গভীর রাত্রে জিপগাড়িটা চলল গাঢ় অন্ধকার ভেদ করে। এখনও বৃষ্টি পড়ছে।

কাকাবাবু কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে এসেছেন অরুণকান্তির বাড়িতে। তাঁকে চলে যেতে হবে শুনে অরুণকান্তি কিছুতেই কাকাবাবুকে একা ছাড়তে চাননি। অফিসের কাজ থাকলেও তিনি সঙ্গে যাবেন বলে জেদ ধরেছিলেন। কিন্তু পুলিশ কিছুতেই সে কথায় রাজি হয়নি। তাতে নানান অসুবিধে আছে।

কাকাবাবুর সঙ্গে পুলিশের কর্তা নিন্‌জানে আসেননি। একজন বিশ্বস্ত অফিসারকে সঙ্গে দিয়েছেন। এ ছাড়া গাড়ির পিছনে রয়েছে দুজন অস্ত্রধারী প্রহরী।

একে তো ঘুরঘুট্টি অন্ধকার, তার উপরে বৃষ্টি। বাইরেটা কিছুই দেখা যায় না। এ দেশে রাত্তিরে গাড়ি চালানো বেশ বিপজ্জনক। প্রায়ই রাস্তার উপর নানান জন্তু-জানোয়ার চলে আসে। গতবার কাকাবাবু একটা জলহস্তী পর্যন্ত দেখতে পেয়েছিলেন। আর যদি হাতির পাল আসে, তা হলে সত্যিই ভয়ের ব্যাপার হয়। আফ্রিকায় হাতিরা আমাদের দেশের হাতির চেয়েও অনেক বেশি বড়। তা ছাড়া প্রত্যেকেরই লম্বা লম্বা দাঁত। আমাদের দেশের সব হাতির দাঁত থাকে না।

এই হাতিরা খেলার ছলে গাড়ি উলটে দিতে পারে। তা যদি না-ও দেয়, রাস্তা থেকে কখন যে সরবে, তা জানার উপায় নেই। হাতিদের তো কোনওক্রমেই তাড়িয়ে দেওয়া যায় না।

এক জায়গায় সত্যিই জিপ থামিয়ে নিঃশব্দে বসে থাকতে হল। খানিক দূরে হাতির পাল রাস্তা দিয়ে একধার থেকে অন্যদিকে যাচ্ছে। অন্ধকারে তাদের দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু শোনা যাচ্ছে তাদের ডাক।

বেশ কিছুক্ষণ পর আর কোনও সাড়াশব্দ না পাওয়ায় জিপটা আস্তে আস্তে এগোল।

বৃষ্টি থামল ভোরের দিকে।

বেলা প্রায় এগারোটার সময় জিপটা থামল তানজানিয়ার সীমান্তে। এখানে একটা চেকপোস্ট আছে। আগে থেকেই ফোনে জানানো হয়েছে, তাই একজন অফিসার অপেক্ষা করছেন অভ্যর্থনা জানাবার জন্য।

অন্য দেশে যেতে ভিসা লাগে, সাময়িক ভিসার ব্যবস্থাও হয়ে গেল এখানে।

যে-পুলিশ অফিসারটি সঙ্গে এসেছে, সে বলল, স্যার, আমাদের তো আর বেশি যাওয়ার পারমিশান নেই। তানজানিয়ার পুলিশ আপনার সবরকম দেখাশোনার দায়িত্ব নেবে। গুড বাই!

তানজানিয়ার পুলিশ অফিসারটি খুব বিনীতভাবে বলল, স্যার, আমার নাম বিল্‌। আর কিছু নেই, শুধুই বিল্‌। আপনার সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছি। আপনি তানজানিয়ায় অতিথি হয়ে এসেছেন, এ জন্য আমরা গর্বিত। আমাদের মিনিস্টার বলেছেন, আপনার যাতে কোনও অসুবিধে না হয়, তা দেখতে। আপনার জন্য আমরা যথাসাধ্য ভাল ব্যবস্থা করে রেখেছি। তবু আপনার আর যা কিছু লাগবে, তৎক্ষণাৎ আমাকে জানাবেন।

কাকাবাবু বললেন, ধন্যবাদ! আমার তো বিশেষ কিছু লাগে না। একটু নিরিবিলিতে থাকা, আর শোওয়ার জন্য একটা বিছানা।

বিল্‌ বলল, আপনার জন্য একটা বাংলোয় থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সেখানে শুধু আপনি থাকবেন। আপনি সারারাত জার্নি করে এসেছেন, এখন আপনার ঘুম দরকার। আপনি এখন বিশ্রাম নিন, বাকি কথা পরে হবে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা লোহিয়ার খোঁজ পেয়েছেন?

বিল্টু বলল, ইয়েস! সেসব কথা পরে হবে। গাড়িটা এসে থামল একটা সাদা রঙের দোতলা বাড়ির সামনে। চারদিকে অনেকখানি কম্পাউন্ড। বড় বড় গাছ দিয়ে ঘেরা।

এরকম বাড়ি দেখলেই পছন্দ হয়। গেটের দুপাশে দুটি গুমটিতে দাঁড়িয়ে আছে দুজন প্রহরী। কী যেন একটা পাখি ডাকছে জোর গলায়।

কাকাবাবুকে দোতলায় পৌঁছে দিয়ে বিল্‌ বিদায় নিল। একজন আরদালি এনে দিল গরম গরম কফি। কাকাবাবু সেই কফি পান করে স্নান সেরে নিলেন। তারপর আর ব্রেকফাস্ট-লাঞ্চ খাওয়ার কথা মনেই রইল না, তিনি শুয়ে পড়লেন। ধপধপে নরম বিছানা, শরীরও খুব ক্লান্ত, ঘুম এসে গেল সঙ্গে সঙ্গে।

ঘুম ভাঙল সন্ধের কাছাকাছি।

এখন শরীর বেশ ঝরঝরে লাগছে। এবার খিদেও পেয়েছে। এই সময় আর ভাত বা রুটি খেতে ইচ্ছে করে না। বেয়ারা এসে খবর নিতেই কাকাবাবু তাকে কয়েকটা টোস্ট আর একটা ডাব্ল অমলেটের অর্ডার দিলেন।

খানিক পরে এসে হাজির হল বি। প্রথমেই জিজ্ঞেস করল, আপনার কোনও অসুবিধে হয়নি তো স্যার?

কাকাবাবু বললেন, কিছুমাত্র না। খুব ভাল ঘুমিয়েছি। ঘুমটা খুব দরকার ছিল।

বি জিজ্ঞেস করল, রাত্রে কী খাবেন স্যার? যা চাইবেন, বানিয়ে দেবে, সব ব্যবস্থা আছে।

কাকাবাবু বললেন, জেব্রার মাংসের কাটলেট কিংবা ফ্লেমিংগো পাখির ঝোল আমার দরকার নেই। যদি মাছ পাওয়া যায়, তা হলে সেই মাছভাজা, ঝোল করতে বারণ করবেন। যদি ডাল পাওয়া যায়, তা হলে একটু ডাল আর ছোট্ট একবাটি ভাত।

বিল্‌ বলল, এ সবই হয়ে যাবে স্যার।

কাকাবাবু বললেন, এবার বলুন, লোহিয়ার কী খবর?

বিল্‌ বলল,  মি. লোহিয়ার ব্যাপারটা একটু রহস্যময়। তাঁকে এ দেশে দেখা গিয়েছে অন্তত তিনবার। আমাদের একজন এজেন্ট তাঁর ফোটোও তুলেছে। কাকাবাবু বললেন, ফোটো তুলেছে? একবার দেখতে পারি? বি একটু ইতস্তত করে বলল, সেটা তো সঙ্গে আনিনি। পরে আপনাকে দেখিয়ে দেব। তাঁর অন্য ফোটোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হয়েছে, কোনও ভুল নেই।

কাকাবাবু বললেন, আপনাদের যে এজেন্ট তাঁকে দেখেছে, সে কি তাঁকে একা দেখেছে?

বিল্‌ বলল, প্রত্যেকবারই একা।

কাকাবাবু বললেন, কেউ তাঁকে জোর করে ধরে রাখেনি। তিনি নিজেই লুকিয়ে রয়েছেন।

বিল্‌ বলল, ঠিক তাই। তিনি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। সেই জন্যই এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকছেন না। তিনি জানেন, তাঁর জীবনের ভয় আছে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, শেষবার তাঁকে কোথায় দেখা গিয়েছে? বি নিজের চেয়ারটা একটু এগিয়ে এনে নিচু গলায় বলল, এইবারেই আসল কথা। আমাদের ধারণা, তিনি এখন এমন এক জায়গায় লুকিয়ে আছেন, যেখানে কেউ তাঁকে খুঁজে পাবে না। আমি নিজে তাঁকে সেখানে খুঁজতে যাব ভাবছি। তিনি আমাদের দেশের অতিথি। অত বড় ব্যবসায়ী। তাঁকে আমরা সবরকম সাহায্য করতে চাই।

কাকাবাবু বললেন, সে জায়গাটা কোথায়, তা জানতে পারি?

বিল্‌ বলল, হ্যাঁ, পারেন। আমরা সঠিক খবর পেয়েছি, তিনি আশ্রয় নিয়েছেন এন গোয়রাংগোরোর পেটের মধ্যে!

কাকাবাবু দারুণ বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, গোরোংগোরো! আগ্নেয়গিরি?

বিল্‌ বলল, হ্যাঁ। আমরা বলি, এন গোরোংগোরো। বাইরের লোক শুধু গোরোংগোরোই বলে। আপনি কি জানেন, সেই আগ্নেয়গিরির তলায় এখন

অনেক কিছু আছে?

কাকাবাবু বললেন, জানব না মানে? সবই জানি। গোয়রাংগোরো তো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য! এই আগ্নেয়গিরির পেটের মধ্যে যেন রয়েছে আরএকটা মিনি পৃথিবী। সেখানে ঘন বন আছে, অনেক রকম জন্তু-জানোয়ার আছে। এমনকী, সিংহ পর্যন্ত। আবার কিছু কিছু মানুষও। তাই না?

বিল্‌ বলল, ঠিক বলেছেন। সত্যিই বিস্ময়কর ব্যাপার। পৃথিবীর নানাদেশ থেকে টুরিস্ট দেখতে আসে।

কাকাবাবু বললেন, আমারও তো অনেক দিনের ইচ্ছে গোরোংগোরো দেখতে যাওয়ার। গতবার কেনিয়ায় এসেও আর এদিকে আসা হয়নি।

বিল্ বলল, জানি। আপনি সেরেংগেটি জঙ্গলে এসে খুব বিপদে পড়েছিলেন। আপনি বিদেশ থেকে এসে আমাদের এ অঞ্চলের বন্যপ্রাণীদের বাঁচাবার জন্য কত সব কাজ করেছেন, তার জন্য আপনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

কাকাবাবু বললেন, সে এমন কিছু না। লোহিয়া ওই গোরোংগোরোর জঙ্গলের মধ্যেই আশ্রয় নিয়েছে, এ ব্যাপারে আপনারা নিশ্চিত?

বিল্‌ বলল, প্রায় নিশ্চিত বলা যায়। একেবারে চাক্ষুষ করার জন্যই কাল সেখানে যাচ্ছি। আপনি আমার সঙ্গে যেতে চান?

কাকাবাবু উত্তেজিতভাবে বললেন, অবশ্যই! লোহিয়াকে খুঁজে বের করতে চাই তো বটেই। তা ছাড়াও ওই বিখ্যাত জায়গাটা আমার দেখা হয়ে যাবে।

বিল, বলল, ভালই হল, আমরা দুজনে একসঙ্গে যাব। কাল খুব ভোরে।

কাকাবাবু বললেন, আমি তৈরি হয়ে থাকব।

বিল্‌ বলল, রাত্তিরটায় আপনি বিশ্রাম নিন। তবে স্যার, একটা বিশেষ। অনুরোধ, আপনি সন্ধের পর আর এই কম্পাউন্ডের বাইরে কোথাও যাবেন। আপনার জীবনের অনেক দাম। কে কোথা থেকে আক্রমণ করবে, তার তো ঠিক নেই। তবে, এই কম্পাউন্ডের মধ্যে কেউ ঢুকতে পারবে না।

বিল্‌ বিদায় নেওয়ার পর কাকাবাবু একই জায়গায় চুপ করে বসে রইলেন।

কী করে একটার পর-একটা ঘটনা গড়িয়ে যাচ্ছে।

পরশু রাত্রে ছিলেন থানার মধ্যে একটা বিচ্ছিরি নোংরা ঘরে, বিছানাও ছিল না, দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে বসে পুরো রাত কাটিয়ে দিতে হয়েছে। কাল রাতটা প্রায় কেটেছে গাড়িতে। আজ আবার এমন চমৎকার আরামের বিছানায়।

কাল আবার যাওয়া হবে গোরোংগোরো। এখানকার লোকেরা বলে উললল গোয়রাংগোরো, সেরকম উচ্চারণ করা খুব শক্ত। গোরোংগোররাই ভাল। পুরনো আগ্নেয়গিরি! বৈজ্ঞানিকরা বলেছেন, এই আগ্নেয়গিরি জ্যান্ত হয়ে আগুন আর লাভা বের করেছিল সেই বহু কাল আগে, প্রায় তিরিশ লাখ বছর আগে, যখন এই পৃথিবী সবেমাত্র হাঁটতে শিখেছে।

গোয়রাংগোররা ছিল খুব উঁচু পাহাড়, বিস্ফোরণে এর শিখরের অনেকটা উড়ে গিয়েছিল, তৈরি হয়েছিল বিশাল খোদল। তার তলাটা অনেকখানি চওড়া। সে জায়গা আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে গিয়ে গাছপালা জন্মেছে। এত বছরের মধ্যে আর অগ্ন্যুৎপাত হয় না। তবে, এই আগ্নেয়গিরিকে একেবারে মৃত বলা যায় না। এখানে আছে মোট নটা চূড়া, তার মধ্যে একটার নাম ওলডোনিয়ো লেঙ্গাল, সেই চূড়া থেকে মাঝে মাঝেই ধোঁয়া আর গরম ছাই বেরিয়ে আসে। তবে মূল গোরোংগোরোর আশ্চর্য সুন্দর গহ্বর দেখার জন্য ছুটে আসে পৃথিবীর বহু দেশের মানুষ।

কাকাবাবু ভাবলেন, ইস, সন্তু আর জোজোকে এবার নিয়ে আসা গেল! ওরা দেখতে পেল না!

খানিক পর শুয়ে পড়ে তিনি ঘুমের মধ্যেও গোয়রাংগোরোর স্বপ্ন দেখতে লাগলেন।

পরদিন ভোরবেলা যাত্রা। বৃষ্টি পড়ছে খুব।

আরুশা শহর থেকে যেতে হবে পঁচাত্তর মাইল। এমন কিছু নয়। যেতে যেতেই বিল্‌ বলল, উপরে গিয়ে আগ্নেয়গিরির পেটের মধ্যে নামার জন্য একটা কাঁচা রাস্তা আছে। খুব সাবধানে নামতে হয়। আপনি তো নামতে পারবেন না।

কাকাবাবু বললেন, পারব না? সে কী? তা হলে যাচ্ছি কেন? হ্যাঁ, ঠিক পারব!

বিল্‌ বলল, ক্রাচ নিয়ে নামা খুব রিস্কি। একরকম ব্যবস্থা আছে। খাড়া রাস্তা ধরে নামতে হয় তো, তাই স্পেশ্যাল, বড় বড় চাকাওয়ালা গাড়ি। আশা করি কিছুক্ষণের মধ্যে এই বৃষ্টি কমে যাবে। বৃষ্টির মধ্যে ভিতরে নামা খুব মুশকিল।

কিন্তু বৃষ্টি থামল না। বরং আরও জোরে হয়ে গেল। শিখরের উপরে উঠে পাওয়া গেল দুঃসংবাদ।

মাসাই জাতির কয়েকটি মহিলা ও বাচ্চা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে একটা চালার নীচে। বাচ্চাদের হাতে ফুলের মালা, আর মহিলারা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করতে লাগল, ফোটো?

এরা টুরিস্টদের সঙ্গে ফোটো তুলিয়ে কিছু পয়সা পায়। বি তাদের সঙ্গে কথা বলে জানল, আজ গাড়ি চলছে না, রাস্তা বন্ধ। এক জায়গায় এত বৃষ্টিতে ধস নেমে গিয়েছে। সেখানে রাস্তা সারাতে দু-তিনদিন লেগে যাবে। তাই আজ আর টুরিস্ট আসেনি।

সে খবর শুনে কাকাবাবু দারুণ হতাশভাবে বললেন, যাঃ! যাওয়া হবে না?

বিল্‌ বলল, কয়েকদিন অপেক্ষা করতেই হবে। রাস্তা ভাঙা।

কাকাবাবু বললেন, রাস্তা ভাঙা হলেও পায়ে হেঁটে যাওয়া যেতে পারে নিশ্চয়ই। ক্রাচ নিয়েও আমি খুব সাবধানে নামতে পারব।

বিল্‌ বলল, ইমপসিবল। আপনি ভি আই পি লোক, আপনার কোনও অ্যাক্সিডেন্ট হলে বা কোনও ক্ষতি হলে আমাকে জবাবদিহি করতে হবে।

কাকাবাবু ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন।

এতদূর এসেও ফিরে যেতে কিছুতেই তাঁর মন চাইছে না। তিন-চারদিনের মধ্যে আবার কী ঘটে যাবে কে জানে? হয়তো আর গোয়রাংগোরো দেখাই হবে না।

বিল্‌ একটু দূরে গিয়ে মোবাইল ফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলতে লাগল।

বৃষ্টি প্রায় থেমে গিয়েছে, এখনও একটু একটু ঝিরঝির করে পড়ছে। বেশ শীত শীত ভাব।

মিনিটদশেক পর ফোন থামিয়ে বিন্ কাছে এসে বলল, একটু আশা আছে। আমি কয়েক জায়গায় ফোন করলাম। দুবাই-এর রাজা, তাঁর দুই রানি আর সঙ্গে আরও তিনজন বেড়াতে এসেছেন। ওঁদেরও আজ গোবরাংগোলোর তলায় যাওয়ার কথা। আমরা বলি কিং, আসলে তো ওঁরা আরবের শেখ, ওঁদের প্রচুর টাকা। রাস্তা বন্ধ বলে তো দু-তিনদিন অপেক্ষা করবেন না, না দেখে ফিরেও যাবেন না। সেইজন্য ওঁরা একটা বেলুন ভাড়া নিয়েছেন, সেই বেলুনে চেপে আগ্নেয়গিরির পেটের মধ্যে যাবেন। সেই বেলুনে প্রায় দশজন ধরে, আমাদের দুজনকেও নিতে পারেন। কিন্তু…!

কিন্তু বলে সে থেমে গেল।

কাকাবাবু আবার অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে ব্যগ্রভাবে বললেন, তা হলে আবার কিন্তু কী? আমরা ওই বেলুনেই যাব।

বিল্‌ বলল, যেতে তো পারি, কিন্তু বেলুন কোম্পানির ম্যানেজার আমাকে বলল, রাজা গোটা বেলুনটা ভাড়া নিয়েছেন, অন্য লোকদের সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইবেন না। আমি বড়জোর অনুরোধ করতে পারি যে, এঁরা আমার নিজের লোক। তাতে রাজি হতে পারেন। তার জন্য আমাদের দুজনকেও ভাড়ার টাকা দিতে হবে। টাকা তিনি ছাড়বেন না। স্যার, আমার সঙ্গে বেশি টাকা নেই!

কাকাবাবু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, সেজন্য চিন্তা করতে হবে না। আমার কাছে ট্রাভেলার্স চেক আছে। টাকা যা লাগে, আমি দিয়ে দেব।

বিন্ কাঁচুমাচুভাবে বলল, স্যার, আপনি আমাদের অতিথি। আপনার থেকে টাকা নেওয়া মোটেই উচিত নয়। আমি সেই কথাই ভাবছি।

কাকাবাবু তার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, বিল, ও নিয়ে কিছু বোলো, প্লিজ! আমার অনেক দিনের ইচ্ছে, এই আগ্নেয়গিরির তলায় যাওয়ার। এরকম সুযোগ তো মানুষের জীবনে দুবার আসে না। তা ছাড়া, লোহিয়া আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তাঁকে যদি খুঁজে পাই…!

বিল্ বলল, তা হলে আর আধঘণ্টার মধ্যেই বেলুন এসে যাবে রাজার। আপনার বেলুনে চাপার অভ্যেস আছে তো?

কাকাবাবু এবার হেসে ফেললেন। তিনি বললেন, অভ্যেস মানে, জীবনে আগে কখনও বেলুনে চাপিইনি। ফোটোয় দেখেছি, সিনেমায় দেখেছি। আমাদের দেশে তো এখন আর বেলুন চলেই না। প্লেন কিংবা হেলিকপ্টার।

বিল্‌ বলল, এই গোবরাংগোরোর মধ্যে প্লেন কিংবা হেলিকপ্টার তো চলে না। বেলুনই সবচেয়ে সুবিধে।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, বেলুনে চাপা কি প্র্যাকটিস করতে হয়?

বিল্ বলল, না, তার ততটা দরকার নেই। নার্ভাস না হলেই হল। খুব হাওয়া না দিলে ভয়ের কিছু নেই। এই ক্রেটারের মধ্যে তেমন হাওয়া নেই। যত নীচে নামবে, ততই ঠান্ডাটা কমে যাবে।

এরপর শুরু হল প্রতীক্ষা। কাকাবাবু আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এখানে আকাশে সব সময়ই নানারকম পাখি দেখা যায়।

ঝাঁক-বাঁধা ফ্লেমিঙ্গো তো আছেই। কাকাবাবু অনেক পাখির নাম জানেন। সেইরকম পাখিদের মধ্যে থেকেই একসময় একটা ছোট্টমতো দেখা গেল বেলুনটাকে। ক্রমশ বড় হতে লাগল সেটা। তারপর একসময় এসে পড়ল একেবারে কাছে। সাদার উপরে লাল ডোরা। আগ্নেয়গিরির মুখের একটু উপরে এসে থেমে গেল বেলুনটা। দুলতে লাগল। সেখান থেকে নেমে এল একটা দড়ির সিঁড়ি।

কাকাবাবু ক্রাচ দুটো বিলের হাতে দিয়ে দিব্যি তরতর করে উঠে গেলেন দড়ির সিঁড়ি বেয়ে।

বিও উঠে আসার পর বেলুনটা আবার দুলতে দুলতে নামতে লাগল গহ্বরের মধ্যে।

দুবাইয়ের কিং বেশ ভদ্র। তিনি কাকাবাবুকে দেখে বললেন, গুড মর্নিং, সেলাম আলেকুম।

কাকাবাবু বললেন, গুড মর্নিং। আলাইকুম আসসালাম।

বেলুনচালক অনুরোধ করল, প্লিজ, এখানে কেউ এখন কথা বলবেন না।

তখন সবাই চুপ। কাকাবাবুও মনে মনে ধারণা করেছিলেন; আগ্নেয়গিরির ভিতরটা বোধহয় অন্ধকার। মোটেই তা নয়। উপরের মুখটা অনেকটা চওড়া। যথেষ্ট রোদুর ঢোকে। খানিক নামবার পর তলাটাও দেখা যায়।

কাকাবাবুর আবার মনে পড়ল সন্তু আর জোজোর কথা। নীচে নামার অভিজ্ঞতায় তাঁরই উত্তেজনা হচ্ছে, আর ওদের মতো বয়সে নিশ্চয়ই দারুণ রোমাঞ্চ হত। ফিরে গিয়ে ওদের কাছে গল্প শোনালে ওরা নিশ্চয়ই আফশোস করবে।

কিন্তু ওদের পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত যে অপেক্ষা করা গেল না। লোহিয়া কেন এত তাড়া দিচ্ছিলেন ঠিক এই সময় আমার জন্য, তা এখানে এসে তিনি বুঝতে পেরেছেন। ওই ফিলিপ কিকুইউ-এর মামলাটায় সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য। এর মাঝখানে ঘটে গেল কত কিছু!

আগ্নেয়গিরির ভিতরটা ক্রমশই চওড়া হচ্ছে। তলার জায়গাটা প্রায় সমতল। এদিক-ওদিক অনেক দূর দেখা জায়গাটা যে আগ্নেয়গিরির পেটের মধ্যে, তা বোঝাই যায় না। সব দিকে শুধু ঘাসের মতোই দেখা যায়, পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা ছোট নদী।

বেলুন থেকে নামার পর বিন্ কাকাবাবুকে বলল, এক জায়গায় দাঁড়াতে। কাকাবাবুর কাছ থেকে চেক নিয়ে সে গেল বেলুনচালককে ভাড়ার টাকা বুঝিয়ে দিয়ে আসতে।

খানিক পর ফিরে এসে বলল, শুনুন স্যার। রাজাটাজাদের ব্যাপার! সব সময় ব্যস্ত। তাঁরা মাত্র দুঘণ্টা পরেই বেলুন নিয়ে ফিরে যেতে চান। কিন্তু মাত্র দুঘণ্টায় আমরা কী দেখব? তাই আমরা যদি দুঘণ্টা পরে না ফিরি, আজকের রাতটা এখানেই থেকে যেতে চাই। তাতে আপনার আপত্তি আছে?

কাকাবাবু বললেন, মোটেই আপত্তি নেই। আমিও এত তাড়াতাড়ি ফিরতে রাজি নই।

বিল্‌ বলল, রাত্রে থাকার ব্যবস্থা আছে। হয়তো আপনার বেশ অসুবিধে হবে। বিছানাটিছানা বোধহয় পাবেন না।

কাকাবাবু বললেন, আমার ওসব কিছু দরকার নেই। কোনওরকমে একটা মাথা গোঁজার জায়গা পেলেই হল। আমি তিন-চারদিনও থেকে যেতে রাজি আছি।

বিল্‌ বলল, তার বোধহয় দরকার হবে না। চলুন!

বেলুনের নামার জায়গাটা চতুর্দিকে বেড়া দিয়ে ঘেরা। তার মধ্যে কটেজও রয়েছে। একদিকের গেট দিয়ে বেরিয়ে এলেন কাকাবাবু আর বি।

একটা সরু রাস্তার দুপাশে ফসলের খেত। বি সব বুঝিয়ে দিল, ওগুলো কোনও ফসল নয়, এক রকমের ঘাস। এই অঞ্চলটা মাসাই জাতির লোকদের জন্য সংরক্ষিত। তারা এখানে মোষ আর ভেড়া চরায়। ঘাস ওইসব পশুদের খুব পছন্দ। আবার হাতিরাও এই ঘাস ভালবাসে। তা হাতিও আসে অনেক।

এই জায়গাটা আগ্নেয়গিরির তলায় হলেও পুরোটাই পাথরে ঢাকা নয়। মাঝে মাঝে খোলা জায়গা আছে। সেখান দিয়েও মানুষ কি জন্তু-জানোয়ার আসতে পারে, বেরিয়েও যেতে পারে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, যেসব জন্তুজানোয়ার এখানে একবার ঢুকে পড়েছে, তারা আর বেরিয়ে যেতে পারে না। এখানেই তারা জন্মায়, আবার এখানেই মরে। কেন যে এই জায়গাটা তাদের পছন্দ, তা বলা মুশকিল। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বিন্ কাকাবাবুকে এইসব কথা শোনাতে লাগল।

মাঝে মাঝে দু-একজন মাসাইকে চোখে পড়ল। তারা প্রত্যেকেই ছফুটের মতো লম্বা, হাতে বর্শা আর গলায় নানারকম পুঁতির মালা।

এক এক জায়গায় রয়েছে তাঁবুর রেস্তরাঁ। সব চেয়ার ফাঁকা। আজ আর কোনও টুরিস্ট আসেনি। রেস্তরাঁর লোকজন ডাকাডাকি করতে লাগল কাকাবাবুদের।

এক জায়গায় ওঁরা দুজনে বসলেন।

দুকাপ কফির অর্ডার দেওয়ার পর কাকাবাবু বললেন, আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, আমি গোরোংগোরো আগ্নেয়গিরির ভিতরে বসে আছি!

বিল্‌ বলল, আমারও ইচ্ছে আছে, একদিন আপনাদের দেশে গিয়ে তাজমহল দেখে আসব।

কাকাবাবু বললেন, চলে এসো একবার। দিল্লিতে আমার চেনাশুনো আছে, আমি বলে দেব, তোমাকে সাহায্য করবে।

বি হেসে বলল, দাঁড়ান, আগে টাকাপয়সা জোগাড় করি। স্যার, আপনি কফির সঙ্গে কিছু খাবেন?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, কিছু একটা খেয়ে নিলেও হয়। কী পাওয়া যাবে?

বিল্ বলল, স্যান্ডুইচ আছে, অনেক রকম মাংসের রোস্ট, ডিমের অমলেট।

কাকাবাবু বললেন, কী মাংস, তার তো কোনও ঠিক নেই। আমি সবই খাই, গোরু-শূকর, সাপ-ব্যাং, কোনওটাতেই আপত্তি নেই, যদি খেতে ভাল হয়। একবার এখানে মুরগির ঝোল বলে ফ্লেমিংগো পাখির ঝোল দিয়েছিল। মুরগির চেয়ে ফ্লেমিংগো সস্তা। ওরে বাবা, সে এমন শক্ত যে দু হাত দিয়ে টেনেও ছিড়তে পারলাম না। আর ওয়াইল্ড বিস্টের মাংসের কাটলেট, এমনই দরকচা ধরনের যে, কিছুই চিবোতে পারি না। গন্ধটাও কীরকম যেন। মনে হয়েছিল ওই মাংস খেতে হলে সিংহের মতো দাঁত দরকার!

বিল্‌ বলল, ওয়াইল্ড বিস্ট তো এখানে সিংহও খায়, মানুষও। ওই জন্তুগুলো এত বেশি পাওয়া যায়!

কাকাবাবু বললেন, থাক, ওসব দরকার নেই। বরং কয়েকটা ভেজিটেবল স্যান্ডুইচ বলে দাও, আপাতত তাই-ই খেয়ে নেব।

দুপ্লেট স্যান্ডুইচ অর্ডার দেওয়ার পর বি জিজ্ঞেস করল, কলকাতায় সাধারণত আপনারা কী খান?

কাকাবাবু বললেন, ভাত, ডাল, তরকারি, মাঝের ঝোল। চিকেন, মাটনও খাই। আমাদের মাটন মানে কিন্তু ভেড়ার মাংস নয়, গোট মিট। গোট কাকে বলে তা তোমরা জানোই না।

বিল্ বলল, কলকাতায় গিয়ে একবার বাঙালি খাবার খাব।

কাকাবাবু বললেন, কলকাতা পর্যন্ত যদি আসতে পারো, তা হলে আমাদের কাছে থাকবে। আমার বড়ভাইয়ের স্ত্রী অনেক রকম রান্না জানেন। শুধু খাওয়া নয়, কলকাতায় গেলে আমি তোমাকে সুন্দরবনে ঘুরিয়ে আনব। দেখবে, সে একেবারে অন্যরকম ফরেস্ট। সেখানে আছে রয়ালবেঙ্গল টাইগার। তোমাদের গোটা আফ্রিকাতেই তা নেই। অত বড় বাঘ তোমরা চোখেই দ্যাখোনি।

বিল্ বলল, ফোটোয় দেখেছি।

গল্পে গল্পে খানিকটা সময় কেটে গেল।

উঠে কাকাবাবু দাম দিতে গেলেন। বিল বলল, না না, স্যার। এটা আপনি নয়, আমাকে দিতে দিন। আপনি আমাদের দেশের অতিথি। আমি গরিব হলেও এইটুকু তো দিতেই পারি। আমি কলকাতায় গেলে আপনি আমাকে খাওয়াবেন।

কাকাবাবু কয়েকবার আপত্তি করলেন, তবু বিন্ শুনল না।

দোকান থেকে বেরিয়ে কাকাবাবু বললেন, আমি এ জায়গাটা দেখতে এসেছি সেটা ঠিক কথা। কিন্তু লোহিয়ারও তো খোঁজ করতে হবে? সে যে এখানেই আছে, সে ধারণা তোমাদের কী করে হল?

বিল্‌ বলল, আমাদের ইনফর্মার যা খবর দিয়েছে তা যদি সত্যি হয়, তবে এখানেই তিনি লুকিয়ে আছেন। লুকোবার পক্ষে এটা আদর্শ জায়গা। এখানে বহু বিদেশি টুরিস্ট আসে বলে পুলিশের নজরদারি খুব কড়া। চোরডাকাত এখানে আসতেই পারে না। আর-একটু দূরে একটা লেক আছে, তার নাম লেক মিগাই। তার ধারে কয়েকটি ছোট ছোট টুরিস্ট লজ নতুন হয়েছে। সেখানে যদি মি. লোহিয়া গেস্ট হয়ে থাকেন, কেউ তাঁর খোঁজ পাবে না। চলুন স্যার, আগে আমরা সেই জায়গাটা দেখি। পারবেন তো?

কাকাবাবু বললেন, খুব পারব। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-নামতে আমার অসুবিধে হয়। কিন্তু প্লেন রাস্তা দিয়ে আমি অনেকদূর যেতে পারি।

একটু দূর যেতে না-যেতেই সরু রাস্তাটা লাফিয়ে লাফিয়ে পার হতে লাগল একপাল হরিণ। প্রায় পঞ্চাশ-ষাটটা।

কাকাবাবু বললেন, এগুলোকে বলে টমসন্স গ্যাজেস, তাই না? তিড়িংতিড়িং করে লাফাতে পারে।

বিল্‌ বলল, হ্যাঁ। হরিণ এখানে নানারকম আছে। ডান দিকে তাকিয়ে দেখুন, একটা গন্ডার দাঁড়িয়ে আছে খানিকটা দূরে। আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। ওরকম গন্ডার আগে দেখেছেন?

কাকাবাবু বললেন, না, আগে দেখিনি, তবে জানি। কালো গন্ডার। এদের সংখ্যা খুবই কমে এসেছে। ও আমাদের দিকে তেড়ে আসবে না?

বিল্ বলল, গন্ডার অকারণে মানুষকে তাড়া করে না। ওরা তো মানুষের মাংস খায় না।

কাকাবাবু বললেন, ওরকম শক্তপোক্ত প্রাণী শুধু ঘাসপাতা খেয়ে বেঁচে থাকে, আশ্চর্য না? হাতিও তাই। এখানে নানান রকম জন্তু-জানোয়ার আছে। কিন্তু কারও ক্ষতি করে না। ঠিক যেমন আমাদের তপোবনের কথা শুনেছি…!

বিল বলল, কিন্তু খাদ্য-খাদকের সম্পর্ক তো থাকবেই। এত হরিণ, ওয়াইল্ড বিস্ট, বুনো মোষ আছে বলেই তাদের খাওয়ার জন্য সিংহ, চিতা, হায়েনাও আছে। অনবরতই এ ওকে…!

কাকাবাবু বললেন, ও হ্যাঁ। হিংসে, মারামারি তো থাকবেই। সারা পৃথিবীতেই চলছে, তো এখানকার মানুষরা কী করে? তারা জন্তু-জানোয়ার মারে না?

বিল্‌ বলল,আপনাকে তো আগেই বলেছি, পুলিশের নজরদারি এখানে খুব কড়া! একটা স্থায়ী পুলিশক্যাম্প আছে। তবু দু-একটা চোরাশিকারি মাঝে এসে পড়তেই পারে। পুলিশকে ঘুষ খাওয়ায়। কোথায় পুলিশ ঘুষ খায় না বলুন?

কাকাবাবু বললেন, থাক ও কথা। এখন ওসব খারাপ জিনিস ভাবতেও ইচ্ছে করছে না। বিকেল শেষ হয়ে আসছে, কী চমৎকার লাগছে চতুর্দিক। রোদুর নেই, চাপা আলো। একদিকে দেখতে পাচ্ছি, আগ্নেয়গিরির ভিতরের দেওয়াল উঠে গিয়েছে ওদিকে। কতরকম পাখি ডাকছে…!

বিল্‌ বলল, স্যার, একটু সাবধান। আমরা লেকের কাছে এসে গিয়েছি। বেশি ধারে যাবেন না। হঠাৎ কোনও জলহস্তী উঠে আসতে পারে।

অনেকটা হেঁটে এসেছেন বলে কাকাবাবু একবার থামলেন।

এখানে গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে কয়েকটা তাঁবুর কটেজ। একেবারেই জনমানবশূন্য। বোঝাই যাচ্ছে, আজ কোনও টুরিস্ট আসতে পারেনি। টুরিস্টদেরও কী এতদূর হেঁটে আসতে হয়? নাকি আর কোনও রাস্তা আছে? থাকবে নিশ্চয়ই। সবাই এতটা হাঁটবে কী করে? হয়তো গাড়িও চলে।

কাকাবাবু ভাবলেন, আজ লোকজন আসেনি বলে গাড়িও চলেনি। হাঁটতে হাঁটতে তিনি এখানকার সৌন্দর্য পুরোপুরি উপভোগ করতে লাগলেন।

বিল্‌ বলল, এর পিছন দিকের একটা তাঁবুতে আমার চেনা একজন লোক আছে। চলুন, তার কাছে একটু খোঁজখবর নেওয়া যাক। আমাদের থাকার ব্যবস্থাও করতে হবে। অন্ধকার হয়ে গেলে আর বেরোনোই যাবে না!

কয়েকটা তাঁবুর পাশ দিয়ে পাশ দিয়ে কাকাবাবু হাঁটতে লাগলেন বিলের সঙ্গে। কোথাও কোনও শব্দ নেই। একটা বেশ বড় তাঁবুর সামনে এসে দাঁড়াল বি। কারও নাম ধরে ডাকার বদলে দুবার শিস দিল।

সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এল একজন দীর্ঘকায় কালো মানুষ।

দুজনে একটুক্ষণ কথা বলার পর বিল্ কাকাবাবুর দিকে ফিরে বলল, আপনি নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। আসুন, আগে একটু ভিতরে বসি। আপনি বিয়ার খাবেন?

কাকাবাবু বললেন, না, আমি বিয়ারটিয়ার খাই না। চা কিংবা কফি খেতে পারি।

ভিতরে একটা ঘর সোফাটোফা দিয়ে বসবার ঘরের মতন সাজানো। কাকাবাবু একটা সোফায় বসলেন।

এবার ভিতর থেকে এল আরও দুজন কালো মানুষ। তাদের একজন সোজাসুজি এসে কাকাবাবুর ক্রাচ দুটো সরিয়ে নিল। আর কাকাবাবু কিছু বলার আগেই অন্য দুজন শক্ত করে চেপে ধরল তাঁর দুটো হাত। তারপর দড়ি দিয়ে তাঁর সারা শরীর পেঁচিয়ে-পেঁচিয়ে বেঁধে ফেলল।

এত তাড়াতাড়ি ব্যাপারগুলো ঘটল যে, কাকাবাবু কোনওরকম বাধা দেওয়ারই সুযোগ পেলেন না।

অবশ্য চেষ্টা করলেও তিনি এই তিনজন ষণ্ডাগুন্ডা চেহারার লোকের সঙ্গে লড়াই করতে পারতেন না।

বিল্‌ একপাশে দাঁড়িয়ে হাসছে। অর্থাৎ এটা বিলেরই কীর্তি? কাকাবাবু দারুণ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

একজন মানুষের এমন দুরকম রূপ থাকতে পারে? কাল থেকে দেখছেন, ছেলেটাকে খুবই বিনীত আর ভদ্র মনে হয়েছে। কতরকম গল্প হল, তার কলকাতায় বেড়াতে যাওয়ার কথাও হল। সে আসলে তাঁকে ভুলিয়েভালিয়ে এখানে নিয়ে এসেছে কারও কাছে ধরিয়ে দিতে! কাকাবাবু তাকে একটুও সন্দেহ করেননি।

বিল্‌ এবার ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, সরি, মি., আমার খুব টাকার দরকার। আপনাকে এখানে পৌঁছে দিলে তিরিশ হাজার ডলার দেবে। সেই টাকাটা আমার খুব দরকার ছিল! একটু থেমে সে আবার বলল, আপনার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। মরে গেলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু আমাকে আরও অনেকদিন বাঁচতে হবে। ওই টাকাটা পেলে সুবিধে হবে। তাই না!

কাকাবাবু অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

বিল্‌ আবার জিজ্ঞেস করল, আমি কি ভুল বলছি?

কাকাবাবু আস্তে আস্তে বললেন, না, ভুল হবে কেন? টাকার লোভে কেউ কেউ তো নিজের বাবা-মাকেও খুন করে?

বিল্‌ এবার চটে উঠে বলল, খবরদার, আমার মা-বাবা নিয়ে কিছু বলবে। তুমি একটা ইন্ডিয়ান। তুমি বাঁচলে বা মরলে আমার কিছু যায়-আসে না। তোমার সঙ্গে আমার বাবা-মায়ের তুলনা?

কাকাবাবু বললেন, যে লোক অন্য মানুষদের ঘৃণা করে, সে নিজের বাবা-মা-ছেলে-মেয়ে কাউকেই ভালবাসতে পারে না।

বিল্‌ বলল, শাট আপ! তোমাকে আর উপদেশ দিতে হবে না।

কাকাবাবু তবু বললেন, তোমাকে আর একটা উপদেশ দিতে পারি। তুমি এখানে কাজ না করে সিনেমায় নামার চেষ্টা করতে পারো। তাতেও অনেক টাকা রোজগার করতে পারবে। তুমি তো চমৎকার অভিনয় করতে পারো!

তখনই আর-একজন লোক বেরিয়ে এল ভিতর থেকে। দেখলেই বোঝা যায়, এই লোকটিই এদের নেতা। যেমন লম্বা-চওড়া চেহারা, তেমনই একটা ঝলমলে আলখাল্লা পরা। মাথায় কোঁকড়া কোঁকড়া চুল একটা হলুদ ফিতে দিয়ে বাঁধা। চোখ দুটো টকটকে লাল, দেখলেই মনে হয় নেশাখোর।

কোমরে দুহাত দিয়ে দাঁড়িয়ে সেই লোকটি বলল, এই সেই ইন্ডিয়ান? এ তো দেখছি একটা খোঁড়া লোক। এরই এত তেজ?

বিল্‌ বলল, হ্যাঁ স্যার। খুব ডেঞ্জারাস ম্যান। খালি হাতেই কয়েকজন সোমালিয়ার হাইজ্যাকারকে জব্দ করেছে। আমি ওকে খুব তোয়াজ করে নিয়ে এসেছি। কিছুই বুঝতে পারেনি এতক্ষণ।

সেই লোকটি বলল, আমি আজ গাড়ির রাস্তাটা বন্ধ করে দিয়েছি, তাতে তোমার সুবিধে হয়েছে বলো?

বিল্‌ বলল, নিশ্চয়ই। আজ একটা বেলুন নামবে, আমি জানতাম। ওর সঙ্গে আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। আজ আর কোনও টুরিস্ট আসেনি, তাই সব দিক থেকেই আমরা ফ্রি।

লোকটি কাকাবাবুর কাছে এসে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, জন্তু-জানোয়ারদের প্রতি তোমার খুব দরদ, তাই না? সব জন্তু-জানোয়ারকে বাঁচিয়ে রাখতে চাও? কেন?

কাকাবাবু বললেন, আপনি কে? আপনার পরিচয় তো জানি না। আপনার সম্পর্কে কিছু না জেনে আপনার কথার উত্তর দেব কেন?

লোকটি আচমকা কাকাবাবুর গালে ঠাস করে এক চড় কষিয়ে বলল, এইজন্য উত্তর দেবে। না হলে আরও মার খাবে।

কাকাবাবু একবার চোখ বুজলেন। তাঁর মেজাজ শান্ত রাখতে হবে। তিনি বললেন, নাঃ, আপনার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে নেই আমার।

লোকটি এবার কাকাবাবুর চুলের মুঠি চেপে ধরল।

কাকাবাবু জানেন, যেরকম শক্তভাবে এরা তাঁকে বেঁধেছে, তার থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় নেই। কোনওরকমে দড়ি খুলে ফেললেও, এত লোকের সঙ্গে তিনি গায়ের জোরে পারবেন না।

তবে, এদের বেশি বেশি রাগিয়ে দিলে এরা কিছু না-কিছু ভুল করে ফেলতে পারে। তাই তিনি নাক কুঁচকে বললেন, এঃ, তোমার গায়ে বিশ্রী গন্ধ! তুমি অনেকদিন স্নান করো না বুঝি?

লোকটি কাকাবাবুর চুলের মুঠি ধরে টানতেই বিল বলল, মি. রাজা, তুমি এঁকে চেনো না। ইনি সাংঘাতিক লোক। ইনি ইচ্ছে করলে এক্ষুনি তোমাকে খতম করে দিতে পারেন। ওঁর নাম রবার্ট কিকুইউ, ইনি ফিলিপ কিকুইউ-এর ভাই। বড় বড় ব্যবসায়ী, মন্ত্রী, পুলিশও এই দুই ভাইকে

ভয় পায়।

কাকাবাবু বললেন, বুঝেছি, এই দুই ভাই মিলেই চোরাশিকার, পশুচালানের কাজ করে বহু পশু মেরেছে, মানুষও খুন করেছে। হ্যারি ওটাংগোর মতো বিখ্যাত মানুষকে এরাই মেরেছে।

রবার্ট কাকাবাবুর চুল ছেড়ে দিয়ে উলটো দিকের সোফায় বসল। সামনের পা দুটো ছড়িয়ে দিয়ে বলল, হ্যাঁ, আমরা জন্তু-জানোয়ার মারি, বেশ করি। সিংহ, হাতি, গন্ডার, এরা মানুষের কী উপকার করে? পৃথিবী থেকে এদের শেষ করে দেওয়াই উচিত।

কাকাবাবু বললেন, আমরা মানুষ, পৃথিবীর একটা প্রাণী। এখানে আরও কতরকম প্রাণী আছে। আমরা যেমন বাঁচতে চাই, তেমনি ওদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে।

রবার্ট ধমক দিয়ে বলল, মোটেই না। অন্য সব হিংস্র প্রাণীকে শেষ করে দিতে হবে। ওরা মানুষের ক্ষতি করে।

কাকাবাবু বললেন, ওদের বিরক্ত না করলে ওরা মানুষের ধারেকাছে। আসে না। অন্য সব প্রাণীকে ধ্বংস করে দিলে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হবে। মানুষও বাঁচবে না।

রবার্ট বলল, যত সব বাজে কথা। ওসব খবরের কাগজে লেখে। মুরগি, হাঁস, ভেড়া, গোরু, শূকরদের যে প্রতিদিন কত মারা হচ্ছে? মানুষ এদের খায়। তা বুঝি দয়ামায়ার প্রশ্ন নেই? সিংহ আর গন্ডারের মাংস যদি আমরা খেতাম, ওদেরও বাঁচিয়ে রাখতাম। অত বড় বড় হাতি বাঁচিয়ে রাখার কী দরকার? শুধু গাছ ধ্বংস করে? বরং ওদের দাঁতগুলো মানুষের কাজে লাগে। সিংহের চামড়া দিয়ে ভাল জুতো হয়।

কাকাবাবু বললেন, মানুষ ক্রমশ নিরামিষাশী হয়ে যাবে। খাওয়ার জন্য কোনও প্রাণীকেই মারবে না। আমাদের ইন্ডিয়ার অনেক লোক নিরামিষ খায়।

রবার্ট বলল, যাক গে ওসব কথা। আসল কথাটা হল, আমার ভাই ফিলিপ এখন জেলে। লোহিয়া নামে ব্যবসায়ীটা অনেক টাকা খরচ করে ওর বিরুদ্ধে উকিল-ব্যারিস্টার লাগিয়েছে। সে নিজেও একজন প্রধান সাক্ষী। আর-একজন তুমি। তোমরা দুজন মিলে ওকে ফাঁসি দিতে চাও? অপরাধ প্রমাণ হলে ওর নির্ঘাত ফাঁসি!

কাকাবাবু বললেন, না, আমি ফিলিপের ফাঁসি চাই না। কারওই ফাঁসি চাই না। যদিও সে আমার ভাইপোকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ফেলে পালিয়েছিল। আমরা কোনওক্রমে বেঁচেছি। সে একজন অতি নিকৃষ্ট অপরাধী। তার অবশ্যই কিছু শাস্তি হওয়া উচিত।

রবার্ট ঠোঁট বেঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, শাস্তি হবে না ছাই! আমরা আছি কী করতে? আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে প্রধান সাক্ষী দুজন, লোহিয়া আর তুমি। খতম হবে। আর-একটা মেয়ে আছে, তার স্বামীটা আমাদের দলে ছিল। তারপর বিশ্বাসঘাতকতা করে ধরা পড়ায় তার মাথা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বউটা যাতে সাক্ষী দিতে না পারে, তাই তাকেও গুম করার ব্যবস্থা করেছি। ব্যস, কোনও সাক্ষী না পেলে শাস্তি হবে কী করে? জজসাহেবকেও ঘুষ। খাওয়াব, বড়ভাই বেকসুর খালাস হয়ে যাবে!

কাকাবাবু বললেন, সবটাই এত সোজা?

রবার্ট বলল, তুমি যা ভাবছ, তার চেয়েও সোজা।

বিল্‌ এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। এবার সে বলল, মাস্টার, এবার আমার টাকাটা দিয়ে দাও। আমি চলে যাই।

রবার্ট বলল, ও হ্যাঁ, তোমার টাকা? কত যেন ঠিক হয়েছিল?

বিল্‌ বলল, তিরিশ হাজার ডলার।

কাকাবাবু বললেন, আমার জীবনের দাম মাত্র তিরিশ হাজার ডলার? অনেক বেশি হওয়া উচিত ছিল!

বিল্‌ আর রবার্ট দুজনেই কাকাবাবুর দিকে তাকাল, কিন্তু কেউ কোনও মন্তব্য করল না।

রবার্ট বিল্‌কে বলল, তিরিশ হাজার ঠিক হয়েছিল, তাই না? এখন তোমাকে যদি আমি এক পয়সাও না দিই? মাল তো ডেলিভারি পেয়ে গিয়েছিই। এখন তোমাকে টাকা দিতে অস্বীকার করলে তুমি কী করবে?

পকেট থেকে সে একটা রিভলবার বের করল।

বিল্‌-এর মুখটা পাংশু হয়ে গেল। সে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, সে কী, টাকাটা দেবেন না? আমি এত কষ্ট করে নিয়ে এলাম? আমি গরিব মানুষ!

রবার্ট বলল, আমি জিজ্ঞেস করছি, টাকাটা না দিলে তুমি কী করবে?

বিল্‌ বলল, কী আর করব? আমার আর কতটুকু ক্ষমতা?

রবার্ট বলল, পাবে। তোমাকে একেবারে বঞ্চিত করব না। দামটা বেশিই দেব। এসব কাজ পাঁচ-দশ হাজারেও হয়। ঠিক আছে, তোমাকে কুড়ি দিচ্ছি। বাকি দশ রইল। আবার কখনও যদি তোমাকে কাজে লাগাতে হয়, তখন পাবে।

একটা ব্যাগ থেকে সে কয়েক তাড়া নোট বের করে ছুড়ে দিল বিলের দিকে।

বিল্‌ বলল, অন্তত আরও পাঁচ বেশি দিন স্যার!

রবার্ট প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলল, যাও!

তারপর সে কাকাবাবুর দিকে ফিরে রিভলবারটা তুলে বলল, ওহে, আমি তোমাকে কতরকমভাবে মেরে ফেলতে পারি, শুনবে? এক নম্বর: এক্ষুনি দুটি গুলি চালিয়ে দিতে পারি তোমার বুকে। দুনম্বর: পাহাড়ের চূড়ায় নিয়ে গিয়ে ফেলে দিতে পারি। তিন নম্বর: হাত-পা বেঁধে ফেলে দিতে পারি লেকে। ওখানে হিপোগুলো তোমাকে নিয়ে খেলা করবে। চার নম্বর: তোমাকে নিয়ে…!

কাকাবাবু তাকে বাধা দিয়ে বললেন, অত কিছুর দরকার কী? তুমি আর আমি সামনাসামনি লড়াই করি কোনও অস্ত্র না নিয়ে। দেখা যাক কে জেতে?

বিল্‌ এখনও যায়নি। সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, খবরদার স্যার, ওতে রাজি হবেন না। এ লোকটি অতি ধুরন্ধর। নিশ্চয়ই কোনও কায়দা করবে!

রবার্ট নীচের ঠোঁট উলটে বলল, ওসব কায়দাটায়দা আমি গ্রাহ্য করি। আমি ইচ্ছে করলে এক্ষুনি খালি হাতে ঘ্যাচাং করে ওর মুন্ডুটা ঘুরিয়ে ওর ঘাড়টা ভেঙে দিতে পারি। কিন্তু আমি কোনও খোঁড়া লোকের সঙ্গে লড়াই করি না। তারপর সে কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমায় আমি কী করে মারব জানো? তুমি জন্তু-জানোয়ারদের এত ভালবাসো। সেই জন্তুদের দিয়েই তোমাকে খাওয়াব। লেক মিগাইয়ের উলটো দিকটায় একটা স্পট আছে, তার নাম লায়ন্স ডেন। সেখানে তোমাকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ফেলে রেখে আসব। তুমি পালাতে পারবে না। সিংহরা জল খেতে এসে তোমাকে দেখতে পেলে জলখাবার (স্ন্যাক্স) হিসেবে খেয়ে নেবে। তখন তোমার পশুপ্রেম কোথায় থাকবে? তারপর সে জিম জিম, বলে একজনকে ডাকল।

সেই লোকটি এল, হাতে একটা ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ। কাকাবাবুর বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নেই। সে প্যাট করে সিরিঞ্জটা ঢুকিয়ে দিল তাঁর বাহুতে।

কাকাবাবুর মনে হল, এটা অজ্ঞান করে দেওয়ার মতন কিছু একটা ওষুধ। তাঁর চোখ টেনে আসছে। সেই অবস্থাতেও তিনি বললেন, আমাকে মেরে ফেলতে পারো, কিন্তু লোহিয়াকে তো পাবে না! সে ঠিক…!

রবার্ট হা-হা করে হেসে উঠল।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়