্তপনার শেষ নেই। সেইজন্য বিম্ববতী এক মুহুৰ্তও ছেলেকে চোখের আড়াল করতে পারেন না। গঙ্গারঘাটে এনেও স্বস্তি নেই, যেটুকু সময় বিম্ববতী স্নান করতে নামেন একদিন তারই মধ্যে ছেলে দাসীর হাত ছাড়িয়ে জলের দিকে ছুটি লাগিয়েছিল। সে কারণে এখন দাসী ছাড়াও পাল্কির পিছু পিছু আসে বাড়ির গোমস্তা দিবাকর এবং একজন পাইক। তারা সর্বক্ষণ নবীনকুমারের ওপর নজর রাখে।

দাসী ও শিশু নেমে যাবার পর বেহারারা আবার পাব্ধি তুলে নেমে গেল ঘাটের দিকে। স্ত্রী-পুরুষের আলাদা ঘাট নেই, যে-যেখানে পারে জলে নামে। বেহারির লোকজন সরাবার জন্য চেঁচাতে লাগলো, হঠ যাও, হঠ যাও!

নিয়মিত স্নানার্থীরাও বড় বড় বাবুদের বাড়ির পালকি দেখে চিনে ফেলে। সিংগী বাড়ির পালকি এসেছে দেখে সবাই পথ ছেড়ে দিল। লোকেরা এই রকম ঘেরাটোপ দেওয়া পাল্কি দেখলেই বোঝে যে ভেতরে রয়েছে কোনো সুন্দরী রমণী। তাই তারা সেদিকে তাকিয়ে থাকে উৎসুক চোরা চোখে। যদি দৈবাৎ কখনো পদার ফাঁক দিয়ে সেই রূপবতীর দর্শন পাওয়া যায়। অনেক সময় ঠকতেও হয় তাদের। হাওয়ায় পদাৰ্ণ উড়লো একটু, আর দেখা গেল ভেতরে বসে আছে দোমড়ানো মোচড়ানো চেহারার কোনো তিনকেলে বুড়ি।

পাল্কিসমেত বেহারারা নেমে গেল বুক জলে। তারপর বিম্ববতী সমেত সেই পালকি এক একবার করে জলে চুবিয়েই আবার তুলে নিতে লাগলো। গুনে গুনে ঠিক এরকম সাতবার করার পর তারা ডাণ্ডা কাঁধে নিয়ে দাঁড়ালো স্থির হয়ে। এখন একটুক্ষণ বিম্ববতী সূর্য প্ৰণাম করবেন।

স্বর্ণ প্রতিমার মতন স্থির হয়ে বসে বিম্ববতী যুক্ত কর ঠেকালেন ললাটে! তাঁর মুখমণ্ডলে প্রশান্ত তৃপ্তি। জীবনে তাঁর আর কোনো অপূর্ণতা নেই।

অকস্মাৎ দিকমণ্ডল কাঁপিয়ে পর পর তিনবার তোপের আওয়াজ হলো। নদীতে বান ডাকবে, তার সতর্কতা। বেহারারা চঞ্চল হয়ে উঠলো।

আবার পালকি উঠে এলো ওপরে। চিন্তা দাসী নবীনকুমারকে কোলে নিয়ে নদীর দৃশ্য দেখাচ্ছিল, দিবাকরের ডাক শুনে ফিরে এলো পাল্কির কাছে। পদাৰ্ণ সরিয়ে সে ভেতরে ঢুকবার পর বিম্ববতী জিজ্ঞেস করলেন, এখানে কে কাঁদে রে?

থাকোমণি চুপ করে গেছে কিন্তু দুলালচন্দ্র তখনো কেঁদে চলেছে। বিম্ববতী সেই কান্না শুনতে পেয়েছেন। কোনো শিশুর কান্না শুনলেই তাঁর বুক কাঁপে। নিজের একটি সন্তান জন্মাবার পর তিনি জগতের সব শিশুর প্রতিই জননীমোহ অনুভব করেন এখন।

চিন্তা দাসী বাইরে উঁকি দিয়ে বললো, এক মাগী মেয়ে কোলে নিয়ে পাতর হয়ে বসে আচে, আর তার কচি ছেলেটা কাঁনচে।

বিম্ববতী জিজ্ঞেস করলেন, কেন?

এর আর কী উত্তর দেবে চিন্তা দাসী! সে ঠোঁট উল্টে বললো, খেতে পায় না বোধহয়।

বিম্ববতীর মুখে একটা পাতলা বেদনার ছায়া পড়লো। এই পৃথিবী এত সুন্দর, তবু এখানে মানুষ এত কষ্ট পায় কেন, কেন লোকে খেতে পায় না? বড়রা তবু না হয় না খেয়ে থাকতে পারে, কিন্তু শিশুদের অনাহারে রাখা ভারী অন্যায়।

-দিবাকরকে ডাক।

চিন্তা দাসী মুখ বাড়িয়ে দিবাকরকে ডাকতেই সে এসে দাঁড়ালো পাল্কির পাশে। বিম্ববতী প্রত্যক্ষভাবে দিবাকরের সঙ্গে কথা বললেন না, কিন্তু তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেন, চিন্তে, তুই দিবাকরকে বল, ঐ যে ছেলেটি কাঁদচে, ওকে ওর মাকে আর সঙ্গে যারা আচে, সবাইকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসতে। আমার বেহারাদের যেতে বল, ওরা পরে আসুক।

দিবাকর বললো, যে আজ্ঞে।

বিম্ববতীর পালকি চলে গেল, কিন্তু দিবাকর পড়লো মহা বিপদে। রাস্তা থেকে যাকে তাকে তুলে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া এক বাতিক হয়েছে গিন্নীমার।

দিবাকর গিয়ে উবু হয়ে বসলো থাকোমণির সামনে। তারপর জিজ্ঞেস করলো, অ মেয়ে, ঐ বাচ্ছাটা তো মরে গ্যাচে, ওকে কোলে নিয়ে বসে রোয়্যোচো কেন? কী হয়েছেল?

জুতো সেলাই থেকে ঠিক চণ্ডীপাঠ না হলেও দলিল দস্তাবেজ পড়া কাজ দিবাকরের। সে সাতঘাটের জল খেয়েছে। সে নানা রকম কথায় ভুলিয়ে ভালিয়ে থাকোমণি আর দুলালচন্দ্রের কাছ থেকে ওদের ঘটনাটা জেনে নিল। দুজন পুরুত এবং কয়েকজন স্নানার্থীকে জুটিয়ে এনে সে একথাও থাকোমণিকে বুঝিয়ে দিতে সমর্থ হলো যে তার কোলের শিশুটি সত্যিই মরে গেছে। ওকে আর বেশীক্ষণ এমনভাবে ফেলে রাখলে ওর আত্মার অকল্যাণ হবে।

তখন থাকোমণি আর এক প্রস্থ কান্নাকাটি করলো ও কিছু পরে মেয়েকে জলে বিসর্জন দিয়ে এলো। এবং দিবাকরের দয়ালু বাক্যে বিশ্বাস করে তার সঙ্গে সঙ্গে চললো। অবশ্য একথা থাকোমণির পক্ষে সুদূরতম কল্পনাতেও জানা সম্ভব নয় যে, তার স্বামী ত্ৰিলোচন দাস যে জমিদার প্রভুর দর্শন মানসে গ্রাম ছেড়ে এই শহরে এসেছিল, এখন সে আর তার ছেলে চলেছে সেই জমিদারেরই বাড়িতে।

জোড়াসাঁকোয় পৌঁছে দিবাকর দেখলো সিংহ বাড়ির সদর দেউড়ির কাছে একজন মোটাসোটা মধ্যবয়স্ক সাহেব দাঁড়িয়ে। হাতে একটি বড় লাঠি। দিবাকর চমকে উঠলো। সে বহুদর্শী লোক। সে এই সাহেবটিকে চেনে। ইনি হেয়ার সাহেব।

পাইক দারোয়ানদের চোখ এড়িয়ে কারুর পক্ষে ভিতরে ঢোকা সম্ভব নয়। অচেনা লোক দেখলে তারা ঘাড় ধাক্কা দেয় কিংবা আগেই কিছু সেলামী আদায় করে। সাহেব দেখে তারা একটু ঘাবড়ে গেছে। সাহেবের কথাও তারা বুঝতে পারছে না কিছুই।

দিবাকর দ্রুত গিয়ে সাহেবের পায়ে হাত দিয়ে প্ৰণাম করে ফেললো।

হেয়ার সাহেব চমকে উঠে সরে গিয়ে বললেন, আরে, করো কী, করো কী!

—সার, আপনি এখানে?

হেয়ার সাহেব বললেন, ইহা গঙ্গানারায়ণের বাপের কুঠি? আমি তাহাকে চাই।

এদিকে থাকোমণি আর দুলালচন্দ্র এত বড় বাড়ির দেউড়ি দেখে আবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ভেতরে ঢুকতে চাইছে না। দিবাকর তাদের দিকে ফিরে বললো, এসো, ভিতরে এসো, ভয় কী? গিন্নীমা তোমাদের আশ্রয় দিতে চেয়েচেন, তারপর আর কী কতা! যাও বাছা, ভেতরে যাও! থাকোমণি আবার কেঁদে উঠলো, আমাদের সে নেই। ওগো, সে মানুষটা আমাদের কোতায় খুঁজে পাবে?

সাহেবের সামনে একটু বিব্রত হয়ে দিবাকর বললো, হবে, হবে, সব হবে, তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে, ভেতরে এসো, গিন্নীমার সঙ্গে কতা বলো।

হেয়ার সাহেবের সব ব্যাপারেই কৌতূহল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ইহারা কাঁদে কেন? কী হইয়াছে?

দিবাকর বললো, হাজব্যাণ্ড লস্ট সার, গঙ্গার ঘাটে ক্রায়িং ক্রায়িং আর একটা ছোট মেয়ে, মানে ডটার সার, ডাই দিস মর্নিং:–ভেরী পুয়োর সার—

বাঁ পায়ের ওপর ডান পা রেখে কেষ্ট ঠাকুরের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে হেয়ার সাহেব সব শুনলেন। তাঁর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগলো। বয়েস হয়েছে, হেয়ার সাহেব আজকাল মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা একেবারে সহ্য করতে পারেন না।

দুলালচন্দ্ৰ কান্না থামিয়ে হাঁ করে চেয়ে আছে। তার ক্ষুদ্র জীবনে এত অল্প সময়ের মধ্যে এত রকম ঘটনার বিপর্যয়ে এক দারুণ আলোড়ন চলছে। সকালবেলা সে একটি রক্তচক্ষু সাহেব দেখেছিল, তার সামনে ডাকিনী যোগিনীরা তার মাকে মারছিল। আর এই একজন সাহেব কাঁদছে।

পকেট থেকে রুমাল বার করে হেয়ার সাহেব চোখ মুছলেন। ধরা গলায় বললেন, তোমরা ইহাদের আশ্রয় দিবে? অন্ন দিবে? ভেরি কাইণ্ড-মোস্ট গ্রেসাস–

অন্য পকেট থেকে একটি মুদ্রা বার করে দুলালচন্দ্রের হাতে দিয়ে বললো, লাও! কয়েক বৎসর পর একটু লায়েক হইলে আমার নিকট আসিও, আমি তোমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়া নিব।

দিবাকর পাইককে বললো, এদের ভেতরে নিয়ে যা। গিন্নীমা এরপর ব্যস্ত হয়ে উঠবেন। আপনি আসুন সার। এদিকে আসুন। দয়া করে এ বাড়িতে পায়ের ধুলো দিয়েচেন–

দিবাকর হেয়ার সাহেবকে নিয়ে এলো বৈঠকখানা ঘরে। সেখানে বিধুশেখর এবং রামকমল আলবোলার, নল হাতে নিয়ে বিষমকর্মের আলোচনা করছিলেন। হেয়ারকে দেখে তাঁরা অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। দিবাকর পরিচয় করিয়ে দিতে যাচ্ছিল, তার আগেই তিনি হাত তুলে নমস্কার করে বললেন, আমি ডেভিড হেয়ার। আপনাদের সেবক।

ঢোলা প্যান্ট, আর সাদা লম্বা কোট পরা, মাথার চুলগুলি প্রায় সব পেকে গেছে, তাতে চিরুনির ছোঁয়া লাগে না মনে হয়। প্রশস্ত কপালে তিনটি স্পষ্ট ভাঁজ। বয়েস যথেষ্ট হলেও এখনো বেশ বলশালী চেহারা হেয়ার সাহেবের।

হাতের লাঠিখানা দরজার পাশে রেখে তিনি একটি কৌচে বসে পড়ে বললেন, গঙ্গানারায়ণের খোঁজে আসিয়াছি। সে দুই সপ্তাহ কলেজে যায় না। সে কি ভুগিতেছে?

রামকমল বললেন, না তো, গঙ্গা তো সুস্থই আচে।

হেয়ার সাহেব বললেন, তবে সে কলেজে যায় না কেন?

রামকমল পুনরায় বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, কলেজে যায় না? কই জানি না তো!

বিধুশেখর চুপ করে আছেন। তিনি গঙ্গানারায়ণকে কলেজে যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর বিরূপতা জানিয়েছিলেন, গঙ্গানারায়ণ যে তা সঙ্গে সঙ্গে মেনে নিয়েছে, তিনি জানতেন না। তিনি হেয়ার সাহেবকে এত সামনা-সামনি দেখেননি আগে। এর কার্যকলাপ তিনি বিশেষ সুনজরে দেখেন না। বলতে গেলে এরই প্ররোচনায় ইদানীং ডাক্তারি শেখার নামে অজাত-কুজাতের মড়া কাটছে হিন্দুঘরের ছেলেরা। আর এদিকে কলেজে চালাচ্ছেন এক বিজাতীয় শিক্ষা, যেখানে ধর্মের কোনো স্থান নেই। ছেলেগুলি দিন দিন দুবিনীত আর উগ্র হয়ে উঠছে। এর ফল কখনো শুভ হতে পারে না।

কিন্তু এ সাহেবের মুখের ওপর তিনি সে ধরনের কোনো কথা বলতে পারলেন না। হাজার হোক সাহেবের জাত তো। তিনি বললেন, গঙ্গানারায়ণের বিবাহ হবে শীঘ্রই, তাই বুঝি সে কলেজে যায়

হেয়ার সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আজকাল তাঁর ধৈর্য কমে গেছে। বয়স্ক লোকদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা দেখলে তিনি হঠাৎ মেজাজ গরম করে ফেলেন। এরা দুজন জানেই না যে এদের ছেলে কোনদিন কলেজে যায় কিংবা বাড়িতে বসে থাকে।

তিনি মাথা নীচু করে নিজেকে শান্ত করলেন। তারপর একটু হেসে বললেন, গঙ্গার বিবাহ-খুব ভালো কথা-আমাদের মিঠাই দিতে ভুলিবেন না-কিন্তু সে কয়দিন বিবাহ করিবে, দুই সপ্তাহব্যাপী?

রামকমল বললেন, আজ্ঞা, না। বিবাহের এখনো কিছু দেরি আচে।

হেয়ার সাহেব বললেন, তবে কি বিবাহের চিন্তাতেই সে মজিল? এখন হইতেই কলেজে যাওয়া বন্ধ করিল?

রামকমল ব্যস্ত হয়ে বললো, না, না, কলেজ যাবে না কেন! সে কি কথা! নিশ্চয় যাবে।

বিধুশেখর একটু বিরক্ত হয়ে বন্ধুর দিকে তাকালেন। রামকমলের আগ বাড়িয়ে কথা বলার কী দরকার। সব কথাবার্তা তো তিনিই বলবেন।

রামকমল বললেন, মিঃ হেয়ার, স্যার, আপনি কী খাইবেন? প্রথমে একটু তামাকু সেবন করিবেন?

হেয়ার বললেন, আমি ধূমপান করি না।

—তবে কি একটু মদিরা ইচ্ছা করেন? ব্র্যাণ্ডি, বীয়ার, ওয়াইন?

—ধন্যবাদ, আমি মাদক গ্ৰহণ করি না।

—সে কি স্যার, আপনি ড্রিংক করেন না?

—সুরা ব্যতীত অন্য পানীয় গ্রহণ করি। কিন্তু এখন কোনো কিছুর প্রয়োজন নাই।

রামকমল সিংহ চমৎকৃত হলেন। জাতিতে সাহেব, অথচ বলে কিনা সুরাপান করে না? কবে শোনা যাবে বাঘ-সিংগী নিরামিষ খায়! ডেভিড হেয়ার সাহেবটি সত্যিই বড় অদ্ভুত!

—তবে সামান্য কিছু মিঠাই? হেয়ার সাহেব বললেন, একবার গঙ্গার সহিত দেখা হইতে পারে কী?

—নিশ্চয়, নিশ্চয়। বলে রামকমল তৎক্ষণাৎ উঠে গিয়ে ভেতর বাড়ির দিকে মুখ করে ডাকলেন, গঙ্গা! গঙ্গা! ওরে, কে কোথায় আচিস, গঙ্গাকে একবার খপর দে!

ফিরে এসে রামকমল বললেন, আপনি এসেচেন বলে আমরা ধন্য হয়িচি। আপনি মহাদাশয়, নিঃস্বার্থভাবে এ দেশীয় বালকদের শিক্ষার জন্য যা পরিশ্রম করচেন!

বিধুশেখর ভ্রূ কুঞ্চিত করে এক মনে আলবোলা টেনে যেতে লাগলেন।

হেয়ার সাহেব নিজের প্রশংসা শুনে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলেন। তারপর হাত তুলে রামকমলকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আপনারা দেশের প্রধান ব্যক্তি, আপনাদের সাহায্য ছাড়া কিছুই সম্ভবে না। আপনারা আর একটু যত্ন লউন।

সাহেবদের সাহচর্যে এলেই রামকমল বিগলিত হয়ে যান। তিনি হাত জোড় করে বললেন, আমি তো কলেজ স্থাপনের সময় বড় ডোনেশান দিয়িচি। পুনরায় যদি বলেন

হেয়ার সাহেব বললেন, সে কথা ঠিক, আপনার সাহায্য দিতে কাপণ্য করেন নাই। কিন্তু আরও প্রয়োজন নৈতিক সাহায্যের।

এই সময় লাজুক মুখে গঙ্গানারায়ণ এসে ঢুকলো। হেয়ার সাহেব সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো, তুমি আমার সঙ্গে কিছুক্ষণের জন্য বাহিরে যাইবে। জেন্টেলমেন, আমি যদি ইহাকে সঙ্গে লই, আপনাদের আপত্তি আছে কি?

এবারও বিধুশেখর কিছু বলার আগেই রামকমল বললেন, বিলক্ষণ না! আপনার সঙ্গে যাবে, তা আবার আপত্তি!

হেয়ার সাহেব কড়া গলায় গঙ্গানারায়ণকে বললেন, বিনা খবরে তুমি কলেজ যাওয়া বন্ধ করিলে কেন? চলো, আজ তোমার শাস্তি হইবে-।

সাহেব এসেছে শুনে চিন্তা দাসী নবীনকুমারকে কোলে নিয়ে দেখতে এসেছে। নবীনকুমার হাত বাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে এলো, যেন সে হেয়ার সাহেবের কোলে উঠতে চায়।

হেয়ার সাহেব তাকে অমনি কোলে টেনে নিয়ে শিশু শরীরের গন্ধ শুর্কতে লাগলেন। তারপর খুশী হয়ে বললেন, এ কুঠিতে পরিচ্ছন্নতা আছে বটে! এ কার সন্তান?

রামকমল বললেন, আমার। এ আমার কনিষ্ঠ সন্তান।

হেয়ার সাহেব বললেন, বাঃ, বড় সুন্দর শিশুটি। ইহার খুব বুদ্ধি হইবে।

একটুক্ষণ নবীনকুমারকে আদর করে তিনি তাকে ফিরিয়ে দিলেন পিতার কাছে। তারপর গঙ্গানারায়ণের কাঁধে হাত রেখে বললেন, চলো!

সকলে সদর দেউড়ি পর্যন্ত গেল হেয়ার সাহেবের সঙ্গে। তিনি যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন তখন কান্না জুড়ে দিল নবীনকুমার। সেও যেন হেয়ার সাহেবের সঙ্গে যেতে চায়।

হেয়ার সাহেব। আবার ফিরে এসে নবীনকুমারের গাল টিপে দিয়ে বললেন, আবার আসিবো। আমি ঘোড়া হইলে তুমি আমার পিঠে চড়িতে পরিবে কি?

নবীনকুমার হেয়ার সাহেবের স্কন্ধ শক্ত করে চেপে ধরলো। এই শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তিটিকে তার খুব পছন্দ হয়েছে।

হেয়ার সাহেব নবীনকুমারকে দু হাতে তুলে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে আবার লুফে নিলেন সঙ্গে সঙ্গে। নবীনকুমার বেশ মজা পেয়ে হাসতে লাগলো। হেয়ার সাহেব বললেন, বাঃ, ভয় পায় না। আমি বলিতেছি, পরে মিলাইয়া দেখিবেন, এই সুশ্ৰী বালকটি কালে কালে অসাধারণ হইবে!

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়