ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কতক্ষণ ছুটেছিল জানে না। তার মাথা দিয়ে রক্ত ঝরছে, শরীর ক্রমশ অবসন্ন হয়ে আসছে, এক সময় সেঝুপকরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল। তারপর কী হয়েছে, তার মনে নেই।

যখন তার জ্ঞান ফিরল, তখন ভোর হয়ে গেছে। শরীর অত্যন্ত দুর্বল, তবু সে কোনও ক্রমে উঠে বসল। এ-দিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজল ছেলেকে। প্রথমে দেখতে পেল না। তারপর চোখে পড়ল খানিকটা দূরে একটা শুকনো পাতার স্তূপের মধ্যে থেকে দুটি কচি পা বেরিয়ে আছে। সুরপতি অজ্ঞান হয়ে পড়ার পরে কিছুক্ষণ ধ্রুবকুমার জ্যোৎস্নার আলোয় গাছের ডাল-পাতা নিয়ে খেলা করেছে। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছে এক সময়।

সুরপতি একটু একটু করে গত রাতের সব কথা মনে করার চেষ্টা করল। যেন পুরোটাই একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন। শেষ ছবিটা মনে পড়তেই তার মাথা ঝিম ঝিম করে উঠল, মনে হল আবার অজ্ঞান হয়ে পড়বে। ধনরাজ সুভদ্রাকে বাঁচাবার জন্য শুধু শুধুছুটে এসে প্রাণ দিল। তার মুণ্ডুটা ঝুলে পড়েছিল, তার রক্ত এখন লেগে আছে সুরপতির গায়ে। সুভদ্রা কোথায়?

ছেলেকে তক্ষুনি না জাগিয়ে সুরপতি উবুহয়ে বসে আঁ আঁ করে কিছুক্ষণ কাঁদল। খানিকটা কেঁদে নিলে তার শরীর হালকা হবে না, সে উঠে দাঁড়াতে পারবে না।

এক জোড়া কাঠবিড়ালি সামনের গাছটায় বারকয়েক ওঠা-নামা করছিল, তারা সুরপতির কান্না শুনে থমকে দাঁড়িয়ে বেল। এক ঝাক ছাতারে পাখি গাছের ডালে বসে খুব গোলমাল করছিল, তারাও চুপ করে গেল ওই কান্নায়।

খানিকটা বাদে সুরপতি চুপ করল। বুকের মধ্যে দমবন্ধ ভাবটা একটু কেটেছে। হাত দিয়ে সে মাথার ক্ষতস্থানটা অনুভব করল। অনেকখানি খোদল মতো হয়ে আছে। জমাট বেঁধে আছে রক্ত।

পরনের কাপড় থেকে খানিকটা ছিঁড়ে সুরপতির মাথার ক্ষতস্থানে একটা ফেট্টি বাঁধল। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। পা দুটো খুবই দুর্বল, তবু হাঁটতে পারবে কোনও ক্রমে।

শুকনো পাতা সরিয়ে সে ছেলেকে জাগাল। চোখ মেলেই ধ্রুবকুমার জিজ্ঞেস করল, মা কোথায়?

সুরপতির চোখে জল এসে যাচ্ছিল। কোনও ক্রমে নিজেকে সামলাল। ধরা গলায় বলল, চলো বাবা, আমরা মাকে খুঁজতে যাই।

মা কোথায় গেছে?

মাকে ডাকাতরা ধরে নিয়ে গেছে।

কেন?

ডাকাতরা যে খুব পাজি হয়।

বাবা, তুমি ডাকাতদের সঙ্গে লড়াই করোনি?

করেছিলাম তো। কিন্তু তারা যে সংখ্যায় অনেক। আমি পারিনি।

আমি ডাকাতদের মারব।

ছেলের হাত ধরে সুরপতি টলতে টলতে হাঁটতে লাগল। পথ খুঁজে পাবার কোনও অসুবিধে নেই। তার মাথা থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়েছে মাটিতে, তাই দেখে পথ বেশ চেনা যায়।

এক সময় তারা কাল রাত্রির ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছল। যেন ছোটখাটো একটা যুদ্ধের দৃশ্য। বণিকরা অনেকেই পালিয়েছে, মরেছেও প্রায় সাত-আট জন। তাদের মধ্যে পূর্ণানন্দকে চেনা যায়। পূর্ণানন্দ মারা গেছেন বসে থাকা অবস্থায়। একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেসান দিয়ে তার মৃতদেহটা সেই ভাবেই রয়েছে। পাশেই একটা ঘোড়ার মৃতদেহ বীভৎস ভাবে পা উলটিয়ে পড়ে আছে।

নিজের জায়গায় এসে সুরপতি দেখল ধনরাজের দেহটা। মুণ্ডুটা একপাশে ঝুলছে, বেরিয়ে আছে গলার নালি। এর মধ্যেই তার মুখের ওপর মাছি ভন ভন করছে।

ধনরাজকে দেখে সুরপতির চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল। এই ধনরাজের ওপর সে কত রাগ করেছিল। ধনরাজ তো অনায়াসেই পালিয়ে বাঁচতে পারত। কিন্তু এই যুবা বয়েসে সে প্রাণ দিল এক জন প্রায় অচেনা নারীর প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টায়। এই মহৎপ্রাণের উদ্দেশে মনে মনে প্রণাম জানাল সুরপতি।

এইসব ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে ধ্রুবকুমার একেবারে থ হয়ে গেছে। তার মুখে দিয়ে আর কথা সরছে না।

কাল রাতে শেষ যেখানে সুভদ্রাকে দেখে গিয়েছিল সুরপতি, সুভদ্রা এখন সেখানে নেই। ডাকাতরা তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে? তাহলে তক্ষুনি তক্ষুনি তার ওপর অত্যাচার করার চেষ্টা করছিল কেন?

