ওরা বিকেলবেলায় একটু বেরিয়ে এল। একটু এগোলেই একটা ঝোরা অনেক ওপর থেকে সশব্দে নেমে আসছে। ঊর্মিলা লক্ষ করল ঝোরার নীচে পথের পাশে একটি মেরির মূর্তির সামনে কেউ বা কারা মোমবাতি জ্বেলে গিয়েছে এর মধ্যে। ওই দারুণ নির্জন জায়গায় জল পড়ার শব্দ, হাওয়ার আওয়াজ আর ঝিঁঝির ডাক মিলেমিশে অপূর্ব কনসার্ট তৈরি করেছে। আর সেই কনসার্ট যেন মেরির প্রতি শ্রদ্ধায় উৎসর্গীকৃত। মেরির মুখের ভঙ্গিটি বড় সুন্দর। পৃথিবীর সব মা যেন তাঁদের স্নেহ নিয়ে ওই ভঙ্গিতে একত্রিত। হঠাৎ ঊর্মিলা অন্যমনস্ক হয়ে গেল। অনেক দিন বিয়ে হয়ে গেল তার। অর্থের প্রাচুর্য না থাকলেও অভাব নেই। স্বামীও রীতিমতো ভদ্রলোক। কিন্তু এখনও সন্তান এল না। কলকাতার গাইনিদের দেখিয়ে দেখিয়ে সে ক্লান্ত। সবাই ভরসা দিচ্ছেন কিন্তু–। না তার যিশুর মতো সন্তান চাই না। একজন সাধারণ মানুষ যদি তার শরীর থেকে বেরিয়ে আসত যে তার কথা ভাববে, বুঝবে তা হলেই সে খুশি হত।

কী ভাবছ তুমি?

 সায়নের গলা পেয়ে ঊর্মিলা চমকে তাকাল।

তুমি কাঁদছ? সায়নের গলায় বিস্ময়।

দূর! একনজরে চেয়ে থাকলে চোখে জল আসে। জল মোছার চেষ্টা না করে ঊর্মিলা আড়চোখে দেখে নিল নন্দিনী আর কমলেন্দু খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে জল পড়া দেখছে, কী সুন্দর মূর্তি, না?

সায়ন মেরির দিকে তাকাল, ঠিক মানুষের মতো।

মানুষ? উনি কে ছিলেন জানিস না?

 জানি। মানুষ ছিলেন বলেই যিশুর মা হয়েছিলেন। মানুষ ছিলেন বলেই ওইভাবে তাকাতে পেরেছেন। যিশুও তো ভগবান নন। তিনিও মানুষ ছিলেন। ভগবান যাঁরা তাঁরা অনেক দূরের হন।

ঊর্মিলা সকৌতুকে তাকাল। সায়নের মুখে এমন কথা আশা করেনি সে।

সায়ন বলল, এই যেমন দূর্গাঠাকুর। তোমার কি কখনও তাকে নিজের বলে মনে হয়? দশখানা হাত নিয়ে মেয়ের চেহারায় রয়েছেন। দেখে ভয়ে মা বলতে হয়, ভেতর থেকে আসে না। কালীঠাকুর, তারও বেলায় একই কথা। সরস্বতী, লক্ষ্মী সবাই কেমন সাজানো।

বুঝেছি। তুমি এখানে এসে খ্রিস্টান হয়ে যাচ্ছ। কপট ভঙ্গি করল ঊর্মিলা, যদিও সায়নের কথার সঙ্গে সে একমত।

আমি খ্রিস্টান হতে যাব কেন? ইচ্ছে করলেই কি খ্রিস্টান হওয়া যায়? কেন? চার্চে গিয়ে বললেই তো হয়।

কী যে বল! এই যে সদুদা, সদুদা কি হিন্দু? আমি? হিন্দুবাড়িতে জন্মেছি বলেই হিন্দু হয়ে যাব ভাবলে খুব বোকামি করা হবে। হিন্দু হতে হলে ধর্মটা জানতে হবে, সেইমতো জীবনযাপন করতে হবে। ঠিক একই কথা খ্রিস্টানদের সম্পর্কে। সায়ন গলার স্বর পাল্টাল, আচ্ছা, টুপুর কী দুষ্টুমি করেছিল?

আচমকা সায়ন এমন প্রসঙ্গ তুলবে কল্পনা করেনি ঊর্মিলা। বলল, আমি ঠিক জানি না যে।

দ্যাখো। তোমরা সবাই একই বাড়িতে থাকো অথচ কেউ কারও খবর রাখো না। আমি ওকে লিখব ব্যাপারটা জানাতে। ওপরের দিকে তাকিয়ে সায়ন বলে উঠল, যাঃ, মোমবাতিটা নিভে গেল।

ঊর্মিলাও সেটা দেখেছিল। মনে মনে সে মা মেরিকে ধন্যবাদ দিল সায়নকে অন্য প্রসঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। টুপুরের ব্যাপারটা ওকে বলা যাবে না। যদি ও সে-সময় থাকত তা হলে আলো নিভিয়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে নন্দিনী ওকে কী বোঝাতেন তা তিনিই জানেন। কিন্তু ওর সামনে সরল মুখে মিথ্যে বলতে পারছিল না ঊর্মিলা।

এই তুই কী করছিস! চেঁচিয়ে উঠল ঊর্মিলা। সায়ন পাথর ধরে খাঁজে পা রেখে ওপরে উঠতে চেষ্টা করছে। সেই চিৎকার শুনে নন্দিনী ছুটে এলেন। পেছনে কমলেন্দু। নন্দিনী চিৎকার করে বললেন, কী হচ্ছে সায়ন? ওপরে উঠছ কেন? তোমার শরীর খারাপ, নেমে এসো।

সায়ন চেঁচিয়ে জবাব দিল, আমার শরীর ঠিক আছে মা। ওই মোমবাতিটা জ্বেলে দিয়েই নেমে আসব।

সর্বনাশ! তুমি পড়ে যাবে। ডাক্তারবাবু আমাকে আস্ত রাখবেন না। আয় বাবা, নেমে আয়, কথা রাখ আমার। নন্দিনীর গলায় কান্না মিশল।

কমলেন্দু চেঁচিয়ে উঠল, সায়ন, নেমে এসো। তুমি ওপরে উঠতে পারবে না। তোমার শরীর দুর্বল। কথা শোনো।

সায়ন এসব শুনছিল না। এই সময় দার্জিলিং-এর পাহাড় থেকে যেসব গাড়ি নীচে নামছিল, তারা একের পর এক দাঁড়িয়ে গেল বাঁকে। গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভার এবং যাত্রীরা ওপরে তাকিয়ে মজা পাচ্ছিল।

নন্দিনী সায়নকে কখনওই অবাধ্য হতে দেখেননি। আজ যেন কোনও কথাই ওর কানে ঢুকছে না। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল নন্দিনীর। যে-ছেলের শরীরে মৃত্যু বাসা বেঁধেছে সে ওই দুঃসাহস দেখাচ্ছে কেন? যদি পা ফসকে নীচে গড়িয়ে পড়ে তাহলে আজই চলে যাবে পৃথিবী ছেড়ে। নন্দিনী চোখ বন্ধ করে ফেললেন। হঠাৎ তাঁর মনে হল, ওর বাবা বলেন মন শক্ত করো। ছেলে চলে যাবে, আজ নয় কাল। আমাদের ওর যাওয়ার জন্যে প্রস্তত থাকতে হবে। কথাগুলো মনে পড়তেই নিজেকে যতটা সম্ভব নিস্পৃহ করে চোখ খুললেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল তাঁর। হাওয়ার আওয়াজ, জলের শব্দ, ঝিঁঝির ডাক, কিছুই কানে যাচ্ছিল না তাঁর। ওখানে কে? ওই পাথর বেয়ে যে উঠে প্রায় মা মেরির কাছে পৌঁছে গিয়েছে? ও কি সায়ন? তাঁর ছেলে? কিন্তু তিনি তো সায়নকে দেখতে পাচ্ছেন না। অপূর্ব এক আলোকময় তরুণ ক্রমশ মা মেরির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর ঝুঁকে পড়ে প্রায় শেষ হয়ে আসা একটি মোমবাতির আগুন থেকে অন্য মোমবাতিগুলোকে একের পর এক জ্বালিয়ে দিল। মা মেরি তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। সেই আলোকময় তরুণ মায়ের পায়ে হাত রাখল। তারপর ধীরে ধীরে নীচে নামতে লাগল। এই নামার পথ বিলম্বিত হচ্ছে। ঠিকঠাক ধাপে, খাঁজে, পা পড়ছে না সহজে। কিন্তু সেগুলো বেশিক্ষণ বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল না। যেন নিজেরাই ওকে নামার জন্যে জায়গা করে দিল।

হঠাৎ একটা আর্তচিৎকার চারপাশের পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হল। নন্দিনী দেখলেন সায়ন নীচে এসে দাঁড়িয়েছে। সেই আলোকময় তরুণ উধাও হয়ে গিয়েছে এর মধ্যে। কিন্তু ওপর থেকে নেমে আসা যাত্রীরা, ড্রাইভাররা উল্লাসে চিৎকার করতে করতে এগিয়ে গেল সায়নের সামনে। লোকগুলো মাথা নত করে তাকে অভিবাদন জানাল। কিন্তু তাদের এড়িয়ে সায়ন ছুটে এসে নন্দিনীকে জড়িয়ে ধরল, মা, আমি পেরেছি। মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়েছি। তুমি রাগ করোনি তো?

নন্দিনী কথা বলতে পারছিলেন না। একটু আগে তিনি যা দেখেছেন তা কি সত্যি না বিভ্রম? ইতিমধ্যে ভিড়ের সবাই জানতে চাইছে ছেলেটি কে? কমলেন্দু জবাব দিচ্ছিল। এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে নন্দিনীকে বলল, মা, আপনারা নিশ্চয়ই কাছেই থাকেন। আমার গাড়িতে উঠুন, পৌঁছে দিচ্ছি। নন্দিনী ভাবলেন তাই ভাল।

ভদ্রলোকের গাড়িতে চেপে ওরা ট্যুরিস্ট লজে পৌঁছে গেল। কিন্তু ওদের অনুসরণ করা কিছু গাড়ি তখন দাঁড়িয়ে গেল লজের সামনে। বাকিরা চলে গেল গন্তব্যস্থানে। লজের ভেতরে ঢুকে ভদ্রলোক বললেন, আমি ওকে একটি কথা বলতে চাই, আপনি অনুমতি দেবেন?

নন্দিনী ঘাড় নাড়লেন।

 ভদ্রলোক সায়নকে বললেন, তুমি আমাকে স্পর্শ করবে?

সায়ন অবাক হয়ে গেল, কেন?

এটা আমার প্রার্থনা।

প্রার্থনা বলছেন কেন?

আর কোনও শব্দ তো আমার জানা নেই।

 সায়ন কী করবে বুঝতে না পেরে হাত বাড়িয়ে দিল। একটু ইতস্তত করে ভদ্রলোক সেই হাত দুটো হাতে ধরলেন, আমি একজন নাস্তিক মানুষ। কিন্তু আজ আমি কোনও ব্যাখ্যা দিতে পারছি না। আচ্ছা, চলি।

কমলেন্দু বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কী হয়েছে বলো তো?

নন্দিনী মাথা নাড়লেন, কিছুই বলতে পারলেন না।

কমলেন্দু বলল, ওরা কেউ জানে না সায়ন অসুস্থ। ওকে দেখে তা বোঝাও যায় না। তাহলে ওর মোমবাতি জ্বালানো দেখে এত লোক ওরকম পাগলামি করছে কেন?

এইসময় একজন বুড়ো বেয়ারা ছুটে এল। সায়নের পায়ের কাছে প্রায় আছাড় খেয়ে পড়ে বলল, আমার মেয়েটাকে তুমি বাঁচিয়ে দাও। আমি শুনলাম তুমি সব করতে পারো। আমার মেয়ে বাঁচবে না বলেছে সব ডাক্তাররা। তুমি তাকে বাঁচিয়ে দাও।

সায়ন হকচকিয়ে গেল, আমি কী করে বাঁচাব? তুমি আরও বড় ডাক্তারকে দেখাও।

আরও বড় ডাক্তার? লোকটা বুঝতে চেষ্টা করল।

শিলিগুড়িতে নিয়ে যাও।

নিয়ে যাব। তুমি যখন বলছ, নিশ্চয়ই শিলিগুড়ির বড় ডাক্তারকে দেখাব। যেখান থেকে পারি টাকা জোগাড় করব।

নন্দিনী ছেলেকে নিয়ে ঘরে গেলেন। দুটো খাট, দুজনের জন্যে। সায়ন বলল, মা, তোমার সঙ্গে সোব।

নন্দিনী আড়চোখে ছেলেকে দেখলেন, তারপর বললেন, অত ছোট খাটে দুজনের কি হয়?

সায়ন জানলার কাছে গেল। পা সরিয়ে কাচের এপাশ থেকে বাইরে দেখল। বলল, দ্যাখো, দ্যাখো, সন্ধে নেমে এসেছে। একটু পরে রাত নামবে। তখন সব অন্ধকার। কিছুই দেখা যাবে না।

পর্দা ঠিক করে দে। ঠাণ্ডা আসবে। নন্দিনী সহজ হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। প্রাণপণে।

পর্দা ঠিক করে সায়ন বলল, আচ্ছা মা, সবাই অমন করছে কেন? ওই বুড়ো লোকটা আমাকে প্রণাম করল কেন?

মাথা খারাপ বোধ হয়।

এবার দরজায় শব্দ হল। ঊর্মিলা ঢুকল। সায়ন দেখল ঊর্মিলাকে এখন অন্যরকম দেখাচ্ছে। নন্দিনী হাসার চেষ্টা করলেন, এসো।

সায়ন তার ঘরে-পরার জামা-পাজামা ব্যাগ থেকে নিয়ে পাশের বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। বন্ধ দরজার দিকে একবার তাকিয়ে ঊর্মিলা নন্দিনীর দিকে মুখ ফেরাল।

নন্দিনী জিজ্ঞাসা করলেন, কমলেন্দু কোথায়?

ঘরে। শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে। ঊর্মিলা জবাব দিল।

সন্ধের পর এসব জায়গায় কিছু করার নেই। নন্দিনী অলস গলায় বলার চেষ্টা করলেন।

একটা কথা জিজ্ঞাসা করব? ঊর্মিলা বলল।

নন্দিনী তাকালেন। তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলেন।

সায়ন যখন মোমবাতি জ্বালাতে ওপরে উঠেছিল তখন তুমি কি কিছু দেখেছিলে? ঊর্মিলা উদগ্রীব হয়ে তাকাল।

দেখেছিলাম মানে? নন্দিনী মুখ ফেরালেন।

আমি দেখলাম ও উঠে যাচ্ছে তারপর আর নেই। ভয়ে নীচের দিকে তাকালাম যদি পড়ে গিয়ে থাকে। নীচেও দেখলাম না। তারপর আবার দেখি মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে মোমবাতি জ্বালাচ্ছে। আর তখন ওকে ঠিক যিশুখ্রিস্টের মতো দেখাচ্ছিল। মনে করতেই আমার গায়ে কাঁটা ফুটছে, দেখ। ঊর্মিলা হাত বাড়াল।

তোমার মনের ভুল।

তাহলে ওই লোকগুলো চেঁচাল কেন?

মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে নেমে এসেছিল, তাই।

তুমি কিছুই দেখনি?

কমলেন্দু কি এক কথা বলছে?

না। ও কিছু দেখেনি। আমাকে বলছে সবাই দিবাস্বপ্ন দেখেছে।

সেটাই ঠিক।

আমিও ভাবছিলাম। যে-ছেলেটাকে একটু একটু করে বড় হতে দেখলাম, যার মধ্যে কোনও কিছু দেখিনি, যার অমন ভয়ঙ্কর অসুখ হয়েছে সে কী করে অবতার হয়ে যাবে।

অবতার! অন্যমনস্ক গলায় বললেন নন্দিনী।

অবতারদের ওই রকম হয়। এখন টিভির যুগে এসব বাস্তবে তো হওয়ার কথা নয়। কিন্তু মুশকিল হল তুমি আর ও কিছু দেখনি কিন্তু অন্য লোকজন আমার মতো দেখতে পেল কী করে! কী আলো বের হচ্ছিল ওর শরীর থেকে। বললাম বলে ও বলল তোমার পেটে বায়ু বেড়েছে।

এইসময় সায়ন বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে। এসে চুপচাপ শুয়ে পড়ল। নন্দিনী জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল? শুয়ে পড়লি যে?

এমনি।

শরীর খারাপ লাগছে?

না। আচ্ছা মা, ওই লোকটা আমার পায়ে পড়ল কেন?

 আবার এক কথা। অনেক ঘোরাঘুরি হয়েছে, কম্বলটা টেনে নিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাক। তোর কি এখন ওষুধ খাওয়ার কথা?

না। সায়ন বালিশে মুখ গুঁজল।

 নন্দিনী বললেন, চলো, আমরা বাইরে গিয়ে আকাশ দেখি।

ঊর্মিলা বলল, বাইরে কিন্তু বেশ ঠাণ্ডা।

নন্দিনী ছেড়ে রাখা-শালটাকে জড়িয়ে নিলেন, আলো নিভিয়ে দেব?

সায়ন বলল, থাক।

দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ কানে এল। সায়নের মনে হচ্ছিল মা ঠিক বলছে না। ওই লোকটির মাথা খারাপ হলে এখানে কাজ করে কী ভাবে? আর যেসব লোক গাড়ি থামিয়ে তাকে দেখছিল, নেমে আসার পর উল্লাসে চিৎকার করেছিল তারা তার দিকে কী অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছিল। কেউ কেউ তাকে ছুঁতে চাইছিল। এমনকী যে ভদ্রলোক তাদের লজে পৌঁছে দিয়ে গেলেন তিনি তার স্পর্শ প্রার্থনা করলেন। প্রার্থনা তো লোকে ঈশ্বরের কাছে করে! হঠাৎ মিস্টার ব্রাউনের কথা মনে পড়ল সায়নের। মিস্টার ব্রাউন ইদানীং তার সঙ্গে যখনই কথা বলেন তখনই খুব সমীহ করে বলেন। অত প্রবীণ মানুষ কেন ওইভাবে কথা বলবেন? প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল তার মনে। প্রচণ্ড অস্বস্তি হচ্ছিল তার। সায়ন উঠে বসল। বসতেই টের পেল নাকের মধ্যে সুড়সুড় করছে। ও আঙুল দিতেই টাটকা রক্ত দেখতে পেল। চিৎকার করতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল সে। তারপর ধীরে ধীরে বিছানা থেকে উঠে বাইরে বেরুবার জামা-প্যান্ট পরে নিল।

বাইরে বেশিক্ষণ থাকা যাচ্ছিল না। ঠাণ্ডা বাড়ছে। ঊর্মিলাকে তার ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে পা দিয়ে নন্দিনী অবাক, কী রে? আবার জামা-প্যান্ট পরলি কেন?

রুমালে নাক চেপে বসেছিল সায়ন। সেইভাবেই বলল, একটা গাড়ি ডাকো। আমাকে এখনই নিরাময়ে নিয়ে চলো।

কেন? ছুটে এলেন ছেলের কাছে নন্দিনী। এক হাতে কাঁধ জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে ওর হাতে ধরা রুমাল নাক থেকে সরিয়ে দেখলেন রক্তের ছোপ রয়েছে তাতে। মায়ের বুকে মাথা রেখে সায়ন বলল, আমার খুব শরীর খারাপ করছে মা। তাড়াতাড়ি করো।

ছেলেকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নন্দিনী প্রায় পাগলের মতো ছুটে গেলেন। ঊর্মিলাদের দরজায় ধাক্কা মেরে বললেন, ঊর্মিলা, দরজা খোলো।

কমলেন্দু তাড়াতাড়ি দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছে?

সানুর নাক থেকে রক্ত বের হচ্ছে। ওকে এখনই নিয়ে যেতে হবে। খুব উত্তেজিত গলায় কথাগুলো বললেন নন্দিনী।

ঊর্মিলা এসে দাঁড়িয়েছিল পেছনে, সে কী! এ কখনও হতে পারে? ও মা মেরির আশীর্বাদ পেয়েছে।

কী পেয়েছে জানি না। তবে রক্ত নিজের চোখে দেখেছি, শরীর খুব খারাপ হয়ে গেছে ওর। তুমি একটা ব্যবস্থা করো।

কমলেন্দু স্ত্রীর দিকে তাকাল, যতই আধুনিক কথা বল, দেখলে তো, কীরকম কুসংস্কার তোমাকে চেপে রেখেছে। কমলেন্দু দ্রুত বেরিয়ে গেল।

তখন সন্ধে পার হওয়া রাত। কিন্তু পাহাড়ে নির্জনতা চেপে বসেছে। রাস্তায় কোনও গাড়ি নেই। টুরিস্ট লজ শহরের বাইরে বলে এদিকে মানুষজনও কম। কমলেন্দু ম্যানেজারকে বলল, আমার সঙ্গে যে-ছেলেটি আছে সে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে হেল্প করুন।

ভদ্রলোক অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, মানে সায়ন অসুস্থ?

আপনি ওর নাম জানেন?

জানতাম না। আজ আপনারা ফিরে আসার পর–। ভদ্রলোক হাঁকডাক করে বেয়ারাদের নির্দেশ দিলেন ট্যাক্সি ধরে নিয়ে আসতে। টেলিফোনে ট্যাক্সি ডাকার নাকি কোনও উপায় নেই। বেয়ারারা বেরিয়ে গেলেও সেই বুড়ো বেয়ারা উদগ্রীব হয়ে পাশে এসে দাঁড়াল। ম্যানেজার বললেন, চিন্তা করবেন না। এখনই ট্যাক্সি এসে যাবে। কী হয়েছে ছেলেটির?

ব্লিডিং হচ্ছে।

ব্লিডিং? কেটে গিয়েছে নাকি?

না। ওর রক্তের অসুখ আছে।

শোনামাত্র বুড়ো বেয়ারা ছুটে গেল। দরজা খোলা, নন্দিনী ছেলেকে জড়িয়ে বসে আছেন। সায়নের নাকে রুমাল চেপে ধরে আছেন তিনি। ঊর্মিলা হতভম্ব হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে। রক্তাক্ত রুমালটা টেবিলের ওপর রেখে নন্দিনী দ্বিতীয় রুমাল নাকে চাপলেন। সেই সময় কমলেন্দু ছুটে এল, ট্যাক্সি এসে গিয়েছে। আপনি সরুন, আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি!

প্রাপ্তবয়স্ক একটি শরীরকে কোলে তুলতে কষ্ট হচ্ছিল কমলেন্দুর। তবু সমস্ত শক্তি দিয়ে সে সায়নকে তুলে দরজার দিকে এগোতে নন্দিনী তাদের অনুসরণ করলেন। ঊর্মিলা সায়নের ব্যাগে জামা-পাজামা দ্রুত পুরে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখতে পেল বুড়ো বেয়ারা টেবিল থেকে রক্তে ভেজা রুমালটি তুলে নিচ্ছে। সে চেঁচিয়ে উঠল, কী করছ তুমি?

লোকটি হাতজোড় করল, লোকে বলছে ওঁর মধ্যে ভগবান আছে। ওঁর রক্ত যদি আমার মেয়ের মুখে দিতে পারি তা হলে অসুখ সেরে যাবে।

ঊর্মিলা পাথর হয়ে গেল। ভারতবর্ষের অশিক্ষিত মানুষের অন্ধ বিশ্বাস নিয়ে অনেক লেখা তাকে কমলেন্দু পড়িয়েছে কিন্তু চোখের সামনে এমন ঘটনা ঘটবে ভাবতে পারেনি। বুড়ো বেয়ারা দ্রুত বেরিয়ে গেলে হুঁস হল ঊর্মিলার। সে যখন ছুটে বাইরে এল তখন ওরা ট্যাক্সিতে উঠে পড়েছে। মারুতি ভ্যানের পেছনে সায়নকে কোলে শুইয়ে নন্দিনী, সামনে কমলেন্দু। ঊর্মিলা সায়নের পায়ের কাছে বসল। গাড়ি চলতে শুরু করলে তার মনে পড়ল কমলেন্দুর কথা। ওই বুড়ো বেয়ারা সম্পর্কে সে যা ভেবেছে ঠিক তাই কমলেন্দু তার সম্পর্কেও বলেছে। সায়ন সম্পর্কে হঠাৎ তার ভাবনা পাল্টেছিল। আসলে বাল্যকাল থেকে শুনে শুনে অলৌকিক ব্যাপার সম্পর্কে আগ্রহ মনের ভেতর লুকিয়েছিল। আজ হয়তো দেখার ভুলেই সেই লুকোনো ভাবনাকে বিশ্বাস করে ফেলেছে। কমলেন্দুর এটা হয়নি বলে তাকে অন্ধ বলে ব্যঙ্গ করতে পেরেছে। সে যদি সায়নের ব্যাপারটাকে অলৌকিক বলে ভাবতে পারে তা হলে বুড়ো বেয়ারাকে দোষ দিয়ে লাভ কী! সায়ন যে সব অর্থে মানুষ তার প্রমাণ হাতে হাতে হয়ে গেল ওর অসুস্থতায়। ভগবানের আশীর্বাদ যে পেয়েছে তার নাক দিয়ে নিশ্চয়ই রক্ত বের হবে না। এক ঝটকায় কঠিন বাস্তবে আছাড় খেল ঊর্মিলা।

নিরাময়ের গেটে তালা পড়ে গিয়েছিল। হর্ন বাজিয়ে শব্দ করে তালা খোলানো হল। ছোটবাহাদুর সায়নকে দেখতে পেয়ে ছুটে গেল ভেতরে। বড়বাহাদুর একটা স্ট্রেচার নিয়ে এল ভেতর থেকে। সায়নকে তার ওপর শুইয়ে কমলেন্দুর সাহায্য নিয়ে ভেতরে নিয়ে যেতেই ডাক্তার নেমে এলেন।

নন্দিনী কেঁদে উঠলেন সশব্দে, ওর নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।

ডাক্তার বললেন, ওকে ইমার্জেন্সি রুমে নিয়ে যাও।

সেখানে খাটের ওপর শুইয়ে কিছুক্ষণ পরীক্ষা করে ডাক্তার হাসলেন, ওয়েল সায়নবাবু, তুমি ঠিক আছ তো?

সায়ন মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

গুড। ডাক্তার অফিসঘরে চলে এলেন। রেজিস্টার বের করে নাম খুঁজলেন। তারপর ছোটবাহাদুরকে বললেন, বিষ্ণুপ্ৰসাদকে খবর দাও। চার্চের ওপর বাড়ি। বলবে এখনই রক্ত দিতে হবে।

ঊর্মিলা জিজ্ঞাসা করল, এখানে ব্লাড ব্যাঙ্ক নেই?

আমি টাটকা রক্ত ব্যবহার করতে চাই।

আমাদের রক্তে হবে না?

 আপনার কোন গ্রুপ?

ঊর্মিলা কমলেন্দুর দিকে তাকাল, আমি ঠিক–?

জেনে রাখা উচিত। প্রতিটি সভ্যমানুষের এটা অবশ্য কর্তব্য। ঠিক আছে, আসুন। আমি দেখে নিচ্ছি।

মিনিট পাঁচেক বাদে ডাক্তারের মুখে হাসি ফুটল, চমৎকার। আপনার রক্ত ওর কাজে লাগবে। শুয়ে পড়ন।

কমলেন্দু ইতস্তত করছিল, ওর কিন্তু মাস ছয়েক আগে জ্বর হয়েছিল।

তাতে কিছু হবে না। কী রকম জ্বর? ম্যালেরিয়া? তা হলে ঠিক আছে। মাস ছয়েকের মধ্যে কাউকে রক্ত দেননি তো?

না, ও কখনও ব্লাড ডোনেট করেনি।

করা উচিত ছিল। প্রতিটি সভ্যমানুষের করা উচিত।

রক্ত নেওয়ার পর বোতলটা উপুড় করে ফ্রিজের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে ডাক্তার বললেন, মিনিট দশেক শুয়ে থাকুন। বড়বাহাদুর, মেমসাহেবের জন্যে মিষ্টি আর দুধ নিয়ে এসো। সঙ্গে একটা ডিমের পোচ।

ঊর্মিলা আপত্তি করল, ও বাবা, আমি অত সব খেতে পারব না।

এখনও তো ডিনার করেননি। ভেবে নিন ডিনার করছেন। এখন বলুন তো হঠাই নাক থেকে রক্ত বেরিয়েছিল নাকি ও খুব পরিশ্রম করেছিল অথবা–। ডাক্তার কথা শেষ করলেন না। নন্দিনীর দিকে তাকালেন।

ওর এখন কিছু হবে না তো? নন্দিনীর গলা দুর্বল।

না। তবে প্রেসার খুব কমে গিয়েছে। প্রথম দিকে এরকম হত। ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন, ও কি কোনও বিষয় নিয়ে খুব ভাবছিল?

আমরা বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। ট্যুরিস্ট লজ থেকে ঝোরা পর্যন্ত। দুরত্ব খুব বেশি নয়। ও স্বচ্ছন্দে হেঁটে গিয়েছিল। ফেরার সময় এক ভদ্রলোক তাঁর গাড়িতে লিফট দেওয়ায় আর হাঁটতে হয়নি। কমলেন্দু বলছিল, তবে ওখানে গিয়ে ও একটা কাণ্ড করেছিল।

কী কাণ্ড?

ঝোরার পাশে পাহাড়ের গায়ে একটি মূর্তি রয়েছে, মাদার মেরির। তার সামনে যে মোমবাতি জলছিল সেগুলো বাতাসে নিভে গিয়েছিল। দু-একটা বেঁচে ছিল। আমাদের অলক্ষ্যে ও পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠে যায় মোমবাতি জ্বালতে।

সে কী? ডাক্তার অবাক, আপনারা দেখলেন না?

দেখামাত্র ওকে নিষেধ করি কিন্তু ও শুনতে চায়নি। কিন্তু যখন নেমে এল তখনও ও ঠিক ছিল। একটুও অসুস্থ মনে হয়নি। লজে ফিরে আমি আমার ঘরে চলে যাই। হঠাৎ কাকিমার চিৎকার শুনে।

নন্দিনী বললেন, ও ভালভাবেই বাথরুমে গেল জামা-প্যান্ট ছাড়তে। ফিরে এসে শুয়ে পড়ল খাটে। আমরা ওকে বিশ্রাম করতে দিয়ে বাইরে এসেছিলাম। কিছুক্ষণ পরে ঊর্মিলাকে ওর ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে ফিরে গিয়ে দেখি ও আবার জামা-প্যান্ট পরে তৈরি, নাকে রুমাল চেপে রেখেছে, বলল, ওকে এখানে নিয়ে আসতে।

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। ডাক্তার ঘড়ি দেখলেন। তারপর বললেন, ব্লিডিং বেশি হয়নি। যে রুমালটা ওর নাকে ছিল সেটাই প্রথম থেকে ব্যবহার করা হয়েছে?

নন্দিনী মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু খাটে শুয়ে ঊর্মিলা বলল, না। এটা দ্বিতীয় রুমাল।

প্রথমটা কি পুরো ভিজে গিয়েছিল?

না, আমি ঠিক, বুড়ো বেয়ারাটা নিয়ে গেল, আমি দেখতে পাইনি। নিচুগলায় কথাগুলো বলল ঊর্মিলা।

লোকটা নিয়ে গেল? ডাক্তার যেন ঠিক শুনতে পেলেন না, কী বললেন? রক্তে ভেজা রুমাল কেউ নিয়ে গেছে?

হ্যাঁ।

কেন?

ওর মেয়ের অসুখ। কিছুতেই নাকি কাজ হচ্ছে না। ওর ধারণা সানুর রক্ত ওর মেয়ের শরীরে ছোঁয়ালে সে ভাল হয়ে যাবে। ঊর্মিলা বলল।

মাই গড! ডাক্তার হতভম্ব। তাঁর মুখ লাল হয়ে গেল। খুব রেগে গিয়ে তিনি বললেন, আপনি এটা অ্যালাউ করলেন?

আমি কিছু বলার সুযোগ পাইনি। তার আগেই লোকটা ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল।

বাট হোয়াই? কেন? সায়নের রক্তে ওর এই বিশ্বাস হল কী করে?

 ঘর নিস্তব্ধ হল। ঊর্মিলা বা নন্দিনী চুপ করে রইলেন।

ডাক্তার রেগে যাচ্ছিলেন আরও, আপনারা চুপ করে আছেন কেন?

কমলেন্দু কথা বলল, আমি বলছি। এরা সবাই একইসঙ্গে এক ধরনের সম্মোহনে আক্রান্ত হয়েছে। কী করে সম্ভব হল আমি জানি না। আমি ওকে খুব বকেছি। কিন্তু একলা ও নয়, যেসব গাড়ি ওপর থেকে নামছিল তাদের ড্রাইভার প্যাসেঞ্জারদের এক্সপ্রেশন ওই একই কথা বলছে। তারাই লজে এসে রটিয়েছে। সেটা শুনেই বোধহয় ওই বুড়ো বেয়ারা উদ্বুদ্ধ হয়।

সম্মোহন। ব্যাপারটা খুলে বলুন তো?

 সানু তখন মোমবাতি জ্বালতে ওপরে উঠছিল। মেরির মূর্তির সামনে পৌঁছোতেই ওর শরীর নাকি আলোয় ভরে যায়। সে আলোর সোর্স নাকি মেরির মূর্তি। অথচ মূর্তির সামনে জ্বলা মোমবাতিগুলোর অধিকাংশ নিবে গিয়েছিল।

আপনি দেখেছেন? ডাক্তার সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন।

না। আমি কিছুই দেখিনি।

ডাক্তার ঊর্মিলার দিকে তাকালেন। সে তখন উঠে বসেছে, আপনি?

 ঊর্মিলা বলল, আমার ভুল হতে পারে। এটা তো সম্ভব নয় জানি। কিন্তু—

 ডাক্তার এবার নন্দিনীর দিকে তাকালেন, আপনি?

নন্দিনী সামান্য ইতস্তত করে বললেন, হ্যাঁ, আমি দেখেছি।

উনি যা বললেন, তাই দেখেছেন?

হ্যাঁ।

ডাক্তার বাঁ হাতে নিজের চিবুক ধরলেন, আমি ভাবতে পারছি না। এটা কি সম্ভব? কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে? নো। কখনওই হতে পারে না। অথচ অনেকে মিলে একই দৃশ্য দেখেছেন। তা হলে তো হয়েই গেল। ঈশ্বরের আশীর্বাদ পেয়ে গিয়েছে ও। মানুষের চিকিৎসায় ওকে না রেখে বাড়ি নিয়ে যান। লোকে জানতে পারলে হাজারে হাজারে ছুটে আসবে। সেন্ট অথবা বাবা হয়ে যাবে আপনার ছেলে। ডাক্তার একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন, আশ্চর্য!

নন্দিনী বললেন, আমরা ওকে নিয়ে যাব এ কথা কখন বললাম?

 কিন্তু আপনারা বিশ্বাস করছেন ওই ঘটনাটা?

তাও কি একবারও বলেছি।

ডাক্তার উঠে পড়লেন, অদ্ভুত। এ পাড়ায় মিস্টার ব্রাউন নামে এক ভদ্রলোক আছেন। অতিশয় ভাল মানুষ। সায়নকে ভালবাসেন। কিছুদিন হল তিনিও ওর সম্পর্কে যে-আগ্রহ দেখাচ্ছেন তা মহামানবদের সম্পর্কে দেখালে মানায়। আর এই মহামানব মানে সুভাষ বসুনয়, ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট যে সব বাবা বা ওই জাতীয় গুরু আছেন তাঁরা। একটা কথা–।

ছোটবাহাদুর এসে দাঁড়াল, বিষ্ণুপ্ৰসাদ এসেছে।

কে? ভাই বিষ্ণুপ্ৰসাদ, এদিকে এসো। ডাক্তার ডাকলেন।

কুড়ি একুশ বছরের যুবক ঘরে ঢুকে সেলাম করল।

ডাক্তার বললেন, খুব কষ্ট দিলাম তোমাকে। এত রাত্রে আবার অনেকটা যেতে হবে। আপনাদের সঙ্গে তো ট্যাক্সি আছে। ওকে পৌঁছে দিতে পারবেন?

নিশ্চয়ই। কমলেন্দু বলল।

 বিষ্ণুপ্রসাদ নেপালিতে বলল, এখনই খুন দিতে হবে?

না। এখন নয়। দরকার হলে কাল সকালে তোমাকে ডেকে পাঠাব। এই দিদির রক্তে আজ কাজ চলে যাবে মনে হয়।

যদি রাত্রে লাগে?

হ্যাঁ, সেটার সম্ভাবনা অবশ্য থাকছে।

আমি বিছানা নিয়ে এসে এখানে শুয়ে থাকব?

 বিছানা আনতে হবে না। তুমি খানা খেয়েছ?

জি।

ছোটবাহাদুর, তুমি বিষ্ণুপ্ৰসাদকে ওপরের একটা খালি ঘরে নিয়ে যাও। সেখানে খাট বিছানা আছে। ওখানেই ও থাকতে পারবে। কিন্তু তুমি এতটা কষ্ট করছ কেন বিষ্ণুপ্ৰসাদ? কাকে রক্ত দিতে হবে জানো?

জি।

কাকে?

সায়নকে। ও আমাকে দোস্ত বলে।

ডাক্তার মাথা নাড়তেই ছোটবাহাদুর বিষ্ণুপ্ৰসাদকে ডাকল। ওরা চলে গেলে অবাক হওয়া কমলেন্দু জিজ্ঞাসা করল, এরা কি রক্ত বিক্রি করে?

না। এরা পেশাদার নয়। আমার ডাকে সাড়া দিয়ে লোক্যাল মানুষেরা এগিয়ে এসেছে। তাদের নাম এবং ব্লাড গ্রুপ আমার কাছে রয়েছে। এদের সহযোগিতা ছাড়া আমি চিকিৎসা করতে পারতাম না। এরাই আমার কাছে ভগবান। ডাক্তার ফ্রিজ থেকে শিশি বের করে দেখলেন। এর মধ্যেই রক্তের বিভাজন হয়ে গিয়েছে। উনি ভেতরে চলে গেলেন।

এই সময় নন্দিনী কাঁদলেন। নিঃশব্দে। কিন্তু তাঁর শরীর কাঁপছিল।

কমলেন্দু ডাকল, কাকিমা! কী হয়েছে?

নন্দিনী নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করলেন। কমলেন্দু বললেন, ভয় পাবেন না। ডাক্তার তো বললেন ভয়ের কিছু নেই।

নন্দিনী কোনওমতে নিজেকে ঠিক করে বললেন, ওকে এখানে এত লোক ভালবাসে। ভাবলেই কীরকম আনন্দ হচ্ছে। ওঁর গলা ধরে গিয়েছিল।

.

১৬.

খবরটা কুয়াশার চেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে। পাড়ার ট্যাক্সিওয়ালা ভোরবেলায় ট্যাক্সি থামিয়ে একজনকে বলছিল কথাটা, সিমির কানে গেল। খুব অবাক হয়ে নিরাময়ের দিকে তাকাল সে। ভোরের ছায়ায় শীতে কুঁকড়ে আছে বাড়িটা। এমনকী তার বাগানের গাছপালাও মাথা নামিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। সায়নের মুখটা মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মিস্টার ব্রাউনের কথা। ব্রাউন ওকে খুব ভালবাসে। সিমি দৌড়োল। চড়াই ভেঙে হাঁপাতে হাঁপাতে ব্রাউনের দরজায় পৌঁছে দেখল ভুটো দরজা আগলে বসে আছে।

ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকে দেখল ব্রাউন মদের গ্লাস গুছিয়ে নিয়ে সবে বসেছেন। সে চিৎকার করল, তুমি এই সাতসকালে মদ গিলছ?

ব্রাউন হাসলেন, আমাকে কখনও এ সময়ে খেতে দেখেছিস?

বুড়ো হলে লোকে সব কিছু কমিয়ে দেয় আর তুমি! ছি ছি ছি। পাড়ার লোকজন এখনও বিছানা ছাড়েনি আর তুমি মদ গিলছ! মরে যাবে, বেশি দিন আয়ু নেই তোমার। পেট পচে মরে পড়ে থাকবে। চিৎকার করছিল সিমি।

আমাকে দোষ দিয়ে কোনও লাভ নেই। স্বয়ং ডাক্তার তামাং আমাকে এই প্রেসক্রিপশন দিয়ে গেছেন। ব্রাউন গম্ভীর হলেন।

ডাক্তার বলেছে ভোরবেলা উঠে মদ খেতে?

হ্যাঁ। বলেছে সকালে ঘুম থেকে উঠে যদি শরীর ঠিক না লাগে তা হলে এক পাত্র পেটে ঢালতে। সব ঠিক হয়ে যাবে।

আর তারপর থেকে ঘুম থেকে উঠেই তোমার মনে হয় শরীর খারাপ, তাই তো? ওই মদো মাতাল ডাক্তারটাকে এবার আমি আচ্ছা করে দেব।

ব্রাউন চোখ বন্ধ করলেন, সকালে তোর কোনও কাজকর্ম নেই?

তখন মনে পড়ল সিমির। চেয়ার টেনে বসল সামনে, কাল কী হয়েছে শুনেছ? এই মাত্র আমি শুনলাম, শুনে গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

কী ব্যাপার? ব্রাউন চোখ খুললেন। কাল বিকেলে ঝোরার কাছে মা মেরির মূর্তির পাশে উঠে দাঁড়িয়েছিল সায়ন। ভাবতে পারছ!

সায়ন। মানে–?

হ্যাঁ, নিরাময়ের সায়ন। তারপর নাকি ওর শরীরে অদ্ভুত কী সব হয়। সবাই দেখেছে মা মেরি ওর কাঁধে হাত রেখেছেন। আমি এই মাত্র শুনে এলাম। এই দ্যাখো আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। হাত প্রসারিত করল সিমি।

হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন ব্রাউন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, কার কাছে শুনেছিস এসব কথা?

জোসেফ। একটু আগে স্ট্যান্ড থেকে ট্যাক্সি নিয়ে এল। ওই বলল।

ব্রাউন খানিকক্ষণ সিমির মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে ভর্তি গ্লাস বেসিনে উপুড় করে দিলেন। ভাল করে হাত ধুয়ে যিশুর ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। মানুষটার এমন পরিবর্তন চুপচাপ দেখছিল সিমি। জোসেফের মুখে কথাটা শুনে সে চমকে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু কোনও মানুষকে যে মা মেরি জীবন্ত হয়ে আশীর্বাদ করতে পারেন এটা সে বিশ্বাস করতে পারে না। সেই যেবার এখানকার গণেশ ঠাকুররা দুধ খাচ্ছে বলে রটে গিয়েছিল এবং লোকে পাগলের মতো যেখানে যত গণেশ আছে দেখতে ছুটেছিল তখনও তার এ কথা মনে হয়েছিল। তারপর কাগজে যখন ও ব্যাপারের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বের হল তখন সবাই এমন চুপ মেরে গেল যে এ নিয়ে কোনও কথাই এখন কেউ বলে না। সায়নের ক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই ওই রকম কিছু হয়েছে। তবে কি না ছেলেটা তাদের পাড়ায় থাকে আর মিস্টার ব্রাউনের খুব স্নেহের পাত্র তাই সে ছুটে এসেছিল এখানে।

ব্রাউন তাঁর মোটা শরীর নিয়ে নিল ডাউন হয়ে যিশুর মূর্তি সামনের বসে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ প্রার্থনা করলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে এক পা বাড়িয়ে সিমির দিকে তাকিয়ে নির্মল বসলেন, লেটস গো।

সিমি প্রশ্ন করল, তুমি এখন ড্রিক করবে না?

না। এখন নয়।

তুমি মদ ফেলে দিলে?

ওটা তুলে রাখলে পরে খেতে খারাপ লাগত।

বাট হোয়াই? এখন কেন খেলে না?

কাছে আয়, বলছি। হাত বাড়ালেন ব্রাউন। সিমি একটু দ্বিধা নিয়েই কাছে এল। ব্রাউন তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ধর তোর খুব জ্বর এসেছে। গা হাত কামড়াচ্ছে। তখন কেউ তোকে বলল অমিতাভ বচ্চনের সিনেমা দেখতে যাবি কি না? গাড়ি করে নিয়ে যাবে। যাবি?

মাথা নাড়ল সিমি। না।

কিংবা ধর, তোর ল্যাট্রিনে যাওয়ার খুব প্রয়োজন। এই সময় পৃথিবীর বেস্ট খাবার তোকে সার্ভ করা হল, তুই খেতে পারবি?

না

ব্ৰাউন হাসলেন, চল, একটু হেঁটে আসি।

দরজা ভেজিয়ে দিয়ে সিমির পাশে কয়েক পা হেঁটে দাঁড়িয়ে গেলেন ব্রাউন, বাঃ। পৃথিবীটা কী সুন্দর!

সিমি দেখল রোদ উঠেছে। হালকা মোলায়েম রোদ। ঝকঝক করছে চারধার। আকাশ থেকে কুয়াশাদের কেউ যেন ঝেটিয়ে পার করে দিচ্ছে দুর পাহাড়ের ওপাশে। ব্রাউন বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ সিমি।

কেন? আমি কী করলাম।

তুই না এলে এমন একটা সকাল চোখের আড়ালে থেকে যেত। চেয়ে দ্যাখ, নিরাময়ের ওপর কী সুন্দর রোদ পড়েছে।

সিমি দেখল এক ফালি রোদ্দুর যেন টর্চের আলো হয়ে নিরাময়ের ওপর নেতিয়ে রয়েছে। ব্রাউনকে হাঁটতে দেখে সে অনুসরণ করল।

গেট খোলা। প্যাসেজে পা রাখতেই ব্রাউন দেখতে পেলেন একজন মহিলার সঙ্গে মিসেস অ্যান্টনি কথা বলছেন অফিসঘরের সামনে দাঁড়িয়ে। তাঁকে দেখতে পেয়ে মিসেস অ্যান্টনি বললেন, গুড মর্নিং মিস্টার ব্রাউন।

গুড মর্নিং মিসেস অ্যান্টনি। ভাল আছেন তো?

মিসেস অ্যান্টিনি মাথা নেড়ে সিমির দিকে তাকালেন, আরে তুমি। কী ব্যাপার। এই সকালে এখানে।

সিমি বলল, উনি এলেন, তাই–। আপনি এত সকালে ডিউটিতে আসেন?

না। আসলে গত রাতে আমি বাড়ি যেতে পারিনি।

কেন? কেউ কি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল? ব্রাউন জিজ্ঞাসা করলেন।

হ্যাঁ। সায়ন। সায়নকে তো আপনি খুব ভালবাসেন।

সায়ন! সে কী! সায়ন অসুস্থ? ব্রাউন হতভম্ব হয়ে গেলেন।

হ্যাঁ। ইনি সায়নের মা। মিসেস অ্যান্টনি নন্দিনীর দিকে তাকালেন, ইনি মিস্টার ব্রাউন। সায়ন ওঁকে খুব পছন্দ করে।

সিমি জিজ্ঞাসা করল, ও কখন অসুস্থ হয়েছে?

 মিসেস অ্যান্টনি বললেন, কাল রাত্রে।

 ব্রাউন জিজ্ঞাসা করলেন, এখন কেমন আছে?

 ভাল। কাল রক্ত দেওয়া হয়েছে। মোটামুটি ঠিক আছে এখন। তবে দুদিন বিছানা থেকে নামতে দেবেন না ডাক্তার।

ব্রাউন জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কী করে খবর পেলেন?

 প্রশ্নটা নন্দিনীর উদ্দেশে। তিনি বললেন, আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। ট্যুরিস্ট লজে আমার সঙ্গে থাকবে বলে গিয়েছিল। কী যে হল, হঠাৎ রক্ত পড়তে শুরু করল।

মিসেস অ্যান্টনি বললেন, যা হোক, এখন চিন্তা করার কিছু নেই। আপনি তো সারারাত জেগে ছিলেন। এখন ফিরে গিয়ে বিশ্রাম করুন।

নন্দিনী গেটের দিকে এগোলেন। কাল রাত্রে অনেক বলে কমলেন্দুদের ফেরত পাঠিয়েছিলেন তিনি।

এই সময় ট্যাক্সিটা এল। কমলেন্দু এবং ঊর্মিলা নেমে এল উদ্বিগ্ন মুখে। অবস্থা জেনে ওরা নন্দিনীকে নিয়ে চলে গেল। ব্রাউন চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলেন। মিসেস অ্যান্টনি এবার কিছুক্ষণের জন্যে তাঁর বাড়ি থেকে ঘুরে আসবেন। ব্রাউনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি সঙ্কোচে বললেন, আপনি কি ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করবেন?

না, না। তিনি নিশ্চয়ই এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। আচ্ছা, আমি যদি একবার চুপচাপ সায়নকে দেখে আসি তাহলে কি অনুমতি পাওয়া যাবে? অনুনয় করলেন ব্রাউন।

মিসেস অ্যান্টনি এক মুহূর্ত ভাবলেন। এই রকম অবস্থায় সায়নের কাছে কাউকে যেতে দেওয়া উচিত কিনা বুঝতে পারছিলেন না। ডাক্তারও কোনও নির্দেশ দিয়ে যাননি। তিনি ব্রাউনের দিকে তাকালেন। গত রাত্রের ঘটনাটা তিনিও শুনেছেন। শুনে পুলকিত হয়েছেন। কিন্তু সেই সঙ্গে মনে হয়েছিল যদি সায়ন স্বর্গীয় স্পর্শ পেয়ে থাকে তাহলে তার শরীর থেকে রক্ত বের হবে কেন! রক্ত দেওয়ার সময় ওর পাশে বসে তিনি একদৃষ্টিতে অনেক অনেক সময় তাকিয়ে ছিলেন। কখনও এক পলকের জন্যেও তার মধ্যে কোনও অলৌকিক কিছু দেখেননি। শেষ পর্যন্ত ধন্দে পড়ে গিয়েছেন তিনি। এখন ব্রাউনের দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হল যেতে দিলে সায়নের কি ক্ষতি হবে? উনি যদি কথা না বলেন, কোনও বিরক্ত না করেন।

এই সময় ডাক্তার নেমে এলেন। এই সকালেই স্নান করে নিয়েছেন। হেসে বললেন, গুড মর্নিং মিস্টার ব্রাউন। আপনার কথাই মনে হচ্ছিল। আরে, এ কী। আপনি এখনও বাড়ি যাননি মিসেস অ্যান্টনি?

এই তো, যাব ভাবছিলাম। সায়নের মা একা ছিলেন তাই।

ও, উনি কোথায়?

 ওঁর আত্মীয়রা ট্যাক্সি নিয়ে এসেছিল, উনি লজে চলে গিয়েছেন।

বেশ। আপনি যান। সারারাত জেগেছেন। আজ সকালে আর আসতে হবে না। লাঞ্চের পর এলেই চলবে। ডাক্তার অফিসরুমের দরজায় পৌঁছোলেন।

মিসেস অ্যান্টনি বললেন, তার দরকার হবে না। আপনি যদি ভোরবেলায় শুয়ে এখন কাজ শুরু রতে পারেন তা হলে আমিও পারব। আমি দশটার মধ্যেই চলে আসছি। বাই। মিসেস অ্যান্টনি চলে গেলেন। সিমিও তাঁর সঙ্গ নিল।

তাঁর যাওয়া দেখলেন ডাক্তার। তারপর বললেন, মিস্টার ব্রাউন ঈশ্বর বলে কোনও অস্তিত্ব আমি কখনও দেখতে পাইনি। তবে কখনও কখনও কোনও মানুষের আচরণ দেখে মনে হয় ঈশ্বর আর কত ভাল হবেন। আসুন, একটু অফিসঘরে বসে চা খাওয়া যাক।

চেয়ারে বসে ব্রাউন জিজ্ঞাসা করলেন, আমার কথা মনে হচ্ছিল কেন?

ডাক্তার হাসলেন, আপনি সায়নকে পছন্দ করেন কারণ ওর মধ্যে আপনি আপনার একেবারে নিজস্ব চিন্তাভাবনার প্রকাশ দেখতে চেয়েছেন। আপনি যিশুর সেবক। যিশুই আপনার সব। সায়নকে আপনার ভাল লাগার কারণ ওর মুখের সঙ্গে যিশুর মিল হঠাৎই আবিষ্কার করে ফেলেছেন। ঠিক তো?

ব্রাউন মাথা নাড়লেন, আপনি যখন বললেন এ সব আমার একেবারে নিজস্ব ভাবনাচিন্তা তখন এ নিয়ে আলোচনা করছেন কেন?

ওই কথায় আসি। আপনার কথা মনে এসেছিল তার কারণ- আচ্ছা, সায়ন সম্পর্কে আপনার ওই ব্যক্তিগত ধারণার কথা আর কজনকে বলেছেন?

কাউকে নয়!

মনে করে দেখুন।

কষ্ট করে মনে করতে হবে না।

ওই যে মেয়েটি আপনার সঙ্গে ছিল, ওর নাম সিমি, তাই তো?

হ্যাঁ। ওকে অবশ্য বলতে পারি। তবে ঠিক মনে করতে পারছি না। কিন্তু আপনি এসব কথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন?

তার কারণ কথা হাওয়ার আগে ছোটে। আপনি যেমন ওর মুখের সঙ্গে যিশুর সাদৃশ্য কল্পনা করেছেন তেমনি গতকাল বিকেলে ঝোরার সামনে বেশ কিছু লোক ওকে মাদার মেরির সামনে আলোকিত হয়ে দাঁড়াতে দেখেছে। পরে তারা ওকে অবতার মনে করে যে আচরণ করেছে তা ওর মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে বাধ্য। ফলে বেচারা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমার মনে হয়েছিল আপনার কথা শুনে কারও কারও ধারণা আরও বড় হয়েছে। একটা সূত্র থেকে যেমন গুজবের ডালপালা বেড়ে যায়, তেমনই। ডাক্তার গম্ভীর মুখে বললেন।

ব্রাউনের চোখ বড় হল, আপনি বললেন ওই দৃশ্য কিছু লোক দেখেছে। একজন লোক নন। এই লোকজন কারা? তাঁদের কাছে গিয়ে নিশ্চয়ই আমি আমার ভাবনার কথা বলিনি। আর একটা কথা, ঝোরার পাশে মাদারের মূর্তির কাছে সায়নের মতো অসুস্থ ছেলে কি একাই চলে গিয়েছিল?

না। ওর মা এবং আত্মীয়রা সঙ্গে ছিলেন?

 তাঁরা কিছু দেখতে পাননি?

ওর কাকা বলেছেন তিনি কিছুই দেখেননি, মা এ ব্যাপারে মুখ খোলেননি, কাকিমা নাকি মিসেস অ্যান্টনিকে জানিয়েছেন, তিনিও ওই সব দেখেছেন।

তা হলে তাঁকেও আমি প্রভাবিত করেছি বলে আপনার ধারণা?

না। এভাবে কথাটাকে নেবেন না। আসলে ওই রকম নির্জন জায়গায় মাদারের মূর্তির পাশে ফরসা রোগা ছেলেটিকে দেখে একটা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়ে গিয়েছিল ওদের মনে। এটাকে সম্মোহন বলা যায়। আমাদের মন এ রকম কিছু ঘটানোর জন্য তৈরি থাকে। পরিবেশ অনুকূল হলেই সেই মন বাস্তবে ঘটছে বলে ভেবে নেয়।

চা এল। নিজের হাতে কাপ এগিয়ে দিলেন ডাক্তার। নিজেরটা ঠোঁটে ছুঁইয়ে মৃদু চুমুক দিয়ে বললেন, এসব কথা বলছি কারণ ওই অলৌকিক ভাবনা চিরকালই মানুষের ক্ষতি করে এসেছে। আপনি দেখেছেন কিনা জানি না, চৈত্র বৈশাখের পিচগলা রাস্তায় এখনও বাঙালি মেয়েরা দণ্ডী কাটতে কাটতে যায় ওই অলৌকিক কিছু প্রাপ্তির আশায়।

সায়নের প্রতিক্রিয়া কী?

ওর সঙ্গে কথা বলিনি। ও খুব সেনসিটিভ ছেলে। যদি সত্যি ওর মাথায় ঢুকে যায় মাদার ওর শরীরে হাত রেখেছেন তা হলে ওকে বেশিদিন বাঁচাতে পারব না। মাদার মেরি নিশ্চয়ই চাইবেন না একটি অসুস্থ ছেলে তাঁর স্পর্শ পেয়ে মারা যাক। অথচ ব্যাপারটা সেই রকমই ঘটতে চলেছিল।

ব্রাউন নিজেকে সংবরণ করলেন, এখন কেমন আছে সে?

ক্রাইসিস কেটে গিয়েছে। ঠিক সময়ে রক্ত পেলে এবং সেই রক্ত যদি শরীর নিতে সম্মত হয়। তাহলে পরিস্থিতি সামলে নেওয়া যেতে পারে।

ডক্টর। আমি কি ওকে একবার দেখতে পারি?

 কাপ ঠোঁটে তুলতে গিয়েও থেমে গেলেন ডাক্তার, কেন?

জাস্ট। এমনই। ছেলেটিকে আমি পছন্দ করি, তাই।

তাহলে আমার কিছু বলার নেই। বেশ, যান। তবে দরজা থেকে দেখে ফিরে আসবেন, কথা বলবেন না! ডাক্তার বেল টিপলেন। বড়বাহাদুর দরজায় এসে দাঁড়ালে বললেন, ব্রাউন সাহেবকে ওপরে নিয়ে যাও।

ওপরে উঠছিলেন বেশ শ্লথ পায়ে। এতক্ষণ ডাক্তারের মুখে যেসব কথা শুনছিলেন সেটা তিনিও এককালে বলতেন। যুক্তি ছাড়া কোনও কিছুকেই আমল দিতেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুক্তি এবং বিশ্বাসের মধ্যে সারা পৃথিবী জুড়ে যে মারামারি চলছে তিনি তার মধ্যে জড়িয়ে গেলেন। যুক্তি, পাল্টা যুক্তি, কথার মারপ্যাঁচ এবং শেষ পর্যন্ত যে যেখানে পৌঁছোল সেখানে শুধুই শূন্যতা। কিন্তু দেখা গেল, বিশ্বাস তা যতই অন্ধ হোক, মন তা থেকে যে আরাম সংগ্রহ করে, তা জীবনের অনেক ঝড় সামলে নিতে সাহায্য করে। একটা ছোট জীবনে এর চেয়ে বেশি চাওয়া আর কী থাকতে পারে। সেই কারণে যা সত্যি তাকে কখনও কখনও মেনে নিতে মন অস্বীকার করে। এই যে এখন, যিশুর সামনে বসলেই তাঁর মন অপূর্ব শান্তিতে ভরে যায় সেটাকে তিনি অস্বীকার করবেন কী করে।

দরজায় পৌঁছে সায়নকে দেখতে পেলেন। দেওয়ালের দিকে পাশ ফিরে শুয়ে আছে। ওর মুখ দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। এই সকালে অসুস্থ বলে ঘুমিয়ে থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু ব্রাউনের খুব ইচ্ছে করছিল ওর মুখ দেখতে। গত রাত্রে যাকে রক্ত দেওয়া হয়েছে তাকে এখন ঘুম ভাঙিয়ে পাশ ফিরতে বলা অপরাধ। ডাক্তারও নিষেধ করেছেন কথা বলতে। কাঁধ অবধি কম্বলে ঢাকা তবু ব্রাউনের মনে হল ছেলেটা খুব রোগা। অথচ তাঁর এত বয়স হয়ে গেল, আজ বাদে কাল কবরে যাবেন তবু শরীরে মেদ মাংসের অভাব নেই। যদি এর কিছুটা ছেলেটাকে দেওয়া যেত।

বড়বাহাদুর পাশেই দাঁড়িয়েছিল, ইশারায় ফিরে যেতে বলল।

ব্রাউন হাত নেড়ে তাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে এক পা এগোলেন। তারপর হাঁটু গেড়ে মেঝের ওপর বসে দুটো হাত বুকের ওপর ধরলেন। চোখ বন্ধ করে তিনি মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগলেন। প্রার্থনার সময় যে সব শব্দ ব্যবহার করলে মনে শান্তি আসে, এক ধরনের শক্তি অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায় সেই সব শব্দ নীরবে উচ্চারণ করতে লাগলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত বললেন, তোমার স্পর্শে কুষ্ঠরোগী সেরে গিয়েছিল, তোমার দেখানো পথে হাঁটলে অন্ধকার দূরে সরে যায়। অসম্ভব বলে কোনও কিছুই তোমার সামনে মাথা তুলতে পারে না। তাহলে আমার বিনীত প্রার্থনা ওই ছেলেটিকে তুমি সুস্থ করে দাও। আমার সমস্ত প্রার্থনার বদলে এইটুকু আমি তোমার কাছে আশা করছি। কারণ আমার বিশ্বাস হয়েছে, এই ছেলেটির দ্বারা পৃথিবীর মানুষ উপকৃত হবে। তুমি তো মানুষের উপকার করতেই চাও। ব্রাউন পরম আন্তরিকতায় নীরবে শব্দগুলো উচ্চারণ করে চোখ খুলেই চমকে গেলেন। এর মধ্যে সায়ন কখন চিত হয়ে শুয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে তা তিনি টের পাননি। চোখাচোখি হতেই সায়ন বলল, গুড মর্নিং মিস্টার ব্রাউন।

গুড মর্নিং মাই বয়। কিন্তু তুমি কোনও কথা বোলো না। তোমার এখন বিশ্রামের প্রয়োজন। আমি পরে আবার আসব। ব্রাউন উঠে দাঁড়ালেন।

আপনি এই ঘরে বসে প্রার্থনা করছিলেন?

ওয়েল, ইয়েস, ইয়েস মাই বয়।

আপনি বরং আমার কপালে হাত রাখুন।

ব্রাউন আড়ষ্ট হয়ে দরজার দিকে তাকালেন। বড়বাহাদুর ক্রমাগত তাঁকে ইশারা করে চলেছে বেরিয়ে আসার জন্যে। কিন্তু ব্রাউন এগোলেন। ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে বললেন, কিন্তু আমার হাতে ইনফেকশন থাকতে পারে।

মাথা নাড়ল সায়ন। না। ব্রাউন দেখলেন প্রায় কাগজের মতো সাদা মুখে কমলালেবুর মত রোদ এক লহমার জন্যে খেলা করে গেল। তিনি দ্রুত হাত তুলে কপালে রেখেই বুঝতে পারলেন জ্বরে ওর সমস্ত শরীর পুড়ে যাচ্ছে। তিনি চটজলদি বাইরে বেরিয়ে এলেন। নীচে নেমে অফিসঘরে ঢুকে ডাক্তারকে বললেন, সায়নের টেম্পারেচার বেড়েছে। খুব জ্বর।

জ্বর। সে কী? আমি একটু আগে দেখে এলাম–! আপনি জানলেন কী করে? ডাক্তার বিস্মিত। পেছন থেকে বড়বাহাদুর বলল, ব্রাউন সাহেবকে সায়ন বলল কপালে হাত রাখতে।

ও। আপনার হাত পরিষ্কার ছিল তো?

ব্রাউনের মনে পড়ল এখানে আসার আগে বেসিনে মদের গ্লাস ঢেলে এসেছেন। অ্যালকোহল হাতে লাগলে ইনফেকসন হওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চয়ই কমে যায়। তিনি মাথা নাড়লেন।

ডাক্তার চলে গেলেন ওপরে।

মন খারাপ হয়ে গেল ব্রাউনের। এই অবস্থায় জ্বরের ধাক্কা ছেলেটা সামলাবে কী করে? যিশু কি তাঁর প্রার্থনায় কান দেবেন না? তিনি ডান হাতের আঙুলগুলো দেখলেন। উত্তাপ যেন এখনও আঙুলে লেগে রয়েছে। জ্বলছে। কিন্তু মানুষের শরীরে যত উত্তাপই আসুক স্পর্শ করার এতক্ষণ পরেও এই জ্বলুনি অস্বাভাবিক। এটা স্রেফ তাঁর মনের ভুল।

ডাক্তার ফিরে এলেন হাসিমুখে, আপনার কী হয়েছে মিস্টার ব্রাউন!

কেন? বৃদ্ধের ভারী মুখে ভাঁজ বাড়ল।

সায়ন একেবারে নর্মাল। ওর টেম্পারেচার আটানব্বইর বেশি কখনওই নয়। আর আপনি বললেন জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। নাকি এটাও মিরাকল! আপনি চলে আসামাত্র সে নর্মাল হয়ে গেল?

ওর শরীরে জ্বর নেই! অবাক হয়ে গেলেন ব্রাউন।

একদমই না।

কী আশ্চর্য! আমি এখনও আঙুলে টেম্পারেচার ফিল করছি।

আপনি আজ বাড়িতে বিশ্রাম করুন। আপনার বিশ্রামের দরকার। আর যদি সম্ভব হয় তা হলে আজ ড্রিঙ্কটা বাদ দিন। ডাক্তার হাসলেন।

সায়ন কী করছে ডাক্তার?

ঘুমোচ্ছে। আমি যে ওকে পরীক্ষা করলাম তা টেরই পেল না।

ঠিক আছে, আমি চলি।

ব্রাউন উঠে দাঁড়াতেই কঙ্কাবতীকে নিয়ে তার মা এল। সঙ্গে একটা স্যুটকেস নিয়ে এসেছে। ডাক্তার বললেন, ওয়েলকাম কঙ্কাবতী।

ব্রাউন মেয়েটিকে দেখে বুঝলেন ও অসুস্থ। এতদিন নিরাময়ে কোনও নেপালি মেয়েকে পেশেন্ট হিসেবে থাকতে দেখেননি। অর্থাৎ আর একটি মানুষের রক্তে মৃত্যু থাবা বসাতে চাইছে। মন খারাপ হয়ে গেল তাঁর। নিরাময়ের গেট দিয়ে বেরিয়ে রাস্তার পাশে খাদের ধারে পাথরের ওপর হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। আকাশে কোথাও মেঘ নেই। ঝকঝকে আলোয় চারধার পরিষ্কার। এমনকী কাঞ্চনজঙ্ঘাকেও তিনি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন। সাদা হয়ে গেছে ওখানকার বরফ। কী রকম বুড়ো বুড়ো দেখাচ্ছে। বুড়ো তো তিনিও হয়েছেন। এই যে তাঁর আঙুলগুলো, কীরকম চোখের ওপর বদলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে জ্বলুনিটা টের পেলেন তিনি।

এটা কী ভাবে হল। তিনি নেশা করেননি অথবা স্বপ্ন দেখেননি। ছেলেটার কপালে যখন হাত রেখেছিলেন তখন মনে হয়েছিল তপ্ত কড়ায় আচমকা আঙুল ছুঁয়েছে। ছ্যাঁক করে উঠেছিল তখন ওই অনুভূতিটা তো মিথ্যে নয়। তাহলে! আঙুলগুলো ঘষতে লাগলেন ব্রাউন। ঘষতে ঘষতে তার মনে হল হয়তো এসবই তাঁর কল্পনা। না হলে ডাক্তার জ্বর দেখতে পেতেন। তিনি কি মনে মনে চেয়েছিলেন সায়ন খুব অসুস্থ হয়ে থাক আর তাঁর প্রার্থনা ওকে সুস্থ করে তুলুক। সঙ্গে সঙ্গে মাথ নাড়লেন তিনি। নো, নেভার। এ রকম খারাপ চিন্তা তিনি করতেই পারেন না। কিন্তু আজ সকালে ছেলেটিকে দেখে তাঁর একবারও মনে হয়নি গতকাল ওকে নিয়ে একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটে গিয়েছে। আজ ও একদম সাধারণ ছেলে। তাহলে!

এ দাজু।

গলাটা কানে আসতেই ব্রাউন দেখতে পেলেন দুজন প্রৌঢ়া রমণী খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আর এরা নেপালি কিন্তু তাঁদের পাহাড়ের বাসিন্দা নয়। তিনি নেপালিতে জিজ্ঞাসা করলেন, বলুন, আপনাদের জন্যে কী করতে পারি?

আমরা তিনধারিয়া থেকে আসছি। ওই বাড়িটাই তো নিরাময়? একজন আঙুল তুলে বাড়িটাকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করল।

ঠিকই বলেছেন।

আচ্ছা, ওখানে এমন একজন থাকে, এই দিদি, তুই বল না!

দ্বিতীয়জন বলল, আজ সকালে শুনলাম মা মেরি নাকি ওই ছেলেটাকে ক্ষমতা দিয়েছেন। ছেলেটা নিরাময়ে থাকে। শুনেই আমরা চলে এসেছি। নামটা এক একজন এক একরকম বলছে। আপনি নিশ্চয়ই তাকে জানেন?

ব্রাউন এই ব্যাপারটা ভাবেননি। তিনি ভয় পেলেন। একবার নিরাময়ের দিকে তাকিয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কী চান?

আমার স্বামীর ক্যানসার হয়েছে। ডাক্তার বলেছে আর বেশি দিন নেই। ও মরে গেলে–। ডুকরে উঠলেন মহিলা মুখে ওড়না চাপা দিয়ে। অন্য প্রৌঢ়া বললেন, উনি যদি একবার দয়া করেন তাই আমরা এসেছি।

কীভাবে দয়া করবেন?

উনি যদি বলেন তাহলে জামাইবাবুকে নিয়ে আসতে পরি এখানে। উনি শুধু ছুঁয়ে দিলেই হবে। মাথা নেড়ে বললেন মহিলা।

আপনারা ভুল শুনেছেন। এটা একটা নার্সিংহোম। যারা খুব অসুস্থ তারাই এখানে চিকিৎসার জন্যে থাকে।

আপনি কী বলছেন! সবাই একসঙ্গে মিথ্যে কথা বলবে!

সবাই মানে?

আমরা এখানে এসে স্টেশনের স্ট্যান্ডে জিজ্ঞাসা করা মাত্র সবাই বলে দিল। ওরাও জানবে কী করে?

ভুল। ভুল রটেছে। যে ছেলেটি সম্পর্কে এটা রটেছে সে এখন খুব অসুস্থ। গত রাত্রে তাকে রক্ত দিতে হয়েছে। বুঝতেই পারছেন যাকে বাঁচাতে রক্ত দিয়ে হয় সে-কী করে অন্যের জীবন বাঁচাবে? কথাগুলো বলে ব্রাউন আর দাঁড়ালেন না। ধীরে ধীরে ওপরে উঠে এসে দেখলেন ভুটো সমানে লাফাচ্ছে এবং চিৎকার করে চলেছে। আর তাঁর বাড়ির দরজায় গোটা দুয়েক হনুমান চুপচাপ বসে আছে। তাঁকে আসতে দেখে হনুমান দুটো কয়েক লাফে সামনের গাছে উঠে বসল। ব্রাউন দেখলেন চারটে বড় বড় স্কোয়াশ দরজার সামনে পড়ে আছে। নিশ্চয়ই হনুমান দুটো পেড়ে এনেছে ওগুলো। তুলে দেখলেন সেগুলোয় ওরা দাঁত বসায়নি। রান্না করলে দিব্যি খাওয়া যাবে। ভুটোর অবশ্য নিরামিষ খাবারে বেজায় আপত্তি।

ভেতরে স্কোয়াশগুলো রেখে বেসিনে হাত ধুলেন তিনি। যে আঙুলগুলো জ্বলছিল সেগুলো জলের ধারার নীচে ধরলেন। আশ্চর্য! অস্বস্তিটা যাচ্ছে না। তোয়ালেতে হাত মুছে জুতো খুলে যিশুর ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। মোমবাতি নিবে গেছে। নতুন একটা জ্বেলে বাতিদানে রাখতেই যিশুর মুখ আলোকিত হল। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ খুব রাগ হয়ে গেল ব্রাউনের। কড়া গলায় বললেন, এসব কী হচ্ছে? তুমি কি আমার মাথা খারাপ করে দিলে! আমি তোমাকে হাজারবার বলেছি সুস্থ অবস্থায় ঘুমের মধ্যে আমাকে তোমার কাছে ডেকে নেবে। এ দিকে আমার কথা শুনে লোকে ভাবছে মাথা ঠিক নেই, বিশ্রামের দরকার। আমি ছেলেটার কপালে উত্তাপ দেখলাম। ভুল দেখলাম? তার আগে যে তোমাকে অত কথা বললাম তা কি কানে যায়নি! যাক গে, আমি চাই ছেলেটা সুস্থ হয়ে উঠুক। বলতে বলতে ব্রাউন দেখতে পেলেন মোমবাতি তাঁর একপাশে ঢলে পড়েছে। অন্যমনস্ক হয়ে ডান হাত বাড়িয়ে সেটাকে সোজা করতে গিয়ে তাঁর আঙুলে সলতের আগুন লেগে গেল। চকিতে হাত সরিয়ে নিয়ে তিনি চোখ বন্ধ করলেন। একটু পরে চোখ খুলে আঙুল প্রসারিত করলেন। না একটুও পোড়েনি, সামান্য মোম লেগেছে। গলা মোম সেঁটে গেছে। মোমটাকে সোজা করলেন তিনি। এবং তখনই বাইরের দরজায় শব্দ হল। ব্রাউন উঠলেন।

দরজা খুলে দেখলেন বড়বাহাদুর দাঁড়িয়ে আছে। তাঁকে দেখেই বলল, ডাকদার সাহাব আপনাকে এখনই একবার যেতে বললেন। কথাগুলো বলল নেপালিতে।

কেন? সায়নের কিছু হয়েছে।

না-না। অনেক লোক ভিড় করেছে আমাদের ওখানে। আপনি জলদি আসুন। বড়বাহাদুর চটপট চলে গেল।

অনেক লোক ভিড় করেছে। ব্রাউন এবার কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। দরজা বন্ধ করে এগোতে গিয়ে খড়গবাহাদুরকে দেখতে পেলেন। খড়্গবাহাদুর বলল, নমস্কার। আজ আপনার চিঠি আছে।

আমার চিঠি? ব্রাউন দাঁড়ালেন।

খড়গবাহাদুর এই পাহাড়ের পিওন। মাসের প্রথম দিকে তাঁর চিঠি আসে। ছেলেরা লেখে। এই সময় তাদের চিঠি আসার কথা নয়। রঙিন খামটা দেখেই বুঝলেন ওটা বিদেশ থেকে এসেছে।

চিঠি নিয়ে বললেন, তুমি তো নিরাময়ের সামনে দিয়ে এলে। সেখানে কিছু দেখতে পেলে?

 খড়্গবাহাদুর হাসল, অনেক লোক এসেছে। আপনাদের যিশু নাকি ওই নিরাময়ের ঘরে লুকিয়ে আছে। ভাগ্যিস যিশু, আমাদের হিন্দুদের কেউ হলে দেখতেন হাজার হাজার লোক এসে যেত।

খড়গবাহাদুর চলে গেল। খামটাকে পকেটে ঢুকিয়ে নীচে নামতে নামতে বাঁক ঘুরতেই তিনি অবাক হয়ে গেলেন, নিরাময়ের সামনে অন্তত পঁচিশ-তিরিশজন মানুষ দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে। তাদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে আসতে একটু হাঁপ ধরল। আজকাল দ্রুত হাঁটলেই এমন হয়। কাছে গিয়ে চিৎকার করলেন, কী ব্যাপার ভাইসব।

চিৎকার থামিয়ে লোকগুলো তাকাল। শহরের একজন চেনা লোক তাঁকে দেখে এগিয়ে এল, দেখুন না, এরা গেট বন্ধ করে দিয়েছে।

আপনারা কী চান?

সায়নকে দেখতে চাই। কাল মা মেরি ওকে আশীর্বাদ করে শক্তি দিয়েছেন। আপনি কি এ কথা শোনোননি? লোকটা চেঁচাল।

আপনাদের কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে?

 কেন?

সায়ন একজন হিন্দু। ওর বাবা-মা হিন্দু। মাদার মেরি যদি সত্যি কাউকে আশীর্বাদ করেন তবে খ্রিস্টানকেই করবেন, হিন্দুকে করতে যাবেন কেন?

লোকটা থমকে গেল। জনতার মধ্যে গুঞ্জন উঠল। অনেকের মনে হল কথাটার যুক্তি আছে। কিন্তু আর একজন বলে উঠল, মাদার মেরির কাছে এই ভেদাভেদ নেই। মানুষ তাঁর সন্তান। তিনি যে কোনও মানুষকেই আশীর্বাদ করতে পারেন।

ব্রাউন বললেন, আশ্চর্য! কোনও হিন্দুকে গির্জায় যেতে দেখেছেন। কোনও হিন্দু মন্দিরে যিশুর উপাসনা করতে দেখেছেন? ভাই, আপনারা যখন গণেশের দুধ খাওয়ার কথা শুনেছিলেন তখন হেসেছিলেন, ঠিক তেমনই এখন হিন্দুরা হাসবে। আমি সায়নকে চিনি। সে অসুস্থ। তার লিউকোমিয়া হয়েছে। গত রাত্রে তাকে রক্ত দিতে হয়েছিল। আপনারা যদি এখানে চেঁচামেচি করেন তা হলে তারই ক্ষতি হবে। সে একজন সহজ স্বাভাবিক ছেলে। আপনারা যা শুনেছেন তা সঠিক নয়। অতএব বন্ধুরা আমি যিশুর দোহাই দিয়ে বলছি আপনারা ফিরে যান। আপনারা প্রার্থনা করুন। ঈশ্বরকে ডাকুন, যিশুকে ডাকুন। দেখবেন তিনি আপনাদের মঙ্গল করবেন।

প্রায় মিনিট পনেরো বোঝানোর পর ভিড় হালকা হতে আরম্ভ করল। শেষ পর্যন্ত দু-তিনজন নাছোড়বান্দা মানুষ খানিকটা দূরে বসে রইল। তাদের দেখে বোঝা যায় জীবনে কোথাও তাদের জন্যে কিছু অপেক্ষা করে নেই।

ছোটবাহাদুর এবার নিরাময়ের গেট খুলল। ডাক্তার বেরিয়ে এলেন।

ব্রাউন বললেন, আশা করি আপনার মনে হয়নি আমি এদের জড়ো করেছিলাম।

ডাক্তার ব্রাউনের হাত ধরলেন, আপনি আমার কথায় আঘাত পেয়েছেন বলে আমি দুঃখিত। কিন্তু আপনি যেভাবে সমস্যার সমাধান করলেন তাতে আমি কৃতজ্ঞ। এ কী ঝামেলা হল বলুন তো!

আমি কীভাবে সমস্যার সমাধান করলাম? অত্যন্ত অন্যায় কথা বলে করলাম। হিন্দু-খ্রিস্টান সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিলাম। দেখলেন, কেউ প্রতিবাদ করেছিল কিন্তু কথাটা যাদের মনে ধরল তাদের কি মানুষ বলা যায়! আমি যে কথাটা বললাম, আমি কোন ধরনের মানুষ? অথচ আমার মাথায় অন্য কোনও চিন্তা এল না, কোনও পথ পেলাম না। নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে। ব্রাউন উত্তেজিত।

কিন্তু আপনি একটা সত্যের গায়ে মিথ্যের অলঙ্কার পরতে দেননি।

ডক্টর কোনটে সত্যি কোনটে মিথ্যে তাই তো আমি জানি না। আমি সায়নের কপালে প্রচণ্ড উত্তাপ দেখেছিলাম ডক্টর। আপনি সেটাকে মনের ভুল বলেছিলেন। অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমি মেনে নিয়েছি আপনার কথা। কিন্তু এখান থেকে বেরিয়েও হাতে সেই উত্তাপের জ্বলুনি অনুভব করেছি। ব্রাউন হাতটা তুলতে তুলতে আবিষ্কার করলেন সেই জ্বলুনিটা আর নেই। খানিকটা অবাক হয়ে তিনি দেখলেন তখনও শুকনো মোমের প্রলেপ আঙুলে লেগে আছে।

এই সময় ট্যাক্সিটাকে উঠে আসতে দেখা গেল। নিরাময়ের সামনে ট্যাক্সি থামতেই নন্দিনী কমলেন্দু এবং ঊর্মিলা নেমে এলেন।

নন্দিনী জিজ্ঞাসা করলেন, ও কেমন আছে এখন?

ভাল। বেশ ভাল। লম্বা ঘুম দিচ্ছে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি চলে এলেন কেন আপনি? সারারাত জেগেছিলেন–! ডাক্তার বললেন।

কমলেন্দু বলল, আমরা খুব বিপদে পড়েছি ডক্টর। ট্যুরিস্ট লজে প্রচুর লোক এসে জিজ্ঞাসা করছে ছেলেটা কোথায় গেল। ওদের কেউ কেউ এর মধ্যে আপনার নিরাময়ের ঠিকানাও জোগাড় করে ফেলেছে। ওদের ধারণা সানু, মানে সায়ন, মির‍্যাকল করতে পারে। এই সব অন্ধ লোককে বুঝিয়েও পারিনি। ভয় হচ্ছে, ওরা এখানে চলে আসবে।

ডাক্তার বললেন, আপনারা ভেতরে আসুন।

ওঁরা ভেতরে চলে গেলে ব্রাউন বাড়ির দিকে ফিরলেন। হঠাৎ চিঠির কথা মনে পড়তেই তিনি খামটা বের করলেন। ‘ডিয়ার ব্রাউন। হঠাৎ আমার চিঠি পেয়ে তুমি খুব অবাক হবে। আমাকে তোমার মনে আছে? আজ থেকে তিরিশ বছর আগে, আটষট্টি সালের শেষ, লস এঞ্জেলেসে তোমার সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। তোমাদের জাহাজ কয়েকদিনের জন্যে এখানে থেমেছিল। তোমার সঙ্গে আমার আলাপ হয়। তুমি ঠিকানা দিয়েছিলে। আমি বলেছিলাম, আবার দেখা হবে। এতদিন সময় পাইনি। শুধু চিঠি লিখে আমি যোগাযোগ রাখতে চাইনি। এখন আমি একবারে একলা। কারও কোনও সমস্যা আমার সঙ্গে জড়িয়ে নেই। তাই ভাবছি ভারতবর্ষে যাব। আর ভারতবর্ষে গেলে তোমার সঙ্গে দেখা করব। তুমি, মনে আছে, খুব ভদ্র ব্যবহার করেছিলে। তাই তুমি তোমার বাড়িতেই থেকো। আমি দেখা করব। লিজা। তারপর আর কয়েকটা লাইন। এই চিঠি যাকে লিখছি তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল তিরিশ বছর আগে। এমন হতে পারে তিনি আজ নেই। যদি না থাকেন, এ চিঠি যিনি পাবেন তিনি কলকাতা শহরের গ্র্যান্ড হোটেলে আমার নামে আগামী একমাসের মধ্যে একটা খবর রেখে দিলে কৃতজ্ঞ হব।‘

তারিখটা দেখলেন ব্রাউন, আগামী কাল একমাস পূর্ণ হবে।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার