মুখার্জি সাহেব গাড়িটা আস্তে করে আমায় জানলা দিয়ে দেখিয়ে বললেন, দেখছেন, ম্যাপল পাতাগুলো কী সুন্দর লাল হয়েছে।

পিছনের সিটে বসেছিল মুখার্জি সাহেবের সাত বছরের মেয়ে ঝুমি। সে আইসক্রিম মাখা মুখে বলল, ড্যারি (অর্থাৎ ড্যাডি) হাউ মেনি টাইমস আই টোলড য়ু, ইট ওয়াজ নট ম্যাপেল! ইট ওয়াজ মে-পল কানচ য় রিমেমবার?

মুখার্জি সাহেব কাঁচুমাচুমুখে বললেন, আচ্ছা বাবা হয়েছে, হয়েছে। এবার থেকে ঠিক বলবো–মেপল, মেপল! হল তো!

আমি হাসতে লাগলুম। মুখার্জি সাহেব এরকম ভুল প্রায়ই করেন এবং ধমক খান মেয়ের কাছ থেকে। উনি হয়তো আমাকে সিঙাড়া খাওয়াতে-খাওয়াতে গত গ্রীষ্মের ভ্রমণ কাহিনী শোনাচ্ছেন; তারপর বুঝলে। আমরা তো গাড়ি নিয়ে পৌঁছলুম গোলড ওয়াটারের দেশ আরিজোনায় উঠছি টাকসন শহরের এক–টেলিভিসানের সামনে থেকে মুখ ফিরিয়ে ঝুমি ইংরেজিতে ধমকালো, আবার ট্যাকসন! বলেছি না টুসন!

–ও হ্যাঁ হ্যাঁ। মনে থাকে না। এমন বিচ্ছিরি বানানটা।

তারপর মুখার্জি সাহেব আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, দেখছো তো কাণ্ডটা! আমিও আমেরিকায় আছি পাঁচ বছর, আমার মেয়েও আছে পাঁচ বছর। অথচ ও কীরকম কথায়-কথায় আমার ভুল ধরে! আমি যেন একটা মুখ।

না, মুখার্জি সাহেব যে মুখ নন তাতে সন্দেহ নেই। উদ্ভিদবিদ্যায় তিনি প্রখ্যাত পণ্ডিত, আমেরিকায় আমন্ত্রিত অধ্যাপক। বছর পাঁচেক এদেশেই আছেন। সদালাপী মজলিশি লোক, কথাবার্তায় পাণ্ডিত্যের কোনও অভিমান নেই।

আমি আসি মাঝে-মাঝে আড্ডা দিতে, বাংলায় হাসাহাসি করতে। ওঁর স্ত্রীও সুন্দর রান্না করেন। কিন্তু ওঁদের মেয়ে ঝুমিকে দেখলে একটু অস্বস্তিবোধ করি, ওর মুখে ইংরেজির ফুলঝুরি শুনে আমিও খানিকটা হকচকিয়ে যাই। অথচ হালকা চেহারায় ঝুমিকে দেখতে ঝুমকো ফুলের মতই সুন্দর। সে যখন এদেশে আসে তখন তার বয়স দুই। এই পাঁচ বছরে সে বাংলা ভাষা আর শেখেনি। কিন্তু খাঁটি নাকি সুরে আমেরিকায ভাষা শিখেছে।

এই রকম আরও দেখেছি। প্রবীন বয়স্কদের তুলনায় শিশুরা অনেক দ্রুত শিখে নিচ্ছে সেই দেশের ভাষা এবং সেইরকম দ্রুতভাবেই অনেক কথা, ভুলে যায় মাতৃভাষা। বয়স্করা ছেলেবেলা থেকে যে সব ভুল উচ্চারণ শিখে এসেছেন তা আর বদলাতে পারেন না সহজে-গানের সুর একবার ভুল শিখলে যেমন সহজে আর আসল সুরটা ভোলা যায় না। শিকাগোতে অর্থনীতির একজন বাঙালি ছাত্র-চার বছর থাকার পরও এখনও উচ্চারণ করে চিকাগো। আমার মৃদু হাসি দেখে তিনি বললেন, কী করবো ভাই সেই যে ছেলেবেলায় পড়েছিলুম স্বামী বিবেকানন্দ চিকাগোতে বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন–তারপর থেকে মুখ দিয়ে শুধু চিকাগো বেরিয়ে যায়।

জেনিভাতে আছেন এরকম এক দম্পতি, ছ’বছর ধরে, ভদ্রলোক কর্মাশিয়াল আর্টিস্টের কাজ করেন। জেনিভার ভাষা হচ্ছে ফরাসি কিন্তু আমাদের পরিচিত এই ভদ্রলোক ছ বছরেও ভালো ফরাসি শিখতে পারেননি। অথচ ওর পাঁচ বছরের ছেলে বন্টু কি ঝরঝর করে ফরাসি বলে। ওর বাবা অনেক সময় ডেকে জিজ্ঞাসা করেন। হ্যাঁরে, বন্টু, হাতুড়ির ফরাসি কী রে? বলু অম্লানমুখে বলে দেয়। দুজনেরই পাঁচ বছরে শেখা।

প্রবাসে আমাদের শিশুদের দেখতে ভালোই লাগে। সুন্দর স্বাস্থ্যবান চেহারা হয়, চমৎকার পোশাক পরিচ্ছন্ন থাকতে শেখে–সেই সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার এবং খেলাধুলো। বিদেশি ভাষাকে ওরকম আয়ত্ত করাও কম নয়। তবে ক্লাশের ছেলের কাছ থেকে শিখে আসা দু-একটা স্ল্যাং বা শপথ ওদের মুখে শুনলে একটু অস্বস্তি লাগে। বয়স্করা কিন্তু বিদেশে গেলে সে ভাষার শ্ল্যাং সাধারণত ব্যবহার করেন না,-কারণ, অপপ্রয়োগ হবার সম্ভাবনাই বেশি।

প্রবাসে বাচ্চা ছেলেমেয়েরা আর, একটা সমস্যার কিন্তু খুব সহজ সমাধান করে নেয়। আজকাল নতুন করে বর্ণবৈষম্যের হাওয়া উঠছে প্রায় পৃথিবীর সব দেশেই-পক্ষে বা বিপক্ষে কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে সর্বত্র, সুতরাং সামান্য আত্মসম্মানজ্ঞান সম্পন্ন যে-কোনও ব্যক্তি বিদেশে গিয়ে এজন্য মাঝে-মাঝে অস্বস্তি বোধ করবেন। কোনও রেস্টুরেন্টে ঢুকে যদি মনে হয় তাঁর গায়ের রং কালো বলে–কেউ বারবার তাকাচ্ছে। তখন কোনওরকম প্রতিবাদ করার প্রবৃত্তি তাঁর হবে না। বরং সেখান থেকে বেরিয়ে আসবেন! কিন্তু বাচ্চাদের কথা আলাদা।

ইংল্যান্ডের সারে অঞ্চলের একটি পরিবারের সঙ্গে আমার পরিচয় হল। স্বামী স্ত্রী দুজনেই বাঙালি। একটি ন’বছরের স্বাস্থ্যবান ছেলে। একদিন ছেলেটি স্কুলের ছুটির পর ফিরে এলহাতে মুখে রক্ত।

ওকী! ওকী! ওকী হয়েছে তোর?

ছেলেটা কিন্তু একটুও ভয় পায়নি বা দমেনি। তেজের সঙ্গে বলল, জানো মা, পার্কের পাশে কয়েকটা ছেলে আমাকে ব্ল্যাকি, ব্ল্যাকি, নিগার, নিগার বলে রাগাচ্ছিল। এমন ঘুষি মেরেছি না, দুজনের নাক ফাটিয়ে দিয়েছি!

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়