ঘড়িটা বুঝি ঠিকমত চলিতেছে না। দুইটা-কুড়িতে কলিকাতার ট্রেন আসিবে। সেই গাড়িতেই প্রদীপের ফিরিবার কথা। আসিয়া পৌঁছিলে হয়?

অরুণা স্বামীর মুখের দিকে তাকাইয়া কহিলেন, “ষ্টেশনে গাড়ি থাকবে ত’?”

স্বামী ঘরের মধ্যে অস্থির হইয়া পাইচারি করিয়া বেড়াইতেছিলেন, স্ত্রীর কথায় একটু থামিয়া একটা শোকাতুর দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া শুধু কহিলেন,—“আর গাড়ি!”

সেই স্তব্ধ-স্তম্ভিত ঘরে কথার অর্থটা স্পষ্ট হইয়া উঠিল। বাবোটা বাজিয়া ঘড়ির ছোট কাটাটা যেন আটকাইয়া গেছে,—সুধীর জীবনে দুইটা-কুড়ি বুঝি আর বাজিল না! প্রদীপের ফিরিয়া আসিবার আগেই প্রদীপ নিভিবে।

আকাশ ভরিয়া তারা জাগিয়াছে, কোটি কোটি জগৎ, কোটি কোটি জীবন! সমস্ত আকাশ ব্যাপিয়া কি বিস্তীর্ণ পথ, কি অপরিমেয় ভবিষ্যৎ! অবনী বাবু জানালা দিয়া বাহিরে চাহিলেন; রাস্তায় দূরে বাতি-থামের উপর একটা লণ্ঠন জ্বলিতেছে শুধু। সুষুপ্ত, প্রশান্ত রাত্রি।

ঘর ঠাণ্ডা রাখিবার জন্য সুধী-র শিয়রের কাছাকাছি পিলসুজের উপর মাটির বাতি জ্বালানো। সুধী বুঝি একটু চোখ চাহিল। অরুণা তাড়াতাড়ি ছেলের আরো নিকটে ঘেঁষিয়া আসিতে-আসিতে স্বামীকে কহিলেন,—“সলতেটা একটু বাড়িয়ে দাও শিগগির। সুধী কি যেন চাইছে।”

তারপর ছেলের আর্ত মলিন মুখের কাছে মুখ আনিয়া কোমলতর কণ্ঠে ডাকিলেন,—“সুধী, বাবা, কিছু বলবে?”

সুধী নিঃশব্দতার অপার সমুদ্রে ডুবিতেছে; জিহ্বায় ভাষা আসিল না,—দুৰ্বল ডান-হাতখানা মা’র কোলের কাছে একটু প্রসারিত করিয়া দিয়া কি যেন ধরিতে চাহিল।

অরুণা কহিলেন,—“এ পাশে একটু সরে এস বৌমা, সুধী বুঝি তোমাকে খুঁজছে।”

নমিতা স্বামীর পায়ের কাছে চুপ করিয়া বসিয়া ছিল,—গভীর রাত্রির যে একটি প্রশান্তিপূর্ণ অনুচ্চারিত বাণী আছে, নমিতা তাহারই আকারময়ী। শাশুড়ির কথা শুনিয়া নমিতা নূতনেত্রে কাছে আসিয়া আঁড়াইতেই অরুণা কহিলেন,—“এ-সময়ে আর লোকলজ্জা নয় মা, তোমার ঘোম্‌টা ফেলে দাও! সুধী! মিতা, তোর মিতা—এই দ্যাখ, কিছু বলবি তাকে?”

সুধী বোধ হয় একটু চেষ্টা করিল, কিন্তু চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ করিতে পারিল না।

ঘরভরা লোকজনের মধ্যেই নমিতা অবগুণ্ঠন অপসৃত করিয়া সজল চোখে স্বামীর বিবর্ণ মুখের দিকে চাহিয়া রহিল,–“কেহ না থাকিলে হয়ত সকল লজ্জায় জলাঞ্জলি দিয়া অনেক কথা কহিত, হয়ত একবার বলিত : “আমাকে ছাড়িয়া কোথায় যাইতেছ, কত দূরে? সেখানে কাহাকে সঙ্গী পাইবে? তুমি আমাকে ভুলিয়া থাকিয়, কিন্তু আমি তোমাকে ভুলিয়া থাকিব কি করিয়া?”

