সে অনেকদিন আগের কথা, যখন ওলন্দাজ যোদ্ধা-ব্যবসায়ীরা বঙ্গোপসাগর থেকে গঙ্গা নদী ধরে ভেতরে চলে এসে নদীর ধারে ছোটো ছোটো বসতি করেছিল। তাদের আগেই এসেছিল পোর্তুগিজরা, তারপর ফরাসি, ইংরেজ, দিনেমার। এদেশে লুঠের বখরা নিয়ে তারা নিজেরা প্রায়ই মারামারি করত বলে কয়েকটা ছোটোখাটো দুর্গও তাদের বানাতে হয়েছিল।

সেরকম দু-একটা দুর্গ ভগ্ন অবস্থায় হলেও এখনও টিকে আছে। গাঁয়ের লোকেরা যাকে আন্দাজগড় বলে, সেটা আসলে ওইরকম একটি ওলন্দাজদের গড়। ধু-ধু করা মাঠের মধ্যে অনেক দূর থেকে দেখা যায় গড়টাকে। দেওয়াল ফাটিয়ে বড়ো বড়ো বট-অশ্বত্থ গজিয়েছে, জায়গাটা বেশ দুর্গম, কিন্তু ভেতরের সিঁড়িটা অক্ষত রয়ে গেছে আজও। কোনোক্রমে ওপরে উঠতে পারলে দেখতে পাওয়া যায় বহুদূর পর্যন্ত নদীর বিশাল বিস্তার। বড়ো সুন্দর সেই দৃশ্য। এ অঞ্চলে এত উঁচু বাড়ি আর তো নেই।

হাতে একটা মস্তবড়ো কাটারি নিয়ে সেই ভাঙা গড়ের অদূরে চিন্তিতভাবে দাঁড়িয়েছিলেন জীবন ডাক্তার। কয়েকদিন ধরে তিনি গড়টাকে নিয়ে একটা দোটানায় পড়েছেন।

এক-একবার তিনি ভাবছেন, গড়টাকে একেবারে ভেঙে ধুলোয় মিশিয়ে দিলে কেমন হয়? এর বড়ো বড়ো পাথরগুলোকে নিয়ে বাঁধ বাঁধার কাজে লাগালে নোনা জল আটকানো যেতে পারে। এ-রকম একটা বেঢপ জিনিস থাকার দরকারই-বা কী?

গড়টার জন্য উৎপাতও কম হয় না। অতিরিক্ত সাহসী চাষার ছেলে বা রাখালেরা এখানে আসে মাঝে মাঝে। ভেতরটা একেবারে সাপখোপের বাসা। গত এক বছরে এখান থেকেই তিনটি সাপে কাটা কেস গেছে জীবন ডাক্তারের কাছে। গত সপ্তাহেই তো একটি জোয়ান ছেলে এসেছিল, তাকে বাঁচানো গেল না।

ছেলেটির যন্ত্রণাকাতর মুখখানা এখনও তার চোখে ভাসে। বড্ড দেরি করে ফেলেছিল তাকে আনতে। সামনের মাসে ছেলেটির বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। মৃত্যু হঠাৎ এসে বড় চমকে দেয়। জীবন ডাক্তারের ধারণা, এটা মৃত্যুর একটা রসিকতা তাঁর সঙ্গে। ছেলেটিকে বাঁচাতে না পেরে, তিনি খুবই রেগে গিয়েছিলেন।

শোনা যায়, রাতের অন্ধকারে কিছু লোক এখানে অসভ্যতা করতেও আসে। তারা সাপখোপের ভয়ও মানে না। আশ্চর্য এই গাঁয়ের মানুষগুলো। এখানে আসবে অথচ একবারও কেউ চেষ্টা করবে না জায়গাটা একটু পরিষ্কার করার। সাপ-টাপ মারার উৎসাহও কারুর নেই। একজন মরবে, তারপর দু-তিন মাস কেউ ভয়ে আসবে না, আবার সব ভুলে গিয়ে আর একজন মরতে আসবে।

এতকালের পুরোনো একটা জিনিসকে একেবারে ভেঙে না ফেলে একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখাই যে ভালো, সে-কথাও ভেবেছেন জীবন ডাক্তার। কিন্তু কে করবে? কারুর মাথাব্যথা নেই। তিনি নিজে করতে পারেন। কিন্তু যে-ই জায়গাটাকে মোটামুটি পরিষ্কার আর নিরাপদ করে তুলবেন, অমনি অন্যরা আসবে অধিকার ফলাতে।

তার চেয়ে বোধ হয় ভেঙে ফেলাই উচিত। ভাঙতে গেলে কেউ বাধা দিতে আসবে না। কতৃপক্ষ হয়তো এটার অস্তিত্ব সম্পর্কেই সচেতন নয়।

দূরে একটা রাখাল ছেলেকে দেখে জীবন ডাক্তার ডাকলেন। ছেলেটি গা মোচড়াতে মোচড়াতে একটু কাছে এগিয়ে এসে বলল, কী?

জীবন ডাক্তার বললেন, চল, আমার সঙ্গে ওই গড়টার মধ্যে যাবি?

কেন?

ওর ভেতরটা একটু দেখব।

জীবন ডাক্তারের আগে ছেলেটা নিজেই এগিয়ে গেল খানিকটা। বিশেষ কোনো পথ নেই। আসশ্যাওড়ার ঝোপঝাড় ঠেলে ভেতরে ঢুকতে হয়। জীবন ডাক্তার হাতের কাটারিটা দু-দিকে চালিয়ে জঙ্গল সাফ করতে লাগলেন।

ছেলেটা গড়টার দরজার কাছে পৌঁছে গেছে ততক্ষণে। ভেতরে উঁকি মেরে চেঁচিয়ে বলল, হুস, যাঃ, যাঃ, মা মনসা জল খাও, বাপের মাথায় তাগা দাও, মা মনসা জল খাও।

জীবন ডাক্তার কাছে এসে বললেন, কী? কী হয়েছে?

ভেতরে যদি সাপ থাকে?

তুই দেখেছিস?

না দেখিনি। কিন্তু ওরমধ্যে অজগর সাপ আছে।

দুর পাগল! অজগর সাপ আসবে কোথা থেকে?

নদীর জলে ভাসতে ভাসতে এসেছে। ওমর শেখ নিজের চোখে দেখেছে। প্রত্যেক শনিবারে বেরোয়।

জীবন ডাক্তার একটু হাসলেন। এইভাবেই উপকথার জন্ম হয়। এরপরে হয়তো শোনা যাবে, ওরমধ্যে এমন গোপন সুড়ঙ্গ আছে, যা দিয়ে পাতালপুরীতে যাওয়া যায়। কিংবা ওখানে আছে গুপ্তধন, ওই অজগর সাপটা বসে বসে পাহারা দিচ্ছে।

তুই অজগর সাপ দেখেছিস কখনো? ছেলেটা দু-হাত ছড়িয়ে বলল, এই এত মোটা।

চল, দেখি গিয়ে সাপটাকে।

দাঁড়ান ডাক্তারবাবু, একটা লাঠি নিয়ে আসি।

ছেলেটা দৌড়ে চলে গেল। রোদ্দুর ছড়ানো মাঠের মধ্যে তার কালো শরীরটা দেখা গেল খানিকক্ষণ, তারপর মিলিয়ে গেল আমবাগানের ওপাশে। জীবন ডাক্তার একা দাঁড়িয়ে রইলেন।

ছেলেটা কিন্তু আর এল না। একটা লাঠি জোগাড় করে আনার জন্য যতটা সময় লাগা দরকার ছেলেটা তার দ্বিগুণ সময়ের মধ্যেও ফিরল না।

অপেক্ষা করে করে বিরক্ত হয়ে পড়লেও খুব বেশি অবাক হলেন না জীবন ডাক্তার। গাঁয়ের লোকগুলো এইরকমই, অলস, ফাঁকিবাজ, মিথ্যুক! জীবনে কোনো দুঃসাহস নেই, ঝুঁকি নেওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। ছেলেটা স্রেফ মিথ্যেকথা বলে কেটে গেল।

জীবন ডাক্তার তারপর ভাবলেন, তিনিই-বা এতক্ষণ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? মনের খুব ভেতরের একটা জায়গায় তিনিও ভয় পেয়েছেন। অজগরের কথা শুনে? বন্যার সময় কখনো কখনো পাহাড়ি সাপ ভেসে আসে, কিন্তু এতদূরে, গঙ্গার মোহানা পর্যন্ত নিশ্চয়ই পৌঁছোবে না। অনেকের ধারণা, সমুদ্রেও নাকি অজগর সাপ থাকে। পৌরাণিক কাহিনির ছবিতে যেমন দেখা যায়। সব বাজেকথা।

সাধারণ সাপকেও ভয় পাওয়ার কিছু নেই। জীবন ডাক্তার কখনো ভয় পাননি। তিনি নিজের হাতে সাপ ধরতে পারেন। আসলে একাকিত্বের জন্য অস্বস্তি। সঙ্গে যদি ওই বাচ্চাছেলেটাও থাকত। তারপরই জীবন ডাক্তার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আজ যদি তাঁর নিজের একটা ছেলে থাকত! একসঙ্গে কত কাজ করতে পারতেন। পর পর চারটি সন্তান জন্মে মারা গেছে। জীবন ডাক্তারের শরীরে বিষ আছে, তাঁর কোনো বংশধর থাকবে না। তিনি নিজে যে এখনও বেঁচে আছেন সেটাই বিস্ময়ের।

কয়েকটা শুকনো ডালপালা আর পাতা এক জায়গায় জড়ো করলেন জীবন ডাক্তার। পকেট থেকে টিনের লাইটারটা বার করে তার থেকে খানিকটা পেট্রোল ঢেলে দিলেন সেগুলোর ওপর। এবং আগুন জ্বালিয়ে দিলেন।

আগুনটা ভালোমতন ধরবার পর তিনি জ্বলন্ত ডাল পাতাগুলোকে কাটারিটা দিয়ে ঠেলে ঠেলে ঢুকিয়ে দিতে লাগলেন ভেতরে। সাপেরা আগুনের তাপ সহ্য করতে পারে না, বেরিয়ে আসবেই। কিছুই বেরোলো না দেখে তিনি ভেতরে পা বাড়ালেন।

সঙ্গে সঙ্গে এমন বিকট একটা আওয়াজ হল যে, জীবন ডাক্তার আতঙ্কে একেবারে লাফিয়ে উঠেছিলেন। শরীরটা এক নিমেষে এমন দুর্বল হয়ে গেল, যেন বাইরে বেরিয়ে আসারও আর শক্তি নেই। কোনোক্রমে শব্দ লক্ষ্য করে ওপর দিকে তাকিয়ে দেখলেন, একটা স্তম্ভের ওপরে একজোড়া জ্বলন্ত চোখ। অত্যন্ত রাশভারী ভঙ্গিতে বসে আছে একটি ভূতুম পেঁচা।

ভয়েরও একটা নেশা নেশা ভাব আছে। ইচ্ছে করে অনেক সময় ভয় পেতে ভালো লাগে। জীবন ডাক্তার ভাবলেন, পেঁচা না হয়ে আর একটা সাংঘাতিক কিছু হলেও মন্দ ছিল না। অন্ধকারে ভূতুম পেঁচার চোখ দেখলে ভয় লাগে ঠিকই, কিন্তু পেঁচা মানুষের তো কোনো ক্ষতি করতে পারে না! ঠিক যেমন এক ফরাসি বৈজ্ঞানিক চোখের সামনে শয়তানকে দেখে বলেছিলেন, যেহেতু তোমার মাথায় শিং এবং পায়ে ক্ষুর আছে, সুতরাং তুমি নিরামিষাশী, তোমাকে আমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

মাঝে মাঝে থাম বসানো বড়ো একটা চত্বরের মতন জায়গা। দারুণ মোটা মোটা দেওয়াল। এটা ভেঙে ফেলা একা জীবন ডাক্তারের সাধ্য নয়। দেওয়ালের গায়ে নানাধরা দাগ দেখে মনে হয়, কখনো কখনো গঙ্গায় জল বাড়লে গড়টার অনেকখানি অংশ ডুবে যায়। পুরোনো অধিবাসীদের কোনো চিহ্নই নেই এখন। শুধু একটা দেওয়ালে-গাঁথা আংটার সঙ্গে ঝুলছে খানিকটা মোটা শিকল। ওই শিকলটা কী কাজে লাগত কে জানে! গুপ্তধনের গুজবটা কেন যে ছড়ায়নি এখনও কে জানে!

জ্বলন্ত ডাল ছুড়ে ছুড়ে তিনি পেঁচাটাকে উড়িয়ে দিলেন। কোনো ক্ষতি করতে পারবে না বটে, কিন্তু মাথার পেছনে বসে ওটা ড্যাবডেবে চোখে তাকিয়ে থাকবে, এটা মোটেই ভালো লাগে না। পেঁচাটা খুব বিরক্তির সঙ্গে উড়ে গেল।

চত্বরটার মাঝখান দিয়ে উঠে গেছে একটা ঘোরানো সিঁড়ি। জীবন ডাক্তার সাবধানে এগোলেন সেই দিকে। ভেতরে আগাছা জন্মালেও মাঝে মাঝে পরিষ্কার করা আছে। আড্ডাধারীরা এসে এখানেই বসে। কী জানি, সেই ছেলেটা এ-রকম কোনো জায়গাতেই মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করেছিল কি না!

দেওয়ালের বাঁধুনি দেখলে বোঝা যায়, একটু সারিয়ে নিলে গড়টা আরও অনেকদিন মজবুত থাকবে। বেশ ভালো একটা বেড়াবার জায়গা হয়। ইউরোপ হলে এইরকম জায়গায় হোটেল হত। দূর দূর থেকে গাড়ি হাঁকিয়ে লোকে খেতে আসত এখানে।

সিঁড়ি দিয়ে আস্তে আস্তে ওপরে উঠতে লাগলেন জীবন ডাক্তার। সিঁড়ির দেওয়ালের মাঝে মাঝে ফোকর। সেই ফোকর দিয়ে গঙ্গা দেখা যায়। মেঘলা দিন বলে বড়ো বড়ো ঢেউ উঠছে। একসময় নিশ্চয়ই এই ফোকরে বন্দুক খুঁজে পাহারা দিত ওলন্দাজ প্রহরীরা।

একা একা সেই নির্জন গড়ের মধ্যে নিজেকে তাঁর কোনো অভিযাত্রীর মতন মনে হল। যেন তিনি একটা নতুন জায়গা আবিষ্কার করতে এসেছেন। শরীরের কোনো অংশ দুর্বল নয়, বেশ যেন ঝকঝক ফিটফাট। শরীরটাকে এতখানি সুস্থ দেখে তিনি নিজেই অবাক হয়ে যান। এখন সামনে কোনো শত্রু এলে তিনি অনায়াসে তার ওপরে কাটারি চালিয়ে দিতে পারবেন। তাঁর একমাত্র শত্রুর নাম মৃত্যু।

ওপরের ছাদটা পুরু শ্যাওলায় ঢাকা। ঠিক যেন একটা গালিচা পাতা আছে। সেখানে পা দিয়েই জীবন ডাক্তারের সাবধানি চোখ দেখে ফেলল সাপ। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন একটা সাপের দুটো মাথা। সঙ্গে সঙ্গে ভুল ভাঙল। দুটো গোখরো সাপ পরস্পরকে পাকিয়ে রয়েছে।

ডান হাতের কাটারিটা উঁচু করে ধরে জীবন ডাক্তার অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। দুর্লভ দৃশ্য। একে বলে শঙ্খ লাগা। সাপের রতিক্রীড়া।

আপনা থেকেই যেন বেরিয়ে এল, মা নিষাদ। জীবন ডাক্তার সাপ মারতেই এসেছেন, কিন্তু যতই বিষাক্ত শত্ৰু হোক, সংগমরত এই সাপদের কী মারা যায়? সাপ দুটো অসহায়

অবস্থায় আছে, তিনি ইচ্ছে করলেই এখন ওদের ফণা দুটো থেঁতলে দিতে পারেন।

কিন্তু উঠল না। জীবন ডাক্তার চুপ করে দেখতে লাগলেন সেই দৃশ্য।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়