নটা বাজতে না বাজতেই বিয়েবাড়ি ফাঁকা হয়ে গেল। একেই শীতের রাত তার ওপর শহরটার নাম জলপাইগুড়ি। গরমকালে এখনও রাত্রে বিকশা পাওয়া যায় কিন্তু শীত পড়লেই সন্ধে গড়ালে তারা উধাও হয়ে যায়। আর রিকশা ছাড়া ঘোরাফেরার অন্য কোন যান এখানে নেই। শহরে চীফ মিনিস্টারের উপস্থিতিও খুব একটা কাজ দেয়নি এ ব্যাপারে। স্টেশনের কাছে ওযেসিস নামের একটা হোটেলে উঠেছেন অমরনাথ। খাওয়া-দাওয়ার পর সেখানে যেতে হবে হেঁটে। মাইলখানেক রাস্তা।

সন্ধে নাগাদ তিনি এসেছেন বিয়েবাড়িতে। বাগান থেকে সুভাষচন্দ্র আর নবনী ছাড়া কেউ তাঁর সঙ্গে আসেনি। হরিদাসবাবুর মৃত্যুর পর কাউকে বলতেও ইচ্ছে হয়নি। এরকম একটা ঘটনায় সমস্ত বাগান একেবাবে চুপ মেরে গিয়েছে। মেয়ের বউভাতে না এলেই নয় তাই আসা। দুঃখ তিনিও কম পাননি। তার চেয়ে বড় কথা কাউকে বলতে পারেননি যে দীপা বাড়িতে থাকতে থাকতেই তিনি হবিদাসবাবুকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখেছেন। শুভযাত্রায় বিঘ্ন ঘটবে বলে পালিয়ে থেকেছেন। স্বার্থপরের মত কাজ করেছেন নিশ্চয়ই তবে সেটা মেয়েটার মুখ চেয়ে। কিন্তু সেইসঙ্গে মনে খুতধুতানি শুরু হয়ে গেছে অঞ্জলির। এই বিয়েতে একটার পর একটা অশুভ ইঙ্গিত ধরা পড়ছে। আজ বউভাতে এসে মন হালকা হল তাঁর। মেয়ের বিয়ে হয়েছিল তার সাধ্যমত। কোথাও কার্পণ্য করেননি। কিন্তু এ বাড়িতে এসে বুঝতে পারলেন সেটা কত সামান্য। নতুন বউ বসে আছে রাজেন্দ্ৰাণীর মত। উপহারের পাহাড় তার পাশে।

সুভাষচন্দ্ৰ পাশে এসে দাঁড়ালেন, জামাই বাবু, এবার চলুন।

হ্যাঁ। একবার দীপার সঙ্গে—।

না। আর যাবেন না। সন্ধেবেলায় অনেক কষ্টে নিজেকে সামলেছে মেয়েটা। এখন চলে যাচ্ছেন জানলে ভেঙ্গে পড়তে পারে। তাছাড়া আমার এখানে থাকতেও ভাল লাগছে না।

কেন সুভাষ? কি হয়েছে?

কি হয়েছে আপনি বুঝতে পারছেন না?

বুঝতে পারলেও এতক্ষণ মনকে প্ৰবোধ দিচ্ছিলেন অমরনাথ। যতটা না এরা করছে তিনি তা অনেক বাড়িয়ে ভাবছেন। সন্ধেবেলায় তাঁরা যখন বিয়েবাড়িতে এসেছিলেন তখন কেউ তাঁদের সাদরে অভ্যর্থনা করেনি। প্রতুলবাবু ছিলেন না। বরযাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ চিনতে পারায় বসার জায়গা মিলেছিল। সুভাষচন্দ্ৰ অনুরোধ করেছিলেন, একবার দীপার সঙ্গে দেখা করতে চাই। মানে, ওর বাবা এসেছেন তো।

খবর নিয়ে যে ভেতরে গিয়েছিল সে ফিরে এসে অপেক্ষা করতে বলেছিল। একঘণ্টা কেটে গেলেও কেউ ভেতরে নিয়ে যায়নি। ইতিমধ্যে দুবার তাগাদ দিয়েছেন সুভাষচন্দ্ৰ। তখন প্রতুলবাবু বেরিয়ে এলেন, ও আপনারা এসে গিয়েছেন। ভাল হল। খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে?

অমরনাথ হাতজোড় করে বলেছিলেন, আজ্ঞে না। আগে একবার দীপাকে দেখতে চাইছি।

নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। আসুন আপনারা আমার সঙ্গে। তবে সে আর দীপাবলী নেই। এখন তো তার পুনর্জন্ম। নামটাও পাল্টে গিয়েছে। আমার স্ত্রী নাম রেখেছেন, আশালতা। আপনি ওকে আশা বলে ডাকলে সুবিধে হয়।

নবনীও সঙ্গে ছিল। সুন্দর সাজানো ঘরে সিংহাসনের ওপর বসে আছে মেয়ে। দরজায় দাঁড়িয়ে অমরনাথের মনে হল তিনি যেন এক মহারাণীর দর্শন পাচ্ছেন। মাথায় মুকুট, সারা শরীরে গহনা, ফুলের মালা, লাল বেনারসীর চাকচিক্য-সব মিলিয়ে ও যেভাবে বসে আছে তাতে মনেই হচ্ছে না। ওকে কখনও দেখেছেন। দরজা পর্যন্ত পৌঁছে প্রতুলবাবু বললেন,  ভেতরে মেয়েদের ভিড়। বিয়ের ব্যাপার হলেও মেয়েরা তো মেয়েই। আপনি এখান থেকেই দেখাসাক্ষাৎ করুন।

প্রতুলবাবুর গলার স্বর শুনে ঘরের মেয়েরা চুপ করে গিয়েছিল। সবাই এদিকে তাকিয়ে। মাথা নিচু করে বসেছিল দীপা। ঘর চুপচাপ হয়ে, যেতেই বিস্ময়ে মুখ তুলল। তার নজর দরজায় আসতেই অমরনাথের চোখাচোখি হল। অমরনাথ কি করবেন বুঝতে না পেরে হাসবার চেষ্টা করলেন। দীপার শরীরটা যেন সিংহাসন ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করল। সঙ্গে সঙ্গে নতুন দি বলে উঠলেন, ওমা, করছি কি? নতুন বউ আসন ছেড়ে ওঠে নাকি?

দীপা ধীরে ধীরে শরীরটাকে ছেড়ে দিল। অমরনাথের কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছিল কিন্তু সুভাষচন্দ্র বললেন, চলুন জামাইবাবু, বাইরে গিয়ে বসি।

এসব অনেকক্ষণ আগের কথা। খাওয়া-দাওয়া হয়েছে এবং সেইসময় প্রতুলবাবু একবার সামনে এসে দাঁড়িয়েও ছিলেন। কিন্তু যে যত্ন তিনি ওঁকে চা-বাগানে করেছিলেন তার সিকিভাগও এখানে পাননি। অতএর সুভাষচন্দ্ৰ কি বলতে চায় তা তিনি ভালভাবেই বুঝতে পারছেন। মেয়েটা সুখী হোক, দীপা মরে গিয়েছে, আশালতা রাজেন্দ্ৰাণীর মত সুখে, বেঁচে থাকুক। নবনী খেয়ে দেয়ে হাসপাতালে চলে গিয়েছিল। ললিতার অবস্থা বিকেলেও ভাল ছিল না। শ্যামল বাবার মুখাগ্নি করেই হাসপাতালে ফিরে এসেছে। চা-বাগানে ওর এই আচরণে ঢি ঢি পড়ে গেছে। গলায় কাছা ঝুলিয়ে সে ললিতার জন্যে রাত জাগছে তা মালবাবুও পছন্দ করছেন না। নবনীকে তিনি তাই বলেছেন। কিন্তু ছেলেটার সাহায্য কাজে আসছে। তাছাড়া যে কারণে ললিতা বিষ খেয়েছিল। সেই কারণটা এখনও থেকে গিয়েছে। ললিতার জন্যেই তাই শ্যামলকে প্রয়োজন। নবনী বিয়েবাড়ি থেকে যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিল হাসপাতাল থেকে খবরটা নিয়ে সে এখানেই চলে আসবে। হাকিমপাড়া থেকে ধড়ধড়া নদী ডিঙ্গি যে হাসপাতালে যেতে তিন মিনিট লাগে। অমরনাথ সুভাষচন্দ্ৰকে বললেন, নবনী তো এখনও এল না। ওর জন্যে আমাদের অপেক্ষা করা উচিত। হোটেল পর্যন্ত বেচারা একা একা যাবে, এটা ভাল দেখায় না, আমাদের সঙ্গেই তো এসেছে।

সুভাষচন্দ্ৰ বুঝতে পারলেন জামাইবাবু একটা অজুহাত খুঁজছেন এখানে আরও কিছুক্ষণ কাটানোর। তিনি বললেন, ঠিক আছে, চলুন আমরা রাস্তায় গিয়ে ওর জন্যে অপেক্ষা করি। যদি রিকশা পেয়ে যাই তাহলে দাঁড় করিয়ে রাখব অমরনাথের ইচ্ছের বিরুদ্ধেই তাঁকে নিয়ে বাইরে আসতেই নবনীকে দেখতে পাওয়া গেল। ওঁদের দেখেই নবনী চিৎকার করে উঠল, সুসংবাদ আছে দাদা। ললিতার জ্ঞান ফিরেছে। ডাক্তার বলল বিপদ কেটে গেছে।

 

নতুন দি জোর করে খাইয়ে দিলো দীপাকে, না বললে চলে আশা! এখন থেকে শরীরটাকে ঠিকঠাক রাখতে হবে। এতদিন কার সঙ্গে শুতে তুমি?

এইভাবে পাঁচজনের সামনে কেউ হাতে খাবার তুলে খাইয়ে দিচ্ছে, খুব রাগ হচ্ছিল দীপার। সে খাবে না বলেছিল। এইটেই তার অপবাধ। এতক্ষণে বুঝে গিয়েছে বাবা আর এবাড়িতে নেই। বাবার সঙ্গে মামা আর নবনীকাকু এসেছিল। ওরাও নিশ্চয়ই চলে গিয়েছে।

নলিনী খাওয়া দেখছিলেন, ধমকে উঠলেন, প্রশ্ন করলে জবাব দাও না কেন? বাপ মা কি তোমাকে সহবৎ শেখায়নি? নাকি এই বাড়ির লোকজনকে পছন্দ হচ্ছে না?

ঠাকুমার সঙ্গে  ঠোঁট খুলে জবাব দিল দীপা।

নতুন দি বললেন, হুম। তিনি তোমাকে খুব ভালবাসতেন?

হ্যাঁ। বিয়ের পাব কি কি করতে হবে বুঝিয়ে বলেছেন?

হ্যাঁ।

নলিনী ছাড়া সবাই গলা খুলে হেসে উঠল। নতুন দি কোনমতে হাসি থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি বলেছেন তিনি? আহা, লজ্জা কি, বল না?

দীপা গড়গড় করে বলে গেল, এবাড়ির সবাইকে নিজের বাড়ির লোক ভাবতে হবে, গুরুজনদের আদেশ মানা করতে হবে, শ্বশুবমশাইকে বাবা শাশুড়িকে মা বলতে হবে, ছুটোছুটি করা চলবে না, চেঁচিয়ে কথা বলা নিষেধ, এইসব।

সবাই এ ওর মুখের দিকে তাকাল। নতুন দি বললেন, খুব ভাল। এসব তো করতেই হবে। তোমার ঠাকুমা অতুলের ব্যাপারে কিছু বলে দেননি?

দীপার কপালে ভাঁজ পড়ল। সবাই উন্মুখ হয়ে বয়েছে। কয়েক সেকেন্ড চলে গেলে একজন বলল, অতুল কে জানো তো? তোমার বর।

দীপা মাথা নাড়ল, হুঁ। ঠাকুমা বলেছে দেবতার মত মনে করতে হবে।

দেবতার মত? আঁ? নতুন দির গলা থেকে শব্দ তিনটি ছিটকে উঠল। সেই সঙ্গে হাসির ফোয়ারা ছড়িয়ে পড়ল। নতুন দিকে নলিনী ধমক দিলেন, আঃ, তোমরা শুধু হেসেই মরছি। ওদিকে আমার ছেলেটা জেগে জেগে কাহিল হয়ে পড়ল। যা বলার ভালভাবে বুঝিয়ে দিয়ে নিয়ে চল। ফুলশয্যা কি রাত পোয়ালে হবে?

নতুন দি বললেন, শোন আশা, আজ তোমার ফুলশয্যা। মেয়েদের জীবনে একবার মাত্র এই রাতটা আসে। আজকোব রাত্রে বরেব সঙ্গে তোমার আলাপ হবে। সে যা যা বলবে তাই করবে। যা যা করতে বলবে তাই মান্য করবে। কোন কাজে বাধা দেবে না। বুঝলে? আজকের রাত্রে সে যদি খুশি হয় তোমার ব্যবহারে তাহলে সারাজীবনে তোমাকে আর দুঃখ পেতে হবে না। মাথায় ঢুকেছে? তোমাকে আজ থেকে ববের পাশে শুতে হবে।

দীপা শক্ত হয়ে বসে রইল। নতুন দি সেটা লক্ষ্য করে জানতে চাইলেন, কি হল?

নলিনী বললেন, কি আবার হবে। শরীরে তেল আছে, না শুকানো পর্যন্ত ওইরকম করবে। নাও, ওঠে সবাই। আমারই ঘুম পাচ্ছে তো খোকার দোষ কি!

তাকে বাথরুম সেরে আসতে বলা হল। দীপা ব্যাপারটা বুঝতেই পারছিল না। সবার মুখ চোখে কেমন যেন রহস্যময় হাসি। ঘুমের কথা হচ্ছে অথচ তাকে কেউ জিজ্ঞাসা করছে না ঘুম পাচ্ছে কিনা। তাকে আজ থেকে বরের পাশে শুতে হবে। ওই কথাটা বলার জন্যে ওরা কত কি না বলে গেল।

মেয়েরা যখন দীপাকে নিয়ে ফুলশয্যার ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন প্রতুলবাবু এলেন। সঙ্গে সঙ্গে বিবাহিতদের মাথার ঘোমটা বড় হল। সম্পর্কে যাঁরা দিদি বা বোন তাঁরা আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়ালেন। প্রতুলবাবু দীপার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলেন, হুম। নলিনী, কালীবাড়িতে পুজো দিয়েছ?

দিয়েছি। তুমি আবার এখন এলে কেন? নলিনীর গলায় মৃদু প্ৰতিবাদ।

একশবার আসব। এই বাড়ি আমার। ওর বাপ আমাকে না জানিয়ে চলে গিয়েছে। ভদ্রতা বলে কিছু নেই! তোমরা সব একে বলে টলে দিয়েছ তো? প্রতুলবাবুর গলার স্বর অন্যরকম শোনাচ্ছিল। তাঁর মুখ থেকে ভেসে আসা গন্ধ চাপা ছিল না।

সব করেছি। তুমি যাও, বিশ্রাম নাও গে।

বিশ্রাম আমি একবারে নেব নলিনী। চীফ মিনিস্টারকে আজ এবাড়িতে আনতে পারলাম না। এ যে কত বড় পারাজয় আমার—! উফ। চোখ বন্ধ করলেন তিনি।

প্রতুলবাবু রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে, তিনি না সরলে এরা এগোতে পারছিলেন না।

নতুন দি বললেন,  ছেলের বিয়ে দিয়ে সাততাড়াতাড়ি বউ আনলেন চীফ মিনিস্টারের জন্যে তো নয়। যে জন্য এনেছেন তা হলেই তো সব সমস্যার সমাধান।

ঠিক। তুমি যা বোঝ নলিনী তা বোঝে না। পকেট হাতড়ালেন প্রতুলবাবু। তারপর একটা কাগজের মোড়ক বের করলেন। মোড়কের ভেতর মোড়ক। সেটি তিনি এগিয়ে দিলেন, খোকাকে আমি এক পুরি যা খাইয়ে দিয়েছি। দেবী চৌধুরাণীর কালীবাড়ির সন্ন্যাসী দিয়েছেন আমাকে। পরীক্ষিত সত্য। খোকাকে যা বলাব একটু আগে বলে এলাম। তুমি এই মেয়েটাকে ইচ্ছে করলে পুরিয়াটা খাইয়ে দিতে পার। এবার পা টলল প্রতুলবাবুর।

নলিনী বিরক্ত হলেন খুব, সে হবেখন। এখন সরো তো। এত করে বললাম এসব নিয়ে তুমি মাথা ঘামারে না অথচ। যাও, যেখানে ইচ্ছা।

পুরিয়ার মোড়ক পকেটে রেখে দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন প্রতুলবাবু, ঠিক হ্যায়। যাচ্ছি। তবে আমি কাজে বিশ্বাস করি না। ফল দেখতে চাই। প্রতুলবাবু হন হন করে বেরিয়ে গেলেন। দলটা আবার এগোল। এসব কথার অর্থ দীপার মাথায় ঢুকছিল না। সে শুধু একটা অভিমানে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। অমরনাথ যে তাকে না বলে চলে গিয়েছেন এটা সে ভাবতে পারছে না। বাবা কি চা-বাগানে ফিরে গেল। বাবা তার সঙ্গে একটাও কথা বলল না। হঠাৎ সে ফুঁপিয়ে উঠল সশব্দে।

নলিনী জিজ্ঞাসা করলেন, আর কি হল আবার?

নতুন দি দীপার মাথায় হাত বোলালেন, আহা। ঘাবডে গিয়েছে বেচারা ওইসব কথা শুনে। আশা, ও আশা, ওর কথায় কিছু মনে ক্র না। চুপ করো।

চুপ সে করে গেল। ফুলশয্যার ঘরে ঢুকল সবাই। জলপাইগুড়িতে ফুলের দোকান নেই। সবরকমেব ফুল সারা বছর পাওয়া যায় না। এ বাড়ির বাগানে যে ফুল ফুটেছিল তাই দিয়ে ফুলশয্যার খাট সাজানো হয়েছে। নেটের মশারির মধ্যে অতুলচন্দ্ৰ শুয়ে আছে। লেপ চাপা দিয়ে।

নতুন দি নলিনীকে বললেন,  ছেলের ফুলশয্যার ঘরে মায়ের থাকতে নেই। যাও এখন।

নলিনী আড়চোখে ছেলের দিকে তাকালেন, তার চোখ পিটাপট করছে। নলিনী বললেন, যাচ্ছি। বাবা। তা তোরাও চল এখান থেকে। এদের ফুলশয্যায় আড়িপাতার দরকার নেই। উনি নিষেধ করেছেন।

নতুন দি বললেন, তা আমি বুঝেছি। খাটের তলায় কেউ আছে কিনা দ্যাখো। শুধু খাট না, আলমারির পেছন থেকেও দুজন বের হল। সবাইকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে নতুন দি বললেন, দরজায় খিল তুলে দাও। ওইখানে সুইচ আছে। ইচ্ছে হলে আলো নিবিয়ে দেবে। মশারি বেশী ফাঁক করে উঠো না, মশা ঢুকে যাবে। কোন ভয় নেই। বুঝলে?

দীপা ঘাড় নাড়ল। নতুন দি ওর চিবুকে আঙ্গুল ছুঁইয়ে চুমু খেলেন। তারপর দীপাকে দরজা পর্যন্ত টেনে এনে নিজেই সেটাকে ভেজিয়ে বেরিয়ে গেলেন। ঝটপট খিল তুলে দিল দীপা। শব্দটা হওয়ামাত্র বাইরে হাসির আওয়াজ উঠল। দীপার কপালে ভাঁজ পড়ল। ওরা এমন হাসাহাসি করছে কেন? শব্দটা মিলিয়ে গেলে সে ঘুরে দাঁড়াল। বিছানায় কেউ শুয়ে আছে তা বুঝতে ভাল করে নজর দিতে হয়। কিন্তু এই মুকুট, এইসব গয়নাগাটি পরে তাকে শুতে হবে নাকি? কেউ তো বলে দেয়নি ফুলশয্যার রাত্রে এসব খুলে ফেললে অন্যায় হয় কিনা। সে মুকুটটা খুলে টেবিলে রাখল। তারপর আলোর দিকে তাকাল। না, আলো নিবিয়ে অচেনা জায়গায় সে শুতে পারবেনা।

মশারিটা সামান্য ফাঁক করে সে বিছানায় উঠে বসল। পাশাপাশি দুজোডা বালিশ। গোলাপ ফুলের পাঁপড়িতে প্ৰায় ঢাকা। সে বিছানায় উঠতেই অতুলচন্দ্ৰ চোখ ফেরাল। দীপা ঠোঁট মোচড়াল। তার পায়ের কাছে লেপ তো দুবের কথা একটা চাদর পর্যন্ত নেই। সে মুখ ঘোরাল, আমি কি গায়ে দেব?

অতুলচন্দ্ৰ মিনমিনে গলায় বলল, এই লেপের তলায় তোমাকে শুতে হবে।

কেন? আমার আলাদা লেপ নেই কেন?

আমি জানি না ?

তোমাদের বাড়িতে আমি এসেছি। তোমার লেপটা আমাকে দাও।

না। আমি কাউকে কিছু দিই না। সবাই আমাকে দেয়। তুমি তাড়াতাড়ি তোমাব জামাকাপড় খুলে ফেল। আমি আর জেগে থাকতে পারছি না। অসহিষ্ণু গলায় বলল অতুলচন্দ্র। তার গলার স্বর শেষদিকে ক্যানকেনে শোনাল।

কি? প্ৰায় চিৎকার করেই উঠল দীপা।

চেঁচামেচি করলে আমার মাথায় লাগে। আমি কিন্তু বাবাকে বলে দেব। তাড়াতাড়ি সব জামাকাপড় খুলে আমার পাশে এসো। একটানা বলে গোল অতুলচন্দ্ৰ।

এম্মা! একি কথা! জামাকাপড় খুলিব কেন?

স্বামীর পাশে বউকে ওইভাবে শুতে হয়।

বাজে কথা। আমার মা বাবা তো স্বামী-স্ত্রী। আমি কোনদিন ওদের জামাকাপড় খুলে শুতে দেখিনি। যদি তোমার একথা মাকে বলি না মেরে হাড় ভেঙ্গে দেবে।

আমাকে আমার বাবা বলেছে।

কি বলেছে?

আঃ, আমি কথা বলতে পারছি না। এসো।

তোমার বাবা মা জামাকাপড় না পরে শোয়? ছিছিছি। আমি বাবা এসব খুলতে পারব না। খুললে আমার ঘুমাই আসবে না। উল্টোমুখ করে শুয়ে পড়ল দীপা। দুজনের মাঝখানে ব্যবধান বড় জোর এক হাত। তার ঠাণ্ডা লাগছিল। অনেকক্ষণ কুঁকড়ে শুয়ে থেকেও তার ঘুম এল না। ঠাণ্ডাটা এবার বাজনা বাজাচ্ছে দুপাটি দাঁত নিয়ে। সে মৃদু গলায় ডাকল, অ্যাই?

ওপাশ থেকে কোন জবাব এল না। দীপা আবার জিজ্ঞাসা করল, তোমার লেপটা কি খুব বড়? এবারও সাড়া মিলল না। দীপা উঠে বসল। একদম আপাদমস্তক লেপে ঢেকে ঘুমাচ্ছে যে তার ওপর প্রচণ্ড রাগ হল। সে ঠাণ্ডায় কষ্ট পাচ্ছে জেনেও ঘাপটি মেরে পড়ে আছে। লেপের একটা প্রান্ত ধরে সে টানতে লাগল। অতুলচন্দ্র প্রতিবাদের সুর গলায় তোলায় চেষ্টা করে পাশ ফিরে শুতেই অনেকটা লেপের অধিকার পেয়ে গেল দীপা। এই লেপটা কি বাগান থেকে এসেছে? নতুন নতুন গন্ধ। ওয়াড় পরানোর পর বুঝতেই পারছে না সে। যদি আসে তাহলে বাবারও ভুল হয়েছে। দুটো ছোট লোপ পাঠালেই পারত তাহলে তাকে এভাবে টানাটানি করতে হত না। লেপের উতাপে এখন আরাম হল দীপার। ওপাশে কোন সাড়া নেই। হঠাৎ মনে হল সে কোন অন্যান্য কথা বলে ফেলেনি তো যাব জন্যে অতুলচন্দ্ৰ রেগে গিয়ে কথা বলছে না। এরা আজ থেকে বব যা বলবে তাই করতে উপদেশ দিয়েছে। কিন্তু জামাকাপড় কেন খুলে শুতে যাবে সে? বার যদি পাগল হয় তাহলে বউ তার কথা শুনবে? অসম্ভব! জামাকাপড় খুলে যে শুতে বলে সে তো পাগল।

নিজের আচরণের সমর্থনে যুক্তি খুঁজে পেয়ে কিছুক্ষণ ভাল থাকল দীপা। কিন্তু অতুলচন্দ্ৰ চুপচাপ থাকায় আবার অস্বস্তি হল। সে ডাকল অ্যাই!

অতুলচন্দ্রর সাড়া মিলল না। দীপার মাথায় দুষ্টবুদ্ধি চাপল। সে ধারে ধীরে লেপ ধরে টানতে লাগল। ঘাপটি মেরে পড় থাকলেও লেপ সরে গেলেই কথা বলতে বাধ্য হবে। এই ঠাণ্ডায় গায়ে চাপা না নিয়ে কেউ শুতে পারবেনা। লেপটা সরে আসছিল হড়হড়িয়ে। অতুলচন্দ্রের কাছ থেকে বাধা আশা করছিল দীপা। পুরোটা সরে আসা মাত্র গলা থেকে ছিটকে আসা চিৎকার গোঙানি হয়ে গেল। কোনমতে লেপেই মুখ চোখ চেপে ধবল সে। সমস্ত শরীরে কাঁপুনি। সেই অবস্থায় দুই হাতের সমস্ত শক্তি দিয়ে লেপটাকে ছুঁড়ে ফেলল অতুলচন্দ্রের ওপর। একটা হাড়জিড়জিড়ে সম্পূৰ্ণ নগ্ন শরীর কুঁকড়ে পড়ে আছে,-চোখের মধ্যে ঢুকে যাওয়া এই ছবিটাকে সে কিছুতেই সরাতে পারছিল না। কি রকম গা গোলানি ভাব চলে এল শরীরে। সে বিছানার এককোণে চলে এল। অতুলচন্দ্র ঘুমাচ্ছে। এই কাণ্ড ঘটল তবু তার ঘুম ভাঙ্গেনি।

পা মুড়ে বসে দীপা লেপের স্তূপটাকে দেখল। অতুলচন্দ্ৰকে লোক বলে ভাবতে ইচ্ছে করছিল না। খোকন কিংবা বিশু যখন ফুটবল খেলতে খেলতে গেঞ্জি খোলে অথবা নদীতে স্নান করতে খালি গায়ে জলে ঝাঁপ দেয় তখন তার মাথায় কোন ভাবনাই আসত না। গা গুলিয়েও উঠত না। এই ছেলেটার শরীর দেখে হল কেন? সম্পূৰ্ণ নগ্ন মানুষেব চেহারা কি এমন বীভৎস হয়? কিন্তু না। মশারির ভেতরও ছেলেটার শরীরে শুধু কয়েকটা হাড় দেখতে পেয়েছে সে। বিজ্ঞান বইতে যে নরকঙ্কালের ছবি ছাপা আছে তাকে যদি বিছানায় শুইয়ে দেওয়া হয় তাহলে অবিকল এমন দেখাবে। দীপার মনে পড়ল অতুলচন্দ্র তাকে জামাকাপড় ছেড়ে শুতে বলেছিল। নিজে আগেভাগেই জামাকাপড় খুলে লেপের তলায় চলে গিয়েছিল। ওকে নাকি ওর বাবা এই কাজ করতে বলেছে। এ বাড়ির নিয়ম নাকি এটা? কি বিশ্ৰী নিয়ম। দীপা হাঁটুতে চিবুক রেখে বসে রইল। মশারির ভেতরেও ঠাণ্ডায় বসে থাকা ক্রমশ কষ্টকর হয়ে উঠল তার। ঘুমের কোন বালাই নেই।

বাইরের পৃথিবীতে কোন শব্দ নেই। চা-বাগানে এইসময় জেগে থাকলে বেতালা মাদল বাজতে শোনা যায়। জলপাইগুড়িতে নিশ্চয়ই কেউ মাদল বাজায় না। দীপা আর পারছিল না। খাটের একপাশে অতুলচন্দ্রের নগ্ন শরীরের দিকে পেছন ফিরে লেপের প্ৰান্ত টেনে শরীর ঢেকে শুয়ে পড়ল হয়। একটু একটু করে ঘুম জড়িয়ে নিল তাকে।

হঠাৎ বুকের পাঁজরে প্রচণ্ড চাপ পড়তেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হল দীপার। চটকে যাওয়া ঘুম এবং নিঃশ্বাসের কষ্টে সে ককিয়ে উঠল, বাবাগো। এবং এখনই দুটি শীর্ণ হাত প্ৰাণপণে তার জামা ছিড়ে ফেলতে চাইল, খোল, খোল, জামা। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলে কথা শোননি। খোল।

দীপা অতুলচন্দ্রকে বুঝতে পারল। কিন্তু সে নিজের জামা দুহাতে আঁকড়ে ধরেও চোখ খুলল না। সে জানত চোখ খুললেই অতুলচন্দ্রর নগ্ন শরীর দেখতে হবে। এই কয়েকবারের চেষ্টাতেই হাঁপিয়ে উঠেছিল অতুলচন্দ্র। এবার সে দীপার পেটের কাছে গোঁজা শাড়ির প্রান্ত ধরে টান দিল। দীপা প্ৰতিবাদ করল চোখ বন্ধ করে, আঃ, কি হচ্ছে? আমার জামাকাপড় ধরে টানছ কেন?

আমি আবার ওষুধ খেয়েছি। বাবা বলেছে তোমাকে আনা হয়েছে বাচ্চা দেওয়ার জন্যে। কাপড় না খুললে তোমার বাচ্চা হবে কি করে? ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছিল তার। দীপার কাপড় কোমর থেকে খুলে এলেও গিটটা আলগা হয়নি। কয়েক বার সেটাকে খোলার চেষ্টা করে হাল ছাড়ল অতুলচন্দ্ৰ, আমি ওষুধ খেয়েছি। বাবা বালিশের নিচে রেখে গিয়েছিল। আবার ঘুমিয়ে পড়লে বাবা বকবে।

কিসের ওষুধ?

আমি রোজ যে ওষুধ খাই সেটা না। এই ওষুধ খেলে বাচ্চা তৈরী করা যায়। আমি তো বেশীদিন বাঁচবো না। তাই বাবা —উঃ, খোল না কাপড়। ঝাঁপিয়ে পড়ল নগ্ন শরীরটা দীপার ওপর। আর নিজের অজান্তেই প্ৰচণ্ড জোরে ধাক্কা মারল দীপা দুই হাতে। সঙ্গে সঙ্গে অতুলচন্দ্ৰের শরীরটা ছিটকে চলে গেল খাটের প্রান্তে। মশারির ছত্রির আওয়াজ উঠল। একটা ককানির শব্দ কানে এল। এবং সেই সঙ্গে কান্নার স্বর উঠল, তুমি আমাকে মারলে? উঃ বাবা। তুমি মারলে? আজ অবধি কেউ আমাকে মারেনি, জানো?

দীপা উঠে বসেছিল। প্ৰচণ্ড রাগে তার শরীর কাঁপছিল। এবং এখন অতুলচন্দ্ৰের নগ্ন শীর্ণ দেহ তার দৃষ্টিতে ছিল না। সে চাপা গলায় বলল, আবার যদি আমার গায়ে হাও দাও তাহলে মেরে তোমার হাড় ভেঙ্গে দেব।

হাড় ভেঙ্গে দেবে? কাতর বিস্ময় অতুলচন্দ্ৰের গলায়।

হ্যাঁ।

আমি বালিশে মাথা রেখে শোবা? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে!

শোও।

প্ৰায় কাঁপতে কাঁপতে লেপটার প্রান্ত শরীরে টেনে নিয়ে অতুলচন্দ্ৰকে বিছানার এক পাশে শুয়ে পড়তে দেখল দীপা। তারপর থেকে একটা কুঁই কুঁই শব্দ বেজে গেল সমানে। অনেকক্ষণ দীপা পাথরের মত বসে রইল। কি শুনল সে? তাকে এ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে বাচ্চা দেবার জন্যে? চকিতে চা-বাগানের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ললিতার গলা বেজে উঠল কানে। ললিতা শ্যামলদার কাজে প্ৰতিবাদ করছিল। সেই ললিতা বিষ খেয়েছে। বিয়ের দিন সবাই এই নিয়ে কথা বলছিল তার সামনেই। ললিতার পেটে বাচ্চা এসেছে। দীপার বুঝতে অসুবিধে হয়নি পেটে বাচ্চা এসেছে বলেই সে বিষ খেয়েছে। ওটা আসুক তা চায়নি বলেই চা-বাগানের ভেতরে প্রতিবাদ করেছিল সেদিন। শ্যামলদা যা করেছিল তাই করতে চেয়েছে অতুলচন্দ্র। কিন্তু ওষুধ খেয়েছে কেন? শ্যামলদা কি ওষুধ খেয়েছিল? বাচ্চা করতে গেলে কি ওষুধ খেতে হয়? মাথায় কিছু ঢুকছিল না তার। শুধু বুঝতে পারছিল খুব একটা গৰ্হিত ব্যাপার করতে যাচ্ছিল অতুলচন্দ্র। কিন্তু ও বলল কেন বেশীদিন বাঁচবে না! বর মরে গেলে বউ বিধবা হয়। বিধবা মানে—দীপার চোখের সামনে চট করে মনোরমা চলে এলেন। মাছ মাংস ডিম পেঁয়াজহীন আলোচালের ভাত আর নিরামিষ তরকারি নিয়ে খেতে বসেন মনোরমা। অসম্ভব। সে বিধবা হতে পারবেনা। অতুলচন্দ্রের দিকে তাকাল সে। লেপমুড়ি দিয়ে সমানে কুঁই কুঁই করে যাচ্ছে। ওই ছেলেটা মরে গেলেই তাকে বিধবা হতে হবে। খুলে যাওয়া কুঁচিগুলো কোমরে জড়াল সে। তারপর একটু সরে এসে জিজ্ঞাসা করল, অমন করছ কেন?

আমার কষ্ট হচ্ছে।

কিসের কষ্ট?

নিঃশ্বাসের।

তোমার বাবা মাকে ডাকব?

না। কিছুতেই না।

কেন?

বাবা খুব রেগে যাবে।

তোমার কষ্ট ত চেষ্টা শুনলে রেগে যাবে?

না। দুদুবার ওষুধ খেয়েও আমি যেটা করার কথা সেটা করতে পারলাম না বলে রেগে যাবে বাবা বলেছে। একজন বংশধর চাই আমি মরে যাওয়ার আগে। আমি সবটা জানতাম না, বাবার কথায় আনা তোমাকে সব শিখিয়ে দিয়েছে। ওষুধ না খেলে আমার শরীর শক্ত হয় না বলে আনা বাবাকে ওষুধ আনতে বলেছিল। তুমি মারলে আমাকে। এখন আমি বাবাকে কি বলব? গলার স্বর ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসছিল।

এসব করতে হবে জানলে বিয়ে করতামই না।

বিয়ে এসব করার জন্যেই মানুষ করে। আমার রক্ত খারাপ হয়ে গিয়েছে। বুকের ভেতর ব্যথা করে। কোন ওষুধে কমে না। শুধু ঘুম পায়। সেদ্ধ ছাড়া কিছু খেতে পারি না। মরে তো যাবই তাই বাবা বলেছে আমার যদি ছেলে থাকে তবে তার মধ্যে আমি বেঁচে থাকব। তুমিও একা থাকবে না। তোমার ছেলে থাকবে।

আমি এখন পড়ি। এইসময় কেউ মা হয়?

ও। আমি ওসব জানি না। আমাকে যা করতে বলেছিল তা করে ছিলাম। এখন পারিনি জানলে যে কি হবে? কি আবার হবে! মরে যাব। তার বেশী কিছু হবে না তো। তুমি বিধবা হবে। এখন তো তুমি রাজি হলেও আমি কিছু করতে পারব না। এই ওষুধটা খাওয়ামাত্র শরীরটা কেমন হয়ে যায়। কিন্তু দশ মিনিটের মধ্যে আবার ঘুম পেয়ে যায়। তুমি আমাকে মারলে বলে ঘুম পাচ্ছে না। কিন্তু আর ওষুধ তো নেই। শোন, তুমি মিথ্যে কথা বলতে পার?

মিথ্যে কথা?

হুঁ। আমি বলব যা যা করার করেছি। তুমি সায় দেবে। এখন তাহলে আর কেউ কিছু বলবে না। বাচ্চা তো দশ মাস আগে হয় না। অতুলচন্দ্ৰ চুপ কলে গেল। তার শরীর কাঁপছিল কারণ লেপটা নড়ছে। কুঁই কুঁই শব্দটা শেষপর্যন্ত বন্ধ হল। দীপা পাথরের মত বসে রইল। তার এখন শীতবোধও ছিল না।

দরজায় খুব জোরে জোরে আঘাত হতে ঘুম ভাঙ্গল দীপার। খাটের একপাশে কুঁকড়ে শাড়িতে মুখ মাথা ঢেকে শুয়েছিল সে। মাথা তুলে ঘরটাকে দেখল। বুঝল সকাল হয়ে গেছে। সে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। ওপাশে অতুলচন্দ্র তখন লেপের তলায় চাপা পড়ে আছে। দীপা খাট থেকে নামতে গিয়ে আবিষ্কার করল। সমস্ত শরীরে আড়ষ্টতা, গা ব্যথা করছে, দরজায় আবার আঘাত হল এবং নলিনীর গলা পাওয়া গেল, ভর দুপুর পর্যন্ত ঘুমাচ্ছে যে। এ কি রকম বউ! বাড়ি থেকে বলে-টলেও দেয়নি?

দীপা খিল খুলতেই ওপাশের চাপে দরজা হাট হয়ে গেল। নলিনী আর আনা দাঁড়িয়ে আছে। নতুন দি বা অন্য মেয়েদের দেখতে পেল না সে। আর তখনই মুখে হাত চাপা দিয়ে হেসে উঠল আনা, ও মা, নতুন বউ-এর মুখখানা দ্যাখো, সিঁদুরে যে গোব্র লেপা হয়ে রয়েছে। প্রথম রাত, সাতসকালে কি ঘুম ভাঙ্গে!

হুম। বুঝেছি। সে এখনও ঘুমাচ্ছে? নলিনী ঘরে ঢুকলেন। তাঁর চোখ মশারির ভেতরটা দেখতে চাইছে। গম্ভীর গলায় তিনি হুকুম করলেন, চটপট মশারিটা তোল আনা। কাকভোরে উঠে তিনি খবরটা শোনার জন্যে অপেক্ষা করছেন। আগে তাঁকে শান্ত করি।

আর চিন্তা করার কি আছে। সিঁদুব দেখে বুঝতে পারছ না। তোমার ছেলের মাথায় শমন এলে কি হবে একেবারে ব্যাসদেবের ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে গো! মশারি তুলতে তুলতে কথাগুলো বলল আনা।

নলিনী দীপার দিকে ফিরলেন, কাল রাত্রে কোথায় শুয়েছিলে আশা?

মাথা না তুলে দীপা জবাব দিল, বিছানায়।

আহা। বিছানায় না। শুয়ে কি মাটিতে শোবে! বিছানার কোনখানে?

নলিনীর কথার অর্থ বোধগম্য হল না দীপার। সে হাত তুলে দ্বিতীয় বালিশটাকে দেখাল। নলিনী বললেন, নানা, খোকাকে না জাগিয়ে ওখানকার লেপ সরা। বিছানার চাদর দেখব আমি। সেইটেই আসল!

মশারি তোলা হয়ে গিয়েছিল। আনা ওপাশে সরে গিয়ে সতর্ক হাতে লেপের প্রান্ত তুলে অতুলচন্দ্রের দিকে সরিযে দিয়ে ঝুঁকে পড়ল। এগিয়ে গিয়েছিলেন নলিনী, বিছানা দেখতে দেখতে তাঁর মুখ থমথমে হয়ে যাচ্ছিল। শেষপর্যন্ত আনার সঙ্গে তাঁর চোখে চোখে কথা হল। আনা ফিসফিসিয়ে বলল, আগে জিজ্ঞাসা করতো, সেখানে খুব দৌড় ঝাঁপ করত কিনা। সেরকম বেশী করলে নাকি আগেই ওসব চুকে যায়। মাথা গরম করো না।

নলিনী ঘুরে দাঁড়ালেন, আশা, এদিকে এসো। দীপা এগিয়ে গেল।

বিয়ের আগে তুমি কি দৌড়াদৌড়ি করতে? নলিনী জানতে চাইলেন।

সত্যি কথা বলা উচিত হবে কিনা বুঝতে পারছিল না দীপা। বিয়ের পর বউ-এর দৌড়ঝাপ করা উচিত নয়। কিন্তু বিয়ের আগে? নলিনী রেগে গেলেন, কি ঘাঁটা মেয়েবে বাবা, প্রশ্ন করলে জবাব দেয় না। আমার কথা কানে ঢুকছে?

ভয়ে ভয়ে সত্যি কথাটা বলে ফেলল, আমরা মাঠে খেলতাম।

হুঁ! তোমার মাসিক কবে হয় প্রথম?

মাসিক শব্দটার অর্থ আন্দাজে ধরে নিল সে। ঠাকুমা বলেছিলেন ঋতু। মা বলেছিলেন পিরিয়ড। প্ৰতি মাসে হয় মেয়েদের বয়স হলে। তাই বোধহয় ইনি মাসিক বলছেন। সে মাথা নাড়ল, একবার হয়েছিল। এ মাসেই।

তারপরেও দৌড়েছ?

না। এটাও সত্যি কথা।

নলিনী আনার দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন, কি বুঝছিস?

জিজ্ঞাসা কর না সরাসরি। সে উপদেশ দিল।

নলিনী আড়চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে আবার ফিরলেন, কালরাত্রে খোকা কিছু করেছে? মেয়েমানুষ, মাসিক হয়ে গিয়েছে, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ কি বলছি?

দীপার মাথা নিম্নগামী হল। চিবুক ঠেকাল বুকে। আনা সেটা লক্ষ্য করে প্রশ্ন চূড়ল, খোকা কি ওষুধ খেয়েছিল?

নীরবে একবার মাথা নেড়ে দীপা জানাল, হ্যাঁ। সঙ্গে সঙ্গে আনা হেসে উঠল, ব্যাস। উত্তর পেয়ে গেছ। যাও, তেনাকে নিশ্চিন্ত কর।

খোকাকে ডাক। তার শরীর কেমন আছে দেখি। সেটাও তো বলতে হবে। ওসব ওষুধ খেলে শুনেছি পারে শরীর খারাপ হয়। নলিনী এগিয়ে গেলেন নিজেই।

ও খোকা, খোকা। খোকরে। লেপটা সরাতে যাচ্ছিলেন তিনি আনা বাধা দিল, করছ কি। লেপ সরিও না, ঠাণ্ডা লেগে যাবে। সে সন্তর্পণে মুখ থেকে লেপের প্রান্ত সরিয়ে দিল, খোকা। খোকা।

অতুলচন্দ্ৰ চোখ মেলল। লাল টকটকে চোখ। তারপর বিডবিড করে বলল, আমি আর ওই ওষুধ খাব না।

আনা খপ করে তার গলায় বুকে হাত রাখল, মাগো কি ঠাণ্ডা! তুমি তাড়াতাড়ি দাদাবাবুকে ডাক্তার ডাকতে বল। নলিনী আর্তনাদ করে ছুটলেন। আনা অতুলচন্দ্রের মুখ ধরে বলল, ও খোকা, কি হয়েছে?

অতুলচন্দ্র বিড়বিড় করে বলল, মিথ্যে কথা বলবে। আমি যে পারিনি, তুমি যে মেরেছ তা কাউকে বলবে না।

সঙ্গে সঙ্গে আনা উঠে দাঁড়াল। তার চোখ দীপার দিকে, তোমার সঙ্গে ওর কাল রাত্রে কিছু হয় নি।

দীপা এবারও সতি কথা বলল, না।

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার