ক্রমে পার হয়ে গেল তিথির পর তিথি, মাসের পর মাস। সুরপতির কাছে কালের হিসাব নেই। তবু সে মনে মনে গণনা করে খানিকটা অনুমান করল যে, কারাগারের দিনগুলি সমেত প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর কেটে গেছে।

এর মধ্যে সে সুভদ্রা ও ধ্রুবকুমারের কোনও সংবাদই পায়নি। তারাও জানে না সুরপতির খবর। তারা বেঁচে আছে কি না কে জানে!

সহায়সম্বলহীন অস্থায় কীভাবেই-বা বেঁচে থাকবে!

তবু সুরপতি কারাগার থেকে বেরিয়ে প্রথমেই দারুকেশ্বর গেল না। কারাজীবনের বিভীষিকার কথা সে ভুলতে পারে না। আবার সে কোনও ক্রমেই ধরা পড়তে চায় না। সে তো সুরপতি হিসেবে ধরা পড়েনি, সে ধরা পড়েছে বংশীলাল হিসেবে। বোঝা যায় বংশীলালের ওপর অনেকেরই অনেক রাগ আছে। সুতরাং জেলপলাতক বংশীলালের জন্য আবার খুব খোঁজাখুঁজি চলবেই।

সুরপতির মুখে এখন দাড়িগোঁফের জঙ্গল। সেগুলো সে ইচ্ছে করেই নির্মূল করল না। কারণ তার দাড়ি কামানো মুখের সঙ্গেই বংশীলালের মিল।

আন্দাজে দিকনির্ণয় করে সে চলতে লাগল দারুকেশ্বরের বিপরীত দিকে। প্রথম কিছুদিন রইল সে এক অরণ্যের মধ্যে লুকিয়ে। অতিকষ্টে ফলমূল সংগ্রহ করে ক্ষুধা মেটায়। ক্কচিৎ-দৈবাৎ কোনও মানুষজন দেখলেই সে ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে, যেন সে অরণ্যের এক ভীত অসহায় পশু। যে-কোনও মানুষকেই তার ভয়।

এইভাবেও কাটল কয়েক মাস। তারপর সুরপতি এক দিন সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল। অরণ্যের জীবনে সে যেন বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, কোনও রকমে ক্ষুধানিবৃত্তি করতে পারলেই আর কোনও চিন্তা নেই, তারপর নিশ্চিন্তে নিদ্রা দেওয়া যায়। আর কোনও দায়িত্ব নেই, আর কোনও ভয় নেই। এইভাবেই তার কাটবে নাকি সারা জীবন? সে সুভদ্রা আর ধ্রুবকুমারেব কোনও সন্ধান করবে না? সে এত স্বার্থপর?

এই উপলব্ধি হবার সঙ্গে সঙ্গেই সে বেরিয়ে পড়ল অরণ্য থেকে। এখন আর তাকে দেখে কেউ সভ্য সমাজের মানুষ বলেই মনে করবে না, কে চিনতে পারবে তাকে? তবু সে সতর্ক হয়ে থাকে।

অরণ্য থেকে বেরিয়ে সে এমন এক রাজ্যে উপস্থিত হল, যেখানকার মানুষজনের পোশাক পরিচ্ছদ অন্য রকম, ভাষাও আলাদা। যাক, তাহলে এ রাজ্যে নিশ্চয়ই কেউ বংশীলালকে চেনে না!

সে অজানা গ্রামগঞ্জে ঘুরতে লাগল। তার পোশাক শতছিন্ন, শরীরে পুরু ময়লা, দাড়িগোঁফের মধ্যে কোটরগত চোখ, তাকে দেখায় ঠিক পথের পাগলের মতো। খিদের জ্বালায় সে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে করে। যে-দিন ভিক্ষে ঠিকমতো পায় না, সে-দিন রাগে তার শরীর জ্বলে। তার এখন শক্তসমর্থ দেহ, প্রচুর খাদ্যে প্রযোজন, অনাহারের কষ্ট সে সহ্য করতে পারে না। এক-এক দিন সন্ধের দিকে তার ইচ্ছে হয়, পথের ধারে লুকিয়ে থেকে কোনও পথিকের মাথায় ডাণ্ডা মেরে তার যথাসর্বস্ব কেড়ে নেয়।

কিন্তু অতি কষ্টে সে নিজেকে দমন করে। সে পাপের পথে কিছুতেই যাবে না। একবার ও-পথে গেলে আর ফেরার উপায় নেই। তাহলে সে আর কোনও দিনই সুভদ্রা ও ধ্রুবকুমারের কাছে যেতে পারবে না। ওদের দুজনের কথা মনে পড়লেই তার চোখে জল আসে। সে তো জ্ঞানত কোনও অপরাধ করেনি, তবু এই দুর্ভাগ্যের মালা কে তার গলায় পরিয়ে দিল। নিয়তি? তাকে নিয়ে নিয়তির এই নিষ্ঠুর খেলা কেন?

সারা দিন ভিক্ষার পর যেটুকু খাদ্য সে পায়, তা নিয়ে সে কোনও নির্জন প্রান্তরের বৃক্ষতলায় বসে। যতটুকু খাদ্যই তার কাছে থাক, সে তার তিনভাগ করে। নিজে একভাগ খেয়ে, বাকি দু’ভাগ রাখে সুভদ্রা আর ধ্রুবকুমারের নামে। ক্ষুধায় তার পেট জ্বলে, তবু সে নিজের স্ত্রী-পুত্রকে ভাগ না দিয়ে খাবে না। এইভাবে সে সুভদ্রা ও ধ্রুবকুমারের কথা মনের মধ্যে জাগিয়ে রাখে।

রাত্রিবেলা সে শুয়ে থাকে উন্মুক্ত আকাশের নিচে। গ্রহ-নক্ষত্রমণ্ডলীর দিকে তাকিয়ে তার চোখে জল আসে। কেউ তাকে দয়া করল না। স্ত্রী-পুত্রের কথা অনেকক্ষণ ভাবতে ভাবতে তার মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়। চোখে ঘোর আসে। সব কিছু অন্ধকার হয়ে যায়। আবার মনে হয়, তার শিয়রের কাছেই বসে আছে সুভদ্রা ও ধ্রুবকুমার, সে তাদের জীবন্ত স্পর্শ পাচ্ছে। তখন খুব চেষ্টা করেও কিছুতেই জেগে উঠতে পারে না সুরপতি। সে গভীর দুঃখে চেঁচিয়ে ওঠে, আমি কে? আমি কে? সুভদ্রা, বলল বলল, আমি কি সেই সুরপতি? তাহলে তোমরা লুকিয়ে আছ কেন?

সে এক অঞ্চলে বেশিদিন থাকতে পারে না। গ্রাম্য শিশুরা তাকে পাগল মনে করে বড় জ্বালাতন করে। তাকে কাঠি দিয়ে খোঁচায়, তাকে ঢিল মারে।

সুরপতি শিশুদের উদ্দেশে হাতজোড় করে বলে, বাবা সকল, আমাকে মেরো না, আমি বড় দুঃখী লোক।

শিশুরা সেই কথা শুনে খল খল করে হাসে। শিশুদের মতো নিষ্ঠুর আর কেউ নেই। তারা সুরপতির অনুনয়-বিনয়কে নতুন ধরনের পাগলামি মনে করে তাকে ভ্যাঙায়। সুরপতি যখন রাস্তা দিয়ে যায়, তখন একপাল শিশু তাকে ভেঙাতে ভেঙাতে পিছু পিছু যায়।

সুরপতি লোকের বাড়িতে গিয়ে কাজ চেয়েও দেখেছে। কেউ দেয় না। সকলেই তার চেহারা ও পোশাক দেখে ভয় পায়। কিন্তু নতুন পোশাক কেনার সামর্থ্য যে তার নেই, কেউ বোঝে না। সকলেই তার কথা শোনার আগেই তাকে দুর দুর করে তাড়িয়ে দেয়।

একটি গ্রামের দুষ্ট শিশুরা তাকে জ্বালাতন করতে করতে এক সময় তার পরিধানের কাপড়টা সম্পূর্ণই ছিঁড়ে দিল। তার কাপড় এমনিতেই ঝুলিঝুলি হয়ে গিয়েছিল, এখন আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না।

রাস্তার ওপর সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় দাঁড়িয়ে সুরপতি হঠাৎ সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে গেল। বালকরা তার গায়ে ঢিল মারছে, কাঠির খোঁচা দিয়ে তার শরীর রক্তাক্ত করে দিচ্ছে, তবু তার ভ্রূক্ষেপ নেই। সে মনে মনে ভাবছে, দেখো সুরপতি, আজ তোমার কী অবস্থা! তুমি সপ্তগ্রামের সম্রান্ত বংশের আদরের দুলাল ছেলে। আজ তুমি ক্ষুধার্ত, উলঙ্গ, অপমানিত। এর চেয়ে চরম অবস্থা আর কী হতে পারে? এরপর কি আরও কিছু আছে? যদি থাকে তো শেষ দেখে নাও।

কাছাকাছি বাড়ি থেকে একটি লোক মোটা বাঁশ নিয়ে ছুটে এল। সুরপতির পিঠে সেই বাঁশের এক ঘা বসিয়ে দিলে লোকটি বলল, হতভাগা, আমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে নচ্ছারপনা হচ্ছে? দূর হয়ে যা!

লোকে যেরকম ষাঁড় বা পথের কুকুরকে মেরে তাড়ায়, এর ভঙ্গি ঠিক সেই রকম। সুরপতির একবার মনে হল, লোকটির হাত থেকে বাঁশটা কেড়ে নিয়ে ওরই মাথায় এক ঘা মেরে দেয়। নিরপরাধকে শাস্তি দেবার ফল কী হয়, ও একটু টের পাক।

তারপর সুরপতি ভাবল, নিরপরাধরাই তো শাস্তি পায়। তার অর্থবল নেই, তার প্রতিপত্তিসম্পন্ন বান্ধব নেই। সে কারুব কাছে প্রমাণ করতে পারবে না যে সে নিরপরাধ। সবাই তাকে আবার শাস্তি দেবে। আবার সেই কারাগার।

সে লোকটির সামনে মাথা নিচু করে বলল, মারুন! আমাকে মেরে শেষ করে দিন।

আবার সে মাথা সরিয়ে নিল। না, এ-ভাবে মরা চলবে না। তাহলে সুভদ্রা আর ধ্রুবকুমারের সঙ্গে আর দেখা হবে না। ওদের সঙ্গে একবার শেষ দেখা করতেই হবে। যদি সুভদ্রা আজও বেঁচে থাকে, তাকে সুরপতি জানাবে যে, সেইচ্ছে করে ওদের পরিত্যাগ করে চলে যায়নি। বুধনাথের কাছে ধর্ষিতা হবার পর লজ্জায় ঘৃণায় সুভদ্রার বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সুরপতি তো লজ্জায় ঘৃণায় পত্নী পুত্রকে পরিত্যাগ করতে চায়নি।

সে বংশধারী লোকটিকে বলল, আমি চলে যাচ্ছি।

লোকটি তবু পিছন থেকে এক ঘা মারল সুরপতির পিঠে। কেটে গিয়ে রক্ত বেরুতে লাগল। মানুষ মানুষকে এমনিই মেরে আনন্দ পায়।

অন্য একটি বাড়ি থেকে আর একটি লোক বেরিয়ে এসে বলল, এখানে কী ব্যাপার হচ্ছে?

আগের লোকটি বলল, এই বেল্লিকটা আমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কু-দৃষ্টি দিচ্ছিল। একে শায়েস্তা করা দরকার। আবার মুখের ওপর বলে কিনা মারুন!

দ্বিতীয় লোকটি বলল, মোটেই না, একে দেখে তো অসৎ লোক মনে হয় না। ইনি নিশ্চয়ই কোনও মুক্ত সাধুপুরুষ। আসুন সাধুবাবা, আমার বাড়িতে আসুন।

দ্বিতীয় লোকটি সুরপতিকে ডেকে নিয়ে গেল নিজের গৃহের দিকে। তারপর ফিস ফিস করে বলল, বাপু হে, তুমি তো সাধুপুরুষ নও, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা নেই, হাতে কমণ্ডলু নেই, দেখেই বুঝতে পারছি তুমি কোনও খুনি আসামি। তা হোক, তোমাকে আমি পরিধানের বস্ত্র দেব, পেট-চুক্তি আহার দেব, আরও দশটি সিক্কা টাকা দেব। তার বদলে তোমাকে একটি কাজ করতে হবে। ওই যে লোকটি তোমার পিঠে বাঁশের ঘা মারল, ওর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিতে হবে। পারবে?

দুই পড়শিব বিবাদ, তার মধ্যে এক জন অপর জনের বিরুদ্ধে সুরপতিকে কাজে লাগাতে চায়। সুরপতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এর নাম সংসারধর্ম। এর চেয়ে তার অরণ্যের জীবন অনেক ভাল ছিল।

সুরপতি লোকটির কথার কোনও উত্তর দিল না। শুধু একটু হেসে পিঠ ফেরাল।

সুরপতি সোজা হাঁটতে আরম্ভ করল। এক সময় সে এসে পৌঁছল গ্রামের শ্মশানে। এক শান্ত নদীর তীরে।

যাক, শ্মশানে কোনও ভয় নেই। শ্মশানে কেউ অত্যাচার করে না। এখানে সে উলঙ্গ থাকলেও কারুর সম্ভ্রম নষ্ট হবে না। শ্মশানের পাশেই তিন-চারটি প্রাচীন বটগাছ। কিছু পোড়া কাঠ, কয়েকটা ভাঙা হাড়ি পড়ে আছে, মানুষজন নেই।

সুরপতি একটা গাছতলায় উপুড় হয়ে শুয়ে অনকক্ষণ ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। লোকচক্ষুর আড়ালে এখানে তার কান্নায় কেউ ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে না।

কেঁদে কেঁদে বুক হালকা করে এক সময় সে ঘুমিয়ে পড়ল।

তারপর অন্ধকার হল, প্রবল বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির মধ্যে একবার জেগে উঠেও সুরপতি স্থানত্যাগ করল না। গাছের তলার চেয়ে আর কোন ভাল জায়গা সে পাবে? ক্ষুধায়, ক্লান্তিতে তার উঠতেও ইচ্ছে করল না। আবার ঘুমোল।

তার পরিপূর্ণ ঘুম ভাঙল শেষরাত্রে। কয়েকটি নিশ্বাসের ফোঁস ফোঁস শব্দে। চোখ মেলে দেখল, তার কাছাকাছি শেয়াল ঘোরাফেরা করছে। এরা কি তাকে মৃত ভেবে খেতে এসেছিল? সুরপতি ধড়মড় করে উঠে বসল।

সে দেখল অদুরে সাদা পোশাক পরা আর একটি লোক চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তার পাশে চার পাঁচটা শেয়াল।

সুরপতি ভাবল, তার মতো এমন দুর্ভাগা আর কে আছে যে, এই শ্মশানে ঘুমোতে এসেছে?

সে দু’একটা পোড়া কাঠতুলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে শেয়ালগুলোকে তাড়াল। তারপর সেই লোকটির কাছে চলে এলে।

লোকটির পাশে নিঃশব্দে বসল সুরপতি। লোকটির অঙ্গে বেশ শৌখিন পরিচ্ছদ। দৈর্ঘ্য-প্রস্থে প্রায় সুরপতির মতো। লোকটির মুখ অবশ্য দেখা যাচ্ছে না, লোকটি শুয়ে আছে মাটিতে মুখ গুঁজে।

লোকটি তত সুরপতির মতো উলঙ্গ আর নিঃস্ব নয়। তবু কী তার এমন দুঃখ যে, শ্মশানে এসে শুয়ে আহে।

সুরপতি ভাবতে লাগল, লোকটিকে জাগানো ঠিক হবে কি না। যদি লোকটি বিরক্ত হয়? কিন্তু যে-ভাবে শেয়ালের দল ঘোরাফেরা করছে, তাতে এখানে এ-ভাবে শুয়ে থাকাও বিপজ্জনক। সে মৃদুস্বরে ডাক, ভদ্র, উঠুন।

কোনও সাড়া পাওয়া গেল না।

সে আবার ডাকল, ভদ্র, উঠুন! এ-ভাবে শুয়ে থাকবেন না!

এবারেও সাড়া না পেয়ে সুরপতি লোকটির অঙ্গ স্পর্শ করল। সঙ্গে সঙ্গে সে চমকে উঠল। স্পর্শমাত্রই বোঝা গেছে যে, লোকটি মৃত। নিশ্চয়ই লোকটিকে দাহ করতে আনা হয়েছিল, বৃষ্টি বাদলার মধ্যে শ্মশানবন্ধুরা ওকে এই অবস্থায় ফেলে পালিয়েছে।

সুরপতি মৃতদেহটি উলটে দিয়ে আবার বিস্ময়ের শব্দ করে উঠল। মৃতের বুকে একটি আমূল ছুরি বেঁধা। এবং মৃত লোকটিকে দেখতেও যেন ঠিক সুরপতির মতো। যেন সুরপতিই এখানে ছুরিবিদ্ধ অবস্থায় নিহত হয়ে পড়ে আছে। সুরপতির এখনকার চেহারা নয়, সপ্তগ্রামে ধনীর দুলাল হিসেবে তার এই রকমই রূপ ছিল। তাহলে এই কি বংশীলাল? এই তার জীবনের কুগ্রহ? বংশীলালের শেষ পর্যন্ত এই নিয়তি হল? কিন্তু আর একটু খুঁটিয়ে দেখার পর সুরপতি বুঝতে পারল, লোকটির সঙ্গে তার চেহারার বেশ কিছু অমিলও আছে। এর নাক একটু বেশি তীক্ষ্ণ, মাথায় চুল সামান্য কুঞ্চিত। বোধহয় এ বংশীলাল নয়, অন্য কেউ।

মৃতদেহটির পাশে একটি মাটির মালসায় কিছু চাল আর ফুল বেলপাতা। ক্ষুধার জ্বালায় সে সেই কাঁচা চালই চিবিয়ে চিবিয়ে খেল খানিকটা। আর খানিকটা চাল সেই মৃত লোকটির মুখেও গুঁজে দিল, যাতে কোনও অবিচার না হয়।

মৃত লোকটির দিকে তাকিয়ে সুরপতির মাথায় একটা পরিকল্পনা এল। এবার তার জীবন পালটাতে হবে। আর দেরি করা চলে না। সে প্রথমে নদীতে নেমে খুব ভাল করে স্নান সেরে নিল। বালি মাটি দিয়ে সারা শরীর মেজে পরিষ্কার করল। তারপর উঠে এসে মৃত লোকটির সমস্ত পোশাক খুলে সে নিজে পরে নিল। লোকটি প্রায় তারই বয়সী হবে। লোকটির দুই হাতে দুটি সোনার আংটি ছিল। সে-দুটিও খুলে নিতে সে দ্বিধা করল না। একটি আংটি লাল পাথরের, অন্যটি সবুজ। চুনি আর পান্না।

মৃত্যের কাছ থেকে এই উপকার পাওয়ার বিনিময়ে সে সেই মৃতদেহটি শিয়ালের খাদ্য হতে দিল না। কী ভেবে সে শেষ মুহূর্তে মৃতের বক্ষে বেঁধানো ছুরিটাও খুলে নিয়ে লুকিয়ে রাখল নিজের পোশাকের মধ্যে। দেহটি কোলে করে এনে সে নদীতে ভাসিয়ে দিল। তারপর সে পা চালাল জোরে জোরে।

রাত্রি শেষ হবার আগেই তাকে এ গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে। এবার আর কোথাও নয়। দারুকেশর।

মৃতের পোশাক পরে প্রায় নতুন মানুষ হয়ে সুরপতি শ্মশান ছেড়ে এসে উপস্থিত হল জনপদে। তার প্রথম কাজই হল কিছু অর্থ সংগ্রহ করা। দু’টি আংটির মধ্যে একটি বিক্রয় করলেই কিছু অর্থ পাওয়া যাবে। অপরের দ্রব্য বিক্রয় করার ব্যাপারে সুরপতির বিবেকে একটু খোঁচা লাগতে লাগল। সুরপতি এর আগে কোনও দিন পরের দ্রব্য ভোগ করেনি। কিন্তু সে এই বলে তার মনকে বোঝালো যে, মৃতের সম্পত্তি কারুর নয়। মতদেহটি সবসমেত নদীতে ভাসিয়ে দিলে এই আংটি দু’টি নদীগর্ভে লীন হয়ে যেত। তার বদলে কোনও মানুষের ভোগে লাগা অন্যায় নয়।

কিছু মানুষজনের কাছে খোঁজখবর নিয়ে সুবপতি জানল যে, দারুকেশর সেখান থেকে বহুদূর। অন্তত সাত দিনের পথ। এই সাত দিনের একটা রাহাখরচ আছে। দারুকেশরের সেই সরাইখানায় সুভদ্রা এবং ধ্রুবকুমার এখনও আছে কিনা তার ঠিক নেই, তবু সেখান থেকেই অনুসন্ধান শুরু করতে হবে। নিঃস্ব অবস্থায় সুরপতি অনুসন্ধান চালাবেই-বা কী করে?

গঞ্জের হাটে এক মণিকারের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল সুরপতি। দু’টি আংটিই এক সঙ্গে বিক্রয় করা উচিত নয়, একটা থাক ভবিষ্যতের জন্য। একটা থাক আঙুলে, একটা যাক মণিকারের কাছে।

এবারেও একটা সমস্যা দেখা দিল। কোনটা বিক্রয় করবে, লাল না সবুজটা? চুনি না পান্না? দুটি আংটিই সমান সুন্দর, ওজনও দু’টিরই সমান। সুরপতি কিছুতেই মনস্থির করতে পারে না, একবার বাঁ হাত একবার ডান হাতের দিকে তাকায়। লাল না সবুজ? চুনি না পান্না?

শেষ পর্যন্ত সুরপতি পান্না-বানো আংটিটিই নিজের কাছে রাখবে ঠিক করল। সবুজ পাথরটি যেন সাপের চোখের মতন দৃষ্টি আকৃষ্ট করে রাখল। সুরপতি লাল পাথর-বসানো আংটিটি নিয়ে মণিকারের দোকানে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে নিয়তি তার সঙ্গে আর একটা নিষ্ঠুর খেলা খেলল।

পৃথিবীর সব দেশের মণিকাররাই অতিশয় ধূর্ত হয়। এই মণিকারটিও সুরপতির কথাবার্তা শুনেই বিদেশি বলে বুঝে নিয়েছিল, তাই সেই মূল্যবান আংটিটি নিয়ে বহু দরাদরি করে শেষ পর্যন্ত পাঁচটি স্বর্ণমুদ্রার বেশি দিতে কিছুতেই সম্মত হল না। সুরপতি সেই পাঁচ স্বর্ণমুদ্রা নিয়েই বেরিয়ে এল।

প্রথমেই তার প্রয়োজন জঠরাগ্নি নিবারণের। সেখানে গঞ্জের ব্যাপারিদের জন্য কয়েকটি ছোট ছোট পান্থশালা আছে, সেগুলি থেকে ভাত রান্নার গন্ধ ভেসে আসছে। একটি পান্থশালায় ঢুকেসুরপতি প্রায় তিন জন মানুষের খাদ্য এক সঙ্গে খেয়ে ফেলল। বহু দিন পর, সেই সপ্তগ্রাম ছেড়ে আসার পর এই প্রথম সে সুস্থির ভাবে বসে ইচ্ছানুরূপ আহার্য ভোগ করতে পারছে।

একটি স্বর্ণমুদ্রা ভাঙিয়ে সে দাম চুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তারপর যাত্রা শুরু করল দারুকেশ্বরের পথে। বেশি দূর যেতে পারল না অবশ্য, এক প্রহর বাদেই সে একটি গাছতলায় বসে বমি করল। এত দিন বাদে এত প্রভূত পরিমাণে আমিষ-সহ খাদ্য তার সহ্য হবে কেন? অবশ্য বমির ফলে তার শরীর অনেকটা হালকা হয়ে গেল, সে তেমন অসুস্থ বোধ করল না। তবু তক্ষুনি পথচলার বদলে সে ঘুমিয়ে রইল সেখানে।

ঘুম ভাঙার পর সে দেখল তার শিয়রের কাছে এক ব্যক্তি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুরপতি দ্রুত উঠে পড়ল। তার মনে হল, লোকটি নিশ্চয়ই কোনও তস্কর বা দস্যু। সুরপতির কাছে স্বর্ণমুদ্রা আছে, একটি মূল্যবান আংটি আছে, দস্যু তস্কররা তো আকৃষ্ট হবেই। অবশ্য এক-আধ জন দস্যু তার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। সুরপতি এখন আত্মরক্ষায় সক্ষম।

সুরপতি প্রশ্ন করল, আপনি কে?

লোকটি বলল, আমি একজন পথিক। আপনার নিদ্রা-ভাঙার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

সুরপতি বলল, আপনার সঙ্গে আমার পুর্বপরিচয় আছে, এমন তো স্মরণ হয় না। আমার সঙ্গে আপনার কী প্রয়োজন?

লোকটি বলল, আমার মনে হল, আপনিও এক জন পথিক। আমার ইচ্ছা, আপনার সঙ্গে এক সঙ্গে পথ চলি। অপরাহ্ন হয়ে আসছে, পথে অনেক বিপদের আশঙ্কা আছে, তাই উভয়ের এক সঙ্গে যাওয়াই ভাল।

সুরপতিতীক্ষস্বরে প্রশ্নকরল, আপনি কীভাবে ঘুমন্ত অবস্থাতেও আমাকে দেখে অনুমান করলেন যে, আমি এক জন পথিক?

লোকটি এবার হেসে উত্তর দিল, পথিক ছাড়া অন্য কেউ কি পথের ধরে বৃক্ষতলায় ঘুমোয়? বিরক্ত হবেন না, আমি আপনার সাহায্য প্রার্থনা করছি। আমি একজন বণিক, আমার সঙ্গে বেশকিছু অর্থ আছে, তাই আপনার সহায়তা চাই।

সুরপতির সন্দেহ আরও দৃঢ় হল। তস্কর বা প্রতারাই এরকম দুর্বল সেজে আসে। অন্য কেউ স্বেচ্ছায় নিজের কাছে অর্থ থাকার কথা প্রকাশ করে না।

সুরপতি জিজ্ঞেস করল, মহাশয় কোন পথে যেতে ইচ্ছে করেন? লোকটি দারুকেশ্বরের দিকের পথই দেখাল।

সুরপতি বলল, আমি একজন ভবঘুরে, কোন পথে যাব তা এখনও স্থির করতে পারিনি, আপাতত আরও কিছুক্ষণ এই বৃক্ষতলে বায়ু সেবন করতে চাই। আপনি অন্য সঙ্গীর খোঁজ করুন।

লোকটি খুবই দুঃখের ভঙ্গি করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিনা বাক্যব্যয়ে চলে গেল। সুরপতি আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল সেখানে। তারপর যাত্রা শুরু করল।

অপরাহ্ন গাঢ় হয়ে এসেছে, দীর্ঘ ছায়া নেমে আসছে ধীরে ধীরে। ধূ-ধূ করা প্রান্তরের মধ্যে পথ। সাবধানতার জন্য সুরপতি রাত্রে পদযাত্রা করতে চায় না। রাত্রে কোনও সরাইখানায় বিশ্রাম নেবে। দুতিন ক্রোশের মধ্যেই আর একটি নগর আছে। সন্ধ্যার আগেই সেখানে পৌঁছতে হবে। আকাশের অবস্থা ভাল নয়, রাশি রাশি কালো মেঘ উড়ে আসছে কোথা থেকে।

কিছু দূরেই দেখা গেল একটা বৃক্ষের আড়ালে সেই লোকটি দাঁড়িয়ে আছে। পাশে এক জন সঙ্গী। স্থানটিতে ছায়া ছায়া অন্ধকার। সুরপতি বুঝে নিল যে, লোক দু’টির মতলব ভাল নয়। কিন্তু ভয়ের চিহ্ন দেখালে আরও বেশি বিপদ। তাই সে লোক দু’টিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেই এগিয়ে গেল।

পিছন থেকে সেই লোকটি জিজ্ঞেস করল, ভবঘুরে মহাশয়, শেষ পর্যন্ত এই পথেই যাওয়া ঠিক করলেন নাকি?

সুরপতি বলল, হ্যাঁ।

দাঁড়ান, আমরাও সঙ্গে যাব।

আমার আগ্রহ নেই।

সুরপতি ঠিক সময়েই পিছনে ঘুরে তাকিয়েছিল, তখন এক জন তাকে মারবার জন্য একটি লাঠি তুলেছে। লাঠির আঘাত তার মাথায় না লেগে লাগল ঘাড়ে। সুরপতি ব্যাঘ্রের মতো লোক দুটির ওপর লাফিয়ে পড়ল।

কারাগারে নিয়মিত কঠোর পরিশ্রম করার ফলে তার শরীর এখন লোহার মতো শক্ত। সুরপতি অতি অল্প সময়েই সেই দস্যু দুটিকে জব্দ করে ফেলল, সে ছুরিকাঘাতে তাদের শেষ করে দিতে পারত, কিন্তু তার বদলে মুষ্টির আঘাতেই ওদের অজ্ঞান করে ফেলল। তারপর ওদেরই বস্ত্র নিয়ে ওদেরই হাত-পা শক্ত করে বেঁধে ফেলে রাখল সেখানে।

এই ক্ষুদ্র ঘটনায় সুরপতির মনের জোর বেড়ে গেল অনেক। দু’জন দস্যকে সে এত সহজে ভূপাতিত করেছে যে, এরপর একটি বড় দল আক্রমণ করলেও সে তেমন ভয় পায় না।

লোক দুটি মুক্তির জন্য কাকুতি মিনতি করছে। কিন্তু সুরপতি আর ভ্রুক্ষেপ করল না। লোক দুটিকে সারা রাত এখানে পড়ে থাকতে হবে, সকালবেলা কেউ না-কেউ নিশ্চয়ই ওদের মুক্তি দেবে। এইটুকু শাস্তি ওদের প্রাপ্য। ওরা যদি লাঠির ঘা সুরপতির মাথায় ঠিক মতো কষাতে পারত, তাহলে সুরপতির মৃতদেহ পড়ে থাকত এখানে। অবশ্য রাত্রের মধ্যে হিংস্র পশু আক্রমণ করতেও পারে ওই দুজনকে। কিন্তু যারা নিজেরাই হিংস্র, তাদের এই রকম নিয়তির ওপর নির্ভর করাই উচিত। আজ থেকে ক’বছর আগেও সুরপতি দু’জন মানুষকে এ-রকম অবস্থায় ফেলে রেখে যেতে পারত না, কিন্তু এখন সে অনেক বদলে গেছে।

বনের মধ্য দিয়ে সুরপতি সতর্ক হয়ে হাঁটতে লাগল। সায়াহ্ন ঘনিয়ে এসেছে। রাত্রিকালে সুরপতি বিশ্রাম নিতে চায়, তাকে বহু দূর যেতে হবে। বেশি ব্যস্ততা দেখাবার কোনও প্রয়োজন নেই, এতগুলি বছর পার হয়ে গেছে যখন, তখন আর দু’চার দিন কাটলেই-বা কী এমন ক্ষতিবৃদ্ধি হবে। সব চেয়ে বড় কথা, তাকে বেঁচে থাকতে হবে এখন।

ভালয় ভালয় সে বনপথটা পার হয়ে এল। এবার পথের ধারে দু’একটি গৃহ দেখা যাচ্ছে। তাহলে অদূরেই কোনও জনপদ থাকার কথা। সুরপতির জঠরে কোনও খাদ্য নেই, সব বমির সঙ্গে বেরিয়ে গেছে। শরীর দুর্বল লাগছে। এ-বেলা অল্প কিছু আহার করে কোনও সরাইখানায় বিশ্রাম নেবে।

কিন্তু এই সময় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির সঙ্গী হয়ে এল ঝড়। বাতাস ও জল তোলপাড় করে দিল সমস্ত প্রকৃতিকে। এত বৃষ্টি ও ঝড়ের মধ্যে গুলে গেছে অন্ধকার। সামনের পথ আর কিছুই দেখা যায় না। তবুসুরপতি ছুটল, তাকে যে-কোনও উপায়ে একটা সরাইখানায় পৌঁছতেই হবে।

কিন্তু বেশি দূর অগ্রসর হওয়া গেল না। এত ঝড়বৃষ্টির মধ্যে ছুটে যাওয়া প্রায় উন্মাদের প্রয়াস। বেশ কয়েক বার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল সুরপতি। বাধ্য হয়ে সুরপতিকে এক বৃক্ষতলে দাঁড়াতে হল। কিন্তু সেখানেও আশ্রয় নেই, অবিশ্রান্ত জল ঝরছে। এবং একটু পরেই প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল। বিদ্যুতের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল সুরপতির, বাজের শব্দে কানে তালা লাগল এবং তার চেয়েও বড় একটা বিপদের চিন্তা ধাক্কা মারল তার বুকে। এ-রকম দুর্যোগের মধ্যে কোনও বড় বৃক্ষের নিচে দাঁড়ানো মোটই নিরাপদ নয়। বড় বড় বৃক্ষগুলিই বজ্রপাতকে আকর্ষণ করে। বাজে পোড়া বৃক্ষ সুরপতি অনেক দেখেছে।

পর পর আরও দু’বার বজ্রপাত হল। খুব কাছেই। তাকে এ স্থান ছেড়ে যেতেই হবে। সামনের দিকে তাকিয়ে বিদ্যুতের চকিত আলোকে সুরপতি দেখল খানিকটা দূরে একটি দ্বি-তল গৃহ। সাদা রঙের। কাছাকাছি আর কোনও গৃহ নেই, মাঠের মধ্যে অন্ধকারে ওই একটি গৃহ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে যেন।

আর কোনও কিছু চিন্তা না করে সুরপতি দৌড়ে গেল সে-দিকে। তার মনে হল, এখন যেন তার মাথায় একটি বাজ পড়বে। কোনও ক্রমে সে সেই গৃহের ফটকের কাছে পৌঁছল। সৌভাগ্য ক্রমে ফটকটি ভোলাই ছিল। দ্বিধা না করে সে ভেতরে ঢুকে গিছে দাঁড়াল অলিন্দের নিচে। এখন সে নিরাপদ।

সুরপতির সর্বাঙ্গ ভেজা, মাথা থেকে জল গড়াচ্ছে। এই অবস্থায় তাকে কতক্ষণ থাকতে হবে কে জানে। ঝড়বৃষ্টি থামবার কোনও লক্ষণ নেই। এই গৃহটি কার? এখানে কি আশ্রয় পাওয়া যাবে? কোনও মানুষজনের সাড়াশব্দ নেই। সুরপতি দ্বারে আঘাত করতেও সাহস পেল না। এই ক’বছরে তার এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, সে কোনও মানুষকেই আর বিশ্বাস করে না। মানুষ দেখলেই তার ভয় হয়। সে একলা পথিক, এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে একটি গৃহের অলিন্দে এসে আশ্রয় নিয়েছে, এ-জন্যও যদি কেউ তাকে অন্য রকম সন্দেহ করে?

একটু পরেই ভিতরের দ্বার খুলে গেল। প্রদীপশিখা করতলে ঢেকে এক জন স্ত্রীলোক এসে দাঁড়াল সেই দ্বারে। স্ত্রীলোকটি মধ্যবয়সিনী, মাথায় কাঁচা-পাকা চুল, কিন্তু চোখে সুর্মা টানা, ওষ্ঠে তাম্বুলরাগ।

স্ত্রী লোকটি সুরপতির দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি ভিতরে আসুন।

সুরপতি কয়েক পলক তাকিয়ে দেখল রমণীর দিকে। তারপর বিনীতি ভাবে বলল, প্রবল বৃষ্টির জন্য আমি এখানে আশ্রয় নিয়েছি। বৃষ্টি ফুরালেই চলে যাব।

রমণী আবার বলল, আপনি ভেতরে আসুন

সুরপতি বলল, তার প্রয়োজন নেই। আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে, আমি এখানেই বেশ আছি।

রমণী বলল, আপনার পোশাক-পরিচ্ছদ সব ভেজা, আমাদের মালিকানি আপনাকে ভেতরে আসতে বললেন।

সুরপতি সেই রমণীর সঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করল। ভেতরে একটি লম্বা চত্বর। দু’দিকে সারি সারি ঘর। একটি ঘরের দ্বার খুলে রমণীটি সুরপতিকে বলল, এই গোসলখানার মধ্যে পানি আছে, আপনি হাত-পা ধুয়ে নিন। শুল্ক বস্ত্রও আছে, সেসব পরে নেবেন, লজ্জা করবেন না।

সুরপতি ভেতরে ঢুকে দেখল, গোসলখানার মধ্যে বড় বড় দুটি রুপোর বাতিদানে মোম জ্বলছে। মাটির বড় বড় জালা ভর্তি জল। একটি তাকে রয়েছে কয়েকটি আতর ও কেশ তৈলের শিশি। এক পাশে একটি দড়িতে ঝোলানোকয়েক প্রস্ত পুরুষের পোশাক। পোশাকগুলি বেশ মূল্যবান ও নতুন।

সুরপতি বিমূঢ় হয়ে গেল। এ কোথায় এল সে? এরা তাকে এত খাতির করছে কেন? আবার কি সে কোনও বিপদের মধ্যে পা দিতে যাচ্ছে? তার তো কোনও দোষ নেই। কিন্তু শুধুকি দোষী ব্যক্তিরই বিপদ আসে?

একটুক্ষণ সাত-পাঁচ ভাববার পর সুরপতির বস্ত্র বদলে নিল। নতুন বস্ত্র তার অঙ্গে মানিয়ে গেল বেশ। এখন সে যেন একটি নতুন মানুষ।

দরজা খুলে বাইরে আসতেই দেখল, সেই রমণীটি অপেক্ষা করছে। সে বলল, আসুন।

এবার তারা প্রবেশ করল আর একটি কক্ষে। কক্ষটি দারুণ ভাবে সাজানো। মেঝেতে লাল রঙের গালিচা পাতা, একটু উঁচু পালঙ্কের ওপর সাদা দুগ্ধফেননিভ শয্যা পাতা। পালঙ্কের শিয়রের কাছে একটি কাশ্মীরি কাজ করা কাঠের পাত্রে কিছু ফলমূল রাখা।

রমণীটি বলল, আপনি এখানে বিশ্রাম করুন। সুরপতি জিজ্ঞেস করল, আপনি কে? আমাকে কেন এত যত্ন করছেন?

রমণী বলল, আমি কেউ নই, আমি এ বাড়ির এক জন বাঁদি। আপনি অতিথি আমাদের।

সুরপতি বলল, আমি এক জন সামান্য লোক। ভবঘুরে পথিক। আমি আপনাদের এত যত্নের যোগ্য নই।

রমণী বলল, আপনি অতিথি সেই তো যথেষ্ট।

রমণীটি সুরপতিকে একা রেখে চলে গেল। সুরপতি অভিভূতের মতো বসে রইল। এ-সব কি স্বপ্ন? যে-বাড়ির বাদিরই এত সাজসজ্জা, সে-বাড়ির মালিকানি যেন কত না ধনী। বাড়িতে কোনও পুরুষমানুষ নেই? আর কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছেনা।

একটু পরেই সেই রমণীটি আবার এল, হাতে একটা রুপোর বড় রেকাব, তাতে কিছু কাবাব, রুটি, একটি বাটিতে মিষ্টান্ন, আর একটি পাত্র ভরা সুরা।

রমণী বলল, আপনি নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত। সামান্য কিছু খাদ্য এনেছি খেয়ে নিন। তারপর আমাদের মালিকানি আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন।

সুরপতি বিস্মিত ভাবে জিজ্ঞেস করল, আপনাদের মালিকানি কে?

রমণী বলল, বেগম রশিদা খান। আপনি তার নাম শোনেননি? সুরপতি বলল, আমি পরদেশি মানুষ। এখানকার কিছুই জানি না।

বেগম রশিদা খান এ রাজ্যের সব চেয়ে বড় তয়ফাওয়ালি। রাজা বাদশারা তার দয়া পেয়ে ধন্য হয়ে যান।

তিনি যে আমার মতো সামান্য এক জন মানুষকে এত দয়া করছেন, সেজন্য আমি কৃতার্থ হয়ে গেছি। বেগমকে আমার একশো কুর্নিশ জানাবেন।

বেগমের মন ভাল নেই। উনি সাধারণত থাকেন আজিমগঞ্জে। এটা ওঁর মন খারাপের বাড়ি। মন খারাপ হলে নগরের ভিড় ওঁর ভাল লাগে না, এখানে চলে আসেন।

বেগমের মন খারাপ কেন?

বেগমের পেয়ারের মানুষ ইউনুস খাঁ ওঁকে ছেড়ে চলে গেছেন। আজ দশ দিন, তার আর দেখা নেই।

ইউনুস খাঁর সঙ্গে বেগমের শাদি হয়েছিল?

তয়ফাওয়ালির কখনও শাদি করতে নেই। ইউনুস খাঁ ছিলেন বেগমের দিল-পসন্দ পেয়ারের লোক। তিনি বিবাহিত। কিন্তু প্রত্যেক দিন মাঝ রাতে বেগমের সঙ্গে এসে দেখা করতেন। হঠাৎ তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন। নিজের বাড়িতেও যাননি। আপনি খেয়ে নিন। একটু পরে মালিকানি এসে আপনার সঙ্গে দেখা করবেন।

রমণীটি চলে গেল। সুরপতির মনে হল, এইসবটাই যেন রূপকথা। এ কোথায় সে এসে পড়ল? এত সুখ তার সইবে তো? এমন মনোরম আশ্রয়টা যখন পাওয়া গেছে, তখন রাত্তিরটা এখানেই কাটানো যাক। কিন্তু কাল ভোরেই সে চলে যাবে। বেশি লোভ করতে নেই।

সত্যিই তার খিদে পেয়েছিল খুব, সে দ্বিধা না করে সব খাবারটুকু শেষ করল। সুরার পাত্র স্পর্শ করল না। তাদের পরিবারের কেউ কোনও দিন সুরা পান করেনি।

আহার শেষ করে সে ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে বিছানায় একটু গড়াতে যেতে আবার দারুণ চমকে উঠল। বাইরে হঠাৎ একটা বাঘ ডেকে উঠল। খুব কাছ থেকে, যেন এ গৃহের প্রাঙ্গণেই। সর্বনাশ, গৃহের মধ্যে বাঘ ঢুকে এসেছে নাকি?

আত্মরক্ষার জন্য সুরপতির প্রথমেই মনে হল তার কক্ষের দ্বার বন্ধ করে দেওয়া দরকার। কিন্তু সে-পর্যন্ত যেতে পারল না, তার আগেই দ্বার ঠেলে ঢুকে এল একটা পূর্ণবয়স্ক বাঘের মুখ, তীব্র জ্বলন্ত দুই চোখে তাকাল সুরপতির দিকে।

সুরপতি ভাবল, এই তার শেষ। এবার বাঘের মুখেই তাকে প্রাণ দিতে হবে। তার কাছে একটা ছুরিকা আছে, কিন্তু সামান্য ছুরিকা নিয়ে কে কবে বাঘের সঙ্গে লড়াই করতে পেরেছে! সে আস্তে আস্তে দেয়ালের দিকে পিছিয়ে যেতে লাগল। বস্ত্রের অভ্যন্তর থেকে সে ছুরিকাটা বার করে একহাতে মুঠো করে ধরেছে।

বাঘটা ঘরের মধ্যে ঢুকে স্থির হয়ে দাঁড়াল। তক্ষুনি সুরপতির ওপর লাফিয়ে পড়ার কোনও উদ্যোগ করল না। তখন সুরপতি লক্ষ্য করল, বাঘটির গলায় একটি সোনার শৃঙ্খল বাঁধা।

সেই শৃঙ্খলের এক প্রান্ত ধরে ঘরে ঢুকল আর একটি রমণী। কালো মখমলের কাঁচুলি ও ঘাঘরা পরা। মুখের ওপর একটা সূক্ষ্ম বস্ত্রের ওড়না চাপা দেওয়া। তবু তাতেও তার মুখ স্পষ্ট দেখা যায়। রমণী অসাধারণ রূপসী।

ভীত, কম্পিত শরীরে সুরপতি তাকে অভিবাদন জানাল।

বীণার ঝঙ্কারেরমতোকন্ঠে রমণী বলল, আপনি বসুন। শের আলিকে দেখে আপনি ভয় পাবেন না। নিরীহ লোককে একখনও আক্রমণ করে না। পরদেশি আপনার নাম কী?

সুরপতি নিজের নাম জানাল।

রমণী বলল, আমার নাম রশিদা খানম, আমারবাদির কাছে বোধহয় শুনেছেন আগেই। এই দারুণ দুর্যোগের মধ্যে আপনি আমারঅলিন্দে আশ্রয় নিয়েছিলেন, আমি গবাক্ষ থেকে দেখেছিলাম। আপনার নিবাস কোথায়? কোথায় যাচ্ছিলেন?

সুরপতি আত্মপরিচয় গোপন করে বলল, আমি পথিক, পথই আমার ঘর। আমি দেশে দেশে ভ্ৰমণ করি নিজের খেয়ালে।

রশিদা খানম্ একটা কেদারায় বসল। বাঘটি দাঁড়িয়ে রইল দরজার কাছে। রশিদা খানম্ বলল, আমি সাত দিন কারুর সঙ্গে কথা বলিনি, আমার মন ভাল নেই। আজ আমার বড় বেশি কষ্ট হচ্ছে, আমার অন্যমনস্ক হওয়া দরকার। আপনি বহু দেশ ঘুরেছেন। অনেক কাহিনি কিস্যা জানেন, আমাকে তার দু-একটি শোনান। আসুন, এক পাত্র সুরা পান করতে করতে আপনার কিস্যা শুনি।

রশিদা খান দু’টি পাত্রে সুরা ঢেলে একটি সুরপতির দিকে এগিয়ে দিতেই সে হাত জোড় করে বলল, মাপ করুন বেগম, আমি সুরা পান করি না, আমার অভ্যাস নেই।

রশিদা খানম্ একটু কৌতূহলী হয়ে বলল, আপনি সুরা পান করেন না? হিন্দুর তো সুরাপানে নিষেধ নেই! আপনি ব্রাহ্মণ?

সুরপতি বলল, না। আমি বৈশ্য এবং বৈষ্ণব। রশিদা খানম্ বলল, ও তাই। বৈষ্ণব বৈষ্ণবদের কারণবারি পান করাও গুনাহ।

তারপর রশিদা খানম্ অধরোষ্ঠ ফাঁক করে মুক্তাপংক্তির মতো দাঁতে ঝর্ণার মতো হাসি ঝরিয়ে জিজ্ঞেস করল, কিন্তু আপনি যে যবনের বাড়িতে আহার করলেন, তাতে আপনার জাত যাবেনা?

সুরপতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ক্ষুধার্তের আবার জাত কী? আপনি যে আমাকে আশ্রয় এবং আহার্য দিয়েছেন, এজন্য আমি কৃতার্থ।

রশিদা খানম্ বলল, হিন্দুদের অনেক ব্যাপার আমি জানি। আমার যে মনের মানুষ, সে-ও আগে হিন্দু ছিল। ধর্মান্তরিত হবার আগে তার নাম ছিল কৃষণ। আমি এখনও তাকে কৃষণ বলে ডাকি। আমি যে গান গাই, তাতে কৃষণজি আর রাধার অনেক কথা থাকে। হায়, আমার সেই কৃষণ আমাকে ছেড়ে কোথায় যে গেল।

সুরপতি মাথা নিচু করে স্তব্ধ হয়ে রইল। এই রমণীর দিকে সে ভালভাবে তাকাতেই পারল না। অসম্ভবতীব্র এর রূপ। তার স্ত্রী সুভদ্রাও অসামান্য রূপসী, কিন্তু সুভদ্রার রূপে আছে স্নিগ্ধ আলো। আর এই তয়ফাওয়ালির রূপ যেন দীপ্ত বহ্নি।

রশিদা খানম্ জিজ্ঞেস করল, আপনি যে পথ ধরে এলেন, সে পথে ইউনুস খাঁ বলে কোনও ব্যক্তির সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছে?

সুরপতি সংক্ষেপে বলল, না।

রশিদা খান সুরার পাত্রে চুমুক দিয়ে বলল, সে যেখানেই থাক সে ঠিক ফিরে আসবে। আপনি একটা কিস্যা বলুন।

মুখে মুখে গল্প বলার অভ্যেস নেই সুরপতির। সে বাকপটু নয়। তবু রশিদা খানমের বার বার অনুরোধে সে নিজের জীবনের কাহিনিই খানিকটা অন্য রূপ দিয়ে সবিস্তারে বলল। দুটি লোক ছিল ঠিক একই রকমের চেহারার। এক জনের নাম রঘুপতি, আর এক জনের নাম বংশীলাল। তারপর বংশীলালের বদলে ভুল করে রাজসেনারা রঘুপতিকে ধরে…।

সুরপতি গল্প শেষ করার পর রশিদা খানম ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞেস করল, তারপর? তারপর? রঘুপতির সঙ্গে বংশীলালের দেখা হয়নি?

সুরপতি বলল, জেল থেকে পালিয়ে এসেছে রঘুপতি, সেইসময় তার সঙ্গে আমার একসরাইখানায় দেখা হয়। তার মুখেই আমি তার এই বিড়ম্বিত জীবনের কাহিনি শুনেছি। রঘুপতি এর পর যাবে তার স্ত্রী-পুত্রকে খুঁজতে। শেষ কী হবে, আমি জানি না।

রশিদা খানমের চোখে অশ্রু এসে গেল। সে বলল, আহা, মানুষটা বড় দুঃখী। পরদেশি, আমার মন খারাপ, এর ওপর আপনি আমাকে আবার একটা দুঃখের গল্প শোনালেন কেন? আপনি কোনও মজাদার কিস্যা জানেন না?

সুরপতি বলল, আমি আর তো কিছু জানি না।

রশিদা খানম্ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনি ক্লান্ত, আপনি এখন বিশ্রাম করুন। কাল আবার কথা হবে। চল শের আলি।

সুরপতি বলল, আমি কাল প্রভাতেই এখান থেকে চলে যেতে চাই।

বিচিত্র হাস্য করে রশিদা খানম্ বলল, কেন, এখানে আপনার কোনও কষ্ট হচ্ছে?

সুরপতি বলল, না না, কষ্ট কী! এত খাতির-যত্ন আমি জীবনে পাইনি। কিন্তু কত দিন আর এই অকারণ আতিথ্য নেব আপনার কাছে?

রশিদা খানম বলল, আপনি পথিক, আপনার তো কোনও নির্দিষ্ট জায়গায়, নির্দিষ্ট সময় পোঁছনোর কথা নেই। সুতরাং ব্যস্ততা কীসের? মানুষ শুধু মৃত্যুর কাছেই পৌঁছয়।

কী বললেন?

সব মানুষ শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে পৌঁছয়। আর তো কোথাও তার পৌঁছবার কথা থাকেনা।

রশিদা খানম্ বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। সুরপতি অবাক হয়ে ভাবতে লাগল, ওর এই শেষ কথাটার মানে কী? হঠাৎ মৃত্যুর কথা কেন? একটা পূর্ণবয়স্ক বাঘকে শেকল বেঁধে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে রাখে। এ নারী অতি সাংঘাতিক। অথচ কত নরম, কত সুন্দর, নিষ্পাপ মুখ। এমন নারীর সন্দর্শনও ভাগ্যের কথা। মূর্খ ইউনুস একে ছেড়ে চলে গেছে কেন?

একটু পরে সুরপতি শুনল, বাড়ির ভেতর থেকে গান ভেসে আসছে। তয়ফাওয়ালি রশিদা খানম্ একা একা গলা সাধছে। ঠিক মনে হয়, কোনও বিরহী রাতপাখির ব্যাকুল চিৎকার।

সেই গান শুনতে শুনতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল সুরপতি। ঘুমের মধ্যে মানুষের স্মৃতিতে বহু রকমের খেলা চলে।

আবার খানিক পরে সুরপতির ঘুম ভাঙল। সে টের পেল তার মাথায় একটা কোমল হাতের স্পর্শ। সে অন্ধকারের মধ্যে হাত বাড়িয়ে ধরল সেই হাত। সত্যি কারও বাস্তব হাত।

সুরপতি জিজ্ঞেস করল, কে সুভদ্রা?

স্পষ্ট উত্তর শুনল, হ্যাঁ।

সুরপতি আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কোথায় গিয়েছিলে?

উত্তর এল, আমি তো এখানেই।

সুরপতি বলল, না, তুমি এখানে ছিলে না, তুমি হারিয়ে গিয়েছিলে। সুভদ্রা আমার মাথায় দারুণ যন্ত্রণা, আমি চোখ মেলতে পারছি না, তুমি আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিলে কেন?

উত্তর এল, আপনার মাথায় এখনও যন্ত্রণা আছে?

সুরপতি বলল, হ্যাঁ, দারুণ যন্ত্রণা, তুমি জানো না, ওরা আমাকে কী সাংঘাতিক ভাবে মেরেছে।

তুমি আর একটু ঘুমোও, সব ঠিক হয়ে যাবে। সুরপতি এখন ঘুমোবে কী, সুভদ্রাকে সে খুঁজে পেয়েছে, এই কি তার ঘুমোবার সময়?

সে ব্যস্তভাবে উঠে বসল।

সুরপতি দেখল, তার এক হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে তয়ফাওয়ালি রশিদা খান। রশিদার অন্য হাতে একটি দীপ। তার সুন্দর মুখখানি এখন ক্রোধে কঠিন।

সুরপতি বলল, এ কী!

রশিদা বলল, পরদেশি, সত্য করে বলো তুমি কে?

সুরপতি রশিদার এই রূপান্তরের কোনও কারণই বুঝতে পারল না। হঠাৎ মধ্যরাত্রে এই রূপসী রমণী তার শিয়রের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে কেন? উন্মাদ নয় তো?

সুরপতি বলল, আমি তো বলেইছি, আমি সামান্য একজন পথিক। আমার অন্য কোনও পরিচয় নেই।

রশিদা হিমশীতল কণ্ঠে আবার প্রশ্ন করল, তুমি আমার কোন সর্বনাশ করতে এখানে এসেছ?

সুরপতি বলল, বেগম, আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি আপনার সর্বনাশ করব কেন? আপনি আমার এত উপকার করছেন, আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।

সুরপতির হাতখানি আরও শক্ত করে ধরে, অন্য হাতের দীপটা কাছে এনে রশিদা জিজ্ঞেস করল, এই সবুজ পান্না বসানো অঙ্গুরীয় তুমি কোথায় পেলে?

সুরপতি চমকে উঠল। তৎক্ষণাৎ কোনও উত্তর দিতে পারল না।

রশিদা ক্রোধে চিৎকার করে বলল, চুপ করে রইলে কেন? বলো, কোথায় পেয়েছ? দুনিয়ায় এই অঙ্গুরীয় শুধু এক জনেরই হাতে থাকবার কথা।

সুরপতি নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল, আপনার নিশ্চয়ই কিছু ভুল হয়েছে। এ-রকম পান্না বসানো সাধারণ অঙ্গুরীয় অনেকেরই থাকতে পারে।

রশিদা বলল, সাধারণ! তোমার চক্ষু নেই? ভাল করে দেখো, এই সবুজ পাথরটির আকার একটি পদ্মফুলের মতো। এই পদ্মফুলটি আমার হৃদয়, তা আমি শুধু এক জনকেই দিয়েছিলাম। তুমি এটা কোথায় পেলে? বলল, সত্য করে বলো!

সুরপতি দেখল, পান্নাটির আকৃতি অনেকটা পদ্মফুলের মতোই বটে। আগে সেঠিক লক্ষ্য করেনি। এই অঙ্গুরীয় যে বিশেষ ভাবে নির্মিত, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

সে বিনীত ভাবে বলল, আমি দরিদ্র পথিক, এ জিনিস আমার নিজস্ব নয়, তা সত্য। আমার চলার পথে পড়ে ছিল, লোভ সম্বরণ করতে পারিনি, কুড়িয়ে নিয়েছি।

পথে পড়ে ছিল? কোথায়?

অবন্তীপুর ছাড়িয়ে, কানসোনা প্রান্তরের মধ্যে।

মিথ্যা কথা।

রশিদা গলা চড়িয়ে ডাকলো, বাঁদি বাঁদি!

বাঁদি এসে দ্বারের কাছে দাঁড়াল। রশিদা বলল, সেগুলো নিয়ে আয়।

বাঁদি প্রায় তৎক্ষণাৎ ফিরে এল। তার হাতে সুরপতির পরিত্যক্ত ভিজে পোশাক এবং একজোড়া নাগরা।

সুরপতির সর্বাঙ্গে শিহরণ বয়ে গেল। রশিদা জিজ্ঞেস করল, এসব কার? তোমার নয়।

সুরপতি বিস্ফারিত চক্ষে বলল, হ্যাঁ, আমার।

শঠ। মিথ্যুক! এ-সব তোমার? বাঁদি চিনতে পারেনি, কিন্তু আমি দেখামাত্র চিনেছি। এই পোশাক, এই নাগরা, এই অঙ্গুরীয় –এইসব ইউনুস খাঁর। তুমি তাকে নিয়ে কী করেছ?

সুরপতি একটি বিরাট দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কোন দুষ্ট শনি তাকে বার বার এমন বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে! স্বর্ণকারের কাছে কেন সে দুটি অঙ্গুরীয়ই বিক্রয় করে দেয়নি তখন? কেন সে নতুন বস্ত্র কিনে মৃতের বস্ত্র পরিত্যাগ করে আসেনি?

সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বেগম, আপনাকে আমি সব সত্য কথা বলব। আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে। কিন্তু আপনি মন শক্ত করুন। আমার সব কথা শুনলে আপনি আঘাত পাবেন খুব।

সুরপতি সংক্ষেপে তার পূর্ব ইতিহাস বর্ণনা করল। তারপর বলল, এক সময় আমার অনেক কিছুই ছিল, কিন্তু ভাগ্যদোষে সব হারিয়েছি। শেষ পর্যন্ত আমার এমন দশা হল যে পরনের বস্ত্রখানি পর্যন্ত ছিল না। মানুষের তাড়া খেয়ে আমি লোকালয় থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম শ্মশানে। এক সময় নিদ্রা ভেঙে দেখি, সেখানে একটি মৃতদেহ পড়ে আছে। একজন অতি সুপুরুষ যুবার দেহ। এখন বুঝতে পারছি সে-ই ইউনুস খা। যেহেতু মৃত ব্যক্তি কোনও সম্পত্তির মালিক হতে পারে না, সেই হেতু তার সম্পদ অন্য কেউ নিলে চুরি করা হয় না। আমি সর্বস্ব-বঞ্চিত, অসহায়, তাই মৃতের অঙ্গ থেকে তার বস্ত্র এবং অঙ্গুরীয় খুলে নিয়েছি। এটা আমি কিছু দোষের মনে করিনি। তারপর দৈবের কৌতুকে ঘুরতে ঘুরতে এসে আশ্রয় নিয়েছি আপনার গৃহে।

রশিদা বলল, ইউনুস খাঁ বেঁচে নেই?

তার সেই কণ্ঠস্বরে যেন নিখিল বিশ্বের হাহাকার ধ্বনিত হল। কম্পিত হল তার সারা দেহ। হাতের দীপ খসে পড়ল মাটিতে। বাঁদির কাঁধের ওপর মাথা লুটিয়ে সে কাঁদতে লাগল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।

সুরপতি কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

একটু পরে অশ্রুসিক্ত দুই চক্ষু তুলে রশিদা বলল, কিন্তু ইউনুস খাঁর শব হিন্দুর শ্মশানে পড়ে থাকবে কেন?

সুরপতি বলল, সে কথা আমি জানি না।

রশিদা ওড়নার প্রান্ত দিয়ে চক্ষু মুছে বলল, চলুন, আমাকে এখনি সেখানে নিয়ে চলুন। আমি নিজে তাকে বহন করে নিয়ে আসব। আমার চোখের জলে ধুইয়ে দেব তার শরীর। আমার এই দেহ হবে তার কাফ। আমরা এক সঙ্গে বেহস্ত-এ যাব।

সুরপতি আড়ষ্ট ভাবে বলল, ইউনুস খাঁর দেহ তো আর সেখানে নেই। শৃগাল-কুকুরে ছিঁড়ে খাবে এই ভয়ে আমি সেই দেহ নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছি।

মুসলমানের শব তুমি জলে ভাসিয়ে দিলে? মাটি খুড়ে কবরও দিতে পারোনি?

আমি তখন তো বুঝিনি।

এই সব তোমার ছলনা। তুমি অতি নিচ, শয়তান। তুমিই ওকে খুন করেছ। তুমি ওকে খুন করে সবকিছু কেড়ে নিয়েছ।

আপনি বিশ্বাস করুন আমি জীবনে কখনও কারুর ক্ষতি করিনি।

তোমাকে বিশ্বাস করব? তোমার এই অলীক কিস্যা দুনিয়ার কোন কাজি, কোন বিচারক বিশ্বাস করবে? তুমি হত্যাকারী।

সুরপতি সভয়ে নিজের বক্ষ চেপে ধরল। তার পোশাকের মধ্যে লুকোনো আছে সেই ছুরিকা। সেটা হঠাৎ দেখতে পেলে তো সন্দেহ আরও বদ্ধমূল হবে।

সুরপতির একবার ইচ্ছা হল, পোশাকের মধ্যে থেকে ছুরিকাটি নির্গত করে সেই রমণীদু’টিকে ভয় দেখায়। এই দুই রমণীকে পর্যুদস্ত করা মোটেই শক্ত কাজ নয়। তারপর সে এখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যাবে। এরা আর তাকে ধরতে পারবে না।

কিন্তু এই চিন্তাটা মনে আসা মাত্র দ্বারের বাইরে গম্ভীর গলায় ব্যাঘ্রনিনাদ শোনা গেল। সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠল সুরপতি। সাংঘাতিক এক দ্বাররক্ষী রয়েছে, সামান্য একটা ছুরিকা নিয়ে সে কী করবে?

রশিদা খানম্ সুরপতির চক্ষে স্থির দৃষ্টি রেখে বলল, আমি তো তোমার কোনও ক্ষতি করিনি। সুন্দর, নিষ্পাপ ইউনুসও তো তোমার কোনও ক্ষতি করেনি। তুমি তুমি আমাদের এই সর্বনাশ কেন করলে? আমরা দুজনে দুজনকে ভালবেসে এক আলাদা দুনিয়া গড়েছিলাম। ইউনুস আমার চোখের তারায় দেখত সারা আশমান, আমি তার চোখের তারায় দেখতাম অকুল দরিয়া, ইউনুসকে ভালবেসে আমি এই দুনিয়ার সবকিছু, এমনকী একটা পিঁপড়েকেও ভালোবাসতাম, সেই ইউনুসকে কেন তুমি আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিলে? কেন?

সুরপতিরও চোখে জল এসে গেল। সত্যিই যারা ইউনুসকে হত্যা করেছে, তারা মহা পাপিষ্ঠ। কিন্তু সে তো তার জন্য দায়ী নয়।

সে রশিদা খানমের হাত জড়িয়ে ধরে বলল, আপনি বিশ্বাস করুন, আমি হত্যাকারী নই, আমি এসবের কিছুই জানি না।

হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রশিদা খানম্ বলল, আমি ফৌজদারের কাছে নিয়ে গিয়ে তোমাকে ফাঁসিতে লটকাব। না না, তোমার সর্বাঙ্গ ছুরি দিয়ে চিবেলবণ মাখিয়ে দেব। না, তোমার দুই পায়ে শিকল বেঁধে বিপরীত ভাবে ঝুলিয়ে রাখব, তার চেয়েও ভাল, শের আলিকে তিন দিন অভুক্ত রেখে ছেড়ে দেব তোমার সামনে। ইউনুস, আমার ইউনুস।

রশিদা আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল বাঁদির কাঁধেব ওপর। বাঁদি তাকে ধরে আস্তে আস্তে নিয়ে গেল কক্ষের বাইরে।

পাথরের মূর্তির মতো সুরপতি দাঁড়িয়ে রইল ঘরের মাঝখানে।

সেইভাবে কেটে গেল দণ্ডপল। সুরপতি মাথার মধ্যে অসংখ্য চিন্তা ফেউয়ের মতো আছনে এসে পড়ছে। সে আর দিশা রাখতে পারছে না। কী কুক্ষণেই যে বৃষ্টি নেমেছিল। এই বাড়ির অলিন্দে আশ্রয় না নিলে এতক্ষণ সে চলে যেতঅনেক দূরে। সবই কুগ্রহ।

খানিকটা পরে সুরপতির ঘোর ভাঙল। এ-ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে তো চলবে না, একটা কিছু উপায় বার করতেই হবে। বাঁচতে তাকে হবেই, সে কিছুতেই হেরে যাবে না।

সে সন্তর্পণে দ্বারের কাছে এসে বাইরে উঁকি দিল। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেকক্ষণ, বাইরে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। সে দ্বারের বাইরে এক পা বাড়াতেই দেখতে পেল হলুদ আগুনের টুকরোর মতো দুটো চোখ। তারপর একটা চাপা গর্জন।

সুরপতি সঙ্গে সঙ্গে কক্ষের মধ্যে চলে এসে দ্বার রুদ্ধ করে দিল। বাইবে প্রহরী রয়েছে শের আলি। সুরপতির পলায়নের কোনও উপায় নেই।

কক্ষে রয়েছে দুটি গবাক্ষ। অনেক উঁচুতে। সেখানে সুরপতিরস্বত পৌঁছয় না। এই কক্ষটি একটি কারাগার। সেখানে সুরপতি আবার বন্দি। তবে এবারে প্রভেদ এই, তারশয়নের জন্য রয়েছে পালঙ্কের ওপর নরম সজ্জা, তার অঙ্গে বহুমূল্য পরিচ্ছদ, তার আহার্যের জন্য রয়েছে অনেক ফলমূল।

পালঙ্কের ওপর বসে আরও কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর সুরপতি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। নিদ্রা সমস্ত সন্তাপহারিণী। তাই ইচ্ছে করেই যেন সুরপতি নিদ্রার মধ্যে ডুবে যেতে লাগল অনেক অনেক গভীরে।

সুরপতির যখন ঘুমু ভাঙল, তখন প্রখর দিনের আলো এসে পড়েছে ঘরে।

প্রথমে সুরপতি মনেই করতে পারল না সে কোথায়। এ কার শয্যা? এ কার পোশাক তার শরীরে? তারপর সব মনে পড়ল। অমনি ভয়ে কেঁপে উঠল আবার।

দ্বার খোলার সাহস তার হল না। বাইরে নিশ্চয়ই শের আলি রয়েছে। এখান থেকে পালাবার উপায় কী?

কোনও উপায়ই মনে আসে না। কোনও একটি গবাক্ষ দিয়ে বাইরে বেরুবার চেষ্টা করা যেতে পারে, কিন্তু গবাক্ষ দুটিই এত ছোট যে, সেখান দিয়ে তার শরীর গলবে কিনা সন্দেহ।

পালঙ্কটা সরিয়ে সে নিয়ে গেল দেয়ালের ধারে। তার ওপর একটা কেদারা বসিয়ে তার ওপরে সুরপতি উঠে দাঁড়াল। সে ঠিকই সন্দেহ করেছিল, গবাক্ষ দিয়ে তার মাথা গলে না।

বাইরে দেখা যায় একটি মনোরম উদ্যান। সেখানে সাজি ভরে ফুল তুলছে এক রমণী। তার মুখ সুরপতি দেখতে পাচ্ছে না। সুরপতি এক দৃষ্টে চেয়ে রইল সে-দিকে।

একটু বাদে রমণীটি মুখ ফেরাতেই সুরপতি চমকে উঠল। রশিদা খান। কিন্তু তার মুখ এখন প্রফুল্ল হাস্যময়, সদ্য স্নানসিক্ত চুল, তাকে পবিত্র সুন্দর দেখাচ্ছে। সে গুন গুন করে গাইছে একটি গান।

সুরপতির সব কিছু অবিশ্বাস্য মনে হল। কাল যে রশিদা খানম্ অমন কান্নায় ভেঙে পড়েছিল, প্রিয়জনের বিচ্ছেদবেদনায় রিক্ত হয়ে গিয়েছিল, এক রাত্রির মধ্যে তার এতখানি রূপান্তর সম্ভব? এখন সে স্নান করে সেজেগুঁজে বাগানে এসে ফুল তুলতে তুলতে গান গাইছে? তাহলে কি কাল রাত্রির সব কিছুই অলীক? একটা দুঃস্বপ্ন?

এক সময় রশিদা খানমের সঙ্গে তার চোখাচোখি হয়ে গেল। সুরপতি চেঁচিয়ে বলল, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আমি অপরাধী নই। আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন।

গভীর বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে রইল রশিদা খান।

সুরপতি ওই একই কথা আবার বলল।

এবার রশিদা বলল, কে আপনি?

আমি সুরপতি।

কে সুরপতি?

আমি এক জন পথিক। কাল রাত্রে আমি…।

আপনি এখানে কী করে এলেন?

সুরপতি ভাবল, রশিদা খানম্ কি উন্মাদিনী? এখন তাকে চিনতেই পারছে না? অথবা শোকে দুঃখে ওর মস্তিষ্কে বিকার দেখা দিয়েছে?

রশিদা খানম্ এগিয়ে এল গবাক্ষর দিকে। তারপর নদীর বাঁকের মতো ভুরু দুটি তুলে বলল, এমন সকালবেলা আপনি চিৎকার করে ক্ষমা চাইছেন কেন? ক্ষমা কি কেউ মানুষের কাছে চায়? ক্ষমা চাইতে হয় খোদাতাল্লার কাছে।

সুরপতি বলল, আমি নিরপরাধ। আমি এখান থেকে মুক্তি চাই। একমাত্র আপনিই আমাকে মুক্তি দিতে পারেন।

রশিদা খান বলল, কে আপনাকে আবদ্ধ করে রেখেছে? বাইরে আসুন।

বাইরে শের আলি রয়েছে।

রশিদা খানম চুৰ্ণ হাসিতে ভেঙে পড়ল। হাসতে হাসতে বলল, আপনি শের আলিকে ভয় পান? ও তো একটা বিড়াল।

রশিদা খান সরে গেল সেখান থেকে। একটু পরেই দ্বারে শব্দ হল। সুরপতি সভয়ে দ্বার খুলে সরে দাঁড়াল দেওয়ালের পাশে।

দ্বার খোলার সঙ্গে সঙ্গে গর্জন করে উঠল শের আলি, কিন্তু ভিতরে এল না। কিন্তু তার বদলে এল রশিদা খান। আজ সকালে তার রূপ যেন আরও ফেটে পড়ছে। গভীর কালোকুঞ্চিত কেশরাশির মধ্যে তার গৌরবর্ণ মুখখানি যেন একটি দুর্লভ ফুল। দেখা মাত্র যার ঘ্রাণ নিতে ইচ্ছে হয়।

রশিদা খানম্ জিজ্ঞেস করল, কে তুমি?

সুরপতি দীন কণ্ঠে বলল, আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না? কাল রাত্রে আপনি আমাকে–।

রশিদা খানম্ আর একটু এগিয়ে এসে বলল, কাল আমি সন্ধ্যা থেকেই ঘুমিয়ে ছিলাম। আমি কিছুই জানি না। আপনার মুখে এত দাড়ি কেন? আপনি কি ছদ্মবেশ ধারণ করেছেন?

আমি নিতান্ত এক অভাজন। এই রকমই আমার বেশ।

আপনার অঙ্গে ইউনুস খাঁর পোশাক, অথচ মুখে দাড়ি। কিন্তু আপনি ইউনুস খাঁ নন, সে আপনার চেয়ে একটু খর্বকায়। আপনিও তো বেশ সুপুরুষ, বলিষ্ঠ দুটি হাত, প্রশস্ত বুক–এমন এক জন পুরুষ গৃহে এসেছে, অথচ আমি তা জানি না!

আপনার কিছুই মনে নেই?

কী মনে থাকবে?

আপনি আমাকে ভুল সন্দেহ করেছিলেন।

না না, আপনাকে আমি সন্দেহ করব কেন? আপনার মুখসুন্দর, চোখ সুন্দর, কথা সুন্দর–এমন মানুষকে কেউ সন্দেহ করে?

এমন সময় দ্বারের পাশে বাঁদি এসে ডাকল, বিবিসাহেবা?

রশিদা খানম্ মুখ ফিরিয়ে বলল, বাঁদী, এই মানুষটা কে রে?

বাঁদি বলল, ও কেউ নয়। আপনি ওপরে চলুন।

কেউ নয় কী রে? একটা জ্যান্ত মানুষকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, আর তুই বলছিস কেউ নয়?

আপনি ওপরে চলুন। মালিকানি আপনাকে ডাকছেন।

যাচ্ছি, যাচ্ছি। এই মানুষটা কে বল না? এই মানুষটাকে আমাকে দিবি? এই বলিষ্ঠ মানুষটাকে আমার চাই।

বাঁদি এসে তার হাত ধরে বকুনি দিয়ে বলল, শিগগির ওপরে চলুন। নইলে মালিকানি খুব রাগ করবেন।

বাঁদি প্রায় জোর করেই তাকে টেনে নিয়ে চলে গেল।

বিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সুরপতি। রশিদা খানম্ কি সত্যি গত রাত্রের সব কথা ভুলে গেছে? এ কখনও সম্ভব? বাঁদিই-বা ওকে জোর করে টেনে নিয়ে গেল কেন? মালিকানি আবার কে? কাল তো রশিদা খানম কেই মালিকানি বলেছিল বাঁদি!

একটু পরেই বাঁদি ফিরে এল এক বিচিত্র ভাবে হেসে সে বলল, শেঠ, খুব ধন্ধে পড়েছেন তো?

সুরপতি তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলল, তুমি আমাকে বাঁচাও। আমি তোমার ক্রীতদাস হয়ে থাকব।

বাঁদি বলল, আপনি ইউনুস খাঁকে হত্যা করেও এ গৃহ থেকে বেঁচে ফিরে যাবেন, তা কখনও হয়?

তুমি বিশ্বাস করো, আমি খুন করিনি। কেন আমি তাকে খুন করব, তার ওপর কি আমার কোনও রাগ আছে? আমি তো তাকে চিনিই না।

তাহলে ইউনুস খাঁর পোশাক আর অঙ্গুরীয় আপনার কাছে এল কী করে?

এগুলি আমি ইউনুস খাঁর শরীর থেকে খুলে নিয়েছি ঠিকই, কিন্তু তার আগেই কেউ তাকে খুন করেছিল। কে খুন করেছে আমি জানি না।

আপনার মিথ্যা কাহিনিও এত দুর্বল!

মিথ্যা নয়। তুমি বিশ্বাস করো, আমি যে-কোনও শপথ নিয়ে বলতে পারি।

আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কী আসে যায়!

রশিদা খানম্ তো সব কথা ভুলে গেছেন।

ও, আপনি বুঝি তাই ভেবেছেন? একটু আগে যে এসেছিল সেরশিদা খানম্নয়। আপনি চিনতে পারলেন না?

নিশ্চয়ই রশিদা খানম্! তাছাড়া আর কে?

এর বাম গণ্ডে একটা তিল ছিল দেখেননি? আমাদের মালিকানির শরীরে কোনও তিল নেই।

তিল? তিল আছে কি না আছে তা তো দেখিনি।

এঁর নাম রেশমি বিবি। রশিদা খানমের যমজ বোন। অনেক দিন থেকেই এর মাথার ঠিক নেই।

সুরপতি মাথায় হাত দিয়ে পালঙ্কে বসে পড়ল। এ কী অদ্ভুত কথা! মানুষে মানুষে এমন মিল হয়! এর কথা শুনে তো একে একটুও উন্মাদিনী মনে হল না।

বাঁদি আবার বলল, শেঠ, আপনাকে আমি সাবধান করে দিতে এসেছি। আপনি শের আলিকে ভয় পান, কিন্তু এই রেশমি বিবি বাঘিনীর চেয়েও সাংঘাতিক। পুরুষমানুষকে গিলে খায়। দেখবেন, ইনি আবার সুযোগ পেলেই এসে আপনাকে শাদি করতে চাইবেন।

সুরপতি বলল, আমি শাদি করব কী করে? আমার নিজের স্ত্রী আছে।

কথার মধ্যে সুরপতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর অনেকটা আপন মনেই বলল, আমার স্ত্রী ছিল, পুত্র ছিল, এখন কোথায় আছে জানি না। তাদের সন্ধানেই যেতে চাই।

শেঠ, তবুআপনাকে সাবধান করে দিলাম। রেশমি বিবিকে এমনিতে দেখে কিছু বোঝা যায় না, কিন্তু হঠাৎ যখন খেপে ওঠেন তখন কী যে সাংঘাতিক নিষ্ঠুর হন তা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না।

বাঁদি চলে গেল। সুরপতি আবার দ্বার বন্ধ করে বসে রইল একা। বেলা বাড়তে লাগল আপন মনে। বাইরে মাঝে মাঝে শের আলির ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা যায়। ওকে বোধহয় খাদ্য দেওয়া হয়নি। এই রকম তিন দিন ওকে ক্ষুধার্ত রাখা হবে, তারপর সুরপতিকে ওর সামনে…। দ্বার বন্ধ থাকলেও কি ওরা জোর করে ভেঙে ফেলবে দ্বার?

দিনের পর রাত এল। তারপর যখন রাত বেশ গভীর, সেই সময় তার দ্বারে শোনা গেল টকটক শব্দ। এ শব্দ শের আলির নয়, কোনও মানুষের।

সুরপতি প্রথমে ভাবল, দ্বার খুলবেনা। কিন্তু শব্দ হতেই লাগল। সেই শব্দের মধ্যে যেন একটা ব্যাকুল আহ্বান আছে। শুধু শুধু বসে থেকেই-বা লাভ কী! সুরপতি উঠে গিয়ে দ্বার খুলে দিল।

দ্বারের বাইরে দীপ হাতে এক সুন্দর রমণী। এ কে? রশিদা খান, না রেশমি বিবি?

সুরপতি জিজ্ঞেস করল, কে আপনি?

রমণী মৃদু হেসে বলল, আমাকে চিনতে পারছ না? আমি রশিদা খান।

সুরপতি, আমি তোমাকে মুক্তি দিতে এসেছি।

ঠিক সেই সময় সুরপতি সেই রমণীর বাম গণ্ডে একটা বড় তিল দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে সে পিছিয়ে এসে বলল, মিথ্যে কথা, আপনি রেশমি বিবি।

রমণী আরও বেশি হাসিতে মুখখানা ভরিয়ে বলল, বাঁদি তোমাকে ভুল কথা বলেছে। বাম গণ্ডে তিল আছে রশিদা খানমের, রেশমি বিবির শরীরে কোনও তিল নেই। তুমি কি আজ সকালে তার গণ্ডে তিল দেখেছিলে?

সুরপতি একেবারে দিশেহারা হয়ে গেল। এরা কী সত্যিই দুই বোন? নাকি এক জনই এক-এক বার এক-এক নাম নিয়ে আসছে? বাঁদিইইচ্ছে করে তাকে ভুল বুঝিয়েছে? এরকম বেশিক্ষণ চললে সুরপতি নিজেই উন্মাদ হয়ে যাবে। এরা কি তাকে অত্যাচার করার এই নতুন কৌশল আবিষ্কার করেছে?

সে নতজানু হয়ে বলল, আপনারা আমাকে নিয়ে কী করতে চান? যদি মারতে চান, এক্ষুনি মেরে ফেলুন।

রমণী এগিয়ে এসে সুরপতির হাত ধরে কোমল কণ্ঠে বলল, ওঠো সুরপতি, তোমার কোনও ভয় নেই। মিথ্যা বলবনা, আমি রশিদা খানমনই, আমি রেশমি বিবি। তুমি আমার সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছ তো! আমি উন্মাদিনী, আমি বাঘিনীর চেয়েও সাংঘাতিক, আমি তোমাকে শাদি করতে চাইব –এ-সব শোনোনি? আমার মুখের দিকে চেয়ে সত্যি কথা বলো তো, আমাকে এ-রকম সাংঘাতিক মনে হয়?

সুরপতি নিঃশব্দে দু’দিকে মাথা নেড়ে জানাল, না।

এটা তার সত্য অনুভূতি। রেশমি বিবিকে দেখে কিছুতেই ভয়ঙ্করি মনে হয় না। নিষ্পাপ সরল মুখ। মস্তিষ্ক বিকৃতির কোনও লক্ষণই নেই। বাঁদি এর নামে মিথ্যা অপবাদ দিতে পারে অনায়োস।

রেশমি বিবি বলল, পাছে লোকজনের কাছে নিজের কদর কমে যায়, তাই আমার বোন রশিদা খান আমাকে বাইরে যেতে দেয় না। লোকসমাজে রটিয়ে দিয়েছে আমার মস্তিষ্ক ঠিক নেই।

সুরপতি চুপ করে রইল।

হঠাৎ রেশমি বিবির চোখ সজল হয়ে এল। কম্পিত স্বরে বলল, ওরা রটনা করে, সুন্দর চেহারার পুরুষমানুষ দেখলেই আমি তাকে প্রলোভন দেখিয়ে শাদি করতে চাই। তারপর তাকে মেরে ফেলি। এ যে কত বড় মিথ্যা! পরদেশি, তোমাকে আমি সত্য কথা বলি আমি খুব ভালভাবেই জানি, কোনও দিন কোনও পুরুষ আমাকে গ্রহণ করবে না। আমাকে সম্পূর্ণভাবে দেখলেই ঘৃণায় দূরে সরে যাবে।

সুরপতি বিস্মিত ভাবে বলল, ঘৃণা! এমন রূপসী রমণীকে কেউ ঘৃণা করতে পারে? আপনাকে দেখলে তো সন্ন্যাসীরও চিত্তবিচলিত হবে।

রেশমি বিবিবলল, না, আমি রূপসীনই। আমি কুৎসিত। অনেক সময় কোনও বান্দবিকেও সুন্দর পোশাকে মুড়ে রাখলে ভাল দেখায়। আমি হচ্ছি সেই রকম। তুমি দেখবে?

রেশমি বিবি একটানে তার বুকের বসন উন্মুক্ত করে ফেলল। সুরপতি লজ্জায় চোখ ফিরিয়ে নিতে যাচ্ছিল, কিন্তু এক পলক দেখেই তার চক্ষু স্থির হয়ে গেল। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, এ কী।

রেশমি বিবির অনাবৃত বুকের ঠিক মাঝখানে পূর্ণচন্দ্রের আকারের একটা গোল কালো দাগ। তার সুগঠিত বর্তুল দুই স্তনও কালো। রেশমী বিবির সর্বাঙ্গ অত্যন্ত ফর্সা, মাঝখানে এই কালো দাগ হঠাৎ ভয় পাইয়ে দেয়।

সুরপতি চোখ সরাতে পারল না। স্থির দৃষ্টিতে সে-দিকে চেয়ে রইল। অস্ফুট স্বরে বলল, এমন কখনও দেখিনি।

রেশমী বিবি বলল, এবার আমাকে ঘৃণা হচ্ছে তো?

সুরপতি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, না না, ঘৃণা নয়। আপনি তবু সুন্দরী, এ-রকম কখনও দেখিনি, তবু মনে হচ্ছে এতে আপনার রূপ অনেক বেড়ে গেছে, পৃথিবীতে আপনার মতো আর কেউ নেই, কিন্তু এরকম কী করে হল?

রেশমি বিবি নিজের বক্ষে হাত রেখে বলল, আসমান থেকে অভিশাপ এসেছিল, আজ থেকে আট বছর আগে, সন্ধ্যাবেলা আমি একটা গোলাপবাগে একা দাঁড়িয়েছিলাম, চাঁদের আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছিল, এমন সময় কে যেন আমার নাম ধরে ডাকল। আমি চমকে উঠে বললাম, কে? চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম কোথাও কেউ নেই। তবে কে ডাকল আমাকে? স্পষ্ট শুনেছিলাম। আমার সে-দিন খুব মন খারাপ ছিল, আমি এক জন সঙ্গী চাইছিলাম, কেউ আসেনি আমার কাছে। মনে হল, কেউ যেন আমাকে দেখছে। চারদিকে কেউ নেই, তবু যেন আসমান থেকে কেউ দেখছে আমাকে এক দৃষ্টে। আমি আসমানের দিকে চেয়ে রইলাম। বললাম, তুমি কে? এসো এসো। কেউ এল না। হঠাৎ আশমানে প্রচণ্ড শব্দ হল আর একটা বিজলি হানল। আমি খুব জোরে কেঁপেউঠেস্থির হয়ে গেলাম, মনে হল আমি মরে গেছি। তুমি বাজে-পোড়া গাছ দেখেছ? আমি ঠিক সেই রকম দাঁড়িয়ে রইলাম প্রহরের পর প্রহর। সকালবেলা লোকজন এসে আমাকে ধরে নিয়ে যায়। আমি মরিনি, বিজলিতে আমার বুক পুড়িয়ে দিয়ে গেছে, তবু আমি মরিনি। সেদিনই আমি বুঝেছিলাম, আমি খোদাতাল্লার না-পসন্দ, কোনও পুরুষমানুষও আমাকে চাইবেনা। সবাই আমাকে ঘৃণা করবে।

সুরপতি বলল, কেউ আপনাকে ঘৃণা করবে না। যে-কোনও পুরুষমানুষ আপনাকে মাথায় করে রাখবে।

রেশমি বিবি আরও কাছে এগিয়ে এসে ব্যগ্র ভাবে বলল, তুমি– তুমি? তুমি আমাকে ঘৃণা করবে না?

সুরপতি বলল, আপনি এত সুন্দর, আপনি সকলের চেয়ে সুন্দর।

রশিদা খানমের থেকেও?

হ্যাঁ। আপনার মতো আর কেউ নেই।

প্রমাণ দাও, তুমি আমার বুকে হাত রাখো, দেখি তোমার ঘৃণা হয় কি না।

বিবিসাহেবা, আমি একজন সামান্য মানুষ।

প্রমাণ দাও?

সুরপতি তার কম্পিত হাত রেশমি বিবির বুকে রাখল। কী নরম, কী স্নিগ্ধ।

আঃ কী শান্তি। আমার যে হৃদয় পুড়েছে তা কেউ দেখেনি। তুমিই শুধু দেখলে। তুমি মহান।

তারপর রেশমি বিবি সুরপতির হাত চেপে ধরে বলল, চলো, তুমি আর আমি এখান থেকে পালিয়ে যাই।

কোথায়?

যে-দিকদুচোখ যায়। তুমি আমি কোনও নির্জন বনের মধ্যে একঝরনার ধারে থাকব। আমাদের আর কেউ দেখবে না। শুধু তোমার জন্য আমি আর আমার জন্য তুমি। চলল, এখনি চলল।

সুরপতি নিজে যে বিবাহিত, তার যে প্রিয়তমা পত্নী আছে, সেকথা এই সময় তার মনে এল না। পলায়নের চিন্তায় সে উত্তেজিত হয়ে উঠল। কাক্ষর পাইরে পা দিতে গিয়েও সে বলল, কিন্তু শের আলি যে পাহারায় আছে।

রেশমি বিবি অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, ও কিছু করবে না। ও আমার হুকুম শোনো।

দু’জনে পা টিপে টিপে বেরিয়ে এল অলিন্দে। শের আলি সেখানে নেই। সমস্ত গৃহটি নিস্তব্ধ। প্রাঙ্গণ পার হয়ে ওরা বাইরের দিকে আসতেই দেখল মূল দ্বারের কাছে দুটি চক্ষু জ্বলছে। চাপা গর্জন করে শের আলি ছুটে এল সে-দিকে।

শের আলি সুরপতিরওপরে ঠিকঝাঁপিয়ে পড়ত, তার আগেই রেশমি বিবি এসে পড়ল মাঝখানে।

শের আলিকে দু’হাত ধরে ফেলে সে বলল, যা, এখন যা।

শের আলি রেশমি বিবির গায়ে মাথা ঘষতে লাগল।

রেশমি বিবি বলল, তুমি দ্বার খুলে ফেলে বাইরে দাঁড়াও, আমি আসছি।

রেশমি বিবি শের আলিকে আদর করে বলল, যা যা, ভেতরে যা! এ আমার দোস্ত, একে কিছু বলবিনা।

শের আলিকে নিরস্ত করে রেশমি বিবি যেই দ্বার পেরিয়ে পথের ওপর এসেছে, অমনি শের আলি লাফ দিয়ে দ্বার ডিঙিয়ে পথের ওপর এসে পড়লল। সে সুরপতিকে আক্রমণ করার আগেই রেশমি বিবি আবার তার মুখ ধরে ফেলে বলল, তোকে যেতে বললাম না! যা, যা–আচ্ছা, তোকে আদর করে দিচ্ছি।

রেশমি বিবি মুচকি হেসে বলল, তোমার সঙ্গে যাচ্ছিকিনা, তাই ওরঈর্ষা হয়েছে। ও আমাকে খুব ভালবাসে।

তারপর সে শের আলির মুখ চুম্বন করল, দু’হাতে আদর করতে লাগল তাকে। সেই হিংস্র ব্যাঘ্রও নখ গুটিয়ে নিয়ে তার থাবা বোলাতে লাগল রেশমি বিবির সর্বাঙ্গে। রেশমি বিবি খল খল করে হাসতে লাগল। একবার সে মুখ তুলে সুরপতির দিকে তাকিয়ে বলল, কী, তোমার আবার ঈর্ষা হচ্ছে না তো?

সুরপতি উত্তর দেবেকী, তার সমস্ত অনুভূতি যেন অসাড় হয়ে গেছে। এ-রকম কাণ্ড সে কখনও দেখেনি। ব্যাঘ্র ও মানবী সম্পূর্ণ প্রণয়লীলা চালাচ্ছে।

একটু পরে রেশমি বিবি উঠে দাঁড়িয়ে পোশাকের ধুলো ঝেড়ে শের আলির মুখে এক চাপড় মেরে বলল, এবার যা!

শের আলি এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে সুরপতির দিকে। সেখাবে না। সেই চাহনি দেখে সুরপতির রক্ত-চলাচল থেমে যাবার উপক্রম হল। এই ব্যাঘ্র তাকে নিষ্কৃতি দেবে না।

রেশমি বিবি বলল, আমি কখনও কখনও ওর পৃষ্ঠে চড়ে বেড়াতে যাই তো, তাই ও অপেক্ষা করছে। আজ যাবেনা রে, আজ তুই ফিরে যা। আচ্ছা, এই একর বসছি। তারপর ফিরে যাবি তো?

শের আলি, আমি আমার দুলহ পেয়ে গেছি, আর কোনও দিন তোর সঙ্গে যাবনা!

রেশমি বিবি ব্যাঘ্রের পৃষ্ঠে চেপে বসল। তার কাঁধের কাছে চাপড় মেরে বলল, এবার হয়েছে তো? এই শেষ বার।

শের আলি সুরপতির দিকে তাকিয়ে একবার চাপা গর্জন করল, তারপর বিরাট লম্ফ দিল সামনে দিকে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটল। রেশমি বিবিকে পৃষ্ঠে নিয়ে সে প্রায় কয়েক পলকের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। মাত্র দু-একবার রেশমি বিবির কণ্ঠ শোনা গেল, থাম, থাম–তারপর মিলিয়ে গেল শব্দ।

সুরপতি বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল একটুক্ষণ। কোথায় গেল? কখন আসবে? সুরপতি কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে? কতক্ষণ?

কিন্তু মুক্তির চিন্তায় সুরপতির আবার চেতনা ফিরে এল। সে এখন মুক্ত, স্বাধীন। সে এখন যেখানে খুশি যেতে পারে। গৃহের দ্বি-তলের একটি গবাক্ষ খুলে গেল না?

আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে সুরপতি সামনে দিকে ছুটল। একবার সে ভেবেছিল, কিছুদুর গিয়ে বোধহয় রেশমি বিবির দেখা পাবে। কিন্তু কোথাও কোনও চিহ্ন নেই।

বেশ কিছু দূর আসবার পর সুরপতি দেখল পথটা দু’ভাগ হয়ে গেছে। একটা পথ গেছে বনের দিকে, অন্যটি নগরে। রেশমি বিবিকে নিয়ে কোন দিকে গেছে শের আলি? বনের প্রাণী নিশ্চয়ই বনের দিকেই যাবে। সুরপতি কি বনের মধ্যে দিয়ে রেশমি বিবিকে খুঁজবে? কিন্তু শের আলির হিংস্র চোখ দু’টির কথা মনে পড়তেই তার বুকে কেঁপে উঠল। সে বুঝতে পারল, শের আলি কিছুতেই রেশমি বিবিকে তার সঙ্গে যেতে দেবে না।

সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অস্ফুট স্বরে বলল, বিদায় রেশমি বিবি।

তারপর নগরের দিকে ছুটল প্রচণ্ড জোরে, অন্ধের মতো। মুক্তির আনন্দ তার পায়ে অনেক দ্রুত গতি এনে দিয়েছে। তবু অন্ধকাবের মধ্যে সে আচমকা ধাক্কা খেয়ে একবার পথের ওপর লুটিয়ে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারাল।

এক প্রহর বাদে ক্ষীণভাবে জ্ঞান ফিরে এল সুরপতির। এবারও তার মনে হল, কে যেন তার মাথা কোলে নিয়ে বসে আছে। তার চুলের মধ্যে কার যেন নরম হাত। তবে কি রেশমি বিবি ফিরে এসেছে? শের আলিকে ত্যাগ করে আবার খুঁজে পেয়েছে তাকে?

সুরপতি জিজ্ঞেস করল, কে, রেশমি বিবি?

উত্তর এল, না, আমি সুভদ্রা।

সুভদ্রা! সুরপতি অমনি সর্বশক্তি দিয়ে উঠল কিন্তু কোথায় সুভদ্রা? সুভদ্রাও নেই, রেশমি বিবিও নেই। সে পথের ওপর একলা পড়ে আছে।

<

Sunil Gangapadhyay।। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়