ভোরবেলায় কলকাতার রাস্তা বড় মোলায়েম, একটু আঁধার লেগে থাকলে আদুরে বেড়ালের মত মনে হয়। সারাদিন শহরটাকে যারা নরক করে রাখে তারা ঘরে ঘরে ঘুমিয়ে। কিছু শান্ত মানুষ গঙ্গাস্নানের জন্যে পথ হাঁটছেন। কিছু ভ্রমণবিলাসী অক্সিজেন নিচ্ছেন প্রাণভরে। জয়িতার মনে হচ্ছিল চৌবাচ্চায় জল জমার মত সারারাত যে অক্সিজেনটুকু কলকাতাকে দিয়ে থাকে তা পাওয়া যায় এই সময়টুকুতেই। যারা পথে বের হতে পারে এখন তারাই ভাগ্যবান।

 

সে সুদীপের দিকে তাকাল। ঠোঁট কামড়ে সুদীপ বসে আছে চোখ বন্ধ করে। ওর মাথার ক্ষতটা এখনও লালচে হয়ে আছে। এ নিয়ে কিছু বলতে যাওয়া বোকামি। সুদীপ জানে কি করে নিজের যত্ন করতে হয়। ঠিক কখন লাগল সেটাও বলতে চায়নি। জয়িতা এবার বাড়ির কথা ভাবল। কাল দুপুর থেকে অদ্ভুত একটা টেনশনের মধ্যে কেটে গেল সময়টা। এমন কি একটা গোটা রাত না ঘুমোনো সত্ত্বেও অস্বস্তি হচ্ছে না। যেন অনন্তকাল সে জেগে থাকতে পারে। একটা গোটা রাত না বলে বাড়ির বাইরে কাটাল সে এই প্রথম। বেরুবার সময় জানা ছিল আর ফেরা হবে না। কিন্তু আনন্দর কথায় যুক্তি ছিল। সমস্যা হল বাড়ি ফিরে সীতা রায়কে কি জবাবদিহি দেবে সে? মুখের ওপর ঘেন্না করে বলার পর থেকেই তো বাক্যালাপ প্রায় বন্ধ। আজ নিশ্চয়ই বদলা নেবে ওরা। জয়িতা কপালে হাত বোলাতেই টের পেল। গত রাত্রে মাসীমা টিপটা লাগিয়ে দিয়েছিলেন, এত ঝামেলাতেও স্থির ছিল এটা। ফেলে দিতে গিয়ে কেমন মায়া হল ওর। এমন ভালবেসে কেউ তাকে অনেকদিন সাজায়নি। টিপটাকে সে পকেটে রেখে দিল। তারপর সুদীপকে জিজ্ঞাসা করল, মাসীমা কিছু জানেন না, না?

কোন্ মাসীমা? সুদীপ চোখ খুলছিল না।

আনন্দর মা।

সব জানে। আনন্দ ওঁকে সব বলেছে।

আশ্চর্য! আমাকে একবারও এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন করেননি।

তোর চেয়ে যে অনেক গভীর-স্বভাবের মানুষ, তাই।

জয়িতা কথা বাড়াল। সুদীপ খোচা না দিয়ে কথা বলতে পারে না। শুনলে শরীর জ্বলে যায় কিন্তু ওর সঙ্গে ঝগড়া করার কোনও মানে হয় না। কিন্তু বাড়িতে ঢোকার পর আর একটা সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে ওকে। আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করে চুপচাপ থাকার পাত্র রামানন্দ কিংবা সীতা নন। জয়িতাকে যদি সরাসরি প্রশ্ন করে তাহলে সে না বলবে না। সত্যি কথা স্বীকার করে বলতে চাইলে পাওয়া যেত

তাই নিয়েছি। এতে যা হবার তা হবে। ক্রমশ একটা রোখ দখল করল তাকে। মনে মনে বাবা মায়ের মুখোমুখি হবার জন্যে সে তৈরি হয়ে নিল। আর তখনই সুদীপ বলল, আমি নামছি। মালগুলো নিয়ে যাচ্ছি। পারলে আজ বিকেলে কফিহাউসে আসিস।

গুরুসদয় রোডের মোড়ে দাঁড়িয়ে জয়িতা চারপাশে তাকাল। রাস্তায় লোকজন নেই। রোদুর ওঠেনি এখনও। একটা শীতল ছায়া গাঢ় হয়ে জড়িয়ে আছে পৃথিবীর গায়ে। এবং এই প্রথম মন খারাপ হয়ে গেল ওর। এটা কি ধরনের মন খারাপ তা ও নিজেই জানে না কিন্তু বুকের ভেতর একটা ভার এসে জমল। এখন কলকাতা কত ভাল, কত শান্ত। মানুষেরা যে যার ঘরে বলেই বাতাসে এখনও আদুরে ছোঁয়া। একটা হলুদ পাখি উড়ে গেল ডানা মেলে। পাখিদের কি মনখারাপ হয়?

 

আড়ষ্ট পায়ে বালিগঞ্জ পার্ক রোডে এল সে। বাগানওয়ালা বাড়ির দারোয়ানটা অদ্ভুত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ জয়িতার ঘুম এল। হাঁটতে হাঁটতেই মনে হল সমস্ত শরীর জুড়ে ঘুম নামছে। শুধু চোখ বন্ধ করাটাই বাকি। আর তখনই কেউ মোটা গলায় হা-ই বলে চেঁচিয়ে উঠল। চোখ বড় করে জয়িতা দেখল সাদা গেঞ্জি আর শর্ট পরে তিনতলার রবীন সেন রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে শরীর ঝাঁকাচ্ছেন প্রাণপণে। খুব বড় চাকুরে ওই ভদ্রলোকের ওজন অন্তত আড়াইশো পাউন্ড। ওকে বেশ কয়েকবার মিট করেছে সে, লিফটে ওঠার সময় কিংবা ওই চত্বরে। একদিন অবশ্য ওদের ফ্ল্যাটে এসেছিলেন মায়ের সঙ্গে কথা বলতে। মা ওকে খবর দিতে কৃতার্থ হয়ে ছুটে এসেছিলেন। কাদের সাহায্যার্থে সীতা রায়রা কি ফাংশন করবেন তার ডোনেশন দিয়ে ধন্য হয়েছিলেন। লোকটার দিকে তাকিয়ে ঘুম উবে গেল জয়িতার। খাটো প্যান্টের নিচে মাংসগুলো কি বীভৎসভাবে কাপছে থলথলিয়ে। জয়িতার শরীর গুলিয়ে উঠল।

ব্যায়াম সেরে রবীন সেন এগিয়ে এলেন, মর্নিং, তুমি রোজ সকালে বের হও জানতাম না।

জয়িতার ঠোঁট মোচড় খেল। মনে মনে বলল ব্যাঙ। রবীন সেন তখন হাত পা নেড়ে বলে যাচ্ছেন, তোমার বোজ মর্নিং ওয়াক জগিং করা উচিত। কে বলে কলকাতার বাতাসে অক্সিজেন নেই। আমি রোজ এত এত অক্সিজেন বুকভরে নিই। তুমি যদি দুমাস আমার সঙ্গে বের হও তাহলে দেখবে মিসেস রায়ের মত ফিগার হয়ে যাবে।

কার মত?

মিসেস রায়। মানে তোমার মায়ের কথা বলছি। উই মাস্ট অ্যাডমিট শী ইজ এ বিউটি। কোমর কত বল তো? দ্যাখা যায় না আজকাল! আমি অবশ্য তিন সপ্তাহ বেরুচ্ছি। খাওয়া কমিয়ে দিয়েছি, বুঝলে! মাত্র সাতশ ক্যালরি ডেইলি। শুনতেই সাতশ, কি খাই জানো? ভোরে অক্সিজেন। তারপর এক চামচ চিনি দিয়ে দুধ ছাড়া চা। বিশ ক্যালরি। তারপর একটা শুকা টোস্ট, তোমাকে বোর করছি? আসলে আজকাল সারাদিন শুধু খাওয়ার চিন্তা মাথায় ঘোরে। প্রাক্টিক্যালি ভারতবর্ষের মানুষ কেন এত খায় বলতে পার? অপচয়, অপচয়। মিসেস রায় আমাকে শরীর তৈরির কারখানায় যেতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি নিজেই নিজেকে বানাবো বলে ঠিক করেছি। আত্মতৃপ্তির হাসি হাসলেন রবীন সেন।

বানাতে পারছেন?

কমছে, বেশ কমছে। তবে মনে হয় কারও কারও চুমু খেলেও ফ্যাট বাড়ে। কিছু মনে করো না, এসব অ্যাকাডেমিক ডিসকাশন। তুমি কি মনে কর চুমুতেও ফ্যাট জমে? ওতেও কি ক্যালরি আছে?

আপনি ওটা বন্ধ করে দেখুন না।

না ভাই, মিষ্টি, দুধ, মাংস, ডিম সব কমিয়ে দিয়েছি কিন্তু চুমু, ইম্পসিবল। একেই ভারতবর্ষের মানুষ কম চুমু খায়, ইটস অ্যান আর্ট। তবে ওতে কত ক্যালরি আছে সেটাই জানতে হবে। খুব ঘেমে গেছি, কিছু মনে করো না। ববীন সেন নিঃশ্বাস নিলেন।

মিসেস রায়কে জিজ্ঞাসা করুন। এ ব্যাপারে উনি আপনাকে সাহায্য করতে পারবেন। চলি।

আহা, দাঁড়াও না এক মিনিট। মিসেস রায় তো দার্জিলিং-এ। চমৎকার ওয়েদার এখন ওখানে। এয়ারপোর্টে ওদের দেখলাম। সান্যাল ছোকরাটা খুব লাকি। এত মেয়েদের সঙ্গে ঘোরে তবু ফ্যাট জমেনি শরীরে। আসলে আমার সেক্রেটারিটাই ইনফেকশান।

খুব মোটা বুঝি?

ছিল না, মাস নয়েকের মধ্যে। ওকে ছাড়াতে হবে। তুমি চাকরি-টাকরি করলে আমাকে বললা। খুব লাইট জব। ও-কে! রবীন সেন আবার ফিরে গেলেন শরীর নাচিয়ে হাঁটার জন্যে। এই ফাঁকে বোদ ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীতে। নরম আদুরে রোদ। জয়িতা লিফটের দিকে এগিয়ে গেল। সীতা রায় তাহলে সত্যি এখন দার্জিলিং-এ। ওর মনে পড়ল কিছুদিন আগে সীতা রায় কাউকে টেলিফোনে বলছিলেন, আই ডোন্ট লাইক অ্যানম্যারেড গাইস। এই বয়সে বিয়ে-থা করতে বলবে—ওরে বাব্বা! যার সম্পর্কে এই কথাগুলো উচ্চারণ করেছিলেন তাকে নিয়েই তিনি এখন দার্জিলিং-এ আরাম করছেন।

যা হোক, একজন অন্তত কৈফিয়ত নিতে সামনে দাঁড়াবে না। সে সো করে লিফটে সোজা ওপরে চলে এল সে। এখনও আলো নেবেনি বাড়িটার। বোতামে চাপ দিল জয়িতা। এই প্রথম একটা গোটা রাত বাইরে কাটিয়ে সে বাড়িতে ফিরছে। বেলের আওয়াজ বাইরে থেকে শোনা যায় না। কিন্তু একটু বাদেই দরজা খুলে গেল। তাকে দেখে শ্রীহরিদা কি করবে বুঝতে পারছিল না। তারপর কেমন গলায় জিজ্ঞাসা করল, কোথায় ছিলে সারারাত? আমি ভেবে মরি। কান খাড়া করে বসেছিলাম।

মানুষটার জন্যে কষ্ট হল জয়িতার। সে চুপচাপ ভেতরে চলে এল। এমনিতে বেল বাজালে শ্রীহরিদার হুঁশ হয় না। এই নিয়ে রামানন্দ এবং সীতার মধ্যে প্রচুর ঝগড়া হয়েছে। সীতা রায়ের জন্যেই ওকে ছাড়াতে পারছেন না রামানন্দ। অথচ আজ একবার বেল বাজাতেই দরজা খুলে দিল শ্রীহরিদা। কখনও কখনও কি ও ঠিকঠাক শুনতে পায়!

পেছন পেছন আসছিল শ্রীহরিদা, তোমার মা বাড়িতে নেই, বাবা কাল রাত্রে ফেরেনি, তুমিও সেই লাইন ধরলে। আমার আর এই সংসার আগলাতে ভাল লাগছে না।

নিজের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে জয়িতা চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল, বাবা বাড়িতে নেই?

মাথা নাড়ল শ্রীহরিদা, না, বাইরে গেছে। কালকে ফিরবে। স্যুটকেস নিয়ে গেছে।

বাবা বাইরে গেছে?

হ্যাঁ। আমিই তো গাড়িতে তুলে দিয়ে এলাম স্যুটকেসটা। সেই সান্যাল ছোকরাটা গাড়ি নিয়ে এসেছিল। তুমি আবার কোন্ চুলোয় গিয়েছিলে?

জয়িতা জবাব দিল না। সত্যি, শ্রীহরিদার সঙ্গে কথা বলার কোন মানে হয় না। বাবার কথা জিজ্ঞাসা করে মায়ের সম্পর্কে শুনতে হচ্ছে। রামানন্দ কি বাইরে গেছেন কারও সঙ্গে? হাতের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে জয়িতা রামানন্দ রায়ের ঘরে এল। পাশের দরজাটা বন্ধ। সীতা রায় বাইরে গেলে ঘরের দরজার চাবি নিয়ে যান।

ঘরটাকে খুঁটিয়ে সে দেখল। এই ঘর দেখে অবশ্য বোঝা যাবে না কেউ বাইরে গেছে কিনা। রামানন্দ রায়ের তিনটে স্যুটকেস পাশাপাশি রয়েছে। নতুন স্যুটকেস কেনাটা অস্বাভাবিক নয়। রামানন্দের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। পরিপাটি করে সাজানো। এমন কিছু চোখে পড়ল না যা থেকে কোন সূত্র পাওয়া যায়।

ঘরে ফিরে এসে স্নান করল জয়িতা। ঠাণ্ডা জলের স্পর্শ সর্বাঙ্গে মাখামাখি হওয়ার পর মন প্রফুন্ন হয়ে গেল ওর। রামানন্দ রায়ের বাড়িতে না ফেরা, সীতা রায়ের ইচ্ছে করে হারিয়ে যাওয়ায় তার কিছু এসে যায় না আর। গতরাত্রে যে কাজটা ওরা করেছে এইরকম কাজ যদি একটার পর একটা করে যেতে পারে, যদি ভণ্ড কপট মানুষগুলোর মুখোশ খুলে দিয়ে দেশের মানুষের বিবেকে কিঞ্চিৎ ঢেউ তুলতে পারে তাহলে বেঁচে থাকার একটা কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। পোশাক পালটে জয়িতা শুয়ে পড়ল। এই সময় শ্রীহরিদা চা নিয়ে ঢুকল। দামী কাপে গরম চা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল সে। আজ যদি সুদীপের সেই আত্মীয়ার বাড়িতে তাদের থাকতে হত তাহলে কপালে কি জুটত? বালিশে মুখ গুঁজে সমস্ত শরীরে আরাম নিতে নিতে হঠাৎ ওর মনে হল এই নরম বিছানা, দামী চা, এইসব আরামদায়ক বস্তু তার জন্যে নয়। এসবই রামানন্দ রায় মারফৎ তার অভ্যেসে এতকাল মিশে ছিল। এখন চটজলদি এসব থেকে মুক্ত হওয়া দরকার। ঠিক এইসময় টেলিফোন বেজে উঠল। করিডোর ডিঙিয়ে জয়িতার ঘরে সেই আওয়াজ ঢুকল কুকুরের কুঁই কুঁই ডাকের মতন। জয়িতা উঠে বসল। আশ্চর্য, পথে আসবার সময় তার ঘুম পাচ্ছিল স্বাভাবিক ভাবেই অথচ বিছানায় গা এলিয়ে দেবার পর আর দুচোখের পাতা এক হচ্ছে না। সে নিজের ঘরের দিকে তাকাল। এই ঘরে এমন সব আসবার আছে যা অনেকের বাড়িতে নেই। এই স্বাচ্ছন্দ্য আনন্দর বাড়িতে দ্যাখেনি সে, কল্যাণের ওখানে তো কল্পনা করা যায় না। এক কথায় নিশ্চয়ই এসব ছেড়ে যাওয়া যায় কিন্তু নিরাসক্ত মন নিয়েও তো এদের সঙ্গে থাকা যায়। ভারতবর্ষের কয়েক লক্ষ মানুষ অর্ধাহারে থাকে বলেই আমাকে অর্ধাহারে থাকতে হবে তার কোন মানে নেই। বরং যা সহজ তাই মেনে নেওয়া ভাল। তাতে আর যাই হোক টেনশন থাকে না।

শেষ পর্যন্ত ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রিসিভারটা তুলল জয়িতা, হেলো।

এভরিথিং অলরাইট জয়ী?

কে বলছেন? ইচ্ছে করেই প্রশ্নটা করছে জয়িতা।

আমার গলা চিনতে পারছিস না? আমি তোর বাবা।

ও! কি বলছ? চ

আমি হঠাৎই অফিসের কাজে জামসেদপুরে চলে এসেছি। গতকাল ফোন করেছিলাম, তোরা কেউ বাড়িতে ছিলি না। কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো?

না।

খানিকক্ষণ চুপচাপ। রামানন্দ যেন কথা খুঁজছেন। জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি একাই গিয়েছ জামসেদপুরে? আই মিন, তোমার সঙ্গে কেউ নেই?

আমার সঙ্গে? নো, আর কারও তো আসার কথা ছিল না। কেন বল্ তো?

মা দার্জিলিং-এ গিয়েছে। সঙ্গে সান্যাল আছে, তাই।

জয়ী! হঠাৎ রামানন্দ রায়ের গলা রুদ্ধ হয়ে এল, আমি জানি, আমি জানি। কিন্তু এসব তো এখন নর্মাল, খুব নর্মাল–আমাকে, আমাদের মানতেই হয়। হয়তো তোর মা কোন একটা একজিবিশনের ব্যবস্থা করতে দার্জিলিং-এ গিয়েছে।

হঠাৎই চুপচাপ হয়ে গেল লাইনটা। রামানন্দ কথা বলছিলেন না। জয়িতা রিসিভারটা চুপচাপ কানে চেপে রেখেছিল। এটা কতক্ষণ? তিরিশ সেকেন্ড হতে পারে, এক মিনিটও। তারপর রামানন্দই বললেন, আমি আজ বিকেলের ট্রেনেই ফিরছি।

জয়িতা বলল, আচ্ছা।

রামানন্দ গলায় জোর আনতে চেষ্টা করলেন, আমি–আমি–আচ্ছা থাক, গিয়ে বলব। আসলে প্রত্যেক মানুষের তো কিছু না কিছু বলার থাকেই। গুডবাই।

লাইনটা কেটে গেল। এবং হঠাৎই রামানন্দ রায়ের জন্যে জয়িতার কষ্টবোধ হল। সে মুখ তুলে দেওয়ালের দিকে তাকাল। সেখানে এক বছরের জয়িতাকে শূন্যে তুলে ধরে রামানন্দ হাসছেন। মেয়ের আতঙ্কিত মুখ দেখে পিতার আশ্বস্ত করা হাসি।

 

রাস্তায় নেমে সুদীপ চারপাশে তাকাল। এই ভোরে মানুষ থাকার কথা নয়। কিন্তু এখন সবাই স্বাস্থ্য উদ্ধার করতে বেরিয়ে পড়েছে। তার কাঁধের ব্যাগটা ভারী, হাতেরটা তেমন নয়। দ্রুত পা চালাচ্ছিল সে। এই সময় একটা লোককে সে ফুটপাতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। চোখাচোখি হওয়া মাত্র আকাশের দিকে মুখ তুলল লোকটা। সুদীপের বুকের মধ্যে ছলাৎ করে উঠল। এই লোকটা কে? কখনও এপাড়ায় দ্যাখেনি ওকে! এই কি ওর খোঁজে এসেছিল বাড়িতে? যদি পুলিশের চর হয় তাহলে এই মুহূর্তে তাকে অ্যারেস্ট করলে আর কিছু করার থাকবে না। হাতের ব্যাগটায় প্রচুর রসদ পেয়ে যাবে লোকটা। কিন্তু মিনি বেড়ালের মত ধরা দেবে না সুদীপ। এখনও তার কোমরে মালটা গোঁজা আছে।

সুদীপের চোয়াল শক্ত হল। লোকটা ওর দিকে আর একবার তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। না, আর সন্দেহ করার কিছু নেই। নির্ঘাৎ ওরই জন্যে দাঁড়িয়ে। সুদীপের গতি কমে এল। এখনও হাত-দশেক বাকি। দূরে ঠাকুরের দোকানটা এখনও বন্ধ। হঠাৎই যেন রাস্তাটা আরও ফাঁকা হয়ে গেল। ডান কাঁধ থেকে বা কাঁধে স্ট্রাপটা বদল করে সুদীপ সরাসরি লোকটার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ওর ডান হাতটা এখন অত্যন্ত সতর্ক। লোকটা যেন তাকে দেখতেই পাচ্ছে না। সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?

চট করে মুখ ফেরাল লোকটা। তারপর দ্রুত মাথা নেড়ে না বলল। ঢ্যাঙা, রোগা লোকটার শরীরে তেমন শক্তি নেই। ময়লা পাজামা আর হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবির দুতিন জায়গায় সেলাই-এর দাগ। সুদীপ একটু সাহস পেল, তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

না, মানে, একটু দরকার ছিল। লোকটার গলার স্বরে বেশ অসহায় ভাব।

আপনি আমাকে চেনেন?

দ্রুত ঘাড় নাড়ল লোকটা, না, আমি তো এপাড়ায় থাকি না।

তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

লোকটা মুখ নামাল। ঠিক কি উত্তর দেওয়া উচিত বুঝতে পারছিল না যেন। সুদীপ বুঝতে পারল গোয়েন্দা হিসেবে লোকটা খুব ঝানু নয়। ওর খুব রাগ হচ্ছিল কিন্তু কিভাবে লোকটাকে বেশ শায়েস্তা করা যায় বুঝতে পারছিল না। এই সময় আর একটা গলা শোনা গেল, কি হয়েছে রে?

সুদীপ তাকিয়ে দেখল সীতানাথ ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে। ভাল ক্রিকেট খেলে সীতানাথ, নিশ্চয়ই সীড়াতে বেরিয়েছিল। ফাস্ট বোলার, বেশ রাগী। সুদীপ বলল, দ্যাখ না সীতানাথ, এই লোকটা কোন ধান্দা নিয়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছে, জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দিচ্ছে না।

সঙ্গে সঙ্গে লোকটি বলল, না ভাই, আমার কোন ধান্দা নেই।

সীতানাথ বেশ রুখু গলায় জিজ্ঞাসা করল, তাহলে কি জন্যে দাঁড়িয়ে আছেন?

লোকটার ঠোঁট নড়ল, তারপর বলল, আমি একজনকে দেখতে এসেছি।

সীতানাথ জিজ্ঞাসা করল, কাকে দেখতে এসেছেন? রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখছেন?

লোকটি মাথা নাড়ল দ্রুত, ঠিক রাস্তায় নয়। আসলে ওই ফ্ল্যাট বাড়িটায় ও আছে। বলেছিল পাঁচটা নাগাদ বেরিয়ে আসবে। তাই দাঁড়িয়ে আছি।

সুদীপ ফ্ল্যাট বাড়িটার দিকে তাকাল। সম্প্রতি কন্ট্রাক্টর জমি কিনে ফ্ল্যাট বানিয়ে বিভিন্ন মানুষকে বিক্রি করেছে। ওই ফ্ল্যাটগুলোর বাসিন্দাদের সঙ্গে পাড়ার লোকের তেমন জানাশোনা হওয়ার সুযোগ নেই। সে জিজ্ঞাসা করল, আপনি ওই ফ্ল্যাটেই গেলেন না কেন?

যাওয়া নিষেধ আছে। আমি ঠিক বোঝাতে পারব না।

সুদীপ, একে ছাড়িস না। পাড়াতে বহুৎ দুনম্বরী চলছে, এ শালার কি ধান্দা কে জানে! এই যে মশাই, বাংলা বলুন তো, ধান্দাটা কি?

এই সময় ফ্ল্যাট বাড়ির শরীর থেকে একটি মেয়ে বেরিয়ে এল। আটপৌরে পোশাক, সুন্দরী। তাকে দেখা মাত্র লোকটি চঞ্চল হয়ে উঠল, আমি যাই, ও এসেছে।

সীতানাথ বাধা দিল, দাঁড়ান। কে হন উনি আপনার? সাতসকালে পাড়ার মেয়ে বউ-এর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন অথচ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকছেন?

কথাটা শোনামাত্র হাসি পেল সুদীপের। এই মুহূর্তে সীতানাথকে বেশ পাড়ার গার্জেন বলে মনে হচ্ছে। পাড়ার মেয়ে বউরা সন্ধ্যেবেলায় ধ্যাষ্টামো করলে দোষ নেই, ভোরবেলায় সেটা দৃষ্টিকটু। মেয়েটি থমকে দাঁড়িয়ে গেছিল। তারপর দ্রুত পা ফেলে কাছে এল, কি হয়েছে বাবা?

কিছু না কিছু না। এখানে দাঁড়িয়ে আছি বলে এরা কারণ জানতে চাইছিলেন।

তুমি কেন সাতসকালে এখানে দাঁড়িয়ে থাক? তোমাকে রোজ আসতে নিষেধ করেছি না?

তোকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে খুকী।

এসো। ওদিকে হাঁটি। এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। মেয়েটি হাঁটতে শুরু করল।

লোকটি সুদীপদের দিকে তাকাল, আমার মেয়ে। বড়ঘরে বিয়ে দিয়েছিলাম। বরপণের টাকা পুরো মেটাতে পারিনি বলে আমার বাড়িতে আর পাঠায় না ওর স্বামী। শরীর খারাপ হয়েছিল বলে ডাক্তার মর্নিং ওয়াক করতে বলেছে। জামাই আবার সকালে বিছানা ছাড়তে পারে না। তাই আমি এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকি, মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়। আমি যাব?

সুদীপ হঠাৎ গলায় কোন স্বর পেল না। ও তাকিয়ে দেখল সীতানাথ হঠাৎ দৌড়াতে শুরু করে দিল। লোকটার উদ্দেশ্যে ঘাড় নেড়ে সে হাঁটতে শুরু করল। নিজেকে খুব খারাপ লাগছিল। খামোকা মানুষটাকে সে সন্দেহ করল। এইভাবে সবসময় আতঙ্কিত থাকায় সব সরষের মধ্যে ভূত দেখার অভ্যেস হয়ে থাকে। তাকে হয়তো কেউ অনুসরণ করেনি, কেউ তার খোঁজ করেনি এই উদ্দেশ্যে অথচ সে সবসময় ছায়া দেখছে। ধরা যদি পড়তে হয় তাহলে একবারই পড়বে। এবং পড়ার আগে কিছু কাজ করে যাবে। সে আর একবার ফ্ল্যাট বাড়িটার দিকে তাকাল। মেয়েটার স্বামী এখনও ঘুমোচ্ছে। এ শালাকে শেষ করে দেওয়া উচিত। বরপণের জন্যে বউকে বাপের সঙ্গে দেখা করতে দেয় না। সুদীপ মাথা নাড়ল। এরকম দেখলে দেশের প্রত্যেক ঘরে ঘরে এমন মানুষ পাওয়া যাবে যাদের মেরে ফেলতে হয় এখনই। আমরা বড় অপরাধগুলো দেখি, কিন্তু ছোট ঘোট অপরাধগুলো জড়ো হয়ে যাওয়ায় বড় অপরাধগুলো শক্তি পায় প্রবল হতে। তাই সব পরিষ্কার করলেই দেশ নির্মল হয়। রাষ্ট্রযন্ত্র সক্রিয় না হলে সেটা সম্ভব নয়। গণতান্ত্রিক কাঠামোয় সেটা আবার অসম্ভব। অতএব সীমিত সুযোগে বড় বড় অপরাধগুলোকেই টার্গেট করতে হবে। তার প্রতিক্রিয়া যদি চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।

সুদীপের আর ঘুম পাচ্ছিল না। সে সহজভাবে হাঁটতে হাঁটতে প্যারাডাইসের কথা চিন্তা করল। ঠিক কতজন লোক মারা গেছে ঠাওর করা সম্ভব নয়। কিন্তু আগুন লেগেছে মারাত্মক, এত দ্রুত বৈদ্যুতিক আগুন যে চারপাশে ছড়িয়ে পড়বে তা ভাবতে পারেনি সুদীপ। এইভাবে কেউ আহত না হয়ে প্যারাডাইসের কোমর ভেঙে ফেলতে পেরে খুব ভাল লাগছে না। ওর মালিক যখন আর কোনদিনই ফিরে আসবে না তখন ধরে নেওয়াই যায় প্যারাডাইস বন্ধ হল।

বাড়ির সামনে এসে এক মুহূর্ত দাঁড়াল। এখন অবনী তালুকদারের মুখোমুখি হতে হবে তাকে। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনরকম ঝামেলা করার বাসনা নেই তার। অবনী তালুকদার যদি চেঁচামেচি করে কৈফিয়ত চায় তাহলে যতটা সম্ভব ভদ্রভাবে এড়িয়ে যেতে হবে। যে কদিন এখানে থাকতে হবে সে কদিন অশান্তি করে কি লাভ।

এইসময় কার্তিকদাকে দেখতে পেল সে। সিড়িতে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। দেখলেই বোঝা যায় রাত্রে ঘুমায়নি। ওকে দেখে সামান্য নড়ল না পর্যন্ত। কার্তিকদার পেছনে বাড়ির সদর দরজা আধভেজানো। সামনে দাঁড়িয়ে সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, কি ব্যাপার, এখানে বসে আছ কেন?

কার্তিকদা নড়ল না। কিন্তু তার দুই চোখ জলে ভরে এল। সুদীপ আবার জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে?

এবার হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল কার্তিকা। তার শরীর কাপছে, দুটো হাতে মুখ ঢাকা। সুদীপ অবাক হয়ে বাড়িটা এবং কার্তিকদাকে দেখল। এবং তখনই কার্তিকদা কোনমতে বলতে পারল, মা নেই, মা চলে গেল।

কে চলে গেল? সুদীপ হতভম্ব।

মা। বাবু আমাকে বসিয়ে রেখেছে এখানে গাড়ি আসবে বলে।

সুদীপের মাথাটা একপাশে সামান্য ঝুঁকল। ও যেন কথাটা বুঝতে চেষ্টা করল। মা নেই? মা মারা গেছে? এক লাফে কয়েকটা সিড়ি টপকেই সুদীপের খেয়ালে এল। হাতের ব্যাগ নিয়ে এইভাবে লাফালে উলটো বিপত্তি ঘটতে পারে। ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকল সে। নিচে কেউ নেই। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল সে। আর তখনই অবনী তালুকদারকে দেখতে পেল। মায়ের ঘরের দরজার সামনে একটা বেতের চেয়ারে গালে হাত রেখে বসে আছেন। তার দৃষ্টি ভেতরের দিকে। সুদীপ যে উঠেছে তা তিনি খেয়ালই করলেন না! ব্যাগ দুটোকে টেবিলের ওপরে রেখে সুদীপ এগিয়ে গেল। এইবার ওকে দেখতে পেলেন অবনী তালুকদার। দেখে সোজা হয়ে বসতে বসতে আবার কি মনে করে আগের ভঙ্গিতে ফিরে গেলেন। বাবাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে সে মায়ের ঘরে পা বাড়াল। এবং তখনই ধূপের গন্ধ পেল। মা শুয়ে আছেন। তার চিবুক পর্যন্ত সাদা চাদরে ঢাকা।

আর কাছে গিয়ে কি হবে? যে চুলোয় রাত কাটালে সেখানে থেকে গেলেই হত!

সুদীপের চোয়াল শক্ত হল। কিন্তু অবনী তালুকদারের কথার কোন জবাব দিল না। মায়ের মুখ কত পালটে গেছে। তার চেনা স্মৃতি, এমনকি জীবন্ত অবস্থায় শেষবার দেখা মানুষটির সঙ্গে এই মৃতদেহের কোন মিল নেই। যে চামড়াটুকু অবশিষ্ট আছে তা হাড়ের সঙ্গে লেপটে। এবং এখনই সেই বীভৎস পচা গন্ধ বের হচ্ছে শরীর থেকে। মহিলা বেঁচে গেলেন। হঠাৎই এইরকম বোধ হল সুদীপের। সে মুখ তুলে নার্সকে জিজ্ঞাসা করল, কখন চলে গেছেন?

রাত তিনটের সময়। যাওয়ার আগে জ্ঞান ছিল?

না।

এইসময় সুদীপ পায়ের শব্দ পেল। অবনী তালুকদার তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, কি জানতে চাইছ তুমি? না, তোমার সম্পর্কে কোন কথা জানতে চায়নি যাওয়ার আগে!

আপনি ছিলেন সে সময়?

থাকব না? সতীসাবিত্রী চলে যাচ্ছে সেই পবিত্র সময়ে থাকব না? আমি আজ লক্ষ্মীহীন হলাম। সে আমার লক্ষ্মী ছিল। ও হো! শেষদিকে গলার স্বর রুদ্ধ হয়ে গেল অবনী তালুকদারের।

সুদীপ আবিষ্কার করল, তার চোখে জল নেই, কান্না পাচ্ছে না মোটেই। অথচ এইরকম সময়ে মানুষেরা কান্নাকাটি করেই। নিজের মা চলে যাওয়ার পর তার মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে সন্তানের কান্না তো স্বাভাবিকই। এইসময় অবনী তালুকদার বিছানার একপাশে বসে হাউ হাউ করে কাঁদছেন। সুদীপ নার্সকে জিজ্ঞাসা করল, ডাক্তার সার্টিফিকেট দিয়ে গেছে?

হ্যাঁ। একটু আগে এসেছিলেন।

 

সুদীপ বেরিয়ে যাচ্ছিল, অবনী তালুকদার ডাকলেন, কোথায় যাচ্ছ?

আত্মীয়স্বজনকে খবর দিতে।

কেন?

শ্মশানে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে না?

না। এ ব্যাপারে তোমার মাথা ঘামানোর দরকার নেই।

তার মানে?

আমি হিন্দু সৎকার সমিতিকে ফোন করে দিয়েছি। ওরা গাড়ি নিয়ে আসছে।

পাড়ার মানুষ, আত্মীয়দের কেউ জানে না তো।

পরে জানবে। এখন দলে দলে লোক এসে নাচতে নাচতে শ্মশানে যাবে আর আমাকে ওদের গাণ্ডেপিণ্ডে খাওয়াতে হবে। এসব বাজে খরচ করার কোন দরকার নেই।

চমৎকার!

উঁহু, ব্যঙ্গ করে আমার সঙ্গে কথা বলো না। আমি জানি কখন কি করতে হবে আমাকে।

সুদীপ আর একবার মায়ের দিকে তাকাল। এখন ছাল ছাড়ানো পোড়া কাঠের মত লাগছে। সে ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে এসে ব্যাগ দুটো নিয়ে নিজের ঘরে চলে এল। এবং তখনই সমস্ত শরীরে একটা ঝিমুনি ছড়িয়ে পড়ল তার। বিছানায় বসে সে দুহাতে মুখ ঢাকল। তারপর চকিতে মনে পড়তেই তার পড়ার টেবিলের পেছনের দেওয়ালে টাঙানো ছবিটার দিকে তাকাল। ছোট্ট সুদীপ দুহাতে মাকে জড়িয়ে হাসছে। মায়ের মুখে তখন স্বর্গীয় তৃপ্তি। কাছে উঠে এল সুদীপ। ও ঘরে যে শুয়ে আছে তার সঙ্গে এই শরীরের কোন মিল নেই। হাত বাড়িয়ে মায়ের ঠোঁটে আঙুল রাখল সে। এবং তখনই সমস্ত শরীর কঁপিয়ে জলস্রোত ছিটকে এল। আচমকা কান্নায় ভেঙে পড়ল সুদীপ।

 

কলেজ স্ট্রীটের মোড় এগারো নম্বর ট্রাম থেকে নেমে পড়েছিল আনন্দ। কল্যাণ প্রথমে ভেবেছিল বাড়ি যাবে, পরে মত বদলালো। কলেজ নোর মূখের একটা চায়ের দোকান তখন খুলে গেছে। ওরা সেখানে চা খেল। তারপর ধীরে ধীরে হোস্টেলের দিকে পা বাড়াল। কলেজ স্কোয়ারের সামনে এসে আনন্দ বলল, এত ভোরে হোস্টেলে ঢোকা ঠিক হবে না। চল, কলেজ স্কোয়ারের বেঞ্চিতে বসে কিছুটা সময় কাটিয়ে দিই।

তুই আমাদের বাড়িতে যাবি? কল্যাণ জিজ্ঞাসা করল।

তোর বাড়িতে! আনন্দ কিছুটা অবাক। কল্যাণের বাড়ির গল্প তারা শুনেছে। কিন্তু কোনদিন যাওয়ার আমন্ত্রণ পায়নি। একটু আগে বাড়িতে ফিরবে বলে কল্যাণ নিজেই ট্রাম থেকে নেমে পড়েছিল।

আমার বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করছিল না। এই যে একটা রাত বাইরে কাটিয়ে এলাম তা নিয়ে বাবা ছাড়া কেউ কোন প্রশ্ন করবে না। উত্তর যা দিই তাই মেনে নেবে। ওই বাড়িতে আর ফিরব না বলেই বেরিয়েছিলাম। এক এক সময় মনে হয় কি জানিস, আমি যদি প্রচুর রোজগার করতে পারতাম, যদি বাড়ির কারও কোন অভাব রাখতাম না, তাহলে হয়তো মানুষগুলোর ব্যবহার পালটে যেত। কিন্তু আমার যা অবস্থা তাতে কোনদিন বড় চাকরি পাব কিনা তাই সন্দেহ ছিল। আর এখন–।

এখন?

তোকে কাল বলিনি, আমি একটা লোকের মাথা লক্ষ্য করে বোমা ছুঁড়েছিলাম। এই আমি কোনদিন বোমা ছুঁড়তে পারব বলে ভেবেছিলাম? কিন্তু লোকটা তোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল বলে স্থির থাকতে পারলাম না। পুলিশ যদি ধরতে পারে তাহলে ফাসি হয়ে যাবে, নারে?

আগে ধরুক তারপর চিন্তা করা যাবে। চল তোর বাড়িতেই যাই। এই ভোরে তোর সঙ্গে আমাকে হোস্টেলে দেখলে যে কেউ সন্দেহ করতে পারে। বিশেষ করে আমাদের গ্রামেই যখন ঘটনাটা ঘটেছে। তোর কাছে রেডিও আছে?

কেন?

সকালের খবর শুনব। কাগজে নিশ্চয়ই ছাপার সুযোগ পাবে না।

আমার ভাই-এর একটা ট্রানজিস্টার আছে।

আবার ট্রামে চেপে ওরা শ্যামবাজারে চলে এল। বস্তি এলাকা বলেই সাতসকালে রাস্তায় বেশ লোকজন। ওরা নিঃশব্দে বাড়িতে ক্ষল। একজন মহিলা বারান্দা দিয়ে হেঁটে গেলেন। কল্যাণ বলল, আমার বড় বউদি। আজ সাতসকালে কেন উঠেছে বুঝতে পারছি না। একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক খালি গায়ে রকে বসেছিলেন, ওদের দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় ছিলে সারারাত?

কাজ ছিল। এর সঙ্গে ছিলাম। আমার বন্ধু।

ভদ্রলোক কিছু বললেন না। নিজের ঘরে ঢুকে কল্যাণ বলল, আমার বাবা। এই ঘরে আমার ছোট ভাইও থাকে। মনে হচ্ছে গতরাত্রে তিনি ফেরেননি। চেয়ারটায় বোস, আমি বিছানাটা পরিষ্কার করছি। মুখটুখ ধুবি নিশ্চয়ই! একটু দাঁড়া। হাওয়াটা কি রকম দেখে আসি।

 

কিছুক্ষণ পরে কল্যাণের ভাই-এর ট্রানজিস্টারে বাংলা খবর শুনল ওরা। কিছু অসার খবরের পর সংবাদ পাঠক পড়লেন, গত রাত্রে ডায়মন্ডহারবার রোডের একটি স্বাস্থ্যনিবাসে দুঃসাহসিক ডাকাতি হয়ে গেছে। স্বাস্থ্যনিবাসের মালিকসহ চারজন নিহত হয়েছেন। যাওয়ার আগে ডাকাতরা আগুন ধরিয়ে দেয়। সম্পূর্ণ ভস্মীভূত স্বাস্থ্যনিবাসটিকে ধ্বংস করার পেছনে ডাকাতদের কোন উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুলিশ ব্যাপক তল্লাসী চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে তিনজনকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ নিশ্চিত এটা কোনও উগ্রপন্থীদের কাজ নয়।

আনন্দ বলল, দরজাটা বন্ধ কর, একটা লম্বা ঘুম দেব।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার