অনিমেষ বাড়িতে ফিরে এল রাত আটটায়। হাতমুখ ধোওয়ার পরে মাধবীলতা খাবার দিল।

খাওয়া শুরু করে অনিমেষ মাধবীলতাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার নিশ্চয়ই খুব কৌতূহল হচ্ছে, আমি কোথায় গিয়েছিলাম তা জানতে?

এই খবরটা তোমাকে কে দিল? মাধবীলতা তাকাল।

মানে? আমি একটি অচেনা লোকের সঙ্গে কথা বলার পাঁচ মিনিট পরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছি। বলেছি ফিরতে দেরি হবে। মাঝে ফোনে তোমাকে খবর দিয়েছিলাম। কিন্তু ফিরে এসে এত টায়ার্ড ছিলাম যে এ বিষয়ে কোনও কথা বলতে পারিনি। অনিমেষ বলল।

তুমি এভাবে কৈফিয়ত দিচ্ছ কেন? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল। অনিমেষ উত্তর না দিয়ে চুপচাপ খেতে লাগল। শেষ পর্যন্ত অর্কই মুখ খুলল, তুমি তো শরীরের কারণে বাইরে যাও না। আমাকে যারা ফোন করে তাদের বেশির ভাগকেই তুমি চেনো না, অথচ শুনলাম ফোনে কথা বলার পরেই বেরিয়ে গেছ। কে ফোন করেছিল তা বলবে?

মোবাইলে তার নাম্বার দেখিসনি?

ওটা তো তোমার সঙ্গে ছিল। এখনও ফেরত দাওনি। অর্ক বলল।

অনিমেষ মাধবীলতাকে বলল, টেবিলের ওপর মোবাইলটা রাখা আছে, এনে দেবে?

মাধবীলতা খাওয়া ছেড়ে ঘরে গিয়ে সেটা এনে অর্ককে দিল। ওটা এখনও সুইচ অফ করেই রাখা আছে। সেট অন করে বাঁ হাতের আঙুলের চাপে রিসিভড কলগুলো দেখতে গিয়ে চমকে উঠল।

অনিমেষ খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করল, চিনতে পেরেছিস?

রামজি ফোন করেছিল! হঠাৎ? অর্ক মাথামুন্ডু বুঝতে পারছিল না।

সে তোর বন্ধু। এই বাড়িতে আমাদের অনুপস্থিতিতে তাকে তুই আশ্রয় দিয়েছিলি। তুই তো ভাল বলবি সে কেন ফোন করেছে? হঠাৎ হবে কেন? অনিমেষ বলল।

আমার সঙ্গে ইদানীং কথা হয়নি। ও কি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিল? আর চাইলেই তুমি বেরিয়ে গিয়ে দেখা করবে কেন? অর্ক গম্ভীর হল।

তুই যদি ওকে নিয়ে বোলপুরে গিয়ে অ্যাডভেঞ্চার করতে পারিস আমি সামান্য দূরত্বে গিয়ে কথা বলতে পারব না কেন? অনিমেষ তাকাল।

রামজি কি এখন কলকাতায়?

ও যদি খগপুরে থাকত তা হলে কি আমি সেখানে যেতে পারতাম?

বাবা, তুমি স্পষ্ট কথা বলছ না কেন?

দ্যাখো অর্ক, তুমি স্পষ্ট কথা বলতে যা বোঝাতে চাইছ তা বোঝার মতো বুদ্ধি আমার নেই, ভাবছ কেন? অনিমেষ বিরক্ত হল।

বেশ। রামজি কি কলকাতায় এসেছে? সরাসরি জিজ্ঞাসা করল অর্ক।

হ্যাঁ। সে এই শহরে না এলে আমি কথা বলতে যেতাম না।

কিন্তু তুমি খুব ঝুঁকি নিয়েছ। রামজিকে পুলিশ খুঁজছে। অর্ক বলল।

তুমি যখন তাকে এই বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলে, যখন তাকে নিয়ে এখানে ওখানে পালিয়ে বেড়িয়েছিলে তখনও তো পুলিশ খুঁজছিল।

কোথায় আছে রামজি?

কেন?

কিছুই না। কৌতূহল হচ্ছে তাই জিজ্ঞাসা করছি।

তোমাকে তো থানার বড়বাবু বলেছিলেন রামজির খবর পাওয়ামাত্র তাকে জানিয়ে দিতে। কারণ পুলিশের মতে সে মাওবাদী। কিন্তু তোমাদের নেত্রী তো বলেছেন পশ্চিমবঙ্গে কোনও মাওবাদী নেই। তা হলে তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? অনিমেষ নিজের ঘরের দিকে এগোল।

ছেলেটা যখন এখানে ছিল তখন তুই জানতিস না ও কোন রাজনীতি করে? এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর মাধবীলতা প্রশ্নটা করল।

রাজনীতি নিয়ে কোনও কথা আমাদের মধ্যে হয়নি।

তা হলে তুই কীভাবে বুঝলি ও মাওবাদী?

একসঙ্গে থাকতে থাকতে বুঝে গিয়েছি। ওর বাড়ি ঝাড়খণ্ডে। কিন্তু সুন্দরবন দিয়ে সমুদ্র পেরিয়ে কোথাও যেতে চাইছিল। সেটা বাতিল হওয়ার পর দিঘার কাছে তালসারিতে চলে গেল। সেখানে সমস্যা হওয়ায় আবার কলকাতায় ফিরে এসে আমার কাছে আশ্রয় চাইল। আমি বুঝেছিলাম ওকে এই বাড়িতে নিয়ে এলে বিপদে পড়ব। আবার ও এত ভদ্র ব্যবহার করেছে যে এড়িয়েও যেতে পারছিলাম না। ওকে নিয়ে গেলাম বোলপুরের কাছে একটা আশ্রমে। কোথাও ওকে রাজনীতির কথা বলতে শুনিনি। এমনকী মোবাইলে খবর পেয়ে ও যখন খড়গপুরে চলে গেল তখন বেশ স্বাভাবিকভাবে বিদায় নিয়েছিল। তৃণমূলের নেত্রীকে রাজনীতি করতে হয়। তার সব কথার চুলচেরা বিচার করা ভুল হবে। অর্ক একটানা বলে গেল।

অনিমেষ বলল, আমার এখনও বিশ্বাস করতে অসুবিধে হচ্ছে যে আদর্শহীন কিছু লোককে জুটিয়ে নিয়ে একজন ব্যক্তি শুধু তার আবেগের ওপর দাঁড়িয়ে একটি রাজ্যের ক্ষমতা দখল করতে পারেন। পৃথিবীর ইতিহাস দেখা গেলে মিলিটারির মদতে বলীয়ান হয়ে ডিক্টেটাররা সেটা করতে পেরেছেন। এমনকী মাও সে তুং, হো চি মিনের মতো ব্যক্তিত্বও ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারেননি। যদি তাও সম্ভব হয় তা হলে তোমার কি ধারণা ক্ষমতায় এলে মাওবাদী বলতে যাদের বোঝা হচ্ছে তারা অস্ত্র ফেলে রেখে নেত্রীর অনুগামী হবে? আর একটিও খুন জঙ্গলমহলে হবে না? যাক গে, অর্ক, যদি রামজি নিজে থেকে যোগাযোগ করে তা হলে তুমি জানতে পারবে কিন্তু আমি তোমাকে তার ঠিকানা জানাতে পারব না।

কেন?

আমরা যখন জলপাইগুড়িতে ছিলাম তখন তুমি রামজির ব্যাপারটা আমাদের জানাওনি। এখন তুমি যে দলের সমর্থক, তোমার যে পরিবর্তন হয়েছে, তাতে আমার কাছ থেকে খবরটা তুমি পেলে রামজি যদি বিপদে পড়ে তা হলে নিজেকে কী বলব? আমার শরীর ভাল নেই, শুয়ে পড়ছি। অনিমেষ ঘরে ঢুকে গেল।

অর্ক মুখ ফিরিয়ে দেখল মাধবীলতা এরই মধ্যে রান্নাঘরে চলে গেছে। সে দাঁড়িয়ে আছে একা। এই সময় উঠোনের ওপাশের দরজায় শব্দ হল। কেউ মৃদু আঘাত করছে। একটু এগিয়ে গিয়ে অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কে?

অর্কদা আমি সলিল। দরজা খুলুন, খুব জরুরি। চাপা গলা ভেসে এল।

একটা দ্বিধা নিয়ে দরজা খুলল অর্ক। যে অল্পবয়সি ছেলেকে সামনে সে দেখতে পেল তাকে আগেও বিশ্বজিৎদের সঙ্গে দেখেছে। জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার?

বিশ্বজিৎদা বলে পাঠাল আপনি যেন আজ রাত্রে ঘরে না থাকেন।

কেন?

সুরেন মাইতিরা আবার হামলা করতে পারে। আপনার খাওয়া হয়ে গেছে?

হ্যাঁ।

তা হলে আমার সঙ্গে চলুন।

দরকার নেই। বিশ্বজিৎকে বলো চিন্তা না করতে।

ওরা বাইরে থেকে ছেলে এনেছে অর্কা! ছেলেটি বেশ উত্তেজিত।

ঠিক আছে। দাঁড়াও।

অর্ক ভেতরে ফিরে গিয়ে মাধবীলতাকে বলল, মা, দলের ছেলেরা এসে ডাকছে। একটা জরুরি মিটিং আছে। তুমি শুয়ে পড়ো।

মাঝরাতে এসে ঘুম ভাঙালে বাকি রাত জেগে বসে থাকতে হবে। মাধবীলতা গম্ভীর মুখে বলল।

মাঝরাত হয়ে গেলে ওখানেই থেকে যাব।

যা ভাল বোঝো তাই করো!

বোঝো শব্দটা কানে লাগল। দূরত্ব বাড়াতে মা তুই থেকে তুমিতে উঠে যায়। ছেলেটির সঙ্গে চায়ের দোকানের কাছে পৌঁছে দেখল সেখানে বিশ্বজিত্রা জটলা করছে। বারো-চোদ্দোজন মানুষ বেশ উত্তেজিত। অর্ককে দেখে বিশ্বজিৎ এগিয়ে এল, দাদা, ওরা আজ রাত্রে আমাদের ওপর হামলা করতে চাইছে। বাইরে থেকে প্রচুর ছেলে আনবে, কিছু এসে গিয়েছে। আমরা ঠিক করেছি প্রতিরোধ করব। আজকের রাত্রে কেউ ঘুমাব না।

কিন্তু ওরা হামলা করবে কেন?

বুঝতে পেরেছে পায়ের তলার মাটি সরে গেছে। মরিয়া হয়ে উঠেছে তাই। নির্বাচনের আগে আমাদের কর্মীদের যদি হাসপাতালে পাঠাতে পারে তা হলে ওদের সুবিধে হবে। আপনি আজ আমাদের সঙ্গে থাকুন। বিশ্বজিৎ বলল।

পুলিশকে জানিয়েছ? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

বড়বাবু নাকি অসুস্থ। সেজবাবু ছোটবাবুরা গৌরাঙ্গ হয়ে গেছেন।

তার মানে?

মাথার ওপর হাত তুলে দিয়েছেন। বলছেন গিয়ে সামাল দিতে গেলে সুন্দরবনে বদলি করবে বর্তমান সরকার আর সামাল না দিলে দার্জিলিং-এ পাঠিয়ে দেবে আগামী সরকার। তার চেয়ে না যাওয়াই ভাল। বুঝুন! বিশ্বজিৎ বলল।

ওরা যদি অস্ত্র নিয়ে মারপিট করে? অর্ক চিন্তিত।

আমরা প্রতিটি ঘরে ঘরে গিয়ে আবেদন জানিয়েছি ঠিক এগারোটা বাজলেই সবাই যেন ঘরে ঘরে জেগে থাকেন। প্রয়োজন হলে তারা বাইরে বেরিয়ে আসবেন। এত লোক দেখলে যত অস্ত্র হাতে থাক কেউ সাহস পাবে না এগোতে। কথাগুলো বলে বিশ্বজিৎ চলে যাচ্ছিল, তাকে ডেকে থামাল অর্ক। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, সুরেন মাইতি কোথায়?

জানি না।

বাড়িতে নেই?

বোধহয় না। হয়তো থানায় গিয়ে বসে আছে।

আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই।

মানে?

ওঁর সঙ্গে কথা বলে যদি এই ঝামেলাটা বন্ধ করা যায়, আমার মনে হয় সেই চেষ্টাই প্রথমে করা উচিত। অর্ক বলল।

বিশ্বজিৎ কাধ নাচাল। তারপর এগিয়ে গিয়ে অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে লাগল।

ধীরে ধীরে মানুষের সংখ্যা বাড়তে লাগল। আজ রাতে এখানে একটা নাটক হবে জেনে সবাই দেখার জন্যে উন্মুখ হয়ে আছে। এরা সেইসব মানুষ যারা যে চোখে বিসর্জনের মিছিল দেখে সেই চোখে মাস্তান বাহিনীর ঝগড়া, মারপিট দেখে তৃপ্ত হয়।

অর্ক ভিড় ছাড়িয়ে সুরেন মাইতির বাড়ির কাছে এসে দেখল বাড়ির দরজা জানলা বন্ধ রয়েছে। সাধারণ মানুষ এই সময় বিছানায় চলে যায় কিন্তু সুরেন মাইতি সাধারণ নয়। ইতস্তত ভাব কাটিয়ে অর্ক বারান্দায় উঠে দরজায় কড়া নাড়ল। দ্বিতীয়বারে ভেতর থেকে সাড়া এল। একটি মহিলা জানতে চাইলেন কে কড়া নাড়ছে। অর্ক নিজের পরিচয় দিয়ে জানাল সুরেন মাইতির সঙ্গে কথা বলতে চায়।

মহিলা বললে, ও তো বাড়িতে নেই।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, কোথায় গিয়েছেন?

হাসপাতালে।

কোন হাসপাতালে?

পিজি হাসপাতালে।

কারও কিছু হয়েছে?

ওর মায়ের খুব অসুখ, তাই।

অর্ক সরে এল। এই মহিলা কে এবং তিনি সত্যি কথা বলছেন কি না তা বোঝা যাচ্ছে না। সুরেন মাইতি বাড়িতে থেকে মহিলাকে মিথ্যে কথা শিখিয়ে দিতেই পারে।

মধ্যরাত পেরিয়ে গেলে মানুষের ঔৎসুক্য উবে গেল। কোনও নাটক হল না, হারে রে আওয়াজ করে অস্ত্র নিয়ে কোনও দল ধেয়ে এল না যখন, তখন দর্শকরা যে যার ঘরে ঘুমাতে চলে গেল। বিশ্বজিৎ এবং তার সঙ্গীরা তখনও অনড়। এই সুযোগটা নিশ্চয়ই নেবে সুরেন মাইতির বাহিনী। শেষরাত্রে হানা দিলে কোনও বাধা পাবে না বলে অপেক্ষা করছে তারা।

কিন্তু রাতটাও ফুরিয়ে গেল। খুব হতাশ দেখাচ্ছিল বিশ্বজিৎদের। অর্ক বেরিয়ে এল ঈশ্বরপুকুর লেন থেকে। সামনেই বাসস্টপ। সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই বাস পেয়ে গেল। ওটা যাবে প্রিন্স আনোয়ার শা রোডের দিকে, পিজি হাসপাতাল হয়ে।

ভোরের পিজি হাসপাতাল প্রায় মর্গের মতো চুপচাপ। কোনও জীবন্ত মানুষ বাড়িগুলোর বাইরে নেই। শুধু ইমারজেন্সি লেখা ঘরটার সামনে কয়েকটি শরীর তখনও নিদ্রামগ্ন। আধঘণ্টা ঘোরাঘুরি করে সুরেন মাইতির হদিশ পেল না অর্ক। গেটের বাইরে এসে ফুটপাতের চায়ের দোকান থেকে এক ভাঁড় চা কিনে খেতে খেতে ভাবল, মহিলাকে দিয়ে কাল রাত্রে মিথ্যে বলিয়েছে সুরেন। মাইতি।

চায়ের দাম দিতেই ওপাশ থেকে একজন বলল, আপনি এখানে?

সে মুখ ফিরিয়ে ছেলেটিকে চিনতে পারল, সুরেন মাইতির একটি ছায়া।

ছেলেটি কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, কেউ কি অসুস্থ?

না। শুনলাম সুরেনবাবুর মা নাকি এখানে ভরতি হয়েছেন, তাই অর্ক থামল।

হ্যাঁ। হয়েছিলেন। ছেলেটি মাথা নাড়ল।

সুরেনবাবু কাল রাত্রে এখানে ছিলেন?

হ্যাঁ। তিনটের সময় মাসিমা চলে গেছেন। দাদা খুব ভেঙে পড়েছেন। আরও একটু বেলা হলে সবাই এসে পড়বে। তখন এখান থেকে নিমতলায় নিয়ে যাব।

অর্ক ঢোক গিলল।

আপনি দাদার কাছে যাবেন?

চলো।

পার্কের পেছন দিকে পাঁচজন মানুষের মধ্যে বসে ছিল সুরেন মাইতি। অর্ককে আসতে দেখে উঠে দাঁড়াল। অর্ক কাছে এসে বলল, শুনলাম!

কিছুই করতে পারলাম না। কিছুই না। বলতে বলতে চোখ মুছল সুরেন।

অর্ক বলল, শক্ত হন, ভেঙে পড়বেন না।

আপনি, আপনি যে আসবেন তা আমি ভাবতেই পারছি না। অর্কর হাত ধরল সুরেন মাইতি, কী বলে ধন্যবাদ জানাব।

কথা না বাড়িয়ে অর্ক বেরিয়ে এল হাসপাতাল থেকে। ঠিক তখনই পকেটে রাখা যন্ত্রটা বেজে উঠল। ওটা বের করে অবাক হল সে। বোতাম টিপে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে জিজ্ঞাসা করল, বলুন রামজি!বলামাত্র লাইন কেটে গেল। তৎক্ষণাৎ ডায়াল করল অর্ক। অন্তত চারবার। প্রতিবারেই রেকর্ড বাজল, আউট অফ রিচ।

অর্ক অপেক্ষা করতে লাগল, নিশ্চয়ই আবার ফোনটা বেজে উঠবে।

.

৪৭.

টেলিফোনটা বাজল কিন্তু অর্ক দেখল নাম্বারটা অচেনা। ল্যান্ডলাইন থেকে কেউ কল করেছে। সে সাড়া দিতেই কুন্তীর গলা কানে এল। কী করছেন? এখন তো আপনাদের ভাল থাকার কথা।

অর্ক হাসল, আমাদের মানে?

ছাড়ুন। শুনুন, আমি একটা অফার পেয়েছি। ভাবছি, অ্যাকসেপ্ট করব। কুন্তী বলল, আপনি কী বলেন?

আমি তো কিছুই জানি না, কী উত্তর দেব? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

ওহো! আজ কীরকম ব্যস্ত আছেন? আসুন না কথা বলি।

বেশ তো। কোথায়?

আমাদের বাড়িতেই আসুন। মা তো আপনাদের কথা জানে। একটু দূর হবে, আসতে আপত্তি নেই তো?

উত্তর থেকে দক্ষিণ, এমন কী দূর! নিশ্চয়ই যাব।

কুন্তী তাকে বুঝিয়ে দিল কীভাবে যেতে হবে। ঠিক হল কাজের পরে অর্ক সোজা পাতাল রেল ধরে চলে যাবে।

সারাদিন ধরে অন্য অস্বস্তি। মোবাইলে সেই কলটা এল না। অস্বস্তি বাড়িতেও। অর্ক বুঝতে পারছিল তারা তিনজন এখন প্রায় তিনটে দ্বীপের মতো। অনিমেষ অতিরিক্ত চুপচাপ, বাড়ির বাইরে এখন একদম বের হয় না। মা মুখ বুজে সংসারের কাজ করে যাচ্ছে। অর্কর সঙ্গে কথা বলে দুবেলা খাবার দেওয়ার সময়ে। বাকি সময় বই নিয়ে বসে থাকে। এই পরিস্থিতিতে কুন্তীর ফোন শীতল বাতাসের আরাম দিল অর্ককে।

এখন নির্বাচনী প্রচার বন্ধ। পশ্চিমবঙ্গ যেন সুচের ওপর দাঁড়িয়ে। সমস্ত মিডিয়া বুঝতে পারছে বিশাল পরিবর্তন ঘটতে চলেছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভাবনাটা ভুল হয়ে যেতেও তো পারে। বিরোধী নেত্রী তাঁর শেষ নির্বাচনী সভার পরে বলেছেন, আর পশ্চিমবাংলায় দলতন্ত্রকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না, সত্যিকারের গণতন্ত্রের পথে রাজ্য চলবে। মানুষের জীবন যাতে একটু সুস্থভাবে চলে তার জন্যে তারা আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। তার প্রথম কাজ হবে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে মানুষকে স্বস্তি দেওয়া। চৌত্রিশ বছরের বাম কুশাসনের অবসান হলে তিনি কোনওরকম বদলার রাজনীতি করবেন না।

অর্ক এই প্রতিশ্রুতিতে খুব খুশি হল। কলকাতাকে লন্ডন বা দার্জিলিংকে সুইজারল্যান্ড করা সম্ভব নয় তা যে-কোনও শিশুও জানে। কিন্তু কথাটাকে সাধারণ অর্থে নিলে ভুল হবে। নেত্রী বলতে চেয়েছেন ওই দুই জায়গার মতো উন্নত এবং সুন্দর চেহারা তিনি দিতে চাইবেন। বিরোধীরা সেটা বুঝেও অপব্যাখ্যা করছে। যদিও অর্কর কাজের দফতরের প্রধান ঠাট্টা করেছিলেন, আমি তো দুবার লন্ডনে গিয়েছি। কলকাতাকে যদি লন্ডন করে দেওয়া হয় তা হলে সেটা হবে খুব দুর্ভাগ্যের। কারণ লন্ডনের রাস্তায় নোংরা পড়ে থাকতে দেখেছি, ছেঁড়া কাগজ উড়ছে ফুটপাতে। চারপাশে ঘিঞ্জি এলাকা। ট্রাফালগার স্কোয়ারের চারপাশে প্রায় সবসময় ট্র্যাফিক জ্যাম হয়ে থাকে। একশো বছর আগের লন্ডন আর এখনকার লন্ডনের মধ্যে কোনও মিল নেই। হয়তো ভদ্রলোক ঠিক বলেছেন। কিন্তু অর্কর মনে হচ্ছিল, শহরটা নয়, লন্ডন নামটার যে মাহাত্ম আছে তার কথাই ভেবে বলেছেন নেত্রী। বিশ্বজিত্রাও তাই বলেছিল। এখন ওরা খুব টেনশনে রয়েছে। কথা বলতে এসেছিল বিশ্বজিৎ, অর্কা, যা ভাবছি তা হবে তো? না হলে সুরেন মাইতির দল আমাদের পাড়া ছাড়া করবে।

আমি নিশ্চিত, এবার পরিবর্তন হবেই। অর্ক বলল।

কেন? কেন আপনি এত নিশ্চিত? বিশ্বজিৎ তাকাল।

এই প্রথম এত বড় একটা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যিনি তিনি মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত বা ধনী পরিবার থেকে রাজনীতি করতে আসেননি। তাঁর সাজ পোশাক এমনকী পায়ের চটিও বাংলার সাধারণ গরিব মানুষের অভ্যস্ত জীবনের সঙ্গে জড়িত। এই প্রথম সান অব দ্য সয়েল হাল ধরেছেন আন্দোলনের। কথাটা পালটে ডটার অফ দ্য সয়েল বলাই ঠিক। মানুষ তো চোখ খুলে এটা দেখছে। তাই ঘরের মানুষের সঙ্গেই এবার রাজ্যের মানুষ থাকবে। দেখে নিয়ে। অর্ক বলল।

আপনার কথা যেন ঠিক হয় দাদা। বিশ্বজিৎ খুশি হল।

কুন্তীর বাড়িতে পৌঁছাতে অসুবিধে হল না। দক্ষিণ কলকাতার রাস্তা অর্কর খুব সড়গড় নয় তবু কুন্তীর বর্ণনা শুনে একটুও ঘোরাঘুরি করতে হয়নি। দোতলা বাড়ি, গলির মুখে। দরজার সামনে লোহার খাঁচায় তালা ঝুলছে। হাত গলিয়ে বেলের বোতামে চাপ দেওয়ার কিছুক্ষণ পরে ওপরের ব্যালকনি থেকে বৃদ্ধার গলা ভেসে এল, কে?

দুপা পিছিয়ে অর্ক মুখ তুলে দেখল খাটো চেহারার বেশ ফরসা এবং অতি বয়স্কা মহিলা নীচের দিকে দেখার চেষ্টা করছেন।

সে সামান্য গলা তুলে বলল আমার নাম অর্ক। কুন্তী আছেন?

না। সে বাইরে গেছে। কিছু বলতে হবে? বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন।

আমাকে এই সময় আসতে বলেছিলেন। অর্ক বলল।

দাঁড়াও। ওর মা কলে গিয়েছে, জিজ্ঞাসা করে দেখি। বৃদ্ধা ভেতরে চলে গেলেন। উত্তর কলকাতায়, বিশেষ করে রাজাবাজার-শোভাবাজার অঞ্চলে এই শব্দগুলো এককালে খুব চালু ছিল। বাথরুম মানে কলঘর, লুচি মানে ময়দা, স্নান করতে যাওয়া মানে নাইতে যাওয়া, মাথা না ভিজিয়ে শরীরে জল ঢালা মানে গা ধোওয়া। বাঙালরা, মানে যাদের দেশ পূর্ববঙ্গে ছিল, এই ভাষাভাষীদের ঘটি বলে হাসাহাসি করত। ঘটিরাও বাঙালদের প্রচুর খুঁত ধরত। মায়ের কাছে শুনেছিল অর্ক। গত তিরিশ বছরে এই বিভাজন উধাও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই বৃদ্ধা অবশ্যই ওই ঘটি সম্প্রদায়ের একজন। কিন্তু কুন্তী বাড়িতে নেই আর বৃদ্ধার মেয়ে বাথরুমে, এর অর্থ কী? বৃদ্ধা কি কুন্তীর ঠাকুমা আর যিনি এখন বাথরুমে তিনি মা? কুন্তী কিন্তু ঠাকুমার কথা তাকে বলেনি। বলেছে মা একা থাকেন এই বাড়িতে।

মিনিট তিনেক বাদে মাধবীলতার বয়সি এক মহিলা ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন। দেখলেই বোঝা যায় বেশ গম্ভীর প্রকৃতির মহিলা। বললেন, আপনি অর্ক? কুন্তী বলেছিল যে আপনি আসতে পারেন। জরুরি দরকারে ও একটু বেরিয়েছে এখনই এসে পড়বে।

তা হলে আমি কি পরে আসব? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

বুঝতেই পারছেন আপনাকে আগে দেখিনি তো! বাড়িতে আমরা দুজন মহিলা আছি। আমার মনে হয় মিনিট কুড়ির মধ্যে এসে যাবে। মহিলা বললেন।

অর্ক মাথা নেড়ে বাড়ির সামনে থেকে সরে বড় রাস্তায় চলে এল। না। এতে ক্ষুণ্ণ হওয়ার কোনও কারণ নেই। আগে মানুষ ভদ্রতা সৌজন্যবোধ ইত্যাদিকে এত গুরুত্ব দিত যে নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করত না। কিন্তু প্রতারিত হতে হতে শেষ পর্যন্ত সতর্ক না হয়ে উপায় থাকল না। যে-কোনও লোক নিজেকে অর্ক বলে ওই বাড়ির বেল টিপতে পারত। ওঁরা দরজা খুলে দিলে সর্বনাশ করতে কতটা সময় লাগত? মাধবীলতা মাঝে মাঝে অনিমেষকে যা বলত তা মনে পড়ে গেল অর্করা বলত, নকশাল আন্দোলন করে কার কী লাভ হল জানি না তবে মানুষের মন থেকে অনেকগুলো বোধ খুন করে গিয়েছিল। ভদ্রতাবোধ, সৌজন্যবোধ, পরস্পরকে সম্মান জানানোর মানসিকতা। মানুষ এখন তাই আত্মসর্বস্ব হয়ে গিয়েছে। কথাগুলো কতটা সঠিক অর্ক জানে না। তবে মা যে-কোনও ভাঙনের জন্যে নকশাল আন্দোলনকেই প্রথম দায়ী করে।

মিনিট দশেকের মধ্যেই কুন্তীকে দেখতে পেল অর্ক। একটু দ্রুত হাঁটছে। সে সামনে দাঁড়াল, আস্তে, আস্তে।

ওঃ এসে গেছেন, সরি, খুব দুঃখিত। কতক্ষণ এসেছেন? কুন্তী বিব্রত।

এই তো! অর্ক হাসল।

একটা ওষুধের জন্যে সাতটা দোকান ঘুরতে হল।

কীসের ওষুধ?

প্রেশারের। রোজ যা খেতে হয় তা শেষ হওয়ার পর কেনার কথা কেন যে এঁদের মনে পড়ে! দিদি নাকি প্রায়ই সেটা ভুলে যান। চলুন।

কুন্তীর ব্যাগে চাবি ছিল, তাই দিয়ে প্রথমে খাঁচা পরে দরজার তালা খুলে বলল, চলুন, ওপরে গিয়ে বসি।

অর্ক দেখল নীচেও বসার ঘর রয়েছে। কিন্তু সে কুন্তীকে অনুসরণ করে ওপরে উঠে এল। পরপর তিনটি ঘর, সামনে সুন্দর বারান্দা ব্যালকনি। বারান্দার এক পাশে বসার ব্যবস্থা। কুন্তী বলল, বসুন!

ঠিক তখনই কুন্তীর মা এবং দিদিমা বেরিয়ে এলেন পাশের ঘর থেকে, কুন্তী বলল, এই নাও তোমার ওষুধ। কুড়ি দিন চলে যাবে। পনেরো দিনের মাথায় কেনার কথা বলবে। খুব হাঁটিয়েছ আজ।

বৃদ্ধা ছেলেমানুষের হাসি হাসলেন। এই বয়স তো হাঁটার। দে–।

ওষুধের প্যাকেট দিয়ে কুন্তী পরিচয় করাল।

কুন্তীর মা বললেন, বসো। তোমার বাবার কথা ওঁর মুখে শুনেছি। উনি এখন কেমন আছেন?

একটা পা তো সেই থেকেই জখম। তবে ক্রাচ নিয়ে হাঁটতে পারেন। আপনারাও বসুন। অর্ক বসল।

বসার পরে দিদিমা জিজ্ঞাসা করলেন, বাড়িতে কে কে আছেন?

বাবা মা আর আমি। অর্ক শেষ কবে এই প্রশ্ন শুনেছে মনে পড়ল না। কুন্তীর মা জিজ্ঞাসা করলেন, কী করো তুমি?

আমি একটা ল্যাবরেটরিতে চাকরি করি। অর্ক জবাব দিল।

দিদিমা জিজ্ঞাসা করলেন, বিয়ে থা করেছ নিশ্চয়ই। ছেলেমেয়ে কী?

অর্ক হেসে ফেলল, বিয়ে করা হয়নি।

ওমা! কেন? বৃদ্ধা অবাক।

কোনও মেয়ে আমাকে বিয়ে করেনি। অর্ক মজা করে বলল।

ও তাই তো। দিদিমা হাসলেন, আজকাল শুনি ছেলেরা বিয়ে করে না, মেয়েরাই বিয়ে করে। তা মা-বাবা চাপ দেননি?

কুন্তী কথা বলল, আচ্ছা দিদা, কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে তুমি নাক গলাচ্ছ কেন? কত মানুষ তো বিয়ে করে না। বিধানচন্দ্র রায়, প্রফুল্ল সেন, এঁরা কি বিয়ে করেছেন?

দেশের জন্যে কাজ করতে ওঁদের নাওয়া খাওয়ার সময় ছিল না, বিয়ে করবেন কখন? তবে শুনেছি, বিধানবাবু নাকি কাউকে ভালবাসতেন, তাঁকে না পেয়ে সারাজীবন আইবুড়ো থেকে গিয়েছিলেন। বৃদ্ধা বললেন।

নাও শুরু হল গল্প! কুন্তী মন্তব্য করল।

তুমি কি রাজনীতি করো? কুন্তীর মা জিজ্ঞাসা করলেন।

অর্ক মুখ খোলার আগেই কুন্তী বলল, আগে রাজনীতির ধারে কাছে থাকত না। কিছুদিন আগে একটু সমস্যায় পড়েছিল। এখন সেটাকে কাটিয়ে পরিবর্তনের পথে হাঁটছে।

অর্ক অবাক হল। কিছুদিন আগে, রামজির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সে যেদিকে যাচ্ছিল তার ইঙ্গিত কুন্তী পেল কী করে! সে বলল, পুরোটা ঠিক নয়। আমি এখনও সক্রিয় রাজনীতি করি না। তবে তিন দশকের ওপর বামপন্থীরা যা করতে পারেনি তা যদি তৃণমূল করতে পারে তা হলে তাদের সমর্থন না করার কোনও কারণ দেখি না। পরিবর্তন যদি সামান্য ভাল এনে দেয় তা মানুষেরই লাভ।

দিদিমা বললেন, ঠিক বলেছ বাবা। আমি তো মেয়েটাকে সবসময় দুহাত তুলে আশীর্বাদ করি। ওইটুকু মেয়ে কিন্তু তার কী তেজ!

কুন্তীর মা বললেন, সব ভাল কিন্তু কথায় কথায় অত ইংরেজি বলার কী দরকার? ওই ইংরেজি শিখলে বাচ্চারা তো পরীক্ষায় ফেল করবে! আচ্ছা জাপানি বা চিনেরা শুনেছি মাতৃভাষায় কথা বলে, আমাদের দেশের তামিল তেলেগুভাষী নেতারা নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় ইংরেজি ব্যবহার করে । তা হলে বাঙালির সঙ্গে কথা বলার সময় বাংলা বললে দোষ কী! গরমেন্ট না বলে সরকার বললেই তো হয়।

দিদিমা রেগে গেলেন, তোর স্বভাব হল সবসময় অন্যের খুঁত ধরা। না হয় একটু আধটু ভুল ইংরেজি বলছে কিন্তু কাজটা কী করছে তা দ্যাখ। কার এই কাজ করার হিম্মত আছে?

কুন্তীর মা হেসে ফেললেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমরা কথা বলো। আমি কাজ সারি। মা, তুমি ওষুধ খেয়ে নাও।

ও হ্যাঁ। বসো বাবা। দিদিমা মেয়েকে অনুসরণ করলেন।

অর্ক কুন্তীর দিকে তাকাল, কীসের অফার পেয়েছেন?

বলছি। কুন্তী মাথা নাড়ল, মাস্টারি ছেড়ে বাড়িতেই ছেলেমেয়ে পড়াব ভেবেছিলাম। কিন্তু আমার এক বান্ধবী, ও জামশেদপুরে থাকে, খবরটা দিল। আপনি কমল চক্রবর্তীর নাম শুনেছেন?

না। কে তিনি?

গল্প লেখেন। জামশেদপুর থেকে কৌরব নামে একটি পত্রিকা দীর্ঘকাল ধরে বের করে চলেছেন।

না। আমি নাম শুনিনি। অর্ক মাথা নাড়ল।

বান্ধবীর কাছে শুনেছিলাম কমলবাবু পুরুলিয়ার খুব নির্জন প্রান্তরে একটি স্কুল চালান আদিবাসী ছেলেমেয়েদের নিয়ে। চাকরি ছেড়ে সমমনস্ক কয়েকজনকে নিয়ে প্রচুর স্ট্রাগল করে স্কুলটাকে দাঁড় করিয়েছেন। কুন্তী বলল, ওইরকম নির্জন জায়গা, যার চারপাশে জঙ্গল আর পাহাড়, সেখানে লক্ষ লক্ষ গাছ লাগিয়েছেন ওঁরা।

অর্ক জিজ্ঞাসা করল, ওরকম জায়গায় ছাত্র পাচ্ছেন কী করে?

আমিও তাই জিজ্ঞাসা করেছিলাম। শুনলাম দশ-বারো মাইল দূরের গ্রাম থেকে বাচ্চাদের নিয়ে আসা হয় প্রতিটি ভোরে। স্টেট ব্যাঙ্ক ওঁদের সাহায্য করেছে একটা বাস দিয়ে। বাচ্চাদের খাওয়ানোর পর পড়ানো হয়। কুন্তী বলল, জানেন, ওইসব গ্রামগুলোর বেশির ভাগকেই মাওবাদী গ্রাম বলে। চিহ্নিত করা হয়েছিল।

তা হলে তো বাচ্চারা ওইসব পরিবারের থেকেই আসে?

হয়তো!

ভদ্রলোকের তো খুব সাহস।

হয়তো সেটাই ওঁর ভরসা। কেউ নিজের সন্তানের ক্ষতি করতে চায় না বলেই স্কুলের গায়ে হাত পড়বে না। কুন্তী বলল, আমি বান্ধবীর কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে কমলবাবুর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। উনি বললেন, আপনি স্বাগত। যদি আসেন তা হলে আমাদের শক্তি বাড়বে। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একবার দেখে যান। আমরা আপনাকে শহরের স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারব না। জীবনযাপনের জন্যে যা প্রয়োজন তার কিছুটা অবশ্যই পারব। আর হ্যাঁ, আমাদের কোনও ধর্মাধর্ম নেই। আমরা একমাত্র বৃক্ষের কাছে কৃতজ্ঞ। আমরা তাই সম্বোধন করি জয় বৃক্ষনাথ বলে।

অদ্ভুত তো? অর্ক বলল।

হ্যাঁ সে কারণেই ভাবছি, দেখে আসি। কলকাতা থেকে চার ঘণ্টার পথ। ওখান থেকে দিনে দিনেই জামশেদপুরে বান্ধবীর বাড়িতে চলে যাব।

কলকাতা ছেড়ে চলে যাবেন?

আমি তো বাইরেই ছিলাম। ব্যান্ডেল কি কলকাতা?

তবু তো পা বাড়ালেই চলে আসা যায়।

মাথা নাড়ল কুন্তী, বিশ্বাস করুন, ভাল লাগছে না। মায়ের কথা ভেবে চুপচাপ বসে থাকব এখানে? মা বাধা দিচ্ছে না। বলল, যাতে শান্তি পাবি তাই করবি।

শান্তি খুঁজতে যাচ্ছেন?

ঠাট্টা করবেন না। আপনাকে বন্ধু বলে ভাবতে ইচ্ছে করল, তাই কথাগুলো বললাম। কুন্তী মুখ ফেরাল।

এই সময় ওর মা এসে গেলেন, হাতে ট্রে-তে বসানো চা এবং কেক। কুন্তী উঠে দাঁড়াল মাকে সাহায্য করতে।

.

কুচবিহার থেকে ডায়মন্ডহারবারে নিঃশব্দে ব্যালট বক্সে বিপ্লব হয়ে গেল। তিন দশকের বেশি প্রাসাদটা ভেঙেচুরে পড়ল মাটিতে। আবেগে মানুষ উচ্ছ্বসিত।

পরিবর্তিত জীবনের জন্যে পশ্চিমবঙ্গ একটি নারীর মুখের দিকে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে এখন।

.

৪৮.

হাওয়া বইছিল, সেটা ঝড় হয়ে গেল। সেই ঝড়ে গোটা পশ্চিমবঙ্গ উত্তাল। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি কখনওই যুদ্ধ দেখেনি, যুদ্ধ জয়ের পর বিজয়ী সৈনিকরা কী আচরণ করে থাকে তা তারা বই-এ অথবা সিনেমা দেখে জেনেছে।

চৌত্রিশ বছরের বাম শাসন যা অনেক আশা জাগিয়ে শুরু হয়ে শেষ পর্যন্ত সকালটাকে রাতের চেয়ে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়েছিল তা ধসে পড়ায় মানুষ আনন্দে উৎফুল্ল হল। বিজয়ী সৈন্যরা জয়ের পরমুহূর্তে কিছুটা অসংযমী হয়। এতদিনের নির্যাতন সহ্য করার পর জেলায় জেলায়, গ্রামে গ্রামে জয়ের স্বাদ পাওয়া মানুষেরা মনের সাধ মেটাতে চাইল। কিন্তু দলনেত্রী, যিনি এখন। মুখ্যমন্ত্রী, ঘোষণা করলেন, বদলার রাজনীতিতে আমি বিশ্বাস করি না। দলতন্ত্র নয়, চাই গণতন্ত্র। দলের কর্মীদের সংযত থাকতে আবেদন করলেন তিনি।

অনিমেষ খবরের কাগজ পড়ছিল। ইদানীং কাগজ পড়ার সময় তার অনেক বেড়ে গেছে। মাধবীলতা বিরক্ত হয়ে বলেছিল, তুমি কি বিজ্ঞাপনগুলোও মুখস্থ করো?

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমি বিজ্ঞাপনগুলো পড়ো না?

আমার অত সময় নেই। মাধবীলতা মুখ ঘুরিয়েছিল, দশজন কাগজ পড়লে তার নয়জন বিজ্ঞাপনে চোখ রাখে না।

তা হলে যারা বিজ্ঞাপন দেয় তারা পয়সা খরচ করে কেন?

আশায়। ভাবে যারা কাগজটা কিনছে তারা পড়ে মুগ্ধ হবে। উঃ, আজকাল তোমার সঙ্গে কথা বলাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। যা বলব অমনি তুমি জেরা করতে শুরু করবে। সত্যি তুমি বুড়ো হয়ে গিয়েছ। মাধবীলতা মাথা নাড়ল।

অনিমেষ হাসল, বিজ্ঞাপনগুলো মন দিয়ে পড়লে দেশের সামাজিক, আর্থিক পরিস্থিতি কীভাবে বদলে যাচ্ছে তা জানতে পারতে। আচ্ছা বলো, আজ থেকে কুড়ি-পঁচিশ বছর আগে কেউ কি ভাবতে পারত এই কলকাতার কোনও টেলিফোন নাম্বার ঘোরালে একটা সংস্থার সদস্য হওয়া যাবে যারা পছন্দমতো মহিলার সঙ্গে এক দিনের বন্ধু হওয়ায় সুযোগ করে দেবে অর্থের বিনিময়ে?

কী যা তা বলছ! মাধবীলতা চাপা গলায় বলল।

আজ্ঞে হ্যাঁ। এই যে কাগজের দ্বিতীয় পাতায় যে পত্ৰ-মিতালি শিরোনামে বিজ্ঞাপন ছাপা হয় তা কখনও পড়েছ? আজ এরকম বিজ্ঞাপনের সংখ্যা সাতটা।

না পড়িনি। কারণ ওগুলো তো চিঠি লিখে বন্ধুত্ব তৈরি করা। ভেবেছি যাদের কোনও বন্ধু নেই, একা থাকে, তারাই পত্রমিতালি করে। মাধবীলতা বলল।

চল্লিশ বছর আগে হয়তো তাই হত। এখন, এই দেখো, ভরসা দেওয়া হয়েছে, কোনও ঝুঁকি নেই। প্রতারিত হবেন না। বুঝতেই পারছ।

অনিমেষ বলল, এই বিজ্ঞাপনগুলো ছাপা হচ্ছে তার কারণ যেসব মানুষ রেডলাইট এরিয়ায় যেতে সংকোচ বোধ করে তাদের সাহায্য করতে। খবরের কাগজে এই বিজ্ঞাপন ছাপা হচ্ছে এবং মানুষ যে তা মেনে নিচ্ছে তার কারণ আমাদের সামাজিক জীবন অনেক উদার হয়ে গিয়েছে। রেডলাইট এলাকায়। যে খরচ করতে হয়, এদের ডাকে সাড়া দিলে তার অনেক বেশি টাকা দিতে হবে জেনেও লোকে যাচ্ছে তার কারণ এখন এই ধরনের মানুষের আর্থিক সংগতি অনেক বেড়ে গেছে।

পুলিশ কিছু বলছে না?

পুলিশ? অনিমেষ হেসে ফেলল, আমাকে বরং এক কাপ চা খাওয়াও।

মাধবীলতা একটা বড় শ্বাস ফেলল, শোনো, আমার আর এখানে থাকতে ভাল লাগছে না। তুমি সারাদিন চুপচাপ বসে শুয়ে থাকো, নয়তো কাগজ পড়ো। ছেলে সেই সকালে কাজে বেরিয়ে রাত করে ফেরে। বাধ্য হয়ে সারাদিন আমাকে বোবা হয়ে থাকতে হয়। এইভাবে থাকতে থাকতে একদিন আমরা মরে যাব, ভাল্লাগে না।

অনিমেষ হাসল, আমার কিন্তু ভাল লাগল।

তার মানে? মাধবীলতা ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল।

এতগুলো বছর পরেও আমরা দুজনে একই রকমভাবে ভাবি, এটা জেনে আনন্দ হবে না? কিন্তু কোথায় যাব? এত সস্তায় থাকার জায়গা কোথায় পাব? বলো?

ঠিক। তবু–। মাধবীলতা বলল, এখন মনে হয় জলপাইগুড়ির বাড়িটা বিক্রি না করলে ভাল হত। ওখানে গিয়েও তো আমরা থাকতে পারতাম। এখন

তো বামফ্রন্টের আমল নয় যে পার্টির নোক এসে লাল চোখ দেখাবে।

কে যে পার্টির লোক ছিল তাই এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না।

বোকা বোকা কথা বোলো না। সুরেন মাইতিদের খুঁজে পাবে না?

সুরেন মাইতিদের কোনও উপায় নেই হারিয়ে যাওয়ার। তা ছাড়া ওরা যত ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে ততটা চক্ষুলজ্জাহীন হতে পারেনি। কিন্তু আজ গলির মুখে দাঁড়িয়ে দেখলাম তৃণমূলের যে মিছিল যাচ্ছে তাতে সুরেন মাইতির পেছনে ঘোরা বেশ কয়েকজন স্বচ্ছন্দে পতাকা বইছে। হয়তো ওদের কেউ কেউ এই বাড়ি সুরেনের নির্দেশে ভাঙচুর করে গেছে। যে নৌকো ভাসে তাতে উঠে পড়তে ওরা দেরি করে না। অনিমেষ বলামাত্র মোবাইল বেজে উঠল। মাধবীলতা এগিয়ে গিয়ে টেবিল থেকে যন্ত্রটা তুলে কানে চাপল, হ্যালো। কে বলছেন?

আমি দেবেশ বলছি, জলপাইগুড়ি থেকে। কানে গলা ভেসে এল। মাধবীলতা চাপা গলায় অনিমেষকে জানাল, দেবেশ। তারপর গলা তুলে বলল, বলুন।

ওপাশের কথা শুনতে শুনতে চোখ বড় হয়ে গেল মাধবীলতার। তারপর বলল, আপনি ওর সঙ্গে কথা বলবেন? আচ্ছা, আমি ওকে বলছি।

মোবাইল রেখে দিয়ে অনিমেষের দিকে তাকাল মাধবীলতা, ছোটমাকে জলপাইগুড়ির হাসপাতালে ভরতি করা হয়েছে।

সে কী? সোজা হয়ে বসল অনিমেষ।

দেবেশবাবু বললেন, আচমকা পড়ে গিয়েছিলেন। ডাক্তার বলছে হার্টের অবস্থা খুব খারাপ। আমরা কী করব জানতে চাইছিলেন। মাধবীলতা বলল, শোনো, দেরি না করে আজই রওনা হই।

হ্যাঁ। কিন্তু যাব কী করে? ট্রেনের টিকিট পাওয়া যাবে কি?

ট্রেনে যেতে না পারলে বাসে যাব। আমি অর্ককে ফোন করে বলছি টিকিটের ব্যবস্থা করতে। আমার খুব খারাপ লাগছে। মাধবীলতা ঠোঁট কামড়াল।

অনিমেষ দেখল মাধবীলতা মোবাইল নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। ওখানে দাঁড়িয়ে কথা বললে লাইন ঠিক থাকে। নিশ্চয়ই অর্ককে ফোন করছে মাধবীলতা। ছোটমা এখন হাসপাতালে। হার্টের অবস্থা খুব খারাপ। দেবেশকে ফোন করলে জানা যেত হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে কি না। ঠাকুরদা-বড়পিসিমা বাবার চলে যাওয়ার সময় সে পাশে থাকতে পারেনি। মা মারা যাওয়ার পরে বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে ছোটমাকে মেনে নিতে প্রথম দিকে খুব অসুবিধে হয়েছিল। ক্রমশ সম্পর্কটা আপাত স্বাভাবিক হলেও দুরত্ব থেকে গিয়েছিল। কিন্তু সেই মহিলা সারা জীবন স্বামীর সংসার, শ্বশুরের বাড়ি আগলে গিয়েছেন, বিনিময়ে কিছুই পাননি। শেষপর্যন্ত বাড়ি বিক্রির টাকাগুলো ওঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা হলেও তা ভোগ করার কথা ছোটমা ভাবেননি, চলে গেলে সেই সুযোগও থাকবে না। কিন্তু এটা সত্যি, ছোটমাই তার একমাত্র গুরুজন যিনি এখনও জীবিত। অনিমেষ এও ভাবল, হয়তো দেবেশ বলতে পারেনি, ছোটমা সম্ভবত আর বেঁচে নেই।

মাধবীলতা ফিরে এল, অর্ক বলছে ও সঙ্গে টাকা নিয়ে যায়নি। এটিএম কার্ড বাড়িতে রেখে গেছে। বাড়ি ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে। তারপর স্টেশনে গিয়ে টিকিটের চেষ্টা করতে পারে। তা হলে তো ওর সঙ্গেই স্টেশনে যেতে হবে আমাদের।

গিয়ে যদি টিকিট না পাওয়া যায়? অনিমেষ তাকাল, না, লতা, আমি আজই যেতে চাই। তুমি আমাকে টাকা দাও, আমি বাসের টিকিট কিনে আনছি।

বাসের টিকিট পাওয়া যাবে?

আগে তো যেত। অনিমেষ বলল।

না, থাক। বাসে চেপে সারারাত বসে বসে শিলিগুড়ি, তারপর আবার বাস পালটে জলপাইগুড়িতে যাওয়ার ধকল অনেক। আমরা কেউ আর একুশ বছরের নেই। তার চেয়ে স্টেশনে চলো। রিজার্ভেশন পাওয়া না গেলেও দুটো বসার জায়গা পেলে ট্রেনে অনেক স্বস্তিতে যাওয়া যাবে। মাধবীলতা বলল।

যদি না পাই?

আঃ। এখন কি নর্থ বেঙ্গলে যাওয়ার একটাই ট্রেন? একটা না একটাতে ঠিক পাওয়া যাবে। আমি গুছিয়ে নিচ্ছি। মাধবীলতা পা বাড়ান।

কিছু টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে নাও। অনিমেষ বলল।

সত্যি। হেসে ফেলল মাধবীলতা, তুমি যে এখনও কোথায় পড়ে আছ! সঙ্গে এটিএম কার্ড থাকলে টাকা বয়ে নিয়ে যেতে হয় না তা ভুলে গেলে? মাধবীলতা বেরিয়ে গেল।

অনিমেষ মাথা নাড়ল। আজকাল অনেক কিছু ঠিকঠাক সময়ে মনে আসে না। প্রায়ই কোনও নাম মনে করতে গিয়ে দেখতে পায়, মনে আসছে না। তখন মাথায় যে অস্বস্তি শুরু হয় তার থেকে নিস্তার পাওয়া মুশকিল। কিন্তু এটাও ঠিক যে নিজেই জানে না কোথায় পড়ে আছে। সে কম্পিউটার ব্যবহার করতে জানে না, ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি তার কাছে হিব্রু। সে আজ পর্যন্ত কোনও বড় শপিং মলে যায়নি।

সময় এগিয়ে চলেছে দ্রুত কিন্তু তার সওয়ারি হওয়ার, ইচ্ছে হোক বা ক্ষমতা হোক, তার নেই। ফলে তাকে একা একা থাকতে হচ্ছে। মাধবীলতা তার সর্বসময়ের সঙ্গী কিন্তু তার পরেও তো নিজের একাকিত্ব থেকেই যাচ্ছে। অর্ক তার ছেলে কিন্তু মনে হয় তারা দুজন এমন দুটো দ্বীপ যাদের মধ্যে অনেক যোজন সমুদ্রের ফারাক। এখন মনে হয় সেই ছাত্রকাল থেকে যা সে শিখেছিল, জেনেছিল সব মিথ্যে হয়ে যাবে? ভাবতেই মন মুষড়ে পড়ে। এই যে পশ্চিমবাংলায় যে নির্বাচন হল, মার্কসবাদী কমিউনিস্টদল তার বিপুল সংগঠন থাকা সত্ত্বেও মুখ থুবড়ে পড়ল তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকত না যদি বিজয়ী দল একটি রাজনৈতিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হত। একজন মহিলার বিপুল আবেগ আর আন্তরিকতার জোয়ারে বেশির ভাগ ভোটার ভেসে গেল, কোনও রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের পক্ষে তা বিশ্বাস করা মুশকিল। সব কিছুর একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আছে। শুধু আবেগ বুকে নিয়ে ট্রেনের ইঞ্জিন চালানো যায় না। যদি কেউ সেটা সচল করে ফেলে তা হলে তা অত্যন্ত সাময়িক ব্যাপার হবে, দুর্ঘটনা হতে বাধ্য। ভালবাসার আবেগ বুকে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে একা কতদিন রাজ্যে সুশাসন করা সম্ভব যখন তার চারপাশে অসংখ্য স্বার্থলোভী চাটুকারের ভিড়? এ কথা ঠিক, ভদ্রমহিলা প্রচলিত ধারণাকে নস্যাৎ করে বিপ্লব এনেছেন। থেমে থাকা ট্রেনে গতি এনেছেন। কিন্তু তারপর? এইসব কথা অর্ক জানে না তা হতেই পারে না। অনিমেষের কানে এসেছে, অর্ক সক্রিয়ভাবে না হোক, এই বিজয়ের উল্লাসে শরিক হয়েছে। এটাও অনিমেষের কাছে বিস্ময়। এইসব ভাবনাচিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে দেবেশের ওখানে থাকলে হয়তো শান্তি পাওয়া যাবে। অনিমেষ মাথা নাড়ল। কে জানে? শান্তি কোথায় আছে তা মানুষ কি জানে?

একটু আগে ছুটি চেয়ে নিয়ে অর্ক বাড়ির পথে বাস ধরল। সেই বাসের ভেতর মোবাইল বেজে উঠল। কুন্তী।

কেমন আছেন?

চমৎকার। অর্ক, আপনি ভাবতে পারবেন না আমি এমন জায়গায় এসেছি যা কল্পনার বাইরে ছিল। আশপাশে মানুষের বসতি নেই। লক্ষ লক্ষ গাছের মধ্যে বাচ্চাদের স্কুল। এখানে মাস্টারমশাইরা সকাল বিকেলে রান্না করেন, সবাই সব কাজ করেন, বাচ্চাদের নিয়ে আসা হয় দূর দূর গ্রাম থেকে। ওরা বাস থেকে নেমেই কচি গলায় বলে ওঠে, গুডমর্নিং। কমলবাবু ওদের ফেনাভাত আর আলুসেদ্ধ পেট ভরে খাইয়ে স্কুলের পড়া শুরু করান। বেচারারা এত গরিব যে ওই খাওয়ার লোভেই বোধহয় কামাই করে না। অর্ক, আমি কাল কলকাতায় ফিরে যাচ্ছি। ফিরে যাচ্ছি দীর্ঘদিন এখানে থাকব বলে। কুন্তীর গলায় উচ্ছ্বাস।

জায়গাটার নাম কী?

কী নাম ছিল জানি না। এখন সবাই বলে ভাল পাহাড়। নামটা কমলবাবু রেখেছেন। দারুণ নাম, তাই না?

কীভাবে যেতে হয়?

গালুডি স্টেশনে নেমে কুড়ি কিলোমিটার যেতে হবে। অটো, ট্যাক্সি ছাড়া মাঝে মাঝে বাস পাওয়া যায়। ঘাটশিলা থেকেও যাওয়া যায়। যাক গে, আপনি কেমন আছেন? কুন্তী প্রশ্নটা করামাত্র মোবাইল শব্দহীন হল। লাইন কেটে গেছে। অর্ক চেষ্টা করে শুনল, আউট অফ রেঞ্জ।

দিনটা যেন খুব দ্রুত শেষ হয়ে গেল। ওই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মাধবীলতা যেন দশ হাতে এক মাটি থেকে শেকড় উপড়ে আর এক মাটিতে স্থিতু হওয়ার যাবতীয় প্রস্তুতি করে নিচ্ছিল। বিকেলে কয়েকটা প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনতে গলির মোড়ে এসেছিল অনিমেষ। অর্ক এখনও ফেরেনি। দোকানদার পরিচিত। জিনিসগুলোর নাম শুনে জিজ্ঞাসা করল, কোথাও যাচ্ছেন?

হ্যাঁ। জলপাইগুড়িতে।

ও। ওখানেও নিশ্চয়ই পরিবর্তনের ঢেউ পৌঁছে গেছে। দোকানদার হাসল।

সেটা স্বাভাবিক। জায়গাটা তো পশ্চিমবঙ্গের বাইরে নয়। জিনিসগুলোর দাম মিটিয়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে শুনল একজন খেকুরে চেহারার বৃদ্ধ বলছেন, এটা ঠিক নয়। এত লড়াই করে দিদি পরিবর্তন আনলেন, আর ওরা এসব করছে কী!

দোকানদার বলল, পাবলিকলি ওসব কথা বলব না দাদু।

তা ঠিক। এখন তো মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতে হবে। বৃদ্ধ বললেন।

কী হয়েছে? অনিমেষ দোকানদারের দিকে তাকাল।

কিছু সমাজবিরোধী দুপুরবেলায় সিপিএমের পার্টি অফিসে আগুন দিয়েছিল। পুরোটা পোড়েনি। তৃণমূলের ছেলেরা ধাওয়া করতেই ওরা পালিয়ে গেছে। দোকানদার বলল, এই রকমটাই তো শুনলাম।

সমাজবিরোধীরা পার্টি অফিস পোড়াতে যাবে কেন?

বৃদ্ধ বলল, বন্যা বয়ে যাচ্ছে এখনও। এই পুকুরের মাছ ভেসে ঢুকছে ওই পুকুরে। জল থিতিয়ে যাবে কয়েকদিনের মধ্যে। তখন কোন মাছ কোন পুকুরে ছিল তা আর বোঝা যাবে না।

অনিমেষ আর কথা বাড়াল না।

.

অর্কর উদ্যোগে ব্যবস্থা হল। টিটি অর্ডিনারি থ্রি টায়ারে দুটো শোওয়ার জায়গার ব্যবস্থা করে দিলেন। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নেমে লোকাল ট্রেন ধরে জলপাইগুড়ি শহরে যেতে হবে। মাধবীলতা বলল, এসি-র দরকার নেই। বাসে যাওয়ার চেয়ে এটা ঢের ভাল হল।

রাতের খাবার বাড়িতেই খেয়ে এসেছিল ওরা। অর্ক বিছানা পেতে দিয়ে বলল, যাচ্ছি।

অনিমেষ বলল, শোনো, ছোটমার কী অবস্থা তা জানি না। দেবেশকে কয়েকবার ফোন করেও লাইন পাইনি। ওখানে যাওয়ার পরে জানতে পারব। কিন্তু কবে ফিরতে পারব তা বলতে পারছি না। তুমি তোমার মতো থেকো।

অর্ক চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল। ট্রেন হুইসল দিচ্ছে প্ল্যাটফর্ম ছাড়ার। মাধবীলতা বলল, তোকে তো কিছু বলার নেই, যথেষ্ট বুঝতে পারিস। শুধু একটা কথা, আর যাই করিস যে-কোনও রকম রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়াস না। রাজনীতি মানুষকে হয়তো ক্ষমতা দেয় কিন্তু কখনওই শান্তি দেয় না।

কথাগুলো শুনে অনিমেষ অন্য দিকে তাকাল। সে যখন নকশাল রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল, পেছন ফিরে তাকায়নি। তখন মাধবীলতা কোনও বাধা দেয়নি, বিন্দুমাত্র আপত্তি করেনি। উলটে লালবাজারে পুলিশের অত্যাচার সহ্য করেও তাকে নিষেধ করেছিল মুখ খুলতে। আজ, এতকাল পরে ছেলেকে কি মনের কথাটা জানাল?

.

৪৯.

পশ্চিমবাংলার মন্ত্রিসভায় বেশ কয়েকজন শিক্ষিত গুণীজনেরা আছেন যারা কখনওই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। যেহেতু এইসব মানুষেরা সাধারণের শ্রদ্ধার পাত্র তাই মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাল সবাই। কিছু সংবাদপত্র স্বীকার করল যে দলীয় রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ না থেকে উপযুক্ত মানুষদের হাতে দফতরগুলো দিয়ে ঠিকঠাক কাজ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

সামনে রয়েছে পাঁচ বছর। চৌত্রিশ বছরের কুশাসন সরিয়ে প্রচুর কাজ তারা করবেন, জীবনযাপনে পরিবর্তন আসবে। মানুষ সেই আশায় স্থির। কিন্তু তারা শুনছিল প্রতিদিন মন্ত্রীরা, বিশেষ করে যারা রাজনীতি করে মন্ত্রিত্ব পেয়েছেন তাঁরা মুখ খুললেই বামফ্রন্টকে গালাগাল করছেন। কাজ করার চেয়ে এই গালাগাল দিয়ে যেন অনেক বেশি সুখ পাচ্ছেন। মানুষ দেখছে, স্কুলে, কলেজে, কারখানায় অফিসে রাতারাতি তৃণমূলের সংগঠন তৈরি হয়ে যাচ্ছে এবং যাদের দলে বিতাড়িত কংগ্রেসি এবং ছেড়ে আসা বামফ্রন্টের সমর্থক ভিড় করছেন।

এবং তার পরেই পার্ক স্ট্রিটের ধর্ষণের ঘটনা ঘটে গেল। কোনও খবর না নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন, ওটা স্রেফ সাজানো ঘটনা। তাঁর সরকারকে হেয় করার জন্য সাজানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী যা বললেন তার ওপর রং চড়িয়ে পুলিশ কমিশনার অপপ্রচারের জন্যে সংবাদ মাধ্যমকে দায়ী করলেন। কিন্তু তারই অধস্তন একজন মহিলা পুলিশ অফিসার যখন অভিযুক্তদের বেশির ভাগকে গ্রেফতার করে বললেন, সত্যি ধর্ষণ হয়েছিল, তখন মানুষের মন থমকে দাঁড়াল। তারা দেখল সেই মহিলাকে সত্যি বলার অপরাধে সরিয়ে দেওয়া হল এমন দফতরে যেখানে তার কোনও জনসংযোগ থাকবে না।

ক্রমশ জটিল হয়ে যাচ্ছে সব কিছু। মুখ্যমন্ত্রীর অসম্ভব জনপ্রিয়তায় সামান্য ছাপ লাগলেও তার প্রতি রাজ্যের মানুষের আস্থা এখনও প্রবল। যে মানুষ ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্যে রাজনীতি করেন না, দেশের মানুষের জন্যে যাঁর জীবন উৎসর্গিত তার পাশে জনসাধারণ থাকবেই।

কিন্তু মহাভারতের মুষল পর্ব শুরু হয়ে গেলে একা শ্রীকৃষ্ণ যা পারেননি তা কি মুখ্যমন্ত্রী পারবেন? স্টেশন থেকে বাইরে বের হওয়ামাত্র অর্কর মোবাইল জানান দিল। সুইচ অন করে হ্যালো বলতেই কানে এল, দাদা, আমি রামজি বলছি।

অর্ক কথা বলল, হ্যাঁ, বলুন রামজি!

রামজির গলা কানে এল, আপনি কি এখন কলকাতায়?

হ্যাঁ।

দাদা, আমি এখন জলপাইগুড়িতে।

সে কী! ওখানে কী করছেন আপনি?

আমার অবস্থা খুব খারাপ। কলকাতায় থাকতে পারলাম না। আপনার বাবা যদি জলপাইগুড়িতে থাকার ব্যবস্থা না করে দিতেন তা হলে– কথা শেষ করল না রামজি।

আমার বাবা আপনার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন?

হ্যাঁ, কিন্তু দাদা, আমার হাত একদম খালি। এই মোবাইলে পঞ্চাশ টাকা ভরেছিলাম, সেটাও শেষ হয়ে আসছে। আমাকে এক হাজার টাকা পাঠাতে পারবেন? আমি কথা দিচ্ছি, মাস তিনেকের মধ্যে শোধ করে দিতে পারব। করুণ গলায় বলল রামজি।

না শব্দটা মুখে চলে এসেছিল কিন্তু সামলে নিল অর্ক। বলল, আপনি জলপাইগুড়ির কোথায় আছেন, কীভাবে টাকা পাঠাব তা জানি না। পাঠালে কতদিনে পাবেন তারও ঠিক নেই। আপনার সঙ্গে তো বাবার পরিচয় হয়েছে, তিনি আপনাকে সাহায্যও করেছেন। এক কাজ করুন, উনি এখন জলপাইগুড়িতে। ওঁর সঙ্গে দেখা করে টাকাটা চান। যদি উনি বলেন তা হলে টাকাটা আমি ওঁকে পাঠিয়ে দেব পরে। অর্ক কথাগুলো বলে খুশি হল।

আপনার বাবা এখন জলপাইগুড়িতে? এখানে যে আসবেন তা আমায় বলেননি তো। কোথায় উঠেছেন? রামজি বেশ অবাক হয়ে গেল।

অর্ক ওকে দেবেশবাবুর আশ্রমের ঠিকানা বুঝিয়ে বলল, হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ করুন। ওখানে আমার ঠাকুমা অসুস্থ হয়ে ভরতি আছেন।

অনেক অনেক ধন্যবাদ দাদা। রামজি যেন স্বস্তি পেল।

একটা কথা রামজি, আপনাকে আমি কখনও জিজ্ঞাসা করিনি, কেন আপনাকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে? আপনি কি একজন মাওবাদী?

দাদা, আপনি তো জানবেন। তবু জিজ্ঞাসা করছেন?

অনুমান করেছিলাম। আপনার ব্যবহার ভাল লেগেছিল বলে কিছুটা সাহায্য করেছিলাম। কিন্তু রামজি, এসব করে কী লাভ? এতবড় ভারতবর্ষকে কয়েক হাজার মাওবাদী কোনও অস্ত্র দিয়ে বদলে দিতে পারে? মানুষ খুন করে কি অসম থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত বিপ্লব আনা সম্ভব? আপনারা যেটা করছেন সেটা স্রেফ আত্মহত্যা। এখনও সময় আছে, পথটা ছেড়ে দিন। অর্ক বলল।

কীভাবে?

পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করুন। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন করে মূল স্রোতে ফিরে আসুন।

আপনাদের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন পশ্চিমবাংলায় মাওবাদী নেই। তা হলে আবেদন করলে কান দেবেন কেন? পুলিশ আমাকে বিনা বিচারে জেলে ফেলে রাখবে। আপনি– লাইন কেটে গেল। অর্কর মনে হল রামজির মোবাইলে যে পঞ্চাশ টাকা ভরা হয়েছিল তা শেষ হয়ে গিয়েছে।

নির্বাচনে প্রার্থী ঘোষণার সময় তৃণমূল নেত্রীর সিদ্ধান্তে অবাক হয়েছিল সাধারণ মানুষ, সাংবাদিকরাও। যাঁরা কখনও রাজনীতি করেননি, নিজের নিজের ক্ষেত্রে যাঁরা অত্যন্ত কৃতী, তেমন কয়েকজনকে তিনি বিধায়কপদে দাঁড় করিয়েছিলেন। কিন্তু মানুষ বুঝতে পেরেছিল পশ্চিমবাংলায় সবগুলো বিধায়কের আসনে তৃণমূল কংগ্রেস জোট বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে নির্বাচনী লড়াই করছে না, লড়াইটা হচ্ছে তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে বিরোধীদের। অবশ্যম্ভাবী ফল হল, মানুষ তৃণমূল নেত্রীকে ভোট দিয়ে তার প্রার্থীদের জিতিয়ে দিলেন। যাঁরা চার মাস আগেও কোনও রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না, তারা রাজভবনের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছায় মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন। এই ঘটনা মানুষকে খুশি করল। অর্থনীতিবিদ, একজন জাঁদরেল আই এ এস অফিসার, একজন নাট্যব্যক্তিত্ব পশ্চিমবাংলার গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পেলেন।

অর্ক ভাবছিল, এই ব্যাপারটা বাবা কীভাবে নেবে? পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে এইরকম ঘটনা এর আগে ঘটেছে কি না তার জানা নেই। প্রচলিত রাজনৈতিক শিক্ষায় যাঁরা শিক্ষিত তারা ব্যাপারটাকে মেনে নিতে পারবেন না। অনিমেষ নিশ্চয় বলত, এইসব মানুষ নিজের কাজের জায়গায় কৃতী হতে পারেন কিন্তু তাদের তো কোনও রাজনৈতিক ভিত নেই। শুধু মন্ত্রিত্ব রক্ষার জন্য দলের প্রতি অনুগত হয়ে কতদিন থাকতে পারবেন তাতে সন্দেহ রয়েছে। অর্ক মনে মনে মাথা নাড়ে, ভবিষ্যৎই শেষ কথা বলবে।

ছোটমা এখনও আইসিইউ-তে। সারাদিনের পরে বিকেলে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেল ওরা। ডাক্তার বললেন, ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। ঠিক সময়ে নিয়ে আসা হয়েছিল বলে আমরা চেষ্টা করতে পারছি। কিন্তু পরিষ্কার বলছি, ওষুধে খুব একটা কাজ হচ্ছে না।

দূর থেকে দেখল ওরা ছোটমাকে। বিছানায় শরীর যেন মিশে গেছে। নাকে নল হাতে নল লাগিয়ে চিত হয়ে রয়েছেন।

এই সময় দেবেশ এল। ওদের দেখে খুশি হল সে, যাক, তোরা এসে গেছিস। কখন এলি? আমাকে ফোন করিসনি কেন?

ফোন করেছিলাম। তোর ফোন বন্ধ ছিল। বেলা বারোটায় পৌঁছেছি, ট্রেন লেট ছিল। অনিমেষ বলল, ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললাম, ভরসা পেলাম না।

হ্যাঁ। সকালে এসে শুনেছিলাম বাহাত্তর ঘণ্টা কাটবে না। খুব খারাপ লাগছে রে। দেবেশ বলল, এদিকে আমি খুব সমস্যায় পড়েছি।

কী?

চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে দেবেশ বলল, বলছি। তোরা কি কোনও হোটেলে উঠেছিস?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, রুবি বোর্ডিং-এ।

বিরক্ত হল দেবেশ, ওঃ আশ্রমে না উঠে হোটেলে গেলি কেন? মিছিমিছি পয়সা নষ্ট করার কী দরকার ছিল?

মাধবীলতা হাসল, আপনার মোবাইল বন্ধ দেখে বুঝতে পারছিলাম না আপনি আশ্রমে আছেন কি না। তা ছাড়া সারারাত প্রায় না ঘুমিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। স্নান খাওয়ার দরকার ছিল। আর এটাও তো ঠিক, আশ্রম থেকে হাসপাতালে আসা যাওয়াটা তো একেবারে সহজ ব্যাপার হবে না। আপনি বাইকে আসছেন বলে বোধহয় টের পান না।

কয়েকটা ওষুধ কিনে দিতে বললেন নার্স। দেবেশই সেটা কিনে দেওয়ার পর ওদের সঙ্গে হোটেলে চলে এল। এখন জলপাইগুড়িতে সন্ধে নামছে, হোটেলের সামনের রাস্তা দিয়ে যেন রিকশার মিছিল চলছে। তাদের হর্নের আওয়াজে কানে তালা লাগার জোগাড়। অনিমেষ বলল, একসময় এই রাস্তাটা শুনশান ছিল।

দেবেশ হেসে বলল, তখন কটা মানুষ রিকশায় চড়ত? চা খাব।

মাধবীলতাই চায়ের অর্ডার দিল বেল বাজিয়ে, হোটেলের কর্মচারীকে ডেকে। অনিমেষ বিছানায় আরাম করে বসে বলল, কী সমস্যার কথা বলছিলি?

দেবেশ ম্লান হাসল, রাজা বদলে গেলেও রাজপুরুষরা বদলাল না।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, রাজপুরুষ মানে?

পার্টির নেতা, উপনেতারাই তো রাজপুরুষ। এখানকার একজন তৃণমূল নেতার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে এতদিন যারা কংগ্রেস করত অথবা সিপিএমের কর্মী বলে যারা পরিচিত ছিল এমন সব লোক। দ্যাখ, শহর থেকে দূরে অনেক কষ্টে আশ্রম বানিয়েছিলাম যাতে বয়স্ক মানুষেরা একটু স্বস্তিতে থাকতে পারেন। বামফ্রন্টের আমলে চাপ আসত একে জায়গা দিন ওকে জায়গা দিন। সেই চাপ কেটে যেত যখন ওপরতলার নেতাদের জানাতাম। সব সময় যে নেতারা সহযোগিতা করতেন এমন নয়, তবু চক্ষুলজ্জা বলে একটা ব্যাপার ছিল। এখন সেইটেও গেছে। দেবেশ বলল।

ঠিক কী হয়েছে বল তো? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

কয়েকদিন আগে তৃণমূলের তিনজন এসে বলল তারা চারজন বৃদ্ধকে আমার আশ্রমে ভরতি করতে চায় কিন্তু তার জন্যে কোনও টাকাপয়সা দিতে পারবে না। আমি বললাম, তা হলে আমি খরচ চালাব কী করে? কী বলল জানিস? বলল, এতদিন অনেক মুনাফা করেছেন, বামফ্রন্টের চামচে ছিলেন, এখন সেই টাকায় এদের উপকার করুন। আমি রাজি না হওয়ায় গালমন্দ করে চলে গেল। তার দুদিন পরেই একজন আঞ্চলিক নেতা কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে চেপে এলেন। বললেন, এটা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাবসা নয়। এখানে যারা আছে তারা জনগণের অংশ। আপনি মা-মাটি-মানুষকে নিয়ে ব্যাবসা করতে পারেন না।

আমি অনেক বোঝাতে চাইলাম। নেতা কোনও কথা না শুনে বললেন, আপনাকে পনেরো দিন সময় দিচ্ছি। আপনার এখানে যারা থাকেন তারা প্রথমে যত টাকা দিয়েছেন, প্রতি মাসে কত টাকা দেন তার হিসেব রেডি করুন। তার সঙ্গে তরি-তরকারি, মাছ, মুরগি বিক্রি করে কী আয় হয় সেটা তৈরি করে আমাদের দেবেন। ওটা অডিট করা হবে।

আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এসব চাইবার অধিকার কি আপনাদের আছে? উত্তর হল, পনেরো দিনের মধ্যে যদি হিসেব না দেন তা হলে আপনার প্রশ্নের জবাব পাবেন।

কথাগুলো বলে দেবেশ চোখ বন্ধ করল।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, পনেরো দিন শেষ হতে আর কত দিন বাকি আছে?

দিন এগারো।

ব্যাপারটা ওপরতলার নেতাদের জানিয়েছেন? মাধবীলতা শ্বাস ফেলল।

কাকে জানাব? রাতারাতি কংগ্রেসিরা তৃণমূল হয়ে গিয়েছে, একসঙ্গে নির্বাচন লড়াই করে মন্ত্রীসভায় অংশ নিয়েও কংগ্রেস দল দূরে সরে দাঁড়িয়েছে। আর তাদের দল থেকে কিছু স্বার্থান্বেষী ঢুকে পড়েছে তৃণমূলে। এদের সঙ্গে কথা বলতে যাওয়াও বিপদ। স্বার্থ ছাড়া কেউ হাত বাড়াবে না। দেবেশের কথার মধ্যেই চা এল।

পুলিশকে বলেছিস?

পাগল!

পুলিশ তোর কথা শুনবে না?

কানেই নেবে না। সিপিএম চৌত্রিশ বছরে যা যা করেছে, পুলিশকে যেভাবে মেরুদণ্ডহীন করে রেখেছিল এরা এই কয়দিনেই সেটা রপ্ত করে ফেলেছে। দেবেশ বলল।

মাধবীলতা মাথা নাড়ল, না দেবেশবাবু। জলপাইগুড়ির বাড়ি নিয়ে সিপিএমের কর্মীরা যখন আমাদের ওপর হুমকি দিচ্ছিল তখন একজন আইপিএস অফিসার তাদের শায়েস্তা করেছিলেন। সব পুলিশই মেরুদণ্ডহীন নয়। ব্যতিক্রমী পুলিশও আছেন। আচ্ছা, আশ্রমের মানুষজন নিশ্চয়ই এসব কথা শুনেছেন। তারা কী বলছেন?

তারা আশঙ্কিত। আশ্রম বন্ধ হয়ে গেলে সবাই বিপদে পড়বেন। ওঁরা আমার পাশে আছেন বলে এখনও মনে জোর পাচ্ছি। চা শেষ করে দেবেশ বলল, এবার অন্য কথা বলি। মাসিমার অবস্থা তো আর আশাজনক নয়। উনি চলে গেলে যে সমস্যা হবে তার কী সমাধান হবে ভেবে দ্যাখ অনিমেষ।

কী সমস্যা?

ব্যাঙ্কের টাকা না হয় জয়েন্ট নামে রয়েছে। কিন্তু আশ্রমের জন্য গতমাসে উনি কুড়ি হাজার টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে দিয়েছিলেন। কয়েকজনকে চিকিৎসার জন্যে শিলিগুড়ির হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল। একজনের গলব্লাডার থেকে পাথর বের করতে হয়েছিল। যাঁদের জন্যে ওই খরচ করতে হয়েছিল তাদের মাসিক টাকা দেওয়ার পর আর কিছু দেওয়ার মতো সংগতি নেই। মাসিমা যেচে ওই টাকা দিয়েছিলেন। আমি ভেবেছিলাম একটু একটু করে টাকাটা ওঁকে ফিরিয়ে দেব। আজ ওঁর যদি কিছু হয়ে যায় তা হলে তোরা আমাকে সময় দিবি? চোখ তুলে তাকাল দেবেশ।

অনিমেষ আচমকা হেসে উঠল, আমরা সময় দেওয়ার কে? যিনি দিয়েছেন তাকেই ফিরিয়ে দিবি, যদি পারিস।

ঠিক তখনই দেবেশের ফোন বেজে উঠল। সেটা অন করে কানে চেপে সে জানান দিল। ওপারের কথা শোনার পর সে বলল, আমি আসছি।

ফোন বন্ধ করে মাথা নিচু করে সে বসে থাকল কয়েক সেকেন্ড।

মাধবীলতার গলা কেঁপে গেল, কোনও খারাপ খবর?

মাথা নাড়ল দেবেশ, মাসিমা চলে গিয়েছেন।

মিনিটখানেক কথা বলল না কেউ।

দেবেশ উঠে দাঁড়াল, এই রাতে কিছু করার নেই। যা হবে তা কাল সকালেই করতে হবে। আমার একটাই সান্ত্বনা, তোরা এসে গেছিস।

আচমকা শরীর কেঁপে উঠল অনিমেষের। সমস্ত শরীর যেন কোনও প্রতিরোধ মানছিল না। গলা দিয়ে আহত শব্দ বেরিয়ে এল, দুচোখ বেয়ে জল। মাধবীলতা তার কাঁধে হাত রাখল।

দেবেশ নিচু গলায় বলল, আমি হাসপাতাল হয়ে আশ্রমে যাচ্ছি। সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। খবর পেয়ে ভেঙে পড়বে। কিছু তো করার নেই। তোরা সকাল আটটার মধ্যে হাসপাতালে চলে যাস। দেবেশ বেরিয়ে গেল।

মাধবীলতা বেশ অবাক হল। ছোটমা সম্পর্কে অনিমেষের কোনও আবেগ, কোনও দুর্বলতা ছিল বলে সে জানত না। অনিমেষ তার ছেলেবেলার গল্প করার সময় বলেছে যে সে তার বাবার দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীকে কখনও মন থেকে মেনে নিতে পারেনি। এই না পারাটা তার পরবর্তীকালের আচরণেও দেখতে পেয়েছে মাধবীলতা। বাবা, বড় পিসিমা গত হওয়ার পরেও বোধহয় সেই কারণে অনিমেষ জলপাইগুড়িতে এসে ছোটমার কাছে কিছুদিন থাকতে চায়নি। তাই আজ তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে অনিমেষের এভাবে ভেঙে পড়া মাধবীলতাকে অবাক করেছিল। সে বলল, শান্ত হও। এরকম করছ কেন?

জানি না। হঠাৎ মনে হল সব কিছু শেষ হয়ে গেল। কান্না চাপল অনিমেষ।

সব কিছু শেষ হয়ে গেল? মাধবীলতা অনিমেষের হাত ধরল।

মা, দাদু, বড় পিসিমা, বাবা চলে গিয়েছেন অনেক আগে। আজ মনে হচ্ছে এতদিন তো ছোটমা ছিলেন যিনি বাবা, দাদু, বড় পিসিমাকে চিনতেন, তাদের সঙ্গে সংসার করেছেন। সেই তার চলে যাওয়া মানে অতীতের সঙ্গে আমার সমস্ত যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে যাওয়া। বড় শ্বাস ফেলল অনিমেষ, যাঁকে কখনওই মন থেকে গ্রহণ করতে পারিনি তার চলে যাওয়ার সময় এলাম। সেই ছোটবেলায় আমার নিজের মায়ের মুখাগ্নি করেছিলাম। তারপর তিন তিনজন যখন চলে গেলেন আমি তখন কলকাতায়। শেষযাত্রায় পৌঁছোতে পারিনি। সেই দায় মেটাতেই বোধহয় এবার এলাম আমার দ্বিতীয় মায়ের মুখাগ্নি করতে।

মাধবীলতা বলল, এসব ভেবো না। জীবন যা করতে বলে মানুষকে তাই করতে হয়। মানুষ জীবনকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে কিন্তু শাসন করতে পারে না। তুমি একটু বিশ্রাম নাও। রাত্রে খেতে ইচ্ছে না করলে খেয়ো না।

রুবি বোর্ডিং থেকে সকাল পৌনে আটটায় বেরিয়ে ওরা যখন রিকশায় উঠল তখন মাধবীলতার ফোন বেজে উঠল। মাধবীলতা সাড়া দিতেই অর্ক বলল, কী ব্যাপার? ওখানে গিয়ে তোমরা কোনও খবর দাওনি। আমি যতবার ডায়াল করেছি ততবার শুনেছি আউট অব রেঞ্জ। শোনো, বাবা কোথায়? ফোনটা দাও, বাবাকে একটা জরুরি কথা বলার আছে।

কী কথা?

তুমি শুনলে রেগে যাবে। বাবাকেই বলব।

শোনো আমাদের মন খুব খারাপ। হাসপাতালে যাচ্ছি। তোমার ছোটঠাকুমা। কাল সন্ধেবেলায় চলে গেছেন। মাধবীলতা গম্ভীর গলায় বলল।

সে কী!

এখন রাখছি।

শোনো অশৌচ-টশৌচ কি মানতে হবে?

মাধবীলতা জবাব না দিয়ে লাইন কেটে দিল। অনিমেষ পাশে বসে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে? কী বলছে সে?

কিছু না। মাধবীলতা কথা বাড়াল ।

ওরা হাসপাতালে পৌঁছে দেখল দেবেশ এসে গেছে। সে একা নয়, সঙ্গে আরও দুজন বৃদ্ধ আশ্রমবাসী রয়েছেন। তারা এগিয়ে এসে অনিমেষকে বললেন, আমরা ভাবতে পারছি না। কাল রাত্রে কেউ ঘুমাতে পারিনি। উঃ। দ্বিতীয়জন বললেন, আমাদের সবাইকে মায়ায় জড়িয়ে ছিলেন।

সমস্ত ব্যবস্থা হওয়ার পরে দেবেশ জিজ্ঞাসা করল, দাহ করার জায়গার ব্যাপারে তোর কি কোনও বিশেষ সেন্টিমেন্ট আছে?

মানে? অনিমেষ তাকাল।

তোর দাদু, বাবা, বড় পিসিমাকে কি মাসকলাইবাড়ির শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল?

সম্ভবত। আমি তখন ছিলাম না। জলপাইগুড়িতে কি তখন আর কোনও শ্মশান ছিল?

না। দেবেশ মাথা নাড়ল।

তা হলে ওখানেই–। তুই জিজ্ঞাসা করছিস কেন? অনিমেষ প্রশ্ন করল।

এখন পর্যন্ত আমাদের আশ্রম থেকে কেউ চলে যাননি, আমরা ভেবেছি যদি কেউ আপত্তি না করে তা হলে চলে যাওয়া মানুষের সৎকার আশ্রমের পাশেই করব। যেখানে তিনি ছিলেন সেখানকার মাটিতেই যেন তিনি মিশে থাকেন। দেবেশ কথাগুলো বলতেই দুই বৃদ্ধ মাথা নেড়ে সমর্থন করল।

অনিমেষ বলল, এর চেয়ে ভাল ব্যবস্থা আর কী হতে পারে?

দেবেশ অনিমেষের হাত ধরল, আশ্রমের সমস্ত বয়স্ক-বয়স্কারা অপেক্ষায় রয়েছেন। মাসকলাইবাড়িতে গেলে ওঁদের পক্ষে আসা সম্ভব হত না। অনেক ধন্যবাদ তোকে।

.

একটা ম্যাটাডোরে খাঁটিয়ায় শুইয়ে ছোটমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল জলপাইগুড়ি শহরের বাইরে, আশ্রমে। দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয় বলে অনিমেষ আর একজন বৃদ্ধের সঙ্গে ড্রাইভারের পাশে বসল। মাধবীলতা ছোটমার মাথার কাছে ম্যাটাডোরের ওপরেই বসে তার মাথায় হাত বোলাচ্ছিল। দেবেশ এবং আর এক বৃদ্ধ দুপাশে দাঁড়িয়ে। ম্যাটাডোর ছুটে যাচ্ছিল রাজবাড়ি ছাড়িয়ে। অনিমেষের মনে হচ্ছিল এইসব রাস্তা, রাজবাড়ির গেট, ডানদিকের দিঘি যা সে আবাল্য দেখে এসেছে, যার ছবি আমৃত্যু মনে থাকবে তা আজ চিরদিনের জন্যে পেছনে ফেলে চলে যাচ্ছে। আর কখনও জলপাইগুড়িতে ফেরার জন্যে কোনও পিছুটান রইল না। বুকে ভার জমছিল তার।

.

মহিলাদের কান্নাকাটির পর্ব শেষ হলে ছোটমাকে নিয়ে যাওয়া হল পুকুরের প্রান্তে, সেখানে ইতিমধ্যে আবাসিকরা চিতা সাজিয়ে রেখেছিলেন। দেবেশ বলল, তুই যদি এখানে নিয়ে আসার অনুমতি না দিতিস তা হলে সবাই খুব কষ্ট পেত।

মাধবীলতা দেখল সমস্ত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা লাইন করে দাঁড়িয়ে আছেন। সবচেয়ে যিনি বৃদ্ধা তিনি হাত জোড় করে কিছু স্তোত্ৰজাতীয় লাইন সুরে গাইছেন। সে কাছে গিয়ে কান পেতে চমকে উঠল। বৃদ্ধা যে রবীন্দ্রনাথের গান গাইছেন। কোনও হরিধ্বনি ভয়ংকর শব্দে আকাশ চৌচির করছে না।

দেবেশ সাহায্য করল। মুখাগ্নি করল অনিমেষ। জীবনের প্রান্তে এসে এই প্রথম সে তার অতীতকে অগ্নিশুদ্ধ করল। দাউদাউ আগুন যখন আকাশ ছুঁতে যাচ্ছে তখন অনিমেষের চোখে পড়ল কেউ একজন এগিয়ে আসছে। সেই লাল আগুনের দেওয়াল ভেদ করে উসকো খুসকো চেহারার মানুষটাকে দেখতে পেল সে। রামজি এসে হাত জোড় করে তাকিয়ে আছে জ্বলন্ত চিতার দিকে। রামজি এখানে কী করে এল?

.

৫০.

ছোটমায়ের শরীর চিতার পোড়া কাঠের সঙ্গে মিশে যাওয়ার পর যা করণীয় তা বয়স্কদের নির্দেশ মেনে পালন করল অনিমেষ। মহিলাদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে মাধবীলতা আজ অন্য অনিমেষকে দেখল। অস্থি বিসর্জনের পরে অনিমেষ দেবেশকে বলল, আমাকে একটা সাদা থান এনে দে।

দেবেশ অবাক হল। সে কী! তুই কাছা নিবি?

না। গলায় কাছা নেব না। কিন্তু এই পাজামা পাঞ্জাবি ছেড়ে থাকব কয়েকটা দিন। আশ্রমে না থাকলে বাজার থেকে আনিয়ে দে, মাধবীলতাকে বলছি টাকা দিতে। আমি ততক্ষণ এখানেই অপেক্ষা করছি। অনিমেষ চিতার দিকে তাকিয়ে বলল।

দেবেশ বলল, আমি ভেবেছিলাম এসব রিচ্যুয়াল মানবি না, শ্রাদ্ধ করবি না।

অনিমেষ বলল, তুই ঠিকই ভেবেছিস দেবেশ। ব্যক্তিগতভাবে আমি এগুলো কখনও মানিনি, মূল্যহীন একটা সংস্কার বলে মনে করি। যিনি চলে গেলেন তার প্রতি শ্রদ্ধা না রেখে যারা এইসব ধড়াচুড়ো পরে শ্রাদ্ধ করে, লোক খাওয়ায় তারা আত্মপ্রচার করে। তুই ঠিকই ভেবেছিস।

মাধবীলতা এবং কয়েকজন পাশে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনছিল। মাধবীলতা বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, তা হলে তুমি থান পরতে চাইছ কেন?

অনিমেষ বলল এই মহিলা সারাজীবন ঠাকুরঘরে থেকে গেছেন নিজের কষ্ট ভোলার জন্যে। দেবদেবীর পুজো করে নিজের কষ্ট ভুলতে চেয়েছিলেন। আমরা যখন ওঁর কাছে এসে কিছুদিন ছিলাম তখন তো দেখেছ সারাদিনের বেশিরভাগ সময় ওঁর ঠাকুরঘরেই কেটে যেত। জীবনভর তিনি তাঁর মতো করে বেঁচেছিলেন। আমি একমত না হলেও যখন মুখাগ্নি করেছি তখন তাকে শ্রদ্ধা জানাতে এই কয়েকদিন তার শান্তির জন্যে নিজের মতামত সরিয়ে রাখছি।

মাধবীলতা নিচু গলায় বলল, আমি আজও ঠিক বুঝতে পারলাম না।

অনিমেষকে একটা মোড়া এনে দেওয়া হল পুকুরের ধারে বসার জন্যে। ভিড়টা সরে গেল আশ্রমের দিকে। অনিমেষ মাধবীলতাকে বলল, ওই যে ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে, ওকে ডেকে দাও।

মাধবীলতা দেখতে পেল, জিজ্ঞাসা করল, ও কে?

ওর নাম রামজি। তোমার ছেলে কলকাতার বাড়িতে থাকতে দিয়েছিল।

আশ্চর্য! ও এখানে কী করে এল? মাধবীলতা বিরক্ত হল।

ওর সঙ্গে কথা না বললে জানা যাবে না। অনিমেষ বলল।

মাধবীলতা রামজির কাছে গিয়ে কথা বলে আর পঁড়াল না। দূরে বৃদ্ধারা যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, সেখানে চলে গেল।

কাছে এসে রামজি হাতজোড় করল, আমাকে মাপ করুন।

আমি এখানে এসেছি তা কি অর্কর কাছে জেনেছ? অনিমেষ তাকাল।

হ্যাঁ চাচা। বিপদে পড়ে ওঁকে ফোন করেছিলাম। ওর কাছে শুনলাম। আমার মোবাইলের টাকা শেষ হয়ে গেছে। তাই ওর কাছ থেকে আপনার নাম্বার নিয়ে ফোন করতে পারিনি।

তুমি এখানে কোথায় উঠেছ?

আপনি যে চা-বাগানে যেতে বলেছিলেন সেখানে গিয়ে শুনলাম যাঁর কাছে আপনি পাঠিয়েছিলেন তিনি দুবছর আগে মারা গিয়েছেন। ওঁর বউ ছেলে আমাকে দুদিন থাকতে দিয়েছিল। কিন্তু ওরা খুব গরিব মানুষ। ওখানে কাজ পেতে গেলে অন্তত এক মাস থাকতে হত যা ওদের ওপর অত্যাচার হয়ে যেত। সঙ্গে যা টাকা ছিল তা ওদের দেওয়ার পরে আমার হাতে আর কিছু নেই। রামজি বলল।

ওরা কি টাকা চেয়েছিল?

না চাচা। অবস্থা দেখে না দিয়ে পারিনি।

অনিমেষ মাথা নাড়ল, বহু বছর যোগাযোগ নেই। সব পালটে গেল। এখানে কীভাবে এলে?

হাসপাতালে গিয়েছিলাম। ওখানেই খবর পেলাম, আশ্রমের কথা শুনলাম। ওখান থেকে হেঁটেই চলে এসেছি। রামজি বলল।

এখন কী করবে?

চাচা, আপনি যদি আমাকে কিছু টাকা দেন তা হলে দেশে চলে যেত পারি। আমি আর পারছি না। রামজি শ্বাস ফেলল।

কিন্তু তুমি বলেছিল সেখানে পুলিশ তোমাকে খুঁজছে।

হ্যাঁ। ফাঁসি তো দেবে না, দু-তিন বছরের জেল হতে পারে। জেলেই যদি থাকতে হয় দেশের জেলেই থাকব। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি টাকাটা গিয়েই শোধ করে দেব।

অনিমেষ হাসল, তা হলে তোমার বিপ্লব শেষ হয়ে গেল!

রামজি বলল, চাচা, এই বাংলায় কখনও বিপ্লব হবে না।

বড় দেরি হয়নি কথাটা বুঝতে। আমরা অনেক হারিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম।

আপনাদের সময়ে কী ছিল জানি না। এখন মানুষের মন থেকে জোর চলে যাচ্ছে। এই সরকার আসার পর থেকে আমাদের অনেকেই লোভী হয়ে উঠেছে। আপনাকে আমি এই সময় নিশ্চয়ই বিরক্ত করছি কিন্তু থেমে গেল রামজি।

অনিমেষ মুখ তুলে দেখতে চাইল মাধবীলতা কোথায়! না দেখতে পেয়ে উঠে দাঁড়াতেই একজন প্রৌঢ় তাড়াতাড়ি চলে এলেন, কোনও দরকার আছে?

এই ছেলেটি আমার পরিচিত। মনে হচ্ছে ও অভুক্ত। যদি কিছু খাবার ওকে দেওয়া সম্ভব হয়– অনিমেষ নিচু গলায় বলল।

নিশ্চয়ই, বড়মাকে বললে সব ব্যবস্থা করে দেবেন। আসুন ভাই। রামজিকে ডাকলেন প্রৌঢ়। রামজি হেসে ফেলল অনিমেষের দিকে তাকিয়ে, আপনি কী করে বুঝলেন?

ওঁর সঙ্গে যাও। অনিমেষ মুখ ঘুরিয়ে নিল।

.

কিন্তু মাধবীলতা আপত্তি জানাল। বলল, চিনি না, জানি না, একটা উটকো ছেলেকে তোমার ছেলে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল বলে আমরা অসন্তুষ্ট হয়েছিলাম আর তুমি সেই ছেলেকে অতগুলো টাকা দিতে বলছ?

অনিমেষ স্নান সেরে শরীরে থান জড়িয়ে বসে ছিল। দেবেশের অনুরোধে আজ সে হবিষ্যি না করে নিরামিষ খেয়েছে। মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে সে বলল, বেচারা খুব বিপদে পড়েছে। ওকে সাহায্য না করলে–।

পৃথিবীর প্রচুর মানুষ এই মুহূর্তে বিপদে রয়েছে।

ঠিকই। কিন্তু ওই ছেলেটা তো দিব্যি নিজের বাড়িতে থেকে কাজকর্ম করতে পারত। তা না করে এতদূরে এসে বিপ্লব করার স্বপ্ন দেখল। নিজের ভবিষ্যৎ বা বর্তমানের কথা একটুও ভাবল না। অনিমেষ বলল, যে কেউ বলবে এটা হঠকারিতা। ইচ্ছে করে নিজের বিপদ ডেকে আনা। যা একসময় আমরা করতে চেয়েছিলাম তা এরা করছে। ইতিহাস থেকে বিন্দুমাত্র শিক্ষা নেয়নি। এই ছেলে যদি আবার নিজের জায়গায় ফিরে যেতে চায় তা হলে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করাই যেতে পারে।

আমাদের কাছে কেন? মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যাক। মাধবীলতা বিরক্ত হচ্ছিল।

মানে? অনিমেষ অবাক হল।

কাগজে দেখলাম মুখ্যমন্ত্রী মাওবাদীদের কাছে মূলস্রোতে ফিরে আসতে আবেদন করেছেন। ওরা আত্মসমর্পণ করলে তিনি তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দেবেন। এই রামজিকে বলো মুখ্যমন্ত্রীর কাছে গিয়ে আত্মসমর্পণ করতে। মাধবীলতা বলল।

সে কী! মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে উনি তো বলেছিলেন এই রাজ্যে কোনও মাওবাদী নেই, যা গোলমাল, খুনখারাপি হচ্ছে তা সিপিএমের হার্মাদবাহিনী করে মাওবাদীদের নামে চালিয়ে দিচ্ছে। সেই তিনি কাদের পুনর্বাসন দিচ্ছেন? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

তোমরা কারও ভাল কাজকেও স্বাভাবিক মনে নিতে পারো না? সবসময় ছিদ্র খোঁজো। বিরোধী নেতা হিসেবে যা বলা যায় ক্ষমতায় থাকলে তা বলা যুক্তিসংগত নয়। তুমি ওই রামজিকে বলো থানায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করতে। মাধবীলতা চলে গেল।

অনিমেষ ফাঁপরে পড়ল। তার নিজের কাছে শচারেক টাকা আছে। যা কিছু খরচ তা মাধবীলতাই করে বলে তার টাকা সঙ্গে রাখার দরকার হয় না। এখন মনে হল, জলপাইগুড়ি থেকে হাজারিবাগ যাওয়ার ট্রেনের টিকিট চারশো টাকার মধ্যে হয়তো হয়ে যাবে। সাধারণ ক্লাসে এর বেশি বোধহয় লাগবে না। ঘরে গিয়ে টাকাটা বের করে সে রামজির খোঁজে বের হল।

ক্র্যাচ নিয়ে কিছুটা হাঁটতেই দেবেশকে দেখতে পেল। দেবেশের পাশে রামজি। কাছে এসে দেবেশ বলল, এই ছেলেটি তত বেশ কাজের। আমাদের একটা পাম্প মাস দুয়েক হল খারাপ হয়ে পড়ে ছিল। জলপাইগুড়ি থেকে মেকানিক আনিয়ে সারাতে প্রায় সাত-আটশো খরচ হত। তারপর সে যদি বলত পার্টস কিনতে হবে তা হলে তো হয়েই যেত। তোমার রামজি আধঘণ্টার চেষ্টায় পাম্পটাকে চালু করে দিয়েছে। অনেক ঝামেলা থেকে বেঁচে গেলাম।

অনিমেষ রামজির দিকে তাকাল। বাঃ, খুব ভাল কথা।

দেবেশ বলল, তার ওপর ও বলছে গাড়ি চালাতে জানে।

গাড়ি? আশ্রমে গাড়ি আছে নাকি? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

গাড়ি নেই। তবে জলপাইগুড়ির এক ব্যবসায়ী তার একটা পুরনো ম্যাটাডর আশ্রমকে দিতে চেয়েছিলেন, আমি নিইনি। পুরনো গাড়ি, রোজ বিগড়াবে, সারাইয়ের খরচ, ড্রাইভারের মাইনে দেব কোত্থেকে? তা রামজি বলছে ছোটখাটো খারাপ হলে ও সারাতে পারবে। আর থাকা খাওয়া ছাড়া মাসে এক হাজার টাকা পেলে ও আশ্রমেই থেকে যেতে পারে। লোভনীয় প্রস্তাব। তুই কী বলিস?

অনিমেষ রামজির দিকে তাকাল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, তুমি দেশে ফিরে যাবে না?

রামজি হাতজোড় করল, আশ্রমের জন্যে কাজ করার সুযোগ পেলে থেকে যেতে রাজি আছি।

অনিমেষের মনে হল দেবেশের প্রস্তাব পেয়ে ছেলেটা আর আত্মসমর্পণ করতে ইচ্ছুক নয়। কিন্তু এটা ভুল হচ্ছে। হাজারিবাগে গিয়ে আত্মসমর্পণ করলে দু-তিন বছর ওকে জেলে কাটাতে হতে পারে, কিন্তু তারপর তো সারাজীবনের জন্যে মুক্ত। কিন্তু এখানে থাকলে সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে। উত্তরবাংলার এই নির্জন জায়গায় একটি অবাঙালি ছেলে আশ্রমের গাড়ি চালালে কারও না কারও মনে সন্দেহ আসতেই পারে। সেটা পুলিশের কানে গেলে ও বিপদে পড়বে। অনিমেষ বলল, কিন্তু রামজি, আমাকে তুমি বলেছিলে দেশে ফিরে যেতে চাও, আমার মনে হয় তাই যাওয়া ভাল।

দেবেশ বুঝতে না পেরে বলল, আরে ভাই কেন ওকে দেশে যেতে বলছিস! ওখানে তো কাজকর্ম কিছু করে না। ও নিজে থেকেই এখানে থাকতে চাইছে যখন তখন থাক না। তোর পরিচিত লোক, তুই না বললে আমি জোর করতে পারি না।

অনিমেষ হাসল, বেশ। তোর যখন ইচ্ছে হচ্ছে তখন আমি বাধা দেব না।

.

আনন্দের উচ্ছ্বাস বাঁধ ভাঙল। ক্ষমতা দখল করেছিলেন কোটি মানুষের ভালবাসা পেয়ে একজন মহিলা। নির্বাচনের আগে তাঁর সংগঠন ছিল সীমিত। কিন্তু নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেল প্রতিটি কেন্দ্রে মানুষ ভোট দিয়েছেন তার মুখের দিকে তাকিয়ে। পরিহাস করে বলা হল, তার আশীর্বাদ পেলে একজন বাবা এবং কালা মানুষও নির্বাচনে জিতে যেত এবার। কুরুক্ষেত্রের আগে শ্রীকৃষ্ণ যে দলে যোগ দিয়েছিলেন সেই দলই জিতে যাবে বলে ব্যাসদেব ইঙ্গিতে জানিয়েছিলেন। দুর্যোধনের ঔদ্ধত্য, যুধিষ্ঠিরের নম্র আচরণই ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল। মানুষ এই নির্বাচনে নেত্রীকে শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকায় দেখতে চেয়েছিল এবং দেখেছিল। নির্বাচনের পরে ওই সীমিত সংগঠিত দল আচমকা ফুলে ফেঁপে বিশাল হয়ে গেল। যারা কখনওই তৃণমূলের ছায়া মাড়ায়নি তারা ক্ষমতার স্বাদ পেতে বেনোজলের মতো ঢুকে গেল সংগঠনের নিচুতলায়।

নেত্রীর স্লোগান ছিল, ভয়ংকর অত্যাচারী সিপিএমকে সরিয়ে পরিবর্তন আনতে হবে। পরিবর্তন এনেও নেত্রী সেই বক্তব্যে অটল থাকলেন। তার মুখে ক্রমাগত সিপিএম বিরোধী কথা শুনে উদ্দীপ্ত হলেন দলের প্রথম সারির নেতারা। তারা সর্বত্র সিপিএমের ভূত দেখতে লাগলেন। সেই উদ্দীপনা ছড়িয়ে পড়ল নিচুতলায়। সদ্য দলে যোগ দেওয়া তৃণমূল কর্মীরা গ্রামে গ্রামে মফস্সলে সিপিএমের কার্যালয় ভাঙতে লাগল। মানুষ ভয় পেল। নেত্রী বলেছিলেন গণতন্ত্রে তিনি বিশ্বাস করেন, অথচ দলতন্ত্র প্রবল হচ্ছে। নেত্রী তা বন্ধ করতে মুখ খুলছেন না। উলটে যা কিছু সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে তা সিপিএমের তৈরি বলে দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন। তিনি মুখ্যমন্ত্রী না বিরোধী নেত্রী সেটা সাধারণ মানুষের কাছে মাঝে মাঝেই বিভ্রম তৈরি করছিল। কেউ সামান্য সমালোচনা করলে মুখ্যমন্ত্রী যদি বিরক্ত হয়ে পড়েন, তার পারিষদরা উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে। ফলে মানুষ মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছে। গ্রামে গঞ্জে মানুষ দেখছে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হওয়ার আগে সিপিএমের হার্মাদ বাহিনী যে আচরণ করত ঠিক তার অনুকরণ করছে তৃণমূলের নিচু তলার কর্মীরা। রাতারাতি স্কুলপরিচালন সমিতি পালটে যাচ্ছে। তার সভাপতি হয়ে যিনি আসছেন তার বিদ্যে স্কুলের চৌহদ্দিতেই শেষ হয়েছে। কিন্তু মানুষ কথা বলতে ভয় পাচ্ছে।

কারণ কেউ প্রতিবাদ করলে সে কারও সমর্থন পাবে না। পুলিশ তাদের আচরণে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছে কোনও তৃণমূল নেতা-নেত্রী কর্মীর বিরুদ্ধে তারা অ্যাকশন নেবে না, বামফ্রন্টের আমলে তারা যে শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিল তাতে যদি মাস্টার্স ডিগ্রি পেয়ে থাকে এখন তারা নামের আগে ডক্টর লিখতে চাইছে। উলটে তৃণমূল কর্মীরা ভাঙচুর করলে তারা রিপোর্ট দিচ্ছে অপরাধীদের কেউ তৃণমূলের সমর্থক ছিল না। তবু পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখা মানুষ ভাবছিল, বন্যার পর অনেক আগাছা ভেসে আসে। জল যখন যায় তখন পলি পড়ে। তারপর সেই মাটিতেই নতুন করে শস্য তৈরি হয়। মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই সবকিছু সামলে পরিবর্তিত শাসন ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করবেন।

কুন্তীর ফোন এল, চলে আসুন।

অর্ক অবাক হল, কোথায়?

সকাল ছটা পঞ্চান্নর ইস্পাত এক্সপ্রেস ধরবেন হাওড়া স্টেশন থেকে। তিন সাড়ে তিন ঘণ্টা পরে নামবেন গালুডি স্টেশনে। ওখান থেকে শেয়ার অটোতে উঠে বলবেন ভাল পাহাড়ে যাবেন। বান্দোয়ানের আগেই ভাল পাহাড়। কুন্তী বলল।

আপনি এখন ওখানে?

হ্যাঁ। দারুণ জায়গা। কমলবাবুর এই স্কুলের বাইরে কোনও মানুষ নেই। শুধু গাছ আর গাছ। দূরে দূরে পাহাড়ের বেড়া। বাতাসে এত অক্সিজেন আমি আগে কখনও পাইনি। আমার মন খুব ভাল হয়ে গেছে। কুন্তী বলল।

আপনি কি এখন ওখানেই থেকে যাবেন? অর্ক জিজ্ঞাসা করল।

না। কমলবাবু চাইছেন এইসব জেনে কলকাতায় ফিরে গিয়ে আমি একটু ভেবে দেখি। আর আমার সঙ্গ কেমন লাগল তাও এঁরা ভাববেন। দুই ভাবনা মিলে গেলে সামনের মাস থেকে আমি পাকাপাকি চলে আসব। এখানে কমলবাবুর সঙ্গে যারা আছেন, সব ছেড়ে মহা আনন্দে বাচ্চাদের মানুষ করছেন সেই জয়তী, দিলীপবাবু আর প্রদীপবাবুরা কিন্তু আমাকে পছন্দ করেছেন। আমি তো আরও দিন তিনেক এখানে আছি, চলে আসুন না। কুন্তী অনুরোধ করল।

দেখি, গেলে আপনাকে জানাব। অর্ক কথাগুলো বলতেই লাইন কেটে গেল। যাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছিল খুব, কাল রবিবার। সঙ্গে আরও দুদিন ছুটি ম্যানেজ করতে পারলে ঘুরে আসা সম্ভব। কিন্তু কমল চক্রবর্তীরা তাকে কীভাবে নেবে? কুন্তী কি তাকে বন্ধু বলে পরিচয় করাবে। তা ছাড়া সেখানে থাকার ব্যবস্থা কীরকম তা জানা নেই। অর্কর মনে হল এখন গিয়ে জটিলতা তৈরি করলে হয়তো কুন্তী সম্পর্কে ওরা সুবিচার করতে পারবে না। তার চেয়ে সামনের মাস থেকে কুন্তী যদি ওখানে গিয়ে থাকে তা হলে তখন যাওয়া যেতে পারে।

কিন্তু অর্কর খুব ভাল লাগল। তার বয়স চল্লিশ পেরিয়ে গিয়েছে। এই বয়সে পৌঁছে কুন্তীর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পরে ধীরে ধীরে যে তার মনের বয়স কমতে শুরু করেছে তা টের পাচ্ছিল। আজ কুন্তীর ফোন পাওয়ার পর মনে হল তার সামনে ভালভাবে বেঁচে থাকার জন্যে অনেক সময় পড়ে আছে।

মাধবীলতাকে ফোন করল অর্ক, ফোন বন্ধ।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ করে যাওয়ার পরে কৃষ্ণ দ্বারকার রাজা হিসেবে তাঁর যাদব প্রজাদের নিয়ে শান্তিতে থাকবেন বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু প্রজাদের চরিত্র ও স্বভাব যে বদলে যাচ্ছে তা অনুধাবন করতে পারেননি। এই সময় নারদ মুনি, বিশ্বামিত্র এবং কন্বমুনি দ্বারকায় এলে যাদবদের কয়েকজন কৃষ্ণের ছেলে শাম্বকে মহিলা সাজিয়ে মুনিদের কাছে নিয়ে গিয়ে বলেছিল, এই মহিলার যে সন্তান হবে সে ছেলে না মেয়ে তা বলুন। লোকগুলোর এই ইতর রসিকতা বুঝতে পেরে তারা অভিশাপ দেন শাম্ব একটি লোহার মুষল প্রসব করবে যা যদুবংশকে ধ্বংস করবে। ভয় পেয়ে ওই যাদবরা লোহার মুষলকে ভেঙে চুরমার করে সমুদ্রের জলে ফেলে দেন। মুনিদের শাপে পুরুষ শাম্ব পরের দিনই মুষলটাকে প্রসব করে।

কৃষ্ণ দ্বারকায় মদ্যপান নিষেধ করেছিলেন। এতে অসন্তুষ্ট হয় কিছু যাদব। চারদিকে অনেক অমঙ্গলের চিহ্ন দেখে কৃষ্ণ সমুদ্রের তীরে প্রভাসতীর্থে সবাইকে পুজোর জন্যে যেতে বলেন, যাদবদের অনুরোধে মাত্র একদিনের জন্যে সুরাপানের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা তুলে নেন, সেইদিন প্রচুর সুরাপান করে যাদবরা মত্ত হয়ে কৃষ্ণের রথের সারথি সাত্যকি ও পুত্র প্রদ্যুম্নকে পানপাত্রের আঘাতে হত্যা করে। কৃষ্ণ সেই হত্যাদৃশ্য দেখে ক্রুদ্ধ হন। তিনি একমুঠো তৃণ তুলে নিতেই সেই তৃণ লোহার মুষলে রূপান্তরিত হয়। সেই লোহার মুষলে কৃষ্ণ সুরামত্ত যাদবদের হত্যা করলেন। কিন্তু ক্রমশ সব তৃণ লোহার মুষলের চেহারা নিতেই যাদবরা তাই দিয়ে পরস্পরকে আঘাত করতে লাগল। ক্রমশ যদুবংশ ধ্বংস হয়ে গেল। কৃষ্ণ বনবাসী হওয়ার সংকল্প নিলেন। তাঁর মন ভেঙে গিয়েছিল। এই সময় গাছের নীচে বসে থাকা কৃষ্ণকে হরিণ ভেবে একজন ব্যাধ তির ছুড়লে তা কৃষ্ণের পায়ে বিদ্ধ হয়। যাঁর হাতে সুদর্শন চক্র থাকত, যিনি ঈশ্বরের বিকল্প হিসেবে মানুষের শ্রদ্ধা পেয়েছেন, সেই অসীম ক্ষমতার অধিকারী কৃষ্ণ এমন শক্তিহীন হয়ে গেলেন যে, তিরের আঘাতে যে ক্ষত তৈরি হয়েছিল তা সারাতে পারলেন না। তার মৃত্যু হল। খবর পেয়ে অর্জুন দ্বারকায় এসে কৃষ্ণের সৎকার করে মহিলাদের হস্তিনাপুরে নিয়ে যান। দ্বারকা সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হল।

অতি জনপ্রিয় কৃষ্ণ ওই মৌষলপর্বে দ্বারকাকে রক্ষা করতে পারেননি। এই মৌষলকাল পশ্চিমবঙ্গে আসুক তা সাধারণ মানুষ চাইছেন না।

.

৫১.

দুপুরে কুন্তী ফোন করেছিল। সে কলকাতায় ফিরে এসেছে। সন্ধেবেলায় অর্ক কুন্তীর বাড়িতে গেল। ওপর থেকে নীচে নেমে দরজা খুলল কুন্তী। হেসে বলল, আসুন। ওপরে উঠে আগের জায়গায় বসল ওরা। অর্ক চারপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, মা-দিদাদের দেখছি না?

মা দিদাকে তার আর এক মেয়ের বাড়িতে পৌঁছোতে গিয়েছেন। দিদার ভাগ্য খুব ভাল। মেয়েরা পালা করে মাকে নিজেদের কাছে রাখে। ফলে দিদার ফ্ল্যাট তালাবন্দি হয়ে পড়ে থাকে বেশিরভাগ সময়ে। কুন্তী আবার হাসল, চা খাবেন?

ওটা করে দেওয়ার মতো কেউ আছে?

না। আমাকেই করতে হবে। কুন্তী উঠতে যাচ্ছিল।

বসুন। এখনই চায়ের দরকার নেই। অর্ক বলল, আমরা বাইরে মিট করতে পারতাম।

তা হলে এই বাড়িতে তালাচাবি দিয়ে যেতে হত আমাকে। মা জানে যে আপনি আসবেন। খালি বাড়িতে আমার সঙ্গে কথা বলতে আপনার কি সমস্যা হচ্ছে?

আমি বলতে চাইছি, চা বানাতে গেলে তো আপনি কিছুটা সময় এখানে থাকবেন না। সেই সময়টুকু কোনও রেস্টুরেন্টে বসলে নষ্ট হত না। অর্ক বলল।

ও। তাই বলুন! কুন্তী হাসল।

এবার বলুন, কী ঠিক করেছেন?

জায়গাটাকে আমার খুব ভাল লেগেছে। তবে ঠান্ডার সময় প্রচণ্ড ঠান্ডা। আবার গরমের সময় অসহ্য গরম। কিন্তু কমলবাবুরা এত গাছ ওখানে আনিয়েছেন যে আবহাওয়াটা ম্যানেজ করা যাবে। তা ছাড়া আমার খুব ভাল লেগেছে ওখানকার মানুষদের। এই কদিনে আমাকে আপন করে নিয়েছেন। আর বাচ্চাগুলো এত মিষ্টি, ওই স্কুল না তৈরি হলে ওরা কোথায় ভেসে যেত! কুন্তী মাথা নাড়ল।

কেন?

জায়গাটা বান্দোয়ান থেকে দশ কিলোমিটার দূরে। কাছাকাছি গ্রামগুলো জঙ্গলের মধ্যে, পাহাড়ের গায়ে। সেখানে প্রচুর ধরপাকড় হয়েছিল কারণ মাওবাদীদের মুক্ত অঞ্চল ছিল এলাকাটা। অনেক খুন হয়েছে। মাওবাদীরা করেছে, পুলিশও। ওদের শিশুরা স্কুলের মুখ দেখত না। বাবা ঠাকুরদাদের মতো অক্ষর না চিনে বড় হয়ে অভাবের সঙ্গে লড়াই করত। কমলবাবু স্কুল করার পর সেই তিন-চার বছরের শিশুরা অক্ষর চিনল, ভাল করে কথা বলতে শিখল, পড়াশোনা আরম্ভ করল। এর জন্যে ওদের পেট ভরে ভাত খেতে দিতে হয়েছে যা গ্রামে প্রায় দুর্লভ ছিল। ভাবতে পারেন, শুধু ভাতের জন্যে বাচ্চাগুলো পড়তে পড়তে একের পর এক ক্লাসে উঠছে? কুন্তী তৃপ্ত গলায় কথাগুলো বলল।

এদের কারও বাবা-কাকা মাওবাদী?

এককালে থাকলেও এখন ওই এলাকায় মাওবাদী কার্যকলাপ নেই।

তবু তো একটা আতঙ্ক থাকেই।

না। নিজের বাচ্চার ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই স্কুলটাকে স্পর্শ করেনি ওরা। আর বোধহয় এই কারণে পুলিশের সন্দেহের তালিকায় এই স্কুল ছিল। কুন্তী বলল।

এখন কী?

এখন তো ওই অঞ্চলে মাওবাদীদের অস্তিত্ব আগের মতো শোনা যায় না। তার ফলে পুলিশও তেমন আক্রমণাত্মক নয়। কুন্তী বলল।

তা হলে আপনাকে ওদের সিদ্ধান্তের জন্যে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। অর্ক বলল।

না। ওঁরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। চলে আসার সময় কমলবাবু বলেছেন, আমি ওঁদের সঙ্গে বাচ্চাদের জন্যে কাজ করলে সবাই খুশি হবেন। কুন্তীর ঠোঁটে হাসি।

ও আচ্ছা! তা হলে কবে যাচ্ছেন?

মায়ের সঙ্গে কথা বলেছি। সামনের এক তারিখে যাব। কুন্তী হঠাৎ গলার স্বর বদলাল, আচ্ছা, আপনি ওখানে গিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে থাকতে পারেন না?

অর্ক হাসল, আমাকে ওরা থাকতে দেবে কেন? আপনি শিক্ষকতা করেছেন তাই আপনার অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে। আমার তো– ।

আচ্ছা, শিক্ষকতা ছাড়াও তো ওখানে প্রচুর কাজ আছে। সংগঠনের কাজ। আমি কমলবাবুকে আপনার কথা বলব? সোজা হয়ে বসল কুন্তী।

কী পরিচয় দেবেন?

যেটা ঠিক। বন্ধু। জবাব দিল কুন্তী।

এখনও এ দেশের মানুষ দুই অনাত্মীয় পূর্ণ বয়সের নারী পুরুষের মধ্যে বন্ধুত্ব হতে পারে বলে মনে করে না। তারা অন্য ব্যাখ্যা করে। অর্ক বলল।

দুহাজার তেরোতে এসে সেটা অনেক কেটে গেছে। আজ দুপুরে বেরিয়েছিলাম। মেট্রো স্টেশনের ঢোকার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিল দুটি উনিশ কুড়ির ছেলেমেয়ে। হঠাৎ মেয়েটা শব্দ করে কেঁদে উঠতেই ছেলেটা তাকে সবার সামনে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমু খেতে লাগল। আমি চোখ সরিয়ে নিয়েছিলাম যেমন, তেমন যারা আশপাশে ছিল তারা দৃশ্যটা দেখেও দেখল না। কয়েক বছর আগে ওরকম করলে ওদের কী অবস্থা হত ভাবুন তো? যত রেপ হোক, ইভটিজিং হোক, তলে তলে মানুষের মানসিকতার বদল হয়েছে এটা তো মানেন? কুন্তী সরাসরি তাকাল।

না মানি না। আগে মানুষ প্রতিবাদ করত। এখন করে না। এখন নিজের স্বার্থ দেখে। ওই ছেলেমেয়ে দুটো যদি তৃণমুলের সমর্থক না হয় তা হলে প্রতিবাদ করলে পুলিশ তার বিরুদ্ধেই একটা সাজানো মামলা রুজু করতে পারে। তার চেয়ে চারপাশে যা হচ্ছে হোক, আমি যেন আমার মতো বাঁচতে পারি, এটাই এখন সত্যি। অর্ক বলল।

চোখ কপালে তুলল কুন্তী, এ কী? আপনার মুখে কী শুনছি?

তার মানে?

নির্বাচনের আগে বামফ্রন্টের পতন চেয়ে আপনি তৃণমুলকে সমর্থন করেছিলেন। হঠাৎ পালটে গেলেন যে! বেশ অবাক হয়ে বলল কুন্তী।

আমি এখনও মুখ্যমন্ত্রীকে সমর্থন করি। কিন্তু ওই ছেলেমেয়ে দুটো যদি বামফ্রন্টের সমর্থক হত তা হলে ইচ্ছে থাকলেও ওসব করতে সাহস পেত না। সাহসী হলে পুলিশ মেরে হাত ভেঙে দিত। ওরা শাসক পার্টির সমর্থক বলে সাহস পাচ্ছে, পুলিশ কিছু বলছে না। অর্ক পরিষ্কার বলল।

আপনি বলতে চাইছেন এর মধ্যেই বিজয়ী সমর্থকরা নেত্রীর নির্দেশ মানছে না?

হ্যাঁ। কিন্তু প্রকাশ্যে নয়। আমাদের পাড়ায় বিশ্বজিৎ চিরকাল সিপিএমের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে এসেছে। কিন্তু ইদানীং যিনি ওর পাশাপাশি নেতা হয়েছেন তিনি বছর দেড়েক আগে সিপিএম থেকে তোলা আত্মসাৎ করার জন্যে বিতাড়িত হয়েছিলেন। এই খবর নেত্রী জানেন না। যেসব নেতারা ওই লোকটিকে বিশ্বজিতের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে তারা ওঁকে জানাবেন না। রাজা তো কান দিয়েই দেখেন! অর্ক বলল।

এইসব ঝামেলা ভাল পাহাড়ে নেই। ওখানে শান্তিতে কাজ করতে পারবেন। কুন্তী বলল, আপনি এলে আমার ভাল লাগবে।

অর্ক বলল, যদি যাই তা হলে আপনার জন্যেই যাব।

হাত বাড়িয়ে দিল কুন্তী। অর্ক সেই হাত ধরে বলল, খুশি হলাম।

.

তুমি মাথা কামাবে আমি কখনও ভাবিনি। মাধবীলতা বলল।

চুল ছাঁটিয়ে এসেছি তো দেখেছ, এখন পুরোটাই হেঁটে ফেলেছি। বেশি আর কী? অনিমেষ বলল, জীবনে দ্বিতীয়বার ন্যাড়া হলাম। চিনতেই পারছিলাম না।

হ্যাঁ। তোমাকে আমি চিনতে পারছি না। মাধবীলতা গম্ভীর হল।

মানে?

তুমি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে আহত হলে, জেলে গেলে। নিজের স্বার্থের কথা, আমার কথা না ভেবে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলে এবং তার প্রায়শ্চিত্ত বাকি জীবন ধরে করে যাচ্ছ। সেই তোমার একটা বিশেষ চরিত্র ছিল। তোমার নিজের মায়ের মৃত্যুর সময় তুমি বালক ছিলে, কিন্তু ঠাকুরদা, বড় পিসিমা, বাবার মৃত্যুর পর তুমি অশৌচ পালন কররানি যা তোমার চরিত্রের সঙ্গে মানানসই ছিল। সেই তুমি ছোটমায়ের শ্রাদ্ধ করলে মাথা ন্যাড়া করে। শ্রাদ্ধের মন্ত্র পড়লে পুরোহিতের সঙ্গে গলা মিলিয়ে যা অন্ধ সংস্কারে বলা হয়ে থাকে। এই তোমাকে আমি চিনতে পারছি না। মাধবীলতা কথাগুলো বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, অনিমেষ ডাকল, শোনো।

মাধবীলতা দাঁড়াল।

অনিমেষ বলল, পাথরও তো কোনও না কোনও সময় টুকরো হয়ে যায়। আমি যা এতদিন ভেবেছি তা কি সত্যি ছিল? পৃথিবীর কোনও দেশে একটি মানুষ কোনও রাজনৈতিক মতবাদ ছাড়া শুধু প্রতিবাদী হয়ে একক চেষ্টায় সরকার গঠন করতে পারেন না বলে বিশ্বাস করতাম। কিন্তু সেই বিশ্বাসটাও তো অসত্য প্রমাণিত হল। কমিউনিজমে বিশ্বাসী মানুষ অশ্লীল আচরণ করতে পারে না বলে দৃঢ় ধারণা ছিল। আমি সিপিএমের মতবাদের বিরোধী হলেও ওদের কমিউনিস্ট বলেই ভাবতাম। কিন্তু অনিল বসু আর তার সঙ্গীরা জনসভায় যে অশ্লীল কথার ফোয়ারা ছোটাল তা কি আমার ভাবনার সঙ্গে মেলে? আজ আমি যা করেছি তা আমার বিপক্ষে গিয়েছে। কিন্তু আমার নিজের পক্ষ কী তাই তো বুঝতে পারছি না। ছোটমা যে জীবনযাপন করতেন তাকে সম্মান দিয়ে নিজের যাবতীয় মানসিকতাকে অসাড় করে যে তার শেষ কাজ করলাম তাতে যদি তিনি এবং আমার ঠাকুরদা, বড় পিসিমা, বাবার আত্মা তৃপ্তি পান তার জন্যে নিজেকে বদলাতে আর আপত্তি নেই। এইসময় বাইরে থেকে রামজির গলা ভেসে এল, চাচা, দেবেশচাচা ডাকছেন।

অনিমেষ গলা তুলল, আসছি, গিয়ে বলো। তারপর মাধবীলতার দিকে। তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, রামজি যে এখানে আছে তা অর্ককে বলেছ?

না। ওর সঙ্গে একবারই কথা বলেছিলাম, বলার সুযোগ পাইনি।

কেমন আছে সে? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।

ঝাড়া হাত-পা হয়ে আছে। ওদের পার্টি সরকারে এসেছে। খারাপ থাকবে কেন?

.

দেবেশের অফিসঘরের দরজায় পৌঁছে অনিমেষ দেখতে পেল দুজন লোক ওর সামনে বসে আছে। একজন মোটাসোটা পাঞ্জাবি পাজামায়, অন্যজন ছিপছিপে, পরনে জিনস্ শার্ট। সে জিজ্ঞাসা করল, ডেকেছিলি?

গম্ভীর মুখে দেবেশ বলল, হ্যাঁ। বোস। অনিমেষ চেয়ারে বসার পর দেবেশ বলল, ও অনিমেষ, আমার বাল্যবন্ধু। ইনি স্থানীয় তৃণমূল নেতা, সম্পন্ন মানুষ, আর উনি ওঁর সহকারী।

তৃণমূল নেতা বললেন, আমার নাম অনুকুল রায়। আমি মশাই কাউকে ঝামেলায় পড়তে দেখলে স্থির থাকতে পারি না। কিছু মাথা গরম ছেলে, আমাদের দলের, দেবেশবাবুর সঙ্গে ঝামেলা বাধিয়েছে। আরে, একজন মানুষ বৃদ্ধবৃদ্ধাদের সেবা করছে, তাকে সেটা করতে দে।

দেবেশ বলল, অনুকূলবাবু বলছেন, ওরা যেসব শর্ত দিয়েছে তা উনি বাতিল করে দিচ্ছেন। হিসেব দেখাতে হবে না, ওঁর পরিচিত এক বৃদ্ধাকে যদি থাকতে দিই তা হলে উনি খুশি হবেন। ছেলেদের সঙ্গে যা বলার তা উনি বলে নিয়েছেন।

অনিমেষ বলল, বাঃ, এ তো ভালই হল। একজনের থাকা খাওয়ার যা খরচ তা যদি সবাই যা দেয় তা থেকে ম্যানেজ করে নিতে পারিস

সেটা চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু সেই সঙ্গে অনুকূলবাবু মাসে কুড়ি হাজার টাকা পারিশ্রমিক চাইছেন। সেটা দেব কোত্থেকে? দেবেশ জিজ্ঞাসা করল।

অনুকুলবাবু বললেন, আমি যে ছেলেদের শান্ত করলাম, আপনাদের গায়ে যাতে কোনও আঁচ না লাগে তার ব্যবস্থা করব তার জন্যে এটা কি খুব বেশি চাওয়া হচ্ছে?

কিন্তু আমার সামর্থ্য কোথায়! দেবেশ বলল।

হে হে। আপনি একদম ভুলে গেছেন। হাসলেন অনুকূলবাবু, কয়েকদিন আগে যে ভদ্রমহিলা গত হয়েছেন তিনি নাকি বাড়ি বিক্রির লক্ষ লক্ষ টাকা রেখে গেছেন। সেই টাকা তো আশ্রমই পাবে। তিনি নেই, খরচও নেই। সেই টাকার সুদ থেকেই তো এটা দিতে পারেন। আচ্ছা, একটা বন্দোবস্ত হোক, ওই টাকার যা সুদ পাবেন তার অর্ধেক আমায় দিলেই চলবে। মাসিক কিস্তি দিতে হবে না।

অনিমেষ মুখ খুলল, যিনি মারা গেছেন তিনি আমার মা। তার রেখে যাওয়া টাকা আশ্রম পাবে না। তার সুদ দেবেশ তো পাবে না।

বাঃ। এটা তো আরও সহজ হয়ে গেল। উনি তো জলপাইগুড়িতে একাই থাকতেন। আপনি তো ভুলেও দেখাশোনা করেননি। আজ মারা যেতেই উদয় হলেন। এ নিয়ে হইচই করতে পারি। কিন্তু করব না। আপনি অর্ধেক দিয়ে দেবেন।

অনিমেষ উত্তেজিত হল, আপনি এক্ষুনি এখান থেকে চলে যান। আমি আপনার দলের কলকাতার নেতাদের জানাব। এসব কী করছেন এখানে?

প্রচণ্ড রেগে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন অনুকূলবাবু, নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনলেন দেবেশবাবু! এই ভদ্রলোক গোখরোর মুখে হাত ঢুকিয়েছেন। আরে, কলকাতার নেতারা কী করবে? আমরা বিশ ত্রিশ কি এক লাখ খাচ্ছি। যারা আমাদের বাঁচাবে তারা কোটির নীচে মুঠো খোলে না। নেত্রীর কানে তারা কখনওই কথা তুলবে না, আর বাইরের লোক নেত্রীকে বললে আমরা তাঁকে জানিয়ে দেব ইনি সিপিএম। নেত্রী সেটাই বিশ্বাস করবেন। কিন্তু এর ফল ভোগ করবেন আপনারা। চল নাটা। অনুকুলবাবু বেরিয়ে গেলেন সঙ্গীকে নিয়ে। দেবেশ বলল, এখন কী করা যায়!

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আমাদের কি কিছু করার আছে?

দেবেশ চিন্তিত গলায় বলল, ওরা যখন এতটা জেনেছে তখন এটাও জানবে যে, তোকে তোর ছোটমা নমিনি করে যাননি। ওঁর অবর্তমানে টাকাগুলো আশ্রমের কাজে খরচ করা হবে। আর সেই খরচের ব্যাপারটা তদারকি করবে মাধবীলতা। এই খবর জানামাত্র ওরা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

অনিমেষ একটু ভেবে নিয়ে বলল, ওদের সবচেয়ে বড় নেতার সঙ্গে পরিচয় আছে?

না। নেই। নির্বাচনের আগে তো দলটাই ছিল নড়বড়ে। সাধারণ মানুষ ওদের শক্তি জোগাল। যারা নেতা হয়ে বসল তাদের মুখ অচেনা। দেবেশ বলল।

তারা দলটাকে চালাচ্ছে কী করে?

দলনেত্রীর নাম ব্যবহার করে।

তা হলে তার কাছেই যাওয়া উচিত। যিনি এত বড় পরিবর্তন দেশে আনলেন, তিনি নিশ্চয়ই অমানবিক হবেন না। নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবেন।

অনিমেষের কথায় অবাক হল দেবেশ, তা হলে তো কলকাতায় যেতে হবে। আর গেলেই মুখ্যমন্ত্রীর সাক্ষাৎ কী করে পাব? যিনি দেশের এত বড় বড় সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন তিনি আমাকে সময় দেবেন কেন?

এ ছাড়া কোনও পথ নেই। চেষ্টা করতে হবে তার সাক্ষাৎ পাওয়ার। ঠিক তখনই গাড়ির শব্দ কানে এল। দেবেশ এবং অনিমেষ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখল, কয়েকজন পুলিশকে নিয়ে দুটো গাড়ি থেকে থানার দারোগা নামছেন।

ওদের দেখতে পেয়ে দারোগা সামনে চলে এলেন, দেবেশবাবু, ইনি কে?

আমার বাল্যবন্ধু, অনিমেষ।

কোথায় থাকেন?

এখন কলকাতায়, কিন্তু এই শহরেই বড় হয়েছে।

দারোগা অনিমেষকে আপাদমস্তক দেখলেন, এটা কী করে হল?

অনিমেষ বলল, দুর্ঘটনাই বলা যায়।

আপনি নকশাল ছিলেন, জেল খেটেছেন? চোখ ছোট হল দারোগার।

হ্যাঁ।

বাঃ। আপনাকে আমার সঙ্গে থানায় যেতে হবে।

কেন? আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে। দারোগা বললেন।

কী অভিযোগ?

সেটা থানায় গিয়ে শুনবেন।

আপনি কি আমাকে অ্যারেস্ট করছেন? তা হলে ওয়ারেন্ট দেখাতে হবে।

কী আশ্চর্য! আমি তো একবারও বলিনি অ্যারেস্ট করছি। হাসলেন দারোগা। তারপর বললেন, একটু আগে আমরা এই এলাকায় একজন মাওবাদীকে ধরতে পেরেছি। দেবেশবাবু জানেন, ডুয়ার্সে মাওবাদীদের অস্তিত্ব ছিল না। সেই লোকটি বলছে যে আপনার সৌজন্যে এখানে এসেছে। আপনাকে সামনে বসিয়ে ওর সঙ্গে একটু কথা বলব। আপনি নকশাল ছিলেন, ও মাওবাদী। যতই বলুন কোনও সম্পর্ক নেই, তবু–। চলুন।

দেবেশ বলল, যদি কোনও মাওবাদী ধরা পড়ে তা হলে তার জন্যে ওকে নিয়ে যেতে হবে কেন? যা জিজ্ঞাসা করার তা এখানেই করতে পারেন।

বললাম না, লোকটা ওঁর কথা বলছে। দারোগা বিরক্ত হলেন।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি রামজিকে অ্যারেস্ট করেছেন?

আরে! এই তো, আপনি ওকে চেনেন তা প্রমাণ হয়ে গেল। দারোগা খুশি।

দেবেশ অবাক, কিন্তু কখন অ্যারেস্ট করলেন ওকে? রামজি একটু আগেও আশ্রমে ছিল। আপনাদের তো এখানে আসতে দেখিনি।

তাকে হাইওয়ে থেকে পেয়েছি আমরা। লোকটা মাওবাদী, এখানে অনিমেষবাবুর মদতে লুকিয়ে ছিল। হাসলেন দারোগা, এই ইনফরমেশন পাওয়া গিয়েছে অনিমেষবাবুর ছেলের কাছ থেকে। জেরার চাপে তিনি বলতে বাধ্য হয়েছেন।

অনিমেষ চেঁচিয়ে উঠল, জেরার চাপে মানে? ওকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে নাকি? কেন? ওর অপরাধ কী?

মাওবাদীদের সঙ্গে ওঁর পরোক্ষ যোগাযোগ ছিল। তা আড়াল করতে উনি তৃণমূলের সমর্থক হয়েছিলেন। চলুন অনিমেষবাবু। অনেক সময় নষ্ট হল! দারোগা বললেন।

অনিমেষ আপত্তি জানাল, তাকে আইনসম্মতভাবে গ্রেফতার করলে সে নিশ্চয়ই যাবে। এই আশ্রম থেকে নিয়ে যাওয়ার পথে তার কিছু হয়ে গেলে পুলিশ তো দায় অস্বীকার করতে পারে। দেবেশ এবং অনিমেষের সঙ্গে দারোগার যখন উঁচু গলায় কথা চলছিল তা পৌঁছে গেল অন্য আবাসিকদের কাছে। ভিড় জমল ওদের ঘিরে। অনিমেষ লক্ষ করল মাধবীলতা অন্য মহিলাদের একেবারে পেছনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়ে অনিমেষ চেঁচিয়ে বলল, মাওবাদীদের সাহায্য করার জন্যে অর্ককে পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে। জেরার চাপে সে রামজির কথা স্বীকার করেছে। এটা আমি ভাবতে পারছি না।

মাধবীলতা পাথরের মতো একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকল। কিন্তু প্রতিবাদে নামলেন অন্য আবাসিকরা। তারা কিছুতেই অনিমেষকে আশ্রম থেকে নিয়ে যেতে দেবেন না। দেবেশ দারোগার কাছে গিয়ে অনুরোধ জানাতেই তিনি বললেন, দুর মশাই, কয়লা খেলে আংরাই তো পটি হবে। ওঁরা যখন আপনাদের এত করে অনুরোধ করলেন তখন যদি রাজি হয়ে যেতেন তা হলে আমাকে এখানে আসতেই হত না।

হকচকিয়ে গেল দেবেশ। তারপর বলল, আমি ওদের প্রস্তাবে রাজি।

গুড। এইজন্যেই তো ওকে ওয়ারেন্ট এনে অ্যারেস্ট করছি না। আমি থানায় নিয়ে গিয়ে এখন বসিয়ে রাখব। আপনি দুঘণ্টার মধ্যে ওঁদের সঙ্গে সমঝোতা করে নিন। ওঁরা আমায় ফোন করে দিলে অনিমেষবাবুকে এখানে পৌঁছে দিয়ে যাব। দারোগা সেপাইদের সাহায্যে অনিমেষকে গাড়িতে তুলে চলে গেলেন।

দেবেশ যাওয়ার জন্যে তৈরি হতেই মাধবীলতা সামনে এসে দাঁড়াল, কোথায় যাচ্ছেন?

নিশ্চয়ই সব শুনেছেন?

শুনেছি। কিন্তু আপনি কোথাও যাবেন না। মাধবীলতা শক্ত গলায় বলল।

মানে? দেবেশ অবাক।

আপনার বন্ধুর পাশে আমি প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে আছি। যখন নকশাল রাজনীতি করত আমি কখনও বাধা দিইনি। জেল থেকে প্রতিবন্ধী হয়ে বেরিয়ে আসার পরে সাধ্যমতো ওর পাশে থেকেছি। এতদিন পরে ও মাওবাদী জেনেও রামজিকে সাহায্য করেছে কারণ ওর মনের সেই আগুন নিভে যায়নি, যা আমি বুঝতে পারিনি। ছেলে বাবার কিছুটা পেয়েছে, অনেকটা পায়নি। ওর বাবা লালবাজারের পুলিশের হাতে প্রচণ্ড অত্যাচারিত হয়েও মুখ খোলেনি, ও সামান্য জেরার চাপে মুখ খুলেছে। মাধবীলতা হাঁফাচ্ছিল।

কিন্তু একটু সমঝোতা করলে যদি অনিমেষ ছাড়া পায়–! দেবেশ বলল।

কার সঙ্গে সমঝোতা করবেন? আশ্রমের এতগুলো মানুষকে বঞ্চিত করে হঠাৎ ক্ষমতা পাওয়া লোভী নেতাকেই ঘুষ দিয়ে অনিমেষকে মুক্ত করবেন? অনিমেষ যদি দোষ করে থাকে তা হলে শাস্তি পাবে। যদি বিনা দোষে ওরা শাস্তি দেয় তা হলে যেদিন এরা ক্ষমতায় থাকবে না, সেদিন সে মুক্তি পাবে। দেবেশবাবু, আপনি যদি মাথা নিচু করেন তা হলে এই আমাদের সবার পায়ের তলায় মাটি থাকবে না। মাধবীলতা মুখ তুলল।

ধীরে ধীরে দেবেশের দুটো হাত ওপরে উঠল। মাধবীলতার সামনে হাতজোড় করে সে মাথা নিচু করল।

.

মহাভারতের কৃষ্ণ মুষলপর্বে অসহায় চোখে যদুবংশ ধ্বংস হতে দেখেছিলেন। এটা ইতিহাস নয়, কাব্যকথায় যদিও বলা হয়ে থাকে, যা নেই মহাভারতে তা ভারতে নেই। তাই ইতিহাসে না থাকলেও ইতিহাস হয়ে গেছে মহাভারতের অনেক ঘটনা। সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে কি না তা আগামীকাল বলতে পারবে। জেলখানার বাইরে দাঁড়িয়ে কুন্তী। সে কি মাধবীলতা হতে পারবে? আর যিনি কোটি কোটি মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তাকে কি ধৃতরাষ্ট্র ক্রমশ গ্রাস করে ফেলবে? হায়!

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার