বাবু বিশ্বনাথ মতিলাল এক পুরুষেই প্রচুর টাকা রোজগার করেছেন। অন্য অনেকের মতন তাঁরও ভাগ্য ফিরেছে নুনে।

লুণ্ঠনপর্বের গোড়ার দিকে ইংরেজ কোম্পানি কাতারে কাতারে জাহাজে এ-দেশ থেকে মালপত্র ভরে নিয়ে যেত নিজের দেশে। ফেরার সময় তার অধিকাংশ জাহাজই খালি আসতো। ও-রকম খালি জাহাজ নিয়ে গভীর সমুদ্রে পাড়ি দেওয়া বিপজ্জনক, ঝড়ের সময় সেগুলো খেলনার মতন পলকা হয়ে যায়, উল্টে যায় হঠাৎ। তাই সাহেবরা সেই জাহাজগুলি সবচেয়ে সস্তা জিনিস, নুন দিয়ে ভর্তি করে আনতে শুরু করে। প্রথম প্রথম সেই নুন এমনি ফেলে দেওয়া হতো। কিন্তু অচিরেই বণিক জাতির চৈতন্যোদয় হলো। ফেলে দেবার দরকার কী, এই নুনও বিক্রি করা যায়। সাত সমুদ্র তের নদীর পাড় থেকে নুন আমদানী করার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। যদিও বিলিতি নুন ও ভারতীয় নুন একই রকমের নোনতা, তবু এ-দেশের ডামাডোলের মধ্যে ইংরেজ নানা কৌশলে সেই নুন বিক্রি করা শুরু করলো। দিশী বাজারে নুন চালাবার জন্য সাহায্য নিল কিছু কিছু দিশী লোকের।

ক্ৰমে ক্রমে এখানকার সমগ্র লবণ ব্যবসাটিই ইংরেজ একচেটিয়াভাবে গ্ৰহণ করে। লবণ অর্থাৎ করকাচ, যা শুধু সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য এবং নতুন ব্যবসায়ীদের কেরামতিতে যার দাম যখন তখন লম্বফ দিয়ে বাড়ে। দেশী উৎপাদকদের বঞ্চিত করে বিদেশী বণিকদের লভ্য বৃদ্ধি এবং সেই সঙ্গে নিজেদেরও সংস্থান করে নিয়েছিল কিছু দেওয়ান ও উপদেওয়ানরা। আদি যুগের কলকাতার অনেক ধনীই প্রকৃতপক্ষে এই নুনের গোলাম।

বাবু বিশ্বনাথ মতিলাল বড়লোক হবার পর শেষ বয়েসে গান-বাজনা, হাফ-আখড়াই আর শখের যাত্রা নিয়ে খুব মেতেছিলেন। তাঁর অগাধ বিষয় সম্পত্তি ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দিয়েছিলেন উত্তরাধিকারীদের মধ্যে। বাড়ির কাছেই তিনি যে একটি মস্ত বড় বাজার বসিয়েছিলেন, সে বাজারের মালিকানা তিনি লিখে দিয়েছিলেন তাঁর এক ছেলের বউয়ের নামে। সেই বউরাণীর বাজারের নামই লোকের মুখে মুখে হয়ে যায়। বউবাজার। ক্রমে পুরো পল্লীটিরই ঐ নাম হয়।

বউবাজার পাড়াটি বড় বিচিত্ৰ। অনেককাল থেকেই এ পল্লীতে বারবনিতাদের রবরবা। বড় মানুষরা তাদের রক্ষিতাদের জন্য আলাদা বাড়ি করে দিয়েছে। ভাগ্যান্বেষণে অনেক মুসলমান ও পশ্চিমা বাঈজীরাও তাদের জীবন্ত শিল্পপসরা সাজিয়ে বসেছে এখানে। পাইকার, ব্যাপারী আর মুকূলে রবিবাসের জন্য সরাইখানাও গজিয়ে উঠছে অনেক যেখানে শস্যা ও শয্যাসঙ্গিনী দুই-ই মেলে।

তাছাড়া এখানে আছে এমন কালীমন্দির যেখানে সাহেবরাও আসে পুজো দিতে। সব ব্যাপারেই সাহেবদের অগ্রাধিকার বলে, যেদিন সাহেবরা কোনো কিছুর মানত করে ডালি সাজিয়ে পুজো দিতে আসে সেদিন পুরুতরা অতি উৎসাহে নেটিভ নিত্য-পূজার্থীদের হাত দিয়ে ঠেলে দিতে দিতে বলে, হঠ যাও, হঠ যাও, আগে গোরা পূজা, আগে গোরা পূজা। সাহেবরা ভক্তিভরে পায়ের জুতো খুলে মাথা নীচু করে কালী মূর্তির দিকে এগিয়ে যায়।

হাফ-আখড়াই, শখের যাত্রা, বুলবুলির লড়াইতে এ পাড়া প্রায়ই জমজমাট থাকে। ইদানীং উড়িষ্যা থেকে আগত গোপাল নামে একটি ছেলে বিদ্যাসুন্দরের গান গেয়ে সবাইকে খুব মাতিয়ে রেখেছে। শোনা যায়, ঐ গোপাল আগে পথে পথে কলা বিক্রি করতো। একদিন সে বাবু বিশ্বনাথ মতিলালের বাড়ির বাইরে হাঁক দিয়েছে, চাই কলা, চাঁপা কলা-আ-আ-অমনি বাড়ির মালিক বৈঠকখানা ঘরে বসে কান খাড়া করলেন। দু-তিনবার সেই কলাওয়ালার হাঁক শুনে বাবু বিশ্বনাথ মতিলাল তাঁর বয়স্য রাধু সরকারকে বললেন, শুনচো, রাধু, লোকটার গলা শুনচো? খাঁটি কোমল গান্ধার লাগেচে। কেমন খেলাচ্চে সুরটাকে। ওরে কে কোথায় আচিস, ধরে আন। লোকটাকে ধরে আন।

সেই গোপালকে নিয়ে গড়া হলো যাত্রা পাটি। তার গলার গান এখন লোকের মুখে মুখে ফেরে। মদন আগুন জ্বলছে দ্বিগুণ কল্পে কি গুণ ঐ বিদেশী!

বউবাজার পাড়ার নানা গলির মধ্যে পুরোনো আমলের অনেক বাবুদের বাড়ি রয়েছে। শহরে জনসংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, তাই সেই সব অনেক বাড়ির বৈঠকখানা এখন ভাড়া দিয়ে দেওয়া হচ্ছে বহিরাগতদের। একখানা দুখানা ঘরে কোনো রকমে মাথা ওঁজে থাকে দশ-বারো জন পুরুষ মানুষ। নিত্য নতুন গজিয়ে উঠছে। এ রকম এক একটা মেসবাড়ি। সাধারণত একজন কেউ কলকাতার চাকরি পেয়ে ও রকম ঘর ভাড়া নেয়, তারপর গা থেকে ছেলে, ভাই, ভাগ্নেদের আনিয়ে কলকাতার ইস্কুলে ভর্তি করে দেয় কিংবা চাকরির উমেদারিতে লাগায়। ক্ৰমে ক্ৰমে দূর সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজন কিংবা তাদের সুপারিশ নিয়ে কেউ কেউ চাকরির ধান্ধায় এসে জুটে যায় সেখানে। থাকা তো বিনামূল্যে বটেই, খাওয়াও প্ৰায় আধলা না খরচ করে, তার বদলে রান্না করা, বাসন মাজার কাজগুলো করে দিতে হয়, এই যা!

বউবাজারের পঞ্চাননতলা গলিতে এ রকম কাছাকাছি দুটি মেসবাড়ি আছে। একটি চালান জয়রাম লাহিড়ী। দুখানি ঘর ও এক চিলতে ছাদে মোট তের জন মনুষ্য থাকে। জয়রাম ধীর, স্থির, নিষ্ঠাচারী ভদ্রমানুষ। কিন্তু জীবিকা অর্জনের জন্য তাঁকে সারাদিন প্রায় মুখের রক্ত তুলে শ্রম করতে হয়। সকালে নাকে মুখে কিছু অন্ন গুঁজে তিনি বেরিয়ে যান, ফিরতে ফিরতে রাত্ৰি নটা-দশটা বেজে যায়। তিনি কাজ করেন খিদিরপুরে এক সাহেবের অধীনে। মাঝে মাঝে সাহেবের সঙ্গে তাঁকে দু-চার দিনের জন্য মফঃস্বলে যেতে হয়। স্বগ্রামের যে-সব লোকেরা তাঁর কাছে এসে আশ্রয় চায়, তিনি কারুকেই বিমুখ করেন না, এত বড় একটা সংসারের খরচ তিনি একা জোগান, এছাড়া কারুর স্কুলের বেতন, কারুর যাতায়াতের ভাড়াও তিনি দিয়ে যান নিয়মিত। অতিশয় ভালো মানুষ বলেই তিনি খেয়াল করেন না যে, এত রক্ত-জল-করা পরিশ্রমের টাকায় তিনি কতকগুলো কুলাঙ্গার পুষছেন।

জয়রাম লাহিড়ীর পোষ্যরা পাড়ার মধ্যে একটি আতঙ্কবিশেষ। তাদের গোদাগোদা চেহারা, বিকট গলার আওয়াজ।। জয়রামের সামনে তারা চুপেচাপে থাকে, আর জয়রাম বাসা থেকে বেরুলেই তারা নিজমূর্তি ধরে। তাদের মধ্যে তিনজন মোটে সামান্য চাকরি জুটিয়েছে, বাকিরা সর্বক্ষণ বাসায় বসে গুলতানি করে আর মদ গাঁজা খায়। এমন কি যে তিনটি কিশোর আছে দলের মধ্যে, স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হলেও তারা ক্লাসে যায় না। বড়োরা তাদের দিয়ে জোর করিয়ে বেশী কাজ করায়। এমনও দেখা গেছে, বুড়োধাড়িরা সারা গায়ে তেল মেখে হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে কুয়োর ধারে, আর সেই তিনটি কিশোর অবিরাম জল তুলে তুলে তাদের মাথায় ঢালছে। সারা দুপুর ধরে চলে এই স্নানপর্ব।

কিশোরদের মধ্যে একটির নাম রামচন্দ্ৰ। পল্লীর লোকে বলে, বাবাঃ, এ আপদের নাম রামচন্দ্ৰ কে রেখেছে? এর নাম হওয়া উচিত ছিল হনুমানচন্দ্ৰ! সেই রামচন্দ্রের উপদ্রবে প্রতিবেশীরা অস্থির। চৌদ্দ-পনেরো বছর বয়েস হলেও তার বেশ ঢ্যাঙা চেহারা, গায়েও যথেষ্ট শক্তি আছে। আর পুলির গলিতে একটা ইস্কুলে তার নাম লেখানো আছে বটে, কিন্তু সেখানে সে যায় কদাচিৎ। পাড়ার মধ্যে কোনো ফেরিওয়ালা এলে সে কিছু না কিছু চুরি করে পালাবেই। জামরুল, আম, কলা যাই হোক না। এক থাবা দিয়ে তুলে নিয়ে সে দৌড়ে কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায়।

ও বাড়ির বয়স্কদের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যক্তিটির নাম হরিবল্লভ। তার কীর্তি-কাহিনী এমনই ছড়িয়ে গেছে যে, এমন কি তার কিছু কিছু জয়রামেরও কানে গেছে। এর মধ্যে দু-বার জয়রাম নিজের চেষ্টায় সেই হরিবল্লভকে চাকরি জুটিয়ে দিয়ে বলেছেন, বাপু, তুমি এবার নিজে পৃথক বাসা ভাড়া নেও। হরিবল্লভ দু-চার দিনের মধ্যেই সেই চাকরি খুইয়ে মুখ কাচুমাচু করে ফের জয়রামের পা জড়িয়ে ধরে। জয়রাম আর কিছু বলতে পারেন না।

হরিবল্লভের আসল কাজ, অন্য যারা চাকরি করে তাদের কাছ থেকে টেকসো আদায় করা। কে কোনদিন বেতন পায়, সেই হিসেব তার নখদর্পণে, সেই সেইদিন সে তাকে তাকে থাকে। সেদিন তার ওপরে হামলে গিয়ে পড়ে, বলে, দে শালা, টাকা দে। ফুর্তি করবো, তুইও ফুর্তির ভাগ পাবি।

ফুর্তি করার নিত্য নতুন উপায় বের করে হরিবল্লভ। তার প্রধান সাগরেদ ঐ কিশোর রামচন্দ্ৰ। বিকেল হলে ছাদে খোলা হাওয়ায় খালি গায়ে বসে থাকে হরিবল্লভ, আর রামচন্দ্ৰ ছিলিমে গাঁজা সেজে দেয়। দুজনে ভাগাভাগি করে ছিলিম টানতে টানতে নানা রকম ফন্দী-ফিকির আঁটে। হরিবল্লাভের গায়ের রঙ কুচকুচে কালো, বুকে পিঠে বড় বড় লোম। লোকে বলে জাম্বুবান আর হনুমান পাশাপাশি বসে আছে।

মেসবাড়িতে কোনো স্ত্রীলোক থাকে না বলে পুরুষগুলোর জিভেরও কানো বয়া নেই। ছোটবড় ভেদও মানে না। যে-কোনো রকম কুকথা তারা অনর্গল বলে যায়। যখন তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে, তখন এমন সব কুৎসিত বাক্যের স্রোত বইতে থাকে যে পথচলতি লোকেরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে শোনে।

জয়রাম কাৰ্য উপলক্ষে মফঃস্বলে গেলে এ বাড়ির লোকদের পোয়া বারো। তখন তারা একাধিক সস্তা বেশ্যাকে পথ থেকে ডেকে নিয়ে আসে বাড়ির মধ্যে। তারপর সারারাত ধরে চলে। হল্লা। আশপাশের বাড়ির শিশুরা হঠাৎ ঘুম ভেঙে ভয় পেয়ে কেঁদে ওঠে। মায়েরা চুপ চুপ চুপ করে সেই শিশুদের পিঠ চাপড়ে আবার ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করে। স্বামীদের দিকে তারা জ্বলন্ত চোখে তাকায়। স্বামীরা মুখ ফিরিয়ে থাকে। হরবল্লভ আর তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের সবাই ডরায়।

একদিন মাঝরাতে ও বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো একটি মেয়ে। মেয়েটি স্বৈরিণী হলেও বোধ হয়। ওদের অতখানি অত্যাচার সহ্য করতে পারেনি, তাই পালিয়ে আসতে চেয়েছিল। তার পেছন পেছন তেড়ে এলো হরবল্লভ হাতে একটা গোল করে পাকানো মোটা দড়ি, স্খলিত গলায় সে গান গাইছে আমার এ বিনোদ মালা, পরাবো সখী তোর গলায়।

হরিবল্লাভের হাত থেকে বাঁচবার জন্য মেয়েটি একবার এ-বাড়ি একবার ও-বাড়ির দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে দুম দুম করে। যদিও মেয়েটি জানে, কেউই তাকে আশ্রয় দেবে না। যে মেয়ে একবার পথে বেরোয়, কোনো বাড়িতে তার আর স্থান নেই।

পাড়ার প্রায় সব বাড়িই তখন অন্ধকার। গোলমালে কেউ কেউ জেগে উঠলেও সাড়া শব্দ করছে না। শুধু আলো জ্বলছে একটি বাড়িতে। সেজবাতি জ্বেলে একটি রোগা পাতলা চেহারার একুশ-বাইশ বছরের যুবক গভীর মনোযোগের সঙ্গে কিছু লিখছিল। স্ত্রীলোকের আর্ত চিৎকারে তার একাগ্ৰতা নষ্ট হলো। প্রথমে একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বোঝার চেষ্টা করলো ব্যাপারটা। ঘরের মধ্যে আরও কয়েকজন ঘুমিয়ে আছে। তাদের পাশ কাটিয়ে সে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। রাস্তায় কোনো বাতি নেই, তাই সহসা কিছু দেখা যায় না। তারপর সে দেখলো, পথের মোড়ে একটি স্ত্রীলোককে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে। একজন পুরুষ। হরিবল্লভ গান ছেড়ে এখন কর্কশ গলায় চিৎকার করছে, চল মাগী! আগে পয়সা নিইচিস, এখন ছেনালী! আজি বেঁধে রাখবো তোকে!

কণ্ঠস্বর শুনেই হরিবল্লভকে চিনতে পারলো যুবকটি। নতুন কিছু নয়, এ রকম প্রায়ই ঘটে। যুবকটি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। একবার সে ভাবলো ছুটে যাবে মেয়েটিকে সাহায্য করবার জন্য, কিন্তু ততক্ষণে ও বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেছে।

সেই যুবকটিও একটি পারিবারিক মেসবাড়িতেই থাকে। এ বাড়িতে বয়ঃজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিটির নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গে তাঁর নিজের তিন ছেলে, তাঁর ভাইয়ের দুই ছেলে, বোনের দুই ছেলে, শ্যালিকার এক ছেলে এবং পুরোনো ভৃত্য শ্রীরাম নাপিত। এছাড়াও মাঝে মাঝেই গ্রাম থেকে তাঁর অন্য ছেলে এবং আরও আত্মীয়-স্বজন এসে থাকে। ঠাকুরদাস মাইনে পান দশ টাকা, তাই দিয়েই অনেকদিন পর্যন্ত তিনি কলকাতার বাসা খরচ এবং ছেলেদের শিক্ষার খরচ চালিয়েছেন। তাঁর ছেলেরা পড়াশুনোয় ভালো, বড় ছেলে ঈশ্বর সংস্কৃত কলেজের নামকরা ছাত্র, মাঝে মাঝে সংস্কৃত শ্লোক রচনা প্রতিযোগিতায় কৃতিত্ব দেখিয়ে পঞ্চাশ-একশো টাকা পুরস্কার পেয়ে সে টাকা তুলে দিয়েছে। বাবার হাতে। মাসে আট টাকা ছাত্রবৃত্তিও পেয়েছে সে। এ বাড়িতে একমাত্র বিলাসিত মাঝে মাঝে বিকেলবেলা বার্তাসা খাওয়া।

ঈশ্বর পড়াশুনোয় ভালো হলেও ছেলেবেলা থেকে দারুণ গোঁয়ার। কোনো একটা কিছু জেদ ধরলে কিছুতেই ছাড়বে না। তার জেদের জন্য এক এক সময় ঠাকুরদাস ওকে মারতে মারতে আধমড়া করে ফেলেছেন, তবু ছেলে জেদ ছাড়েনি। ঠাকুরদাস এখন মারধোর বন্ধ করলেও মাঝে মাঝেই বলেন, আমার এই ছেলেটা একটা ঘাড় বেঁকা এঁড়ে গরু!

সংস্কৃত কলেজের পাঠ সেরে সম্প্রতি ঈশ্বর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে। সেরেস্তাদারের চাকরি পেয়েছে। মাইনে বেশ ভালোই, পঞ্চাশ টাকা। তার কাজ সাহেব সিভিলিয়ানদের দেশীয় ভাষা শিক্ষা দেওয়া। এ-দেশ শাসন করতে এসে সাহেবরা বুঝেছে, এ দেশের ভাষা না শিখলে এ দেশবাসীর মর্মে প্রবেশ করা যাবে না। সাহেবদের সংস্পর্শে এসে ঈশ্বরও বুঝেছে যে তাকেও ইংরেজি ভাষাটা শিখতে হবে। রাজভাষা না শিখলে রাজ সংসর্গে থাকা যায় না। সকালে ও সন্ধ্যেবেলা সে নিয়ম করে ইংরেজি ও হিন্দী শিখছে। প্রায়ই তার রান্না করার পালা থাকে। চাকরি সেরে এসে সে রান্নাবান্না সেরে নেয় দ্রুত, খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকলে সে ছোট ভাইদের পড়া বলে দেয়। তারপর সকলে ঘুমিয়ে পড়লে সে নিজের পড়াশুনো নিয়ে বসে। খুব গভীর রাত্রে সে লেখে। রাত জাগার ব্যাপারে তার কোনো ক্লান্তি নেই। বাইশ বছর বয়েস হলেও তার রোগা পাতলা ছোট্টখাট্টো চেহারা, শরীরের তুলনায় মাথাটা বড়।

একদিন বিকেলে কর্মস্থল থেকে ফেরার পথে ঈশ্বর এক মুদিখানা থেকে আধা পয়সার ছোলা। কিনছে এমন সময় তার কাঁধে কে যেন থাবড়া মারলো। ঈশ্বর ফিরে দেখলো, তার বন্ধু মদনমোহন।

মদনমোহন ঈশ্বরের চেয়ে বয়েসে কিছু বড় হলেও দুজনে বাল্যকালে সহপাঠী ছিল বলে গভীর বন্ধুত্ব জন্মে গেছে। মদনমোহনের মাথা কামানো, মাঝখানে মস্ত বড় টিকি। স্বভাবটা তার দিলাদরিয়া ধরনের। মদনমোহন সেই মুদিখানায় মুড়ি কিনতে এসেছিল।

মদনমোহন বললো, কি হে বাঁড়ুজ্যের পো! অ্যাতখানি ছোলা কোন কাজে লাগবে? ছোলার চাষ দিবে নাকি?

ঈশ্বর হেসে বললো, হ্যাঁ, চাষের কাজটা আমি ভালো পারি বটে। ছেলেবয়েসে কাস্তে হাতে নিয়ে চাষীদের সঙ্গে মাঠে ধান কাটতে যেতাম।

মদনমোহন বললো, নাও, মুড়ি খাও! আমি ভেবেছিলাম, তোমার রসনাই কাস্তের সমান, সত্যকারের কাস্তে হাতে নেবার তোমার দরকার নাই! তা অ্যাতখানি ছোলা। কিনলে কোন কম্মে?

—বাড়িতে তো খাবার লোক কম নাই। আমাদের ওদিককার লোকদের পেট বড়ো হয়। আমার ভাইগুলো একদিক থেকে হালুম হালুম করে খায় আর সমানে হাগে।

—এত পরিমাণ ছোলা তো বিশ-পচিশজনেও খেয়ে শেষ করতে পারবে না।

–ধরো, এখন আমাদের বাড়িতে এগারোটা পেট। সকালে এই ছোলা ভিজিয়ে রাখলে বিকেলে বেশ ড়ুমো ড়ুমো হয়। সেই দিয়ে বিকেলের জলখাবারটা বেশ চলে যায়। সব শেষ করতে পারে না, যতগুলো বাঁচে তা রাতের কুমড়োর তরকারির মধ্যে মিলিয়ে দেই। অমনি সেটা কুমড়োর ছক্কা হয়ে যায়, আর তাতে স্বাদও বাড়ে। শুধু একঘেয়ে কুমড়োর ডালনা আর রোজ ভালো লাগে না।

—বিকালেও ছোলা আর রাত্ৰেও ছোলা? আর সকালে কী খাও?

–আদা!

—হেঃ হেঃ হেঃ হেঃ! সেইজন্যই স্বাস্থ্যটি চমৎকার!

গল্প করতে করতে দুই বন্ধু হাঁটতে লাগলো। রাস্তা দিয়ে। ঈশ্বরের বাড়িই কাছে। ঈশ্বর মদনমোহনকে অনুরোধ করলো, তার বাড়িতে একটু বসে যেতে। পঞ্চাননতলার গলিতে সেদিনও হরিবল্লভ আর তার চ্যালারা হুড়োহুড়ি লাগিয়েছে। রামচন্দ্ৰ এক দইওয়ালার বাঁকে ঝোলানো দইয়ের ভাঁড় থেকে এক খাবলা দই চুরি করতে গিয়ে পুরো ভাঁড়টিই ভেঙে ফেলেছে। সে বেচারা জুড়ে দিয়েছে। মড়াকান্না। খেসারত না নিয়ে সে কিছুতেই যাবে না। তাকে কিছু দেবার বদলে উল্টে তার ওপরেই হান্বিতম্বি শুরু করেছে হরিবল্লভ। কোমরে হাত দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার আরও দু তিন স্যাঙাত।

কী হয়েছে, কী হয়েছে বলে ঈশ্বর সেদিকে যেতে গেল। মদনমোহন তার হাত ধরে টেনে বললো, করো কী, করো কী, এসব বর্বরদের সঙ্গে বিবাদ করতে যেও না।

ঈশ্বর বললো, ওরা ঐ গরীব বেচারির ওপর হামলা কচ্ছে। এদের অত্যাচারে এ পল্লীতে তেষ্টানো মুশকিল।

মদনমোহন বললো, তুমি উহাদের দিকে তাকায়ো না। উহাদের কথা শুনিও না। তা হলে আর কে তোমাকে বিরক্ত করবে?

—ভাই, পথ চলাবার সময় চোখ বন্ধ করা যায় না। আর কান বন্ধ করার ক্ষমতা মনুষ্যগণের পক্ষে সম্ভব?

ঈশ্বর সেইখান থেকেই হাঁক দিয়ে বললো, এই দইওয়ালা, তুই আমার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে যাস। আজ পারবো না, পরশু আসিস। ঐ যে সাদা রঙের বাড়ি।

হরিবল্লভ। ঈশ্বরের দিকে ফিরে বললো, ঐ যে লাটের ব্যাটা এসে গ্যাচে? তবে আর ভাবনা কী!

রামচন্দ্ৰ সেই সঙ্গে যোগ করলো, বাইরে কোঁচার পত্তন, ভেতরে ছুঁচোর কোত্তন!

মদনমোহন ঈশ্বরের হাত ধরে বাড়ির দিকে নিয়ে চলে গেল। ঈশ্বরের নাকের পাটা ফুলে গেছে, চোখে ক্রোধের আগুন। ঘাড়টিও বেঁকে গেছে। হাতে বিশেষ পয়সা নেই বলে সে অসহায় বোধ করছে এখন।

মদনমোহন বললো, দইওয়ালার ভাঁড়ের দাম তুমি মিটাবে। আরও কত গরীব দুঃখী আছে, সকলের দুঃখ তুমি ঘুচাতে পারবে কি?

ঈশ্বর বললো, সাধ্য মতন ঘুচাবো।

—এখন তা হলে বেশ বড় মানুষ হয়েছে মনে হয়?

ঈশ্বর অহংকারের সঙ্গে বললো, আমি গরীব, তবু আমি বড় মানুষ।

বাড়ির মধ্যে এসে মদনমোহনকে নিজের বিছানার ওপর বসিয়ে বললো, কী খাবে বলে? মদনমোহন বললো, আমি বাপু তোমার ঐ ভিজানো ছোলা খেতে পারব না। ভালো চাকুরি করতেছ, আজ মণ্ডামেঠাই খাওয়াও।

ঈশ্বর বললো, নিশ্চয়ই খাওয়াবো।

পয়সার অনটন থাকলেও ঈশ্বর বন্ধুবান্ধবদের খাওয়ানোর ব্যাপারে খুব উদার। ছাত্র অবস্থায় জলপানির টাকায় প্রায়ই বন্ধুদের খাইয়েছে। এমনকি, এজন্য মিঠাইওয়ালার দোকানে ধার করতেও দ্বিধা করে না। সে ছোট ভাই শত্ৰুচন্দ্ৰকে ডেকে বললো, যা, মোড়ের মিঠাইওয়ালাকে আমার নাম করে বল, মতিচুর আর সন্দেশ নিয়ে আয়।

ঠাকুরদাস কয়েকদিনের জন্য দেশের বাড়িতে গেছেন। ঈশ্বরই এখন এ বাড়ির কতা। কিছুদিন আগে মেজো ভাইটির বিবাহ দেওয়া হয়েছে, সেইজন্য ঋণ করতেও হয়েছে অনেক। ঈশ্বর এখন সংসারের হাল ধরে খরচ চালাচ্ছে টেনে টুনে। অতি সামান্য শাক ব্যঞ্জন রান্না করতে গিয়ে ছোট ভাইরা দিশা পায় না বলে আজকাল রান্নার ভার ঈশ্বর পুরোপুরি নিজেই নিয়েছে।

মদনমোহন বললো, মতিচুর নামটা শুনে আমার একটা কথা মনে পড়ল। সরস্বতী পূজা উপলক্ষে তুমি একবার একটি শ্লোক রচে ছিলো, মনে আছে? আমার কিন্তু মনে আছে, ভারি সরস ছিল শ্লোকটি;

লুচি কচুরি মতিচুর শোভিতং
জিলেপি সন্দেশ গজা বিরাজিতম।
যস্যাঃ প্ৰসাদেন ফলারমাণুমঃ।
সরস্বতী মা জয়তান্নিরন্তম।

ঈশ্বর বললো, তুমি ঠিক মনে রেখেছে তো! আমি ভুলে গিসলাম।

মদনমোহন বললো, তুমি অপরের রচনা রাশি রাশি মুখস্ত করো, তাই নিজের রচনা মনে রাখতে পারো না।

ঈশ্বর বললো, এক কাজ করা যাক। আমি রসুইটা ধী করে সেরে নিই। তুমি রান্নাঘরের দোরে এসে বসে না, তাহলে আমি কাজ করতে করতে গল্পও করতে পারি।

রান্নাঘরটি অত্যন্ত নোংরা আর স্যাঁতসেতে। একটি মাত্র দরজা, কোনো জানলা নেই। এক দেয়াল থেকে আরেক দেয়ালে ফরর ফরুর করে উড়ে যাচ্ছে আরশোলা।

সেই আরশোলার বহর দেখে মদনমোহন বললো, বাপরে, এত তেলাপোকা! কোনদিন যে ওরা দু একটা ব্যঞ্জনের সঙ্গে পাক হয়ে যাবে!

ঈশ্বর মুচকি হাসলো। একদিন যে সত্যিই আরশোলা রান্না হয়ে গিয়েছিল এবং সকলের খাওয়া নষ্ট হবার ভয়ে ঈশ্বর নিজেই কচর মচার করে চিবিয়ে সেই আরশোলা খেয়ে নিয়েছিল, তা তো মদনমোহন জানে না। অবশ্য তাতে দোষই বা কী হয়েছে, চিনেম্যানরা নাকি ওগুলো খায়। কেউ কেউ বলে আরশোলা খেলে হাঁপানি রোগ হয় না।

রান্না অতি সংক্ষিপ্ত। শ্ৰীরাম ধাঁ করে উঠোনে গিয়ে কিছু কাঠ চ্যালা করে আনলো। তারপর সেই কাঠে সাজিয়ে ফেললো উনুন। চকমকি ঠুকে ঠুকে সেই উনুনে আগুন ধরিয়ে ফেললো ঈশ্বর। মদনমোহন বললো, বাপরে বাপ। কী ধোঁয়া!

শম্ভুচন্দ্ৰ চাল ধুয়ে এনে মাটির হাঁড়িতে মাপমতন জল নিয়ে চাপিয়ে দিল উনুনে। খানিকবাদে ভাত ফুটে উঠতেই ঈশ্বর হাঁড়ি নামিয়ে ফ্যান গাললো। তারপর হলো ডাল। সেই ভিজে ছোলা দিয়ে কুমড়োর ছক্কা। আর পোস্তর বড়া ভাজা।

মদনমোহন বললো, মিছেই সন্দেশ মতিচুর খেলাম। ঈশ্বর, এখন তোমার হাতের রান্না খেতে আমার লোভ হতেছে।

ঈশ্বর বললো, খাও না! বেশী রাত করে আর বাড়ি ফিরেই বা কী করবে। এখানেই আজ শোও বরং।

তাই হলো, খাওয়া দাওয়ার পর অনেক রাত পর্যন্ত দুই বন্ধু গল্প করতে লাগলো। এক সময় সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন ঈশ্বর চুপি চুপি বললো, ভাই মদন, আমি একটা লেখা তোমাকে পড়িয়ে শোনাতে চাই। তুমি শুনবে?

মদনমোহন একটু আশ্চর্য হয়ে বললো, কার লেখা? তোমার?

ঈশ্বর তখন যে-কোনো নবীন লেখকেরই মতন আরক্ত মুখ করে লাজুক গলায় বললো, হ্যাঁ।

—কী লিখেছ? নতুন সংস্কৃত শ্লোক?

–না, সংস্কৃতও নয়, শ্লোকও নয়। বাংলা। গদ্য ভাষায় কিছুটা বাংলা লিখেছি।

—বাংলা? তাও গদ্যে? তুমি বলো কী, ঈশ্বর? বাংলা গদ্য অতি অপাঠ্য ও নিরস। বস্তু। উহা লিখে লাভ কী?

—ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যেসব বাংলা টেকসট আছে, তা পড়াতে আমার ভক্তি হয় না। অতি উৎকট ভাষা। সেইজন্যই নতুনভাবে কিছু বাংলা রচনার প্রয়োজন অনুভব করি।

—ছাত্রপাঠ্য কিছু যদি লিখে থাকো তো তা আলাইদা কথা। নচেৎ ও লেখা পণ্ডশ্রম।

—কেন, সর্বসাধারণের পাঠ্য কিছু বাংলায় লেখা যায় না?

–সর্বসাধারণের কী দায় ঠেকেছে বাংলা পড়বার। যে রসশাস্ত্ৰ পাঠ করতে চায়, তাহার জন্য সংস্কৃতের বিশাল ভাণ্ডার রয়েছে। আর কাজ চালাবার জন্য রয়েছে ইংরাজি। এখন তো সকলেই ইংরাজি পড়ে—

-আমি কিন্তু সর্বসাধারণের কথা চিন্তা করেই লিখতে শুরু করেছিলাম।

–পড়ো, শুনি।

বালিশের তলা থেকে ঈশ্বর টেনে বার করলো লম্বা খাতা। খাগের কলম ছেড়ে সে সম্প্রতি ইংলিশ নিব ব্যবহার করতে শুরু করেছে। প্রথম মাসের মাইনে পেয়েই সে বড় এক শিশি বিলিতি কালি কিনে এনেছিল হ্যামিল্টনের দোকান থেকে।

খাতাখানি হাতে নিয়ে ঈশ্বর বললো, বাসুদেব চরিত লিখবো ভেবে শুরু করিছি। একটু শুনে বিচার করে দ্যাখো দেখি।

ঈশ্বর পড়তে শুরু করলো,-নারদ মথুরায় আসিয়া কংসকে কহিলেন মহারাজ তুমি নিশ্চিন্ত রহিয়াছ কোনও অনুসন্ধান করো না। এই যাবৎ গোপী ও যাদব দেখিতেছ

মদনমোহন বললো, আস্তে, একটু আস্তে পড়ো, একেবারে যে পালকি বেহারাদের মতন তুর্কি নাচন শুরু করলে।

ঈশ্বর একটুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বললো, আমি ঠিক, গতিতেই পড়ছি, কিন্তু তুমি বুঝতে পারছে না, কারণ অভ্যাস নাই। ইংরাজি গদ্য পড়তে গিয়ে আমি দেখেছি, ওরা কমা, সেমিকোলন, প্রশ্নচিহ্ন, বিস্ময়বোধক চিহ্ন ব্যবহার করে। পদ্যে এগুলির তেমন দরকার না থাকলেও গদ্যে খুব উপকারী। আমি ভাবছি বাংলা গদ্যে এগুলির ব্যবহার করলে কেমন হয়?

মদনমোহন বললো, ঈশ্বর, তুমি দুই চারিদিন মাত্র সাহেবদের সঙ্গে গতায়াত করেই যে উহাদের সব কিছুর গুণগান করতে শুরু করলে দেখি! ইংরাজি চিহ্ন আমাদের দেশীয় ভাষায় লাগবে কেন?

—ওসবের প্রয়োজন নাই, তুমি মনে করো?

–কোনো প্রয়োজন নাই।

—আমার কিন্তু মনে হয়, ঐসব চিহ্নে পাঠের সুবিধা হয়। যা হোক, বাকিটা পড়ি?

ঈশ্বর আবার পড়তে শুরু করলো,…ইতিমধ্যে বলরাম প্রভৃতি গোপনন্দনেরা নন্দমহিষীর নিকটে গিয়া কহিল ওগো কৃষ্ণ মাটী খাইয়াছে আমরা বারন করিলাম শুনিল না। তখন পুত্রবৎসলা যশোদা অস্তব্যস্তে আসিয়া কৃষ্ণের গণ্ড ধরিলেন এবং তর্জন করিয়া কহিলেন রে দুষ্ট তুই মাটী খাইয়াছিস রহ আজ আমি তোকে মাটী খাওয়া ভালো করিয়া শিখাইতেছি…

মদনমোহনের ক্রমশ ভুরু কুঁচকে যাচ্ছিল, এক সময় বললেন, থামো, থামো! ঈশ্বর, এসব কী ছাইমাটী লিখিয়াছ! এসব তো চাষাভূষার মতন কথাবার্তা। সব বোঝা যায়। ইহার মধ্যে রস কোথায়?

ঈশ্বরের মুখখানা বিবৰ্ণ হয়ে গেল। আস্তে আস্তে বললো, এর মধ্যে রস নাই?

—কোথায় রস? লোকে চিঠি চাপাটিও এমন সরল লেখে না। ঈশ্বর, তুমি এ কাজে ক্ষান্ত দেও। এ তোমার উপযুক্ত নয়। এমত ছেলেখেলায় কেন সময় নষ্ট করছে?

-ভাই মদন, ছেলেখেলা বললে!

—তা নয় তো কী?…তুই মাটী খাইয়াছিস রহ আজ আমি তোকে মাটী খাওয়া ভালো করিয়া শিখাইতেছি।– হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ-এই নাকি রচনা? তুমি এতবড় সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত, তুমি এরকম স্ত্রীলোকদের মতন অশিক্ষিত ভাষা লিখলে সবাই তোমায় উপহাস করবে। যে!

–তাই?

—আমাকে দেখিয়েছ দেখিয়েছ, আর কাহাকেও দেখিও না! এ সব হাবিজাবি রচনা গুড়গুড়ে ভট্টচাজের মতন লঘু লোকেদের মানায়। এ তোমার উচিত কাজ হয় না। কলেজে পড়বার সময় তুমি উত্তম শ্লোক রচনা করতে, তোমার কাছ থেকে সকলে সে রকম আরও রচনা আশা করে।

ঈশ্বরের ঘাড়খানি পাশে বেঁকে গেছে। চোয়াল কঠিন। মদনমোহনের কথা তার পছন্দ হয়নি। অন্য কেউ এ রকম মন্তব্য করলে সে ক্রুদ্ধ উত্তর দিত। কিন্তু মদনমোহনের কথা সে মান্য করে।

সে গম্ভীরভাবে বললো, তুমি বাঙলা রচনার পক্ষপাতী নও?

মদনমোহন বললো, বাঙলায় পদ্য রচা যায়। শিশু ও স্ত্রীলোকদের নীতি শিক্ষার জন্য বাঙলা পদ্য খুব উপকারী। কিন্তু গদ্যের উপযুক্ত গাম্ভীর্য এ ভাষায় সহে না।

—আমি এই বাসুদেব চরিতখানি ছাপাবো ঠিক করেছিলাম!

–সেটা তোমার মতন পণ্ডিতেরা যোগ্য কাজ হবে না।

খাতাখাতা মুড়ে রেখে ঈশ্বর বললো, থাক, ছাপাবো না তা হলে। ছিঁড়ে ফেলে দেব। তোমার কথাই বুঝি ঠিক। বাঙলা ভাষায় সাহিত্য হয় না।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়