এক জনের নাম শক্তি, অন্য জনের নাম ধ্রুব। এঁরা দুজনে বেশ বন্ধু, কিন্তু সম্প্রতি একটা ব্যাপারে দুজনে রয়েছেন দুই বিপরীত মেরুতে। শক্তি অনেকদিন ‘ফরেন’-এ কাটাবার পর এক সময় ভাবলেন, যথেষ্ট হয়েছে। কলকাতার টানে, বাড়ির লোকজনের টানে, এবং হয়তো দেশের টানে তিনি একদিন আমেরিকা ছেড়ে ফিরে গেলেন কলকাতায়। চাকরি পেতেও অসুবিধে হয়নি। কিন্তু একবছর থাকবার পর ফিরে এসেছেন। নিউ ইয়র্কের বাঙালি মহলে এখন শক্তিই প্রধান আলোচ্য বিষয়। একজন আরেকজনের সঙ্গে দেখা হলেই বলে ওঠে, জানো, শক্তি ফিরে এসেছে? এর অবধারিত উত্তরটি শোনা যায়, জানতুম, আসতেই হবে!

নিউ ইয়র্ক শহরের উপকণ্ঠেই নিউ জার্সি। সেখানকার বাঙালিদের একটি ক্লাব আছে। সেই ক্লাবের কয়েকজন সদস্য এক সন্ধেবেলা আমাকে ডেকেছিলেন আড্ডা মারার জন্য। নিউ জার্সিতে অনেক বাঙালি। একজনের বাড়িতে কাঁচা লঙ্কা ফুরিয়ে গেলে প্রতিবেশী বাঙালির বাড়ি থেকে চেয়ে আনা যায়। সেই আড্ডাতেই দেখা হল শক্তি ও ধ্রুবর সঙ্গে। শক্তিকে নিয়েই আলোচনা চলল অনেকক্ষণ। আমি একবার জিগ্যেস করলুম, থাকতে পারলেন না? কী অসুবিধে হল? শক্তি একটু লাজুক হেসে বললেন, নাঃ! কিছুতেই পারা গেল না। ট্রাম-বাসের ভিড়, মশা, লোডশেডিং এসবও আমি গ্রাহ্য করিনি, কিন্তু অফিসের পরিবেশটাই এমন যে টেকা যায় না।

আমেরিকায় চাকরি করার যোগ্যতা হিসেবে সরকারের কাছ থেকে গ্রিন কার্ড পাওয়া যায়। সেই গ্রিন কার্ড যারা পেয়েছে, তারা এক বছর দু-বছর অনুপস্থিত থাকলেও ফিরে এসে আবার চাকরি পেতে পারে। তাই শক্তির কোনও অসুবিধে হবে না এখানে।

পাশেই বসে আছেন ধ্রুব। তাঁর সুঠাম, বলিষ্ঠ চেহারা। চিবুকে দৃঢ়তার ছাপ আছে। ধ্রুব এখানে ভালো চাকরি করেন, বেশ সচ্ছল অবস্থা, তবু তিনি হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যেসব ছেড়েছুঁড়ে তিনি দেশে ফিরে যাবেন। তাঁর পরিচিত বন্ধুবান্ধবরা শুধু যে অবাক হয়েছে তাই-ই নয়, সবাই শক্তির দৃষ্টান্ত দিয়ে বলছে, এতেও তোমার শিক্ষা হল না? তুমিও সেই একই ভুল করবে? কেউ বা ঠাট্টা করে বলে, যাক না, গোঁয়ারের মতন যেতে চাইছে যাক। জানি তো বছর ঘুরতে-না-ঘুরতেই আবার দৌড়ে ফিরে আসবে।

ধ্রুব কিন্তু দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। অবহেলার সঙ্গে বললেন, আমায় ওসব কথা বলে কোনও লাভ নেই। আমি অনেক ভেবে চিন্তেই যাচ্ছি। গ্রিন কার্ড ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে যাব। আমি বুড়ো বয়েসে একা একা সেন্ট্রাল পার্কে ঘুরে বেড়াব না!

আমার দিকে ফিরে ধ্রুব জিগ্যেস করলেন, আপনি বলুন তো, আমি দেশে গিয়ে থাকতে পারব না?

আমি আমতা-আমতা করলুম। এই সব সিদ্ধান্ত এমনই ব্যক্তিগত যে অন্যের পরামর্শ কোনও কাজে লাগে না।

আচ্ছা হচ্ছিল যাঁর বাড়িতে, তাঁর নাম ভবানী মুখার্জি, বেশ সুপুরুষ ও সুরসিক যুবা। এই ভবানীর সঙ্গে আমার আগে পরিচয় ছিল না। কিন্তু কথায়-কথায় বেরিয়ে পড়ল যে ওঁর দাদা নারায়ণ মুখার্জি আমার অনেকদিনের চেনা। নারায়ণকে আমরা কলকাতায় ফরাসিভাষাবিদ বলে জানি। ওঁদের ছোট ভাই, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গায়ক পিনাকী মুখার্জির কথাও অনেক শুনেছি। একবার এইরকম চেনাশুনো বেরিয়ে পড়লেই কথাবার্তা অনেক সহজ হয়ে যায়।

ভবানীর স্ত্রীর নাম আলোলিকা, এঁর রূপ ও ব্যবহারের মধ্যে বেশ একটা সঙ্গতি আছে। খুবই সুশ্রী ও কোমল। ইনি একজন লেখিকা এবং এখানকার বাচ্চাদের নিয়ে নাচ-গান ও নাটক করান। এঁদের বাড়ির পরিবেশটি চমৎকার। এসেছেন আরও কয়েকজন।

রাত্রি বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে আড্ডা বেশ জমতে লাগল। তবে প্রায়ই ঘুরে-ঘুরে প্রসঙ্গ উঠতে লাগল শক্তি আর ধ্রুবের প্রত্যাবর্তন ও প্রস্থানের ব্যাপারটা। শক্তির মুখে খানিকটা লজ্জিত

অস্বস্তির ভাব আর ধ্রুব-র মুখে জেদ।

উত্তমকুমারের মার্কিন দেশ সফর নিয়ে অনেক মজার মজার গল্প বলছিলেন ভবানী। এঁদের সকলের কথা থেকেই একটা জিনিস ফুটে উঠছিল যে উত্তমকুমারের ভদ্র ব্যবহারে সবাই মুগ্ধ হয়েছেন। কোনও চিত্রতারকার কাছ থেকে এরকম ব্যবহার যেন আশা করা যায় না।

কথায়-কথায় ভবানী আমায় জিগ্যেস করলেন যে, উত্তমকুমার তো এখান থেকে নায়েগ্রা ফলস দেখতে গিয়েছিলেন, আপনি যাবেন না?

আমি বললুম, নায়েগ্রা বোধহয় এমনিতে এমন কিছু দ্রষ্টব্য স্থান নয়। তবে উত্তমকুমার যখন দেখেছেন, তখন নিশ্চয়ই আমারও দেখা উচিত।

ভবানী সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, তা হলে আমার বোন ওখানে থাকে, আপনি ওখানেই উঠবেন।

আলোলিকা বললেন, আমি এক্ষুনি টুনুকে ফোন করে দিচ্ছি।

আমি বললুম, না, না, এক্ষুনি দরকার নেই। কবে যাব, তার ঠিক নেই।

–আপনি কবে কোথায় যাবেন, এখনও কিছু প্ল্যান করেননি?

আমি বললুম, ওই একটা জিনিসই করা হয়ে ওঠেনি।

এবারে ধ্রুব জিগ্যেস করলেন, আপনি কাল কী করছেন?

আমি বললাম, জানি না তো।

ধ্রুব বললেন, আমার কোম্পানি আমাকে নতুন গাড়ি দিয়েছে। আমার তেলের খরচ লাগে না। কাল আমার কোনও কাজ নেই। আপনি কাল যদি কোথাও বেড়াতে যেতে চান, নিয়ে যেতে পারি।

আমি বললুম, এ যে আকাশ থেকে একটা হিরের টুকরো খসে পড়ার মতন প্রস্তাব। কিন্তু কোথায় যাওয়া হবে?

–আপনি আটলান্টিক সিটিতে গেছেন কখনও?

–আমি আটলান্টিক সিটির নামই শুনিনি। সেখানে কী আছে?

–চলুন, ভালো লাগবে?

তক্ষুনি প্রোগ্রাম হয়ে গেল। অনেকেই বেড়াতে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী। কিন্তু সপ্তাহের মাঝখানে কাজের দিন বলে অনেকেরই অসুবিধে। ভবানী যেতে পারবেন না, তাঁর অফিসের কাজ আছে। কিন্তু আলোলিকার খুব আগ্রহ।

কে যেন একজন বললেন, ধ্রুবর সঙ্গে যাচ্ছেন, খুব সাবধান। ও কিন্তু গাড়ির ড্যাসবোর্ডে রিভলবার রাখে।

ধ্রুব বললেন, এখনও রাখিনি, তবে রাখবার ইচ্ছে আছে। আমায় এদেশে কেউ অপমান করলে আমি তাকে ছাড়ব না।

সে রাত্রে বাড়িতে ফিরে মনটা খুব ভালো হয়ে গেল। নায়েগ্রা যাওয়ার কোনও পরিকল্পনা ছিল না। অথচ একটা ব্যবস্থা হয়ে গেল কত সহজে। সদ্য পরিচিত একজন গাড়িতে আটলান্টিক সিটি নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিল। একেই আমাদের ভাষায় বলে পূর্বজন্মের সুকৃতির ফল। সাহেবরা পূর্ব জন্ম মানে না, তবু তারাও এরকম কোনও ব্যাপার বিশ্বাস করে। সাউন্ড অফ মিউজিকে জুলি অ্যান্ড্রুজ একটা গান গেয়েছিল, আমার অল্প বয়েসে নিশ্চয়ই আমি কোনও ভালো কাজ করেছিলুম, এখন তার ফল পেলুম।

পরের দিন আমাদের গাড়িতে যাত্রী সংখ্যা একটু বেড়ে গেল। অম্বুজ মুখার্জির বাড়িতে প্রীতি নামে যে মেয়েটির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল সে যেতে চায়। এবং তার সঙ্গে ছোট্টিমা নামে তার এক বান্ধবী। এই ছোট্টিমা বাঙালি মেয়ে, মুখচোরা স্বভাবের। এবং আলোলিকা তো আছেনই।

মহিলারা বসলেন পেছনে আমি আর ধ্রুব সামনে। ধ্রুবর পুরো নাম ধ্রুব কুণ্ডু। তার ব্যবহারে বেশ একটা বনেদিয়ানা আছে, কথার মধ্যে আত্মপ্রত্যয়ের সুর। যাওয়ার পথে একটা গ্যাস স্টেশনে ঢুকে সে বলল ট্যাঙ্ক ভরতি করে দিতে। কী একটা কারণে অ্যাটেনড্যান্ট একটু দেরি করছিল, ধ্রুব গাড়ি থেকে নেমে তাঁকে প্রচণ্ড এক ধমক লাগালেন। বাঙালি হয়েও তাঁর এত সাহস যে সাহেবদের দেশে তিনি সাহেব জাতিকে এমন ধমক দিতে পারেন। ধ্রুব এদেশে আছেন পুরো ডাঁটের সঙ্গে, তিনি এদেশ ছেড়ে যাচ্ছেন স্বেচ্ছায়।

এক সময় ধ্রুব আমাকে জিগ্যেস করলেন, আচ্ছা, আমার তো এদেশে কোনও কিছুরই অভাব নেই, তবু আমি দেশে ফিরে যেতে চাই কেন বলুন তো?

আমি বললুম, অনেকের কাছে বন্ধুবান্ধব, কলকাতার নিজস্ব আড্ডার টানই বেশি মনে হয় বোধহয়–

–ঠিক তা-ও নয়, আমার অনেক বন্ধুবান্ধব এদেশে। ইন ফ্যাকট আমাদের ব্যাচের অনেক ছেলেই এদেশে চলে এসেছে। এদেশে আড্ডা দেওয়ারও কোনও অসুবিধে নেই।

–তা হলে কেন যাচ্ছেন। আপনিই বলুন।

–যাচ্ছি, আমার যেতে ইচ্ছে করছে বলে। আমি জানি, আর বেশিদিন থাকলে, ফেরা যাবে। এখানে শেকড় গজিয়ে যাবে।

নিউ ইয়র্ক শহর থেকে আটলান্টিক সিটি শ’ দেড়েক মাইল দূর। প্রশস্ত, নতুন রাস্তা। আড়াই ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে গেলুম। শহরে ঢুকবার মুখেই বাতাসে পেলুম সামুদ্রিক গন্ধ। শহরটি একেবারে সমুদ্রের ওপরেই। আগে এখানে ছোটখাটো শহর ছিল, এখন সেটিকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে। এখানে তৈরি হচ্ছে বিরাট একটি জুয়া খেলা ও প্রমোদ কেন্দ্র।

আমেরিকার পশ্চিম দিকে লাস ভেগাস জুয়া ও ফুর্তির জন্য জগৎবিখ্যাত। পূর্বদিকে সে রকম কিছু ছিল না। সেই অভাব পূরণ করার জন্যই গড়ে তোলা হচ্ছে আটলান্টিক সিটিকে। এখন সব বাড়িগুলো সম্পূর্ণ হয়নি। তবে যা হয়েছে তা-ই এলাহি জগঝম্প ব্যাপার। এক-একটা হলের মধ্যে অন্তত দু-তিন হাজার লোক এক সঙ্গে বসে জুয়া খেলতে পারে। শুধু একতলায় নয়। অনবরত এসকেলেটর চলছে, তা দিয়ে ওপরে উঠে গেলে দোতলা তিনতলাতেও প্রায় একই ব্যাপার। এরকম পরপর অনেকগুলো বাড়ি। জুয়া খেলার পদ্ধতিও আছে নানারকম, মেশিন জুয়া, ব্ল্যাক-জ্যাক, রুলেৎ, ডাইস, তাস। শনি-রবিবারেই এখানে ভিড় বেশি হয়। আমরা এসেছি সপ্তাহের মাঝখানে, তাও লোক কম নয়। তবে অধিকাংশই বুড়ো-বুড়ি, এবং বুড়ির সংখ্যাই বেশি। জুয়াড়ি বুড়ি মানেই পাগলিনীর মতন চেহারা। এক সঙ্গে হাজার-হাজার উন্মাদিনী দেখাও একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।

আমরা তো খেলতে আসিনি, আমরা দেখতে এসেছি। দেখার জিনিসও অনেক আছে। রয়েছে নীল জল বিধৌত চমৎকার বেলাভূমি, অনেক নাচ-গানের আসর। উপহার দ্রব্যের অনেক দোকান।

নিছক লঘু কৌতুকেই আমি বললুম, একবার একটু চেষ্টা করে দেখিই না।

নতুন খেলুড়েদের পক্ষে মেশিনই প্রশস্ত। অনেক রকম মেশিন আছে, কোনওটায় পাঁচ পয়সা ফেলতে হয়, কোনওটায় দশ পয়সা, কোনওটাতে সিকি, কোনওটাতে টাকা। আমি একটা খালি মতন মেশিন দেখে তাতে একটা কোয়ার্টার অর্থাৎ সিকি ফেললুম। তারপর একটা অলৌকিক কাণ্ড হল। মেশিনটায় ঝকঝকাং শব্দ হতে-হতে অনবরত পয়সা পড়তে লাগল নীচে। পড়ছে তে-পড়ছেই। মেশিনটা খারাপ হয়ে গেল নাকি। পয়সার একটা স্তূপ জমে যাওয়ার পর মেশিনটা থামল।

ধ্রুব বললেন, আপনি একশোটা পেয়েছেন।

একটা সিকির বদলে একশো? এ যে সাংঘাতিক ব্যাপার। চার আনা দিয়ে পঁচিশ টাকা। সেই স্তূপ থেকে একটা সিকি তুলে নিয়ে আমি ফেললুম পাশের মেশিনটায়।

আবার সেই একই ব্যাপার। ঝকাং-ঝকাং শব্দ ও পয়সা বর্ষণ। আবার একশো সিকি।

আমার বুক ধড়াস-ধড়াস করছে।

আলোলিকা বললেন, বিগিনার্স লাক। আপনি আর খেলবেন না।

কথাটা আমার মোটেই পছন্দ হল না। মেশিনের কি চোখ আছে না মন আছে যে বুঝতে পারবে আমি নতুন খেলতে এসেছি? আজ আমার ভাগ্য ফেরাবার দিন।

কিন্তু এত খুচরো পয়সা নেবো কী করে? কোটের পকেটেও তো রাখা যাবে না।

মাঝে-মাঝে এক-এক জায়গায় শক্ত কাগজের গেলাস রাখা আছে। সেখান থেকে একটা গেলাস এনে ধ্রুব আমাকে বললেন, পয়সাগুলো এতে ভরে নিন। কাছেই কাউন্টার আছে, আপনি খুচরো বদলে টাকা করে আনতে পারেন।

কিন্তু ততক্ষণে আর একটা মেশিনের দিকে আমার চোখ পড়ে গেছে। তাতে লেখা পাঁচটা সিকি এক সঙ্গে দিলে পাঁচ হাজার পাওয়া যাবে।

গেলাসটা নিয়ে গিয়ে সেই মেশিনে পাঁচটা সিকি ফেলে উত্তেজনায় কাঁপতে লাগলুম। মেশিনটা নিঃশব্দে রইল। বেমালুম হজম করে ফেলল। আবার ফেললুম পাঁচটা, আবার সেই একই ব্যাপার। তা হলে আমার পাঁচ হাজারের জন্য আর লোভ করা উচিত নয়।

তার পাশের মেশিনটাতেই অন্য প্রলোভন। এখানে এক ডলার ফেললে পাঁচ হাজার ডলার পর্যন্ত আসবে। এ তো সুবর্ণসুযোগ। একবার পাঁচ হাজার ডলার পেলেই আমার অনেক সমস্যা মিটে যায়। আরও কত জায়গায় নিশ্চিন্তে বেড়াতে পারব।

সিকিগুলো সব বদলে টাকা করে নিয়ে এলুম।

এই ডলার মেশিনটাও টপটপ টাকা খেয়ে ফেলে। কোনও শব্দ করে না। আমি মনে-মনে হিসেব করলুম, যদি পঞ্চাশ ডলার ফেলেও পাঁচ হাজার ডলার পাই, তাতেও তো আমার দারুণ লাভ। পঞ্চাশ বারের মধ্যে আমার ভাগ্য ফিরবে না? তার মধ্যে মেশিনের একবার না একবার দয়া হবে নিশ্চয়ই।

পঞ্চাশ ডলার ফেলতে আমার পনেরো মিনিটও লাগল না। এ মেশিন মহা পেটুক। কিছু বার করে না। আমার সঙ্গের মহিলারা আমায় অনবরত বারণ করে চলেছেন। আমি কর্ণপাত করছি না। পাঁচ হাজার ডলারের দাম যে আমার মতন বেকারের কাছে কতখানি তা ওরা কী বুঝবে!

এই সময় এক বৃদ্ধ আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, ওহে ছোঁকরা, এক মেশিনে বেশিক্ষণ খেললে লাক নষ্ট হয়ে যায়। মেশিন পালটে-পালটে খেলতে হয়।

সেই শুনে আমি যেই সেখান থেকে সরে গেলুম, অমনি সেখানে সেই বৃদ্ধটি ডলার ফেলতে লাগল। তিনবার ফেলার পরই মেশিন শুরু করল ঝকাং-ঝকাং আওয়াজ ও ডলার বৃষ্টি। আমি হাঁ। আর তিনবার ফেললে ওই টাকা তো আমারই ভাগ্যে ছিল।

পাঁচ হাজার নয় অবশ্য, সেই বৃদ্ধ পেল পাঁচশো ডলার। কাঁটাটা কোথায় যায় তার ওপর নির্ভর করে কত টাকা পড়বে। পাঁচশো টাকা কুড়িয়ে নিতে নিতে বৃদ্ধটি আমার দিকে চেয়ে একখানা দুষ্টুমির হাসি হাসল।

আমার তখন মাথায় রক্ত চড়ে গেছে। আমি খেলতে লাগলুম একটা ছেড়ে আর একটা মেশিনে। তারপর রুলে খেলায়। তারপর তাসের বাজিতে। আমার পকেটে নিজের যা ছিল তাও নিঃশেষ। আমি মেয়েদের কাছে ধার দেওয়ার জন্য ঝুলোঝুলি করতে লাগলুম।

ওরা না, না করতে লাগল সমস্বরে। প্রীতি বলল, কত সুন্দর-সুন্দর মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আপনি তাদের পর্যন্ত দেখছেন না। এত খেলার নেশা?

আমি রক্তচক্ষে বললুম, টাকা দেবে কিনা বলো!

ধ্রুব কিছুই না বলে মুচকি মুচকি হাসছেন আর মাঝে-মাঝে নিজেও খেলে যাচ্ছেন এখানে সেখানে। ধ্রুবর ঠিক করাই আছে ঠিক পঁচিশ ডলার খেলবেন, তাতে হার জিৎ যাই হোক।

শেষ পর্যন্ত মেয়েরা আমাকে প্রায় জোর করেই টেনে নিয়ে এলেন বাইরে।

প্রীতি আমাকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, কী হয়েছিল আপনার?

শূন্য পকেটে হাত ঢুকিয়ে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললুম, আমি সত্যিই পাগল হয়ে গিয়েছিলুম, তাই না।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়