কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর সুরপতির পাওয়া হল না। তার আগেই আর একটি ঘটনা ঘটে গেল।

সে-দিন তখন নিদারুণ দ্বিপ্রহর। রৌদ্রের তেজে পথঘাট একেবারে ফাঁকা। সেই সময়েই একজন অশ্বারোহী এসে থামল সরাইখানার সামনে। অশ্বারোহীটি বেশ সুপুরুষ, মাথায় বিশাল পাগড়ি বাঁধা।

সরাইখানার চত্বরে ঢুকে সে একটা চৌকিতে বসল। তারপর পাগড়িটা খুলে হাওয়া খেতে খেতে বলল, কে কোথায় আছ হে? এক পাত্র জল নিয়ে এসো!

সেই চত্বরের এক পাশে একটি বড় পেয়ারা গাছ। ধ্রুবকুমার তখন সেই গাছে চড়ে পেয়ারা পাড়ছিল। গাছের ওপর থেকেই সে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, বাবা!

সেই ডাক শুনে ক্ষৌরকারের চালাঘরে বসে চমকে উঠল সুরপতি। ধ্রুবকুমার তো বলভদ্রকে এ-রকম ভাবে বাবা বলে ডাকে না। বাইরে এসে সে দেখাল, ধ্রুবকুমার গাছ থেকে নেমে এসে দৌড়ে গিয়ে একটি লোককে জড়িয়ে ধরে আনন্দে চিৎকার করছে, বাবা –বাবা এসেছে। আমার বাবা এসেছে।

চৌকিতে বসে থাকা লোকটিকে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল সুরপতি। অবিকল তার যৌবনের চেহারা, ঠিক যেন তার একটি প্রতিবিম্ব বসে আছে ওখানে। ধ্রুবকুমার তো ভুল করবেই।

সুরপতির চিনতে এক মুহূর্ত দেরি হল না। এই তবে সেই বংশীলাল। বংশীলালের দাড়িগোঁফ কামানো, চকচকে চেহারা, বেশ একটা শৌখিনতার ভাব আছে। এই সেই নটবর চূড়ামণি। লোকটার সাহস আছে, এ-রকম দিনের বেলা সে প্রকাশ্যে ঘুরতে পারে এখানেও।

ধ্রুবকুমারের চিৎকার শুনে বেরিয়ে এসেছে বলভদ্র। সে-ও স্তম্ভিত হয়ে গেছে। একটুক্ষণ পরে সে বলল, তুমি ফিরে এসেছ, এত দিন পর। কেন এসেছ? দূর হয়ে যাও।

বংশীলাল কোনও কথা বলল না। সে অতি চতুর লোক, প্রথমেই কিছু ভুল বলে না ফেলে ব্যাপারটা বুঝে নিতে চায়।

বলভদ্র হুকুম করল, ধ্রুবকুমার, যাও ভেতরে যাও!

ধ্রুবকুমার বলল, না, আমি যাব না। আমার বাবা এসে গেছে মা, মা, মা, এসে দেখো বাবা এসেছে।

এত দিন পর দ্বি-তলের সেই বন্ধ কক্ষটির একটি জানলা ফট করে খুলে গেল। সুরপতিও ততক্ষণে সরাইখানার চত্বরে এসে দাঁড়িয়েছে। সে আর বংশীলাল এক সঙ্গে দেখল সুভদ্রাকে। এতগুলি বছরেও সুভদ্রার সেই রূপ একটুও ম্লান হয়নি।

সুন্দরী রমণী দেখে বংশীলালের চোখ চক চক করে উঠল। এতক্ষণ সে ধ্রুবকুমারের চিৎকারে কোনও মনোযোগ দেয়নি, এবার সে দক্ষ অভিনেতার মতো কণ্ঠস্বর কম্পিত করে বলল, এসোবৎস, তোমাদের জন্যই তো আমি এত কাল পরে ফিরে এসেছি!

সুরপতির শরীরের রক্ত চলাচল যেন থেমে গেছে। এক সঙ্গে দুটি চরম উত্তেজক ব্যাপার তার সহ্য হচ্ছে না। এত দিন পর সে সুভদ্রাকে দেখল। সেই চোখ, সেই ওষ্ঠ! একরাশ কালো চুলের মধ্যে সুভদ্রার ফরসা মুখখানি দেখে মনে হয় ঠিক যেন এক অপ্সরী, এই মাটির পৃথিবীতে বন্দি হয়ে আছে।

সুরপতি সুভদ্রার নাম ধরে ডাকার চেষ্টা করল। কিন্তু গলা দিয়ে কোনও শব্দ বেরোল না। সুভদ্রা তার দিকে তাকায়নি। সে এক দৃষ্টিতে বংশীলালকে দেখছে।

বংশীলালকে দেখেও সুরপতি কম বিহ্বল হয়নি। এই সেই লোক, যার জন্য বিনা অপরাধে সুরপতিকে এত কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। জীবনের কতগুলি মূল্যবান বছর নষ্ট হয়ে গেছে তার। এই বংশীলালের জন্যই সে নিজের স্ত্রী-পুত্রকে হারিয়েছে।

এই বংশীলাল এখন এসেছে তার বাকি জীবনটাও বিড়ম্বিত করতে। সে এখন সুভদ্রাকে হরণ করতে চায়।

বংশীলাল লুব্ধের মতো কয়েক বার সুভদ্রার দিকে তাকাল। তারপর দু’হাত উচ্চে তুলে বলল, দেখো, আমি এসেছি! আমি ফিরে এসেছি। আমি মরিনি।

সুভদ্রা এখনও নিঃশব্দ, কোনও উত্তর জানাল না বংশীলালকে।

বংশীলাল ধ্রুবকুমারকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, আমি ফিরে এসেছি, আর কোনও ভয় নেই।

তারপর বলভদ্রের দিকে ফিরে বলল, ভাই, তুমি যে আমার স্ত্রী-পুত্রকে এত দিন আশ্রয় দিয়েছ সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ। এবার এদের সব ভার নেব।

বলভদ্র তিক্ত গলায় বলল, এবার এদের ভার তুমি নেবে? নির্লজ্জ, কাপুরুষ! এক সময় এদের ফেলে পালিয়েছিলে কেন? স্ত্রীর জন্য চিকিৎসক ডাকার নাম করে ভোররাত্রে চুপি চুপি কেন পালিয়েছিলে? তখন এদের কথা মনে পড়েনি? একটি কানাকড়িও সম্বল রেখে যাওনি এদের জন্য!

বংশীলাল তাকে থামিয়ে দেবার চেষ্টা করে বলল, সেসব কথা পরে বলব। আমার দারুণ বিপদ হয়েছিল।

বলভদ্র গর্জে উঠে বলল, পরে নয়, এখুনি সব কথা হয়ে যাক। কোন অধিকারে তুমি এদের ওপর দাবি জানাতে এসেছ?

বংশীলাল মৃদুহাস্য করে বলল, স্বামীর অধিকারে। পিতার অধিকারে। সে-অধিকার নষ্ট হয় না।

বলভদ্র বলল, যে-স্বামী তার স্ত্রীকে অসহায় অবস্থায় রেখে পলায়ন করে, তার আবার অধিকার কী? যে-পিতা তার পুত্রের গ্রাসাচ্ছাদনের কথা ভাবে না, সে আবার কী-রকম পিতা? তুমি এখান থেকেশীঘ্র দূর হও। আমার ক্রোধ জাগ্রত হবার আগে তুমি আমার চোখের সামনে থেকে সরে যাও।

বংশীলাল এ-কথায় ভয় পেল না। সুভদ্রার মতো সুন্দরী রমণী সে আগে কখনও দেখেনি। এমন নারীরত্ন দৈবাৎ পেয়ে গিয়ে সে কিছুতেই ছাড়বেনা। সেমিষ্টভাবে বলল, অত রাগকরছ কেন ভাই? নিশ্চয়ই কোনও গুরতর কারণ ঘটেছিল, তাই আমি ফিরে আসতে পারিনি এত দিন। এখন তো এসেছি, এখন আর আমি দেরি করতে পারছি না, অধীর হয়ে পড়েছি, তুমি আমাকে সুভদ্রার কাছে যেতে দাও।

দাঁড়াও।

কেন আমাকে বাধা দিচ্ছ?

তোমার লজ্জা করছেনা? তুমি এমন ভাব করছ যেন সব কিছুই স্বাভাবিক আছে। সুভদ্রার ওপরে তোমার চেয়ে আমার অধিকার অনেক বেশি। তুমি যে-দিন ওদের পরিত্যাগ করে চলে গিয়েছিলে, সেদিন থেকে সুভদ্রা অনশন নিয়েছিল।

এই সময় সুভদ্রার ঘরের জানলা আবার রুদ্ধ হয়ে গেল। সকলেই সেদিকে তাকাল একবার।

বলভদ্র আবার বলল, হ্যাঁ, অনশন নিয়েছিল সুভদ্রা। আমি অনেক বুঝিয়েও তাকে অনুগ্রহণ। করাতে পারিনি। সে কারুর দয়ার দান গ্রহণ করবে না। শিশুপুত্রটি কাঁদছিল, তবু সুভদ্রা ভ্রূক্ষেপ করেনি। তিন দিন এইভাবে থাকার পর সুভদ্রা বুঝেছিল যে, তুমি আর ফিরবে না। তোমার অনুসন্ধানে আমি নিজে লোক পাঠিয়েছিলাম চতুর্দিকে। কেউ তোমার সন্ধান আনতে পারেনি। তুমি এ রাজ্য ছেড়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলে, সেকথা সুভদ্রাকে জানাতে, সে শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে পাগলিনীর মতো পথে বেরিয়ে পড়েছিল। কেউ তাকে ফেরাতে পারেনি, বেশ কিছু দূর গিয়ে সে পথের মধ্যে পুড়ে যায়। তার শরীর অসুস্থ, তার ওপর উপবাসের দুর্বলতা, এই অবস্থায় সে হাঁটবে কী করে? আমি প্রথম থেকে তাকে আশ্রয় দিতে চেয়েছি বিনাশর্তে। সে রাজি হয়নি। শেষ পর্যন্ত আমি তার শিশুপুত্রকে কেড়ে নিয়ে এসেছিলাম। সিংহিনী যেমন তার শাবককে ছেড়ে থাকে না, সেই রকম সুভদ্রা তার সন্তানের টানে আবার ফিরে এসেছিল সরাইখানায়। আমার আশ্রয়ে।

বংশীলালের চোখ দিয়ে কৃত্রিম অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। সে বলল, ভাই, তুমি যে উপকার করেছ, সারা জীবনে কীভাবে সেই ঋণ শোধ করব তা জানি না। তবু যথাসাধ্য চেষ্টা আমি করব।

বলভদ্র বলল, তোমার ঋণশোধের তোয়াক্কা আমি করি না। আমি এদের আশ্রয় দিয়েছি, আমার নিজের অন্তরের টানে। আমি এই শিশু আর তার জননীকে নিজের বলে গ্রহণ করেছি। আমি জানতাম না সুভদ্রা দ্বিতীয় বার অন্তঃসত্ত্বা। তবু আমি তার বিন্দুমাত্র অযত্ন করিনি। তুমি এমনই পাষণ্ড যে নিজের গর্ভিণী স্ত্রীকে পরিত্যাগ করতেও তোমার বিবেকে আটকায়নি। সুভদ্রার জন্য আমি কত ক্ষতি সহ্য করেছি, তুমি জানো! এই দারুকেশ্বরে সব চেয়ে বড় সরাইখানার মালিক ছিলাম আমি। সুভদ্রা যখন সুস্থ হয়ে উঠল, তার রূপআবার খুলে গেল, তখন সেই রূপের লোভে শৃগালেরা ঘোরাফেরা করতে লাগল দিন-রাত। সুভদ্রাকে কেড়ে নেবার অনেক চেষ্টা করেছে কামুকেরা। আমি বুক দিয়ে ওদের আগলেছি। দিবারাত্রি প্রহরা দিয়েছি। আমার সরাইখানায় দু-দু’বার ওরা অগ্নিসংযোগ করেছে, তবু আমি সুভদ্রাকে অন্য কারুর হাতে তুলে দিইনি। তাকে নিয়ে পালিয়ে এসেছি এখানে। আমি আজও সুভদ্রার ওপর বলপ্রকাশ করিনি একদিনও, শুধু তার করুণা চেয়েছি।

বংশীলাল বলল, ভাই, আমার স্মৃতিভ্রংশ হয়েছিল। এক সাধুর আস্তানায় আমি গিয়েছিলাম সুভদ্রার জন্য ঔষধ আনতে।

সুরপতি স্তম্ভিত হয়ে সরাইখানার দ্বারের পাশে দাঁড়িয়ে এ-সব শুনছে। জালিয়াৎ বংশীলালের দুঃসাহসের কোনও সীমা নেই। এত অনর্গল মিথ্যা সে বলতে পারে! কিন্তু এখনও যদি তাকে জেরা করা যায়, সে ধরা পড়ে যাবে। সুভদ্রার পূর্ব-পরিচায় সে কিছুই জানে না। বস্তুত সুভদ্রা সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। সুভদ্রার শরীরের কোথায় কোথায় তিল আছে, সে-প্রশ্ন করলেই সে নির্বাক হয়ে যাবে। সে অতি চতুর, বলভদ্রকে রাগিয়ে দিয়ে সে পূর্ব-কথা সব শুনে নিচ্ছে। এখনও যদি সুরপতি ওর সামনে গিয়ে প্রশ্ন করে–।

কিন্তু সুরপতিকে কে চিনবে? ধ্রুবকুমার পর্যন্ত তার পিতাকে চিনতে পারেনি। সুভদ্রাও যদি তাকে এই বেশবাসে চিনতে না পারে? সুভদ্রা কি বংশীলালকেই সুরপতি ভাবছে?

আর দেরি করলে মহা সর্বনাশ হয়ে যাবে। অতি ধূর্ত বংশীলাল নিজের স্মৃতিভ্রংশের কথা তুলেছে, ওই একযুক্তিতে সেসব পুরনো কথা অস্বীকার করতে পারে। সে যদি সুভদ্রার ওপর নিজের স্বামীত্বের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, বলভদ্র কি আটকাতে পারবে? হাকিমের কাছে গেলে বলভদ্রই তিরস্কৃত হবে।

আর সময় নেই। সুরপতি দৌড়ে ফিরে এল ক্ষৌরকের আস্তানায়। ওঠো, ওঠো! তোমাকে সেই স্বর্ণমুদ্রা দিয়েছিলাম মনে আছে? আজ তার হিসাব মেটাও। আমার চুল-দাড়ি সব কেটে দাও।

ক্ষৌরকার চোখ মেলে বলল, এত ব্যস্ততার কী আছে? তুমি কি বিবাহ কবতে যাচ্ছ নাকি? সুরপতি তাকে ঝাঁকানি দিয়ে বলল, হ্যাঁ, তাই যাচ্ছি। আব এক মুহূর্তও সময় নেই।

ক্ষৌরকার বলল, তোমার মতো সহায়সম্বলহীনকে কে বিবাহ করবে হে? দারুকেশরের পাত্রীরা এত শস্তা তো নয়!

সুরপতি তাকে তুলে বসিয়ে দিয়ে বলল, কোনও পাত্রীর সঙ্গে নয়, আমার বিবাহ হবে মৃত্যুর সঙ্গে। শীঘ্র করো।

ক্ষৌরকার সুরপতির চুল হেঁটে, দাড়িগোঁফ নির্মূল করে দিল সযত্নে। তারপর সুরপতির মুখে নিজ শিল্পকীর্তির দিকে তাকিয়ে সে বলল, তোমার মুখখানি তো মন্দ নয়! মৃত্যু নিশ্চয়ই পছন্দ করবে তোমাকে।

সুরপতি লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ক্ষৌরকারের হাত থেকে ক্ষুরটি কেড়ে নিল। তাকে আর কোনও বাক্য উচ্চারণ করতে না দিয়ে সে ছুটে গেল সরাইখানার দিকে।

বংশীলাল তখন জোর করে সরাইখানার দ্বি-তলে ওঠার চেষ্টা করছে। বলভদ্র বাধা দিচ্ছে তাকে। বংশীলালের মুখ থেকে এতক্ষণে বিনয় ও কৃতজ্ঞতার ভাব খসে পড়েছে। সে রুক্ষভাবে বলভদ্রকে ধাক্কা দিয়ে বলছে, লম্পট, তুমি আমার স্ত্রীকে ভোগ করতে চাও? যদি এখনও তুমি সরে যাও, তবে আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারি। নইলে হাকিমকে দিয়ে তোমাকে শূলে চড়াব।

সুরপতি পিছন থেকে ছুটতে ছুটতে এসে চিৎকার করে বলল, দাঁড়াও।

বলভদ্র আর বংশীলাল দু’জনেই সেই চিৎকার শুনে ঘুরে দাঁড়াল। দু’জনেরই মুখ গোলাকার হয়ে গেল। তারা যেন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না।

বলভদ্রই বলল, এ কে?

বংশীলাল বলল, এ নিশ্চয়ই কোনও প্রতারক। আমার চেহারার মতো রূপসজ্জা করে এসেছে।

সুরপতি আর বংশীলাল মুখোমুখি দাঁড়াল। এক বিচিত্র হাস্য ফুটে উঠল সুরপতির ওষ্ঠে। তার জীবনের এক অশুভ চক্র যেন আজ সম্পূর্ণ হল। এক দিন এই বলভদ্রের সরাইখানায় এসে প্রথম দাঁড়াবার পর তাকে বংশীলাল বলে ভুল করা হয়েছিল। তারপর থেকে তার জীবনটাই বদলে গেল।

সুরপতি বলল, এবার?

বংশীলাল বলল, এ জীবনে কত কিছুই দেখেছি, কিন্তু এমন বিচিত্র দৃশ্য কখনও দেখিনি। কে তুমি ওস্তাদ? আমারই প্রতিচ্ছবি হয়ে কোথা থেকে এলে?

সুরপতি জিজ্ঞেস করল, আমাকে চিনতে পারছ না?

বংশীলাল ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল, না, আমি নিজেকে এখনও চিনি না। চেনার চেষ্টাও করি না।

সুরপতি ধারালো ক্ষুরটা উঁচুতে তুলে ধরে বংশীলালকে বলল, নরাধম, আজ তোর সব পাওনা মিটিয়ে দিতে এসেছি।

বংশীলাল তবু ভয় না পেয়ে বলল, তুমি কে? তুমি কি কোনও প্রেতাত্মা? তুমি কি আমার মনেরই কোনও অন্ধকার রূপ? তুমি অলীক?

সুরপতি বলল, তোমার রক্তের ফোয়ারায় যখন আমি হাত ধোবো তখন তুমি বুঝবে আমি কে। তুমি এ জীবনে যত পাপ করেছ, তার শাস্তিভোগ করতে হয়েছে আমাকে। এবার আমার হাত থেকেই নাও তোমার শেষ শাস্তি।

বংশীলাল তার কটিবন্ধ থেকে ছুরিকাটি বার করারও সময় পেল না। তার আগেই ক্ষুর নিয়ে সুরপতি লাফিয়ে পড়ল তার ওপর। ফালা ফালা করে ফেলল বংশীলালের গলা। সত্যিই ফোয়ারার ধারার মতো রক্ত ফিনকি দিয়ে লাগল সুরপতির হাতে।

বংশীলাল বলল, এবার তাহলে গেলাম। সেটাই বংশীলালের শেষ কথা। নির্বাক প্রস্তরমূর্তির মতো দণ্ডয়মান বলভদ্রকে স্পর্শ করে সুরপতি বলল, আমাকে প্রথম দিন দেখেই তুমি বংশীলাল বলে ভুল করেছিলে। আজ সত্যিকারের বংশীলালকে দেখেও তুমি চিনতে পারলে না?

বলভদ্র অস্ফুট কণ্ঠে বলল, এ বংশীলাল!

সুরপতি বলল, কোনও সন্দেহ নেই।

তাহলে তুমি কে?

আমি সুরপতি। তুমি বংশীলালের মৃতদেহটি রাজদরবারে নিয়ে যাও। জীবিত বা মৃত অবস্থায় তাকে সেখানে নিয়ে যেতে পারলে এক সহস্র মুদ্রা পুরস্কার দেবার কথা ঘোষণা করা আছে। সেই পুরস্কার তুমি নাও। আমি আমার স্ত্রীর কাছে যাচ্ছি।

এই সময় দ্বি-তলের কক্ষ থেকে তীক্ষ্ণ আ-আ-আ শব্দ হল। তারপর মনে হল, কেউ পড়ে গেল ভূমিতে।

বলভদ্র বলল, এ তো সুভদ্রার গলা। এ তো সুভদ্রার চিৎকার।

সুরপতি বলল, তোমার আগে আমি ওই কণ্ঠস্বর চিনেছি।

বলতে বলতে সে লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল।

ঘরের দ্বার ভিতর থেকে বন্ধ।

সুরপতি প্রাণপণ শক্তিতে সৈই দ্বারে ধাক্কা দিল।

ততক্ষণে বলভদ্রও সেখানে উঠে এসেছে। ধ্রুবকুমার মা মা বলে চিৎকার করছে।

সুরপতি বলভদ্রকে বলল, তুমি আমাকে এই দ্বার ভেঙে ফেলতে সাহায্য করো। করবে না?

দু’জনের মিলিত ধাক্কায় দ্বার ভেঙে পড়ল কয়েক মুহূর্তের মধ্যে। ঘরের মধ্যে দেখা গেল, সুভদ্রা নিস্পন্দ হয়ে পড়ে আছে মেঝের ওপরে। তার পাশে একটি বিষের কৌটো।

বলভদ্র হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল। ধ্রুবকুমার ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মায়ের বুকে। শুধু সুরপতি চঞ্চল হল না। সে নিচু হয়ে ঝুঁকে সুভদ্রার ওষ্ঠ ও অধর ফাঁক করে দেখল। সুভদ্রার জিহ্বায় তখনও বিষের সাদা সাদা গুড়ো লেগে আছে। তখনও উত্তাপ আছে সুভদ্রার শরীরে।

সুরপতি উন্মত্তের মতো চিৎকার করে বলল, এখনও সময় আছে! আমি বাঁচাব, আমি সুভদ্রাকে বাঁচাব। আমি এমন ভাবে সব কিছু ব্যর্থ হতে দেব না।

সুভদ্রার দেহটা পাঁজাকোলা করে নিয়ে সে ছুটল। এই পৃথিবীতে মাত্র এক জন ব্যক্তিই আছেন, যিনি সুভদ্রাকে বাঁচাতে পারেন। তিনি রাজবৈদ্য বাসবদত্ত।

বাতাসের মতো বেগে ছুটে সুরপতি সুভদ্রাকে কোলে নিয়ে এসে পৌঁছল রাজবৈদ্য বাসবদত্তের বাসভবনে। সেখানে তখন লোকে লোকারণ্য। সকলের চোখেই কাতর অশ্রু।

তবে কি বাসবদত্ত আর বেঁচে নেই? সুরপতির সব আশা শেষ?

কিছু লোককে প্রশ্ন করে সুরপতি জানল, বাসবদত্ত এখন একেবারে উত্থান-শক্তিরহিত। তিনি খুব মৃদুকণ্ঠে শ্রীবিষ্ণু নাম করছেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, তার আয়ু আর কয়েক দণ্ড মাত্র। সকলেই শোকের সেই চরম মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছে।

সুরপতি কাতর ভাবে বলে উঠল, আমাকে যেতে দাও! তোমরা আমাকে একবার যেতে দাও!

জনতা সরে গিয়ে পথ করে দিল। সুরপতি সুভদ্রাকে কোলে নিয়ে উঠে এল বাসবদত্তের বাসভবনের দ্বি-তলে। মাঝখানে প্রধান কক্ষটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন বাসবদত্ত। তাকে ঘিরে নতমুখে বসে আছে তার পরিচারিকাবৃন্দ। সুরপতিকে দেখে সবাই চমকে তাকাল।

সুরপতির সারা শরীরে রক্ত, তার বক্ষে বিদ্যুৎলেখার মতো এক নারী। যেন স্বয়ং মহাদেব সতীকে বক্ষে নিয়ে উন্মাদের মতো উপস্থিত হয়েছেন সেখানে। কেউ কোনও কথা বলার সাহস পেল না।

সুরপতি আস্তে আস্তে সুভদ্রার দেহ নামিয়ে রাখল মাটিতে। তারপর বাসবদত্তের শিয়রে এসে দাঁড়াল। বাসবদত্তের ঠোঁট একটু একটু নড়ছে। মুখে প্রশান্ত হাসি।

সুরপতি বাসবদত্তের কানের কাছে মুখ নিয়ে ডাকল, প্রভু! প্রভু! আমি একবার আপনার শরণ নিতে এসেছিলাম। তখন আপনার কৃপা গ্রহণ করার সুযোগ পাইনি। তাই আমি এখন এসেছি।

বাসবদত্ত চোখ মেলে বললেন, কে?

সুরপতি বলল, আমি একজন সামান্য মানুষ। কিন্তু ওই দেখুন, ভূমিতে পড়ে আছে এক অসামান্য নারী। ও বিষ খেয়েছে। একমাত্র আপনার কৃপাতেই ও বাঁচতে পারে।

বাসবদত্ত চোখ মেলে বললেন, আমাকে তুলে ধরো।

সুরপতি বাসবদত্তের মাথাটা উঁচু করে তুলে ধরতে তিনি তাকালেন সুভদ্রার দিকে। তার চক্ষু করুণায় আর্দ্র হয়ে উঠল। তিনি বললেন, আহা, এমন চন্দ্রলেখার মতো রূপ, এ কেন অকালে প্রাণত্যাগ করবে। কিন্তু মুখ, আর একটু আগে আসতে পারোনি? আমার যে সময় ফুরিয়ে এসেছে।

প্রভু আপনি তবুকিছু নিদান বলে দিন।

শুধু নিদানে হয় না। আমার স্পর্শ করা চাই। আমি এ পর্যন্ত যতগুলি মানুষকে বাঁচিয়েছি, তার বদলে নিজে একটু একটু করে মরেছি। আমার আর যেটুকু প্রাণশক্তি আছে, তাতে কী আর একটা প্রাণ বাঁচবে! তবু নিয়ে এসো, ওকে আমার এই শয্যায় নিয়ে এসো।

সুরপতি সুভদ্রাকে তুলে এনে শুইয়ে দিল বাসবদত্তের পাশে। তিনি তিনটি ওষুধের নাম বললেন। পরিচারিকার সঙ্গে সঙ্গে সেই ওষুধগুলো এনে সুভদ্রার মুখে ঢেলে দিল।

বাসবদত্ত নিজের ডান হাতখানা সুভদ্রার কপালে রেখে মৃদুস্বরে বলতে লাগলেন, ওঁ শ্রীবিষ্ণু, ওঁ শ্রীবিষ্ণু…।

কয়েক মুহূর্ত পরে সুভদ্রার চোখের একটা পাতা নড়ে উঠল। পরিচারিকার সঙ্গে সঙ্গে তুমুল স্বরে বলল, জ্ঞান আসছে, জ্ঞান আসছে।

বাসবদত্ত সুভদ্রার কপাল থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে অতি কষ্টে জানলার বাইরের সূর্যদেবকে প্রণাম করলেন। তারপর সকলের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি আনন্দে চলে গেলাম!

তার শেষ নিশ্বাস বেরিয়ে গেল, তিনি ঢলে পড়লেন।

আর তখনই জেগে উঠে বসল সুভদ্রা। প্রথমেই সে দেখল সুরপতিকে। সে আবেগ ভরে ডাকল, নাথ?

সুরপতি সুভদ্রাকে ধরে বললেন, আমাকে চিনতে পেবেছ? আমি সুরপতি। তোমার স্বামী।

সুভদ্রা বলল, কেন চিনব না? আমি তো দীর্ঘকাল ধরে আপনারই প্রতীক্ষায় ছিলাম। আমি এক দিনও ধর্মচ্যুতি হইনি। আমি জানতাম, আপনি ঠিক একদিন আসবেন।

সুরপতি বলল, সুভদ্রা।

সুভদ্রা বলল, নাথ! এ আমি কোথায়? আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলুন।

সুরপতি আর দাঁড়াতে পারছে না। তার শরীরের সব শক্তি চলে যাচ্ছে। তার চোখের সামনে একটা অন্ধকার সমুদ্র দুলে উঠল। পালঙ্কের দণ্ড ধরে সে নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করল। এত আনন্দ, এত তীব্র সুখ, হঠাৎ এক শরীরে বুঝি ধারণ করা যায় না। অথচ এই সময় ঘরের মধ্যে কান্নার কলরোল কেন? এই আনন্দের সময় সবাই কেন শোক করছে?

সুভদ্রা ডাকছে তাকে। সুভদ্রা তার হাত ধবেছে, তবু সুরপতি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। তার সব স্নায়ু অবশ হয়ে গেল, সে জ্ঞান হারিয়ে ঝুপ করে পড়ে গেল ভূমিতে।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়