শুধু ইন্দ্র রায়ই নয়, হেমাঙ্গিনীও ভুল করিলেন।

ফুলশয্যার দিন-দুই পরেই বর ও কন্যার জোড়ে কন্যার পিত্রালয়ে আসবার বিধি আছে, ‘অষ্টমঙ্গলা’র যাহা কিছু আচার-পদ্ধতি সবই কন্যার পিত্রালয়েই পালনীয়; সূতরাং অহীন্দ্র ও উমা-রায় বাড়িতে আসিল। হেমাঙ্গিণী ও বাড়িতে আসা-যাওয়া করিলেও উমাকে ভাল করিয়া দেখিবার সুযোগ পান নাই, সুযোগ তিনি ইচ্ছা করিয়াই গ্রহণ করেন নাই। হাজার হইলেও তিনি মেয়ের মা। নদীকূলের বাসিন্দার মত, নিন্দারূপ বন্যার ভয় যে মেয়ের মায়ের অহরহ। কঠোরভাবে তিনি কন্যার জননীর কর্তব্য পালন করিয়াছেন, উমার কাছে গিয়া একদিন বসেন নাই পর্যন্ত। মানুষের মনকে বিশ্বাস নাই, কে হয়তো এখনই বলিয়া বসিবে যে, মেয়েকে তিনি কোন গোপন পরামর্শ দিতে আসিয়াছেন।

আপন গৃহে কন্যাকে পাইয়া কন্যার মুখ দেখিয়া তিনি প্রথমটায় শিহরিয়া উঠিলেন, কিন্তু পরক্ষণেই হাসিলেন, স্বামীর কথাটা তাঁহার মনে পড়িয়া গেল। রায় সেদিন বাড়ি আসিয়াই হেমাঙ্গিনীকে কথাটা বলিয়াছিলেন। হেমাঙ্গিনী হাসিয়া বলিয়াছিলেন, ওদের তো আমাদের মত অজানা-অচেনাও নয়, পনেরো বছরের বর, দশ বছরের কনেও নয়।

রায় হাসিয়া বলিয়াছিলেন, তা বটে।

হেমাঙ্গিনী মৃদু হাসিয়া, উমার কপালে খসিয়া-পড়া চুলগুলিকে আঙুলের ডগা দিয়া তুলিয়া দিলেন, বলিলেন, স্নান করে খেয়ে-দেয়ে বেশ ভাল করে একটু ঘুমো দেখি।

উমা নিতান্ত ছোট মেয়ে নয়, সে মায়ের মৃদু হাসি ও কথাগুলির অর্থ দুইই বেশ বুঝিতে পারিল। দুঃখে অভিমানে তাঁহার চোখ ফাটিয়া জল আসিতেছিল কিন্তু প্রাণপণে আপনাকে সংহত করিয়া সে-আবেগ সে রোধ করিল। মাথা নীচু করিয়া ধীরে ধীরে সে উঠিয়া গেল। মা মনে করিলেন, কন্যার লজ্জা। তিনি আরও একটু হাসিয়া অহীন্দ্রকে জলখাবার দিতে উঠিলেন। বিবাহ উপলক্ষে সমাগতা তরুণী কুটুম্বিনীর দল উমার সঙ্গে সঙ্গে উঠিয়া গিয়াছিল, উমার আজ তাহাদের মধ্যেই থাকিবার কথা। ভাঁড়ারের দিকে চলিতে চলিতে হেমাঙ্গিনী আবার হাসিলেন।

অমল বাড়ি নাই, ইন্দ্র রায় তাহাকে সদরে পাঠাইয়াছেন। ওই চরের ব্যাপার লইয়াই সে খোদ ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের নিকট এক দরবার করিতে গিয়াছে। চক্রবর্তী-বাড়ির প্রতিনিধি হইয়াই সে গিয়াছে। কলওয়ালার অত্যাচারে চরের প্রজা উৎখাত হইয়া যাইতেছে, জোরপূর্বক নদীতে বাঁধ দিয়া পাম্প করিয়া জল তোলায় জলাভাবে চাষ নষ্ট হইয়া যাইতেছে; এমন কি গরীবদের গার্হস্থ্যজীবন পর্যন্ত বিপর্যস্ত হইয়া গেল। যাওয়া উচিত ছিল অহীন্দ্রের। কিন্তু বিবাহের আচার-আচরণগুলির জন্য তাহার যাওয়া চলে না বলিয়াই অমল গিয়াছে চক্রবর্তী-বাড়ির প্রতিনিধিরূপে। শ্বশুর-জামাই দুইজনে উপরের ঘরে বসিয়া আলোচনা করিতেছে; আলোচনা অবশ্য একতরফা। রায় একাই কথা বলিতেছিলেন। অহীন্দ্রকে সমস্ত কথা ভাল করিয়া বুঝাইতেছিলেন।

অহীন্দ্র নীরবে বসিয়া শুনিতেছিলেন। হেমাঙ্গিনী জলখাবার আনিয়া রায়কে বলিলেন, না বাপু তুমি কি অদ্ভুত মানুষ, জমিদারি, মকদ্দমা, দাঙ্গাহাঙ্গামা এই ছাড়া কি আর কথা নাই তোমাদের? অমলকে তো পাঠিয়ে দিলে সদরে, এইবার অহীনকে পার তো হাইকোর্টে পাঠাও?

রায় হাসিয়া বলিলেন, জান, আকবর-শা বাদশা বারো বছর বয়সে হিন্দুস্থানের বাদশা হয়েছিলেন। জমিদারের ছেলে জমিদারির কাজ না শিখলে হবে কেন? জেলার হাকিমদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় রাখতে হবে, বিষয়-সম্পত্তির কোথায় কি আছে জানতে হবে; তবে তো! আর মোটামুটি আইন-কানুন-এগুলোও জেনে রাখতে হবে। আর দাঙ্গা-হাঙ্গামা-এগুলোও একটু-আধটু শিখতে হবে বৈকি। জান তো, ‘মাটি বাপের নয়, মাটি দাপের’? একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া মৃদু হাসিয়া রায় আবার বলিলেন, দাঙ্গাই বল, আর হাঙ্গামাই বল, আসলে হল যুদ্ধ! রাজায় রাজায় হলেই হয় যুদ্ধ, আর জমিদারে জমিদারে হলেই হয় দাঙ্গা। আসলে হলাম আমরা রাজা। ছোট অবশ্য-গরুড় আর চামচিকে যেমন আর কি! বলিয়া তিনি হা-হা করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। তারপর উঠিয়া বলিলেন, তা হলে তুমি বস বাবা। আমি একবার দেখি, সেরেস্তার কাজ অনেক বাকি পড়ে আছে। অমল এই বেলাতেই এসে পড়বে।

অমল ফিরিল অপরাহ্নে-অপরাহ্নের প্রায় শেষভাগে। অহীন্দ্র তখন বেড়াইতে বাহির হইয়া গিয়াছে। স্বভাবধর্ম অনুযায়ী অমল শোরগোল তুলিয়া ফেলিল। সে উমাকে এক নূতন নামে চীৎকার করিয়া ডাকিতে আরম্ভ করিল, উমনী! উমনী! এই উমনী!

হেমাঙ্গিনী ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, ও কি? উমনী আবার কি?

হাসিয়া অমল বলিল, উমার নূতন নাম বের করেছি আমি।

দাদার সাড়া পাইয়া উমা ঈষৎ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। সে হাসিমুখে আসিয়া অমলের কাছে দাঁড়াইল, অমল বলিল, তোর নূতন নাম দিয়েছি উমনী; পছন্দ কি না, বল? সে আপনার সুটকেসটি খুলিতে বসিল।

উমা কোন জবাব দিল না, হাসিতেছিল, হাসিতেই থাকিল। অমলকে পাইয়া তাহার মন যেন অনেকটা হাল্কা হইয়া উঠিয়াছে।

অমল সুটকেসের তলায় চাবিটা পরাইয়া বলিল, বল বল, শিগগির বল্- yes or no?

উমা এবার বলিল, খারাপ নাম আবার কেউ পছন্দ করে নাকি?

ও সব আমি বুঝি না। Say, yes or no।

ঘাড় নাড়িয়া উমা বলিল, No।

No! আচ্ছা, তবে থাকল, পেলি না তুই। অমল সুটকেস হইতে হাত সরাইয়া লইল।

উমা উৎসুক হইয়া প্রশ্ন করিল, কি?

 সে জেনে তোর দরকার কি?

অত্যন্ত ব্যগ্র হইয়া উমা এবার বলিল, না না না, তবে no নয়, no নয়। Yes-yes।

অমল সুটকেস খুলিয়া বাহির করিল-সাঁওতাল-তাঁতীর বোনা মোটা সুতার একখানি সাঁওতালী কাপড়। সাদা ধবধবে দুধের মত জমি, প্রান্তে লাল কস্তার চওড়া সাঁওতালী মইপাড় শাড়ি। দেখিয়া উমার চোখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। অমল শাড়িখানি উমার হাতে দিয়া বলিল, Queen of the Santhals- মহামহিমান্বিত উমনী ঠাকরুণ। যা পরে আয়, এক্ষুণি পরে আয়, দেখি কেমন মানায়। যা।

উমা গেল, কিন্তু উৎসাহিত চঞ্চল গমনে নয়; মন্থর গতিতেই চলিয়া গেল।

অমল হাসিয়া বলিল, তিন দিনে দেখছি, উমনীর তেত্রিশ বছর বয়স বেড়ে গেছে। মেয়েটার লজ্জা এসে গেছে।

হেমাঙ্গিনী একটু ধমক দিয়া বলিলেন, তোর জ্ঞানবুদ্ধি কোন কালে হবে না অমল। নে, মুখ-হাত ধুয়ে নে। অহীন বেড়াতে গেছে, তুই বরং একটু বেরিয়ে তাকে সঙ্গে নিয়ে আয়।

উত্তম কথা। উমনী ঠেক্রুণকেও তা হলে সঙ্গে নিয়ে যাব। বলিয়াই সে হাঁকিতে আরম্ভ করিল, উমনী! উমনী!

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, না। গাঁয়ে শ্বশুরবাড়ি; ও সব তোমার খেয়াল-খুশি মত হবে না। শ্বশুরবাড়ির কথা ছেড়ে দিয়েও তোমার বাপই শুনলে রাগ করবেন।

উমা সাঁওতালী শাড়ি পরিয়া আসিয়া দাঁড়াইল। অদ্ভুত রকম দেখাইতেছিল উমাকে। হেমাঙ্গিনী দেখিয়া হাসিয়া ফেলিলেন, বলিলেন, যা যা, ছেড়ে ফেল্ গে। অমল বলিল, না না না, এক কাজ কর উমনী, সাঁওতালদের মত চুলটা বাঁধ দেখি, কতকগুলো গাঁদাফুল পর খোঁপায়। একটা ফোটো তুলে নিই তা হলে।

ফোটোর নামে উমা আবার একটু দীপ্ত হইয়া উঠিল।

***

অমল আসিয়া উপস্থিত হইল কালিন্দীর ঘাটে। সে ঠিক জানে অহীন্দ্রকে কোথায় পাওয়া যাইবে। ঘাটের পাশে অল্প একটু দূরে একটা ভাঙনের মাথায় ঘাসের উপর অহীন্দ্র বসিয়া ছিল। ভাঙনটার ঠিক সম্মুখে ও-পারে চরের উপর সাঁওতাল-পল্লীটি দেখা যাইতেছে। পল্লীটি স্তব্ধ। চরের ও-পাশে কারখানার হিন্দুস্থানী শ্রমিক-পল্লীতে একটা ঢোল বাজিতেছে। পচুই মদের দোকান হইতে ভাসিয়া আসিতেছে উজ্জ্বল কলরব। অহীন্দ্র স্থাণুর মত বসিয়া ও-পারের দিকে চাহিয়া ছিল। অমল পা টিপিয়া আসিয়া তাহার পিছনে দাঁড়াইল। কিন্তু তাহাতেও অহীন্দ্রের একাগ্রতা ক্ষুণ্ণ হইল না। অমল বিস্মিত হইয়া সশব্দে অগ্রসর হইয়া অহীন্দ্রের পাশে বসিয়া কহিল, ব্যাপার কি বল তো? ধ্যান করছ নাকি?

এ আকস্মিকতায় অহীন্দ্র কিন্তু চমকিয়া উঠিল না, ভ্রূ-কুঞ্চিত  করিয়া বিরক্তিভরেই সে অমলের। আপাদমস্তক দৃষ্টি বুলাইয়া লইল, তারপর মৃদু হাসি হাসিয়া বলিল, তুমি!

হাসিয়া অমল বলিল, হ্যাঁ, আমি। কিন্তু তোমার যে দেখি ধ্যানি বুদ্ধের মত অবস্থা।

অহীন্দ্রও একটু হাসিল, তারপর বলিল, ভাবছি ওই চরটার কথা।

ওই চরটাই তোমাকে খেলে দেখছি। ও-সব ভাবনা ছাড়, ওর ব্যবস্থা আমি করে এসেছি। কালেক্টর খুব মন দিয়ে আমার কথা শুনলেন। ইমিডিয়েটলি এর ব্যবস্থা তিনি করবেন; আর্জেন্ট নোট দিয়ে তিনি আমার সামনে এস.ডি.ও-কে একোয়ারির ভার দিলেন। সাঁওতালদের জমি সম্বন্ধে একটা স্পেশাল আইন আছে। তাতে ওদের জমি বিক্রি হয় না। সে আইন এখানে চালানো যায় কি না দেখবেন।

কথা বলিতে বলিতে অমল অকস্মাৎ ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল কলওয়ালা বিমলবাবুর উপর। বলিল, স্কাউণ্ডেলটার সমস্ত কথা আমি বলেছি কালেক্টারকে। দ্যাট পুয়োর ইনোসেন্ট গার্ল-ওই সারী বলে মেয়েটার কথা সূদ্ধ আমি বলেছি কালেক্টারকে।

অহীন্দ্রের মুখে অদ্ভুত হাসি ফুটিয়া উঠিল। সে হাসি দেখিয়া অমল আহত ও বিরক্ত না হইয়া পারিল, বলিল, হাসছ যে তুমি?

হাসছি ওই লোকটার ওপর তোমার রাগ দেখে।

কেন? রাগের অপরাধটা কি?

অপরাধ নয়, অবিবেচনা। মানে, ও-লোকটা আর নতুন অন্যায় কি করেছে বল? চিরকাল পৃথিবীতে বুদ্ধিমান শক্তিশালীরা দুর্বল নির্বোধের ওপর যে আচরণ করে এসেছে, তার বেশী কিছু করে নি ও বেচারী। সম্রাট বাদশা রাজা দিগ্বিজয়ী থেকে আরম্ভ করে রায়হাটের জমিদার-বংশের পূর্বপুরুষেরা পর্যন্ত সকলেই এই একই আচরণ করে এসেছেন, আপন আপন সাধ্য এবং সামর্থ্য অনুযায়ী। তুমি আমিও সুযোগ পেলে এবং সামর্থ্য থাকলে তাই করতাম; হয়তো ভবিষ্যতে করবও।

অমল বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া গেল, শুধু বিস্ময় নয়, অন্তরে অন্তরে সে একটা তীব্র জ্বালাও অনুভব করিল। সে ঈষৎ উষ্মভরেই প্রশ্ন করিল, হোয়াট ডু ইউ মীন?

হাসিয়া অহীন্দ্র বলিল, বিশ্বচরাচরে আদিকাল থেকে যা ঘটে, ওই চরেও ঠিক তাই ঘটল বন্ধু। সাঁওতালগুলো ওই ভাবে বঞ্চিত হতেই বাধ্য, ওই মেয়েটার ওই দুর্দশাই স্বাভাবিক। চরটা এবং তোমার মধ্যে টাইম অ্যাণ্ড স্পেসের ডাইমেশন বাড়িয়ে নাও না, দেখবে চরটা বেমালুম পৃথিবীর সঙ্গে মিশে গেছে, পার্থক্য নেই।

অমল এবার স্তব্ধ হইয়া গেল। অহীন্দ্রের কথা এবং তাহার কণ্ঠস্বরের সকরুণ আন্তরিকতা তাহাকে প্রতিবেশীর শোকের মত স্পর্শ করিল, আচ্ছন্ন করিল। অর্ধস্ফূট হাসিটুকু অহীন্দ্রের মুখে লাগিয়াই রহিল, সেই অবস্থাতেই সে গভীর চিন্তায় মগ্ন হইয়া গেল।

অনেকক্ষণ পর অমল জোর করিয়া চিন্তাটাকে ঝাড়িয়া ফেলিয়া বলিল, হ্যাং ইয়োর বিশ্বপ্রেম। ওঠ এখন, সন্ধ্যে হয়ে গেল।

অন্যমনস্কভাবে অহীন্দ্র বলিল, অ্যাঁ?

ওঠ ওঠ, সন্ধ্যে হয়ে গেল। যত সব উদ্ভট চিন্তা! চল, এখন বাড়ি চল। আচ্ছন্ন স্বপ্নাতুরের মতই অহীন্দ্র উঠিল এবং অমলের সঙ্গে রায়-বাড়ির পথ ধরিল। চলিতে চলিতে অমল বলিল, দিস ইজ ব্যাড, অহীন

অহীন্দ্র কোন উত্তর দিল না।

অমল তাহার দিকে ফিরিয়া বলিল, ভো-ভো চিন্তাকুল মনুষ্য!

অ্যাঁ!

আরে রাম রাম, তুমি যে শেষ পর্যন্ত পাগল হয়ে যাবে।

অহীন্দ্র এ কথার কোন জবাব দিল না। তাহার কানে কোন কথাই যেন প্রবেশ করিতেছে না, শব্দ কর্ণপটহে আঘাত করিলেও অর্থ মন পর্যন্ত পৌঁছিতে পারিতেছে না। তাহার মনের অবস্থা ঠিক যেন ভাটার সমুদ্রের মত; তাহার পরিচিত পৃথিবীর সুন্দর শ্যামল তটভূমি ক্রমশ যেন মিলাইয়া একাকার হইয়া যাইতেছে দূর হইতে দূরান্তরের অস্পষ্টতায় অপরিচয়ের মধ্যে। অথচ কোন গোপন অতল পথে কেমন করিয়া যে। জীবনের সকল ঊর্ধ্বমূখী জলোচ্ছাস নিন্মমুখে নিঃশেষিত হইয়া যাইতেছে, সে রহস্য তাহার অজ্ঞাত।

.

উমা তখন উত্তেজিত হইয়া একটা ড্রেসিং টেবিলের কোণ ধরিয়া দাঁড়াইয়া ছিল। বেশভূষা প্রসাধন লইয়া প্রচণ্ড একটা ঝড় বহিয়া গিয়াছে ইহারই মধ্যে। সে কোনমতেই বেশভূষার পরিবর্তন করিবে না, যেমনই আছে তেমনি থাকিবে! হেমাঙ্গিনী মেয়ের উপর ভীষণ চটিয়া গিয়া হাল ছাড়িয়া দিয়াছেন, বলিয়াছেন, ‘ঘি দিয়ে ভাজ নিমের পাত, নিম না ছাড়েন আপন জাত’, তোর দোষ কি বল, তোদের বংশের ধারাই এই!

উমা কোন উত্তর করে নাই, কিন্তু তাহার কালো বড় চোখ দুইটি হইয়া উঠিয়াছিল বিদ্যুতালোকিত মেঘের মত। হেমাঙ্গিনী সে-দিকে ভ্রুক্ষেপ না করিয়া চলিয়া গিয়াছিলেন। তাঁহার ভাজ-উমার মামীমা তাঁহাকে শান্ত করিয়া মৃদুস্বরে বলিয়াছেন, ঠাকুরঝি, ও-সব হচ্ছে আজকালকার ফ্যাশান। তুমি রাগ করছ কেন?

উমা তখন হইতেই ড্রেসিং টেবিলের কোণ ধরিয়া তেমনি ভাবেই দাঁড়াইয়া আছে। সেই সাঁওতালদের মত সিঁথি বিলুপ্ত করিয়া চুল বাঁধা, খোঁপায় গাঁদাফুলের মালা, পরনে মোটা সূতার সাঁওতালী শাড়ি; এক নজরে উমাকে চিনিবার পর্যন্ত উপায় নাই। অকস্মাৎ উমা চকিত হইয়া সরিয়া দাঁড়াইল, আয়নার মধ্যে ছায়া পড়িল অহীন্দ্র ও অমলের। অহীন্দ্র ও অমল ঘরে প্রবেশ করিতেই উমা বিব্রত হইয়া পড়িল, সাঁওতালী শাড়িটা অবগুণ্ঠন দিবার মত পর্যাপ্ত দীর্ঘ নয়। অমল হাসিয়া বলিল, লেট মি ইনট্রোডিউস, উমনী টেকরুন অ্যাণ্ড রাঙাবাবু।

উমা দ্রুতপদে পাশ কাটিয়া পালাইবার উদ্যোগ করিল। কিন্তু অমল বলিল, বস পোড়ারমুখী বস। একেবারে যেন নাইনটিন্থ সেঞ্চুরির কলাবৌ!

অন্যমনস্ক অহীন্দ্র পর্যন্ত এই অভিনব সজ্জায় সজ্জিতা উমাকে দেখিয়া সমস্ত ভুলিয়া তাহার দিকে চাহিয়া রহিল, তাহার চোখে প্রদীপ্ত মুগ্ধ দৃষ্টি ফুটিয়া উঠিল। উজ্জ্বল মুগ্ধ হাসি হাসিয়া সে আবার বলিল, বস না উমা। ও, তুমি বুঝি ঘোমটা দেবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েছ? কিন্তু সাঁওতালরা তো কাপড়ের আঁচলে ঘোমটা দেয় না। আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।

আলনা হইতে উমার লাল ডুরে গামছাখানা টানিয়া লইয়া অহীন্দ্র বলিল, ওরা গামছার ঘোমটা দেয় এমনি করে। অগ্রসর হইয়া গামছা দিয়া সে উমার মাথায় ঘোমটা টানিয়া দিল।

অমল হাসিয়া বলিল, দাঁড়াও দাঁড়াও, চায়ের ব্যবস্থা করি। তারপর উমিকে আজ সাঁওতালের মেয়ের মত নাচতে হবে।–বলিয়া সে বাহির হইয়া গেল।

উমা ঘাড় হেঁট করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, অহীন্দ্র অকস্মাৎ অনুভব করিল উমা কাঁদিতেছে। সে সবিস্ময়ে চিবুক ধরিয়া তাহার মুখখানি তুলিয়া ধরিয়া দেখিল অনর্গল ধারায় উমার চোখ দিয়া জল ঝরিয়া পড়িতেছে। অহীন্দ্র তাহার অশ্রুসিক্ত মুখখানি বুকে চাপিয়া সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, তুমি কাঁদছ? কি হয়েছে উমা?

উমা জোড় করিয়া চিবুক হইতে অহীন্দ্রের হাত সরাইয়া দিয়া তাহার বুকে মুখ লুকাইয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল। অহীন্দ্র সস্নেহে তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া বলিল, কি হয়েছে, বলবে না আমাকে? এইবার তাহার মনে হইল, সে উমাকে অবহেলা করিয়াছে। অনুতাপের উত্তাপে তাহার আবেগ গাঢ়তর হইয়া উঠিল।

উমা তাহার বুকের মধ্যেই সবেগে মাথা নাড়িল। অহীন্দ্র দুই হাতে তাহার মুখখানি আবার তুলিয়া ধরিল। উমা চোখ বন্ধ করিল, অকস্মাৎ অহীন্দ্র চুমায় চুমায় তাহার মুখখানি ভরিয়া দিয়া তাহাকে অস্থির করিয়া তুলিল।

আকাশে যেন পূর্ণচন্দ্র উঠিয়াছে, জীবনের রিক্ত বালুময় বেলাভূমি জলোচ্ছ্বাসের উল্লাসে আবৃত হইয়া গিয়াছে, তাহা চিরপরিচিত তটভূমির বুকের কাছে অসীম আগ্রহে আবার আগাইয়া আসিতেছে।

***

পরদিন তখনও অন্ধকারের সম্পূর্ণ ঘোর কাটে নাই। উমা এবং অহীন্দ্র সবিস্ময়ে দেখিল, কালো কালো ছায়ার মত সারিবদ্ধ কাহারা সম্মুখের রাস্তা দিয়া চলিয়াছে। সমস্ত রাত্রির মধ্যে উমা ও অহীন্দ্র ঘুমায় নাই। অহীন্দ্র উমাকে বলিয়াছে তাহার অন্তরের সকল চিন্তা সকল বেদনার কথা। উমা নিতান্ত অজ্ঞ পল্লীকন্যা নয়, সে শহরে বড় হইয়াছে, স্কুলে পড়িয়াছে। অহীন্দ্রের কথার প্রতিটি শব্দ না বুঝিলেও, আভাসে সে বুঝিয়াছে অনেক। তাহার তরুণ চিত্ত অহীন্দ্রের গৌরবে কানায় কানায় ভরিয়া উঠিয়াছে।

অহীন্দ্র ওই কালো ছায়ার সারি দেখিয়া সবিস্ময়ে উমাকে প্রশ্ন করিল, কারা বল দেখি?

 উমা শঙ্কিত হইয়া বলিল, ডাকাত নয় তো?

অহীন্দ্র উঠিয়া বাহিরের দরজা খুলিয়া বারান্দায় আসিয়া রেলিঙের উপর ঝুঁকিয়া দাঁড়াইল। পুরুষ নারী-শিশু, গরু-মহিষ-ছাগল সারি বাঁধিয়া চলিয়াছে। পুরুষদের কাঁধে ভার, মেয়েদের মাথায় বোঝা, গরু মহিষের পিঠে ছালায় বোঝাই জিনিসপত্র; নীরবে তাহারা পথ অতিক্রম করিয়া চলিয়াছে। কয়খানা গরুর গাড়িও আসিতেছে ধীর মন্থর গতিতে সকলের পিছনে। বোঝাগুলির মধ্যে নিশ্চয় কোথাও মুরগীর পাল আছে, আসন্ন নিশাবসানের আভাসে তাহাদের একটা চীৎকার উঠিল, সঙ্গে সঙ্গে আর একটা, তাহার পর আরও কয়েকটা।

উমাও অহীন্দ্রের পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, সে অহীন্দ্রকে বলিল, সাঁওতাল?

তাই মনে হচ্ছে। পরক্ষণেই সে ডাকিয়া প্রশ্ন করিল, কে? কারা যাচ্ছ তোমরা?

মেয়েদের কণ্ঠে মৃদু গুঞ্জন ধ্বনিত হইয়া উঠিল, তাহার মধ্যে অহীন্দ্র ও উমা বুঝিল একটা শব্দ, রাঙাবাবু।

কে একজন পুরুষ উত্তর দিল, আমরা গো-মাঝিরা।

মাঝিরা! কোথায় যাচ্ছিস সব?

 ইখান থেকে আমরা উঠে যাচ্ছি গো-হু-ই মৌরক্ষীর ধারে লতুন চরাতে!

 উঠে যাচ্ছিস তোরা? চলে যাচ্ছিস এখান থেকে? এবারে ব্যাথিত কণ্ঠে উমা প্রশ্ন করিয়া ফেলিল।

হেঁ গো। অত্যন্ত সহজ স্বাভাবিকভাবে কথাটার উত্তর দিল, অন্য কথা শুনিবার বা উত্তর দিবার জন্য মুহর্তের অপেক্ষাও করিল না।

সবাই চলে যাচ্ছিস তোরা?–সকরুণ মমতায় উমা নিতান্ত শিশুর মতই অর্থহীন প্রশ্ন করিতেছিল। অহীন্দ্র নীরব, তাহার চোখে গভীর একাগ্র নিস্পলক দৃষ্টি, মুখে ক্ষুরের তীক্ষ্ণ স্বল্পপরিসর হাসি। আবার জীবনের সকল উচ্ছ্বাস স্তিমিত হইয়া ভাটায় নামিয়া চলিয়াছে।

উমার প্রশ্নের উত্তরে একজন জবাব দিল, উই বজ্জাত চূড়া মাঝিটো আর ক-ঘর থাকলো গো। উয়ারা সায়েবের সঙ্গ সাঁট করলে, উয়ার কলে খাটবে।–বলিতে বলিতে দলটি অগ্রসর হইয়া চলিয়া গেল। মানুষের ও পশুর পায়ে, গাড়ির চাকায় পথের ধূলা উড়িয়া শূন্যালোক আচ্ছন্ন করিয়া দিল। রহস্যময় প্রত্যুষালোকের মধ্যে ধুলার আবরণখানি যবনিকার মত কালো মানুষগুলির পিছনে প্রসারিত হইয়া ক্রমে তাহাদিগকে বিলুপ্ত করিয়া দিল।

ধীরে ধীরে আঁধার কাটিয়া আসিতেছিল। চরের উপর বয়লারের সিটি বাজিয়া উঠিল। প্রভাতের আলোকে লাল সুরকির পথ, সুদীর্ঘ চিমনি, নূতন মিল হাউস, কুলি-ব্যারাকের বাড়িঘর লইয়া চরখানা একটি নগরের মত ঝলমল করিতেছে।

.

৩২.

ইহার পর বিরাট একটি মামলা-পর্ব।

সাঁওতালদের জমি এবং নদীর বাঁধ উপলক্ষ করিয়া কলওয়ালার সহিত ইন্দ্র রায় ও চক্রবর্তী-বাড়ির ছোট-বড় ফৌজদারী দেওয়ানী মামলা একটির পর একটি বাধিয়া চলিতে আরম্ভ করিল।

সদর হইতে এস.ডি.ও আসিয়া তদন্ত করিয়া গেলেন। অমলের আনীত অভিযোগ তিনি প্রত্যক্ষ করিলেন, সাঁওতালরা ভূমিহীন হইয়া অধিকাংশই এখান থেকে চলিয়া গিয়াছে, যাহারা আছে তাহাদেরও জমিজমা নাই। কিন্তু ইহাদের মধ্যেও তিনি বে-আইনী কিছু দেখিলেন না। বিমলবাবু ঋণের দায়ে জমিগুলি খরিদ করিয়াছেন, সাঁওতালরাও স্বেচ্ছায় বিক্রয় করিয়াছে। চূড়া মাঝি ও তাহার অনুগত মাঝি কয়জন-যাহারা এখানে থাকিয়া গিয়াছে, তাহারাই সে কথা স্বীকার করিল। সারী-সম্পর্কিত অভিযোগের তদন্ত করিয়া তিনি যাহা দেখিলেন, সে কথা সত্যের খাতিরেও পুরোপুরি লেখা চলে না।– ‘বর্বর জীবনের সঙ্গে লোভ এবং নীতিহীন উজ্জ্বলতার সম্বন্ধ অতি ঘনিষ্ট; এক একটা জীবনে তাহা অত্যুগ্র হইয়া আত্মপ্রকাশ করিয়া থাকে, এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। বর্বর লোভপরবশ, উজ্জ্বল মেয়েটির এই পরিণতি ভয়াবহরূপে দুঃখজনক হইলেও ইহা স্বাভাবিক। তাহার বর্তমান অবস্থা হইতে তাহা প্রত্যক্ষ, কিন্তু সে অবস্থার কথা লেখা চলে না।’

 মোটামুটি অভিযোগের বিষয়গুলি বাহ্যত প্রত্যক্ষ হইলেও অন্তর্নিহিত সত্য ইহার মধ্যে কিছুই নাই; ইহার অন্তর্নিহিত সত্য হইতেছে জমিদারের সহিত কলের মালিকের প্রতিপত্তি লইয়া বিরোধ। কলের মালিক এখানে কল স্থাপন করিয়া সমগ্র অঞ্চলের একটি বিশেষ উপকার করিয়াছেন। দীনদরিদ্রের মজুরির সুবিধা হইয়াছে, আখের চাষের উন্নতির বিশেষ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে; চারিদিকের পথঘাটের উন্নতি হইয়াছে, এবং এ-কথাও সত্য যে, জমিদারের প্রাপ্য ন্যায্য খাজনা বন্ধ করিয়া কলের মালিক আইন বাঁচাইয়াও যথেষ্ট অন্যায় করিয়াছেন। প্রকৃতপক্ষে, কোন স্থানের প্রজারা সঙ্ঘবদ্ধ হইয়া ধর্মঘট করিলে যে বিশৃঙুলা ঘটিত, এ-ক্ষেত্রে একক তিনি কৌশলে সেই বিশৃঙ্খলা ঘটাইয়াছেন।’

কিন্তু ইহাতেও কোন ফল হইল না।

উভয় পক্ষই একটির পর একটি নূতন বিবাদ বাধাইয়া চলিলেন। ইন্দ্র রায়ের স্বাভাবিক জীবন আর। একরকম হইয়া উঠিল, তাঁহার গোঁফজোড়াটা পাক খাইয়া ভোজালির মত বাঁকা এবং তীক্ষাগ্র হইয়া উঠিয়াছে। জমিদারী কাগজপত্র ও ফৌজদারী দেওয়ানী আইনের বইয়ের মধ্যে তিনি ডুবিয়া আছেন। অন্দরমহল পর্যন্ত এ উত্তেজনা সঞ্চারিত হইয়া পড়িয়াছে। নিত্য প্রভাবে আজ আবার নূতন কি ঘটিবে, তাহারই আশঙ্কায় চিন্তায় সকলে কল্পনা-মুখর মস্তিষ্কে শয্যাত্যাগ করিয়া থাকেন।

অহীন্দ্র অমল কলিকাতায়। অমল ভালভাবেই আই.এ পাস করিয়া বি.এ পড়িতেছে; অহীন্দ্র পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইতেছে। সে নাকি খাড়া সোজা হইয়া বিদ্যা সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়া ডুবিয়াছে। অমল ইহার মধ্যে বারদুয়েক বাড়ি আসিল, কিন্তু অহীন্দ্র আসিল না।

হেমাঙ্গিনী অভিযোগ করিয়া বলিলেন, তাকে ধরে নিয়ে এলি নে কেন তুই?

অমল ভুরু কুঁচকাইয়া বলিল, সে হল বিশ্ববিদ্যালয়ের রত্ন- হীরের টুকরো; আমার হলাম কয়লার কুচো। সম্বন্ধ ঘনিষ্ট হলেও তার স্থান হল সোনার গহনায়, আর আমাদের স্থান চুলোয়। তার নাগাল আমি পাব কেমন করে, বল?

হেমাঙ্গিনী একটু আহত হইয়া চুপ করিয়া রহিলেন। একটু নীরব থাকিয়া অমল আবার বলিল, জান মা, অহীন আজকাল আমার সঙ্গে ভাল করে মেশেই না। তার এখন সব নূতন সঙ্গী জুটেছে, অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে অহীনের।

হেমাঙ্গিনী দুঃখ অনুভব করিলেন, বলিলেন, অহীনের হয়তো দোষ আছে অমল, কিন্তু দোষ তোমারও আছে। ভগ্নিপতির সঙ্গে তোমাদের গুষ্টিরই কোনকালে বনে না। ভগ্নিপতির কাছে মাথা নীচু করতে তোমাদের যেন মাথা কাটা যায়।

অমলও একটু আহত হইল, কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া হাসিয়া বলিল, মায়েরা দেখছি ছেলের চেয়ে জামাইকে ভালবাসে বেশী। বাসো তাতে হিংসে আমি করছি না। কারণ আমারও তো বিয়ে হবে। কিন্তু আমার ওপর তুমি অবিচার করছ, অহীনের কাছে মাথা নীচু করতে আমার লজ্জা নেই। মাথা নীচু করলেও সে আমাকে দেখতে পায় না। দুঃখ হয় আমার সেইখানে।

হেমাঙ্গিনী চুপ করিয়া রহিলেন। এমন কথার পর অমলকে তিনি দোষ দিতে পারিলেন না।

অমল আবার বলিল, অহীনের একটা ঘোর পরিবর্তন হয়ে গেছে। সঠিক কিছু বুঝতে পারি না, কিন্তু সে অহীন আর নেই। কেমন একটা মিষ্টি মিষ্টি ভাব ছিল অহীনের; এখন সেটা যেন একেবারে মুছে গিয়েছে। এখন তার সব তাতেই বাঁকা ধারালো ঠাট্টা, আর এমন একটা অদ্ভুত হাসি হাসে।

হেমাঙ্গিনী বিস্মিত হইলেন, একটু চিন্তিত হইলেন।

ঠিক এই সময়েই হেমাঙ্গিনীর ডাক পড়িল; রায় মহাশয় নিজে ডাকিতেছিলেন। • একবার তোমার বেয়ানের কাছে যাও দেখিঃ বলে এস, পুরনো দলিলগুলি একবার দেখা দরকার। মানে, আমাদের রায়-বাড়ির মূল বণ্টননামায় চক্ আফজলপুরের কি চৌহদ্দি

এত সব কথা তোমার আমিও বুঝি নে, সুনীতিও বুঝবে না। কি বলছ তাই বল। তোমাদের মামলা মকদ্দমার হাঙ্গামায় আমাদের আহারনিদ্রা সুদ্ধ ঘুচে গেছে।

দলিলের বাক্সগুলো একবার দেখতে হবে। সেগুলো পাঠিয়ে-না থাক, বলে এস, আমিই যাব সন্ধ্যেবেলায়, সব দেখব। রামেশ্বরের ঘরেই যেন বাক্সগুলো বের করিয়ে রাখেন। হ্যাঁ, আরও বলো মঙ্গলবারে মা-সৰ্বরক্ষার পুজো হবে। কালিন্দীর বাঁধের মকদ্দমায় আমাদের একরকম জিতই হয়েছে। বাঁধ দিতে হলে বছর বছর একটা করে খাজনা দিতে হবে কলওয়ালাকে; তার অর্ধেক পাবে চক্রবর্তীরা-ওপারের চরের মালিক হিসাবে, আর অর্ধেক রায়হাটের মালিকরা পাবে। বর্ষা পড়লেই বাঁধ কেটে দিতে হবে।

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, যাব; এখনই অমল এল, তাকে জল খাইয়ে তারপর যাব। ছেলে বাড়ি এল, তার খোঁজ করা নেই, মামলা নিয়েই মেতে আছ! ধন্য মানুষ তুমি!

রায় বললেন, আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে অমলের। তিনি হাসিলেন, সে হাসিটুকু একান্ত ভাবে দোষক্ষালনের জন্য অপ্রতিভের হাসি। তারপর তিনি বলিলেন, কই অমল কই? একখানা আইনের বইয়ের জন্য লিখেছিলাম-অমল! অমল!–বলিয়া ডাকিতে ডাকিতে তিনি উপরে উঠিয়া গেলেন, পদক্ষেপে সিঁড়িটা যেন কাঁপিতেছিল।

হেমাঙ্গিনী সুনীতির কাছে আসিয়া উমার সহিত নির্জনে দেখা করিলেন। অমলের কথা শুনিয়া অবধি উমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করিবার জন্য তিনি ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছিলেন।

উমা একটু বিস্মিত হইল-এমন নির্জনে মা কি বলবেন? হেমাঙ্গিনী বলিলেন, একটা কথা জিজ্ঞেস করব উমা। সত্যি বলবি তো? আমার কাছে লুকাবি নি তো?

কি মা?

হ্যাঁরে অহীন তোকে চিঠিপত্র লেখে তো?

 লজ্জিত হইয়া উমা সবিস্ময়ে বলিল, লেখে বৈকি মা।

বেশ ভাল করে লেখে তো?

উমা হাসিয়া ফেলিল। হেমাঙ্গিনী বলিলেন, অমল বলছিল, অহীন নাকি তার সঙ্গে ভাল করে মেশে না। তার নাকি অনেক পরিবর্তন হয়েছে।

উমা গম্ভীরভাবে কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, তারপর বলিল, তিনি অনেক কথা ভাবেন মা। অনেক বড় বড় বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। সেই জন্য বোধ হয়

কন্যার গৌরববোধ দেখিয়া মা তৃপ্ত হইলেন। আর কোন প্রশ্ন করিলেন না।

***

হেমাঙ্গিনী তখনকার নিশ্চিন্ত হইয়াছিলেন, কিন্তু পূজার ছুটিতে অহীন্দ্র বাড়ি আসিলে তাহাকে দেখিয়া তিনি মনে মনে শঙ্কিত হইয়া উঠিলেন। অহীন্দ্রের দেহ শীর্ণ হইয়া গিয়াছে, মাথার চুল বিশৃঙ্খল, শরীরের প্রতি অমনোযোগের চিহ্ন সুপরিস্ফুট, অমনোযোগ না বলিয়া অত্যাচার বলিলেও অন্যায় হয় না। তাহার শীর্ণ দেহের মধ্যে চোখ দুইটি শুধু জ্বলজ্বল করিতেছে, কৃষ্ণপক্ষের রক্তাভ যুগল মঙ্গল গ্রহের মত।

তিনি সস্নেহে অহীন্দ্রের মাথায় হাত বুলাইয়া বলিলেন, শরীর তোমার এত খারাপ কেন বাবা?

অল্প একটু হাসিয়া অহীন্দ্র বলিল, শরীর? তারপর আবার একটু হাসিল, আর কোন উত্তর দিল না, যেন হাসির মধ্যেই উত্তর দেওয়া হইয়া গিয়াছে।

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, হাসির কথা নয় বাবা, শরীর বাঁচিয়েই সকল কাজ করতে হয়। এই গোটা সংসারটি তোমার মুখপানে তাকিয়ে আছে।

অহীন আবারও একটু হাসিল।

হেমাঙ্গিনী যাবার সময় কন্যাকে সতর্ক করিয়া দিলেন, উমা, তুই একটু যত্নটত্ন কর ভাল করে।

উমা মাথা হেঁট করিয়া নীরব হইয়া রহিল। হেমাঙ্গিনী বিরক্ত হইয়া উঠিলেন। বলিলেন, আমাদের কালের ঘোমটা দেওয়া কলাবৌ তো নস্। বেশ করে রাশ একটু বাগিয়ে ধরবি, তবে তো।

হেমাঙ্গিনী চলিয়া গেলে উমা মৃদু হাসিয়া ঘরে প্রবেশ করিল, অহীন্দ্র বলিল, সুস্বাগত বাঙালিনী!

গুড আফ্রন্টারনুন সায়েব। চমৎকার শরীরের অবস্থা কিন্তু সায়েবের!

বাঙালিনীর অভাবে সায়েবের এই অবস্থা। এখন তো কাছে পেয়েছ, এইবার বেশ গ্রামফেড মাটন করে তোল।

উমা হাসিয়া বলিল, উঁহু মাটন না, ওয়েল-ফেড হর্স। মা বলে গেলেন রাশ টেনে ধরতে। হাড়পাঁজরা ঝুরঝুরে আকাশে-ওড়া পক্ষিরাজকে মাটিতে নামতে হবে।

এবং নাদুসনুদুস হয়ে বাঙালিনীকে পিঠে নিয়ে গ্রুপথুপ করে চলতে হবে।

ঘর পরিস্কার করিয়া বিছানা করিবার জন্য দুয়ারে আসিয়া দাঁড়াইল মানদা। উমা একটু সারিয়া দাঁড়াইল। মানদা অহীন্দ্রকে দেখিয়া গালে হাত দিয়া বলিল, কি চেহারা হয়েছে দাদাবাবু!

সুনীতি কিছু বলিলেন না, কেবল তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে ছেলের দিকে চাহিয়া দেখিলেন। কয়েক দিন পরেই উমাও যেন কেমন শুষ্ক বিশীর্ণ হইয়া উঠিল। সেও সুনীতি দেখিলেন।

অবশেষে একদিন রাত্রির অন্ধকারে মা আসিয়া ছেলের সম্মুখে দাঁড়াইলেন। কোজাগরী পূর্ণিমা পার হইয়া গিয়াছে, সম্মুখে অমাবস্যা আগাইয়া-আসিতেছে, সেই অন্ধকারের মধ্যে ছাদে অহীন্দ্র একা বসিয়া ছিল। এমনই করিয়া সে এখন একা অন্ধকারে বসিয়া থাকে। কাছারিপ্রাঙ্গনের নারিকেল-বৃক্ষশীর্ষগুলি ছাদের আলিসার অল্প দূরে শূণ্যলোকে জটাজুটময় অশরীরীবৃন্দের মত স্তব্ধ হইয়া-যেন সভা করিয়া বসিয়া আছে; ঝাউগাছ দুইটার শীর্ণ দীর্ঘতময় শীর্ষদেশ হইতে ছেদহীন কাতর দীর্ঘশ্বাস ঝরিয়া পড়িতেছে। তাহারই মধ্যে সুনীতি নিঃশব্দে অহীন্দ্রের পাশে আসিয়া দাঁড়াইল। অহীন্দ্র জানিতে পারিল না।

সুনীতি ডাকিলেন, অহীন!

চমকিত অহীন্দ্র মুখ ফিরাইয়া বলিল, মা?

হ্যাঁ, আমি।

এস মা, বস। কিছু বলছ?

বলব। অন্ধকারে অহীন্দ্র মায়ের মুখ দেখিতে পাইল না, কিন্তু কণ্ঠস্বরের সুরে সে বেশ অনুভব করিল যে, তাঁহার মুখে সেই বিচিত্র করুণ হাসি ফুটিয়া উঠিয়াছে, যে হাসি তাহার মা ছাড়া বোধহয় এ পৃথিবীতে কেহ হাসিতে পারে না।

সুনীতি ছেলের পাশে বসিলেন, তাহার মাথাটি আপনার কোলের উপর টানিয়া লইয়া রুক্ষ চুলগুলি সযত্নে বিন্যস্ত করিয়া দিয়া বলিলেন, তোর কি হয়েছে বাবা?

কিছুই তো হয় নি। অহীন্দ্রের কণ্ঠস্বরে কপটতার লেশ ছিল না।

তবে?

কি মা?

তুই আমাদের কাছ থেকে এমন দূরে চলে যাচ্ছিস কেন বাবা?

দূরে চলে যাচ্ছি!-সবিস্ময়ে অহীন্দ্র প্রশ্ন করিল।

হ্যাঁ। মা বলিলেন, হ্যাঁ, দূরে চলে যাচ্ছিস, আমরা যেন তোর নাগাল পাচ্ছি নে।

অহীন্দ্র স্তব্ধ হইয়া রহিল। মা আবার বলিলেন, প্রথমে ভেবেছিলাম, তুই বুঝি আমার কাছ থেকেই সরে গেছিস। বৌমা-। কণ্ঠস্বরে তাঁহার লজ্জার রেশ ফুটিয়া উঠিল, বলিলেন, বিয়ের পর বৌয়ের ওপর ছেলের একটা টান হয়, তখন মায়ের কাছ থেকে ছেলে একটু সরে যায়। আমি ভেবেছিলাম তাই। কিন্তু বৌমার মুখ দেখে বুঝলাম, তাও তো নয়। মাঝে মাঝে তার হাসিমুখ দেখি, কিন্তু আবার দেখি তার মুখ শুকনো। আমি বেশ লক্ষ্য করে দেখেছি অহীন, শুকনো মুখই তার বেশির ভাগ সময় চোখে পড়ে।

অহীন যেমন স্তব্ধ হইয়া ছিল, তেমনি স্তব্ধ হইয়া রহিল। কিছুক্ষণ উত্তরের প্রতীক্ষা করিয়া মা বলিলেন, উমা তো অপছন্দের মেয়ে নয় অহীন।

না মা, না। উমাকে নিয়ে আমি অসুখী নই তো। অহীন্দ্রের কণ্ঠস্বরে আন্তরিক শ্রদ্ধার আভাস ফুটিয়া উঠিল।

তবে? মা প্রশ্ন করিলেন, তবে?

তবে? কি উত্তর আমি দেব মা? কথা শেষ করিয়া মুহূর্ত পরে সে সচকিত হইয়া উঠিল, বলিল, তুমি কাঁদছ মা? তাহার কপালের উপর অশ্রুবিন্দুর উষ্ণ স্পর্শে সে চমকিয়া উঠিল।

মা বলিলেন, নিরুচ্ছ্বসিত অথচ উদাস কণ্ঠস্বরে, জানি নে তুই আমার কাছে লুকোচ্ছিস কি না, কিন্তু সমস্ত চেহারার মধ্যে এক নতুন মানুষ ফুটে উঠছে অহীন। তুই কি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এর মধ্যে নিজেকে ভাল করে দেখিস নি? আমার সর্বশরীর শিউরে ওঠে মধ্যে মধ্যে তোর চোখের দৃষ্টি দেখে।

অহীন্দ্র বলিল, আমি আজকাল একটু বেশী চিন্তা করি। সে কথা সত্যি। কিন্তু আমার দৃষ্টির কথা কিংবা আমি নাগালের বাইরে, এ-সব তোমার কল্পনা মা।

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া মা বলিলেন, কি জানি! কিন্তু আমার মন কেন এমন হয়ে উঠেছে অহীন? যেন আমার কত দুঃখ কত শোক! দুঃখ আমার অনেক, কিন্তু যাদের জন্য দুঃখ, তাদের মুখ তো মনে পড়ে না আমার। তোর মুখই কেন চোখের ওপরে ভেসে ওঠে?

জীবনে তুমি আঘাত পেয়েছ মা, সে আঘাতের বেদনা এখনও তুমি সহ্য করে উঠতে পার নি, ও-সব চিন্তা তারই ফল। তুমি কেঁদো না, তোমার কান্না আমি সইতে পারি নে।

কিন্তু তুই এত কি ভাবিস, আমায় বল্ দেখি?

ভাবি? অহীন্দ্র হাসিল, বলিল, তুমি যা ভাবতে শিখিয়েছ, তাই ভাবি। আর কি ভাবব? ভাবি, মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা। মানুষ মানুষের ওপর অন্যায় অত্যাচার করে, সেই কথা ভাবি।

সুনীতি নীরব হইয়া বসিয়া রহিলেন। দুঃখ তাহার গেল না কিন্তু শোকের মধ্যে সান্তনার স্নেহস্পর্শের মত সন্তানগর্বের একটি নিরুচ্ছ্বসিত আনন্দ তাঁহার মনে জাগিয়া উঠিল। কিছুক্ষণ পর বলিলেন, আশীর্বাদ করি, তুই মানুষের দুঃখ দূর কর।

আবার তাঁহার চোখ জলে ভরিয়া উঠিল; কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছিয়া তিনি বলিলেন, সেই সঙ্গে মনে রাখিস বাবা, আমরা- আমি, উমা

মা! মা রয়েছেন নাকি? আচ্ছা মানুষ বাপু আপনি। সুনীতির কথায় বাধা দিয়া মানদা ঝি ঝঙ্কার দিতে দিতে ছাদের দরজার মুখে আসিয়া দাঁড়াইল; কথার সুর ও ভঙ্গির মধ্যে বক্তব্যের স্বরূপের একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত থাকে, মানদার কথায় সুনীতি ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, কি রে মানদা?

বাবা! এই অন্ধকারে মায়ে-পোয়ে ছাদে বসে রয়েছেন, তা কি করে জানব বলুন? সারা বাড়ি খুঁজে হয়রান। দাদাবাবুর শ্বশুর এসেছেন, শাশুড়ী এসেছেন, খুঁজছেন আপনাকে। দাদাবাবুর সম্বন্ধী এসেছেন।

ব্যস্ত হইয়া সুনীতি বলিলেন, নীচে আয় অহীন;-বলিয়া তিনি অগ্রসর হইলেন, অহীন্দ্রও তাঁহার অনুসরণ করিল। কোথাও কিছু পড়িয়া আছে কিনা দেখিতে দেখিতে মানদা আপন মনেই বলিল, কথায় বলে ‘কাতির শিশিরে হাতি পড়ে’। কার্তিক মাসে শিশির মাথায় করে এই অন্ধকারে–আচ্ছা মানুষ বাবা।

***

রায় আসিয়াছিলেন বৈষয়িক প্রয়োজনে, মামলা পরিচালনা সম্পর্কে একটি বিশেষ পরামর্শ করিবার প্রয়োজন হইয়াছে। রামেশ্বরের ঘরে তিনি বসিয়া আছেন। ঘরের মধ্যে মৃদু প্রদীপের আলো তেমনি জ্বলিতেছে, রামেশ্বর খাটের উপর বসিয়া রহিয়াছেন। রায়ের অদূরে রামেশ্বরের খাটের সম্মুখে অতি নিকটেই বসিয়া আছেন হেমাঙ্গিনী; উমা ঘরের কোনে টেবিলের উপর বই গুছাইয়া রাখিতেছে। শ্বশুর ও পুত্রবধূতে মিলিয়া কাব্যলোচনা হইতেছিল। উমার কল্যাণে রামেশ্বর অল্প একটু সুস্থ হইয়া উঠিয়াছেন। সুনীতি যখন ঘরে প্রবেশ করিলেন, তখন সদ্য কোন হাস্যপরিহাস শেষ হইয়াছে, সকলের মুখেই হাসির রেখা ফুটিয়া রহিয়াছে। হেমাঙ্গিনী অপ্রতিভ মুখে হাসিতে হাসিতে বলিতেছেন, কথায় আপনার সঙ্গে কেউ পারবে না। আমি হার মানছি।

রামেশ্বর হাসিয়া বলিলেন, তা হলে আপনার কাছে আমার মিষ্টান্ন প্রাপ্য হল।

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, মিষ্টান্ন আমাকেই আপনার খাওয়ানো উচিত, কারন আপনি জিতেছেন।

রামেশ্বর হাসিয়া একটি কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, আপানার কথায় বড়ই দুঃখ পেলাম দেবী। রায় হল রাজশব্দের অপভ্রংশ; রায়-গিন্নী আপনি, আপনি হলেন রাণী। মিষ্টান্ন বস্তুটা চিরদিন রাণী এবং রাজকূল কথায় পরাজিত হয়ে বয়স্যগণকে করস্বরূপ প্রদান করে এসেছেন। আজ সেই বস্তুর দিকে যদি আপনার হস্ত প্রসারিত হয়, তবে সে হস্তকে রাজহস্তে সমর্পণ করা ছাড়া তো গত্যন্তর দেখি না।

হেমাঙ্গিনী ঘরের মধ্যে উমার অস্তিত্ব স্মরণ করিয়া লজ্জিত হইয়া পড়িলেন, তাহাকে সরাইয়া দিবার জন্যই বলিলেন, উমা, অমল বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, দে তো মা।

উমা চলিয়া গেল, উহার নাম উচ্চারণে রামেশ্বরও সংযত হইয়া উঠিলেন।

রায় হাসিতেছিলেন, তিনিও অকস্মাৎ গম্ভীর হইয়া কাজের কথা পাড়িয়া বসিলেন, এমনি একটা সুযোগের প্রতীক্ষাই যেন তিনি করিতেছিলেন। কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকিয়া গলা ঝাড়িয়া লইয়া তিনি বলিলেন, রামেশ্বর, তোমার সঙ্গে কয়েকটি জরুরী বিষয় আলোচনার জন্য এসেছি।

গম্ভীরভাবেই রামেশ্বর হাসিলেন, বলিলেন, চক্ষুষ্মান পথভ্রান্ত হলে নিরুপায়ে অন্ধের কাছেও পথ জিজ্ঞাসা করে। কি বলছ, বল? দিক বলতে না পারি, সম্মুখ পশ্চাৎ দক্ষিণ বাম-এগুলো বলতে পারব। পথের পারিপার্শ্বিক চিহ্নের কথা বলতে পারব না, তবে বন্ধুরতার বিষয় বলতে পারব।

রায় বলিলেন, মানমর্যাদা নিয়ে মকদ্দমা, অথচ টাকার অভাব হয়ে পড়ল রামেশ্বর! আমার হাত পর্যন্ত শুকনো হয়ে এল। এ ক্ষেত্রে রামেশ্বর বলিলেন, অধর্মকে বর্জন করে সাক্ষাৎ নারায়ণরূপী রামের শরণাপন্ন হয়েও বিভীষণ অমর হয়ে কলঙ্ক বহন করেছেন। মামলা শেষ পর্যন্ত লড়তেই হবে ইন্দ্র। টাকা না থাকে ঋণের ব্যবস্থা কর।

না। রায় গম্ভীরভাবে ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, না। ঋণ করতে গেলে শেষ পর্যন্ত ওই কলওয়ালার কবলস্থ হতে হবে। লোকটা ধরাট দিয়েও সে-খত কিনবে। সুদখোরের মত ধূর্ত এবং লোভী এ সংসারে আমি তো কাউকে দেখি না, তারা অর্থের লোভে সব করতে পারে; এ খত তো তারা বিক্রি করবেই!

রামেশ্বর স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। রায় বলিলেন, মহলে যে-সব খাস জোত আছে, তারই কিছু বন্দোবস্ত করে দেওয়াই কি ভাল নয়?

রামেশ্বর কোন উত্তর দিলেন না। তিনি চিন্তা করিতেছিলেন, কিছুক্ষণ পরেই তাঁহার দুর্বল মস্তিষ্কে সব যেন গোলমাল হইয়া গেল। শূণ্য অর্থ হীন স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া তিনি বসিয়া রহিলেন।

রায় তাহাকে ডাকিলেন, রামেশ্বর! রামেশ্বর নড়িয়া চড়িয়া বসিলেন, একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, ইন্দ্র!

তা হলে তাই করি, কি বল?

অনেকক্ষণ ধরিয়া কথাটা স্মরণ করিয়া সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, হ্যাঁ, সেই ভাল। ঋণ-না ভাল নয়। শেষ পর্যন্ত বডি ওয়ারেন্ট করে।

.

বাতাসেরও কান আছে। জমি বন্দোবস্তের কথা প্রকাশ করিয়া জানাইতে হইল না। অথচ সমস্ত গ্রামময় কথাটা রটিয়া গেল।

দুই-তিন দিন পরেই গ্রামের চাষীরা ছুটিয়া আসিয়া পড়িল, ‘জমি যখন বন্দোবস্তই করবেন, তখন চরের ওই ভাগে-বিলি-করা জমিটা আমাদের বন্দোবস্ত করিয়া দিন। এক-শ বিঘা জমির বিঘা-পিছু ত্রিশ টাকা হিসাবে সেলামী এবং দুই টাকা হারে খাজনা দিতে আমরা প্রস্তুত।’ দলটির সর্বাগ্রে ছিল রংলাল।

রায় ভ্রু কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন, এত টাকা তোরা পাবি কোথায়?

রংলাল বলিল, আজ্ঞে, আমরা তিরিশ জনায় লোব। জনাহি একশ টাকা আমরা যোগাড় কোনরকমে করব।

গভীর ব্যগ্রতায় সে রায়ের পা দুইটি জড়াইয়া ধরিল, হেই হুজুর। নইলে এ চরণ আমরা কিছুতেই ছাড়ব না।

রায় বিবেচনা করিয়া দেখিলেন, এত বেশী টাকা অন্য মহলে জমি বন্দোবস্ত করিয়া পাওয়া যাইবে না। তা ছাড়া চাষীরাও গোলাম হইয়া থাকিবে।

যোগেশ মজুমদার আসিয়া পাঁচ হাজার টাকা সেলামী দিতে চাহিল, কিন্তু রায় হাসিয়া বলিলেন, না!

.

৩৩.

আরও মাস তিনেক পর।

মাঘ মাসের প্রথমেই একদিন প্রাতঃকালে কলের মালিক অকস্মাৎ সমস্ত চরটাই দখল করিয়া বসিলেন, রংলাল-প্রমুখ চাষীরা যে-জমিটা অল্পদিন পূর্বে জমিদারের নিকট বন্দোবস্ত করিয়া লইয়াছিল। সে অংশটা পর্যন্ত দখল করিয়া লইলেন।

মোটর-সংযুক্ত বিলাতী লাঙল চালাইয়া চরের সমস্ত আবাদী জমি এ-প্রান্ত হইতে ও-প্রান্ত পর্যন্ত চষিয়া এক করিয়া দিল। সংবাদ পাইয়া সমস্ত রায়হাট গ্রামখানাই বিস্ময়ে কৌতূহলে উত্তেজনায় মাতিয়া উঠিল। চরের উপর কলের লাঙল আসিয়াছে। গরু নাই, মহিষ নাই, কোন লোক লাঙলের মুঠা ধরিয়া নাই, অথচ চাষ হইয়া চলিয়াছে। কেবল একজন লোক গাড়ির মত কলটার উপর বাবুর আরামে বসিয়া আছে, হাতে পায়ে দু-একটা কল ঘুরাইতেছে টিপিতেছে, আর গাড়িটা চলিতেছে, পিছনে ইয়া মোটা মোটা মাটির চাঁই উল্টাইয়া পড়িতেছে। ওটা নাকি মোটরের লাঙল, ঠিক মোটরের ধোঁয়া ছাড়ে শব্দ করে। ভটভট শব্দ করিয়া বুনো শূকরের মত এ-প্রান্ত হতে ও-প্রান্ত ছুটিয়া চলিয়াছে; বাধাবিঘ্ন বলিয়া কিছু নাই, উঁচু-নীচু খাল-টিপি সব উখড়াইয়া দিয়া চলিয়াছে।

গ্রামের অবালবৃদ্ধ কালিন্দীর ঘাট হইতে চর পর্যন্ত ভিড় জমাইয়া ছুটিয়া আসিল। বনিতারা সকলে না আসিলেও অনেকে আসিয়াছিল। তাহারা কালিন্দীর এ-পারেই দাঁড়াইয়া ছিল। চাষীদের বউগুলি দাঁড়াইয়া ঘোমটার অন্তরালে কেবলই কাঁদিতেছিল। তাহারা কল দেখিতে আসে নাই, তাহারা দেখিতেছিল, তাহাদের। জমি চলিয়া যাইতেছে। দূরান্তর হইতে প্রিয়জনের মৃত্যুশয্যার শিয়রে যেমন মানুষ আসিয়া অঝোরঝরে কাঁদে, আর নির্নিমেষ নেত্রে মৃত্যুপথযাত্রীর দিকে চাহিয়া থাকে, এ দেখিতে আসা তাহাদের সেই দেখিতে আসা। তাহাদের চোখে সেই মমতাকাতর দৃষ্টি। চাষীরা কিন্তু আসে নাই। সমবেত জনতা প্রতি মুহূর্তে প্রত্যাশা করিতেছিল, চাষীদের সঙ্গে ছোট রায়-বাড়ি ও চক্রবর্তী-বাড়ির পাইকেরা রে রে করিয়া আসিয়া পড়িল বলিয়া। কিন্তু বহুক্ষণ চলিয়া গেল, তবু কেহ আসিল না। ও-দিকে চরটা সমস্তই চষিয়া ফেলিয়া কলটা স্তব্ধ হইল।

রায়-বাড়ির ও চক্রবর্তী-বাড়ির পাইকদের না আসিবার কারণ ছিল। তাহারা আর কোনদিন আসিবে না। চর লইয়া জমিদার ও কলের মালিকের দ্বন্দ্বের সমাপ্তি ঘটিয়াছে। জমিদারপক্ষ সমস্ত মামলায় হারিয়া গিয়াছেন। গত কাল অপরাহ্নে বিচারকের রায় বাহির হইয়াছে, সংবাদটা এখনও সকলের মধ্যে প্রচারিত হয় নাই।

মামলার পরাজয়ের সংবাদ সুনীতিও জানিতেন না। ইন্দ্র রায় সে সংবাদ এখন তাঁহাকে জানাইতে পারেন নাই, সুনীতি কেন, হেমাঙ্গিনীকেও জানাইতে তাহার বাধিয়াছে। কলের মালিক কলের লাঙল চালাইয়া চর দখল করিতেছেন। সংবাদ পাইয়া সুনীতি নূতন দাঙ্গা-হাঙ্গামার আশঙ্কায় উদ্বেগে অস্থির হইয়া উঠিলেন। ভাঁড়ার বাহির করিতে গিয়া তাঁহার হাত কাঁপিতেছিল। নীরবে নতমুখে বাঁটির উপর বসিয়া উমা শ্বশুরের জন্য আনারস ছাড়াইয়া কুটিতেছিল। এমন সময় মানদা ছড়া কাটিয়া ভণিতা করিয়া বাড়ি ফিরিল; সেও কলের লাঙল দেখিতে গিয়াছিল। চোখ দুইটি বড় করিয়া গালে হাত দিয়া বলিল, ‘যা দেখি নাই বাবার কালে, তাই দেখালে ছেলের পালে! কালে কালে আরও কত হবে, বেঁচে থাকলে আরও কত দেখব।

সুনীতি ব্যাগ্রভাবে প্রশ্ন করিলেন, কোনও খুনখারাপি হয় নি তো?

না গো না। কেউ যায়ই নাই। দিব্যি কলের লাঙল চালিয়ে এ-মুড়ো থেকে ও-মুড়ো পর্যন্ত চষে নিলে কলওয়ালা।

সুনীতি পরম স্বস্তিতে একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিলেন। মানদার আসল বক্তব্য তখনও শেষ হয় নাই। সে বলিয়াই গেল, গরু নাই, মোষ নাই, চাষা নাই, লাঙলের ফাল নাই-এই একটা গাড়ির মতন, ফটফট শব্দ করে চলেছে, আর জমি চাষ হয়ে যাচ্ছে। এক দণ্ডে এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত চাষ হয়ে গেল।

উমা মৃদু হাসিয়া বলিল, ওটা হল মোটরের লাঙল, মোটর গাড়ি তো আপনি চলে দেখেছ, এও তেমনি চলে। নীচে বড় বড় ধারালো ইস্পাতের ছুরি লাগানো আছে, মোটরটা চলবার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো মাটি কেটে উলটে দিয়ে যায়।

মানদা সবিস্ময়ে মৃদুস্বরে বলিল, তাই সবাই বলছে বৌদিদি। আর ধোঁয়া ছাড়ছে কলটা, তার গন্ধ নাকি অবিকল মোটরের ধোঁয়ার গন্ধের মত। কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া আবার সে বলিল, আঃ, অনাথা গরু-মোষের অন্নই মারা গেল, আর কি!

সকৌতুকে উমা মানদার দিকে চাহিল, মানদা বলিল, গরু-মোষ তো আর কেউ পালাবে না বৌদিদি, না খেতে পেয়েই ওরা মরে যাবে!

উমা এবার বেশ একটু জোরেই হাসিয়া উঠিল। সুনীতি মৃদু হাসিয়া বলিলেন, তা এতে এমন করে হাসছ কেন বউমা? ও-বেচারার যেমন বুদ্ধি তেমনি বলছে।

মানদা একটা সমর্থন পাইয়া বেশ জাঁকিয়া উঠিয়া কি বলিতে গেল, কিন্তু নবীন বাগদীর স্ত্রী মতি বাগদিনী হন্তদন্ত হইয়া বাড়ির মধ্যে আসিয়া পড়ায় সে-কথা তাহার বলা হইল না। মতির মুখে প্রচণ্ড উত্তেজনাভরা উচ্ছ্বাস; সে বাড়িতে প্রবেশ করিয়াই ডাকিল, রাণীমা!

কি রে? কি হয়েছে বাগদীবৌ? সুনীতি শঙ্কিত হইয়া প্রশ্ন করিলেন। চরে কি আবার

 চরে নয় মা, রংলাল মোড়লের এক-পাটি দাঁত লাথি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন রায়হুজুর।

 সে কি? কেন?

ওই চরের জমির লেগে মা। চরের জমি লিয়ে চাষীরা নাকি কলের সায়েবের সঙ্গে কি ষড় করেছিল। সায়েব আজ চর দখল করেছে কিনা! তাই জানতে পেরে

সুনীতির মুখ বিবর্ণ হইয়া উঠিল। ঠোঁট দুইটি থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল। রংলালের মুখ তাহার মনে পড়িয়া গেল, নির্বোধ দৃষ্টি, ঘোলাটে চোখ, পুরু ঠোঁটে বিনীত তোষামোদভরা হাসি; আহা সেই মানুষকে! টপ টপ্‌ করিয়া চোখের জল মাটির উপর ঝরিয়া পড়িল।

উমা বটি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল, সে জমিদার-কন্যা জমিদার বধু হইলেও নবীন যুগের মেয়ে, তাহার উপর মুহর্তে তাহার মনে পড়িয়া গেল অহীন্দ্রকে। মানুষের মুখে লাথি মারার কথা শুনিয়া সে যে কি বলিবে, হয়তো কিছু বলিবে না, কিন্তু অদ্ভুত দৃষ্টিতে চাহিয়া থাকিবে, ক্ষুরধার মৃদু হাসি হাসিবে। সে বলিল, আমি একবার ও-বাড়ি যাব মা।

সুনীতি বলিলেন, মানদা, সঙ্গে যা মা। তুমি দেখো বউমা, আর যেন কোন উৎপীড়ন না হয় গরীবের ওপর। বলো, ও-চর আমি চাই না, ও যাওয়াই ভাল।

উমা ও মানদা চলিয়া গেল, সঙ্গে সঙ্গে মতিও গেল। মতি এখন সাধ্যমত প্রহরিণীর কাজ করিয়া স্বামীর কাজ বজায় রাখিবার চেষ্টা করে। প্রয়োজন হইলে লাঠি হাতে লইতেও লজ্জিত হয় না।

সুনীতি স্তব্ধ উদাস হইয়া বসিয়া রহিলেন।

সর্বনাশা চর! ওই চরের জন্যই এত। তাহার মনে পড়িল, এই লইয়া দ্বন্দ্বের প্রথম দিন হইতে রংলাল জড়িত আছে। খানিকটা জমির জন্য বেচারা চাষীর কি লোলুপ আগ্রহ! নবীনদের দাঙ্গার মকদ্দমাতেও রংলাল জড়িত ছিল। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতচমকের মত মনে পড়িয়া গেল একদিনের কথা। নবীনদের মকদ্দমার সময়েই একদিন তিনি চরটাকে যেন ঘুরিতে দেখিয়াছিলেন; এই বাড়িটাকেই কেন্দ্র করিয়া চক্রান্তের চক্র সৃষ্টি করিয়া ঘুরিতেছিল। সেটা কি আজও ঘুরিতেছে? নইলে ওই নিরীহ চাষীর মুখ দিয়া এমন করিয়া রক্ত ঝরিয়া পড়িল কেন? সর্বনাশা চর!

তাহার ভাবপ্রবণ অনুভূতিকাতর মন শিহরিয়া উঠিল। না, ও-চরের সঙ্গে আর কোন সংস্রব তিনি রাখিবেন না। অহীন্দ্রকে তিনি আজই পত্র লিখিবেন, সে আসুক, চর বিক্রয় করিবার জন্য সে আসুক।

সঙ্গে সঙ্গে মনে হইল, সে আজ পনেরো দিনের উপর পত্র দেয় নাই। সে আজকাল কেমন যেন হইয়াছে!

***

প্রাতঃকাল হইতেই রায় গুম হইয়া বসিয়াছিলেন।

ভোর রাত্রে সদর হইতে মামলার সংবাদ লইয়া লোক ফিরিয়া আসিয়াছে। সমস্ত মামলাতেই জমিদার পক্ষ পরাজিত হইয়াছেন। চর লইয়া সমস্ত দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি ঘটিয়াছে। মাথা হেঁট করিয়া নিস্পন্দের মত তিনি বসিয়া রহিলেন। তাহার পরই সংবাদ আসিল, কলের মালিক মোটর লাঙল চালাইয়া চর দখল করিতেছে, এমন কি হালে বন্দোবস্ত করা চাষীদের জমিও দখল করিয়া লইতেছে। রায় সোজা হইয়া বসিলেন, আবার একটি সুযোগ মিলিয়াছে। চাষীদের সম্মুখে রাখিয়া আর একবার লড়িবেন তিনি। নায়েব মিত্তিরকে ডাকিয়া তিনি বলিলেন, জলদি বাগদীদের আর কাহারদের তলব দাও। আর চাষীদের ডাকাও দেখি।

সঙ্গে সঙ্গে লোক ছুটিল। রায় আবার গোঁফে পাক দিতে আরম্ভ করিলেন। চেয়ার ছাড়িয়া তিনি উঠিয়া পড়িলেন। সন্ধ্যার অন্ধকারের জন্য প্রতীক্ষামান গুহাচারী অস্থির বাঘের মত বারান্দায় পায়চারি আরম্ভ করিলেন। ঠিক এই সময়েই রংলাল আসিয়া তাহার পায়ের উপর উপুড় হইয়া পড়িল, ডাকিবার পূর্বেই সে নিজেই আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে।

রায় সস্নেহে বলিলেন, ও ও, ভয় নেই। আমি লাঠিয়াল দিচ্ছি, তোদের কিছু করতে হবে না, তোরা কেবল দাঁড়িয়ে থাকবি, দেখবি। টাকা পয়সা সমস্ত খরচ আমার, কোনও ভয় নেই তোদের।

রংলাল ভেউ ভেউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, আমরা যে নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মেরেছি হুজুর!

রায় চমকিত হইয়া উঠিলেন, এই নির্বোধদের তিনি ভাল করিয়াই জানেন। ইহাদের সকলের চেয়ে বড় নির্বুদ্ধিতা এই যে, ইহারা নিজেদের ভাবে অতি বুদ্ধিমান-ভীষণ চতুর। বৈষয়িক জটিল বুদ্ধির প্রতি, কুটিল চাতুরির প্রতি এদের গভীর আসক্তি। সচকিত হইয়া রায় বলিলেন, কি করেছিস, সত্যি করে বল দেখি? সত্য কথা বলবি। ছাড় পা ছাড়-। তিনি আবার চেয়ার টানিয়া বসিলেন।

হাতের তালুর উলটা পিঠ দিয়া চোখ মুছিতে মুছিতে রংলাল বলিল, আজ্ঞে হুজুর, ওই মজুমদারের ধায় পড়ে, উনিই বললেন, হুজুর

মজুমদার কি বললে?

বললে টাকার ভাবনা কি? আমি টাকা দেব।

 কিসের টাকা?

আজ্ঞে, সেলামীর টাকা। আমাদের টাকা ছিল না হুজুর। উনিই আমাদিগে টাকা দিয়েছিলেন। আমাদের ‘বাপুতি’ সম্পত্তি বন্ধক নিয়ে দলিল করে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, চরের জমি বন্দোবস্ত হয়ে গেলে এ দলিল ফেরত দিয়ে চরের জমি বন্ধক দিয়ে দলিল করে নিতে হবে। এখন নতুন দলিলে সই করিয়ে নিয়ে বলছে হুজুর, বন্ধক নয়, জমি তোদের বিক্রি হয়ে গেল, এ দলিল কবলা-দলিল।

অজগরের মত একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া রায় বলিলেন, হুঁ।

হুজুর আমাদের কি হবে?

 দলিল তোরা রেজেস্ত্রী করিস নে।

দলিল যে রেজেস্টারী হয়ে গেল হুজুর। নইলে যে সাবেক বন্ধকী দলিল ফেরত দিচ্ছিল না।

 রংলাল আবার ফোঁসফোঁস করিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল।

রায় রুদ্ধমুখ আগ্নেয়গিরির মত বসিয়া রহিলেন। এই নির্বোধ অথচ কূটমতি অপদার্থগুলির উপর ক্রোধের তাঁহার সীমা রহিল না। তাঁহার জমিদার মন হতভাগ্যের নিরুপায় দিকটা দেখিতে পাইল না। হতভাগ্য অন্ধ বাঘের লেজে পা দিলে বাঘ তাহার অন্ধত্ব দেখিতে পায় না।

রংলাল তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া বসিয়া ছিল, রায়ের কোন উত্তর না পাইয়া সে আবার তাঁহার পা দুইটি চাপিয়া ধরিল। আর রায়ের সহ্য হইল না, প্রচণ্ড ক্রোধে তিনি ফাটিয়া পড়িলেন, রংলালের মুখে সজোরে লাথি মারিয়া আপনার পা ছাড়াইয়া লইলেন। সেই আঘাতে রংলালের সম্মুখের দুইটা দাঁত উপড়াইয়া গিয়া তাহার নির্বোধ মুখখানাকে রক্তাক্ত করিয়া দিল।

হেমাঙ্গিনী কিছু বলিতে সাহস করেন নাই, কিন্তু উমা করিল। বাপের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, ছি ছি ছি, এ কি করলে বাবা? সে যাই হোক, সে তো মানুষ!

রায় নীরবে ঘরের মধ্যে একা পদচারণা করিতেছিলেন, তিনি থমকাইয়া দাঁড়াইলেন, মেয়ের মুখের দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিলেন, পাপ করেছি মা। মানুষ আমি, মতিভ্রম হয়েছিল। কিন্তু রংলালের পায়ে ধরে প্রায়শ্চিত্ত তো করতে পারব না।

এ কথার উত্তরে উমা আর কিছু বলিতে পারিল না, সে যেন এতটুকু হইয়া গেল। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া রায় ডাকিলেন, তারা, তারা মা!

উমা এবার লজ্জিত হইয়া কুণ্ঠিত স্বরে বলিল, আপনি একটু বসুন বাবা, আমি বাতাস করি।

রায় হাসিলেন, কিন্তু কন্যার কথা উপেক্ষা করিলেন না, বসিলেন। বসিয়া বলিলেন, মানুষের দিন যখন শেষ হয়, তখন অমনি করেই মতিভ্রম হয়। আমাদের দিন শেষ হয়েছে মা।

উমা শিহরিয়া উঠিল, ও কি বলছেন বাবা?

মরণের কথা বলছি না মা, আমাদের সুদিনের কথা বলছি। চাষীরা সব আমাদের বিপক্ষ হয়ে কলের মালিকের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। অথচ একদিন খুন করলেও তারা আমাদের বিপক্ষে কথা বলে নি, বিচার বলে মেনে নিয়েছে।

উমা চুপ করিয়া রহিল।

রায় বলিলেন, আজ একটা কথা মুখ দিয়ে বের করতে লজ্জার আমার মাথা কাটা যাচ্ছে মা। অথচ তোর শ্বশুর-শাশুড়ীকে বলতেই হবে। তুই-ই সে কথাটা বলে দিবি মা।

কিছুক্ষণ প্রতীক্ষা করিয়া উমা বলিল, বলুন।

 চরের সমস্ত মকদ্দমায় আমাদের হার হয়েছে মা।

উমা একটা নিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিল, বলব।

আমার অনেক লজ্জা মা। জেদের বশে তোর শ্বশুরদের আমি অনেক অনিষ্ট করে দিলাম। সম্পত্তি তো শুধু অহীন্দ্রের নয়, মহীন্দ্রও ফিরে আসবে। লজ্জা আমার তার কাছেই হবে বেশি। আমার ইচ্ছে কি জানিস? আমার সম্পত্তির অর্ধেক আমি অহীন্দ্রকে উপলক্ষ করে ওদের দুজনকেই দিই। অহীন্দ্রের শ্বশুর হিসাবে নয়, সুনীতির ভাই সম্বন্ধ নিয়েই দিতে চাই।

উমা বলিল, বেশ তো, বিবেচনা করে যা হয় করবেন। কিন্তু কিছুদিন যাক, নইলে ওঁরা ভাববেন, আপনি ক্ষতিপূরণ দিচ্ছেন।

রায় হাসিয়া বলিলেন, কিছুদিন সময় আর আমার নেই মা। আমি আর সংসারে থাকব না, আমি কাশী যেতে চাই।

উমা মৃদুস্বরে বলিল, সংসারে হারজিত তো আছেই বাবা। তার জন্যে কাশী কেন যাবেন?

হেমাঙ্গিনী আসিয়া ঘরে প্রবেশ করিলেন, তার হাতে শরবতের গ্লাস। উমা আসিয়াছে- এই সুযোগে তিনি রায়কে শরবত খাওয়াইতে ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছেন।

রায় বলিলেন, আজ আহ্নিকে বসে জপ ভুলে গেলাম, মায়ের রূপ ধ্যান করতে পারলাম না। শুধু বললাম, চর চর, মামলা মামলা; আর ধ্যান করলাম, ওই রংলাল আর কলওয়ালার মুখ। আর নয়, আর সংসার নয় মা, আমি মন স্থির করে ফেলেছি, আমি কাশী যাব।

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, বেশ তাই হবে। কিন্তু সে তো আর এখুনি নয়। এখন শরবতটা খাও দেখি।

***

চরের মামলায় পরাজয় হইয়াছে, চরটার সাথে সকল প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ শেষ হইয়া গিয়াছে- সংবাদটা শুনিয়া সুনীতি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন। দুঃখের দীর্ঘনিঃশ্বাস। অথচ এই কামানা তিনি কিছুক্ষণ পূর্বেই শুধু নয়, চর লইয়া দ্বন্দ্ব আরম্ভ হইবার পর হইতেই অহরহ করিয়া আসিয়াছেন। বার বার তিনি মনে করিতে চেষ্টা করিলেন, ভালই হইয়াছে, ভাগ্যবিধাতা নিষ্ঠুর চক্রান্ত হইতে তাহাকে নিষ্কৃতি দিলেন। কিন্তু স্মৃতির মমতা তাঁহাকে তাহা ভাবিতে দিল না। তাঁহার মহীন্দ্র দ্বীপান্তরে গিয়াছে ওই চরের জন্য, তিনি নিজে প্রকাশ্য আদালতে দাঁড়াইয়াছেন ওই চরের জন্য। সংসারের চরম দুঃখের বিনিময়ে যাহা পাওয়া যায়, তাহার এক পরম মূল্য আছে।

আজ অহরহ তাঁহার মনে পড়িতে লাগিল মহীন্দ্রকে। দিনান্তে সন্ধ্যার সময় তিনি আসিয়া বারান্দায় বসিলেন। ও-পারের চরের উপর আজ বাজনা বাজিতেছে, আনন্দোন্মত্ত মানুষের কোলাহল ভাসিয়া আসিতেছে। হিন্দুস্থানি ঢোলক বাজিতেছে, আরও অনেক বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি শোনা যাইতেছে, কলের মালিক বোধ হয়। বিজয়োৎসব জুড়িয়া দিয়াছে। তিনি ছাদে গিয়া উঠিলেন, ছাদ হইতে চর, কালিন্দীর গর্ভ পরিষ্কার দেখা যায়। বাদ্যযন্ত্র ও কোলাহলের শব্দ স্পষ্ট হইয়া উঠিল।

অন্ধকার গাঢ় হইয়া আসিয়াছিল, দূরের চরের উপর আলো জ্বলিতেছে, আলোর ঘটা আজ অনেক বেশী। কালিন্দীর শুষ্ক গর্ভে বালির উপর একটা আলোর সমারোহ, মশালের আলোর মত দুই তিনটা আলো জ্বলিতেছে-রক্তাভ আলো! আলোর চারিপাশে ক্ষুদ্র একটা জনতার মধ্যস্থলে একটি দীর্ঘাঙ্গী কালো মেয়ে হাত ঘুরাইয়া, দেহ বাঁকাইয়া নানা ভঙ্গিতে নাচিতেছে।

মা!

সুনীতি চমকিয়া উঠিলেন, কে? পরক্ষণেই ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, বউমা!

উমাই ডাকিতেছিল, সে বলিল, এই আলোয়ানখানা গায়ে দিন মা, বড় কনকনে হাওয়া দিচ্ছে।

সত্য এইবার শীতটা বেশ তীক্ষ্ণ হইয়া উঠিয়াছে। সুনীতি আলোয়ানখানি গায়ে দিয়া সস্নেহে বধুর দিকে চাহিয়া রহিলেন। উমা আজ মনে মনে লজ্জিত হইয়া ছিল, তাহার বাবা আজ সকালে যে বলিয়াছিলেন, আমি জেদের বশে অনেক ক্ষতি করে দিয়েছি, সেই কথাটা তাহার মনের মধ্যেও সংক্রামিত হইয়াছে। সে মাথা হেঁট করিল। অন্ধকারের মধ্যে সুনীতি উমার মুখ দেখিতে পাইলেন না বলিয়া কিছু বুঝিতেও পারিলেন না। সস্নেহেই তিনি প্রশ্ন করিলেন, আর কিছু বলছ বউমা?

না।–বলিয়া সে মন্থর পদক্ষেপে সিঁড়ির দরজা অতিক্রম করিয়া নীচে নামিয়া গেল। এপাশে সুনীতির সম্মুখে চক্রবর্তী-বাড়ির কাছারির প্রাঙ্গণে নারিকেল গাছগুলির মাথা, অন্ধকারের মধ্যে জটাজুটধারী তমোলোকবাসীদের মত শূন্যলোকে সভা করিয়া বসিয়া আছে। দীর্ঘ পাতাগুলির মধ্যে কি যেন গোপন কথার কানাকানি চলিতেছে। সুদীর্ঘ ঝাউগাছ দুইটা মর্মন্তুদ বেদানায় যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলিতেছে।

সুনীতির মনে পড়িয়া গেল অহীন্দ্রের কথা। বেশী দিন নয়, অল্পদিন পূর্বেই, এই ছাদে এমনি অন্ধকারে এমনি আবেষ্টনের মধ্যে অহীন্দ্র একা শুইয়া ছিল; তিনি আসিয়া তাহার কাছে বসিয়া কাতর-ভাবে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, কেন তুই দূরে চলে যাচ্ছিস, অহীন? আমরা যে তোর নাগাল পাচিচ্ছ নে বাবা?

তাঁহার আজিকার বিচলিত মন একেবারে অস্থির হইয়া উঠিল। অহীন্দ্র আজ পনেরো দিন পত্র দেয় নাই পুজোর ছুটির পর সেই গিয়াছে আর আসে নাই। যে-পত্র সে লেখে, সেও যেন কেমন-কেমন, মাত্র দুই তিন ছত্র। উমা চলিয়া গেল, তাহার মন্থর গতি এখন একটা অর্থ লইয়া তাহার মনের মধ্যে জাগিয়া উঠিল। উমা শুকাইয়া গিয়াছে। তাহাকেও কি সে এমনি ভাবে পত্র লেখে? সেও কি তাঁহারই মত তাহার নাগাল পায় না? দ্রুত ছাদের সিঁড়ির মুখে আসিয়া তিনি ডাকিলেন, বউমা বউমা! উমা!

মা!

উমা আবার আসিয়া তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইল।

অহীন তো তোমাকে পত্র দেয় নি বউমা!

 উমা নীরবে নতমুখে দাঁড়াইয়া রহিল।

অহীন কেন এমন হল? আমার মন যেন কেমন হাঁপিয়ে উঠেছে।

আজ সমস্ত দিনটা উমার মনও বিচলিত হইয়া ছিল, সে আর থাকিতে পারিল না। কাঁদিয়া ফেলিল, অন্ধকারের মধ্যে কম্পনত্রস্ত দেহ দেখিয়া উমার কান্না সুনীতি অনুমান করিলেন, বধুর মুখে হাত দিয়া তিনি চমকাইয়া উঠিলেন, বলিলেন, কাঁদছ কেন বউমা? কি হয়েছে মা? আমাকে বলবে না?

উমা আর গোপন করিতে পারিল না; নূতন যুগের মেয়ে সে, আধুনিক শিক্ষাদিক্ষার সহিত পরিচয়ের ফলে অহীন্দ্রের যে-কথা সে স্বীকার করিয়া লইয়াছে, কঠিন উদ্বেগ আশঙ্কা সহ্য করিয়াও এতদিন গোপন রাখিয়াছিল, আজিকার এই বিচলিত চরম মূহর্তটিতে অহীন্দ্রের মায়ের কাছে তাহা প্রকাশ করিয়া ফেলিল। সবটা সে জানিত না, যতটুকু জানিত ধীরে ধীরে ততটুকুই বলিল।

সুনীতির সর্বাঙ্গ থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল, সমস্ত ব্যাপারটা না বুঝিলেও তাহা যে ভয়ঙ্কর কিছু ইহা অনুভব করিলেন; ব্যাকুল আশঙ্কায় অধীর হইয়া তিনি প্রশ্ন করিলেন, এরা কি চায় মা?

ঠিক তো জানি না মা। তবে মনে হয়, এরা চায়, মানুষের সঙ্গে মানুষের কোন ভেদ থাকবে না; জমি ধন সব সামানভবে ভাগ করে নেবে। সেইজন্য তারা বিপ্লব করে এ-রাজত্ব উলটে দিতে চায়। সে আবার কাঁদিয়া ফেলিল।

সুনীতির মনে পড়িল, অহীন্দ্র তাহাকে ইঙ্গিতে বলিয়াছিল, তিনি তাহা বুঝিতে পারেন নাই। তিনি স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। কিছুক্ষণ পর উমা বলিল- সে আজ আর কথাগুলি গোপন করিয়া রাখিতে পারিতেছে না বলিল, সাঁওতালদের চরের জমি কেড়ে নেওয়ার পর তারা একদিন ভোর-রাত্রে চর থেকে উঠে চলে গেল; তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলেন। সেদিন আমায় বলেছিলেন, এ-পাপ আমাদের পাপ। পুরুষ পুরুষ ধরে এই পাপ আমাদের জমা হয়ে আসছে, কলের মালিক একা এর জন্য দায়ী নয়। এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত আমাকে করতে। হবে। আমি সেদিন বুঝতে পারি নি মা। আবার পুজোর সময় আমি বুঝতে পারলাম; সুটকেস খুলে কাপড় গোছতে গিয়ে, কখানা চিঠি থেকে বুঝতে পারলাম। আর সে বলিতে পারিল না, অনর্গল ধারায় চোখের জল তাহার মুখ ভাসাইয়া ঝরিতে আরম্ভ করিল।

অনেকক্ষণ পর সুনীতি বলিলেন, চল, বউমা, দাদার কাছে যাই। তিনি ভিন্ন আর কে উপায় করবেন?

উমা অতিমাত্রায় ব্যাগ্র হইয়া কাতরভাবে বলিয়া উঠিল না, না। তাতে তাঁকে বিশ্বাসঘাতক হতে হবে, সমস্ত দল ধরা পড়ে যাবে মা। না না।

সুনীতি পাথর হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। উমাও নীরব।

ও-পারের চরে বাজনার শব্দ উন্মত্ত উজ্জ্বলতায় উচ্চ হইয়া উঠিয়াছে। নদীর চরের উপর লাল আলোর মধ্যে সেই দীর্ঘাঙ্গী কালো মেয়েটা উন্মত্ত আনন্দে যেন তাণ্ডবনৃত্য করিতেছে। লম্বা ফালি সর্বনাশা চরটা যেন ঐ দীর্ঘাঙ্গী কালো মেয়েটার রূপ ধরিয়া সর্বনাশীর মত নাচিতেছে।

.

৩৪.

নিতান্ত বিস্মৃতিবশেই খান-দুই ইস্তাহার এবং একখানা পত্র সুটকেসের নীচে পাতা কাগজের তলায় রহিয়া গিয়াছিল; ঝাড়িয়া মুছিয়া গুছাইতে গিয়া উমা সেগুলি পাইয়াছিল। লাল অক্ষরে ছাপা ইস্তাহারখানা পড়িয়াই উমা ভয়ে উত্তেজনায় কাঁপিয়া উঠিয়াছিল, তারপর সেই পত্রখানা; তাহার মধ্যে সব সুস্পষ্ট- “মৃত্যু মাথায় করিয়া আমাদের এ অভিযান। প্রায় পৃথিবীব্যাপী বিরাট শক্তিগুলি ভরা রাইফেলের ব্যারেল উদ্যত করিয়া রাখিয়াছে। ফাঁসীর মঞ্চে দড়ির নেকটাই প্রস্তুত হইয়া ঝুলিতেছে। অন্যদিকে মানুষের আত্মঅজ্ঞাত স্বার্থবুদ্ধি প্রণোদিত বিধানের ফলে অসংখ্য কোটি মানুষের অপমৃত্যু যুগ যুগ ধরিয়া ঘটিয়া আসিতেছে” শেষের কয়টি লাইনের পাশে অহিন্দ্র দাগ দিয়া লিখিয়াছে, “আবছা অন্ধকারের মধ্যে সাঁওতালেরা চর ছাড়িয়া চলিয়া গেল। আমি চোখে দেখিয়াছি।”

উমা বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে একে একে সমস্ত কথাই সুনীতিকে প্রকাশ করিয়া বলিল। বলিতে পারিল না কয়েকটি কথা; অহীন্দ্র ঠিক এই সময়েই আসিয়া পড়িয়াছিল, উমার হাতে কাগজ ও চিঠি দেখিয়া ছোঁ মারিয়া সেগুলি কাড়িয়া লইয়া বলিয়াছিল, এ তুমি কোথায় পেলে?

উমা যেমন ভঙ্গিতে দাঁড়াইয়া চিঠিখানা পড়িতেছিল, তেমন ভঙ্গিতেই দাঁড়াইয়া ছিল, ঠোঁট দুইটি কেবল থরথর করিয়া কাঁপিয়াছিল, উত্তর দিতে পারে নাই। অহীন্দ্র হাসিয়াছিল, হাসিয়া তাহাকে কাছে টানিয়া বলিয়াছিল, “না জাগিলে হায় ভারতললনা, ভারত স্বাধীন হল না হল না।” এই নব জাগরণের ক্ষণে তুমি টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরির লেখাপড়া জানা মেয়ে কেঁদে ফেললে উমা? নাঃ, দেখছি তুমি নিতান্তই ‘বাঙালিনী’! তারপর সে তাহাকে বলিয়াছিল লেনিনের সহধর্মিণীর কথা, রাশিয়ার বিপ্লবের যুগের মেয়েদের কথা।

উমার তরুণ রক্তে আগুন ধরিয়া গিয়াছিল। স্বামীর সাধনমন্ত্র নিজের ইষ্টমন্ত্রের মত এতদিন সে গোপন করিয়া রাখিয়াছিল। কিন্তু আজ একটি বিচলিত মুহূর্তে স্বামীর বেদনা-বিচলিত মায়ের কাছে সে আত্মসংবরণ করিতে পারিল না, সব প্রকাশ করিয়া ফেলিল।

সুনীতি স্থির হইয়া শুনিলেন।

তিনি যেন পাথর হইয়া গেলেন। বজ্রগর্ভ মেঘের দিকে যে স্থির ভঙ্গিতে পাহাড়ের শৃঙ্গ চাহিয়া থাকে, সেই ভঙ্গিতে অপলক দৃষ্টিতে তিনি ভবিষ্যতের দিকে চাহিয়া রহিলেন।

***

মাস দুয়েক পর একদিন সে বজ্ৰ নামিয়া আসিল।

উমার হাত ধরিয়া সুনীতি নিত্যই ইহার প্রতীক্ষা করিতেছিল। প্রতিকারের উপায় কিছু দেখিতে পান নাই। অহীন্দ্রকে বাড়ি আসিবার জন্য বার বার আদেশ অনুরোধ মিনতি জানাইয়া পত্র লিখিয়াছিলেন, অহীন্দ্র আসে নাই, কোন উত্তর পর্যন্ত দেয় নাই। অমল জানাইয়াছে, অহীন্দ্র কোথায় যে হঠাৎ গিয়াছে সন্ধান করিয়াও সে জানতে পারে নাই; ফিরিলেই সে খবর দিবে। কোন বন্ধুর সহিত সে কলিকাতার বাহিরে কোথাও গিয়াছে।

সুনীতি ও উমা নীরবে পরস্পরকে অবলম্বন করিয়া অবশ্যম্ভাবীর প্রতীক্ষা করিয়া রহিলেন। হেমাঙ্গিনী বা ইন্দ্র রায়ের নিকটেও গোপন করিয়া রাখিলেন। ও-দিকে ইন্দ্র রায় কাশীযাত্রার আয়োজনে সম্পূর্ণ ব্যস্ত, তাহা ছাড়া তিনি যেন বড় লজ্জিত, চক্রবর্তী বাড়ির অনেক অনিষ্ট রায় করিয়া দিয়াছেন। তিনি এ বাড়ি বড় একটা আসেন না। মাঝে মাঝে আসেন, কিন্তু ম্লানমৌন সুনীতির সম্মুখে তিনি বসিয়া থাকিতে পারেন না। মনে হয় এই ম্লান মুখে সুনীতি যেন বৈষয়িক ক্ষতির জন্য তাঁহাকে নিঃশব্দে তিরস্কার করিতেছেন। উমার স্লানমুখ দেখিয়া ভাবেন বাপের লজ্জায়ই উমা এমন নতশির ম্লান হইয়া গিয়াছে। কোন কথা জিজ্ঞাসা করিতেও তাহার কণ্ঠ রুদ্ধ হইয়া আসে।

সেদিন মেঘাচ্ছন্ন অন্ধকার রাত্রি; রাত্রি প্রথম প্রহর শেষ হইয়া আসিয়াছে। চৈত্র মাসের প্রথম সপ্তাহে একটা অকাল বর্ষা নামিয়াছিল; আকাশে সেই অকাল বর্ষার ঘনঘটাচ্ছন্ন মেঘ; চারিদিকে জমাট অন্ধকার। সেই অন্ধকারের মধ্যে সচল দীর্ঘাকৃতি অন্ধকারপুঞ্জের মত কালিন্দীর বালি ভাঙিয়া চলিয়া আসিতেছে অহীন্দ্র। গায়ে একটা বর্ষাতি জামা, মাথায় বর্ষাতি টুপি। গভীর অন্ধকারের মধ্যে আত্মগোপন করিয়া এই দুর্যোগ মাথায় করিয়া সে মা ও উমার সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়াছে। পুলিস তাহাদের ষড়যন্ত্রের সন্ধান পাইয়াছে।

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের মহাযুদ্ধের পর তখন ভারতের গণ আন্দোলনের প্রথম অধ্যায় শেষ হইয়াছে। নূতন অধ্যায়ের সূচনায় রাশিয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত সমাজতন্ত্রবাদী যুবকসম্প্রদায়ের এক ষড়যন্ত্র। আবিস্কৃত হইয়া পড়িল। ভারতের নানা স্থানে খানাতল্লাসী এবং ধরপাকড় আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। অহীন্দ্র ছিল ইউ.পি-র কোন একটা শহরে; সেখান হইতে আত্মগোপন করিয়া চলিয়া আসিতেছে, আবার আজই, রাত্রির অন্ধকার থাকিতে থাকিতেই বাহির হইয়া পড়িতে হইবে। দৃঢ় দীর্ঘ পদক্ষেপে বালি ভাঙিয়া কূলে আসিয়া উঠিল।

এ কি? এ তো রায়হাটের ঘাট নয়, এ যে চরের ঘাট! পাকা বাঁধানো রাস্তা, ওই তো অন্ধকারের মধ্যেও সুদীর্ঘ চিমনিটা, ওই বোধহয় বিমলবাবুর বাংলোয় একটা উজ্জ্বল আলো জ্বলিতেছে। কুলীব্যারাকের সুদীর্ঘ ঘরখানার খুপরির মত ঘরে ঘরে স্থিমিত আলোর আভা। যেন স্তব্ধগতি ট্রেনের মত মনে হইতেছে। রায়হাট ও-পারে; ভুল করিয়া সে চরের উপর আসিয়া উঠিয়াছে। সে ফিরিল। কিন্তু আবার দাঁড়াইল। অনেক কথা মনে পড়িয়া গেল।

কাশ ও বেনাঘাসের জঙ্গলে ভরা সেই চরখানি, জনমানবহীন, যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন। কতদিন নদীর ওপার হইতে দাঁড়াইয়া সে দেখিয়াছে। তারপর একদিন এইখানেই সরু একটি পথের উপর দিয়া সারিবদ্ধ কালো মেয়ের দলকে বাহির হইতে দেখিয়াছিল, মাটির ঢিপির ভিতর হইতে যেমন পিপীলিকার সারি বাহির হয় তেমনি ভাবে। সত্য সত্যই উহারা মাটির কীট। মাটিতেই উহাদের জন্ম, মাটি লইয়াই কারবার, মাটিই উহাদের সব। সেদিন সঙ্গে ছিল রংলাল। সেই দলটির মধ্যে সারীও ছিল নিশ্চয়, মুকুটের মধ্যস্থলে কালো পাখীর দীর্ঘ পালকের মত। এই পথ দিয়াই সে চরের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছিল-আদিম বর্বর জাতির বসতি মাটির কীটদের গড়া বাসস্থান। সচল পাহাড়ের মত কমল মাঝি, বৃদ্ধা মাঝিন, কালো পাথরে গড়া প্রায় উলঙ্গ। মানুষের দল। চিত্রিত বিপুলদেহ মৃত অজগরের মাংসস্তূপ। রাশীকৃত কুচির ফুল, দীর্ঘাঙ্গী মুখরা সারী; সাঁওতাল মেয়েদের নাচ। মাটির উপর রংলালের প্রলোভন। নবীন বাগদীর দলকেও মনে পড়িল। জমিদারের অলস উদরের লোলুপ ক্ষুধা। মনে পড়িল তাহার দাদাকে। ননী পালের মৃত্যু। শ্রীবাস ও মজুমদারের ষড়যন্ত্র। দাঙ্গা, নবীনের দ্বীপান্তর। কলওয়ালা বিমলবাবু! তাহার চোখ জ্বলিয়া উঠিল, সরলা সাঁওতালদের মেয়ে সারীকে জোর করিয়া করায়ত্ত করিয়া তাহার সর্বনাশ করিয়াছে, সাঁওতালদের জমি আত্মসাৎ করিয়াছে। তাহারা নিজেরা- তাহার শ্বশুর, তাহার বাবা-বাকিটুকু কাড়িয়া লইয়াছেন। রাত্রিশেষের অস্পষ্ট আলোকময় অন্ধকারের মধ্যে কালো কালো মানুষের সারি, কাঁধে ভার, মাথায় বোঝা, সঙ্গে গরু ছাগল ভেড়ার পাল, বসতি ছাড়িয়া চলিয়া গেল, নিঃশেষে ভূমিহীন হইয়া চলিয়া গেল। যুগে যুগে এমনি করিয়াই উহারা স্থান হইতে স্থানান্তরে হাঁটিয়া কাল সমুদ্রের প্রায় কিনারার উপর আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।

অহীন্দ্রের চোখ অন্ধকারের মধ্যে শ্বাপদের মত জ্বলিতেছিল। অই বিমলবাবুটাকে–পকেট হইতে সে ছোট কালো ভারী একটা বস্তু বাহির করিল। ছয়টা চেম্বার বোঝাই করা রিভলবার। বিকারগ্রস্থ রোগীর মত অস্থির অধীর হইয়া উঠিল সে। একবার সতর্ক দৃষ্টিতে চারিদিক চাহিয়া দেখিয়া লইল। আশেপাশের সম্মুখে চরখানা তেমনি, এখানে-ওখানে আলোকচ্ছটা বিকীর্ণ হইতেছে মাত্র, মানুষ দেখা যায় না; পিছনে কালিন্দীর গর্ভেও কেহ নাই। ও-পারে রায়হাট স্তব্ধ অন্ধকার, শুধু গাছপালার মাথার উপর একটা আলোর ছটা, একটা বাড়ির খোলা জানলার আলো। এ যে তাহাদেরই বাড়ি-হ, তাহাদের বাড়ির জানলার আলো। আলোকিত ঘরের মধ্যে দুইটি মানুষ, স্ত্রীলোক-মা আর উমা। সে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। মা আসিয়া জানলা ধরিয়া দাঁড়াইয়াছেন, স্পষ্ট মা। কিছুক্ষণ পর রিভলবারটি পকেটে পুরিয়া সে চরকে পিছনে ফেলিয়া রায়হাট অভিমুখে দ্রুত অগ্রসর হইল। পুরনো গ্রামের বৃক্ষছায়াচ্ছন্ন পথ অতিবাহন করিয়া সে সেই আলোকিত জানলার তলে আসিয়া দাঁড়াইল, অনুচ্চ অথচ স্পষ্ট স্বরে ডাকিল, মা!

কে? কে?-শঙ্কিত ব্যাগ্রকণ্ঠে সুনীতি প্রশ্ন করিলেন।

মা!

অহীন?…যাই যাই, দাঁড়া।

মাথার টুপিটা খুলিয়া ফেলিয়া রেন কোর্টের বোতাম খুলিতে মায়ের মুখের দিকে চাহিয়া অহীন্দ্র মৃদু হাসিল, ছলনা করিয়া মাকে ভুলাইবার জন্যই সে হাসিল।

সুনীতি অপলক চক্ষে অহীন্দ্রের দিকে চাহিয়া ছিলেন; চোখে জল ছিল না, কিন্তু ঠোঁট দুইটি থরথর করিয়া কাঁপিতেছিল, অহীন্দ্রের হাসি দেখিয়া তাঁহার কম্পিত অধরেও একটি অস্পষ্ট বিচিত্র হাস্য রেখা ফুটিয়া উঠিল, মৃদুস্বরে বলিলেন, আমি সব শুনেছি অহীন।

অহীন্দ্র চমকিয়া উঠিল।

 সুনীতি বলিলেন, বউমা আমাকে সব বলেছে।

ও-বাড়ির ওঁরা? তা হলে কি তোমরাই-? তাহার সন্দেহ হইল, হয়তো প্রাচীন জমিদারবংশ তাহাকে রক্ষার্থে রাজভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখাইয়া পুলিসের শরণাপন্ন হইয়াছেন।

না, আর কেউ জানে না। আমাকে না বলে বউমা বাঁচবে কি করে বল? এত দুঃখ সে কি লুকিয়ে রাখতে পারে? কিন্তু এ তুই কি করলি বাবা?

কোটের শেষ বোতামটা খুলিয়া অহীন্দ্র মৃদু হাসিয়া বলিল, আজই রাত্রে আমাকে চলে যেতে হবে মা, পুলিস আমদের দলের সন্ধান পেয়ে গেছে।

সুনীতি সমস্ত শুনিয়াছেন জানিয়া সে আর ভূমিকা করিল না, সান্তনা দিবার চেষ্টা করিল না। একেবারে কঠিনতম দুঃসংবাদটা শুনাইয়া দিয়া নিশ্চিন্ত হইল। একবার শুধু হাস্যমুখে মুখ ফিরাইয়া উমার দিকে চাহিল। খাটের বাজু ধরিয়া উমা দাঁড়াইয়া আছে। সে তাহাকে বলিল, একটু চা খাওয়াও দেখি উমা। সঙ্গে কিছু খাবার-খিদে পেয়ে গেছে।

***

সুনীতি শুধু বলিলেন, তুই যদি বিয়ে না করতিস অহীন, আমার কোন আক্ষেপ থাকত না। অহীন্দ্র উত্তরে উমার দিকে চাহিল, উমার মুখে বেদনার্ত ম্লান হাসি; কিন্তু কোন অভিযোগ সেখানে ছিল না, তাহার জলভরা চোখে স্বচ্ছ জলতলে বাড়বহ্নিদীপ্তির মত তরুণ প্রাণের আত্মত্যাগের বাসনা জ্বলজ্বল করিতেছে। অহীন্দ্র মাকে বলিল, উমা কোনদিন সে-কথা বলবে না মা; উমা এ-যুগের মেয়ে।

সুনীতি একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন, তারপর বলিলেন, একটু বিশ্রাম করে নে বাবা, আমি ঠিক ভোরবেলা তোকে জাগিয়ে দেব। তিনি উঠিয়া গেলেন; বধুকে বলিলেন, দরজা বন্ধ করে দাও বউমা।

উমা দরজা বন্ধ করিয়া অহীন্দ্রের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল; অহীন্দ্র তাহার মুখের দিকে চাহিয়া মৃদু হাসিল, কিন্তু কোন কথা বলিতে পারিল না। তাহার ভয় হইতেছিল এখনই হয়তো উমা ভাঙিয়া পড়িবে।

কথা বলিল উমা নিজে। বলিল শুয়ে পড় এখন ঘুমিয়ে নাও।

অহীন্দ্র একান্ত অনুগতের মতই শুইয়া পড়িল। উমা তাহার মাথার চুলের মধ্যে আঙুল চালাইয়া যেন তাহাকে ঘুম পাড়াইতে বসিল।

ভোরবেলা, খানিকটা রাত্রি ছিল তখনও। সুনীতি আসিয়া ডাকিলেন, বউমা! বউমা!

উমা কখন ঘুমে ঢলিয়া অহীন্দ্রের পাশেই শুইয়া ঘুমাইয়া গিয়াছিল, কিন্তু ঘুমের মধ্যেও তাহার উদ্বেগকাতর মন জাগিয়া ছিল, দুই বার ডাকিতেই তাহার ঘুম ভাঙিয়া গেল; তাড়াতাড়ি উঠিয়া সে অহীন্দ্রকে ডাকিয়া তুলিল। অহীন্দ্র উঠিয়া জানলা খুলিয়া একবার বাহিরটা দেখিয়া লইল, তারপর একবার গভীর আবেগে উমাকে বুকে টানিয়া লইয়া তাহার কম্পিত অধরে প্রগাঢ় একটি চুম্বন করিল; কিন্তু সে ওই মুহর্তের জন্য, সে জামা পরিয়া জুতার ফিতা বাঁধিতে ব্যস্ত হইয়া পড়িল। উমা দরজা খুলিয়া দিল, সুনীতি আসিয়া ঘরে। প্রবেশ করিলেন। অহীন্দ্র আর কাহারও মুখের দিকে চাহিল না, হেঁট হইয়া মায়ের পায়ে একটি প্রণাম করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া পড়িল। সিঁড়ি অতিক্রম করিয়া দরজা খুলিয়া সে রাস্তায় বাহির হইয়া গেল, দরজার দাঁড়াইয়া সুনীতি ও উমা দেখিলেন, রাত্রিশেষের তরল অন্ধকারের মধ্যে অহীন্দ্র যেন কোথায় মিশিয়া গেল।

বেলা দশটা হইতেই কিন্তু অহীন্দ্র আবার ফিরিয়া আসিল, তাহার সঙ্গে পুলিস। রেলস্টেশনে পুলিস তাহাকে গ্রেপ্তার করিয়াছে। ইউ.পি হইতে পুলিস জেলা পুলিসকে টেলিগ্রাম করিয়া ছিল। পুলিস এখন বাড়ি ঘর খানা তল্লাস করিয়া দেখিবে।

অভিযোগ গুরুতর-রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং রাজকর্মচারী হত্যার ষড়যন্ত্র।

***

দশটা হইতে আরম্ভ করিয়া বেলা তিনটা পর্যন্ত খানাতল্লাসি করিয়া পুলিসের কাজ শেষ হইল। ইন্দ্র রায়ের বাড়িও খানাতল্লাস হইয়া গেল। বাড়ির আশেপাশে লোকে লোকারণ্য হইয়া উঠিয়াছিল। কাহারও চোখই শুষ্ক ছিল না, হ্যাণ্ডকাপ দিয়া কোমরে দড়ি বাঁধিয়া অহীন্দ্রকে লইয়া যাইতে দেখিয়া সকলেরই চোখ সজল হইয়া উঠিল। তাহার মধ্যে অঝেরঝরে কাঁদিতেছিল কয়েকজন; মানদা, মতি বাগদিনী প্রিয়জন বিয়োগের শোকার্তের মতই কাঁদিতে ছিল। আর কাঁদিতেছিলেন যোগেশ মজুমদার। লজ্জা আর অনুতাপে তাহার আর সীমা ছিল না। সমস্ত কিছুর জন্য সে অকারণে আপনাকে দায়ী করিয়া অস্থির হইয়া উঠিয়াছিল। এ-কান্না তাহার সাময়িক, হয়তো কালই সে কলের মালিকের ইঙ্গিতে চক্রবর্তী-বাড়ির অনিষ্ট সাধনে উঠিয়া পড়িয়া লাগিবে, কিন্তু তবু সে আজ কাঁদিতেছিল। অচিন্ত্যবাবুও একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াইয়া বেশ স্কুটভাবেই ফোঁপাইয়া ফোঁপাইয়া কাঁদিতেছিলেন, এই মর্মন্তুদ দৃশ্য দুর্বল মানুষটি কোনমতেই সহ্য করিতে পারিতেছেন না। রংলালও কাঁদিতেছে। কেবল একটি মানুষ ক্রোধভরে আস্ফালন করিতেছিল, হু হু বাবা, এয়ারকি, গবরমেন্টারের সঙ্গে চালাকি! সে শূলপাণি, সদ্য গাঁজা টানিয়া সে জ্ঞাতিশত্রু-নিপাতের তৃপ্তিতে আস্ফালন মুখর হইয়া উঠিয়াছে।

পুলিস অহীন্দ্রকে লইয়া চলিয়া গেল। হেমাঙ্গিনী আছাড় খাইয়া পরিলেন, উমা নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল, চোখভরা জল আঁচলে মুছিয়া সে মাকে ডাকিল, ওঠ মা। একদিন তো তিনি ফিরে আসবেন; কেঁদো না। হেমাঙ্গিনী মুখ তুলিয়া মেয়ের মুখের দিকে চাহিয়া অবাক হইয়া গেলেন।

ইন্দ্র রায় মাথা নীচু করিয়া পায়চারি করিতেছেন। রায়-বাড়ি ও চক্রবর্তী-বাড়ির মিলিত জীবন-পথ আবার ভাঙিয়া গেল। পরমুহর্তে মনে হইল, না না, ভাঙে নাই। বিপদ আসিয়াছে আঘাত আসিয়াছে সে আঘাত দুই বাড়িকেই সমানভাবে বেদনা দিয়াছে; কিন্তু বিচ্ছেদ হয় নাই, দুই বাড়ির বন্ধন ছিন্ন হয় নাই। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া তিনি ডাকিলেন ইষ্টদেবীকে, তারা, তারা মা! তারপর বলিলেন, ওঠ গিন্নী, ওঠ।

হেমাঙ্গিনী বলিলেন, ওগো আর নয়, তুমি কাশী যাবে বলছিলে, কাশী চল।

যাব। অহীন্দ্রের বিচার শেষ হোক। মা যে বাধা দিলেন। উমা, তোর শাশুড়ী কোথায় গেলেন, দেখ মা।

রামেশ্বরের ঘরে সুনীতি মাটির উপর মুখ খুঁজিয়া মাটির প্রতিমার মতই পড়িয়াছিলেন, মৃদু নিঃশ্বাসের স্পন্দন ছাড়া একটুকু আক্ষেপ সর্বাঙ্গের মধ্যে কোথাও ছিল না; মহী যেদিন আত্মসমর্পণ করে সেদিনও ঠিক এমনিভাবেই তিনি পড়িয়া ছিলেন।

খাটের উপর রামেশ্বর বসিয়া ছিলেন পাথরের মত।

.

৩৫.

গভীর রাত্রি।

রামেশ্বর তেমনি পাথরের মূর্তির মত বসিয়া আছেন। তেমনি দৃষ্টি তেমনি ভঙ্গি। ঘরের মধ্যে তেমনি। স্বল্প আলোক, আলোক-পরিধির চারিপাশ তেমনি নিথর অন্ধকার। সুনীতি তেমনি উপুড় হইয়া মাটিতে মুখ খুঁজিয়া পড়িয়া আছেন। উমাকে হেমাঙ্গিনী লইয়া গিয়াছেন। রায় লইয়া যাইতে চান নাই। কিন্তু হেমাঙ্গিনীর কাতরতা দেখিয়া না বলিতেও পারেন নাই। অপরাধীর মত বলিয়াছিলেন, কাল সকালেই পাঠিয়ে দেব উমাকে।

একবার মাত্র মুখ তুলিয়া সুনীতি বলিয়াছেন বেশ।

মানদা নীচে পড়িয়া কাঁদিতেছে।

শোকাচ্ছন্ন নীরবতা ভঙ্গ করিয়া রামেশ্বর বলিলেন, জল। শুষ্ক কণ্ঠস্বর দিয়া রব বাহির হিল না, কিন্তু ভাষা বোঝা গেল।

সুনীতি একটা দীর্ঘনিঃসশ্বাস ফেলিয়া উঠিলেন, মনে তাহার অনুতাপ হইল, আজ রামেশ্বরের খাওয়া পর্যন্ত হয় নাই। উঠিয়া তিনি দেখিলেন, উমা জলখাবার সাজাইয়া কোণের টেবিলের উপর নিয়মমত রাখিয়া গিয়াছে। জলখাবারের থালা ও গ্লাসটি আনিয়া মৃদুস্বরে বলিলেন, খাও কিছু। আমি ভুলে গেছি, মনে করতে পারি নি।

জলের গ্লাসটি শুধু তুলিয়া লইয়া নিঃশেষে পান করিয়া রামেশ্বর খাদ্য প্রত্যাখ্যান করিয়া বলিলেন, না।

সুনীতি এতক্ষণে ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিলেন।

রামেশ্বর মৃদুস্বরে প্রশ্ন করিলেন, অহীনের কি ফাঁসী হবে?

আর্তস্বরে সুনীতি বলিয়া উঠিলেন, না না, সে তো খুন করে নি, বিপ্লবের খুনের ষড়যন্ত্র করেছিল, খুন তো করে নি।

রামেশ্বর বলিলেন, তোমার পূণ্য, উমার ভাগ্য তাকে বাঁচিয়েছে।

 সুনীতি চুপ করিয়া রহিলেন।

রামেশ্বর বলিলেন, আচ্ছা, ওরা আমাকে কেন সাজা দিক না। অহীন তো আমারই ছেলে। দোষ তো আমারই।

আবেগপীড়িত কণ্ঠে সুনীতি বলিলেন, না না, আমার জন্যেই তোমার এত কষ্ট। তোমার দোষ নয়, আমার ভাগ্যের দোষ, আমার গর্ভের দোষ।

অতি ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়িয়া অস্বীকার করিয়া বলিলেন না।

তারপর বহুক্ষণ নীরবতার পর বলিলেন, জান না তুমি, কেউ জানে না। আমারই রক্তের দোষ। ছায়ামূর্তির মত মৃদু সঞ্চালনে হাত তুলিয়া অঙ্গুলিনির্দেশ করিয়া বলিলেন, ওইখানে তোমার দিদিকে রাধারাণিকে আর আমার প্রথম সন্তানকে গলা টিপে মেরেছিলাম।

সুনীতি আতঙ্কে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন।

রামেশ্বর বলিতেছিলেন, একদিন দেখলাম, রায় বাড়িতে রাধারাণী সুন্দর একটা ছেলের সঙ্গে হাসছে। সে তার পিসতুতো ভাই। আমার চরিত্র-দোষ ছিল কিনা, আমার সন্দেহ হল। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিলেন, সংসারে এই নিয়ম, ‘আত্মবৎ মন্যতে জগৎ’। যে অন্ধ সে পৃথিবীকে অন্ধকার দেখে, এ প্রকৃতির নিয়ম। রামেশ্বর নীরব হইলেন।

কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেন, ছেলেটা হল, তার চুল কালো হল, আমাদের মত পিঙ্গল হল না। আমি যেন পাগল হয়ে গেলাম। ঠিক মনে হল, ছেলেটা তার মত দেখতে। একদিন শুয়ে ছিল ছেলেটা, গলা টিপে দিলাম।

সুনীতি থরথর করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে স্বামীর মুখ চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন, না না না বলো না, বলো না।

রামেশ্বর নীরব হইয়া বসিয়া রহিলেন। বহুক্ষণ পর আবার অকস্মাৎ বলিলেন, কিন্তু রাধারানি বুঝতে পেরেছিল। হয়ত দেখেছিল। কিন্তু সে কাঁদলে না। শুধু বললে, যে চোখে তুমি এমন কূ দেখলে ওই চোখ তোমার অন্ধ হয়ে যাবে।

আবার কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকিয়া বলিলেন, সে কাউকে কিছু বললে না, বাপের বাড়িও গেল না; একদিন কাশী যাবে বলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। সন্ধ্যাবেলা একাই চলে গেল। আমি সেই রাত্রেই স্টেশন থেকে ফিরিয়ে এনে, ওইখানে গলা টিপে–। যখন তার গলা টিপে ধরলাম, সে অভিশাপ দিল, চোখ নয়, ওই দুই হাতেও তোমার কুষ্ঠ হবে।

সুনীতির যে সব গোলমাল হইয়া যাইতেছে। স্থান কাল পাত্র সব ঝাপসা হইয়া গিয়াছে। বিহ্বল দৃষ্টিতে তিনি স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া ছিলেন, নির্বোধের মত তিনি এবার বলিলেন, কই, তোমার তো কুষ্ঠ হল না? তোমার চোখ তো অন্ধ হয় নি?

হয়েছিল; ভাল হয়ে গেল। মহীন আর অহীন ভাল করে দিলে। একটি হাত ও চোখ দেখাইয়া বলিলেন, এইটে অহীন, আর এইটে মহীন। তারপর মৃদুস্বরে বলিলেন তোমার গর্ভের দোষ নয়, আমার রক্তের দোষ। জান সুনীতি আমাদের বংশ পাপের বংশ। নবাবরা দেওয়ালে পুঁতে মানুষ মারত। আমার কিন্তু সব পাপ নষ্ট হয়ে গেল। সব রোগ ভাল হয়ে গেল।

সুনীতি নীরবে বসিয়া রহিলেন, সূতা কাটা ঘুড়ির মত তাহার মন জীবনকেন্দ্র হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া গিয়াছে, তাহাকে আকর্ষন করিতে আর কিছুতেই পারিতেছে না। বিহ্বল দিশাহারার মত উদাস তিনি।

কিছুক্ষণ পরেই বাহিরে পাখীরা কলরব করিয়া প্রত্যুষ ঘোষণা করিয়া দিল। রামেশ্বর চকিত হইয়া বলিলেন, ভোর হয়ে গেল? বলিতে বলিতে বিছানা হইতে নামিয়া তিনি জানলা খুলিয়া দিলেন। আকাশের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া তিনি দাঁড়াইলেন, সম্মুখে আকাশে মুক্তির বার্তা বহন করিয়া উদয়াচল হইতে মৃত্তিকার বুকে লক্ষ লক্ষ যোজনা অতিক্রম করিয়া ধারায় ধারায় আলোকের বন্যা ছুটিয়া আসিতেছে। মুহূর্তে মুহূর্তে চারিদিক পরিষ্কার হইয়া উঠিতেছে সমস্ত দেখা যাইতেছে-জীর্ণ রায়হাট, শীতের শীর্ণা কালিন্দী, ও পারের চর আকাশে উদ্যত চিমনী কলের সারি সারি অট্টালিকা প্রশস্ত সুগঠিত পথ, লোকজন ঐশ্বর্যময়ী চর।

চরটা চোখে পড়িতেই সুনীতি চমকিয়া উঠিলেন। সর্বনাশা চর। ব্যাকুলভাবে তিনি প্রশ্ন করিলেন, তুমি কি-তুমি কি আমার সতীনের দেহ ওই-ওই ওই চরে পুঁতেছিলে?

সবিস্ময়ে মুখ ফিরাইয়া রামেশ্বর বলিলেন না বাড়িতে কুয়ার মধ্যে। সেটা বন্ধ করে দিয়েছি।

সুনীতি বিহ্বল বিস্ময়ে প্রশ্ন করিলেন তবে? দিশাহারা বিহ্বল মন উদ্ভট চিন্তা, উদ্ভট প্রশ্ন জাগিয়া উঠিতেছিল। সতীনের কঙ্কালের উপর তো চরটা গড়িয়া উঠে নাই তবে কেন এমন হল?

রামেশ্বর সে কথায় কান দিলেন না, মুখ ফিরাইয়া আপনার দুইটা হাত শূন্যালোকে প্রসারিত করিয়া দিলেন। তখন দিগন্তশিখরে সূর্য দেখা দিয়াছে, অতিরিক্ত আলোক অকৃপন দীপ্তি ও উত্তাপ লইয়া রামেশ্বরের। হাতের উপর ছড়াইয়া পড়িল। হাতের দিকে চাহিয়া রামেশ্বর বলিলেন, আঃ, কোন দাগ নেই একেবারে সাদা হয়ে গেছে।

অস্থিচর্মসার রক্তহীন বিবর্ণ দুখানি হাত।

হাত দুইখানি মুক্ত করিয়া রামেশ্বর সূর্যকে প্রণাম করিলেন জবাকুসুম-সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং। ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরম্।

সুনীতি উদাস দৃষ্টিতে চরটার দিকে চাহিয়া ছিলেন, রামেশ্বর কথা কানে যাইতেই তিনি আকাশের দিকে চাহিলেন; সম্মুখেই রক্তিম সূর্য উদয়শিখর হইতে অস্তাচল পর্যন্ত মেঘমুক্ত নির্মল আকাশ সর্ব পাপঘ্ন দেবতার মহাদ্যুতিতে ঝলমল করিতেছে। তাহারই প্রতিবিম্ব পড়িয়াছে রায়হাটে কালিন্দীর চরে সর্বত্র সর্বত্র।

ওই দূরে নতুন ওঠা সর্বনাশা চরটার কোল ঘেঁষিয়া শীর্ণা কালিন্দীর বারোমেসে অগভীর অপরিসর জলধারা বহিয়া চলিয়াছে। মন্থর তাহার গতি এখন। কালের ভগ্নী কালিন্দী! কালিন্দীর জলস্রোতের মধ্যে নূতন চরটার ছায়া প্রতিফলিত হইয়াছে। গাছ-গাছালির মধ্যে চিনির কলের চিমনিটা স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। চিমনিটার গায়ে প্রভাতসূর্যের রৌদ্র পড়িয়াছে-তাহাও ফুটিয়াছে প্রতিবিম্বের মধ্যে।

নিত্য প্রভাতে উঠিয়াই প্রথম এই চরটার ছবি ওই কালিন্দীর জলে দেখিয়া আসিতেছেন। চরটা যেন তাহার ভাগ্য তাহার ঘর সংসারকে বেষ্টন করিয়া পাক দিয়া পাকে পাকে জড়াইয়াছে বলিয়া তাহার মনে হইত। আজ মনে হইল কালের ভগ্নী কালিন্দী মহাকালের নির্দেশকে প্রতিফলিত করিয়া চলিতেছে। আগে যেখানে কালিন্দীর জলে শুধু আকাশ ও নদীতীরের গাছ গাছালি তৃণবনের ছায়া ভাসিত আকাশে ওড়া বকের সারির ছবি ভাসিত–আজ সেখানে কালিন্দীর সেই স্রোতধারায় উদয় সূর্যের আলোয় আলোকিত কলের চিমনি এবং চিমনিতে ওঠা ধোঁয়ার রাশি একটা অনির্দেশ্য শাসনের মত ভাসিতেছে বলিয়া মনে হইল। আরও ভবিষ্যত কালে এই চরের ভাঙা গড়ার সঙ্গে আরও কত ছায়া আরও কত নবতর মূর্তি ওই স্রোতে ফুটিয়া উঠিবে মানুষকে ভয় দেখাইবেন কে জানে। কিন্তু তাহার আর ভয় নাই। না। বরঞ্চ চরাচরব্যাপী আলোর মধ্যে যে আশ্চর্য অভয় আছে তাহারই স্পর্শ পাইয়া সুনীতি আশ্বস্ত হইলেন। তাহার চোখ ফাটিয়া জল আসিল।

<

Tarasankar Bandyopadhyay ।। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়