বুধনাথ যে বলেছিল, এক আওরতকে সে দু’বার চায় না! কিন্তু তার দলের লোকরা চাইতে পারে। কোথায় গেল সুভদ্রা? সুভদ্রাকে খুঁজে পেতেই হবে। সুভদ্রাকে ছাড়া সুরপতি বাঁচবে না। শিশু ধ্রুবকুমারকেই-বা সে বাঁচাবে কী করে?

একটু খুঁজতেই সুভদ্রাকে পাওয়া গেল একটা ঝোঁপের পাশে। এক নজর দেখেই মনে হয় প্রাণ নেই। তার শরীরে একটুকরো বস্ত্র নেই, বিভিন্ন জায়গায় ছোপ ছোপ রক্ত, গাল ও বুকে নখ দিয়ে চেরার দাগ। যেন অনেকগুলো নরপশু তাকে আঁচড়ে খুবলে খেয়েছে। সুভদ্রাকে দেখে সুরপতির কান্না এল না, তার গলা শুকিয়ে গেল।

‘মা! ’ বলে চিৎকার করে ধ্রুবকুমার ছুটে গেল সুভদ্রার দিকে। জননীকে নগ্ন অবস্থায় দেখে বালকের বিকার হয় না, তবুসুরপতি অল্প দূরে পড়ে থাকা সুভদ্রার শাড়িটা কুড়িয়ে এনে তার শরীরটা ঢেকে দিল।

সুভদ্রাকে একটু স্পর্শ করতেই সুরপতির মনে হল, তার দেহে এখন একটু একটু উত্তাপ আছে। তাড়াতাড়ি সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে সুভদ্রার নাকের কাছে হাত রাখল। খুব ক্ষীণ নিশ্বাস টের পাওয়া যায়।

সুরপতি ব্যাকুল ভাবে ডেকে উঠল, সুভদ্রা, সুভদ্রা।

ধ্রুবকুমার ডাকল, মা! মা!

সুভদ্রা সাড়া দিতে পারে না।

সুরপতি তখন দৌড়ে গেল ঝরনার কাছে। নিজের গায়ের জামাটা খুলে জবজবে করে ভিজিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে এল। সেই জামা চিপড়ে জল ছড়াল সুভদ্রার চোখে-মুখে।

সুভদ্রার তবু জ্ঞান এল না।

দস্যুরা পিতল-কাঁসার ভাণ্ডগুলো নেয়নি। সে-রকম কয়েকটা ছড়িয়ে আছে এ-দিক ও-দিকে। তার মধ্যে থেকে একটা বড় ভাণ্ড বেছে নিয়ে সুরপতি অনেকখানি জল নিয়ে এল আবার। সুভদ্রার ক্ষতস্থান মুছে দিতে লাগল। তার ঠোঁট ফাঁক করে ফোঁটা ফোঁটা জল দিতে লাগল মুখে। তবু সুভদ্রা চোখ মেলে না।

সুভদ্রার প্রাণ এখনও যে আছে তা নিশ্চিত, কিন্তু কোনও এক কঠিন আঘাতের ফলে তার জ্ঞান কিছুতেই ফিরে আসছে না। চিকিৎসার জন্য তাকে এখনই কোনও বৈদ্যের কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু কী করে নিয়ে যাবে? সুরপতি অসহায়। তার নিজের শরীর দুর্বল। সামনে আর কতটা পথ পার হলে একটা নগর মিলবে তার ঠিক নেই। এখন উপায় কী?

দারুণ নৈরাশ্যের জন্যই সুরপতির মনে আরও কয়েকটা বিশ্রী কথা জাগল। সুভদ্রা তার কাছে বিষ চেয়েছিল, কোনও ক্রমে তাকে বিষ দিতে পারলেই বোধহয় অনেক ভাল ছিল। তাহলে এ গ্লানি তাকে সইতে হত না। এখন সুভদ্রাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও বোধহয় কোনও লাভ হবে না, পোঁছবার আগেই মারা যাবে। তাছাড়া সুভদ্রাকে বাঁচিয়ে তুলেই বা লাভ কী? দেখে মনে হয়, অন্তত চার-পাঁচটি পশু তার ওপর অত্যাচার করেছে। এরপর আর কোনও বর্ণহিন্দু নারীর সমাজে স্থান হয় না। সমাজ তাকে চাপ দেবে সুভদ্রাকে পরিত্যাগ করার জন্য।

তার বদলে আর এক কাজ করলে হয় না? সেটাই সব চেয়ে সহজ। জীবনের এতগুলি বিড়ম্বনা সুরপতি আর সহ্য করতে পারছে না। তার পক্ষেও এখন আত্মঘাতী হওয়া ভাল। সে নিজেও এখানে সুভদ্রার পাশাপাশি শুয়ে থেকে প্রাণ বিসর্জন দিক। একটা অস্ত্রের খোঁজে সুরপতি এ-দিক ও-দিক তাকাল।

ধনরাজের তলোয়ারটা তার পাশেই পড়ে ছিল। সেটা তুলে নিয়ে এল সুরপতি। এই অস্ত্রের এক কোপে সে সুভদ্রার প্রাণ এখনই শেষ করে দিক, তারপর নিজের গলাটাও কেটে ফেলবে।

সুভদ্রা চোখ বন্ধ করে আছে, কিন্তু ক্ষীণ নিশ্বাসে তার বুক সামান্য দুলছে, তাতেই প্রাণের লক্ষণ বোঝা যায়। এমন সোনার প্রতিমা, তার আর বেঁচে থাকার অধিকার রইল না। সুরপতি তলোয়ারটা উঁচু করে ধরল, তার হাত কাঁপছে, তার শরীর খুবই দুর্বল, তবু এক কোপে শেষ করে দিতে হবে। যেন আর জ্ঞান না ফেরে সুভদ্রার। তারপর নিজের গলাটাও এক কোপে…।

হঠাৎ ধ্রুবকুমারের দিকে তার চোখ পড়ল। তাহলে ধ্রুবকুমারের কী হবে? এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একা একা ওই শিশুটি কোথায় যাবে?

পরক্ষণেই সুরপতির মন দারুণ অনুতাপে ভরে গেল। ছি ছি, এ-সব সে কী কথা ভাবছিল? তার প্রাণের চেয়েও প্রিয় এই সুভদ্রা, তাকে সে বাঁচাবার চেষ্টা করবে না? যতক্ষণ তার দেহে একবিন্দু রক্ত আছে, ততক্ষণ সে সুভদ্রাকে মরতে দিতে পারে? একটা কুকুর যদি সুভদ্রাকেহঠাৎ কামড়াত, তাহলে কী সে সুভদ্রাকে পরিত্যাগ করার কথা চিন্তা করতে পারত? তাহলে কটা মানুষ-পশু তাকে কামড়েছে বলেই-বা কেন সে সুভদ্রাকে পরিত্যাগ করবে? আর সমাজ? সমাজ তাকে কী দিয়েছে? সে যখন বিপদে পড়েছিল, বিষয়-সম্পত্তি সব ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তখন কি এই সমাজ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তার দিকে? সমাজ কিছুই দেয় না, শুধুশাসন করার জন্য মুখিয়ে থাকে। সে আর কোনও দিন তার পুরনো সমাজে ফিরে যাবে না। সে বসতি নেবে নতুন এক দেশে, যেখানে কেউ তাকে চিনবে না, কেউ তাদের পূর্বপরিচয় জানবে না। সেখানে নতুন ভাবে জীবন শুরু হবে।

সুরপতি সুভদ্রাকে তুলে নিল নিজের কাঁধে। তারপর বলল, বাছা ধ্রুব, তুই নিজে হেঁটে যেতে পারবি তো?

বিপদের সময় শিশুরাও অনেক কর্মক্ষম হয়ে যায়। গত কাল পর্যন্ত খানিক দূর হাঁটার পরই ধ্রুবকুমার কারুর না কারুর কোলে চড়ত, আজ সে একবারও সেকথা বলল না। দিব্যি হেঁটে যেতে লাগল সামনে সামনে।

সুরপতিই পারছে না। ঘুমন্ত বা অজ্ঞান মানুষের দেহ যেন বেশিভারি হয়ে যায়। সুরপতির নিজের শরীরও খুব দুর্বল। চাপলাগতেই তার মাথা দিয়ে আবার রক্ত বেরুচ্ছে। কয়েক পাগিয়েই সে হাঁপিয়ে পড়ছে খুব। সুভদ্রাকে নামিয়ে দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস টানছে আর ব্যগ্রভাবে পরীক্ষা করে দেখছে, সুভদ্রার তখনও শ্বাস আছে কিনা।

এইরকম ভাবেই কয়েক দণ্ড চলার পর দূরে একটা গ্রামের আভাস দেখা গেল। এতক্ষণে সুরপতি প্রায় ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল, গ্রামটা দেখতে পেয়ে আবার তার শরীরে রক্তসঞ্চার হল। গ্রাম মানেই বিশ্রাম, খাদ্য, সুভদ্রার জন্য চিকিৎসা।

গ্রামটি খুবই ছোট। কয়েক ঘর মাত্ৰ কৈবর্তের বাস। কোনও চিকিৎসক এখানে নেই। তবে এক বৃদ্ধা জড়িবুটির টোটকা দেয় গ্রামবাসীদের। তাকে খুঁজে বার করা হল।

গ্রামের অনেক পুরুষ ডাকাতির খবর শুনে হইহই করে ছুটে গেল বনের দিকে। এরা সবাই বুধনাথ সিংকে চেনে। তাকে চটাবার সাল এদের নেই। এরা ছুটে গেল, মৃতদের যা কিছু জিনিসপত্র এখনও ছড়ানো ছেটানো রয়েছে, সেগুলো সংগ্রহ করতে। ডাকাতরা তো সব নেয় না।

এক কৈবর্তের বাড়ি থেকে দুধ, মুড়ি আর কলা সংগ্রহ করে সুরপতি ছেলেকে আগে খাওয়াল, নিজেও কিছু খেতে গেল, কিন্তু পারল না। কিছু মুখে দিলেই বমি হয়ে যাচ্ছে। মাথায় অসহ্য ব্যথা, মনে হচ্ছে সুরপতি যে-কোনও মুহূর্তে অজ্ঞান হয়ে যাবে। কিন্তু অসম্ভব মনের জোরে তাকে চোখ মেলে থাকতে হচ্ছে। এই সময় তার অসুস্থ হয়ে পড়লে চলবে না। বালক ধ্রুবকুমার তাহলে সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়বে। সুরপতি ধ্রুবকুমারকে নিজের কোলের কাছে বসিয়ে রাখল। সুভদ্রার ওপর ততক্ষণ বৃদ্ধার চিকিৎসা চলছে।

বৃদ্ধা একটা কী যেন গাছের শিকড়ে তখন আগুন জ্বালিয়েছে। তার থেকে অত্যন্ত দুর্গন্ধময় ধোঁয়া বেরুচ্ছে। সেই জ্বলন্ত শিকড়টা সুভদ্রার নাকের কাছে ধরে বুড়ি বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে লাগল। অনেকক্ষণ সেই রকম চলল। তারপর ভারভার জল এনে ঢালা হতে লাগল তার গায়ে। আবার সেই দুর্গন্ধ শিকড়ের ধোঁয়া। এই রকম চলল।

একসময় সুভদ্রার শরীরে স্পন্দন দেখা দিল, তারপর আস্তে আস্তে চোখ মেলল।

আনন্দে বুকের মধ্যে ধক করে উঠল সুরপতির। তাহলে আর চিন্তা নেই। সুভদ্রা বেঁচে উঠেছে। তার প্রাণের পুত্তলি সুভদ্রা না বাঁচলে সে নিজেই-বা বেঁচে থাকত কী করে? গত রাত্রির দুঃস্বপ্ন এক সময় মিথ্যে হয়ে যাবে। আবার তারা সুখের সংসার পাতবে।

কিন্তু সুভদ্রা কোনও কথা বলল না।

সুরপতি বার বার ডাকতে লাগল, সুভদ্রা! সুভদ্রা।

ধ্রুবকুমার ডাকল, মা, মা!

সুভদ্রা কোনও সাড়া দিল না। সে শুধু এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল ওদের দিকে।

ধ্রুবকুমারকে বসিয়ে দেওয়া হল সুভদ্রার কোলে। তখন তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে জল পড়তে লাগল। কিন্তু কথা বলতে পারলো না। যেন তার বাক্যহরণ হয়ে গেছে।

আরও কিছুক্ষণ চিকিৎসা চলল, তাকে কথা বলার জন্য। কিছুতেই কিছু হল না। তাকে গরম দুধ খাওয়াবার চেষ্টা করা হল। সুভদ্রা খেতে চায় না। জোর করে তার মুখে দুধ ঢেলে দিলেও মুখের বেয়ে দুধ নেমে আসে। শুধু অবিরল ঝরছে তার চোখের জল।

বুড়ি দেয়াসিনী বলল, এর বেশি চিকিৎসা করার সাধ্য তার নেই। তবে আর কিছু পথ গেলেই অন্য রাজ্য। সেই রাজ্যে দারুকেশরনামে এক বড়নগর আছে। সেইনগরের রাজবৈদ্য বাসবদত্ত একেবারে ধন্বন্তরি। তাঁর কাছে গেলে আর কোনও চিন্তা থাকবেনা।

দারুকেশর নামটা শুনে সুরপতির বুকের মধ্যে আবার শির শির করে উঠল। ধনরাজ চেয়েছিল তাদের ওই নগরে নিয়ে যেতে। তখন সুরপতি মনে মনে রাজি হয়নি। এখন তাকে ওই জায়গাতেই যেতে হবে, কিন্তু ধনরাজ থাকবে না। আহা!

দারুকেশ্বর পায়ে হেঁটে গেলে এখন দেড় দিনের পথ। তবে গোরুর গাড়িতে গেলে আরও একটু তাড়াতাড়ি হতে পারে।

সুরপতির কোমরে বাঁধা টাকার বটুয়াটা ঠিকই আছে। দস্যুরা সুভদ্রার মতো রত্নকে পেয়ে আর সুরপতির অন্য ধনরত্নের কথা চিন্তা করেনি। এই শেষ সম্বল চলে গেলে সুরপতির আর কিছুই করার থাকত না।

এক কৈবর্তের কাছ থেকে সুরপতি একটি গো-শকট ভাড়া করল। তাতে খড় বেছানো হল খুব পুরু করে। তারপর কিছু চিড়ে আর কলা রসদ হিসেবে নিয়ে তারা বেরিয়ে পড়ল।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়, তারপর সন্ধ্যা আসে। সুভদ্রা ঠায় বসে থাকে বাইরের দিকে চেয়ে। একটি শব্দ উচ্চারণ করেনা। সুরপতি কিংবা ধ্রুবকুমার তাকে বার বার কিছু প্রশ্ন করতে গেলেই সে অমনি চোখের জল ফেলে। তখন সুরপতি বলে, থাক থাক।

সুভদ্রার অপরূপকণ্ঠস্বর সুরপতির কানে সুধা বর্ষণ করত। সুভদ্রার সামনে বসে থেকেও সুরপতি তা শুনতে পাচ্ছে না বলে তার কষ্ট হচ্ছে খুবই। তবু সে মনকে বোঝাচ্ছে যে, সুভদ্রা কথা বলতে পারুক বা না-পারুক, তাতে কিছু যায় আসে না। সে যে বেঁচে আছে, এই তো যথেষ্ট!

মায়ের কাছ থেকে কথার উত্তর না পেয়ে অবুঝ ধ্রুবকুমার এক সময় ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল। এখন সে ক্লান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছ। ওইটুকু ছেলের ওপর দিয়ে এই কদিনেই কত রকম চাপ যাচ্ছে। তার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বড় মায়া হয় সুরপতির। পৃথিবীতে কোনও শিশুর কষ্ট পাওয়ার মতো করুণ দৃশ্য আর নেই। সুরপতি ধ্রুবকুমারের মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে আদর করে। তারপর ফিস ফিস করে বলে, সুভদ্রা, তোমার কথা বলার দরকার নেই। তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ তো? আমরা দারুকেশ্বরেই থাকব, আর কোথাও যাব না। আমাদের নতুন বাড়ি হবে, আমাদের আবার সাজানো সংসার হবে।

সুভদ্রা মুখটাও ফেরায় না। বাইরের দিকে ও তাকিয়ে থাকে।

সুরপতি একবার সুভদ্রাকে ধরে দারুণ জোরে ঝাঁকুনি দিল। যদি তাতে সুভদ্রার ঘোর ভাঙে। কিন্তু তাতে ফল হল উলটো। সুভদ্রার চোখ দুটি বিস্ফারিত হয়ে গেল, ঠোঁট দিয়ে ফেনা গড়াতে লাগল, তারপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল ধপ করে। ভয়ে বুক কেঁপে উঠল সুরপতির। এ আবার কী নতুন রকম সঙ্কট! তাড়াতাড়ি গো-শকট থামিয়ে সে পথের পাশের এক ইদারা থেকে জল এনে ঢালতে লাগল সুভদ্রার মাথায়। তবু সুভদ্রার জ্ঞান ফেরে না। তাহলে কি সুভদ্রা মরেই গেল? এ-কথা ভাবলেই সুরপতির মাথা ঝিম ঝিম করে। সেই বৃদ্ধা দেয়াসিনীর দেওয়া কয়েক টুকরো শিকড় ছিল সুরপতির কাছে। সেগুলি পুড়িয়ে তার কটু গন্ধময় ধোঁয়া সুভদ্রার নাকে দিতে লাগল সুরপতি। অনেকক্ষণ বাদে সুভদ্রার চোখের একটা পাতা পড়ল।

বেঁচে আছে, সুভদ্রা বেঁচে আছে! সুরপতি আনন্দে কেঁপে উঠল আবার। সুভদ্রার পিঠে হাত রেখে সুরপতি বলল, তুমি ঘুমোও। তোমাকে আর কথা বলাবার চেষ্টা করব না। তুমি শুধু বেঁচে থাকো, সেই আমার যথেষ্ট।

একটু পরে, সুভদ্রা ঘুমিয়ে পড়েছে, সুরপতি ঠায় বসে আছে। নিজের মাথার যন্ত্রণায় তার চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসছে। এই যন্ত্রণার কথা সে কারুর কাছে বলতে পারবে না। সুভদ্রা এখনও জানে না যে, সুরপতি কতখানি আহত! একা একা এতখানি কষ্ট সহ্য করা যেন আরও শক্ত।

ধ্রুবকুমারের পাশে সুরপতিও ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ এক সময় তার ঘুম ভেঙে গেল। তার পায়ের ওপর যেন কার হাতের স্পর্শ। চোখ মেলে দেখল, ঠিক অন্যান্য রাতের মতো, সুভদ্রা তার পা টিপে দিচ্ছে। সুভদ্রার চোখ থেকে টপ টপ করে জল পড়ছে তার পায়ে।

তাহলে তো সুভদ্রার বোধ আছে। তার স্মৃতিও আছে! সুরপতি ধড়মড় করে উঠে বসে আবেগের সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, সুভদ্রা! সুভদ্রা! তুমি যে আমার কতখানি, তা জানো না।

সুভদ্রাকে সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

দারুকেশ্বরতারা পৌঁছল মধ্যরত্রির কাছাকাছি। নগরে ঠিক ঢোকার মুখেই একটা বেশ বড় সরাইখানা। তখন সেখানে বাতি জ্বলছে।

সুরপতি ঠিক করল, রাতের মতো সেখানেই আশ্রয় নেওয়া বিধেয় হবে। এত রাত্রে তো আর রাজবৈদ্যকে তোলা যাবে না। তাছাড়া সুভদ্রা তো এখন অনেকটা ভালই আছে। তার কথা বলার চিকিৎসা কাল করালেও হবে।

গোরুর গাড়ির চালককে সে সেখানেই থামতে বলল। তারপর নেমে হাঁক-ডাক করতে একটি মাঝবয়সী লম্বা মতো লোক বেরিয়ে এসে বলল, কী চাই? আমার এখানে জায়গা নেই। পথ দেখো।

সুরপতি চিন্তায় পড়ল। তাহলে কোথায় যাওয়া যায়?

সে জিজ্ঞাসা করল, মহাশয়, কাছাকাছি কি আর কোথাও কোনও চটি বা সরাইখানা আছে?

লোকটি বলল, দারুকেশ্বরের দু’প্রান্তে দুটি সরাইখানা। অন্যটা এখান থেকে তিন ক্রোশ হবে। নগরের মধ্যে ধর্মশালা আছে দুতিনটি। তবে এখন রাসের মেলা চলছে, ধর্মশালায় স্থান সঙ্কুলান হবে কিনা সন্দেহ। লোকে তো বিনা পয়সার জায়গাতেই আগে যায়।

সুরপতি বলল, আমার সঙ্গে অসুস্থ স্ত্রী ও শিশুপুত্র রয়েছে। আপনার এখানে কি কোনও ক্রমেই আশ্রয় পাওয়া যাবেনা?

সরাইখানার মালিকের দশাসই চেহারা। দুই কানে দু’টি কুণ্ডল। চোখ দুটি রক্তবর্ণ। বোঝাই যায়, লোকটি সন্ধ্যাকাল থেকেই সুরাপান করছে। লোকটির মুখখানিতে কিন্তু ক্রুরতার চিন্তা নেই, বরং খানিকটা যেন শিশুসুলভ ভাব।

এত রাত্রেও সরাইখানার বিভিন্ন কক্ষ থেকে হাসি এবং গানের শব্দ শোনা যাচ্ছে। তার সঙ্গে মিশে আছে স্ত্রীলোকের কণ্ঠ। জায়গাটা বোধহয় ভাল না। অন্য জায়গায় চলে গেলে হত। কিন্তু এত রাত্রে আর কোথায়ই-বা যাবোনগরের অন্য প্রান্তে আর একটি সরাইখানা আছে, যদি সেখানে গিয়েও স্থান

পাওয়া যায়? সুরপতি নিজেই যে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না।

সে বিনীত ভাবে বলল, মহাশয়, যদি কিছু বেশি অর্থ দিলেও একটা কক্ষ পাওয়া যায়, অন্তত আজকের রাতটার মতো…।

বলভদ্র হুঙ্কার দিয়ে বলল, কী? আমার নাম বলভদ্র, আমাকে কেউ অর্থের প্রলোভন দেখায় না। সৈনিক পুরুষরা আমার সব ক’টা ঘর জুড়ে আছে, আপনি অন্যত্র চেষ্টা দেখুন।

সুরপতি বলল, আমি বড় বিপদে পড়েছি আমার স্ত্রী খুব অসুস্থ। লোকটি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে সুভদ্রার মুখের দিকে তাকাল। তার মুখে এখন অবগুণ্ঠন নেই। একদৃষ্টে সুভদ্রাকে কিছুক্ষণ দেখে সে অস্ফুট ভাবে বলল, যেন সাক্ষাৎ দেবীপ্রতিমা!

তারপর সুরপতির দিকে ফিরে সে হাঃহাঃ করে হেসে উঠল। হাসতেই থাকল। সুরপতি এ হাসির মর্ম বুঝল না।

লোকটি হাসি শেষ করে বলল, আরে বংশীলাল! তুমি আমার চোখে ধুলো দিতে পারবে না, যতই ছদ্মবেশ ধরো আর যাই করো!

সরাইখানার মালিক সুরপতির কানের কাছে মুখে এনে বলল, তুমি পালাও! এ দেশ ছেড়ে শীগগির পালাও! তোমার কুকীর্তির কথা সবাই জেনে ফেলেছে।

সুরপতি বলল, আপনি এ-সব কী বলছেন? আমি কোন কুকীর্তি করেছি? আমি শ্রান্ত, ক্ষুধার্ত।

শ্ৰেষ্ঠী বিনয় পালের স্ত্রীর সঙ্গে তোমার গুপ্ত আশনাইয়ের কথা জানাজানি হয়ে গেলে প্রহরীরা তোমাকে ধরতে পারলে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। আবার এ কার সুন্দর স্ত্রী হরণ করে এনেছ? বংশীলাল, ভাল কথা বলছি, শীগগির পালাও।

আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি বংশীলাল নই। শ্রেষ্ঠী বিনয় পালকে আমি চিনি না। আপনি আমার সম্পর্কে এ-রকম অসমীচীন কথা বলছেন কেন? আমার সঙ্গে আমার স্ত্রী ও পুত্র।

তুমি বংশীলাল নও! আমি নিজের চোখকে অবিশ্বাস করব? তুমি ভেবেছ, তুমি মাথায় একটা ফ্রেট্টি বেঁধেছ বলেই লোকে তোমাকে চিনতে পারবে না? এই রমণী তোমার স্ত্রী? বংশীলাল সাতজন্মে বিয়ে করেনি। বেশ তো, এই রমণী নিজের মুখে বলুক, তুমি এর স্বামী!

সুরপতি প্রমাদ গুনল। সুভদ্রা যে কথা বলতে পারছে না, সে কথা কি সরাইখানার মালিক বিশ্বাস করবে? সুভদ্রা তো সব শুনতে পাচ্ছে, সে এই বিপদ থেকে তাকে উদ্ধার করবে না?

সে ব্যাকুল ভাবে বলল, সুভদ্রা, একটা কথা বলো! এই লোকটিকে বলে দাও, আমি বংশীলাল নই। আমি তোমার স্বামী!

সুভদ্রা নির্বাক।

সরাইখানার মালিক হা-হা করে হাসতে লাগল। তারপর বলল, এসব চালাকি আবার কবে থেকে শুরু করেছ? সন্তান সমেত এই রমণীকে বার করে এনে কার ঘরের সর্বনাশ করেছ? তুমি তো আগে গোপনেই কাজ সারতে, এখন একেবারে প্রকাশ্যে? ওহে বংশীলাল, তোমার দিন ফুরিয়ে এসেছে, এইনগর থেকে ভাগো।

বংশীলাল কে?

তুমিই বংশীলাল, তুমি নিজেই জানো তুমি কে।

সুরপতি এগিয়ে গিয়ে সুভদ্রার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে বলতে লাগল, বলল বলল সুভদ্রা, একবার অন্তত বলল।

সেই গোলমালে ঘুম ভেঙে গেল বালক ধ্রুবকুমারের। সুরপতির ও-রকম ব্যাকুল চিৎকার শুনে সে ভয় পেয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি উঠে সে সুরপতিকে জড়িয়ে ধরে ডাকল, বাবা, বাবা মার কী হয়েছে? মা কথা বলছে না কেন?

বলভদ্র বলল, বাবাঃ। এই শিশুটিকেও বাবা ডাকতে শিখিয়েছ? তোমার আবার সন্তান হল কবে? তুমি তো বাপুও-সব ঝামেলায় কখনও যাও না! তুমি তো ভ্রমরের মতো ফুলে ফুলে শুধু মধু খাও! বিবাহিতা নারীদের প্রতিই তোমার বেশি লোভ।

সুরপতি এবার কঠোর ভাবে বলল, সাবধান। আপনি সংযত হয়ে কথা বলুন। ঠিক আছে, আপনি আশ্রয় দেবেন না, আমরা চলে যাচ্ছি।

হাসি থামিয়ে সরাইখানার মালিক বক্ৰচোখে পর্যায়ক্রমে তাকাতে লাগল সুরপতি আর সুভদ্রার দিকে। তারপর সুরপতির কাঁধে চাপড় মেরে বলল, তুমি সত্যিই বংশীলাল নও! তাহলে আপনি কে?

আমার নাম সুরপতি, নিবাস ছিল সপ্তগ্রামে। স্ত্রী ও পুত্র নিয়ে ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়েছিলাম, পথে দুবৃত্তের আক্রমণে আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে।

লোকটি বলল, আমার নাম বলভদ্র। বিপদগ্রস্ত মানুষকে আমি কখনও ফেরাই না।

সরাইখানার পিছনে একটি ছোট্ট ঘর, তৈজসপত্রে ঠাসা। সেগুলি বার করে নিয়ে সেখানেই স্থান দেওয়া হল সুরপতিদের। খড়ের ওপর কম্বল পেতে বানানো হল শয্যা। আপাতত তাই যথেষ্ট।

সুভদ্রা ও ধ্রুবকুমারকে সেই ঘরে বসিয়ে রেখে আবার বাইরে বেরিয়ে এল সুরপতি।

সরাইখানার মালিক বলভদ্র তখন বাইরের অলিন্দে বসে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গান শুরু করেছে। হাতে একটি সুরাপাত্র।

সুরপতি তার পাশে দাঁড়িয়ে একটি গান শেষ নাহওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল। তারপর শেষ হতেই বিনীতি ভাবে বলল, আপনি আমাকে একটু সাহায্য করবেন? রাজবৈদ্য বাসবদত্তের গৃহে কোন দিক দিয়ে যেতে হবে, একটু দেখিয়ে দেবেন?

বলভদ্র বলল, কেন, সেখানে গিয়ে কী হবে?

আমার স্ত্রী অসুস্থ। ডাকাতের অত্যাচারে ভয় পেয়ে তার কণ্ঠরোধ হয়ে গেছে। শুনেছি বাসবদত্ত ধন্বন্তরি।

এত রাতের বাসবদত্তকে ডাকতে যাওয়া! হা-হা-হো-হো হি-হি।

কেন, তিনি আসবেন না? যদি যথেষ্ট দক্ষিণা দিই?

আপনি কিছুই জানেন না দেখছি। বাসবদত্ত একজন বিখ্যাত সুরাপায়ী। সন্ধ্যার পর তাকে আর কেউ ডাকতে সাহস করেনা। দেখুন গিয়ে তিনি হয়তো এখন উলঙ্গ হয়ে নৃত্য করছেন কিংবা মাটিতে গড়াগাড়ি দিয়ে গর্দভ-রাগিণীতে গলা সাধছেন।

কী সর্বনাশ। স্বয়ং রাজার যদি রাত্তিরবেলা কোনও ব্যাধি হয়, তাহলে কী হবে?

তিনি বিনা চিকিৎসায় মারা যাবেন, আর কী হবে?

তাহলে এ-রকম সুরাপায়ীকে রাজবৈদ্য রাখা হয়েছে কেন?

তার কারণ দিনেরবেলা স্বয়ং যমরাজও ওঁর কাছে আসতে সাহস পাবেন না। আমাদের এই দারুকেশ্বরে দিনেরবেলা একটাও লোক মরেনি কোনও দিন।

এমন কথা শুনিনি কক্ষনও।

দারুকেশ্বরে অনেক কিছুই নতুন দেখবেন। এক পাত্র সুরা পান করবেন নাকি?

না!

একটু চিন্তা করে সুরপতি আবার জিজ্ঞাসা করল, অন্য কোনও চিকিৎসক ডাকা যায় না?

সন্ধ্যার পর দারুকেশরে কেউ চিকিত্সক ডাকে না। সবাই দারু পান করে। আপনি কিছুই জানেন না দেখছি। আপনাদের সপ্তগ্রামে কী নিয়ম?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুরপতি বলল, সপ্তগ্রামে দিনের বেলাতেও মানুষ মরে।

কাল সকালে বাসবদত্তকে পাবেন। চিন্তা করছেন কেন, বাসবদত্তকে দেখলেই সব রোগ ভয় পেয়ে মানুষের শরীর ছেড়ে পালায়।

হাত মুখ ধুয়ে, সামান্য কিছু খাবার খেযে সুরপতি সুভদ্রার পাশে শুয়ে পড়ল। সুভদ্রাকে কথা বলাবার অনেক চেষ্টা করল, কিন্তু সুভদ্রা যেন পাথর। তার শরীর তখন জ্বরতপ্ত, নিশ্চয়ই সাংঘাতিক কোনও ব্যাধি হয়েছে সুভদ্রার। ওষ্ঠ ও অধরও খুব ফুলে আছে, সেটাই কি কথা না বলার কারণ? পশু, পশু, দস্যু বুধনাথ একটা পশু। কোনও দিন যদি হাতের কাছে পায়, সুরপতি তাকে নিশ্চয়ই হত্যা করবে।

বাকিরাত সুরপতির চোখে ঘুম এল না। সুভদ্রা আর ধ্রুবকুমারের ঘুমন্ত নিশ্বাসের শব্দ সে শুনতে পাচ্ছে। সে নিজেও খুবই ক্লান্ত, সুভদ্রাকে অনেকখানি রাস্তা বহন করে আনতে হয়েছে বলে তার সারা শরীরে ব্যথা, কিন্তু মস্তিষ্কভরা দুশ্চিন্তার জন্য তার ঘুম আসছে না। অবিলম্বে অর্থ-উপার্জনের একটা পথ খুঁজে বার করতে হবে। সঙ্গে যা অর্থ আছে, শুধু বসে তা ব্যয় করলে বেশি দিন তো চলবে না। রাজবৈদ্য বাসবদত্ত চিকিৎসার জন্য কত অর্থ দাবি করবেন কে জানে।

সুভদ্রা সব কাজে সাহায্য করত সুরপতিকে। সে তার মধুর ব্যবহারে সুরপতিকে কখনও বেশি চিন্তিত হতে দিত না। সেই সুভদ্রা এখন অনড়। সে এখন কত কষ্ট পাচ্ছে, সেটা ভেবেই সুরপতির বেশি কষ্ট।

যাক, বেঁচে থাকাটাই বড় কথা। তবু যে সুভদ্রা এত বড় বিপদের পরেও বেঁচে আছে, এটাই যথেষ্ট।

সুভদ্রা শেষ কথা বলেছিল, আমাকে বিষ দাও, বিষ! তারপর থেকে আর সুভদ্রার কোনও কথা শোনেনি সুরপতি।

.

ভোর হবার পর, সুভদ্রা আর ধ্রুবকুমারের তখনও ঘুম ভাঙেনি, সুরপতি উঠে পড়ল। ওদের আর জাগাল না। নিজে প্রাতঃকৃত্য সেরে নিল তাড়াতাড়ি। পোশাক বদলাবার কোনও উপায় নেই, কারণ আর কিছু নেই সঙ্গে। তাই গত কালের অপরিচ্ছন্ন পোশাকটাই পরে নিল। আজই কিছু পোশাক পরিচ্ছদ কিনতে হবে নিজের মাথার ক্ষতস্থানটায় একবার হাত বুলিয়ে নিল সুরপতি। মনে হচ্ছে যেন ব্যথা-বেদনা সব দুর হয়ে গেছে। কী করে এমন হল? ক্ষতস্থানটায় চাপ বেঁধে আছে, কিন্তু বেদনা নেই কেন? আপনাআপনি সেরে গেল? যাই হোক, পরে এ নিয়ে চিন্তা করা যাবে। সুরপতি মাথার রক্তাক্ত ফেট্টিটা খুলে ফেলে দিল মাটিতে। তারপর টাকার পুঁটলিটা সাধানে কোমরে বেঁধে নিল, তারপর বেরিয়ে পড়ল।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়