অরুণা নমিতাকে সুধীর পাশে বসাইয়া দিয়া তাহার ব্রীড়াকুণ্ঠিত করতলে মুমূর্ষু সন্তানের শিথিল হাতখানি অৰ্পণ করিলেন। নমিতা দেখিল হাতখানি ঠাণ্ডা, যেন অব্যক্ত স্নেহে সিক্ত হইয়া আছে! মনে পড়িল, মাত্র সাত মাস আগে এই হাতখানিরই কুলায়ে ভীরু পক্ষীশিশুর মত তাহার দুর্বল কমনীয় হাতখানি রাখিয়া, এক উজ্জ্বল দীপালোকিত সহস্রকলহাস্যমুখর উৎসব-সভায় সে সর্বাঙ্গে প্রথম পুলকসঞ্চার অনুভব করিয়াছিল। আজো বুঝি তাহাদের নূতন করিয়া বিবাহ হইতেছে। নমিতার আজ নববধুর বেশ—সে আকাশচারী মৃত্যু—প্রতীক্ষামগ্ন দুই চক্ষু মেলিয়া স্বামীর শয্যাপাশ্বে আসিয়া বসিয়াছে। তোমরা উলু দিতেছ না কেন? আলো নিভাইয়া দাও, রাত্রির এই প্রগাঢ়-প্রচুর, অন্ধকারকে অবিনশ্বর করিয়া রাখ!

মৃত্যু আসিতেছে, ধীরে, অতিনিঃশব্দপদে—নিস্তরঙ্গ নদীর উপরে প্রশান্ত গোধুলির মত! কেহ কথা কহিয়ো না, মৃত্যুর মৃদুপদপাত শুনিবার আশায় নিশ্বাস রোধ করিয়া থাক!

অবনীনাথ হেঁচাইয়া উঠিলেন : “জানলাটা খুলে দাও শিয়রের, পথ আটকে রেখ না।”

কে একজন শিয়রের জানালা খুলিয়া দিল। আরেকজন কহিল,—“আপনি অত অস্থির হবেন না মেলোমশাই।”

অবনীনাথ চলিতে-চলিতে হঠাৎ থামিলেন : “পাগল! অস্থির আর হ’তে পারি কই, সত্য! আমাদের শরীর এমন সব স্নায়ু দিয়ে তৈরি যে অস্থির সে হতেই শেখেনি। আমরা ত’ অর আগ্নেয়গিরি নই!” দুই-পা হাঁটিয়া আবার দাঁড়াইলেন : “শুনেছি ভগবান যোগে বসে আছেন সমাহিত হয়ে, আর প্রকৃতি রাজ্য চালাচ্ছেন; বিধাতাকে আমি দুষবো না। আমি স্থির, হয়ত ভগবানেরই মতো। আমি ভাবছি ছেলে মরেছে বলে আমি বড় জোর একদিন কোর্ট কামাই কতে পাব —আমাকে একটা সাত-লাখ টাকার মোকদ্দমার রায় লিখতে হবে। আমি ভাবছি, পশু আমার লাইফ-ইসিয়োরেন্স-এর প্রিমিয়াম পাঠাবার শেষ তারিখ। আমার কি অস্থির হওয়া চলে?”

মধ্যরাত্রির মুহূর্তগুলি মন্থর হইয়া আসিয়াছে,—এত নিঃশব্দতা বুঝি সহিবে না। আত্মীয়-পরিজনের অন্ত নাই,—সবাই প্রশস্ত ঘরে রোগীর পরিচর্যায় নিযুক্ত। এখন সবাই সেবাশুশ্রুষা পরিত্যাগ করিয়া রোগীকে ঘিরিয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছে—শেষনিশ্বাস-পতনের প্রতীক্ষায়। পরিবারের শিশুগুলি অন্য ঘরে দাসীর তত্ত্বাবধানে রহিয়াছে,–কেহ ঘুমাইয়া পড়িয়া গত রাত্রে শোনা পথিক-রাজপুত্রের স্বপ্ন দেখিতেছে, কেহ বা বসিয়া আপন আপন মা’র কথামত অর্থহীন অসম্পূর্ণ ভাষায় অচেনা ভগবানের কাছে অসম্ভব প্রার্থনা করিতেছে। সমস্ত ঘরে সুগভীর শান্তি বিরাজমান। অবনী বাবুর লঘু পদশব্দ ছাড়া কোথা হইতেও একটি অস্ফুট কোলাহল হইতেছে না। সৃষ্টি যেন গতিবেগ রুদ্ধ করিয়া একটু দাঁড়াইয়াছে!

এইটি সুধী-র পড়িবার বসিবার শুইবাব ঘর। এই ঘরেই একদিন পড়িতে পড়িতে সুধী পিছন হইতে বাবার স্নিগ্ধ কণ্ঠস্বর শুনিয়াছিল : “রংপুরে একটি মেয়ে দেখে এলাম,—প্রতিমার চেয়েও সুন্দর। সামনে ফাগুন মাস, কবির বলেন কাব্যের পক্ষে প্রশস্ত,তোমাকে একটি কাব্যলক্ষ্মীর সন্ধান দিচ্ছি।” সুধী একটু হাসিয়া পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে কহিল,—“কাল মার্কস্-এর কোনো জায়গায় এমন কথা লেখা নেই, বাবা।” অবনীনাথ বলিয়াছিলেন,—“তা না থাক্‌, নমিতা এখন নমিন্যালি আছে, তার জন্যে তোমার এক্‌জামিনের মার্কস কমবে না।” শেষ পৰ্যন্ত অবশ্য আপত্তি টি কে নাই, নমিতাকে বিস্তৃত শয্যার একটা সঙ্কীর্ণ অংশ ছাড়িয়া দিতে হইল। এই ঘরেই সুধী বোকার মত (প্রত্যেক স্বামীই বিবাহের প্রথম রাত্রির প্রথম সম্ভাষণে একটু বোকা হয়) নমিতাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল,—“আমাকে তোমার ভালো লাগবে?” নমিতা নিঃশব্দে কতকগুলি ঢোঁক গিলিয়া বলিয়াছিল,–“একবার যখন বিয়ে হয়েই গেছে তখন আর ভাল লাগালাগির কথাই নেই। আমাকে আরেকটু বড়ো হ’তে দিয়ে বিয়ের আগে দেখা করে’ মতটা জিজ্ঞেস করলেই পারতে!” মেয়েটি বেশ সপ্রতিভ, সুধী-র এত ভাল লাগিয়া গেল যে ফের বোকার মত বলিয়া বসিল,—“দেখো, আমাকে তোমার খুব ভালো লাগবে।”…একুশ বছর ধরিয়া সুধী এই ঘরে বসিয়া কত স্বপ্ন দেখিয়াছে। ইস্কুলে পড়িতে-পড়িতে তাহার মনে হইয়াছিল, পণ্ডিতমশাই হইয়া ছেলেদের বেঞ্চির উপর দাঁড় করাইয়া দিবার মত সুখ বুঝি আর কোথাও নাই; থার্ড ক্লাশে উঠিয়া সে ভাবিয়াছিল যে, সে মোক্তার হইয়া শালা আঁটিবে ও খোঁচা খোঁচা দাড়ি রাখিয়া পেসকারকে ভয় দেখাইবে। ষোল বছর বয়সে সুধী কীসের Endynion পড়িয়া একটি অপরিচিত ভাববিলাসী ব্যর্থ-প্রেমিকের বেদনার স্বপ্নে তাহার স্বল্প-প্রসার ভুবনকে অনুরঞ্জিত করিয়া তুলিয়াছিল; বি, এ পাশ করিয়া কঠিন রক্তাক্ত মাটিতে পা রাখিয়া সীমাশূন্য আকাশের নীচে দাঁড়াইয়া দুই ফুসফুস ভরিয়া প্রচুর বাতাস নিতে-নিতে সে স্বপ্ন দেখিয়াছিল স্বাধীন গর্বিত ভারতের—উপরে উদার উজ্জ্বল আকাশ, পদনিম্নে উত্তরঙ্গ উদ্বেল সমুদ্র! এই ঘরে বসিয়াই।

পুত্রের মৃত্যুশয্যাপার্শ্বে অরুণাকে দেখিবে এস,-মা’কে! চিত্রাপিতের মত বসিয়া আছেন। যে হাতখানা দিয়া নমিতা স্বামীর হাত ধরিয়া আছে, সেই হাতখানি অরুণা নিজের কোলের উপর টানিয়া লইলেন। কতদিন ধরিয়া যে ঘুমান নাই তাহা তাহার হতাশ স্থির দুই চক্ষুতারকা দেখিয়া নির্ণয় করা অসম্ভব,—সব শ্রান্তি ও প্রতীক্ষার আজ চরম অবসান হইবে। অরুণার মন বাইশ বছর পূর্বের অতীততীরে উড়িয়া গিয়াছে। বাইশ বছর পূৰ্বে অরুণা এই সংসারে পদার্পণ করিয়াছিল,–একটি বৎসর ফুরাইতে-না-ফুরাইতেই যখন অরুণার প্রথম সন্তানসম্ভাবনা হইল, তখনকার সেই সুখরোমাঞ্চময় অনুভূতিতে বিস্ময়ে সে বাণীহীন হইয়া গিয়াছিল। তাহার যেন সম্পূর্ণ বিশ্বাস করিতে ভয় হইতেছিল। নভচারী কোন নক্ষত্র হইতে একটি জ্যোতি-স্ফুলিঙ্গ মতলে প্রাণ পাইবার আশায় তাহার শরীরকে আশ্রয় করিয়াছে,–যেন কোন্ অতিথি-আত্মা—আত্মপ্রকাশের বিপুল ব্যাকুলতায় অরুণাকে মিনতি করিতেছে। সে-দিন মনে আছে অরুণ গভীর রাত্রে ছাতে উঠিয়া নক্ষত্ৰমণ্ডিত অবারিত আকাশের দিকে তাকাইয়া প্রার্থনা। করিবার উপযুক্ত ভাষা খুঁজিয়া পায় নাই, স্বামী ডাকিতে আসিলে তাহাব মনে হইয়াছিল, যে ক্ষুদ্র মাংসাপণ্ডটা তাহার জঠরে আকারহীন অবস্থায় সঙ্কুচিত হইয়া আছে, তাহা একদিন দৈর্ঘ্যে, আয়তনে ও বলশালি তায় ঐশ্বৰ্যময় হইয়া উঠিবে—সৃষ্টির এই গৌরবপূর্ণ অভিজ্ঞতায় অরুণার মন ‘সুখাবেশে অবশ হইয়া পড়িল! এই জ্বণ একদিন কর্মে, সাহসে, তেজে, দীপ্তিতে অগ্রগণ্য হইবে, হয়ত বা ভালবাসিয়া একটি নিখিলব্যাপ্ত বিরহবেদনার কবি হইবে কে বলিতে পারে! কিন্তু সে যে আবার একদিন ক্ষণস্বপ্নের মতই কয়েকটি বর্ণের বুদ্বুদ তুলিয়া অদৃশ্য হইয়া যাইবে, তাহা কে কবে ভাবিয়াছিল! আর দু’টি মাত্র মুহূর্তের পর অরুণা কি বলিয়া ও কতখানি জোর দিয়া চীৎকার করিয়া উঠিবে, তাহা ভাবিয়া পাইতেছিল না। এতগুলি বৎসর ধরিয়া সে যত আকাঙ্ক্ষা করিয়াছে, যত স্নেহ বর্ষণ করিয়াছে, তাহার এই ভয়ঙ্কর অকৃতার্থতা সে সহিবে কি করিয়া? ভালবাসা এত ভঙ্গুর কেন, আশা কেন এত অসহায়?

বসিয়া থাকিতে থাকিতে অরুণার এক সময় মনে হইল আজিকার রাত্রিটি তাহার জীবনের সাধারণ রাত্রিগুলির মতই একটা। পরীক্ষার সময় মাঝরাতে উঠিয়া ঘুমন্ত সুধীকে পড়িবার জন্য জাগাইয়া দিতে হইত,গায়ে ঠেলা দিলেই বুঝি সুধী এখনি হাত-পা মেলিয়া তেমনি জাগিয়া উঠিবে। টেবিলে আলো জ্বালিয়া সুধী পড়িতে বসিলে, অরুণা ছাতে উঠিয়া আকাশের কাছে সন্তানের কুশল প্রার্থনা করিবে, অন্ধকার স্বচ্ছতর হইয়া আসিতে থাকিলে, মাঠে নামিয়া ফুল কুড়াইয়া ছেলেকে গিয়া উপহার দিবে। অরুণার মনে হইতেছিল খানিকক্ষণ চোখ বুজিয়া থাকিয়া পরে চাহিয়া দেখিলেই দেখিবে যে, এই রাত্রির চেহারাটা সম্পূর্ণ বদলাইয়া গিয়াছে। তিনি জাগিয়া-জাগিয়া এতক্ষণ একটা দুঃসহ দুঃস্বপ্ন দেখিতেছেন মাত্র। এই ভাবিয়াই তিনি চক্ষু বুজিলেন, হঠাৎ একটা অসংলগ্ন চীৎকারে মাথা তুলিয়া চাহিয়া দেখিলেন, অবনীনাথ দুই হাতে মাথার চুল ছিঁড়িতেছেন।

ব্যাপারটা আবার আয়ত্ত হইল। কিন্তু গাঢ় নিদ্রায় অরুণার চক্ষুপল্লব ভারাক্রান্ত হইয়া আসিতেছে; নিদ্রা যে শোকমাধুৰ্যপূর্ণ বিস্মৃতি আনিয়া দেয়, তাহারই নদীতে তিনি এইবার স্নান করিবেন। এই ঘরদুয়ার স্বামী-পুত্র—সব অপরিচিত আত্মীয়; এত দিনের কঠিন কদৰ্য ক্লান্তির পর আজ তাহার ঘুম আসিবে। অরুণ ছেলের পাশে শুইয়া পড়িলেন।

ইহার পর আর দুইটি মিনিটু-ও বুঝি কাটিল না। রাস্তায় কিসের একটা শব্দ হইতেই, সবাই অসঙ্গত প্রত্যাশায় সচকিত হইয়া উঠিল; প্রদীপ ফিরিয়া আসিল বুঝি।

সমস্ত আত্মীয়বন্ধু সুধী-র আরো কাছে ঘেঁসিয়া আসিয়া সমস্বরে চেঁচাইয়া উঠিল; একটা-বিয়াল্লিশ মিনিটের সময় সুধী যে নিশ্বাস ত্যাগ করিল, তাহা আর ফিরিয়া গ্রহণ করিতে পারিল না। তাহার জন্য বাতাস ফুরাইয়া গেছে।

আশ্চৰ্য্য, অরুণার ঘুম ভাঙিল না। অবনীনাথ হঠাৎ ছুটিয়া আসিয়া ফু দিয়া বাতিটা নিবাইয়া দিলেন; চীৎকার করিয়া কহিলেন, “খবরদার, কেউ কাদতে পাবে না—সবাই চুপ করে থাক, কারু মুখ। থেকে যেন একটাও শব্দ না বেরোয়, ওকে চলে যেতে দাও।”

খোলা জাল্লা গুলি দিয়া বন্যার মত অজস্র অন্ধকার ঘরে ঢুকিয়া পুঞ্জীভূত হইয়া উঠিতে লাগিল—মৃত্যুর নিঃশব্দ তরঙ্গ! চাদ কখন অস্ত গিয়াছে,—আকাশে হঠাৎ মেঘ করিল নাকি,-রাত্রি বোধ হয় আত্মঘাতিনী হইল! ঘরে যতগুলি লোক ছিল অবনীনাথের আকস্মিক আর্তনাদে একেবারে হতবাক হইয়া গেছে; নিস্পন্দ, নিবালম্ব—কাহারো মুখে কথা ফুটিতেছে না। অবনীনাথ ঘরের মধ্যখানে একটা স্তম্ভের মত অচল হইয়া দাঁড়াইয়া আছেন, আর নমিতা কি করিবে কিছু বুঝিতে না পারিয়া, ভয়ে স্বামীর হিম, শক্ত বাহুটা দুই হাতে মুঠি করিয়া আঁকড়িয়া রহিয়াছে।

<

Achintya Kumar Sengupta ।। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত