ইহার পর কমল যেন আর এক কমল হইয়া উঠিল। মহান্ত চলিয়া গেল, কিন্তু তাহার কোনো সন্ধান সে করিল না। কাহাকেও করিতে বলিল না। কেহ তাহাকে বারেকের জন্য বিষণ্ণ হইয়া থাকিতে দেখিল না।

রাত্রে ঘুমাইয়া কাঁদে কি না, সে কথা ভগবান জানেন। সকালে ওঠে। কিন্তু সে হাসি মুখে লইয়া, সে হাসি অহরহই তাহার মুখে লাগিয়া থাকে। সামান্য কারণে হাসিতে গানে উল্লাসে সে যেন উথলিয়া উঠিল। দেহলাবণ্যের মার্জনবিন্যাস আরও বাড়িয়া উঠিল। কেঁকড়া কেঁকড়া ফুলো ফুলো একপিঠ চুল তাহার। সে-চুল সে পরিপটি বিন্যাস করিয়া রাখালচূড়া বাঁধে। ঈষৎ বাঁকা নাকটির সুবঙ্কিম মধ্যস্থলেই শুভ্ৰ তিলক-মাটি দিয়া একটি সূক্ষ্ম রসকলি আঁকে। তাহারই ঠিক উপরে কালো রেখা দুইটির মধ্যস্থলে সযত্বে তিলক-মাটিরই একটি টিপ পরে। গলায় থাকে দুকণ্ঠি মিহি তুলসী কাঠের মালা।

দেখিয়া দেখিয়া ভোলা বলে, শোভা কি মালার গুণে, শোভা হয় গলার গুণে।

ঘাড়টি দুলাইয়া কমল মৃদু মৃদু হাসে।

আখড়ার সেই উৎসব-সমারোহ যেন বাড়িয়া গিয়াছে।

ভোলা আসে, বিনোদ আসে, পঞ্চানন আসে, আরও অনেকে আসে। দিনে দিনে তাঁহাদের দলবৃদ্ধি হয়। কিশোর যাহারা তাহাদের কেহ আখড়ার বাহিরে দীড়াইয়া দেখিলে কমল তাহার হাত ধরিয়া লইয়া যায়। প্রৌঢ়রা কেহ দুই-চারিদিন আখড়ার সুমুখ দিয়া আনাগোনা করিলে পঞ্চম দিনে কমল তাঁহাকে ডাকে, এস মোড়ল, পায়ের ধুলো দিয়ে যাও।

সন্ধ্যায় কমল গান ধরে, অপর সকলে দোহারকি করে। প্রহরখানে, রাত্রে আখড়া ভাঙে। কমল বলে, এইবার বাড়ি যাও সব ভাই। সবাই উঠি উঠি করে, কিন্তু কেহই যাইতে চায় না। কমল একে একে হাত ধরিয়া আখড়ার বাহিরে পথের উপর। মানিয়া বলে, কাল সকালেই ঠিক এসো যেন। বাড়ি ফিরিয়া কমল ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া দেয়।

কিছুক্ষণ পরে ভোলা ডাকে, কমলি! কমলি!

কাহারও কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। কোনো কোনো দিন সাড়া মেলে। ঘরের মধ্য হইতে। কমল বলে, তুই আবার ফিরে এসেছিস?

ভোলা বলে, একবার তামাক খাব ভাই, দেশলাইটা দে।

উত্তর আসে, বাড়িতে-বাড়িতে তামাক খেগে যা ; বউ সেজে দেবে।

ভোলা ডাকে, কমল!

কমল বলিয়া ওঠে, দেখছিস বঁটি, আমায় বিরক্ত করবি তো নাক কেটে দোব। যা বলছি, বাড়ি যা। তোর বউয়ের, তোর মায়ের গাল খেতে পারব না আমি।

সত্যই ভোলার মা, শুধু ভোলার মা কেন, গ্রামের গৃহস্থজন সকলেই কমলকে গলাগলি দেয়। বলে, ছি! এই কি রীতিকরণঃ রঞ্জনকে দেশছাড়া করলে, মহান্তকে তাড়ালে, আবার কার মাথা খায় দেখ। যাকে দশে বলে ছি, তার জীবনে কাজ কি?

সমস্তই কমলের কানে পৌঁছায়, লোক স্বল্প দূরত্ব রাখিয়া সমস্তই তাহাকে শুনাইয়া বলে। এ ঘাটে কমল স্নান করে, কথা হয় পাশের ঘাটে। কমল পথ চলে, পিছনে থাকিয়া লোকে কথা বলে। কমল পিছনে থাকিলে তাহার আগে থাকিয়া লোকে ওই কথা বলিয়া পথ চলে।

কমলের হাসিমুখ আরও খানিকটা হাসিতে ভরিয়া ওঠে। সেদিন ভোলার মা তাহাকে ডাকিয়াই বলিল, মর মর, তুই মর।–

কমল হাসিল, বলিল, মনুষ্যজন্ম বহু-ভাগ্যে হয়েছে, সাধ করে কি মরতে পারি, না মরতে আছে?

ভোলার মা স্তম্ভিত হইয়া গেল। কমল কথা না বাড়াইয়া হাসিমুখেই চলিয়া গেল।

ভোলার মা পিছন হইতে আবার ডাকিল, শোন, শোন।

কমল বলিল, মাখন মোড়লের নতুন জামাই এসেছে। খুড়ীমা, জামাই দেখতে যাচ্ছি, পরে শুনব।

মাখন মোড়লের বাড়িতে নূতন জামাইয়ের আসর হাসিতে গানে রসিকতায় গুলজার করিয়া দিয়া হঠাৎ সন্ধ্যার মুখে সে উঠিয়া পড়ে।

জামাই বলে, সে কি, এর মধ্যে যাবে কি ঠাকুরঝি? এই সন্ধে লাগল।

কমল হাসিয়া বলে, আমার যে আয়ান ঘোষের একটি দল আছে ভাই শ্যামচাঁদ। ফিরতে দেরি হলে ঘর-দোর ভেঙে তছনছ করে দেবে হয়ত।

ব্যাপার চরমে উঠিল একদিন। গ্রামের নদী আসিয়া বলিল, পান আছে বোষ্ট্রমী? গোটা পান চাইলে গোমস্তা। জমিদার এসেছেন, পান আনতে ভুল হয়েছে।…গোটা পান দিয়া তাহাকে বিদায় করিয়াও, তাহার কি মনে হইল, সে পানের বাটা লইয়া পান সাজিতে বসিল। একখানা ঝকঝকে রেকাবিতে পানের খিলিগুলি সাজাইয়া পাশে একটু চূন, কিছু কাটা সুপারি রাখিয়া হাসিমুখে সে কাছারিতে গিয়া হাজির হইল। রেকাবিটি সামনে নামাইয়া রাখিয়া গলায় কাপড় দিয়া প্ৰণাম করিল। জমিদার সবিস্ময়ে মুগ্ধদৃষ্টিতে কমুলের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন। কমল হাসিয়া বলিল, আমি আপনার প্রজা-কমলিনী বোষ্ট্রমী। নগদী গেল গোটা পানের জন্যে। পান কি পুরুষমানুষে সাজতে পারে! তাই সেজে আনলাম।

জমিদার একটি পান তুলিয়া মুখে দিয়া বলিলেন, বাঃ! কেয়ার গন্ধ উঠছে দেখছি!

সে জমিদারকে আবার একটি প্ৰণাম করিয়া চলিয়া আসিতেছিল। জমিদার বলিলেন, পান সেজে তুমি দিয়ে যাবে কিন্তু।

কমল হাসিয়র ফিরিয়া দাঁড়াইল, বলিল, আমি?

হ্যাঁ। তোমার পান। যেমন মিষ্টি, হাসি তার চেয়েও মিষ্টি। গানও নাকি তুমি খুব ভাল গাও শুনেছি।

বৈষ্ণবী তাহার ঘোমটা ঈষৎ একটু বাড়াইয়া দিয়া বলিল, ভিখিরির ওই তো সম্বল প্রভু। জমিদারকে সে গান শুনাইল।

আশ্চর্যের কথা, সেই দিন সন্ধ্যায় তাহার আখড়ায় কেহ আসিল না। ভোলাও না। কমল ঠাকুরঘরের মধ্যে দরজা বন্ধ করিয়া বসিল।

 

দিন কয়েক পর।

জমিদার চলিয়া গিয়াছেন ভোররাত্রে। সকালবেলাতেই গ্রামখানা উচ্চ চিৎকারে মুখরিত হইয়া উঠিল। কোথাও কলহ বাধিয়াছে।

লোকে কটু কথা বলে শুনিয়া আসিতেছিল, শুনিয়া সে জ্বলিয়া যাইত। কমল তাহাকে বলিত, ছি! লোকের সঙ্গে ঝগড়া করতে নাই। আজ জমিদার চলিয়া যাইতেই লোকে ওই পান দেওয়া এবং গান গাওয়া লইয়া নানা কথা কহিতে শুরু করিয়াছে ভোরবেলাতেই। ঘাটে কাঁদু সেই কথা লইয়া ঝগড়া বাধাইয়াছে। সে আর সহ্য করিতে পারে নাই।

একা ভোলার মা নয়, বিনোদ-পঞ্চাননের মাও ছিল। আরও ছিল দুই-চারিজন স্পষ্টভাষিণী প্রতিবেশিনী। কিন্তু কাদুর জিহ্বা ও কণ্ঠের তীব্রতার কাছে তাহাদিগকে হার মানিত হইল। সত্য সত্যই এ যেন লঙ্কাকাণ্ড, কি কুরুক্ষেত্ৰ! কিন্তু কাদুর এক নিক্ষেপে লক্ষ বাণ ধায় চারিভিতে।

কমল আসিয়া কাদুকে টানিয়া লইয়া গেল। আপনার বাড়ি। কহিল, ছি!

কাদু উগ্রভাবেই বলিল, ছিঃ? ‘ছি’ কেন শুনি? যে চোখ সংসারে খারাপ বৈ দেখে না, তার মাথা খাব না? তাদের জিভ খসে যাবে না?

কমল হাসিল। বলিল, বলুক না।

না, বলবে কেন? কেন বলবে শুনি? কোন চোখ-খাগীর-? সে কাঁদিয়া ফেলিল।

সস্নেহে তাহার চোখ মুছাইয়া দিয়া কমল বলিল, আমার মাথা খাবি।

কাদু বলিল, তোর মাথা খাব না ভেবেছিস? তোর মাথাও খাব। জীতি দিয়ে তোর চুলের রাশ কাটব, ঝামা দিয়ে নাকের রসকলি তুলব, তবে আমার নাম ননদিনী।

কমল হাসিয়া বলিল, তাই আন। পরের সঙ্গে কেন বাপু?

কাদু ও-কথায় কান দিল না। কাদু কমলের মুখখানি তুলিয়া ধরিয়া মুগ্ধনেত্ৰে দেখিতে দেখিতে বলিল, দেখ দেখি, এই রূপে চোখ-খাগীরা কু দেখে! পোড়ামুখীদের কালো হাঁড়িমুখ, না পোড়াকাঠি?–

কমল ননদিনীর গালে একটি টোকা মারিয়া বলিল, আবার? তারপর সে মৃদুকণ্ঠে গান ধরিয়া দিল–

ননদিনীর কথাগুলি নিমে গিমে মাখা,
কালসাপিনী-জিহ্বা যেন বিষে আঁকাবাঁকা।
আমার দারুণ নানদিনী—

কাদু একটু হাসিল। কমল বলিল, ছিঃ কাদু, মানুষকে কি ওই সব বলে?

কাদু বলিল, তবে কি বলব, শুনি? শ্ৰীমতী কি বলিতে বলেন, শুনি?

কমল আবার মধুরস্বরে গাহিল—

ননদিনী বোলো নগরে
ড়ুবেছে রাই রাজনন্দিনী কৃষ্ণ-কলঙ্ক সাগরে।

কাদু বলিল, তবে আর গালাগালি দিই কি সাধ করে বউ? ওরা যে তা বিশ্বাস করবে না। বলে, তাই নাকি হয়?

কথাটা হইতেছে এই-কমল এবার সঙ্কল্প করিয়াছিল যে, আর মানুষ নয়, এ রূপে সে এবার শ্যামসুন্দরের পূজা করিবে। বহু ইতিকথা তো সে শুনিয়াছে। তাই সে রাত্রে আখড়া ভাঙিয়া গেলে মালতী বা মাধবীর মালা গীথে, সুশোভিত কাঠের সিংহাসনে স্থাপিত কৃষ্ণমূর্তির পটখানির গলায় পরাইয়া দেয়। অনিমেষে পটের দিকে চাহিয়া থাকে-যদি সে মূর্তি হাসে! মাথার উপর ঘূতদীপ ধরিয়া সে পটের আরতি করে। তাই রাত্রে আখড়া ভাঙিবার পর ভোলা যখন ডাকিত ‘কমল’, পূজারত কমলের সে কথা কানে যাইত না বা উত্তর দিবার অবসর থাকিত না। পূজায় বসিবার পূর্বে হইলে বলিত, তোর নাক কেটে দোব ভোলা।

এটুকু জানিত শুধু ননদিনী কাদু।

আজ কাদুর কথার উত্তরে কমল বলিল, আমার একটি কথা রাখতে হবে কাদু।

কাদু বুঝিয়াছিল, কথাটা কি। সে হাসিয়া বলিল, রাখব। কিন্তু আমারও একটা কথা রাখতে হবে তোকে।

কমল ম্লান হাসি হাসিয়া বলিল, ছেলেবয়সের সাথী-সখী’র দল—কি করে বলব কাদু যে এসো না তোমরা?

কাদু তাহার হাত ধরিয়া বলিল, তোর কলঙ্ক আমার সহ্য হয় না বউ। তাহার ঠোঁট দুইটি কাঁপিতেছিল।

বহুক্ষণ পর কমল বলিল, তাই হবে ননদিনী। সেই ভাল। পটের পায়ে ড়ুবতে হলে ভাল করে ডোবাই ভাল। সঙ্গী-সাথী ডেকে হাত বাড়িয়ে তুলতে বলা হয় কেন? তাই হবে।

কাদু বলিল, ননদিনীর জিভও কাটা গেল বউ আজ থেকে।

এরপর কমলের জীবনের এক নূতন অধ্যায়।

পটের পূজায় সে গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করিল। কমলের ভাবভঙ্গি দেখিয়া ননদিনী পর্যন্ত শঙ্কিত হইয়া পড়িল। সে একদিন বলিল, একটা কথা বলব বউ?

কি?

রাগ করবি না তো?

কমল কোনো উত্তর দিল না, শুধু হাসিল। কাদু উত্তর পাইয়াছিল, সে ভরসা করিয়া বলিল, এ পথ ছাড় ভাই বউ ; তুই পাগল হয়ে যাবি।

কমলের মুখ যেন বিবৰ্ণ হইয়া গেল। সে বলিল, আমার আশার ঘর তুই ভেঙে দিস না ভাই।

কাদু কিছুক্ষণ নীরব হইয়া রহিল। তারপর কহিল, ভগবান বড় নিষ্ঠুর ভাই।

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কমল বলিল, অতি নিষ্ঠুর ননদিনী, অতি নিষ্ঠুর।

ছবি পূজার দীর্ঘ দুইটি বৎসর তাহার কাটিয়া গেল, কিন্তু মূক ছবি মূকই রহিয়া গেল। কোনোদিন তো সে হাসিল না, স্বপ্নেও কোনোদিন সে দেখা দিল না। কল্পনায় একটি কিশোর মূর্তি মনে করিতে গেলে ফুটিয়া উঠে চঞ্চল কিশোর সখ্যার রূপ। কমল শিহরিয়া ওঠে। সহসা আজ তাহার মনে হইল, পট না হাসুক, কিন্তু যুগান্তরের প্রাণপ্ৰতিষ্ঠা-করা বিগ্ৰহ তো আছে।

কাদু বলিল, তুই মালা-চন্দন কর ভাই বউ! তোদের তো আছে।

কমল বলিল, না, আমার আশা আজও যায় নাই ননদিনী। আমি মন্দিরে মন্দিরে তাকে খুঁজে দেখব।

কাদু আর কিছু বলিতে পারিল না।

ইহার পর হইতে কমল গ্রামে-গ্রামান্তরে তীর্থে তীর্থে বিগ্ৰহ-মূর্তির দ্বারে দ্বারে ঘুরিতে আরম্ভ করিল। প্রাণঢালা গানের নৈবেদ্যে সে দেবতার পূজা করিত, প্রাণের আবেদন শুনাইত, অপলক নেত্ৰে বিগ্ৰহ মূর্তির মুখের দিকে চাহিয়া থাকিত, যদি ঈষৎবিকশিত চোরাহার্সিটি পালকের অন্ধকারে চোখ এড়াইয়া মিলাইয়া যায়।

নিষ্পলক দৃষ্টিতে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে চোখ জলে ভরিয়া আসে। তখন আর সে পলক না ফেলিয়া পারে না।–চোখের জল তাহার গণ্ডদেশ বহিয়া গড়াইয়া পড়ে।

Tarasankar Bandyopadhyay ।। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়