বৃষ্টিটা চলে যাওয়ার পরেই ফিনফিনে শীতের দিন শুরু হয়ে গেল। চা-বাগানের গাছের পাতা রঙ পাল্টাচ্ছে আকাশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। একটা রুক্ষু ভাব মাখামাখি চারপাশে। এখন সূর্য ড়ুবলেই চোরা পায়ে ঠাণ্ডা নেমে আসে আকাশ থেকে। রাত নটাতেই সেটা টের পাইয়ে ছাড়ে। রোদে গরম করে রাখা লেপ কম্বল পৌঁছে যায় খাটে খাটে। এখন আর চাদরে কাজ হয় না। এই সময় বাগানে পাতি তোলার কাজটা বাড়ে। ফ্যাক্টবিব ওপর চাপ পড়ে। মাঝে মাঝেই রাতে কাজ হয় সেখানে। ভুটিয়া পুরো হাতা পুলওভার নিয়ে রাতে বের হন। অমরনাথ। কারো কারো মাথায় ইতিমধ্যেই মাঙ্কিক্যাপ উঠে গেছে।

অনন্তর এখন নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। মায়ের শরীর এখন নিটোল। এক পোঁচ রঙ পড়ে গেছে। ইতিমধ্যে। মাঠের কোণে প্যাণ্ডেল বাঁধাব কাজ চলছে। বাগানের। বাবুরা ছুটির পর তার সামনে চেয়ার পেতে বসে নানান আলোচনা করছেন রোজ। পুজোর দাযিত্ব এবারও শ্যামলের ওপর। প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি হবার সুযোগ তার নেই। কিন্তু খেটে কাজ তুলতে তার জুড়ি নেই একথা সবাই স্বীকার করে। আজ রাত্রে ঠাকুরকে প্যাণ্ডেলে আনা হবে। পরশু পুজো। আগামীকাল সারারাত জেগে মায়ের সাজ শেষ করবে, চোখ আঁকবে অনন্ত।

আজ অমরনাথকে রাত নটায় ফ্যাক্টরিতে যেতে হবে। বিকেলে অফিস থেকে ফিরে চা খেয়ে তিনি এলেন পুজো প্যাণ্ডেলে। সেখানে তেজেন্দ্র একাই আসব জমিয়েছেন। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর সাধারণত সবাই তাঁকে এড়িয়ে চলে সারা বছর। কিন্তু এইসব বারোয়ারি ব্যাপার এলে তিনি মাতকবরী করতে ছাড়েন না। তেজেন্দ্রর ছেলে, এখন যিনি বড়বাবু তিনি রয়েছেন দূরে। পিতার সামনে থাকলে তাঁর ব্যক্তিত্ব কম হওয়ার সম্ভাবনা। অমরনাথকে দেখে তেজেন্দ্র বললেন, এসো অমর। তুমি হয়তো কিছুটা মনে করতে পাবরে। এদের বলছিলাম পুরনো দিনের কথা। পঁয়তাল্লিশ বছর আগে যখন এই বাগানে এলাম তখন কালীপুজোর কথা ভাবতেই পারতাম না। কে পুজো করবে? বাঙালি বলতে তো আমরা চারজন। না না হরিপদ তখনও জয়েন করেনি। চৌমাথায় কোন দোকান ছিল না হে। বিকেল হলেই ঘরের দরজা বন্ধ করতে হত। ওই যে তারের বেড দেখছ। ওইখানে বসে বাঘ ডাকত। কুকুরের মত শেয়াল ঘুরে বেড়াত এই মাঠে।

একটু দূরে দাঁড়িয়ে শ্যামল প্যাণ্ডেল বাঁধা দেখছিল। ত্রিপল বাঁশ সব বাগানেরই। যারা কাজ করছে তাদের পাঠানো হয়েছে ফ্যাক্টবি থেকেই। শ্যামলের কান ছিল এদিকে। তাই প্রশ্ন করে বসল, তাহলে পুজোটা শুরু হল কিভাবে জ্যাঠামশাই।

কেউ প্রশ্ন করলে তেজেন্দ্র খুশী হন। তাছাডা এই সময়টাতেই চাকরির পদ অথবা বয়সের বাদবিচাবি করা হয় না। তিনি পাকচুলে হাত বুলিয়ে বললেন, একবার বড় সাহেব আমাকে ডেকে পাঠালেন। মিল্টন সাহেব। চাষ করতে এদেশে আসেনি হে। পেটে বিদ্যে ছিল। মিল্টন সাহেব বললেন, বাবু, তুমি কি হিন্দু?

আমি বললাম, ইয়েস স্যার। সেন্ট পার্সেন্ট হিন্দু। মুরগীও খাই না।

মিল্টন সাহেব খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন, তবে আদমসুমারিতে বলছে যে এ তল্লাটে কোন হিন্দু থাকে না। সবাই মুসলমান।

আমি তো অবাক। মাঝে মাঝে মুসলিম লীগের লোকজন এসে চৌমাথায় ভিড় জমাতো বটে হাটেব দিনে কিন্তু আর কিছু খবর রাখতাম না। সাহেব বললেন, তোমাদের তো অনেক ভগবান শুনেছি। তাদের মধ্যে পছন্দ করে তুমি একটা ভগবানের নাম বল যার পূজো তোমরা করতে পার। আমি কোম্পানি থেকে সেই পুজোর খরচ দেব।

আমি তো উৎফুল্ল হয়ে বললাম, দুর্গাঠাকুর আমাদের জননী।

সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, তার পুজো করতে কত খরচ হবে? বাজেট দাও।

আমি দিলাম কাগজে লিখে। দেখে সাহেবের চক্ষু চড়কগাছ। সে কি, তুমি বললে একজন আর এ যে দেখছি পুরো ফ্যামিলি। তার ওপর চার পাঁচ দিন ধরে পুজো। তার মানে এই কদিন নো ওয়ার্ক? অসম্ভব। এই পূজো করতে আমি অনুমতি দিতে পারি না। তোমাদের মুশকিল কি জান কিছু চাইতে বললে তোমরা মাত্রা ছাড়িয়ে চাও। এমন একটা পূজো কর যার সঙ্গে কোন ফ্যামিলি থাকবে না এবং একদিনেই শেষ হয়ে যাবে; তখন সব দেবদেবীকে ছেড়ে শ্যামামায়ের কথা মনে পড়ল! বাজেট দিতেই অনুমতি পাওয়া গেল।

তেজেন্দ্র গল্পটা তখনও শেষ করেননি তা ওর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল।

ডাক্তাববাবু জিজ্ঞাসা করলেন, কত বাজেট দিয়েছিলেন?

পনের। বড় সাহেব সেটা কমিয়ে বারো করেছিলেন। তা সেই পূজো করে প্রমাণ হল এই চা-বাগানে হিন্দুরা থাকে। বলতে পার আমিই প্রথম মায়ের পূজো করলাম।

চারজনে মিলে এত বড় পুজো? শ্যামল যেন সন্দেহ দেখাল।

চারজন? চা-বাগানেন সমস্ত মদেশিয়া কুলিকামিনরা হাত মেলালো। সেই কদিন আর তারা গীর্জায় যায়নি। তা যা বলছিলাম, সাহেব এলেন ঠাকুর দেখতে মেমসাহেবকে নিয়ে। এক মিনিট দাঁড়িয়েই তাঁবা চলে গেলেন। আমাদের মাথায় হাত। সাহেব কি কোন কারণে রেগে গেলেন আমাদের ওপরে? শলাপরামর্শ করে সঙ্গে সঙ্গে ছুটলোম চা-বাগানের কোণে মিল্টন সাহেবের বাংলোয়। সাহেব আমাকে দেখে বললেন, ছি ছি! কি লজ্জার ব্যাপার। তুমি তো আমাকে বলবে তোমার ভগবান জামাকাপড় পরে না। মেমসাহেবকে নিয়ে তাহলে যেতাম না। তাছাড়া হাজার হোক তিনি একজন নারী, তাঁকে অত বড়সড় করে তৈরী না করে স্বাভাবিক লম্বা করলেই তো পারতে। সাহেবকে বোঝাতে আমার প্রাণান্ত। এসব তো আর তোমাদের ফেস করতে হচ্ছে না হে। এখন মোটা মোটা চাঁদা তুলছ সাপ্লায়ারের কাছ থেকে, কোম্পানিও কিছু দিচ্ছে, কাউকে জবাবদিহি দেবার নেই। আমাদের সেই সময়টাই ছিল আলাদা। সেইসময় যদি চেষ্টা না করতাম এখন তোমরা কি ফলভোগ করতে পারতে?

আজকাল তেজেন্দ্ৰ যে কোন প্রসঙ্গ এইভাবে খোঁচা দিয়ে শেষ করেন। বুড়ো মানুষ, ভাসান পর্যন্ত তাঁর বকবকানি শুনতে হবে। অমরনাথ সরে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তেজেন্দ্ৰ ছাড়বার পাত্র নন। চেয়ার ছেড়ে তিনি উঠে এলেন। অমরনাথ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন দীপা মায়ের মূর্তির সামনে ছেলেগুলোর সঙ্গে দাঁড়িয়ে। তেজেন্দ্র বললেন, অমরনাথ, তোমার সঙ্গে দুটো কথা আছে।

বলুন। অমরনাথ দেখলেন অন্য বাবুরা নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছেন। তেজেন্দ্ৰ যতদিন ক্ষমতায় ছিলেন তখন কেউ সাহস পেত না এমন করতে। প্ৰাক্তন বড়বাবু এবং বর্তমান বড়বাবুর বাবা হিসেরে এখন সামনাসামনি কেউ কিছু বলে না। কিন্তু বেশী কথা বলার স্বভাব অবসর নেওয়ার পর তৈরী হওয়ায় লোকে ওঁকে নিয়ে আড়ালে মশকরা করে। মানুষ নিজেই নিজের সম্মান হারাতে সাহায্য করে।

তেজেন্দ্ৰ বললেন, তোমার মায়ের বয়স হয়েছে। বউমা সংসারধর্ম নিয়ে ব্যস্ত। তিনি তো অনেক দিন ধরে সেবাযত্ন করে এসেছেন, এখন বউমার পালা। তুমি তাঁর দিকে নজর দাও।

অমরনাথ কিঞ্চিত অপ্ৰস্তৃত, আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।

তেজেন্দ্ৰ অমরনাথের কাঁধে হাত রাখলেন, সেদিন তোমার মায়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। মনে হল তীর্থে যাওয়ার শখ খুব। একবার ওকে নিয়ে তীর্থে ঘুরে এস। এই কাশী, বৃন্দাবন, হরিদ্বার। হরিদ্বারে অবশ্য আমি যাচ্ছি। আমার সঙ্গেই যেতে পার তোমরা।

অমরনাথ এবার অবাক। জ্ঞান হবার পর তিনি কোনদিন মনোরমার মুখে এমন অভিলাষের কথা শোনেননি। মনোরমা তাঁকে বা অঞ্জলিকে না জানিয়ে তেজেন্দ্ৰকে বলতে গেলেন কেন? মন খারাপ হয়ে গেল তাঁর। তেজেন্দ্র বললেন, আর দ্বিতীয্য কথাটি হল দীপাকে নিয়ে। যাদের সঙ্গে এতকাল খেলাধুলো করত, ছেলেমানুষ বলেই তা মানিয়ে যেত। কিন্তু এখন সতর্ক হবার সময় হয়েছে। সবই তো দেখি আমি ওই বারান্দায় বসে।

আপনি কি বিশেষ কিছু দেখেছেন? অমরনাথ বিরক্ত গলায় প্রশ্ন করলেন।

না ঠিক তেমন নয়। তবে যেভাবে হুড়োহুড়ি করে তা উচিত নয়। তেজেন্দ্রর কথা শেষ হওয়ামাত্র দীপা দৌড়ে এল। কাছে, বাবা, কাল রাত্রে যখন ঠাকুরের চোখ আঁকা হবে তখন আমি মণ্ডপে আসব?

কেন? অমরনাথ বিরক্তি এড়াতে পারলেন না।

সবাই বলছে সেইসময় নাকি কালীঠাকুরের শরীরে ভগবান এসে যায়।

কখন চোখ আঁকা হবে তার ঠিক নেই। যাও বাড়ি যাও।

বল না, আসব কি না! বিশু বলেছে চোখ আকার আগে আমাকে বাড়িতে গিয়ে ডেকে আনবে। তুমি হ্যা বললে মা আর কিছু বলবে না। দীপা খুব সাহস করে কথাগুলো বলে যাচ্ছিল। অমরনাথ আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। চাপা গলায় ধমকে উঠলেন, বড্ড বাড়াবাড়ি করছ। যাও, এখনই বাড়ি চলে যাও।

দীপা অবাক চোখে অমরনাথকে একবার দেখে আচমকা ঘুরে নিজেদের কোয়ার্টার্সের দিকে দৌড়ে চলে গেল। অমরনাথ তেজেন্দ্রর কাছ থেকে সরে এলেন। এবং তখনই তিনি হবিদাসবাবুর সামনে পড়ে গেলেন। অমরনাথ বললেন, হরিদাসদা, আমি ভাইফোঁটার পরই জলপাইগুড়িতে যাব ওঁদের সঙ্গে কথা বলতে। আপনি যদি একটু জানিয়ে দেন তাহলে ভাল হয়।

হরিদাসবাবু খুশী হলেন, হ্যা হ্যাঁ, শুভকাজে অকারণে দেরি করো না। এমন পাত্রের খোঁজ পেলে যে কেউ তো ছুটে যাবে হে দেরি করলে আবার আপুল কামড়াতে না হয়।

 

আলো নিবে এলে মণ্ডপে হ্যাজাক জ্বলল। তিনটে হ্যাজাক মাঠের চেহারাটা পাল্টে দিল লহমায। বাবুবা চাদর মুড়ি দিয়ে এখনও আড্ডা মারছেন। তেজেন্দ্র ফিরে গেছেন কোয়ার্টার্সে হিম পড়ছে বলে! অনন্ত হ্যাজাকের আলোয় এখনও কাজ করে যাচ্ছে। একসময় সে হাঁকল, ঠাকুর তোল গো।

অমবনাথের হঠাৎ একটা কাঁপুনি এল। চুপচাপ একপাশে বসে ছিলেন তিনি। অনন্তর হাঁকটা কানে যাওয়ামাত্র শরীরে শিরশিরানি ছড়িয়ে পড়ল। সব কিছুবই একটা সময় আসে আর তখন ঈশ্বর নীরবে হাঁক দেন। যে মানুষ সেটা শুনতে পায় তার চেয়ে সুখী কেউ নেই। সময়ের ডাক সময় পেরিয়ে গেলেই বা না এলেই আমাদের কানে আসে যে! পাশে বসা নবনী জিজ্ঞাসা করল, কি হল অমরদা দা শরীর খারাপ করছে? অমরনাথ চমকে উঠলেন, না তো!

নবনী বলল, আপনি এমনভাবে কেঁপে উঠলেন যে আমার মনে হল কিছু একটা হয়েছে।

অমরনাথ হাসার চেষ্টা করলেন, না হে। ওই অনন্ত আচমকা এমন হেঁকে উঠল। যে–। কথা শেষ করলেন না অমরনাথ। নবনী মুখ ঘুরিয়ে নিল। অমরনাথের মনে পড়ল লালাবাবুর কথা। বেলা যায় শুনে ভদ্রলোক একবস্ত্রে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কাঁপুনিটা তাঁর শরীরে যত তাড়াতাড়ি এল মিলিয়ে যেতে তার চেয়ে বেশ সময় নিল না!

মণ্ডপে নিয়ে আসা হল রঙবিহীন কালীঠাকুরকে। উদ্যোগটা শ্যামলেরই তারই হাকাহাকি সবাইকে ছাপিয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে ঘাস থেকে, দেওদারু চাঁপার গাছ থেকে অজস্র শ্যামাপোকা ছুটে এসেছে হ্যাজাকগুলোর গায়ে। অমরনাথ প্ৰায় নিঃশব্দে চলে এলেন কোয়ার্টার্সে। বাইরের দরজা শক্ত করে ভেজানো ছিল। সামান্য চাপ দিতে খুলে গেল। বাইরের ঘরে জাম্বো হারিকেন জ্বলছে। ভেতরের বড় ঘর থেকে অঞ্জলির গলা ভেসে এল, মা, কাল চৌদ্দশাকটা আপনি করুন। গতবার আপনার ছেলের আমার রান্না ভাল লাগেনি।

মনোরমা বললেন, চোদ্দরকম শাক একসঙ্গে ভেজে নেবে। এর আবার রান্না কি আছে। চোদ্দটা প্ৰদীপ তোলা আছে। কাল সলতে পাকিয়ে নিলেই হবে। আর হাঁ, শাকগুলো যখন বুধুয়া তুলবে তখন তুমি একটু দাঁড়িয়ে থেকে নইলে জংলা পাতা মিশিয়ে দেবে।

অঞ্জলি বলল, না না। আমি ওকে বলেছি চোদ্দরকম শাক আলাদা করে ভাগ করে রাখবি আমি দেখাব পর মেশাবি।

ঘরে পা দিতেই অমরনাথের বিদ্যাসাগরী চটিতে মচ মচ শব্দ উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ভেতরের ঘরের আলাপ থেমে গেল। অমরনাথ মুখ তুলে বড় ঘড়িতে সময় দেখে চেয়ারে গিয়ে বসলেন। খবরের কাগজটা টেনে হেডিং দেখলেন, বিধানচন্দ্র রায় জহরলাল নেহরুর সঙ্গে উদ্ধান্তু সমস্যা নিয়ে আলোচনায় বসবেন। কাগজ রেখে দিয়ে অমরনাথ ডাকলেন, মা।

মনোরমার সাড়া এল, বল।

একবার এই ঘরে আসবে? যতটা সম্ভব নরম গলায় প্রশ্নটা করলেন অমরনাথ।

মনোরমা উঠে এলেন দরজায়, কি হয়েছে?

তোমার সঙ্গে কথা ছিল। কি কথা!

বল। না। মানে, আমি তো জানতাম না তোমার তীর্থ-দর্শনের বাসনা হয়েছে। তুমি কি ঠিক করেছ কোন কোন তীর্থে যেতে চাও? মুখ না তুলেই প্রশ্ন করলেন অমরনাথ।

আমি? তীর্থদর্শন করতে চাই? কি আজেবাজে কথা বলছিস? ঝাঁঝিয়ে উঠলেন মনোরমা।

আমি তো তাই শুনলাম। ফেব্রুয়ারি মাসেব আগে আমি তো ছুটি পাব না। তার ওপর যদি বিয়ের দিন স্থির হয়ে যায়-, মানে খরচ টরচ তো হবে, তবু তোমাকে নিয়ে যেতে পারব ছুটি পেলে। আগে থেকে ব্যবস্থা করলে নিশ্চয়ই থাকব জায়গা পাওয়া যাবে।

আমি তীর্থে যেতে চেয়েছি এ কথা তোকে কে বলল?

পুরোন বড়বাবু।

কি বললেন তিনি?

এইসব কথাই। তোমার যাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে অথচ আমি খবর রাখছি না। উনি নিজেও নাকি হরিদ্বারে যাচ্ছেন। তোমাকে তো কখনই এসব কথা বলতে শুনিনি। অমরনাথের কথা শেষ হওয়ামাত্র পেছনের দরজায় দাঁড়িয়ে অঞ্জলি প্ৰচণ্ড জোরে হেসে উঠল। মুখে হাত চাপা দিয়েও সে নিজেকে সামলাতে পারছিল না। হতভম্ব অমরনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, কি হল?

মনে হল মনোরমাও কিঞ্চিত অপ্ৰস্তুত। চাপা গলায় বললেন, অঃ বউমা।

অঞ্জলি হাসি নিয়েই বলল, ওই বুড়োর মতিভ্ৰম হয়েছে। মা কিছুই বলেনি। উনিই গায়ে পড়ে নানান উপদেশ দিয়ে বললেন হরিদ্বারে যাচ্ছেন। বোধহয় খুব শখ হয়েছে মাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার। ব্যাটাছেলের জাতটাই এমন।

মনোরমা এবার ধমকে উঠলেন, যা মুখে আসছে তাই বলছি তুমি।

ঠিক কথাই বলছি মা আপনাকে একা পেয়ে বলে দেখল লাভ হচ্ছে না। তাই আপনার ছেলেকে তাতাতে গেল। আর তুমিও এমন কানপাতলা মানুষ তাই বিশ্বাস করে ফেললে। আশ্চর্য!

অমরনাথ মুখ নিচু করে বসেছিলেন। মায়ের দিকে তাকাতে তাঁর লজ্জা করছিল। তেজেন্দ্র চিরকালই চুকলিখোর, ধান্দাবাজ। যখন চাকরিতে ছিলেন তখন অনেক কষ্টে মানিয়ে ছিলেন অমরনাথ। তেজেন্দ্ৰ অন্তত তিনজন বাবুর চাকরি খেয়েছেন সাহেবের কাছে লাগিয়ে। সেসব অবশ্য অনেকদিন আগের কথা। কিন্তু এই বয়সে যে তিনি মনে মনে অমন ভাবনা পোষণ করেন তা ভাবতেই শরীর শক্ত হয়ে গেল অমরনাথের। মনোরমা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সেটা অনুমান করলেন, আমার বাবা এখন কোথাও যাওয়ার বাসনা নেই। মরার আগে শুধু একবার জন্মস্থানটা দেখতে যাব। তাই দেখাস।

অঞ্জলি বলল, সেটা তো মালবাজারে। এখান থেকে আর কতটুকু!

মনোরমা মাথা নাড়লেন, না। মালবাজারে আমার বাবা চাকরিতে বদলি হয়ে এসেছিলেন। ছেড়ে দাও এসব কথা। তুই তো গুদামে যাবি। বউমা খাবার দিয়ে দিক।

একটু পরে। দীপা কোথায়? অমরনাথ প্ৰসঙ্গ পাল্টাতে গিয়ে আর একটা অস্বস্তিতে পড়লেন। দীপার নামটা মুখে আনামাত্ৰ মনে হল মেয়েটাকে যেন একটু বেশী বকেছেন তখন। অবশ্য তেজেন্দ্ৰ মনোরমার সম্পর্কে বানিয়ে বললেও দীপা সম্পর্কে খুব কিছু বলেননি। বিশু খোকনদের সঙ্গে মেলামেশা ওঁর চোখে খারাপ লাগার আগে মনোরমারই লেগেছে। আর তো কদিন!

অঞ্জলি জবাব দিল, কিছুক্ষণ আগে ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরল। বলল কিছু খাবে না শরীর খারাপ। একটু আগে দেখলাম মায়ের ঘরে বই নিয়ে বসেছে।

কাছে পিঠে নেই তো।

অঞ্জলি মুখ ঘুরিয়ে বলল, না।

অমরনাথ বললেন, বসো মা। একটু আগে হরিদাসদাকে বলে দিলাম পাত্ৰপক্ষকে জানিয়ে দিতে যে আমি ছেলে দেখতে যাব।

দুদ্দাড় করে দুজোড়া কচি পা ছুটে গেল ভেতরের বারান্দায়। দরজা ভেজানো। একটা গুনগুনানি আসছে, ঘরের ভেতর থেকে। সত্যসাধনবাবু আজ আসবেন না। পুজোর কদিন সকালে এসে পড়িয়ে যাবেন তিনি। তাঁরই দেওয়া হোমটাস্কের একটা অংশ মুখস্থ কাবাব চেষ্টা করছিল দীপা; অথচ মনু কিছুতেই স্থির হচ্ছিল না। এই মুহুর্তে অভিমান নিয়ে নেমে এসে খিদে এবং পুজোক মণ্ডপ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল এক সঙ্গে। পড়তে বসা শুধু জেদের বশেই, যে জেদ জন্ম নিয়েছিল অভিমান থেকেই। এখন দরজায় শব্দ হতে দীপার মনে হল ঠাকুমা এসেছেন মান ভাঙাতে। সে আবার পাঠে মন দেওয়ার চেষ্টা করতেই খিলখিল হাসি শুনতে পেল। চোখ কুঁচকে হ্যারিকেনের আলোয় দীপা দেখতে পেল দুই ক্ষুদে বদমাস দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।

অ্যাই। কি চাই এখানে? পড়াশুনা নেই?, ধমকে উঠল দীপা।

বড়টা দাঁত বের করে হাসল, এই দিদি। তোর বিয়ে!

বিয়ে? হকচাকিযে গোল দীপা।

হুঁ। জলপাইগুঁড়িতে বিয়ে হবে। কি মজা! আমরা নেমন্তন্ন খাব।

মারব এক থাপ্পড়। ইয়ার্কি হচ্ছে, না? দীপা এবার চিৎকার করে উঠল।

এইসময় অঞ্জলির গলা পাওয়া গেল, এই ওখানে তোরা কি করছিস? পড়াশুনা করতে বললেই বুঝি পিঠে পাখা গজায়। আয়। ক্ষুদেরা দরজা ছেড়ে ছুটে ফিরে গেল। আর তারপরেই সেখানে অঞ্জলিকে দেখা গেল, তুই চেঁচাচ্ছিলি কেন?

ঠোঁট টিপে চোখ বড় বড় করে দীপা মাকে দেখল। অঞ্জলি একটু গলা নামিয়ে মেয়েকে জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে তোর?

বই-এ মুখ নামাল দীপা, কিছু না। ওরা আমার কত ছোট। অথচ আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারে।

কি বলেছে তোকে?

আমার নাকি বিয়ে! এরপর বললে আমি কিন্তু মারব।

মারবি কেন মেয়েদের তো একসময় বিয়ে হয়ই।

সেই সময় যখন আসবে তখন বলুক।

সময় কখন আসবে সেটা ঠিক করবেন তোমার বাবা।

মানে।

এর আবার মানে কি। ভাল ছেলে পেলে তোমার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে।

না। আমি এখন বিয়ে করবই না।

তাহলে কি বাড়ি বাড়ি বাসন মেজে বেড়াবে।

আমি পড়ব। চাকরি করব।

বুঝেছি। ওই রমলা সেন তোমার মাথা ঘুরিয়ে দিয়ে গেছে। এখন এস, একটু মুখে দিয়ে আমাকে উদ্ধার করে। একটা কথা যদি তুমি আমার শোন আজকাল। অঞ্জলি চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। দীপা ঠিক বুঝতে পারছিল না ব্যাপারটা কি হল। হঠাৎ আজ তার বিয়ের কথা উঠল। কেন? তার বয়সে এই বাগানে কারো বিয়ে হয়নি। ওই যে, ললিতাদি, কত বড়, তবু তো বিয়ে হচ্ছে না। কিন্তু ক্ষুদে দুটো খামোকা তার সঙ্গে বসিক তা করতে যাবে কেন? বই এবা অক্ষবগুলো কেমন জড়িয়ে মিশিযে অদ্ভুত চেহারা নিচ্ছিল এখন।

রাত্রে সবার খাওয়া দাওয়ার পব মনোরমার পাশে শুযে সে মৃদুস্বাবে বলল, ঠাকুমা, মা না আমাকে মিছিমিছি ভয় দেখিয়েছে।

কিসের ভয়? মনোরম পাশ ফিরে শুযেই জিজ্ঞাসা করলেন।

বিয়ের।

মনোরমা জবাব দিলেন না। দীপা একটু অপেক্ষা করে এবার আলতো নাড়া দিলে মনোরমার বাজু ধরে, ও ঠাকুমা।

আঃ। জ্বালাস না বাপ। বড্ড ঘুম পাচ্ছে। মনোরমা প্ৰসঙ্গটায় যেতে চাইলেন না।

 

আগামীকাল কালীপূজো। কোয়ার্টার্সের সামনের মাঠে এবার শুধু প্যাণ্ডেল বাধা হয়নি, সামনের অনেকটা জায়গা ঘিরে টব দিয়ে সাজানো হয়েছে। সাহেব একটা ডায়নামো পাঠিয়েছেন ফ্যাক্টরি থেকে! ঘেরা জায়গার সামনে ভেতবে যাওয়ার জন্যে যে গেট করা হয়েছে তাতেও রঙিন কাগজে মুড়ে বাল্ব ঝোলানো হয়েছে। এই প্ৰথম, আজ রাত্রে এই চা-বাগানের কোয়ার্টার্সগুলোর সামনে ইলেকট্রিক আলো জ্বলবে। এখন পূজোর আমেজ ছড়িয়েছে সর্বত্র। উৎসব উৎসব ভাব সারা মাঠে। সা্রাটা দুপুর মাঠে থেকে দীপা লক্ষ করল ললিতাদি একবারও এল না রাস্তা পেরিয়ে মণ্ডপে। অথচ দুপুর থেকেই নিজেদের কোয়ার্টার্সের বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে আছে ললিতাদি। আর শ্যামলদা সারাদিন ছুটোছুটি করে তদারকি করে যাচ্ছে এখানে। বিকেল ফুরিয়ে গেলে ডায়নামো চালু হতেই অন্ধকার মেখে যাওয়া মাঠের চেহারা বদলে গেল। তেজেন্দ্র চিৎকার করে বলে উঠলেন, একেবারে ইন্দ্রপুরী করে ফেললে হে!

কালীপুজোর আগের রাত্রেই এমন ভিড় কখনও হয়নি। ইলেকট্রিকের আলোয় সাজানো প্যাণ্ডেল দেখতেই কোয়ার্টার্সগুলো থেকে তা বটেই চৌমাথার লোকজনও আসতে লাগল এখানে। অবশ্য প্ৰতিমার সামনে বিরাট একটা পর্দার আড়াল রেখেছে শ্যামলদা। মায়ের চোখ আঁকা শেষ না হওয়া পর্যন্ত জনসাধারণের চোখের আড়ালে থাকবেন তিনি। বিশু অনন্তর কাছ থেকে খবর এনেছে চোখ আঁকা হবে রাত তিনটের সময়।

একসময় মায়ের সঙ্গে ললিতাদি এল মণ্ডপে। ওর মা যখন পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলছিল তখন ললিতাদি এমন ভঙ্গীতে দাঁড়িয়েছিল যেন অজানা জায়গায় এসেছে। এমন কি শ্যামলদা যে দুবার সামনে দিয়ে চলে গেল তা চোখ ফিরিয়ে দেখলই না। খুব মজা লাগছিল দীপার। যারা চা-বাগানের গাছের ভেতলে লুকিয়ে কথা বলে তারা কেন সামনা-সামনি অপরিচয়ের ভান করে থাকে! ব্যাপারটা বিশু বা খোকনের নজরেই পড়ছে না। দীপার মনে হল এইজন্যে ওদের রেজাল্ট খারাপ হয়। কিছুই মনে রাখতে পারে না।

সাড়ে আটটার সময় অঞ্জলির সঙ্গে বাড়িতে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছিল দীপা। মাথার ওপরে হিম পড়ছে। রাত্রে ঘুমানোর সময় সে মনোরমাকে অনুরোধ করেছিল ঠাকুরের চোখ আঁকার সময় যেতে দেওয়ার জন্যে। মনোরমা মত দেননি। অত রাত্রে যাওয়া ঠিক হবে না। অনেক বায়নার পরে বলেছিলেন, তিনটের সময় যদি ঘুম ভাঙ্গে তখন ভেবে দেখব। কিন্তু আজ দীপার কিছুতেই ঘুম আসছিল না। সবাই রাত জাগবে আজ আর সে-ই শুধু বাড়িতে পড়ে আছে। এর মধ্যে খোকন তাকে ঠাট্টা করেছে মেয়ে বলে। বুকের মধ্যে একটা অভিমানের উত্তাপ গোল হয়ে ঘুরছিল। মাঝে মাঝে ঘুম আসছিল বটে। কিন্তু সেটা ভেঙে যেতে সময় লাগছিল না। শেষপর্যস্ত সে ঘড়িতে দুটো বাজতে দেখল। নিবু নিবু হ্যারিকেনের সামনে ঠাকুমার গোল ঘড়িতে একসময় আড়াইটে বাজল। দীপা আর বিছানায় থাকতে পারছিল না। পোনে তিনটের সময় সে বিছানা ছাড়ল। সন্তর্পণে নিচে নেমে দেখল মনোরমা আঘোরে ঘুমাচ্ছেন। তাঁর মুখ সামান্য খোলা, দাঁত চিকচিক করছে। পা টিপে টিপে দীপা দরজার কাছে গেল। মনোরমার ঘুম ভাঙবার সম্ভাবনাই নেই। সে সন্তর্পণে দরজাটা খুলল। হুডকোটা নামাবাব সময় সামান্য শব্দ হল কিন্তু মনোরমা তা টের  পেলেন না। বাইরে ঘুটফুটে অন্ধকার! এই সময় অমবস্যা নামবার কথা। বছরের সবেচেয়ে কালো রাত। এই রাতে নাকি সব ভূতপ্ৰেত পৃথিবীতে নেমে আসে। দীপার সমস্ত শরীরে কাঁটা ফুটল। কোন মতে দরজাটা ভেজিয়ে সে এক লাফে উঠোনে নেমে ছুটতে ছুটতে তারের বাড়ার কাছে পৌঁছে গেল। অভ্যস্ত ভঙ্গিতে সেটা লাফ দিয়ে পেরিয়ে এসে শিশির ভেজা ঘাসে দাঁড়িয়ে দীপা চট করে নিজেদের কোয়ার্টার্সকে দেখে নিল। অন্ধকারে ভূত হয়ে আছে। গাছাপালাগুলোকেও আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। আজ রাত্রেও অমরনাথ ফ্যাক্টরিতে গিয়েছেন। বাবাকে অসম সাহসী বলে মনে হল দীপার। এই ভূতচতুর্দশীর অন্ধকারে বাবা চা-বাগানের ভেতর দিয়ে ফিরে আসবে একা। সে ছুটল। দূরে একটা হ্যাজাক জ্বলছে। ডায়নামোর আওযাজ কানে এল না। আওযাজটা হচ্ছে না বলেই ইলেকট্রিকের আলোও নেই। দীপার কানে কলের গান ভেসে এল। বাড়ি থেকে প্রতিবছর নিয়ে আসে শ্যামলদা। পাণ্ডেলের পেছনে এসে দাঁড়াল সে। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান বাজছে,  কোন এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোন রূপকথা নয়, সে নয়। চিনচিনে সরু গলায় গান বাজছে। অথচ রেডিওতে যখন গানটা বাজে তখন গলাটা ভরাট লাগে। একটু একটু করে দীপা ঘুরে গিয়ে প্যাণ্ডেলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আঃ। ঠাকুরের গায়ে এখন চকচকে নীলচে কালো রঙ। মাথার চুল লাগানো হয়ে গেছে। যে আড়ালটা সামনে রাখা ছিল সারাদিন সেটা এখন সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। শীতেব জন্যেই সবাই ঠাকুরেব সামনে চাদর মুড়ি দিয়ে বসেছে। এক কোণায় বিশু খোকনদেরও দেখতে পেল সে। কেউ এখন অন্ধকার মাঠের দিকে তাকাচ্ছে না। অনন্ত চুপচাপ বিড়ি খাচ্ছে। ওই মানুষটা এত সুন্দর ঠাকুর গড়তে পারে! ঠাকুমা বলেন অনন্তর ওপর নাকি ভগবানের ভর হয়। দীপা কালী ঠাকুরেব মুখের দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে কাঁপুনি এল তার। দুই চোখ সাদা। কপালেও চোখ ফোটেনি। হঠাৎ শীত করতে লাগল। এমন যে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল মণ্ডপের দিকে। তারপর কেউ লক্ষ করার আগে ঝুপ করে বসে পড়ল খোকন আর বিশুর মাঝখানে। বসেই ফিসফিসিয়ে বলল, চাদরটা আমাকে একটু দে।

ওরা দুজন খুব অবাক। খোকন বলল, কি করে এলি? তোর মা কিছু বলেনি?

কেউ জানে না। সবাই ঘুমোচ্ছে। ফিসফিস করে জবাব দিল দীপা।

এই রাত্রে একা একা এলি তুই?

হুঁ।

কি সাহস রে। আমার ঘুম পাচ্ছে কিন্তু একা বাড়িতে যেতে সাহস পাচ্ছি না।

মায়ের কোলে বসে দুদু খা যা। কথাটা বলে দুজনের চাদরের বাড়তি অংশ টেনে নিয়ে নিজের শরীরে জড়াল দীপা। এখন তিনটে শরীর পরস্পরের উত্তাপ পাচ্ছে।

শীত থেকে রেহাই পেয়ে দীপার আরাম লাগছিল। এইসময় শ্যামলদা বিরাট কেটলি আর কয়েকটা গ্লাস নিয়ে প্যাণ্ডেলে ঢুকল, নাও, অনন্তদা, গলা ভিজিয়ে নিয়ে তোমার কাজ শেষ কর। চা দেখে বড়দের মধ্যে উল্লাস দেখা গেল। শ্যামলদা এবার এদিকে তাকিয়ে বলল, কি রে! খুব বড়দের সঙ্গে তাল দিয়ে রাত জাগছিস! তা খাবি নাকি! তিনজনেই একসঙ্গে মাথা নেড়ে না বলল। ওদিকে তখন চোঙা গ্রামাফোনে রেকর্ড পাল্টানো হয়েছে, অন্ন দে! সঙ্গে সঙ্গে শ্যামলদা ধমকালো, অ্যাই। মাঝ রাতে আর অন্ন চাইতে হবে না। অন্য রেকর্ড বাজা। রেকর্ড পাল্টানো হল। এবার যে গান বাজল তা দীপার খুব ভাল লাগে, চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে।

চা খেয়ে একটা বড় টুলের ওপর উঠল অনন্ত। খুব দ্রুত তুলির আঁচড়ে মায়ের দুটি চোখ আঁকা হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মুখখানার চেহারা পাল্টে গেল। সেদিকে তাকিয়ে হঠাৎ দীপা জিভ বের করল। বিশু সেটা লক্ষ্য করে ধমকালো, আই জিভ ঢোকা!

কেন? জিভটা টেনে নিল দীপা চটপট।

মা কালীকে ভেঙাচ্ছিস?

কপালের চোখ আঁকা না হলে মা কালী হয় না। দীপা মাথা নেড়েই বিরক্ত হল, এই খোকন, ঠেলিস না। ঠিক হয়ে বস। পায়ের তলায় ত্রিপল তবু উঁচু হয়ে বসেছিল সে। হঠাৎ মনে হল পেটের ভেতরটা কেমন করে উঠল।

অনন্ত এবার গলা তুলল, গান বন্ধ কর ভাই। এবার মায়ের তৃতীয় নয়ন জাগ্রত হবে। খুব মনঃসংযোগ দরকার। কেউ কথা বলবে না। ভাই শ্যামল, কাঁসব ঘণ্টা আছে না, ঢাকীদের বল তৈরী হতে। যেই মায়ের চোখ আঁকা হয়ে যাবে অমনি বাদ্য বাজাবে। শ্যামলদা উত্তেজিত হল, একটু দাঁড়ান অনন্তদা। এই যে ঢাকী ভাই, ওঠ ওঠ। আমি ইশারা করা মাত্র বাজাতে আরম্ভ করবে।

ঘুম ভাঙা মুখে বিরক্তি এনে ঢাকী ঠাকুরের পেছন থেকে বেরিয়ে এসে বলল, আমাকে আর ইশারা করতে হবে না। পঁচিশটা পুজো পার করলাম।

শ্যামলদা বলল, মেয়েরা তো কেউ নেই। তোরা কেউ উলু দিতে পারিস?

দু-তিনজন চেষ্টা করবে বলল। বিশু সামান্য চাপ দিল দীপার গায়ে, তুই পারিস না?

চুপ। আমি আছি বলবি না। দীপা চাদরটাকে মাথার ওপরে টেনে দিল।

অনন্ত হাত জোড় করে। প্ৰণাম করল, মা, মা আমার। এই অধমের সব পাপ ক্ষমা করো মা। তুমি তোমার অলৌকিক দৃষ্টিতে সমস্ত অতীন্দ্ৰিয় বিষয় দেখে নাও। মা গো। বুকে সহকারীর বাড়ানো থালা থেকে রঙ তুলে নিল অনন্ত।

এখন চারপাশ নিস্তব্ধ। দীপার বুকের মধ্যে উত্তেজনার মাদল বাজছে। সে উদগ্ৰীব হয়ে কালী ঠাকুরের কপালের দিকে তাকিয়ে। অনন্তর আঙুলের সঞ্চালনে একটু একটু করে  রেখা ফুটে উঠছে সেখানে। চোখের আদল ভেসে এল। দীপা আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ল। শ্যামলদা মুখ ফিরিয়ে তাকে দেখে অবাক। এই মুহুর্তে কথা বলা বারণ বলে ইশারা করল দীপাকে বসে পড়ার জন্যে। দীপা সেটা লক্ষই করল না। অনন্ত এবার চোখের মণি আঁকছে। দীপা দম বন্ধ করল। তার পেটের অস্বস্তিটা এখন নিচে নামছে। কনকল করছে সেখানে। হঠাৎ অনন্ত চিৎকার করে উঠল, মা, মাগো। আর সঙ্গে সঙ্গে ঢাক বেজে উঠল। শ্যামলদা চিৎকার করল, কালী মা কি, জয়। সেই প্ৰচণ্ড শব্দ তরঙ্গের মধ্যে দীপা অসহায় মুখে দাঁড়িয়েছিল। মায়ের মুখের চেহারা পাল্টে গিয়েছে, একেবারে। তিনি তাঁর জ্যোতিময়ী রূপ নিয়ে দীপার দিকে তাকিয়ে যেন হেসে উঠলেন। ঢাক বাজছে, কাঁসব বাজছে। কালী মায়ের জয়ধ্বনি চলছে। অন্ধকার ভেদ করে তেজেন্দ্র চিৎকাব্য করলেন, মায়ের তৃতীয় নয়ন আঁকা হয়ে গেল নাকি শ্যামল?

হ্যাঁ, জ্যাঠামশাই। শ্যামলদা জবাব দিলেন।

লুঙ্গি পরে চাদর জড়িয়ে তেজেন্দ্র এসে দাঁড়ালেন মণ্ডপে, বাঃ চমৎকার। মা মাগো!

তিনি নমস্কারের ভঙ্গীতে মাথা নোয়াতেই দীপা চট করে বেরিয়ে পড়ল মণ্ডপ থেকে। এইসময় দূরে  একটা সাইকেলের আলোকে এগিয়ে আসতে দেখল সে। দেখামাত্র দৌড় লাগাল দীপা। পাগলের মত।

এখন অন্ধকার পাতলা। শুকতারা উঠে গেছে। আকাশেব চেহারাটা পাল্টে গিয়েছে। সারা রাত ডিউটি করে ফেরার পথে মণ্ডপে দাঁড়াবেন ভেবেছিলেন অমরনাথ। ঢাকের আওয়াজেই বুঝেছিলেন মায়ের কপালেব চোখ আঁকা হয়ে গেছে। অমবস্যা পড়েছে। কিন্তু সাইকেলের তীব্র আলোর প্ৰান্তে ছুটে যাওয়া ফ্রক পরা শরীরটাকে দেখে তিনি খুব অবাক হয়েই সিদ্ধান্ত পাল্টালেন। একদম বাড়ির কাছে এসে ধরলেন মেয়েকে। সাইকেল থেকে নেমে থরথরিয়ে কাঁপতে থাকা দীপার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তুই? কার সঙ্গে এসেছিলি? কে আসতে বলেছে তোকে?

দীপার চিবুক বুকে ঠেকাল। সে জবাব দিল না। কথার উত্তব না পেয়ে মাথায় রক্ত উঠে যায় অমরনাথের। তিনি মেয়ের কান ধরলেন, পালিয়ে আসা হয়েছিল? বদমাস, অবাধ্য মেয়ে। কখন এসেছিলি মণ্ডপে?

একটু আগে। কাঁপা গলায় মিনমিনিয়ে জবাব দিল দীপা।

কেন এসেছিলি? আমি নিষেধ করিনি? এক ঝটকায় মেয়েকে দূরে সরিয়ে দিতেই সে ব্যালেন্স হারিয়ে ঘাসের ওপর পড়ল। এবং তখনই ড়ুকরে কেঁদে উঠে বলল, কপালের চোখ আঁকা দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল যে।

কপালের চোখ। দেখা হয়েছে চোখ মেলে?

হুঁ। বলে উঠতে গিয়েই দীপা আবার গলা খুলে চেঁচিয়ে কাঁদল।

হতভম্ব অমরনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, আরে। কি হল তোর?

তিনি সাইকেলের আলো ঘুরিয়ে মেয়ের ওপর ফেলতেই দেখলেন দীপা সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তার হাঁটু পর্যন্ত রক্তের ধারা নেমে এসেছে। কোন কিছুতে কি কেটে গেল। অমরনাথ দেখলেন দীপা ভয়ার্ত চোখে একটু একটু করে সরে যাচ্ছে তার কাছ থেকে। তারপর এক ছুটে বাইরের বন্ধ দরজায় আঘাত করতে আরম্ভ করল, মা মা গো। ও ঠাকুমা। ঠাকুমা গো।

এবার অমরনাথ নাড়া খেলেন। সাইকেলের আলো নিবিয়ে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে গাঢ় গলায় বললেন, শান্ত হ মা। এতে ভয়েব কিছু নেই। আমি তোর মাকে ডাকছি।

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার