চন্দ্রা আমার সঙ্গে নিজে থেকেই একবার দেখা করতে এসেছিল ঠিকই।

চন্দ্রার ব্যবহারে ফিল্ম অ্যাকট্রেসসুলভ কোনও ভাব ছিল না। যেন এমনিই এক জন উজ্জ্বল তরুণী, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী।

যে-দিন ঘটনাটা ঘটল, তার আগের দিনই বিকেলের দিকে হঠাৎ চন্দ্রা উপস্থিত হয়েছিল আমার বাড়িতে। সে-দিন প্রায় সারা দিন ধরেই বেলাভূমির এখানে-সেখানে শুটিং চলছিল বলে আমি আর বাইরে বেরুইনি, এমনকী স্নান করতেও যাইনি।

চন্দ্রা এসে বলল, আমি কোনও দিন কোনও লেখকের ঘর দেখিনি, একবার আপনার লেখার টেবিলটা দেখব। আপনি এখন কী লিখছেন?

এই বাড়িখানায় তিনটে ঘর, তার মধ্যে একটা তালা দেওয়া, সেখানে মালিকের জিনিসপত্র আছে। আর দুটি ঘরেই খাট-বিছানা পাতা, অর্থাৎ বেডরুম। একটা বড় ঘেরা বারান্দাই বসার জায়গা। আমি পুরো বাড়িটা ভাড়া নিলেও একখানা মাত্র ঘর ব্যবহার করি। কোনও ঘরেই কোনও লেখার টেবিল নেই।

কিছু লেখা তো দূরের কথা, আমার কাছে যে একটা সাদা পৃষ্ঠাও নেই, তা চন্দ্রা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না।

খাটে ওপর অনেক বইপত্র ছড়ান। চন্দ্রা বইগুলো তুলে তুলে দেখছিল। আমার একটা বিচিত্র স্বভাব আছে। আমি একটানা একখানা বই পড়ে শেষ করার বদলে, একই সঙ্গে চার-পাঁচখানা বই একটু একটু পড়ি। সব বই-ই সেইভাবে ওলটানো। সেই সব বই দেখে চন্দ্রা প্রথমে ভুরু তুলল, তারপর হাসতে হাসতে বলল, আপনি এইগুলো পড়ছেন?

যদুনাথ সরকারের অ্যানেকডোটস অব আওরঙ্গজেব, বৈষ্ণব পদাবলী, বশীর আল হেলালের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, রাজশেখর বসুর মহাভারত, নীরদ সি চৌধুরির দাই হ্যান্ড গ্রেট অ্যানার্ক, ইনিড স্টার্কির বদলেয়ারের জীবনী এই সব বইয়ের পরস্পরের মধ্যে কোনও মিল নেই। আমিও তো কোনও কাজের জন্য পড়ছিনা, পড়ার জন্যই পড়া, আসবার সময় হাতের কাছে এগুলোই পেয়েছি। কেউ দেখে ফেললে লজ্জা লাগে।

বিকেলের পর চন্দ্রার আর শুটিং নেই, তাই সে চলে এসেছিল, বেশ হাসিখুশির মুডে ছিল, কোনও রকম ফ্রাসট্রেশানের চিহ্নই আমার চোখে পড়েনি।

চন্দ্রা আমার কাছে কোনও গোপন কথা কিংবা তার জীবনী শোনাতেও আসেনি, কোনও ফিল্মের প্রসঙ্গই তোলেনি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সে তার বন্ধুদের সঙ্গে কীভাবে কাড়াকাড়ি করে বই পড়ত সেই গল্প শোনাচ্ছিল।

চন্দ্রা আমার বাড়িতে একা এসেছিল বটে, কিন্তু বেশিক্ষণ একা থাকেনি। মিনিট পনেরো পরেই ওদের ফিল্ম ইউনিটের আর দুটি ছেলে-মেয়ে চন্দ্রাকে খুঁজতে চলে এল। ওরা সেই রাতেই একবার বেরহামপুরে কী সব কেনাকাটা করতে যাবে। পল্লব আর সুনেত্রা ওরা স্বামী-স্ত্রী। পল্লব অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্যামেরাম্যান আর সুনেত্রা আছে প্রোডাকশানে, কনটিনিউটি নোট করাই তার প্রধান কাজ।

পল্লব আর সুনেত্রা আমার সঙ্গে গল্প করার ব্যাপারে উৎসাহী ছিল না, এরা প্রায় জোর করেই ধরে নিয়ে গিয়েছিল চন্দ্রাকে।

এই পল্লবই পরের সন্ধেবেলা চন্দ্রাকে জীবিত অবস্থায় শেষ দেখে।

সমুদ্রের ধারে একটা ডিঙি নৌকোয় একা বসেছিল চন্দ্রা। আকাশে তখন ফ্যাকাশে জ্যোৎস্না, চন্দ্রার পা দুটো ঝোলানো ছিল জলের মধ্যে। পল্লব তাকে জিজ্ঞেস কবেছিল, এই তুই এখানে বসে আছিস যে?

চন্দ্রা বলেছিল, এমনিই।

পল্লবের হাতে তখন একটা মদের বোতল, পাম বিচ হোটেলের পেছন দিকে একটা নিরিবিলি জায়গায় তাদের আসর বসবে। চন্দ্রাকে বলেছিল, তুই ওখানে চলে আয় না।

চন্দ্রা বলেছিল, তুই যা। তোরা গিয়ে বোস। আমি একটু পরে জয়েন করব।

পল্লবের জন্য অন্যরা অপেক্ষা করছিল, সে আর দাঁড়ায়নি।

 চন্দ্রাকে জোর করে সেই নৌকো থেকে নামানো কিংবা কোনও বিপদের সম্ভাবনার কথা তার মাথাতেই আসেনি। ওড়িশা পুলিশ এখনও প্রত্যেক দিন পল্লবকে জেরায় জেরায় নাজেহাল করছে।

চন্দ্রার অদৃশ্য হয়ে যাবার কথা মাঝরাত্তিরের আগে কারুর খেয়ালই হয়নি।

রাত্তিরেও কিছু কিছু শুটিং ছিল। ইউনিটের সবাই খেতে বসেছিল রাত সাড়ে বারোটায়। তখন দু এক জন জিজ্ঞেস করেছিল, চন্দ্রা কোথায়?

চন্দ্রা না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে সুনেত্রা তার ঘরেও খুঁজে দেখতে গিয়েছিল। না পেয়ে ঠোঁট উলটেছে। ইউনিটের অন্য অনেকে মুচকি হেসেছে। একটি যুবতী মেয়ের গতিবিধি সম্পর্কে অনেকেরই মাথায় রসালো চিন্তা আসে। চন্দ্রার বয়সি অভিনেত্রীদের সঙ্গে অনেক সময় তাদের মা কিংবা ভাই-বোন কেউ আসে পাহারা দেবার জন্য। চন্দ্রা সঙ্গে সে-রকম কেউ নেই। সুতরাং সকলে ধরেই নিয়েছিল, চন্দ্রা হোটেল ছেড়ে গোপালপুরের অন্য কোনও বাড়িতে রাত কাটাতে গেছে। পল্লব-সুনেত্রার মাথায় আমার নামটাও ঝিলিক দিয়েছিল নিশ্চিত।

পরদিন সকাল ন’টায় সন্তোষ মজুমদার এসেছিলেন আমার কাছে। তারও দু’ঘণ্টা বাদে পুলিশে খবর দেওয়া হয়। চন্দ্রার ঘরে তার ব্যবহারের জিনিসপত্র, এমনকী সোনার গয়না ও টাকাকড়িও পড়ে আছে, এ-সব ছেড়ে চন্দ্রা নিশ্চিত একা একা কোথাও চলে যাবে না।

পল্লবের পর চন্দ্রাকে আর কেউ দেখেনি, অন্তত আর কেউ সে-রকম কিছু স্বীকার করেনি, সুতরাং চন্দ্রা সমুদ্রে ভেসে গেছে, এটাই হল একমাত্র থিয়োরি।

দরজা বন্ধ করে আমি শুয়ে পড়লাম। এখন সমুদ্রের শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। সমুদ্রের শব্দ আমার কখনও একঘেয়ে লাগে না। আসলে গাড়ি, ট্রেন, কলকারখানা, এই সব মেকানিক্যাল শব্দে মানুষ এখনও অভ্যস্ত হয়নি, এখনও কানে পীড়া দেয়, কিন্তু প্রকৃতির নিজস্ব শব্দ আমাদের রক্তের মধ্যে মিশে আছে।

আমার একা থাকার অভ্যেস আছে। ছেলেবেলায় আমি ইচ্ছে করে ভূতের বাড়িতে রাত কাটাতে গেছি। জঙ্গলের মধ্যে ডাকবাংলোয় দিনের পর দিন থেকেছি একা। গোপালপুরেও তো বেশ কয়েকটা দিন হয়ে গেল। এক-এক রাতে ঘুম আসতে চায় না। তাতেও আমার কোনও অসুবিধে নেই। একটা পুরো রাত না ঘুমোলেও মানুষের কিছু যায়-আসে না। এক রাত না ঘুমোলে পরের রাতে শরীর ঠিক ঘুম আদায় করে নেবে।

ঘুম না এলে, ছটফট করার বদলে আমি বই পড়ি। একটু কঠিন ধরনের বই হলেই সুবিধে। এক সময় চোখ টেনে আসবেই।

জানালায় একটা শব্দ হতেই আমি বিছানা থেকে প্রায় লাফিয়ে উঠলাম। বুকের মধ্যে জয়ঢাকের মতো দমাস দমাস শব্দ হচ্ছে।

নিজের ওপর অসম্ভব রাগ।

এটা কী ব্যাপার, আমি ভয় পাচ্ছি কেন শুধু শুধু! আমার ঠিক পায়ের কাছে জানালাটার একটা কপাট আলগা। মাঝে মাঝে যে এ-রকম বন্ধ হয়ে যায়, তা তো আমি জানিই। জানলাটা পুরো বন্ধ করে দিলে হাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ফ্যানের হাওয়ার বদলে সমুদ্রের হাওয়া খাবার জন্যই তো এখানে আসা।

আজ সেই জানালার আওয়াজে এমন বুক কাঁপার কী আছে?

আজ সমুদ্রের ধারে সন্ধেবেলা নৌকোর ওপর বসা সেই রহস্যময় তরুণীটির কথা কিছুতেই ভোলা যাচ্ছে না। হয়তো কিছু রহস্য নেই, এমনিই একটি সাধারণ মেয়ে। বাঁধা নৌকোর ওপর উঠে একটুখানি বসা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। চন্দ্রার সঙ্গে যে মিলে গেছে, সেটাও কাকতালীয় হতে পারে।

কিন্তু মেয়েটি কে? ফিল্ম ইউনিটের কেউ না, ওদের সবাইকেই মোটামুটি চিনে গেছি। তাছাড়া মেয়েটি পাম বিচ হোটেলের দিকেও গেল না। অন্য কোনও টুরিস্ট হতে পারে। কিন্তু ওই বয়েসি কোনও মেয়ে কি একা আসে? চন্দ্রার ঘটনা কিছুই শোনেনি!

আমার যে মনে হয়েছিল, ওই নীল শাড়ি পরা মেয়েটি সমুদ্রের জলে নেমে মিলিয়ে গেল, এ-কথা আমার বন্ধু-বান্ধবেরা শুনলে হাসবে। অথচ মনে হয়েছিল, তা-ও ঠিক। এবং এখন এ-ও জানি, ও-রকম কিছু হতেই পারে না।

আবার জানলাটা বন্ধ হল, আবার আমার বুক কাঁপল। এ তো দেখছি মহা জ্বালা! আমার বুকের মধ্যে কোথাও খানিকটা ভয় জমে আছে। এটা তাড়ানো দরকার।

প্রথমে মনে হল, উঠে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করে দেওয়াই ভাল।

জানলার ধারে এসে আমি সন্তর্পণে বাইরে তাকালাম। কেন যে মনে হচ্ছে, ঠিক বাইরেই কারুকে দেখতে পাব।

দুর ছাই, মানুষের আত্মা-ফাত্মা কিছু নেই, চন্দ্রা আর কোনও দিনই ফিরে আসবে না। চন্দ্রা সঙ্গে আমার কোনও ঘনিষ্ঠতা ছিল না। চন্দ্রা বেঁচে থাকলে তার সঙ্গে আমার হয়তো কখনও আর দেখা হত না। চন্দ্রা অমন ভাবে সমুদ্রে চলে গেছে বলেই সে প্রায় সর্বক্ষণ আমার মন জুড়ে আছে। শুধু আমার নয়, আরও অনেকের।

বেশ জোর হাওয়া দিচ্ছে, ঢেউয়ের শব্দও খুব বেশি। বেলাভূমি একেবারে শুনশান। জানলা বন্ধ করার বদলে আমি দরজা খুলে বেরিয়ে পড়লাম পায়ে চটি গলিয়ে।

ভয় কাটাতে হলে এখন এই রাত্রির নির্জনতায় কিছুক্ষণ বাইরে ঘুরে আসা দরকার।

.

০৬.

 রবীনবাবুর কথাই ঠিক, এরা পুরোদমে আবার শুটিং শুরু করে দিয়েছে। সকাল থেকেই শুনতে পাচ্ছি বেশ হট্টগোল।

আমার বাড়ির বেশ কাছাকাছি একটা খড়ের ঘরের সেট বানিয়ে ফেলেছে এর মধ্যে। ওখানে ঘর দিয়ে কী হবে তা কে জানে! বালির ওপর বসানো হয়েছে ট্রলি, এ-দিকে ও-দিকে অনেকগুলি রিফ্লেক্টের, আজ সারা দিনই শুটিং চলবে মনে হয়।

জানলা দিয়ে ওদের ব্যাপার-স্যাপার দেখেই ঠিক করলাম, আজ আর ও-দিকে যাবই না। চন্দ্রা নেই বলেই এই ফিল্মটার বাপারে আমার কেমন যেন একটা বিদ্বেষ জন্মে গেছে। অনেক টাকা-পয়সার ব্যাপার, প্রায় পঞ্চাশ ভাগের কাজ আগেই হয়ে গেছে। এখন এ ফিল্ম শেষ না করে ওদের উপায় নেই, তা ঠিক, কিন্তু একটি মেয়ে এমনি এমনি হঠাৎ হারিয়ে গেল, তার চিহ্ন কোথাও থাকবে না?

চন্দ্রার ভূমিকাটা কী হবে? বাকিটা হয়তো বাদই দিয়ে দেবে। এই সব গাঁজাখুরি গল্পের তো কোনও মা-বাপ নেই, যে-কোনও চরিত্র যে-কোনও জায়গায় হারিয়ে যেতে পারে।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি বৈষ্ণব পদাবলী পড়তে লাগলাম।

এগারোটা আন্দাজ মনে হল, এক কাপ চা পেলে মন্দ হয় না। আবার বাড়িতে চা-তৈরির ব্যবস্থাও নেই। সকালের চা-ব্রেকফাস্ট পাশের গেস্ট হাউস থেকেই দিয়ে যায়। দ্বিতীয় বার নিজে গিয়ে চাইতে হয়। তেলেঙ্গি মেয়েটি একটু আগে ঘর মুছছিল, সে চলে গেল নাকি? তাকে দিয়ে আনানো যেতে পারে চা।

মেয়েটি চলেই গেছে। আমাকেই উঠতে হল।

বাইরে বেরুতেই প্রতিমার সঙ্গে দেখা! আর এক জন অচেনা ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলছেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হল, আমি সামান্য সৌজন্যের হাসি দিয়ে চলে গেলাম গেস্ট হাউসের দিকে।

এদের ডাইনিং রুমে পাঁচ-সাত জন নারী-পুরুষ বসে আছে, কেউ কেউ চায়ের বদলে বিয়ার খাচ্ছে। দু’জন মুখচেনা, কিন্তু এখন কারুর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মুখখানা উৎকট গম্ভীর করে রাখলাম। একটু কান পাতলেই বোঝা যায়, অন্য সবাই চন্দ্রার বিষয়েই আলোচনা করছে।

তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম চা শেষ করে। ওদের কথাবার্তা শুনে বোঝা গেল, চন্দ্রার বাবা আর ছোট বোন এসে পৌঁছেছে গত কাল, চন্দ্রার মা নেই। চন্দ্রার বাবা নাকি কান্নাকাটি করছেন খুব। সঙ্গে সঙ্গে আমি ঠিক করে নিয়েছি, কিছুতেই চন্দ্রার বাবার সামনে পড়তে চাই না।

একটা ভাঙা বাড়ির সামনে প্রতিমা এখনও কথা বলছেন অচেনা ব্যক্তিটির সঙ্গে। এবারও আমার সঙ্গে তার চোখাচোখি হল, কোনও কথা হল না, আমি ঢুকে গেলাম নিজের বাড়িতে।

মিনিট পাঁচেক পরেই প্রতিমা আমার দরজায় উঁকি মেরে জিজ্ঞেস করলেন, আসতে পারি?

 আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে বললাম, আসুন, আসুন। রবীনবাবু কোথায়?

প্রতিমা বললেন, ও শুটিং দেখতে গেছে। আপনি গেলেন না?

আমি হেসে দুদিকে ঘাড় নাড়লাম।

প্রতিমা একটা চেয়ারে বসে বললেন, আজ চড়া রোদ। এর মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে শুটিং দেখা, খুবই বিরক্তিকর ব্যাপার। রবীন গেছে, আমার মনে হয়, আরও কিছু খবরটবর জোগাড় করার আশায়। আসলে পুলিশ তো! ওর এখনও ধারণা, এটা আত্মহত্যা নয়, এর মধ্যে কিছু ফাউল প্লে আছে।

আমি বললাম, রবীনবাবু যদি মিস্ট্রি সলভ করতে পারেন তাহলে দারুণ ব্যাপার হয়। এখানকার পুলিশ তো কোনও খেই পাচ্ছে না।

প্রতিমা হঠাৎ প্রসঙ্গ পালটে বললেন, অনেক দিন আগে জীবন যে-রকম নামে একটা বাংলা ছবি হয়েছিল, তার কাহিনিটা আপনার লেখা?

আমি বেশ তীব্র চোখে প্রতিমার দিকে তাকালাম। এই প্রসঙ্গটা কেউ তুললেই আমার রাগ এসে যায়, এত কাল বাদেও।

আমি বললাম, আমি কখনও কোনও সিনেমার কাহিনি লিখি না। আমার লেখা গল্প-উপন্যাস থেকে মাঝে মাঝে কেউ ফিল্ম করেন। জীবন যে-রকম’ আমার একটা উপন্যাস, সেটা অবলম্বন করে একটা বাংলা ছবি হয়েছিল। সে-ছবি আমি নিজে অবশ্য দেখিনি। অন্যদের মুখে শুনেছি। সে-ছবি দেখলে আমার উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীদের চেনাই যায় না।

প্রতিমা বললেন, আমি যে ভদ্রলোকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম, ওকে আপনি চেনেন?

আমি বললাম, না!

প্রতিমা বললেন, আমি ইচ্ছে করেই তখন আপনাকে ডাকিনি। ওরনাম সুগত মজুমদার। একটি সিনেমা পত্রিকার রিপোর্টার। আপনাকে পেলে ছাড়ত না, অনেকক্ষণ ধরে ভ্যাজর ভ্যাজর করত। ওই ভদ্রলোকের বোন আমার সঙ্গে কলেজে পড়ত, সেই সূত্রে চেনা। তবে আপনাকে এসে ধরবে ঠিকই।

আমি বললাম, আমি এবার কেটে পড়ব ভাবছি।

প্রতিমা বললেন, ওই সুগতই জীবন যে-রকমে’র প্রসঙ্গ তুলল। আপনার লেখা গল্প, তা আমার খেয়াল ছিল না। সেই ছবিরও শুটিঙের সময় জলে ডুবে কেয়া চক্রবর্তী…সেই সময় খুব তোলপাড় হয়েছিল ঘটনাটা নিয়ে। এখন আবার কেউ কেউ সেই প্রসঙ্গটা টানবেই। প্রায় একই রকম ব্যাপার তো!

আমি ঝাঁঝের সঙ্গে বললাম, কেয়া চক্রবর্তীর ঘটনাটা বাংলা সিনেমার একটা কলঙ্ক। আমাদের থিয়েটার জগতের কী বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল, বলুন তো! কেয়া বাংলা মঞ্চে ইদানীংকার সব চেয়ে প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী, শুধু তাই নয়, গ্রুপ থিয়েটারের জন্য সে ছিল ডেডিকেটেড। কলেজের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল পর্যন্ত। সেই কেয়াকে কত তুচ্ছ কারণে প্রাণ দিতে হল। একটা রাবিশ বাংলা সিনেমার জন্য।

প্রতিমা সামান্য হেসে বললেন, আপনারই লেখা কাহিনি, তবু আপনি রাবিশ বললেন?

আমার উপন্যাসটাকে কেটে, ছিঁড়ে ওলোট-পালোট করে যা খুশি করেছে। কাহিনির নায়ক-নায়িকা পর্যন্ত বদলে গেছে।

সিনেমার লোকরা ইচ্ছে মতো এ-রকম বদলাতে পারে, আপনারা কিছু বলেন না?

 আমাদের কথা কি ওরা শোনে?

আপনারা আপত্তি করতে পারেন না?

মৌখিক আপত্তি গ্রাহ্যই করে না। অনেক সময় সিনেমার লোকেরা গল্পের রাইট কিনে সেই যে উধাও হয়, আর কোনও যোগাযোগই রাখে না লেখকের সঙ্গে। তাছাড়া কন্ট্রাক্ট ফর্মে এক জায়গায় লেখা থাকে যে চলচ্চিত্রে রূপ দেবার জন্য কিছু কিছু পরবির্তন-পরিবর্জন করা যাবে। ওরা সুযোগটা নেয়।

আমাদের ধারণা, লেখকরা টাকার জন্য আজে বাজে সিনেমার জন্যও কাহিনি বিক্রি করে দেন।

বাংলা সিনেমার জন্য কী সামান্য টাকা পাওয়া যায় তা তো আপনারা জানেন না। অনেক সময় চুক্তিতে যা লেখা থাকে, সেটাও পুরো পাওয়া যায় না।

কেয়ার ঠিক কী হয়েছিল? দুর্ঘটনা, না কেউ ঠেলে জলে ফেলে দিয়েছিল?

মামলা-টামলা হয়েছিল শুনেছি, শেষ পর্যন্ত কেউ শাস্তি পেয়েছিল কি না জানি না। সব চেয়ে দুঃখের কথা কি জানেন, ওই জীবন যে-রকমে যে-ভূমিকায় কেয়াকে মরতে হল, সেই ভূমিকাটা আমার লেখাই নয়, উপন্যাসে ও-রকম চরিত্রই নেই। সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দেবার জন্য চিত্রনাট্যে একটি অন্ধ মেয়ে আমদানি করা হয়েছিল, গল্পের সঙ্গে তার বিশেষ যোগই নেই।

ওই রকম এলেবেলে ভূমিকা নিতে কেয়া রাজি হয়েছিল কেন?

গ্রুপ থিয়েটারের সেই সময়টা ছিল খুব স্ট্রাগলিং পিরিয়ড। ওরা অভিনয়ের জন্য ভাল হল পেত না। নান্দীকার গ্রুপকে বোধহয় সেই সময় রঙ্গনা থেকে উৎখাত করা হয়েছিল। সেই জন্যই কেয়া, অজিতেশ, রুদ্রপ্রসাদ এরা ঠিক করেছিল সিনেমাতে ছোটখাটো অভিনয় করে টাকা তুলে নিজস্ব একটা রঙ্গমঞ্চ বানাবে। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অত বড় এক জন অভিনেতাকেও কত বাজে সিনেমায় অভিনয় করতে হয়েছে, মনে নেই?

কেয়া কি ইচ্ছে করে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল?

সেটা আমি কী করে জানব, বলুন! সুন্দরবনের দিককার নদীগুলো সাংঘাতিক, ওখানে কেউ স্নানই করতে নামে না, সেখানে ঝাঁপ দেবার কোনও মানে হয়? অন্য কতভাবে দেখানো যেত। জলে ঝাঁপ দিলেও জাল-টাল পেতে রাখার ব্যবস্থা করতে হয়।

কেয়া আত্মহত্যা করেছে, এ-রকম একটা কথাও উঠেছিল না?

অসম্ভব! কেয়াকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনতাম। ও-রকম তেজী, বুদ্ধিমতী মেয়ে খুব কমই দেখেছি। সব সময় সে উৎসাহে টগবগ করত। সব চেয়ে দুঃখের কথা কি জানেন, দুর্ঘটনা হোক বা যাই-ই হোক, কত অকিঞ্চিৎকর একটা কারণে ও-রকম এক জন প্রতিভাময়ী মেয়েকে প্রাণ দিতে হল। কী নিদারুণ অপচয়! ছি ছি ছি ছি, কী বিরাট অন্যায়।

আপনি তখন খুব কষ্ট পেয়েছিলেন?

এখনও পাই। কেয়ার প্রসঙ্গ উঠলেই আমার মাথায় আগুন জ্বলে।

কেয়া আর চন্দ্রা, চন্দ্রা অবশ্য তেমন কিছু বড় অভিনেত্রী নয়, তবু তো একটা সম্ভাবনাপূর্ণ প্রাণ, সবেমাত্র শুরু হয়েছিল ওর যৌবন ও কেরিয়ার…। নেটালি উড অবশ্য পরিপূর্ণতায় পৌঁছেছিল, সিনেমা জগত থেকে তার আর বিশেষ কিছু পাবার ছিল না।

চন্দ্রা কি নেটালি উডের ঘটনাটা জানত?

চন্দ্রার সঙ্গে আমার পরিচয়ই হয়নি। তার মনের কথা আমি কী করে জানব বলুন। তবে, আমাদের চেয়ে যারা দশ-পনেরো বছরের ছোট, তারা হলিউডের ওইসব অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রায় চেনেই না বলতে গেলে, গ্রেগরি পেক-এর জন্য কি আর এখনকার মেয়েদের বুক কাঁপে? আমার দিদির মেয়ে, তার একুশ বছর বয়েস, সে রোনালড কোলম্যান কিংবা ইনগ্রিড বার্গম্যানের নামই শোনেনি। ওদের ফিল্ম তো আজকাল পাওয়াই যায় না! অবশ্য ভি সি আর-এর দৌলতে এ-সব ফিল্ম আবার কিছু কিছু ফিরে আসছে, কিন্তু ওই সব স্টার সম্পর্কে তেমন কৌতূহল কিংবা উন্মাদনা তো আর হবে না। আমি এবার উঠি। মেয়েটা একলা রয়েছে।

আপনার মেয়ে খুব পড়ুয়া, সবসময় ওকে বই পড়তে দেখি।

হ্যাঁ, গল্পের বই পড়তেই বেশি ভালবাসে। ছোটবেলায় যারা সুকুমার রায়, লীলা মজুমদার, অবন ঠাকুর পড়ে না, তাদের সম্পর্কে আমার যা মায়া হয়।

প্রতিমা উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।

প্রতিমার স্বভাবে এমন একটা ব্যক্তিত্ব আছে, যাতে ওঁর সঙ্গে ঠিক যেন ঠাট্টা-ইয়ার্কি করা যায় না।

হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে উনি বললেন, আপনাকে একটা খবর দিই। এটা আমার স্বামীই খুঁজে বার করেছে। সুনেত্রার সঙ্গে চন্দ্রার একদিন বেশ বিরাট ধরনের ঝগড়া হয়েছিল। এটা আপনি শুনেছেন?

আমি বললাম, না তো! ওদের দু’জনের তো বেশ ভাবই মনে হত।

প্রতিমা বললেন, এর আগের একটা ছবির শুটিং হয়েছিল এলাহাবাদে। তাতে চন্দ্রা ছিল, পল্লবও সেই ছবিতে ক্যামেরার কাজ করেছিল। সুনেত্রা সেবার এলাহাবাদ যায়নি। পল্লব প্রত্যেক দিনই বেশি ড্রিঙ্ক করে, খানিক বাদে তার ভাল-মন্দ জ্ঞান থাকে না। এলাহাবাদে সে নাকি চন্দ্রার সঙ্গে অ্যাফেয়ার করার চেষ্টা করেছিল। চন্দ্রা তখন জানত না পল্লব বিবাহিত। সেই ঘটনা সুনেত্রা এখানে এসে শুনেছে।

কে বলল?

ওদেরই ইউনিটের অন্য কেউ। এই সব কথা জানিয়ে দিয়ে এক ধরনের লোক খুব আনন্দ পায়। তার ফলে ব্যাপারটা আর একটু কমপ্লিকেটেড হয়ে গেল না?

আমি চুপ করে রইলাম।

প্রতিমা আবার বললেন, পল্লবই চন্দ্রাকে শেষ দেখেছিল। তার সঙ্গে চন্দ্রার কী কথা হয়েছে, কেউ জানেনা। চন্দ্রা সাঁতার জানত না। পল্লব নৌকোর দড়ি খুলে নৌকোটা সমুদ্রের মধ্যে যদি ঠেলে দিয়ে থাকে..সেটা অসম্ভব কিছুনা।

আমি তবু চুপ করে রইলাম।

প্রতিমা দরজার বাইরে গিয়ে আবার বললেন, আমার পুলিশ স্বামীটির ধারণা, সেক্স অ্যাঙ্গেলটা খুব ইমপর্টেন্ট। যে-সব মেয়ে খুন হয়, তাদের অধিকাংশেরই প্রাণ যায় পুরুষদের বিকৃত যৌন তাড়নায়।

প্রতিমার মুখে সেক্স কথাটা কেমন যেন বেমানান লাগে।

ঘটনাটা ক্রমশই যেন একটা রোমহর্ষক রহস্য কাহিনির দিকে যাচ্ছে। আমার হাসি পেল এই ভেবে যে, এই কাহিনিতে আমি নিজেও একটা ছোটখাটো চরিত্র।

.

০৭.

 দুপুরবেলা আকাশ কাঁপিয়ে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।

আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, খোলা জানলা দিয়ে বৃষ্টির ঝাপটা এসে জাগিয়ে দিল আমাকে। ধড়মড় করে উঠে জানলা বন্ধ করতে আমার ইচ্ছে হল না। ভিজুক না বিছানাটা। এমন কিছু ক্ষতি হবে না। শুয়ে শুয়ে দেখতে লাগলাম বিদ্যুতের লকলকে রেখা।

মিনিট পাঁচেকের বেশি অবশ্য শুয়ে থাকা যায় না। ভেতরের সাবধানী মনটা বলে ওঠে, বিছানা একেবারে জবজবে ভিজে গেলে রাত্তিরে শোবে কী করে? এরমধ্যেই চাদর-টাদর বেশ ভিজে গেছে।

একা থাকার এই মজা। কলকাতায় নিজের বাড়িতে কি এক মিনিটও এমন বৃষ্টির মধ্যে জানলা খুলে শুয়ে থাকতে পারতাম? স্বাতী এসে বকুনি দিত।

এখানে জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরো ইচ্ছে মতো মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলতে পারি। চায়ের কাপে ছাই ঝাড়লে আপত্তি করার কেউ নেই। সদর দরজাটা বন্ধ থাকলে পা-জামার দড়ি একেবারে আলগা করে শুয়ে থাকা যায়। বাথরুম থেকে স্নান সেরে আমি সোজা উলঙ্গ হয়ে বেরিয়ে আসি। কয়েক দিনের জন্য এই একটা অন্য রকম জীবন।

উঠে গিয়ে দাঁড়ালাম জানালার সামনে।

ফিল্ম ইউনিটের লোকের ছোটাছুটি করছে। বৃষ্টি ও ঝড় এসে পড়েছে একেবারে জানান না দিয়ে। ক্যামেরার ওপর কম্বল চাপা দিয়ে কাঁধে করে দৌড়াচ্ছে পল্লব, বড় বড় রিফ্লেক্টরগুলো সরানো হচ্ছে তাড়াতাড়ি। খড়ের ঘরের যে-সেটটা ওরা বানিয়েছিল, সেটা হেলে পড়েছে ঝড়ের ধাক্কায়।

আজ আর শুটিং হবার আশা নেই।

এতে আমার আনন্দ হচ্ছে কেন? এক-এক দিন শুটিং বন্ধ হয়ে গেলেই অনেক টাকা ক্ষতি হয়ে যায়। অপরের ক্ষতি দেখে কেন আমার এই বিকৃত উল্লাস? না, এদের লাভ-লোকসানের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। তবু, বেশ হয়েছে, বেশ হয়েছে এই রকম একটা ভাব আমার মনের মধ্যে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। লোকজনের ছুটোছুটি দেখতে মজাই লাগছে বেশ।

সমুদ্রের ওপর অজস্র রুমালের মতো উড়ছে বৃষ্টি।

এক সময় সমস্ত বেলাভূমি জনশূন্য হয়ে গেল। জানলার ধারে দাঁড়িয়ে আমার গেঞ্জি-পাজামা পরা সর্বাঙ্গ ভিজে গেছে, আমি নিমগ্ন হয়ে দেখছি শূন্যতা। ঠিক শূন্যতা নয়, বৃষ্টি যেন জীবন্ত প্রাণী। এখন এই সমুদ্রকে নিয়ে বৃষ্টির খেলা করার সময়।

বেশ কিছুক্ষণ পর আবার একটি দৃশ্য দেখে আমার বুকটা ধক করে উঠল। একটা লাল রঙের ছাতা মাথায় দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছে একটি যুবতী।

সেই মুহূর্তে আমি এক লক্ষ টাকা বাজি ফেলে বলতে পারতাম, ওই নারীটি নিশ্চয়ই চন্দ্রা। ঠিক চন্দ্রার মতো হাঁটার ভঙ্গি, তার মুখখানা যদিও আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি না, তবু চন্দ্রারই মতো, এই লাল ছাতা মাথায় দিয়ে আমি চন্দ্রাকে ঠিক এই রকমভাবে হাঁটতে দেখেছি।

তবে শুধু এক মুহূর্তের জন্যই আমার এ-রকম মনে হয়। পরের মুহূর্তেই আমি নিজেকে চোখ রাঙিয়ে বলি, দিনে-দুপুরে ভূত দেখছ নাকি, সুনীল?

এমনও তো হতে পারে, চন্দ্রাকে খুঁজে পাওয়া গেছে! সে ফিরে এসেছে কোনও জায়গা থেকে! তাহলে কি রবীনবাবু তখনি এসে সে-খবর আমাকে জানাতেন না?

মেয়েটি আমার চোখের আড়ালে চলে যেতেই আমি ছটফটিয়ে উঠলাম। প্রকৃত ব্যাপারটা আমাকে জানতেই হবে। আমার কি দৃষ্টিবিভ্রম হচ্ছে? চন্দ্রার মতো অন্য এক জনকে আমি দেখছি কেন?

ছুটে বেরিয়ে এলাম বাড়ি থেকে।

আমার এই বাড়িটার পেছন দিকেই একটা দেওয়াল, সেখানে বালি জমতে জমতে অনেকটা উঁচু হয়ে গেছে। অনেকটা খাড়া মতো বালির স্তূপ। সেখান থেকেই একটা লাফ দিলাম আমি। কেউ তো দেখছে না, একটু ছেলেমানুষি করলেই-বা ক্ষতি কী?

লাল ছাতা মাথায় মেয়েটি একটু দূরে চলে গেছে, সে যাচ্ছে পাম বিচ হোটেলের দিকে। এখনও তাকে চন্দ্রাই মনে হচ্ছে আমার। যে যা-ই মনে করুক, একবার ওই মেয়েটির কাছে গিয়ে ওর মুখ দেখে, ওর সঙ্গে দু’একটা কথা বলতেই হবে।

ঝড় থেমে গেলেও বৃষ্টি পড়ছে সমানে। বিচে আর কেউ নেই। আমি ছাতা আনিনি, সারা গা এমনিতেই ভেজা। দৌড়ে না গেলে মেয়েটিকে ধরা যাবে না।

অন্য বাড়িগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। কোনও বারান্দাতেই কোনও মানুষ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু দিনেরবেলা অনেকেই জেগে আছে, জানলা দিয়ে কেউ কেউ আমাকে দৌড়তে দেখতে পেয়ে যেতে পারে। একটা মেয়ের পেছনে আমি ছুটছি? মন্দ কী, মেয়েদের পেছনে ছোটা মোটেই অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়।

একটু জোরে পা চালাতেই পাশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল এক জন লোক। মাথায় কালো ছাতা। চেঁচিয়ে ডাকল, ও সুনীলদা, একবার শুনুন!

সকালবেলা প্রতিমা এর সঙ্গেই কথা বলছিলেন। সিনেমার কাগজের লোক।

সে এসে আমার সামনেটা জুড়ে দাঁড়িয়ে বলল, আমায় চিনতে পারছেন, সুনীলদা? আমার নাম সুগত মজুমদার। সত্যজিৎ রায়ের ঘরে-বাইরে ছবির প্রিভিউয়ের দিনে আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, আপনি আপনার পকেট থেকে আমাকে একটা সিগারেট দিয়েছিলেন। কোথায় যাচ্ছেন, পাম বিচে? চলুন, আমিও ওই দিকেই যাব, একসঙ্গেই যাওয়া যাক।

ভিজে গায়ে, গেঞ্জি-পাজামা পরে আমি যাব পাম বিচ হোটেলে? কিন্তু আমি অন্য কোথায় যাচ্ছি, সেকথাও কি বলা যায়?

সুগত আবার বলল, দাদা, আপনার একটা ছোট্ট ইন্টারভিউ নেব।

আমি চিবিয়ে বললাম, এই বৃষ্টির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতেই ইন্টারভিউ হবে বুঝি?

সুগত বললো, না না, মানে, আপনি যখন সময় দেবেন। চলুন ওদের হোটলে গিয়ে বসা যাক। আজ তো শুটিং প্যাক আপ হয়ে গেছে, ওখানে আড্ডা জমবে।

আমি থমকে দাঁড়িয়ে বললাম, আমি ওদের হোটেলে যাচ্ছি না।

লাল ছাতা মাথায় মেয়েটি ক্রমশ চলে যাচ্ছে দূরে। একবার সে নিচু হয়ে বালি থেকে একটা কিছু কুড়াল। হয়তো ঝিনুক। দূর থেকেও ওকে ঠিক চন্দ্রা বলেই মনে হচ্ছে। আর একটু পরেই চোখের আড়ালে চলে যাবে। কিছুতেই কি ওর কাছে গিয়ে মুখখানা দেখা যাবে না? আগের দিন সন্ধেবেলা একেই কি দেখেছিলাম?

সুগতকে যে কী অজুহাত দেব, তা মনেই এল না। ওকে এড়িয়ে কী করে ছুটে যাই মেয়েটির কাছে? তাহলে সুগত নিশ্চয়ই মনে মনে একটা রসালো গল্প বানিয়ে নেবে। কাগজে একটা কিছু লিখে দিলেই হল। গোপালপুরে সমুদ্রের ধারে দুপুরবেলায় বৃষ্টির মধ্যে আমি একটি মেয়ের পেছনে ছুটোছুটি করছি।

সুগত জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা সুনীলদা, কেয়া চক্রবর্তীর যখন অ্যাকসিডেন্টটা হয়, তখন, মানে, জীবন যে-রকম’-এর শুটিঙের সেই দিনে আপনি কি সেখানে উপস্থিত ছিলেন?

আমি গর্জন করে বলে উঠলাম, না!

 তারপর পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলাম নিজের বাড়ির দিকে।

.

০৮.

 বাড়িটা ভাড়া নিয়েছিলাম পনেরো দিনের জন্য, আর ছ’দিন বাকি আছে। কিন্তু আমার আর এখানে মন টিকছে না। নির্জনতার সুখ উপভোগ করার আর কোনও আশা নেই। আগামীকালই তল্পি তল্পা গুটিয়ে সরে পড়ব ঠিক করে ফেললাম।

চন্দ্রা উধাও রহস্য নিয়ে আমার আর মাথা ঘামাবার আগ্রহ নেই।

রবীনবাবু আর প্রতিমা অবশ্য এখনও নানা রকম থিয়োরি নিয়ে প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু একটা বেশ অসুবিধেতেও পড়েছেন রবীনবাবু।

এখানকার থানাটা ছোট। সাধারণ খুন-টুনের ব্যাপার হলে বিশেষ কেউ মাথা ঘামাত না। কিন্তু এক জন যুবতী অভিনেত্রীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, কারণ অনেক কাগজেই ফলাও করে খবরটা ছাপা হয়েছে। ভুবনেশ্বর থেকে এসেছেন তিন জন পুলিশ অফিসার। এই রহস্যের কিনারা করার ভার ওড়িশার পুলিশ দফতরের। ওড়িশার অফিসারদের মধ্যে একজনের সঙ্গে আমাদের আলাপও হয়েছে, তাঁর নাম অর্জুন মহাপাত্র। বেশ দক্ষ অফিসার বলে মনে হয়। ব্যবহারও খুব ভদ্র।

তবে অর্জুন মহাপাত্র ইংরেজিতে ছাড়া কথা বলেন না। আমরা ওড়িয়া ভাষা মোটামুটি বুঝতে পারি, আমাদের বাংলাও স্থানীয় লোক ঠিক বুঝে নেয়। অন্যদের সঙ্গে ওড়িয়া-বাংলা মিলিয়ে-মিশিয়ে আলোচনা চালাতে কোনও অসুবিধে হয় না, কিন্তু অর্জুন মহাপাত্র খুবই ইংরিজিওয়ালা!

অর্জুনবাবু এখানে রবীনবাবুর উপস্থিতি খুব একটা পছন্দ করেননি। তার ধারণা, পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ ওড়িশার ব্যাপারে নাক গলাচ্ছে। রবীনবাবু যে এখানে ছুটিতে এসেছেন, তার অফিসিয়াল পজিশন নিয়ে তদন্ত করছেন না, এটা অর্জুন মহাপাত্র ঠিক বিশ্বাস করছেন না। তিনি মুখে অবশ্য বলছেন, অফ কোর্স আপনার মতো এক জন অভিজ্ঞ অফিসারের পরামর্শ ও সাহায্য পেলে আমরা খুশিই হব।

অর্জুন মহাপাত্র ছ’ফুটেরও বেশি লম্বা, চোখ দুটি উজ্জ্বল এবং চঞ্চল। সকলের সঙ্গেই তিনি ভাল ব্যবহার করেন, অথচ সকলকেই তিনি সন্দেহ করেন বলে মনে হয়। টিপিক্যাল ডিটেকটিভ। আমার ওপরেও তার কোনও সন্দেহ আছে কি না কে জানে!

চন্দ্রা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল আমার বাড়িতে, সে দিন ঠিক কী কী কথা হয়েছিল, তা নিয়ে তিনি আমাকে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট জেরা করলেন, সঙ্গে একটা ছোট টেপ রেকর্ডার।

অর্জুন মহাপাত্রই বললেন যে, ম্যাড্রাস থেকে আরও দু’জন ডুবুরি এসেছে, তারা সন্ধেবেলাতেই জলে নেমে পড়েছে।

আমার জবানবন্দি শেষ হবার পর আমি অর্জুনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি ইচ্ছে করলে এখন গোপালপুর ছেড়ে চলে যেতে পারি? তাতে কোনও অসুবিধে আছে কি?

অর্জুনবাবু খুবই অবাক হয়ে বললেন, আপনি চলে যাবেন কি না, তা আমাকে জিজ্ঞেস করছেন? অফ কোর্স। আপনাকে হ্যারাস করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আপনার সময় নষ্ট করার জন্য খুবই দুঃখিত। আপনাকে এত কথা জিজ্ঞেস করছিলাম, যদি সিচুয়েশানটা বুঝতে কিছু সাহায্য হয়। অফ কোর্স আপনি যে-কোনও সময় যেখানে খুশি যেতে পারেন।

অফ কোর্স অর্জুন মহাপাত্রের একটা মুদ্রাদোষ।

ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেটের প্যাকেট আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে তিনি আবার বললেন, যদি খুব অসুবিধে না হয়, আরও দু’একটা দিন থেকে যান না। মাঝে মাঝে আপনার সঙ্গে এসে গল্প করে যাব। এই ব্যাপারটা সলভ করতে আর দুদিনের বেশি লাগবে না। অফ কোর্স আপনার যদি অন্য কোনও কাজ থাকে, তাহলে আটকাতে চাই না।

এটা ওঁর অনুরোধ না প্রচ্ছন্ন আদেশ, তা বোঝা গেল না।

আমি খানিকটা জেদের সঙ্গেই বললাম, নাঃ, কাল বিকেলেই আমি চলে যাব ঠিক করেছি। বেরহামপুর থেকে রাত্তিরের ট্রেন ধরব।

অৰ্জন মহাপাত্র এবারে আরও ভদ্রতার সঙ্গে বললেন, তাহলে আমার গাড়ি আপনাকে বেরহামপুরের স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসবে। টিকিট কাটা আছে আপনার? নো প্রবলেম।

অর্জুন মহাপাত্র চলে যাবার মিনিট দশেক পর একটা গাড়ি এসে থামল আমার বাড়ির সামনে। সদর দরজা খোলা, ভেতরে ঢুকে এলেন সন্তোষ মজুমদার, তার সঙ্গে সুনেত্রা ও আরও দুই ব্যক্তি। সুনেত্রার মুখখানায় রাগ ও বিষণ্ণতা মাখা।

সন্তোষ মজুমদার বললেন, উঠুন স্যার, পায়ে জুতো গলিয়ে নিন, একবার আমাদের হোটেলে চলুন।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন, কী ব্যাপার?

সন্তোষ মজুমদার বললেন, চলুন না। একা একা বসে থাকেন, আমাদের জন্য একটু সময় দিতে পারবেন না? আমরা কি এতই খারাপ লোক?

আরে নাঃ, যাঃ কী বলছেন! হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে এসেই আমাকে যেতে বলছেন, কেন আবার কিছু ঘটেছে।

নতুন কিছু ঘটেনি। তবে আমাদের ইউনিটের লোকজন ক্রমশ খেপে যাচ্ছে। সবাইকে আর সামলানো যাচ্ছে না। ওড়িশার পুলিশ আমাদের খুব হ্যারাস করছে।

তার মানে?

মহাপাত্র সাহেব অর্ডার দিয়েছেন যে, আমাদের ইউনিটের কোনও এক জন লোকও এখন গোপালপুরের বাইরে যেতে পারবে না। আচ্ছা ভাবুন তো, কী মুশকিলের ব্যাপার। ফিল্মের এত বড় ইউনিট, সবাই কি এক জায়গায় বেশিদিন পড়ে থাকে? অনবরত লোক যাতায়াত করে। যার দু’এক দিনের কাজ, সে কাজ শেষ হলেই চলে যায়। আর যে-দিন কাজ, তার আগের দিন আনানো হয়, ঠিক কি না? সবাইকে এক মাস ধরে হোটেলে রেখে খাওয়ালে যে করপোরেশানের বাজেট হয়ে যাবে। তাছাড়া আমাদের প্রোডাকশানের জিনিসপত্র আনবার জন্য দুতিনজনকে প্রায় প্রত্যেকদিন কলকাতায় পাঠাতে হয়, সেসবও বন্ধ।

আমি সন্তোষবাবুর মুখের দিকে চেয়ে চুপ করে রইলাম। এটা ওঁদের পক্ষে একটা সত্যিকারের সমস্যা বটে, কিন্তু এই সমস্যা সমাধানে আমার তো কোনও হাত নেই!

সন্তোষ মজুমদার আবার বললেন, দেখুন, আমাদের মধ্যে একটা অত্যন্ত স্যাড ব্যাপার ঘটে গেছে। চন্দ্রা ফিল্ম লাইনে নতুন এলেও সবাই ওকে পছন্দ করত। ভাল মেয়ে, যথার্থ ভাল মেয়ে, ট্যালেন্ট ছিল, রাইজ করতে পারত। তার এই রকম হল, সেজন্য সবাই খুব জেনুইন দুঃখ পেয়েছে। কিন্তু কাজও তো করে যেতে হবে। আপনি তো জানেন স্যার, ফিল্ম প্রোডাকশান মানে একটা বৃহৎ যজ্ঞ। সময় নষ্ট করলেই হাজার হাজার টাকা ক্ষতি।

নিতান্ত কথার কথা হিসেবেই আমি বললাম, আজ তো সারা দিনই প্রায় বৃষ্টির জন্য শুটিং বন্ধ রইল।

সন্তোষ মজুমদার বললেন, সেই জন্যই আজ সারা রাত আবার শুটিং সিডিউল রেখেছি। হোটেলের কাছাকাছিই হবে। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে, নাইট ফর ডে কাজ হবে।

সন্তোষবাবু, আপনারা সারা রাত শুটিং করবেন, সেখানে আমি গিয়ে কী করব?

শুটিং দেখতে আপনাকে ডাকছি না। সে-সব শুরু হবে রাত দশটা থেকে। লাইটিং করতে, ট্রলি বসাতে অনেক সময় লেগে যাবে। তার আগে সাতটা থেকে ন’টা পর্যন্ত একটা গেট টুগেদারের ব্যবস্থা করেছি। সেখানে একবার আপনাকে আসতেই হবে যে! পুলিশদের বলেছি, আরও দু’চার জন গণমান্য লোক আসছেন, সেখানে অর্জুন মহাপাত্রর কাছে আমাদের সমস্যাটা তুলব। আপনাকে আর কিছু করতে হবে না, শুধু একটু মরাল সাপোর্ট দেবেন। সামান্য খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা আছে, একবার চলুন।

অন্য দুই ভদ্রলোকের মধ্যে এক জন প্রোডাকশন ম্যানেজার ও অন্য জন সহ-পরিচালক, তারাও এমন পিড়াপিড়ি করতে লাগলেন যে আর না বলা গেল না।

আমি বললাম, সাতটা বাজতে তো দেরি আছে, আমি যাচ্ছি আধ ঘণ্টা পরে।

সন্তোষবাবু বললেন, ঠিক আসবেন তো? গাড়ি পাঠাব?

আমি বললাম, না, হেঁটেই যাব। সারা দিন একটুও হাঁটা হয়নি সমুদ্রের ধারে।

হঠাৎ অত্যন্ত ক্ষুব্ধভাবে চেঁচিয়ে উঠে সন্তোষ মজুমদার বললেন, জানেন, আজ দুপুর থেকে পল্লবকে থানায় ডিটেইন করে রেখেছে? আমরা এই মাত্র তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, দেখা করতেই দিল না। এ কি মগের মুল্লুক?

আমি তাকালাম সুনেত্রার দিকে।

সুনেত্রা অদ্ভুত ঠাণ্ডা গলায় বলল, আপনার বন্ধু রবীনবাবুই ওর নামে লাগিয়েছে।

সন্তোষ মজুমদার বললেন, রবীনবাবু আর ওঁর স্ত্রীকেও গেট টুগেদারে ডেকেছি। তুই আবার ওঁদের সামনে কিছু বলে বসিসনা।

সুনেত্রা বলল, যদি ওরা পল্লবকে না ছাড়ে, পল্লবের ঘাড়ে মিথ্যে দোষ চাপায়, তাহলে আমি অনেক কিছু ফাঁস করে দেব। ওই রবীনবাবুকে আমি ছাড়ব না। উনি চন্দ্রার পিছনে অনেক দিন ধরে ঘুর ঘুর করছেন।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়