একটা ট্যাক্সি ডেকে হাওড়া স্টেশন। সেখান থেকে ট্রেনে জসিডি।

জসিডি স্টেশনে দলবল নিয়ে অপেক্ষা করছিল বাদশা। তার পুরো নাম সিরাজুল হক, সবাই তাকে বাদশা বলেই ডাকে। যেমন লম্বা, তেমনই চওড়া চেহারা। খুব দিলদরিয়া মানুষ। বন্ধুবান্ধবদের খুব খাওয়াতে ভালবাসে। মধুপুর, দেওঘর, জসিডি, শিমুলতলায় তার চারখানা রেডিয়ো, টিভির দোকান আছে। চলে বেশ ভালই। তার নিজের বাড়ি শিমুলতলায়। সেখানে সে আর-একটা বড় বাড়ি কিনেছে।

বাদশা একটা টাটা সুমো গাড়ি এনেছে। জসিডি থেকে শিমুলতলা বেশি দূর নয়।

গাড়িতে উঠে বাদশা বলল, কাকাবাবু, আজ রাতেই কি ভূতের বাড়িতে থাকবেন, না প্রথম রাতটা কাটাবেন আমার বাড়িতে? আমার বাড়িতেও ভাল ব্যবস্থা আছে।

কাকাবাবু কিছু বলার আগেই সন্তু উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠল, ভূতের বাড়ি, ভূতের বাড়িতে থাকব!

কাকাবাবু বললেন, দ্যাখো বাদশা, আমি তো আর ভূত ধরতে আসিনি। সেটা আমার কম্মো নয়। আমি এসেছি, সন্তু আর জোজো এই দিকটায় বেড়াতে আসতে চাইছিল আর তোমার বাড়িতে নাকি দারুণ বিরিয়ানি রান্না হয়, তা চেখে দেখার জন্য। যে বাড়িতেই থাকি, তাতে কিছু আসে যায় না।

জোজো জিজ্ঞেস করল, সত্যি ভূত আছে?

বাদশা বলল, সত্যি ভূত না মিথ্যে ভূত, তা জানি না। তবে পাড়ার লোক ওটাকে বলে ভূতের বাড়ি। আমি নিজের কানে শুনেছি, ও-বাড়িতে একএক দিন রাতে নানারকম বিকট শব্দ হয়। দুমদুম করে পায়ের আওয়াজ হয়। সিঁড়িতে। দরজা-জানলা দড়াম দড়াম করে পড়ে। ভয়ে কেউ সন্ধের পর ওই বাড়ির ধারেকাছে যায় না।

সন্তু বলল, শুধু শব্দ? ভূতে কোনও ক্ষতি করে না?

বাদশা বলল, এককালে এখানে বাঙালিরা অনেক বড় বড় বাড়ি বানিয়েছিল শখ করে। ছুটি কাটাতে আসত সপরিবার। এখন অনেকেরই আর বংশধর নেই। থাকলেও এদিকে আসে না, বিলেত-আমেরিকায় যায়। বাড়িগুলো ভেঙে ভেঙে নষ্ট হচ্ছে। সেরকম একটা বাড়ি আমি কিনেছি। দিল্লির সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রমথনাথ মিত্রের বাড়ি ছিল ওটা। পনেরোখানা ঘর, বিশাল বিশাল বারান্দা, অনেকখানি জায়গা জুড়ে বাগান, সবই প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। আমি পুরো বাড়িটাই ভেঙে ফেলে ওখানে একটা হোটেল বানাব ঠিক করেছি। কিন্তু ভূতেরা বাধা দিচ্ছে বলে হচ্ছে না।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, কী করে বাধা দিচ্ছে? শুধু আওয়াজ করে?

বাদশা বলল, না। কন্ট্রাক্টরের একজন লোককে একদিন দুপুরে সিঁড়ি দিয়ে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। তার হাত ভেঙে গিয়েছে। সে আর ও বাড়িতে ঢোকে না। বাড়িটা যেদিন ভাঙা শুরু হল, সেদিন…

জোজো বলল, যাকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, সে কি কাউকে দেখেছে?

বাদশা বলল, হ্যাঁ, সে বলেছে, সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়তে পড়তে সে দেখেছে, সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে একটা সাদা কাপড় পরা কঙ্কাল!

কাকাবাবু আপন মনে বললেন, সাদা কাপড় পরা। সব ভূতই সাদা কাপড় পরে?

বাদশা আবার বলল, যেদিন বাড়িটা ভাঙা শুরু হয়, সেদিন বিকেলের দিকে একজন মিস্তিরি রক্তবমি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গেল। জ্ঞান ফেরার পর সেও বলেছে, একটা কঙ্কাল এসে দাঁড়িয়েছিল তার সামনে! থুথু করে থুতু ছিটিয়ে দিয়েছে তার গায়ে। সে গ্রামে ফিরে গিয়েছে। আর কোনও মিস্তিরিও কাজ করতে রাজি হচ্ছে না।

কাকাবাবু বললেন, কঙ্কালের থুতু? কঙ্কালের কি জিভ থাকে? কখনও শোনা যায়নি।

সন্তু বলল, আমিও এটা নতুন শুনছি।

কাকাবাবু বললেন, যে মিস্তিরি রক্তবমি করেছে, তার টিবি রোগ আছে কিনা খোঁজ নেওয়া হয়েছে? এরা প্রচুর পরিশ্রম করে। সেই অনুযায়ী ভাল খাবারদাবার খেতে পায় না। অনেকেরই টিবি হয়। রোগটা অনেকখানি ছড়ালে রক্ত পড়ে।

বাদশা বলল, কাকাবাবু, আমি জানি, আপনি এসব কিছুই বিশ্বাস করেন না। সেই জন্যই আপনাকে এখানে এনেছি। আপনি কয়েকদিন থেকে বলে দিন, সত্যিই ব্যাপারটা কী হচ্ছে। যদি ভূত বলে কিছু না থাকে, তা হলে লোকে ভয় পাচ্ছে কেন? সেটাই আমি জানতে চাই।

জোজো বলল, কাকাবাবু, ভূত দেখা কি অসম্ভব?

কাকাবাবু বললেন, না, অসম্ভব কেন হবে? কেউ কেউ দেখে। মানুষ তিন রকম। যারা ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করে, ঠাকুর-দেবতার পুজো করে, ছেলেবেলা থেকেই এসব বিশ্বাস মনের মধ্যে জমিয়ে রেখেছে, তারা কখনও ভূতও দেখতে পারে, ঠাকুর-দেবতাদেরও দেখতে পারে। বিশ্বাস থেকেই তো ওসব তৈরি হয়। আর যারা বিশ্বাস তো করেই না, ওরকম কিছু সম্ভবই নয় বলে মনে করে, তারা জীবনেও ভূত দেখতে পাবে না। আর একদল আছে, যারা ঠিক বিশ্বাসও করে না, আবার জোর অবিশ্বাসও করে না। তারা কখনও দেখতেও পারে, আবার না-ও দেখতে পারে।

জোজো বলল, আরও একদল আছে, যারা ভূত বিশ্বাস করে না। কিন্তু রাতে একা থাকতে ভয় পায়।

সন্তু বলল, যেমন তুই!

জোজো বলল, ঠিক বলেছিস। আর তুই কোন দলে?

সন্তু বলল, আমার মতোও একদল আছে, যারা ভূতে বিশ্বাস করে না, ভয়ও পায় না, কিন্তু ভূতের গল্প খুব ভালবাসে। ভাল গল্প হলে একটু একটু গা ছমছমও করে।

কাকাবাবু বললেন, অনেক সময় চোর-ডাকাতরা এরকম ভাঙা বাড়িতে আস্তানা গেড়ে ভূত সেজে ভয় দেখায়!

বাদশা বলল, তা যদি হয়, তা হলে তো ঝামেলা চুকেই গেল। সেই চোর-ডাকাতদের কোনও একটাকে কি চেষ্টা করলে ধরা যাবে না? একটাকে ধরলেই তাকে দেখিয়ে সবাইকে বলা যাবে, এই দেখুন ভূত নয়, জ্যান্ত মানুষ। তারপর সে ব্যাটাকে ধরে খুব করে পেটালেই অন্যদের সন্ধান পাওয়া যাবে। সে ব্যবস্থা আমি করছি।

গাড়িটা এসে থামল একটা লোহার গেটের সামনে। চারদিকে অন্ধকার। একটা কুকুর ঘেউঘেউ করে ডেকে উঠল।

একটা বড় টর্চ জ্বেলে বাদশা বলল, এই হচ্ছে সেই বাড়ি। দেখুন, লোহার গেটের দুপাশে দুটো পাথরের সিংহ ছিল, এখন মুন্ডু নেই, পাশে গাছ গজিয়ে গিয়েছে। অনেক ঘরের ছাদ নেই। শুধু দুটো ঘর আস্ত আছে এখনও।

কাকাবাবু বললেন, ওতেই হবে। দুখানা ঘরই যথেষ্ট। বাথরুমটাথরুম আছে তো?

বাদশা বলল, আমি ভেবে দেখলাম, আজকের রাতটা আপনারা আমার বাড়িতেই থাকুন। এখানে ঘরটর পরিষ্কার করা আছে ঠিকই, কিন্তু আলোর ব্যবস্থা, জলের ব্যবস্থা করতে হবে। কাল সন্ধের পর এখানে চলে আসবেন।

সন্তু তবু বলল, কেন, আজ থেকেই থাকি না। আমাদের সঙ্গে তিনখানা টর্চ আছে। আর আলো লাগবে না।

বাদশার পকেটে মোবাইল ফোন বেজে উঠল। খানিকক্ষণ কথা বলে সেটা অফ করে বাদশা বলল, আমার স্ত্রী আজ কিছুতেই ছাড়তে রাজি নন। প্রচুর খাবারদাবার করে রেখেছেন। সন্তু, আজ বরং খেয়েদেয়ে ভাল করে ঘুমিয়ে নাও। কাল হয়তো সারারাত জাগতে হতে পারে।

বাদশার নিজের বাড়ি সেখান থেকে মিনিটদশেকের পথ। সেটাও বেশ বড় বাড়ি। আলোয় ঝলমল করছে। আরও কিছু মানুষ আগে থেকেই বসে আছেন বৈঠকখানায়। বোঝাই যাচ্ছে, আজ এটা নেমন্তন্ন বাড়ি।

তারপর প্রচুর খাওয়াদাওয়া আর গল্প করতে করতে রাত বারোটা বেজে গেল। পাশাপাশি দুটো ঘরে খাটের উপর বিছানা পাতাই আছে। সন্তু আর জোজো প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল বিছানায়।

প্রতিদিনই ঘুমোবার আগে কিছুক্ষণ বই পড়ার অভ্যেস কাকাবাবুর। তিনি একটা বই খুলে বসলেন। একসময় দেখলেন দেড়টা বেজে গিয়েছে। শুয়ে পড়লেন আলো নিভিয়ে।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়