মাঝে মাঝে আমি ভাববার চেষ্টা করি, এইসব দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের কোথায় কোথায় মিল।

একটু ফাঁকা জায়গা দিয়ে গাড়ি করে যেতে-যেতে মনে হয়, এখন অনায়াসেই ভাবতে পারি। যে নিজের দেশেরই কোনও জায়গা দিয়ে যাচ্ছি। আকাশ তো একই রকম, দূরের মাঠও একই রকম। গাছপালার, চেহারা একটু আলাদা হলেও কিছু আসে যায় না, কাশ্মীর বা শিলং-এর গাছ আর পুরুলিয়া-বর্ধমানের গাছও তো আলাদা। রাস্তার পাশে খানাডোবা দেখলে আমার বড় আনন্দ হয়, খুব চেনা লাগে। নোংরা জলের সেরকম খানাডোবা এদেশে একেবারে দুর্লভ নয়।

কিন্তু তফাত আসলে অনেক। পৃথিবীর এ-পিঠ আর ও-পিঠ, তফাত হবে না?

যেকোনও বাড়ি দেখলেই মনে পড়ে যায়, অন্য দেশে আছি। খুব বরফ পড়ে বলে কোনও বাড়িরই ছাদ সমতল নয়। এ দেশের সাধারণ লোকের বসত বাড়ি একতলা বা দোতলা এবং প্রায় পুরোটাই কাঠের তৈরি, এইসব বাড়ির ছাদ সমতল হলে ওপরে বরফ জমে ছাদ ভেঙে পড়বে। এরকম চুড়োওয়ালা বাড়ি আমাদের দেশের শৈল নিবাসগুলিতে কিছু-কিছু চোখে পড়লেও সেগুলোকে আমরা সাহেবি বাড়ি বলেই জানি।

বাড়ির পরেই গাড়ি। এতরকমের গাড়ি তো আমাদের দেশে দেখবার উপায় নেই। এক জায়গায় যদি তিরিশটা গাড়ি থেমে থাকে, তবে তিরিশটাই আলাদা মডেলের। গাড়িগুলি চলে নিঃশব্দে, ভেতরে বসে থাকলে তো কোনও আওয়াজই পাওয়া যায় না, আর প্রায় প্রতিটি গাড়িই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। গাড়িতে হর্ন থাকে একটা অলঙ্কার হিসেবে, কেউ হর্ন বাজায় না। দৈবাৎ কারুর হর্নে হাত লেগে গেলে সে লজ্জায় জিভ কাটে। কোনও গাড়ির পিছনে হর্ন দেওয়া মানে তাকে প্যাঁক দেওয়া। একমাত্র যারা নতুন বিয়ে করে চার্চ থেকে বেরোয়, তখন তারা প্যাঁপাঁ করে হর্ন বাজাতে বাজাতে যায়। সেরকম ভাবলে আমাদের দেশের প্রত্যেকটি গাড়িই নতুন বিবাহিতদের।

এরা পৃথিবীর প্রায় সব দেশের গাড়ি কেনে। যার যেরকম গাড়ি পছন্দ তা কিনতে বাধা নেই। আমাদের ভারতবর্ষে যে বিদেশি গাড়ি নিষিদ্ধ তার জন্য আমাদের গর্ব হওয়ার কথা। আমরা নিজেদের গাড়ি বানাই, এশিয়ার অনেক গরিব দেশ মোটর গাড়িতে স্বনির্ভর নয়। বেশ ভালো কথা। কিন্তু এদেশের লোকরা যখন জিগ্যেস করে, তোমাদের গাড়ি দিন দিন খারাপ হচ্ছে কেন, তখন উত্তর খুঁজে পাই না। আমরা অনেকেই বলি, পুরোনো মডেলের অ্যাম্বাসাডর কিংবা ফিয়াট এখনকার নতুনগুলোর তুলনায় অনেক ভালো। এদেশের বিচারে এটা অত্যন্ত অদ্ভুত। যন্ত্রপাতির জিনিস তো দিন দিন আরও উন্নত, আরও ভালো হওয়ার কথা। আমাদের দিশি গাড়িগুলোর কলকবজা দিন-দিন নিকৃষ্ট হচ্ছে আবার দামও বেড়ে যাচ্ছে। এদের গাড়ি দিন দিন উন্নত মানের ও বেশি আরামদায়ক হচ্ছে, সেই তুলনায় দামও কমছে। জাপানি গাড়ির সস্তা দামের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে তো আমেরিকায় গাড়ি-কোম্পানিগুলির ত্রাহি-ত্রাহি অবস্থা। জাপান না হয় শিল্প জাদুকরদের দেশ, কিন্তু শুনছি ছোট্ট দেশ উত্তর কোরিয়া আরও সস্তা আরও মজবুত গাড়ি নিয়ে এখানকার বাজারে ধেয়ে আসছে। তবে কেন ভারতীয় গাড়ি এখানকার রাস্তা দিয়ে চলবে না?

চালককে সাবধান করে দেওয়ার জন্য এখানকার গাড়িতে নানা রকম শব্দ হয় ও আলো জ্বলে ওঠে তো বটেই, কোনও-কোনও গাড়ি আবার কথাও বলে। কেউ হয়তো ব্যাক লাইট না নিভিয়ে ভুল করে নেমে পড়ছে, অমনি গাড়ি বলে উঠল, ওগো প্রিয়, তুমি যে বাতি নেভাতে ভুলে গেছ! নিভিয়ে দিয়ে যাও, লক্ষ্মীটি! তাও পুরোনো স্ত্রীর মতন ঘ্যানঘ্যানে গলায় নয়, নতুন প্রেমিকার মতন সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরে।

গাড়ির পরে রাস্তা। ভালো রাস্তা যে আমাদের দেশে নেই তা নয়, চওড়া রাস্তাও কিছু কিছু আছে, কিন্তু মাইলের পর মাইল, একশো, দুশো, পাঁচশো, হাজার মাইল একইরকম মসৃণ বিশাল রাস্তার কথা কি আমরা কল্পনা করতে পারি? একটাও ট্রাফিক লাইটে থামতে হবে না এইরকমভাবে একশো-দুশো মাইল চলে যাওয়া যায়। শহরের বাইরে সব রাস্তায় যাওয়া-আসার পথ আলাদা। দু-দিকে চারটে-চারটে আটটা গাড়ি চলতে পারে, এমন রাস্তা উত্তর-আমেরিকা মহাদেশটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।

দেখে শুনে মনে হয়, এদেশে গাড়ি চালানো খুব সহজ। এত সহজ বলেই বোধহয় এদেশে গাড়ি দুর্ঘটনা হয় বেশি।

পুরো দেশটাই গাড়িনির্ভর। ছুতোর মিস্ত্রি, কলের মিস্ত্রি, পোস্টম্যান, স্কুল শিক্ষক এমনকী অনেক ছাত্রছাত্রীরও নিজস্ব গাড়ি আছে। যেকোনও লোক তার দু-তিন মাসের মাইনে জমিয়ে বেশ ঝকমকে তকতকে একটা সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়ি কিনতে পারে। আর একেবারে নতুন গাড়িও কেনা যায় পাঁচ-ছ’মাসের মাইনেতে। একটা পরিসংখ্যান দেখছিলুম, আমেরিকায় লোকের নিম্নতম আয় সাড়ে আটশো ডলার। ডলারকে টাকাই ধরতে হবে এদেশের মান অনুযায়ী। আমাদের দেশের গরিবদের কথা বাদ দিচ্ছি, কিন্তু ব্যাঙ্কের পিওন বা কয়লাখনির শ্রমিকের আয় ওইরকমই টাকা। তারা গাড়ি করে ঘুরছে, এমন চিন্তা করা যায়? এদেশে কিন্তু আড়াই-তিন হাজার ডলারে বেশ চালু গাড়ি পাওয়া যায়। আর পরিসংখ্যান যাই বলুক, দোকান কর্মচারি বা ছুতোর মিস্তিরির রোজগার মাসে বারো-চোদ্দোশো ডলারের কম নয়।

মনে করুন, আপনার বাড়ির জলের পাইপে গুরুতর গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। শীতের সময় কলে গরম জল না এলে কিংবা কমোডের ফ্ল্যাশ ঠিক মতন কাজ না করলে সারা বাড়িতে দারুণ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। আপনার বাড়ির নোংরা জল তো আর রাস্তায় যাওয়ার উপায় নেই, তেমন হলে মিউনিসিপ্যালিটি এমন ফাইন করবে যে আপনার ঘটি-বাটি বন্ধক দিতে হবে। সুতরাং জলের পাইপ খারাপ হওয়া মাত্র আপনি ডাক্তারকে কল দেওয়ার মতন টেলিফোনে কলের মিস্তিরিকে খবর দিলেন। মিস্তিরিমশাই যে-মুহূর্তে টেলিফোন ধরলেন, সেই মুহূর্ত থেকে তাঁর সময়ের হিসেব হবে। অবশ্য তিনি আসবেন ঝড়ের বেগে নিজস্ব গাড়ি হাঁকিয়ে, এসেই চটপট কাজ শুরু করে দেবেন। ধরা যাক, ঊনপঞ্চাশ মিনিট পর আপনার কল দিয়ে আবার ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল, আপনি সন্তুষ্ট হয়ে ঘাড় নাড়লেন। তখন মিস্তিরিমশাই পকেট থেকে ক্যালকুলেটর বার করে, ধরুন মিনিটে দেড় ডলার হিসেবে তাঁর মজুরি কত হয় তা হিসেব করে ফেললেন। আপনার সাড়ে তিয়াত্তর ডলার খসে গেল।

আপনার মনে হতে পারে, ওরে বাপরে, এত রেট কলের মিস্তিরির। তা তো হবেই, কারণ তিনি তো প্রত্যেকদিনই ঘনঘন কল পান না। খরচ বাঁচাবার জন্য প্রত্যেকেই বাড়ির ছোটখাটো কাজ নিজের হাতে করে। মিস্তিরি মশাই হয়তো গড়ে মাসে তিরিশবার কল পান, সেইজন্যই তিনি উচ্চ রেট করে রেখেছেন, যাতে সমাজের আর পাঁচজনের মতন তিনিও সমান মর্যাদায় জীবন কাটাতে পারেন। কলের মিস্তিরির কাজ করেন বলে তিনি আর পাঁচজনের চেয়ে কোনও অংশে ছোট নন!

হাতি কেনা সহজ, কিন্তু তার প্রতিদিনের খাদ্য জোগাড় করাই যে আসলে বিরাট খরচের ব্যাপার, গাড়ির বেলাতেও সেইরকম তেল। ভারতে দিন দিন তেলের দাম আকাশ ছুঁচ্ছে, সেই তুলনায় এদেশে তেলের দাম অবিশ্বাস্য রকম সস্তা। এক গ্যালন (সাড়ে চার লিটার তেলের দাম পাঁচ সিকে থেকে এক টাকা চল্লিশ পয়সার মধ্যে। এটা অবশ্য ডলারের হিসেব, টাকার হিসেবেও মাত্র এগারো-বারো টাকা! আমাদের দেশে যে ব্যক্তির আয় এক হাজার টাকা, সে যদি দেড় টাকায় পাঁচ লিটার পেট্রোল পেত, তাহলে নিশ্চয়ই ট্রাম-বাস এড়াবার জন্য যেকোনও উপায়ে মরিয়া হয়ে একটা গাড়ি কিনে ফেলত।

এদেশে তেল পাওয়া যায় দু-তিন রকম, লেডেড, আন লেডেড, সুপার লেডেড। গাড়ির তেলপোড়া ধোঁয়ায় স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় বলে এরা এখন চিন্তিত। সেই জন্য গাড়ির যন্ত্রপাতি পালটানো হচ্ছে, তেলও শুদ্ধ করা হচ্ছে।

এখানে একজন অধ্যাপকের একটি চমৎকার সুদৃশ্য দোতলা বাড়ি আছে, তাঁর দুটি গাড়ি, একটি স্ত্রীর জন্য, একটি নিজের জন্য, দুটি টিভি, তার মধ্যে একটি বাচ্চাদের ভিডিও খেলার জন্য, ডিস ওয়াশিং মেশিন আছে। তিনি তিনটি মেয়েকে পড়াবার খরচ চালান। এর মধ্যে একজন তাঁর স্ত্রী। তা ছাড়া এই অধ্যাপকের প্রচুর বই ও রেকর্ড কেনবার এবং ছবি তোলা ও ভ্রমণের শখ আছে। এবং আমার মতন ভ্যাগাবন্ড ঘুরতে-ঘুরতে এখানে এসে পড়লে তিনি অম্লানবদনে দিনের পর দিন আশ্রয় দেন। অর্থাৎ আমি দীপকদার কথা বলছি।

এঁর সঙ্গে আমাদের দেশের অধ্যাপকদের তুলনা করলে নিশ্চয়ই দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হবে। অবশ্য দীপকদা নিজের গাড়ি নিজেই ধোওয়া মোছা করেন, বাড়ির বাগানের ঘাস কাটেন, বাড়ি রং করার সময় নিজেই ব্রাশ আর রং নিয়ে বাড়ির ছাদে উঠে যান এবং একদিন অন্তর অন্তর বাড়ির বাসনপত্তর মাজেন। আমাদের দেশের অধ্যাপকরা করেন এসব কি কাজ?

হঠাৎ দেশ থেকে জয়তীদির মেজদি এসে উপস্থিত হলেন।

এঁরও চেহারা বেশ ছিপছিপে, তবে জয়তীদির মতন অতটা নন। চোখে চশমা, দারুণ ছটফটে। ভদ্রমহিলার চশমা দিনে অন্তত দশবার হারায়। সারা বাড়ির লোক চশমা খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রতি এক ঘন্টা-দু’ঘন্টা অন্তরই মেজদি সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে অসহায় মুখ করে বলবেন, এই, আমার চশমাটা কোথায় রেখেছি? অমনি আমরা সবাই বেসমেন্ট থেকে রান্নাঘর পর্যন্ত সব জায়গায় চশমা খুঁজতে শুরু করি। কখনও হয়তো মেজদির চশমা চোখেই আছে, তবু দীপকদা মজা করে জিগ্যেস করেন, মেজদি, আপনার চশমা? অমনি তিনি ব্যস্ত হয়ে বলে ওঠেন, তাই তো, কোথায় রাখলুম এই মাত্র?

মানুষের নাম ভুল করার ব্যাপারেও জুড়ি নেই মেজদির। আমার সংক্ষিপ্ত নীলু নামটির বদলে তিনি কখনও শম্ভু, কখনও মহেন্দ্র, কখনও ধনঞ্জয় ইত্যাদি কত নামেই যে ডাকেন, তার ঠিক নেই। আমি অবশ্য প্রত্যেকবারই সাড়া দিয়ে যাই।

জয়তীদির ব্যক্তিত্ব আছে খুব, তিনি ছটফট করেন না, তিনি তাঁর এই ভুলোমনা মেজদিটিকে সামলাবার চেষ্টা করেন সব সময়। এক এক সময় বোঝাই যায় না, ওঁদের দুজনের মধ্যে কে বড় কে ছোট।

যাই হোক, এই মেজদি এসে পড়ায় বেশ জমে গেল। জয়তীদির পরীক্ষা হয়ে গেছে, তাঁর মেয়েদেরও ছুটি, দীপকদা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক মাসের ছুটি নিয়েছেন, সুতরাং প্রায়ই নানান জায়গায় বেড়াতে যাওয়া শুরু হল। কোনওদিন বাইরের হোটেলে খাওয়া, কোনওদিন সিনেমা, কোনোদিন দূরের কোনও শপিংমহল ঘোরাঘুরি।

এ ছাড়া সপ্তাহান্তে এর ওর বাড়ি নেমন্তন্ন তো লেগে আছেই।

এর মধ্যে একদিন একটা জিনিস দেখে চমৎকৃত হলুম।

দীপকদা জয়তীদি এই বাড়িটা বিক্রি করে আর একটা বড় বাড়ি কেনার কথা ভাবছেন। এদেশে ভাড়া বাড়িতে থাকা সাংঘাতিক খরচের, তার চেয়ে কিছু টাকা জমিয়ে বাড়ি কিনে ফেলা অনেক সহজ। অনেক রকমের ঋণ পাওয়া যায়, বাড়ি কিনলে ইনকামট্যাক্সের অনেক সুবিধে হয়। এদেশে যেমন লোকেরা ঘনঘন গাড়ি বদল করে, সেইরকম কয়েক বছর অন্তর বাড়িও পালটায়। পুরোনো বাড়ি বিক্রি করে নতুন বাড়ি কেনার মধ্যে কী সব অঙ্কের ব্যাপারও আছে।

মেজদি আসার পর জয়তীদি নতুন বাড়ি দেখতে শুরু করলেন। আমিও ওঁদের সঙ্গী।

এমনভাবে যে বিক্রির জন্য বাড়ি সাজানো থাকে, তা কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবিনি।

এখানে বাড়ি তৈরি ও বিক্রির নানারকম কোম্পানি আছে। তারা বাড়ি তৈরি করে নিখুঁতভাবে সাজিয়ে রেখে দেয়, ইচ্ছুক ক্রেতারা সেই সব বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখতে পারে। সেসব কী বাড়ি, দেখলে চোখ কপালে উঠে যায়।

কোনও কোনও পাড়ায় এরকম নতুন বাড়ি পরপর সাজানো আছে। এগুলোকে বলে শো হাউজ। কোনও একটা বাড়িতে গিয়ে ঘণ্টা বাজালেই একজন কেউ দরজা খুলে দিয়ে অভ্যর্থনা করবে। তারপর সেই লোকটি বা ভদ্রমহিলাটি সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সারা বাড়ি দেখাবে, অথবা, ইচ্ছুক ক্রেতারা নিজেরাই ইচ্ছে করলে যেকোনও জায়গায় ঘুরে দেখতে পারে। সমস্ত বাড়িতে কার্পেট পাতা, জানালায় রং মেলানো পরদা, দেওয়াল আলমারির রং ও ডিজাইন অনুযায়ী বিশেষ রকমের চেয়ার ও টেবিল, খাট, বিছানা। এমনকী বসবার ঘরে যেটা তাস খেলার টেবিল, তার ওপরে রাখা আছে দু’সেট তাস, টেবিলে কাপ-ডিশ ও টি পট, কোনও কোনও দেওয়ালে ছবি পর্যন্ত। অর্থাৎ এই মুহূর্তে দাম চুকিয়ে দিয়ে যে-কেউ এক্ষুনি এই বাড়িতে বসবাস করতে পারে।

ঠিক যেন হলিউডের কোনও সিনেমার সেট, এক্ষুনি শুটিং শুরু হবে।

বাড়ি বিক্রি কোম্পানির যে প্রতিনিধি সেখানে উপস্থিত, তাকে বললে যেকোনও আসবাব বা কার্পেট-এর রং বদলে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। দাম কীরকম? দাম বলবে, দেড় লক্ষ টাকা…আস্কিং। অর্থাৎ ওই টাকা চাওয়া হলেও দরাদরির সুযোগ আছে।

বাড়িগুলো বাইরে থেকে প্রায় একরকম দেখতে হলেও, প্রত্যেক বাড়িরই ভেতরের ব্যবস্থা আলাদা। কত রকম ডিজাইনই যে মন থেকে বার করতে পারে!

আমরা ঘুরে ঘুরে এরকম বেশ কয়েকটা বাড়ি দেখে ফেললুম। আমি নিজেই এমন ভাব করতে লাগলুম, যেন এক্ষুনি একটা বাড়ি কিনে ফেলতে পারি, নেহাত দোতলায় ওঠার সিঁড়িটা পছন্দ হচ্ছে না। কোনও বাড়ি দেখতে গিয়ে রক্ষয়িত্রীকে গম্ভীরভাবে জিগ্যেস করি, বাথরুমে পিঙ্ক রঙের বাথটবটা বেশ ভালোই লাগছে কিন্তু সনা বাথের ব্যবস্থা নেই?

আমরা কালো লোক হলেও এই সব বাড়ি কোম্পানির প্রতিনিধিরা আমাদের মোটেই অবজ্ঞা করে না, আমরা সত্যিই ক্রেতা কিনা তাতেও সন্দেহ করে না। কানাডায় ভারতীয়রা বেশ সচ্ছল সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত।

কুড়ি-পঁচিশটা বাড়ি দেখার পরও জয়তীদির বা তাঁর মেজদির একটাও বাড়ি পছন্দ হল না। আমিও বাড়ি দেখে ক্লান্ত হয়ে গেলুম।

অতিথি কথাটার মানে বোধহয় এই যে, এক তিথির বেশি থাকে না। দীপকদার বাড়িতে আমার পনেরো দিনের বেশি কেটে গেছে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে যত তোমার আতিথ্যকে লম্বা করবে, তত তোমার সমাদর কমে যাবে। কিংবা, আরও বলে, মাছ এবং অতিথি দুদিন পরেই পচা গন্ধ ছাড়তে শুরু করে। সুতরাং এবার আমার কেটে পড়াই উচিত।

একদিন কাঁচুমাচু মুখ করে দীপকদাকে বললুম, দীপকদা…মানে…এবার তাহলে আমি যাই…আমার অন্য জায়গায় যাওয়ার কথা আছে…যদি দয়া করে একটু এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেন…।

দীপকদা বললেন পাগল নাকি! এক্ষুনি কোথায় যাবে? তোমায় কি আটকে রেখেছি এমনি এমনি? মেজদি এসে গেছেন, এবার আমরা অনেক দূরে বেড়াতে যাব।সত্যি-সত্যি এর দুদিন পরেই আমরা বেরিয়ে পড়লুম দূরপাল্লার ভ্রমণে।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়