সদানন্দ হকচকিয়ে গেল। বৃদ্ধার মুখ গম্ভীর। বয়সের আঁচড়ে সেই মুখের অনেকটাই ক্ষতবিক্ষত কিন্তু গলার স্বর দৃঢ়তা হারায়নি, মুখে গাম্ভীর্য অটুট। সে নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, কী হবে?

তোমার বয়সে ঠিকুজি দিয়ে কী হয় তা যদি না বুঝতে পার। কথা শেষ না করে বৃদ্ধা কাঁধ ঝাঁকিয়ে সোজা হয়ে বসতে চেষ্টা করলেন, তোমার মাকে বললেই হবে। তাকে গিয়ে বলো।

আপনি যদি আমার বিয়ের কথা ভাবেন তাহলে ঠিকুজি নিয়ে কোনও কাজ হবে না। এই মুহূর্তে আমার ওসব চিন্তা নেই।

তোমার চিন্তা নেই? তোমাকে চিন্তা করতে কেউ বলেছে নাকি? এই বাড়িতে আমি, আমরা চিন্তা করি, আমাদের বয়সে এলে তোমরা করবে। যাও। বেশি কথা বলতে আজকাল আর ভাল লাগে না। বড়মা কথাগুলো বলতে বলতে হাত নাড়তেই আতরবালা এগিয়ে এল দু পা। যেন সদানন্দ বেরিয়ে গেলেই সে দরজা বন্ধ করে দেবে।

সদানন্দ সেই আগ্রহ দেখাল না। সে জিজ্ঞাসা করল, আমি পরিশ্রম করছি। আমাদের জন্যে বরাদ্দ ঘর থেকে ব্যবসা করছি, এ ব্যাপারে আপনার কোনও আপত্তি নেই তো? যদিও আমি কোনও অন্যায় করছি না তবু আপনার মতামত নেওয়া জরুরি বলেই জানতে চাইছি।

বড়মা বললেন, এ বাড়ির বাবুরা এককালে ব্যবসা করত। বউ হয়ে এসে শুনেছি এদের জাহাজের ব্যবসা ছিল। একবার আমার শ্বশুরমশাইয়েরর বাবা সাহেবদের কাছ থেকে একটা জাহাজ ভাড়া নিয়েছিলেন। সেই জাহাজে লবঙ্গ দারুচিনি আসছিল। হল কী, গঙ্গায় ঢোকার সময় কীসের সঙ্গে ধাক্কা লেগে জাহাজটা ডুবে যায়। ইনি তখন সাহেবদের কাছ থেকে নামমাত্র টাকায় ডোবা জাহাজ কিনে নেন। সেই জাহাজ তোলার পর দেখা গেল বাক্সভর্তি রানির টাকা। সেই টাকা তুলে এনে এ বাড়ির ছাদে শুকোনো হয়েছিল। দশটা লোক পাহারা দিত যাতে ওই টাকা না উড়ে যায়। সে যে কত টাকা তার ঠিক হিসেব নেই। যারা পাহারায় ছিল তারা যা চুরি করেছে তাতেই দেশে ফিরে গিয়ে বড় বড় বাড়ি তুলেছে। ওই হল ব্যবসা। কত দূরদৃষ্টি থাকলে তবে লোকে ডুবোজাহাজ কেনে। সেই থেকে এ বাড়ির ছেলেরা ব্যবসা করে আসছে। চাকর হওয়ার জন্যে কেউ এ বাড়িতে জন্মায় না। তাই বলে ভিখিরিদের গায়ে গা মিলিয়ে ব্যবসা করার মতো নীচে কেউ নামেনি।

এত বড় বক্তৃতা শোনার পর সদানন্দ জিজ্ঞাসা করল, আমি সেটা করছি বলে আপনার মনে হচ্ছে?

তুমি কী করছ তা আমি জানব কী করে? আমি কি এই ঘর থেকে বের হই? তবে পাঁচজনে যদি বলে তবে তারা তো দেখেশুনেই বলে।

সদানন্দ ঠোঁট কাঁমড়াল। তারপর বলল, পাঁচজন প্ল্যান করে ছাগলকে কুকুর বলেছিল। আমি আশা করব সেই বোকা বামুনের মতো আপনি ভুল করবেন না।

নমস্কার করে সদানন্দ বেরিয়ে এল। একটু উত্তেজিত বলে সে অন্যমনস্ক ছিল। হঠাৎ ঘোরানো সিঁড়ির বাঁকে পৌঁছোতেই নিজের নাম শুনতে পেয়ে ফিরে তাকাল। এ বাড়ির গন্ধরাজ দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর দরজায়। পরনে কাজ করা পাঞ্জাবি আর দামি লুঙ্গি। এ বাড়িতে কেউ লুঙ্গি পরে না, ইনি ব্যতিক্রম।

ঝামেলায় পড়েই মনে হচ্ছে? গন্ধরাজ হাসলেন।

না। বলুন।

মুখে না বললে কী হবে, মুখ অন্য কথা বলছে। আমি তোমার বাবার বয়সী। তোমাকে একটি উপদেশ দিচ্ছি। তুমি যদি সমুদ্রের ধারে যাও, দেখবে একের পর এক ঢেউ তীরে আছড়ে পড়ছে। সেই ঢেউয়ের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়াতে চাইলে তুমি বেদম আছাড় খাবে, হাত-পা ভাঙতে পারে। কিন্তু ঢেউ যখন মাথার কাছে আসবে তখন ডুব দাও, ঢেউ মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাবে, তোমার কিস্যু হবে না। গন্ধরাজ আবার হাসলেন, উপেক্ষা করো, এসব উপেক্ষা করো।

কথাটা মনে ধরল সদানন্দর। কে কী বলছে তা কানে না নিলেই হল। সে অন্যায় করছে না, কারও অনুগ্রহ চাইছে না, অতএব নিজে যা ভাল মনে করছে তা করতে অসুবিধে কোথায়?

আপনি কি কিছু বলবেন?

তুমি তো গাড়ি কেনাবেচা কর। টাকার দরকার হয় না?

তার মানে?

ব্যবসা করতে গেলে তো টাকার দরকার হয়। সে রকম হলে কী কর?

আমাদের যতটুকু ক্ষমতা তার মধ্যেই কাজ করি।

এই জন্যে বাঙালির কিছু হল না। ক্ষমতার বাইরে গিয়ে ক্ষমতাকে ধরতে হবে হে। ব্যবসা বাড়াও। আরও গাড়ি কিনে বিক্রি করো।

সদানন্দ হাসল, টাকা পাব কোথায়?

হ্যাঁ। এতক্ষণে ঠিক প্রশ্নটা করলে। টাকা পেতে হলে টাকা দিতে হয়। তোমার যদি টাকার দরকার হয়, তা ধর হাজার পঞ্চাশেক, আমি ধার দিতে পারি। থ্রি পার্সেন্ট ইন্টারেস্ট পার মান্থ। দু মাসে তুমি ফিফটি পার্সেন্ট লাভ করলে আমাকে সিক্স পার্সেন্ট দিতে নিশ্চয়ই আপত্তি করবে না। অনেস্ট প্রপোজাল। মাথায় রেখো। গন্ধরাজ ঘুরে দাঁড়ালেন।

সদানন্দ তড়িঘড়ি জিজ্ঞাসা করল, আপনার শর্তগুলো যদি বলেন?

গন্ধরাজ মাথা দোলালেন, ব্যবসা করছ যখন তখন ব্যবসায়ীর মতো কথা বলো। খুড়ো-ভাইপোর সম্পর্ক সেখানে অচল। দরকার যখন পড়বে খবর দিও, তোমার ওই নতুন আপিসে গিয়ে শর্তগুলো বলব। গন্ধরাজ চলে গেলেন।

সদানন্দ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এই লোকটি এই বাড়ির মানুষদের থেকে একটু আলাদা। সবাই যেমন ওঁকে এড়িয়ে চলে উনিও কারও সঙ্গে মেশেন না। বিয়ে করেননি, সন্ধের পর ঘরে বসে নেশা করেন, একা থাকেন এবং প্রায়ই ওঁর কাছে যেসব কাজের মেয়ে কাজ করে তারা চাকরি ছেড়ে দেয়। রবিবারে রবিবারে গন্ধরাজকে ঝি খুঁজতে রাস্তায় বের হতে দেখা যায়। এই নিয়ে যেমন হাসাহাসি তেমন ঘেন্নাও আছে। কিন্তু লোকটাকে আজ খারাপ লাগল না সদানন্দর। অযৌক্তিক কথা কিছু বলেনি।

তোর চা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ঘরে ঢোকামাত্র বাদল বলল।

সদানন্দ দেখল বাদলের সামনে খালি চায়ের কাপ আর ডিশ। তার চায়ের কাপ প্লেট দিয়ে ঢাকা। পাশের ডিশে গোটা চারেক কচুরি এবং তরকারি। চেয়ার টেনে বসে দ্রুত সেগুলো গলায় চালান করে দিতে দিতে সে জিজ্ঞাসা করল, বাদল, একটা উপকার করবি?

কবে করিনি? বাদল একটা সিগারেট বের করে দু-আঙুলে মাথা টানতে লাগল।

তোর জানাশোনা ভাল জ্যোতিষী আছে যে ঠিকুজি বানাতে পারে।

সর্বনাশ। না, নেই।

তাহলে আর হল না।

দুর! জানাশোনা করে নিতে কতক্ষণ। কেসটা কী?

আমার একটা ঠিকুজি বানাতে হবে।

তোর? ছেলেবেলায় কেউ করায়নি?

করিয়েছিল। সেইটে ফেলে দিয়ে নতুনটা রাখতে হবে।

খুলে বল। নিজেকে টিউব লাইট বলে মনে হচ্ছে। বাদল খুব গম্ভীর মুখে বলল, মেয়েদের ঠিকুজি চেঞ্জ করা হয় বলে শুনেছি, ছেলেদের এই প্রথম শুনলাম।

সদানন্দ বলল, আমি তোর সঙ্গে ইয়ার্কি মারছি না বাদল। আমার এমন একটা ঠিকুজি করতে হবে যাতে মনে হবে আমার কোনও ভবিষ্যৎ নেই। সাতাশ-আঠাশ বছরে ভয়ঙ্কর অ্যাকসিডেন্ট হবে, বেঁচে গেলে তিরিশ বছরে অবধারিত মৃত্যু। মরার আগে যা-কিছু বিষয়সম্পত্তি আছে তা জুয়ো খেলে উড়িয়ে দেব। যার সঙ্গে আমার বিয়ে হবে তার বিধবা না হয়ে উপায় নেই।

বাদল খানিকক্ষণ চেয়েছিল সদানন্দের মুখের দিকে। এবার তার মুখ হাসি হাসি হল, বুঝেছি। হয়ে যাবে।

কী বুঝেছিস?

তোর বিয়ের সম্বন্ধ হচ্ছে কিন্তু তুই সেটা চাইছিস না। কী কপাল তোর, এই বয়সেই পাবলিক বিয়ের সম্বন্ধ করছে আর আমার দিকে কোনও মেয়ে ভুল করেও তাকায় না। কিন্তু গুরু, অরিজিন্যাল ঠিকুজিটা দাও, নকল করতে হলে ওটার হেল্প লাগবে।

ঠিক পারবি তো?

তুই ভাবিস না, অ্যাকসিডেন্ট কী, তোর এইডস হবার সম্ভাবনা আছে এমন কথাও লিখিয়ে নেব।

ইয়ার্কি মারিস না, আমার জন্মাবার সময় এইডসের নাম কেউ শোনেনি। কথাটা বলেই সদানন্দ দেখল দরজায় একজন এসে দাঁড়িয়েছেন। ও উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আসুন, আসুন ফুলকাকু। কোনও দরকার আছে?

ভদ্রলোক একটু ইতস্তত করলেন, হ্যাঁ, মানে, তোমার কাকিমার কাছে শুনতে পেলাম তুমি দার্জিলিং যাচ্ছ?

সদানন্দ মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, ওই ব্যবসার ব্যাপারেই।

ভদ্রলোক বললেন, আসলে আমরা সায়নকে লিখেছিলাম ওকে দেখতে যাব। কিন্তু এখানে এত ঝামেলায় পড়েছি যে সময় বের করা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বলছিলাম কী—!

ভদ্রলোককে থামতে দেখে সদানন্দ বলল, আমি তো কাকিমাকে বলেছি যদি কিছু দেওয়ার থাকে আমাকে দিলে পৌঁছে দেব। ওকে দেখতে আমারও খুব ইচ্ছে করছে। আমার সঙ্গে বেশ ভাব ছিল।

তোমার টিকিট কাটা হয়ে গিয়েছে?

না। আমি রকেট বাসে যাব।

রকেট বাসে? খুব কষ্ট হবে না?

বাদল এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল, এবার বলে উঠল, আমাদের কষ্ট হবে না।

না, আমি ভাবছিলাম, তোমার কাকিমাকে যদি সঙ্গে পাঠানো যায়!

অসম্ভব। সদানন্দ মাথা নাড়ল, ওঁর খুব কষ্ট হবে।

ভদ্রলোক মাথা নেড়ে দরজা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে সদানন্দ বলল, এ বাড়ির লোকজন একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে।

বাদল ভ্রূ কোঁচকাল, কী ব্যাপার?

সদানন্দ বলল, বুঝতে পারছি না। এ বাড়ির ইতিহাসে এরকম ঘটনার কথা কেউ শোনেনি। যতই বয়সে বড় হোক, কাকিমা তো যাকে বলে বুড়ি হয়ে যায়নি। আমার সঙ্গে যাচ্ছেন জানলে এ বাড়িতে প্রলয় হয়ে যাবে।

বাদল বলল, কিছু মনে করিস না, তোদের এই বাড়িটা এখনও মধ্যযুগে বাস করছে। সমস্ত কলকাতার থেকে আলাদা।

ঠিকই। শুধু আমাদের এই বাড়ি নয়, যাদের সঙ্গে আমাদের বিয়ে-থা হয় সেই কয়েকটা বাড়িরও একই দশা। আর জ্ঞাতিদের মধ্যে যারা আজকের আবহাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়েছে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা হয় না। কাকিমা না গেলেও সায়নকে দেখে আসব। সদানন্দ বলল।

ব্লাড ক্যানসার হলে মানুষ বাঁচে না, ও কিন্তু এখনও লড়ে যাচ্ছে।

হুঁ। ওর লড়াই মানে ফুলকাকুর শেষ হয়ে যাওয়া। যাক গে, তুই আজই আমার ঠিকুজির ব্যবস্থা কর। বাইরে যাওয়ার আগে ডুপ্লিকেটটা মায়ের আলমারিতে রেখে যাব। তুই একটু ওয়েট কর, আমি অরিজিন্যালটা নিয়ে আসছি। সদানন্দ বেরিয়ে গেল।

.

পাঁচদিন বন্দী থাকার পর টুপুর স্নান করে যখন শোওয়ার ঘরে এল তখন সমরেন্দ্রনাথের মনে হল মেয়েটার মুখের চেহারা বদলে গিয়েছে। সেই ছটফটে চপল স্বভাবের মেয়েটা এখন বড় বেশি গম্ভীর। স্কুলে খবর দেওয়া ছিল না। মুক্তির পর যখন সমরেন্দ্রনাথ ওকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন টুপুরের ব্যাগে তাঁর লেখা অসুস্থতার কারণে অনুপস্থিতি মকুবের জন্যে আবেদনপত্র রয়েছে। ওদের স্কুলে বড় কড়াকড়ি। অকারণে ছুটি নেওয়া প্রিন্সিপ্যাল পছন্দ করেন না। সৌদামিনী উদাস গলায় বলেছিলেন, কী হয়েছিল তা কাউকে বলার দরকার নেই। বলবে শরীর খারাপ হয়েছিল। মেয়েরা ওই কথা বললে সবাই বুঝে নেয়।

সাতসকালে সমরেন্দ্রনাথ মেয়েকে নিয়ে নীচে নেমে এলেন। এখন টুপুরের পরনে স্কুলের ইউনিফর্ম, হাতে বইয়ের ব্যাগ। কদিন আগে স্কুল থেকে ফেরার সময় দুটো স্ট্র্যাপ দুই কাঁধে ঢুকিয়ে ব্যাগটাকে পিঠে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল বলে সৌদামিনী খুব বকেছিলেন। বকুনির কারণটা কিন্তু তিনি স্পষ্ট করেননি। টুপুর জানতে চাইলে হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলেছিলেন, এ মেয়ের কী হবে?

বাড়ি থেকে বেরুবার সময় সমরেন্দ্রনাথ পাঁড়েজিকে দেখতে পেলেন, হাতে একটা কাগজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সমরেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার?

পাঁড়েজি কাগজ এগিয়ে দিতে সমরেন্দ্রনাথ পড়লেন, এতদ্বারা এই বাড়ির সমস্ত শরিককে জানানো হইতেছে যে বাড়ি সংক্রান্ত কিছু সমস্যা উদ্ভূত হওয়ায় এবং তাহা সমাধানের জন্যে আজ বেলা বারোটায় মায়ের মন্দিরে একটি জরুরি সভার আয়োজন হইয়াছে। প্রতিটি পরিবারের কর্তাদের সেই সভায় উপস্থিত থাকিতে অনুরোধ করা হইতেছে। নীচে ন’বাবুর সই। এই বাড়ির ট্যাক্স বা ওই জাতীয় বিষয় দেখাশোনার দায়িত্ব ন’বাবুর ওপর দেওয়া আছে। সমরেন্দ্রনাথ ভেবে পেলেন না হঠাৎ এমন কী সমস্যা দেখা দিল যে আজই সভা ডাকতে হচ্ছে?

কাগজটা ফেরত দিয়ে কয়েক পা হাঁটতেই পেছন থেকে ডাক ভেসে এল, এই টুপুর।

সমরেন্দ্রনাথ দেখলেন মেয়ে পেছন ফিরল এবং তার মুখে এখন হাসি ফুটেছে। বাইক চালু করে সদানন্দ পাশে এসে দাঁড়াল, কদিন দেখতে পাইনি কেন? তোর স্কুলের বাস দাঁড়াচ্ছে আর চলে যাচ্ছে।

সমরেন্দ্রনাথ বললেন, হ্যাঁ, স্কুল কামাই হয়ে গেল। অসুস্থ হয়েছিল।

সঙ্গে সঙ্গে টুপুর বলল, শরীর খারাপ হয়েছিল।

সদানন্দ বলল, এই, আজ আমি দার্জিলিং যাচ্ছি। তোর জন্যে কী নিয়ে আসব বল। বলে ফ্যাল।

সমরেন্দ্রনাথ সঙ্কুচিত হলেন, না, না, ওসবের কী দরকার।

টুপুর জিজ্ঞাসা করল, দাদাভাই, দার্জিলিং-এর কাছেই সানুদা থাকে, তাই না?

সদানন্দ মাথা নাড়ল, হ্যাঁ রে। আমি ওর কাছেও যাব।

সত্যি? চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল টুপুরের। তারপর ব্যাগ খুলে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করল, এই চিঠিটা সানুদাকে দিয়ে দেবে?

নিশ্চয়ই। সদানন্দ কাগজটা নিল।

সমরেন্দ্রনাথ বললেন, সদু, ওর বাস চলে যাবে, আমরা যাচ্ছি।

আজ আমি ওকে স্কুলে পৌঁছে দেব?

 তুমি? না-না। স্কুলের বাস তো আসছে। চল। সমরেন্দ্রনাথ এগিয়ে গেলে টুপুর বাধ্য হল তাঁকে অনুসরণ করতে। কয়েক পা হাঁটার পর সমরেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি চিঠিটা কখন লিখলে?

কালকে।

হঠাৎ সানুকে চিঠি লিখলে?

সানুদা আমাকে চিঠি দিয়েছিল।

ও হ্যাঁ। তা চিঠি পোস্ট না করে ব্যাগে নিয়ে বেরিয়েছিল কেন? ওটা কাউকে দিয়ে পোস্ট করানো উচিত ছিল।

টুপুর জবাব দিল না। চিঠিটা সে ব্যাগে রেখেছে আজ। তারপর আর খেয়াল ছিল না। কিন্তু বাবার কথা শুনে তার মনে হচ্ছিল সদুদাকে চিঠিটা পৌঁছে দিতে বলাটা পছন্দ হয়নি।

সমরেন্দ্রনাথের অস্বস্তি তবুও গেল না। বাসস্টপে পৌঁছে তিনি বললেন, তুমি এখনও বড় হওনি। কতগুলো জিনিস এই সময় শেখা দরকার। যেমন ধর, কোনও চিঠি লিখলে মা বা আমাকে পড়িয়ে দেখে নেবে ভুল হয়েছে কি না।

মা তো পড়েছে। কোনও ভুল ছিল না।

অ। সমরেন্দ্রনাথ গম্ভীর হয়ে গেলেন।

স্কুলবাসে ওঠামাত্র চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। টুপুরদের ক্লাসের পাঁচটা মেয়ে ওই বাসে যায়। বেশ কয়েকদিন পরে ওকে দেখতে পেয়ে বন্ধুরা হইহই করতে লাগল। সুভদ্রা জিজ্ঞাসা করল, কী হয়েছিল রে তোর? একদম বলাকওয়া নেই ডুব মারলি? কোথাও চলে যেতে হয়েছিল?

অঙ্গনা চোখ ঘোরাল, তুই নিশ্চয়ই তোর সেই সানুদার কাছে গিয়েছিলি। এখন কেমন আছে রে?

টুপুর গম্ভীর মুখে বলল, আমি কোথাও যাইনি।

তাহলে? কামাই করলি কেন?

 আমার ইচ্ছে। সে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল।

বন্ধুরা কথাটা পছন্দ করল না। এই সময় বাসটা গতি কমিয়ে দিল আর একটি মেয়েকে তোলার জন্যে। তখনই মুঠো পাকানো কাগজটা জানলা দিয়ে বাসের ভেতর আছড়ে পড়ল। সুভদ্রা অঙ্গনারা প্রসঙ্গ ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়ল কাগজটার জন্যে।

এই সময় ক্লাস নাইনের একটি মেয়ে সিট ছেড়ে এগিয়ে এসে হাত বাড়াল, কাগজটা দেখি। অঙ্গনা সেটা তুলে ধরতে মেয়েটি গম্ভীর মুখ নিয়ে ফিরে গেল নিজের জায়গায়। জায়গায় ফিরে এসে অঙ্গনা ফিসফিস করে বলল, একটা লাইন আমি দেখে ফেলেছি, জানিস?

সুভদ্রা চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, কী?

কাউকে বলবি না? প্রমিজ?

 প্রমিজ।

আই লাভ ইউ!

টুপুর দেখল অঙ্গনার মুখটাকে এখন একদম অচেনা মনে হচ্ছে।

.

রোলকলের পরই ক্লাসটিচার মিসেস দত্ত টুপুরকে কাছে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই কদিন অ্যাবসেন্ট হয়েছিলে কেন?

টুপুর ঠাকুমার গলায় বলল, আমার শরীর খারাপ হয়েছিল।

অ্যাপ্লিকেশন এনেছ?

ঘাড় নেড়ে সমরেন্দ্রনাথের লেখা চিঠি ব্যাগ থেকে বের করে এনে সে মিসেস দত্তের হাতে দিল। সেটায় চোখ বুলিয়ে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছিল তোমার? জ্বর না পেটখারাপ?

ওসব কিছু হয়নি।

ডাক্তার দেখেছে?

না।

আশ্চর্য! তোমার বাবা লিখেছেন সিরিয়াস ইলনেস। অথচ তোমাকে কোনও ডাক্তার দেখানো হয়নি? নিশ্চয়ই তুমি বাবা-মায়ের সঙ্গে স্কুল কামাই করে কোথাও বেড়াতে গিয়েছিলে। সত্যি কথা বলো। মিসেস দত্ত বেশ জোরে জোরে কথাগুলো বললেন।

আমি কোথাও বেড়াতে যাইনি। টুপুর প্রতিবাদ করল।

আই কান্ট অ্যাকসেপ্ট দিস অ্যাপ্লিকেশন। এখন বছরের শেষ দিক। কদিন বাদেই পরীক্ষা। এটা তো কর্পোরেশনের স্কুল নয় যে যা ইচ্ছে তাই করবে। আমি ডাক্তারের সার্টিফিকেট দেখতে চাই। নইলে একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। কালই ওটা নিয়ে আসবে।

এই সময় সুভদ্রা বলে উঠল, ওকে তো কোনও ডাক্তার দেখেনি তাহলে সার্টিফিকেট কী করে পারে।

এটা ওর বাবার হেডেক। মেয়েকে ভাল স্কুলে পড়াতে হলে মিনিমাম ডিসিপ্লিন মানতেই হবে। যাও, আজ নিজের সিটে বোসো।

টুপুর মিসেস দত্তের দিকে তাকাল, ঠাকুমা বলেছিল আপনাকে বলতে যে আমার শরীর খারাপ হয়েছিল। মেয়েরা ওই কথা বললে সবাই বুঝে নেয় কী হয়েছিল।

মিসেস দত্ত হাঁ হয়ে চেয়ে রইলেন কয়েক সেকেন্ড। তারপর বললেন, মাই গড! তোমার পিরিয়ড হয়েছিল?

টুপুর শব্দটা এর মধ্যে মায়ের মুখে শুনে ফেলেছে। এই একই শব্দের অন্য অর্থ সে জানে। অতএব নীরবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

মিসেস দত্ত কাগজটা তুলে ধরে বললেন, অথচ তোমার বাবা লিখেছেন তোমার ভয়ঙ্কর অসুখ হয়েছিল। এবারই প্রথম হল নাকি?

আবার মাথা নাড়ল টুপুর।

তা আমি যখন তোমাকে জিজ্ঞাসা করলাম তখন তুমি বললে না কেন?

আমাকে শরীর খারাপ হয়েছে বলতে বলেছিল।

হ্যাঁ, শরীর নিশ্চয়ই একটু খারাপ লাগে কিন্তু এর পরে আর কখনও কামাই কোরো না। মেয়েদের এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।

আমাকে ওরা পাঁচ দিন আটকে রেখেছিল। টুপুর বলল।

আটকে রেখেছিল? তার মানে?

টুপুর ঘটনাটা বলতেই সমস্ত ক্লাস জুড়ে যে আওয়াজটা পাক খেল সেটা শুনতে তার খুব ভাল লাগল। মিসেস দত্ত উত্তেজিত হলেন, আশ্চর্য। এ সব প্রিমিটিভ ব্যাপার এই কলকাতায় এখনও চলে? এর প্রতিবাদ করা দরকার। আমি তোমার বাবাকে লিখব সামনের বার থেকে নিতান্ত বাধ্য না হলে ওই সময় যেন তোমার স্কুল কামাই না হয়। যাও বোসো।

টুপুর নিজের সিটে ফিরে গেলেও ভদ্রমহিলা স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। ক্লাসের মেয়েরা এখন তার দিকে তাকাচ্ছে। সুভদ্রা ফিসফিস করে বলল, তোকে বন্দী করে রেখেছিল কেন?

কী জানি! হয়তো ছুঁয়ে ফেলব বলে।

 মিসেস দত্ত বললেন, ব্যাপারটা তোমাদের জানা দরকার। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ বেশ কিছু কুসংস্কার লালন করেন। যেমন ধর, চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণের আগে খাবারদাবার শেষ করে কুলের কাঁটা ছড়িয়ে রাখা হয়। গ্রহণের পর আগের রান্না খাওয়া হয় না। একসময় মানুষ অজ্ঞতা থেকে কল্পনা করত রাহু চাঁদ বা সুর্যকে গ্রাস করছে। গ্রাস করলে তারা এঁটো হয়ে যায়। এখন মানুষ চাঁদে হাঁটছে, চাঁদের পাথর নিয়ে এসেছে পৃথিবীতে তবু অনেকেই ওই কাণ্ডটি করে যাচ্ছেন। এরকম কাউকে করতে দেখলে তোমরা বুঝিয়ে বলবে গ্রহণ ব্যাপারটা কী। তোমরা জানো তো?

সমস্ত ক্লাস একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, হ্যাঁ।

গুড। আমরা গরম দেশের মানুষ। মেয়েদের শরীর যখন বিবর্তিত হয় তখন তার মধ্যে নানান পরিবর্তন আসে। পৃথিবীর সমস্ত মেয়ে তখন নারী হয়ে ওঠে যখন তার শরীর থেকে প্রতি মাসে রক্তক্ষরণ হয়। প্রকৃতি তাকে নারীত্ব দিচ্ছে যাতে পরবর্তী প্রজন্ম আসতে পারে। এটা একটা সিস্টেম। শরীর তার বাড়তি আবর্জনা ড্রেনেজ সিস্টেমের সাহায্যে বাইরে বের করে দেয়। এটা কোনও অসুখ নয় যে সংক্রামক রোগ ভেবে আলাদা করে রাখা হবে। একমাত্র রক্তপাত ছাড়া অন্য দিনের সঙ্গে কোনও পার্থক্য নেই। নিজেকে তোমরা কখনওই অপবিত্র বলে মনে করবে না।

একটি মেয়ে বলে উঠল, আমার মা তখন ঠাকুরঘরে ঢোকেন না।

মিসেস দত্ত বললেন, উনি ভুল করেন। ওকে তুমি বোঝাবে যে ওই সময় তিনি একটুও অপবিত্র হন না। মনে পাপ না থাকলে পরিষ্কার পোশাকে উনি যা স্বাভাবিক তাই করতে পারেন। আমাদের মা-মাসিরা তাঁদের অন্ধ ভাবনা থেকে এমন আবহাওয়া তৈরি করেছিলেন যে পিরিয়ড হওয়া মেয়েদের পাপ, মজাজনক ব্যাপার। একটা সময় ছিল যখন ওই সময়ে মেয়েরা একটু অসহায় হয়ে পড়ত। রক্তপাত আটকানোর আধুনিক ব্যবস্থা ছিল না। তাই তারা নিজেদের আড়ালে রাখতে চাইত। কিন্তু এখন তো সে-সমস্যা নেই। মেয়েরা ওই অবস্থার শারীরিক সমস্যাকে অতিক্রম করে অলিম্পিক দৌড়েও অংশ নিচ্ছে। এই যে কথাগুলো তোমাদের বললাম, কেন বললাম তা জানো? কারণ তোমরা যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে ওঁদের অন্ধত্ব দূর করবে। কখনও অন্যায়, কুসংস্কার, মেনে নেবে না। তুমি ছুটির পরে আমার কাছ থেকে চিঠি নিয়ে যেও।

.

এবাড়ির অনেক বাবুর ঘুম দেরিতে ভাঙে। মায়ের মন্দিরের সামনে পাতা সতরঞ্জিতে বসা কিছু মুখে এখনও ঘুমের আমেজ রয়ে গিয়েছে যদিও ঘড়িতে ঠিক বারোটা বাজে। সবাই এসে যাওয়ার পর ন’বাবু উঠে দাঁড়ালেন, তোমাদের সবাইকে বিরক্ত করতে বাধ্য হয়েছি। প্রথমেই বলে নিচ্ছি, আমার পক্ষে আর দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়। আমার অনেক সমস্যা, এবার তোমাদের মধ্যে কেউ এই দায়িত্ব নিক।

সমরেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, এই বিষয় নিয়ে কথা বলার জন্যে কি আজ আমাদের এখানে ডাকা হয়েছে?

ন’বাবু বললেন, না। সেই বিষয়ে পরে আসছি। আগে এই ব্যাপারটার একটা বিহিত করা হোক।

কমলেন্দু বলল, নকাকা, আপনি আগে বড় সমস্যাটার কথা বলুন।

 ফুলবাবু বললেন, হ্যাঁ। কমলেন্দু ঠিক বলেছে।

ন’বাবু একটু আশাহত হলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে, শেষেই না হয় আলোচনা করা যাবে। হ্যাঁ। তোমরা সবাই জানো, আমাদের এই বাড়িটার বয়স অনেক হয়েছে। শেষবার কবে হোয়াইট ওয়াশ করা হয়েছিল তা নিশ্চয়ই অনেকের মনে নেই। পুরনো বাড়ির যা হয় তাই হয়েছে। আমার ঘরে জল পড়ে। বাইরের দেওয়ালে বড় চিড় ধরেছে। এখনই মেরামত না করলে খুব শিগগির বাড়ি নিয়ে বিপদে পড়তে হবে।

সদানন্দ সবার পেছনে চুপচাপ বসেছিল। তার পরিবারের একমাত্র পুরুষ হিসেবে এই সভায় তাকে আসতে হয়েছে। যেহেতু সামনে কাকা জ্যেঠারা বসে আছেন তাই তার মুখ খোলার সুযোগ হয় না। অথচ না এসেও উপায় নেই। সদানন্দ কথা না বলে পারল না, পশ্চিম দিকের দেওয়ালে দুটো বড় গাছ বেড়ে চলেছে।

ন’বাবু সদানন্দর দিকে তাকালেন, হ্যাঁ। গাছ দুটোকে তুলে ফেললে না কেন?

বাঃ, সিঁড়ি ছাড়া ওখানে আমি পৌঁছোব কী করে? সদানন্দ বলতেই কয়েকজন হেসে উঠল।

সমরেন্দ্রনাথ বললেন, কথাগুলো মিথ্যে নয়। বাড়িটার অবস্থা বেশ খারাপ। কিন্তু এত বড় বাড়ি মেরামত করার জন্যে যে প্রচুর টাকার দরকার।

গন্ধরাজ চুপচাপ ছিলেন এক পাশে। এবার বললেন, এই প্রচুরটা কত তা আমরা জানি না। একজন কন্ট্রাক্টরকে ডেকে বাজেট দিতে বললেই হয়।

ফুলবাবু বললেন, লাখ আটেকের মতো বাজেট দেবে।

গন্ধরাজ বললেন, কাজটা যারা করে তাদের মুখ থেকেই শোনা ভাল।

ন’বাবু বললেন, আমার বড় শ্যালকের ভায়রাভাই সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। তিনি একদিন আমার কাছে এসেছিলেন। তাঁকে ব্যাপারটা বলতে তিনি বলেছেন আগামী পঁচিশ-তিরিশ বছরের জন্যে নিশ্চিন্ত হতে গেলে লাখ সাতেক লাগবে। আর যদি প্যাচ ওয়ার্ক করানো হয় তাহলে তিন লাখেই ম্যানেজ করা যাবে।

সমরেন্দ্রনাথ বললেন, তিন লাখ?

কমলেন্দু বলল, তিনের চেয়ে সাত লাখ খরচ করে নিশ্চিন্ত হওয়াই ভাল।

সাত লাখ কোত্থেকে আসবে? ন’বাবু বললেন, মেয়ের বিয়ের পর এখনই আমার পক্ষে বেশি টাকা বের করা সম্ভব নয়।

ফুলবাবু বললেন, সাত লাখ হলে মাপাপিছু প্রায় সত্তর হাজার পড়বে। অসম্ভব। তার চেয়ে প্যাচ ওয়ার্ক হলে কোনওমতে তিরিশ দিলে চলে যায়।

গন্ধরাজ বললেন, এসব তো হাওয়ার ওপর কথা বলা হচ্ছে। ন’বাবুর শালার ভায়রাভাই একবার দেখেই ঠিকঠাক বলে দেবেন এটা ভাবা যায় না। আরও দু-চার জায়গায় খোঁজখবর নেওয়া হোক। হা, আর একটা কথা, আমি একা মানুষ। বয়সও হচ্ছে। পঁচিশ বছর তো অনেক দূর। আর সবাই স্ত্রীছেলেমেয়ে নিয়ে ঘর করছে। বাড়ির ব্যাপারে তাদের স্বার্থ আমার চেয়ে অনেক বেশি। তাই যা খরচ হবে তা সমান ভাগ করে আমার ওপর চাপালে ঠিক কাজ হবে?

প্রশ্নটা শুনেই কেউ কিছু বলল না। গন্ধরাজ একা থাকেন। নেশাভাঙ করেন। সবাই তাঁকে এড়িয়ে যায়। বস্তুত কাজের মেয়ের ওপর নির্ভর করে থাকেন গন্ধরাজ। এবং এই নিয়ে অনেক ফিসফিসানি এবাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে চালু আছে।

ফুলবাবু বললেন, কথাটা ঠিক হলেও মনে রাখতে হবে এবাড়ির ভিত অনুযায়ী আমরা সবাই আলাদা আলাদা ইউনিট। বাড়ির ট্যাক্স সবাই সমানভাবে দিয়ে থাকি। বাড়ি মেরামতির ক্ষেত্রেও সেটা হওয়া উচিত।

গন্ধরাজ বললেন, কিন্তু এ ব্যাপারে আমি একটা উপায় বলতে পারি সেটা করলে কাউকে পকেট থেকে কিছু বের করতে হবে না।

ন’বাবু জিজ্ঞাসা করলেন, কী রকম?

এখন সবাই মুখ ঘুরিয়ে গন্ধরাজের দিকে তাকিয়ে।

গন্ধরাজ বললেন, এককালে এ বাড়ির সামনে বাগান ছিল। বাগানে শ্বেতপাথরের পরীদের গায়ে আলো ফেলা হত। এখন বাগান নেই। আলো নেই। ন্যাড়া মাঠের ওপর পরীগুলো পড়ে আছে অযত্নে। দিনের বেলায় কাক হাগছে ওদের ওপর। আর আমাদের কারও যখন সময় নেই ওদের দেখাশোনা করার তখন খামোকা রেখে কী হবে? বিক্রি করে দিলেই তো হয়।

সঙ্গে সঙ্গে গুঞ্জন উঠল। সবাই নিচু স্বরে কথা বলতে লাগল। শেষ পর্যন্ত ন’বাবু বললেন, প্রস্তাবটা মন্দ নয়। পাঁড়েজি পাহারা দেয় বলে মূর্তিগুলো এখনও টিকে আছে। ওভাবে ফেলে রাখার কোনও মানে হয় না। কিন্তু কথা হল, ওগুলো বিক্রি করলে কী আর পাওয়া যাবে। শ্বেতপাথরের আর দাম কী।

ফুলবাবু বললেন, এখন মানুষ নিজের জন্যেই মাথা গোঁজার জায়গা খুঁজে হিমসিম হচ্ছে, পরী কিনে রাখবে কোথায়? এ কোনও প্রস্তাবই না।

কমলেন্দু মাথা নাড়ল, আমার খুবই খারাপ লাগছে মূর্তিগুলোকে বিক্রি করার কথা ভাবতে। কিন্তু আপনারা যা বলছেন সেটা ঠিক নয়। এই পরীগুলোকে বিলেত থেকে জাহাজে করে আনা হয়েছিল। ঘষামাজা করলে আগের অবস্থায় নিশ্চয়ই ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে। এর গড়ন ভঙ্গি শিল্প হিসেবে উঁচু দরের। এদের তো মার্বেলওয়ালার কাছে বিক্রি করা হবে না যে শ্বেতপাথরের দাম পাব। বিদেশের মিউজিয়ামে এদের দাম অনেক। যারা কিউরিও হিসেবে কিনবে তারাও মোটা টাকা দেবে। সেদিন কাগজে পড়ছিলাম বিহারের এক জমিদার এরকম একটা পরীকে বিক্রি করেছেন পাঁচ হাজার ডলারে।

গন্ধরাজ জিজ্ঞাসা করলেন, ডলার? টাকায় কত হবে?

এক লাখ আশি হাজারের মতো। কমলেন্দু চটপট জবাব দিল।

বাপস। তাহলে আমাদের যে কটা আছে তা বিক্রি করলে আর কোনও অসুবিধে হওয়ার কথাই নয়। গন্ধরাজ গর্বিত ভঙ্গিতে তাকালেন।

সদানন্দ হাত তুলল।

ন’বাবু খুশি-খুশি মুখে জিজ্ঞাসা করলেন, সদু, কিছু বলবে?

আজ্ঞে হ্যাঁ। সরকার এ দেশ থেকে বিদেশে মূর্তি এক্সপোর্ট করার ব্যাপারে নাকি খুব কড়াকড়ি করেছে। বাদল বলছিল।

ফুলবাবু বললেন, আঃ। ওগুলো ঠাকুরদেবতার মূর্তির ব্যাপারে। তা কমলেন্দু তুমিই উদ্যোগ নাও। এই লাইনের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে তাড়াতাড়ি বিক্রির ব্যবস্থা করো।

সদানন্দ বলল, তাহলে মাঠ হয়ে অতখানি জমি যে পড়ে আছে, কোনও কাজে লাগছে না, এখন তো অনেক দাম, বিক্রি করে দিলেই হয়।

মুখ দেখে মনের কথা বুঝে নিল সদানন্দ, কারও কথাটা ভাল লাগেনি।

ন’বাবু বললেন, যে-চিন্তা আমরা করতে পছন্দ করি না তা তোমার মাথায় এল কী করে? অভাব আছে বলে ঘরের সোনা জমি বিক্রি করব? এবাড়ির একটা ঐতিহ্য আছে সেটা ভুলে যাচ্ছ কী করে?

আশ্চর্য! মাঠটা কোনও কাজে লাগছে না। মেয়েরা ছাদে ভিড় জমায় কিন্তু ওই মাঠে গিয়ে খেলে না। ছেলেদের ফুটবল ক্রিকেট খেলতে নিষেধ করা আছে কারণ মূর্তিগুলো নষ্ট হতে পারে। সেই সমস্যা যখন থাকবে না তখন খেলার মতো কোনও ছেলে এবাড়িতে থাকবে না। তাই বলেছিলাম।

সমরেন্দ্রনাথ বললেন, তোমরা আজকালকার ছেলে। নতুন ধরনের ব্যবসা করো। তোমাদের কাছে বাপঠাকুরদার ঐতিহ্যের চেয়ে যেনতেন প্রকারেণ সমস্যার সমাধান করতে চাওয়াই স্বাভাবিক। তবে তোমার জেনে রাখা ভাল, শরিক ভাগাভাগি হওয়ার সময় ওই মাঠটাকে টানা হয়নি। ওটার দায়িত্ব বড়মায়ের ওপর অর্পণ করা হয়েছিল। তিনি যতদিন জীবিত থাকবেন ততদিন তাঁর অনুমতি ছাড়া ওই জমি নিয়ে কিছু করা যাবে না। কী, আমি ঠিক বললাম তো? ন’বাবুর দিকে তাকিয়ে শেষ প্রশ্নটা করতেই তিনি মাথা নাড়লেন, ঠিক।

সদানন্দ বলল, তাহলে তো সমস্যা বাড়ল।

ন’বাবুর কপালে ভাঁজ পড়ল, কী রকম?

 পুকুর যার শুধু জল তার নয়, মাছও তার। তাই তো?

 নিশ্চয়ই।

তাহলে ওই মাঠের বুকে বছরের পর বছর দাঁড়িয়ে থাকা পরীদের বিক্রি করতে গেলেও বড়মায়ের অনুমতির প্রয়োজন হওয়া উচিত।

সঙ্গে সঙ্গে গন্ধরাজের মুখ শক্ত হয়ে গেল। তিনি পকেট থেকে রুমাল বের করে কপাল মুছতেই সুন্দর গন্ধ বাতাসে ভাসতে লাগল, মাছ জলে জন্মায় তাই পুকুরের মালিকের হক থাকে। কিন্তু ওই মূর্তিগুলো ওখানে মাটি খুঁড়ে উঠে দাঁড়ায়নি। বিদেশ থেকে এনে বসানো হয়েছিল। জমির মালিকানার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই।

সঙ্গে সঙ্গে এ নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত সমরেন্দ্রনাথ বললেন, এ কথা তো সত্যি, আমাদের প্রত্যেক পরিবারের আচার-অনুষ্ঠানের ব্যাপারে আমরা বড়মায়ের কথা মেনে চলি। তিনি আমাদের মাথার ওপরে আছেন। মূর্তিগুলো বিক্রি করার ব্যাপারে ওঁকে একটু জানিয়ে রাখলেই হবে।

ন’বাবু বললেন, জানিয়ে রাখলে মানে?

 যাতে উনি না ভাবেন আমরা ওকে অস্বীকার করছি।

গন্ধরাজ উঠে দাঁড়ালেন, ঠিক আছে, আর কিছু বলার নেই। কী হল আপনি নোটিস দিয়ে জানিয়ে দেবেন। কমলেন্দু, তুমি জাপানি ক্লায়েন্ট খোঁজ করো। পত্রিকায় পড়েছি ওরা পয়সা বেশি দেয়।

সমরেন্দ্রনাথ হাসল, না কাকা, পয়সা দেবে আরবের শেখরা। জাপানিদের পয়সা হয়তো বেশি কিন্তু বড় কৃপণ হয়। ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে মাথা ঘামায় কিন্তু শিল্প নিয়ে চিন্তা করে না।

ফুলবাবু বললেন, তাহলে আজ বিকেলেই বড়মায়ের কাছে যাওয়া যাক।

সমরেন্দ্রনাথ বললেন, সবার যাওয়ার দরকার নেই। দু-তিনজন গেলেই হবে।

গন্ধরাজ বললেন, যারাই যাবে সদানন্দকে সঙ্গে নিয়ে যেও। মনে হয় ওঁকে উনি স্নেহ করবেন। পিতৃহারা তো।

ন’বাবু বললেন, সেটা তো কমলেন্দুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

না। এক হল না। সদানন্দ বিয়ে করেনি। কমলের বিয়ে হয়েছে তার মায়ের পছন্দ অনুযায়ী।

সদানন্দ উঠে দাঁড়াল, কিন্তু আজ তো আমি থাকছি না। ব্যবসার কাজে দার্জিলিং যাচ্ছি।

ন’বাবু বললেন, ব্যবসা?

 আজ্ঞে হ্যাঁ।

গাড়ির ব্যবসা?

সবই তো জানেন। দার্জিলিং-এ মারুতি ভ্যানের ডিম্যান্ড বেশি, মারুতি কার, অ্যাম্বাসাডার তেমন চলে না। আমরা ওই ধরনের গাড়ি সস্তায় পেয়ে যেতে পারি। সদানন্দ সরল গলায় বলল।

ন’বাবু বললেন, সদানন্দ, তোমার এই ব্যবসা নিয়ে কথা উঠেছে।

কী রকম?

আমাদের বংশে কেউ চাকরি করেনি। ব্যবসা করেছে। কিন্তু সেই ব্যবসা সবাই সম্ভ্রমের সঙ্গে করেছে। তোমার কাছে যেসব লোক আসে তারা আগে এই বাড়ির গেট ডিঙোতে সাহস করত না। এইসব ছোটলোকদের সঙ্গে তোমার মাখামাখি আমরা পছন্দ করি না। ন’বাবু বললেন।

আপনাদের কী করে মনে হল ওরা ছোটলোক?

সমরেন্দ্রনাথ বললেন, চেহারা দেখেই বোঝা যায়। নিচুতলার দালাল শ্রেণীর লোক সবাই।

সদানন্দ হাসল, দেখুন, আমার মাঝে মাঝে মনে হয় এই উনিশশো আটানব্বই যখন গায়ের কাছে তখনও আপনারা আঠারোশো আটানব্বইতে বাস করেন। মনে হওয়াটা যে মিথ্যে নয় তা এখন প্রমাণিত হল। আমি চুরিচামারি করি না, খেটে খাই। বাপঠাকুরদার রেখে যাওয়া ব্যবসার ডিম সংগ্রহ করে বেঁচে থাকি না। যাদের আপনারা ছোটলোক বলছেন তারা আমাকে খবর দেয়। আর এই লোকগুলো ভদ্রলোকের মুখোশ পরা শিক্ষিত মানুষের চেয়ে অনেক বেশি জেনুইন। দয়া করে আপনারা এ ব্যাপারে মাথা ঘামাবেন না। কথাগুলো বলে সদানন্দ উঠে চলে গেল।

.

১২.

বড়মা তাঁর ইজিচেয়ারে শুয়েছিলেন। তাঁর কোমরের পাশে হালকা গরম জলের ব্যাগ। ঘাড়ের বীচে বালিশ। আতরবালা চুলে চিরুনি বুলিয়ে কাঁধের শাড়ির ব্রোচ ঠিক করে দিল। বড়মা জিজ্ঞাসা রিলেন, কজন?

আতরবালা বলল, তিনজন।

হঠাৎ? উদ্দেশ্য কিছু বলেছে?

না। জরুরি দরকার।

হুম। সদুর মা আসতে চেয়েছে?

হ্যাঁ। আমি খবর দিয়েছিলাম। বলেছেন বিকেলে আসবেন।

এইসময় যেন এসে না পড়ে। ব্যাটাছেলেদের সঙ্গে কথার সময় তার থাকা ঠিক নয়। এলে ও ঘরে বসাস। শরীরটাকে নাড়িয়ে যেন রক্ত চলাচল ঠিক করলেন বৃদ্ধা, নাতবউ কী করছে?

টিভি দেখছে।

যা, এবার ডাক ওদের। বালিশটাকে পিঠের নীচে নামিয়ে ঋজু ভঙ্গিতে বসার চেষ্টা করলেন বড়মা। আতরবালা এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল। ন’বাবু, সমরেন্দ্রনাথ এবং কমলেন্দু ভেতরে ঢুকে নমস্কার করল।

ওই একই ভঙ্গিতে বড়মা জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার?

ন’বাবুরা সামনের চেয়ারে বসলেন, আপনাকে একটু বিরক্ত করছি–।

বড়মা জবাব দিলেন না। গম্ভীর মুখে তাকিয়ে রইলেন।

ন’বাবু বললেন, আমাদের এই বাড়িটার কোনও সংস্কার দীর্ঘদিন করা হয়নি। ছাদ ফেটে গিয়েছে, পলেস্তারা খসেছে, গাছও গজিয়েছে। বারান্দাগুলোতেও ফাটল ধরেছে। এখনই মেরামত না করলে আর বাসযোগ্য থাকবে না।

আতরবালা দূরে দাঁড়িয়ে শুনছিল, বলে উঠল, আমাদের ওই ঘরটার দেওয়াল ফেটে গিয়েছে। ভয় লাগে খুব।

বড়মা বললে কথা হচ্ছে আমাদের মধ্যে। আতর, তুই তোর কাজে যা। আতরবালা সুড়ত করে বেরিয়ে গেল।

ন’বাবু মাথা নিচু করে বললেন, মুশকিল হল, নড়বড়ে বাড়ির মেরামতিতে প্রচুর টাকার দরকার। আমাদের পক্ষে তা জোগাড় করা অসম্ভব ব্যাপার।

তোমরা কি আমার কাছে টাকা চাইতে এসেছ?

সমরেন্দ্রনাথ বলে উঠলেন, না-না-না, আপনি আমাদের মাথার উপরে আছেন। আছেন বলে এখনও ভরসা পাই। আপনার অনুমতি ছাড়া তো আমরা কোনও কাজ করি না। একটা পথ বের হয়েছে, সেই পথে চললে কারও উপর চাপ পড়বে না অথচ বাড়িটা বেঁচে যাবে।

বাড়িটা যখন রক্ষা পাবে তখন আর ইতস্তত করছ কেন?

না, আপনার অনুমতি পেলেই কথাবার্তা শুরু করা যেতে পারে।

 কী সেটা! বড়মা তিনজনকেই দেখলেন।

সমরেন্দ্রনাথ কথা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। তিনি কমলেন্দুকে ইশারা করলেন বলার জন্যে। কমলেন্দু নড়েচড়ে বসল। এই বৃদ্ধা মহিলা তাঁর কাছে বিস্ময়। কমলেন্দুর অবসর কাটে গল্পের বই পড়ে। এ রকম চরিত্রের কথা সেখানেই পাওয়া যেতে পারে বলে তার ধারণা। বৃদ্ধা এবার তার দিকে তাকিয়ে আছেন। কমলেন্দু বলল, বাড়ির সামনে আর বাগানটাগান তো নেই। হুটহাট লোকজন ঢুকে যায়। পাঁড়েজির পক্ষে এই বয়সে সবসময় পাহারা দেওয়াও সম্ভব নয়। আপনি নিশ্চয়ই এসব কথা জানেন!

না, জানি না। যতক্ষণ ওর শরীরে প্রাণ আছে কর্তব্য থেকে সরবে না বলেই জানি।

হ্যাঁ, তা ঠিক। তবে শরীরের তো বয়স হচ্ছে। ইচ্ছে থাকলেও পেরে ওঠে না। বাগান এখন মাঠ হয়ে গিয়েছে। আর ওই মাঠে পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে মূর্তিগুলো।

মূর্তিগুলো?

হ্যাঁ, পরীর মূর্তিগুলো। শ্যাওলা পড়ে দাগ ধরে গিয়েছে, পাখিরা নোংরা করছে। তাই সবাই মিলে ঠিক করেছি ওগুলোকে যখন রক্ষণাবেক্ষণ করা যাচ্ছে না, তখন বিক্রি করে দিয়ে সেই টাকায় বাড়ি সারিয়ে নেব। কমলেন্দু বুঝিয়ে বলল।

সবাই মিলে যখন ঠিক করা হয়েছে তখন আমার কাছে আসার কী দরকার!

ন’বাবু বললেন, আপনি মাথার ওপরে আছেন। আপনার অনুমতি ছাড়া তো কোনও কাজ করা হয় না।

সবাই মিলে ঠিক করার আগে সেটা খেয়াল হয়নি?

সমরেন্দ্রনাথ বললেন, আসলে নিজেরা আলোচনা না করে তো আসা যায় না।

বড়মা সট করে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। তাঁর কুঁচকে যাওয়া চামড়ায় একটু কাঁপন লাগল। কয়েক সেকেন্ড ওইভাবে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ওই পরীদের বয়স কত তোমরা জানো? তোমরা কি জানো ওরা সবাই একসঙ্গে আসেনি। কর্তামশাই-এর ঠাকুরদা এক এক বছর এক একজনকে এনেছিলেন। ওদের এমনভাবে বসানো হয়েছিল যাতে তিনি তাঁর দোতলার ঘরের জানলা থেকে প্রত্যেকের মুখ দেখতে পান। কর্তামশাই-এর ঠাকুমা ওদের বলতেন সতীন। বড়মা আবার চুপ করলেন। এরা তিনজন অপেক্ষা করছিল। আগ বাড়িয়ে কেউ কথা বলতে চাইছিল না।

শেষ পর্যন্ত বড়মা বললেন, ওই জমিটা বোধহয় ভাগ হয়নি, না?

ন’বাবু বললেন, আজ্ঞে না। ওটা আপনার নামেই আছে।

দ্যাখো, আমি যখন সেই বারো বছর বয়সে এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছিলাম তখন থেকে এদের বাড়ির মানুষ হিসেবেই জেনে এসেছি। তোমাদের হয়তো ওদের সম্পর্কে সেরকম দুর্বলতা নেই। মজার কথা হল, ছেলেরা আশেপাশে থাকলে আমরা ওই পরীদের দিকে তাকাতে পারতাম না। ওদের কারও উদ্ধত ভঙ্গি, কারও লজ্জায় নুয়ে পড়া, কারও উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকা আমরা দেখতাম জ্যোৎস্না রাত্রে জানলার এপাশে দাঁড়িয়ে। যারা ওদের বানিয়েছিল তারা শরীরে বেশি জামাকাপড় রাখেনি। কর্তামশাই-এর ঠাকুরদা বলতেন মানুষ তার সব কুমন ওখানে রেখে বাড়িতে ঢুকবে যেমন কোনারকের মন্দিরে ঢোকে। তা এখন তোমাদের সব গেছে। থাকার মধ্যে রয়েছে এই বাড়ি আর ওই মূর্তিগুলো।

ন’বাবু বললেন, বুঝতেই পারছি, আপনার খারাপ লাগছে।

বড়মা বললেন, আমার খারাপ লাগায় তোমাদের কী এসে গেল! তোমার মেয়ে তো এখন তোমার কাছেই আছে। তার শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে কী সব গোলমাল হয়েছে বলে কে যেন বলছিল। তা তাকে তো কদিন বাদে তোমাদের দায় বলে মনে হতে পারে। ওরকম মেয়ে ঘরে থাকলে আদর পায় না। তোমার অবর্তমানে তার ভাইরা কি তাকে জোর করে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দিতে পারবে?

ন’বাবুর মুখ কালো হয়ে গিয়েছিল। মেয়ের ব্যাপার নিয়ে আর দুজন শরিকের সামনে কথা বলা তাঁর পক্ষে রীতিমতো অপমানজনক। কিন্তু নিজেকে সামলে তিনি বলতে পারলেন, মানুষের সঙ্গে মূর্তির তুলনা কি চলে?

চলে। তোমরা যাদের মূর্তি বলে দেখছ তারা আমাদের কাছে নিছক মূর্তি নয়। এ বাড়ির ঠাকুরদালান, মায়ের মূর্তি এমনকী এই দেওয়ালগুলোও আমার কাছে আত্মীয়ের মতো। বড়মা চোখ বন্ধ করলেন।

সমরেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে?

বড়মা চোখ খুললেন, বিষয় সম্পত্তি যখন ভাগাভাগি হয়েছিল তখন ওই মূর্তিগুলো তো বাগানে ছিল। তাই না?

সমরেন্দ্রনাথ বললেন, হ্যাঁ।

তাহলে মূর্তিসুদ্ধু বাগান আমার উপর অর্পণ করা হয়, তাই তো?

ওরা কেউ জবাব দিল না। কমলেন্দুর মনে পড়ল সকালের আলোচনায় পুকুরের জল এবং পুকুরের মাছের উদাহরণটি। কিন্তু এই বৃদ্ধার কথায় তো যুক্তি আছে। এই সময় টেলিফোন বাজতে লাগল ভেতরের ঘরে। সেটা থামার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে, একটা রিসিভার নিয়ে আতরবালা ছুটে এল এঘরে। চাপা গলায় বলল, খোকা।

বড়মা ঘড়ির দিকে তাকালেন, এখন তো সেখানে রাত। দে।

রিসিভার কানে নিয়ে তিনি বললেন, খোকা বলছ নাকি?

এরা তিনজন দেখল বৃদ্ধার মুখটা খুশিতে ভরে উঠল, হ্যাঁ, হ্যাঁ ভাল আছি। এত শিগগির মরব না। হ্যাঁ সবাই ভাল আছে। তারপর আবার ওপাশের কথা শোনা, শুনতে শুনতে গম্ভীর হয়ে যাওয়া, তা সিদ্ধান্তটা কি তুমি নিজেই নিয়ে নিলে না এখান থেকে চিঠি গিয়েছে, চাপ দেওয়া হয়েছে? আবার ওপারের কথা শোনা। তারপর বললেন, আমার সঙ্গে কথা না বলে যখন সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছ তখন আর লোক দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করা কেন? তার বাপকে লিখে দাও, সে যা করার করে রাখবে। তুমি আমার সামনে এসে কথা বলো। আমেরিকা থেকে কথা ছুঁড়ে দিলে আর আমি সেটা বুঝে যাব এটা ভাবছ কেন? আমার বয়স হয়েছে। বুঝতে সময় লাগে। আতর, এটা নাতবউকে দে। রিসিভারটা বড়মা আতরবালার দিকে উঁচিয়ে ধরতেই সে সেটাকে নিয়ে দ্রুত ভেতরে চলে গেল।

বৃদ্ধার চিবুক বুকের ওপর নুয়ে পড়ল। তিনজনেই বুঝতে পারছিল ফোনটা কে করেছিল। সুধীন্দ্রনাথ–এ বাড়ির একমাত্র ছেলে যে ফার্স্ট ডিভিসনে স্কুল ফাইন্যাল পাশ করেছিল। হায়ার সেকেন্ডারিতেও তাই। যাদবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সে চলে গিয়েছে আমেরিকায়। তার ব্যবসা করার মানসিকতা নেই। অথচ এ বাড়ির ছেলে হয়ে এখানে চাকরি করে নিয়ম ভাঙার চেয়ে বিদেশে চলে গিয়ে সে এখন খুব উন্নতি করেছে। অবশ্য এর মধ্যে ফিরে এসে তাকে বিয়ে করতে হয়েছে বড়মার নির্দেশে। খুব ধুমধাম হয়েছিল তখন।

বড়মা মুখ তুললেন, এবার আমি একটু বিশ্রাম নেব।

তিনজনেই একসঙ্গে উঠে দাঁড়াল। সমরেন্দ্রনাথ এবং ন’বাবু বলে উঠলেন, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। ওরা তিনজন দরজার দিকে এগোচ্ছিলেন। বড়মা ডাকলেন, শোনো।

ওরা ঘুরে দাঁড়াল।

বড়মা বললেন, যে দেশে মানুষেরই কোনও দাম নেই সে দেশে পাথরের পরীর আর কত দাম হবে! আমি ভেবে পাচ্ছি না!

কমলেন্দু উৎসাহিত হল। আপনি ঠিকই বলছেন। এ দেশে ওদের তেমন দাম হবে না। কিন্তু পরীগুলো বিদেশি। গ্রিক পুরাণের চরিত্র ধরে গড়া। ওদের বয়সও বেশ হয়েছে। বিদেশে যার কিউরিও-এর ব্যবসা করে তারা বেশি দাম দেবে।

কী জানি! হাত উঠালেন বড়মা, আচ্ছা, এই মতলবটা তোমাদের কে দিয়েছে?

তিনজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। ন’বাবু গন্ধরাজের নামটা বলতে গিয়েও বললেন না। বড়মা যে গন্ধরাজকে অপছন্দ করেন তা এ বাড়ির সবাই জানে। তিনি বললেন, আমরা সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক করেছি।

মনে হয় না। বড়মা বললেন, দ্যাখো। সব তো শেষ হয়ে যাচ্ছে। যার যা প্রয়োজন তা নিয়ে যাচ্ছে। আমি কেন আর যক্ষের মতো আগলে রাখি। দ্যাখো!

ওরা তিনজন বেরিয়ে যেতেই আতরবালা এগিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। দিয়ে জিজ্ঞাসা করল এদের কারও ঘরে কি টাকা পয়সা নেই?

থাকলেও সেটা পাঁচ ভূতের বাড়ির পেছনে খরচ করবে কেন? নাতবউকে ডাক।

আতরবালা গলা নামাল, বকাঝকা না করাই ভাল। টেলিফোন রেখে দিয়ে কাঁদছিল।

 কাঁদছিল? সেকী! এখন তো তার হাসার সময়। ডেকে দে।

নাতবউ এল। চিবুক বুকের ওপর ঠেকিয়ে একপাশে দাঁড়াল। বড়মা তার মুখের দিকে তাকালেন, হঠাৎ কান্নাকাটি কেন?

নাতবউ জবাব দিল না।

প্রশ্ন করে উত্তর না পেলে আমার মাথা গরম হয়ে যায়।

নাতবউ একবার তাকাল, ও যেতে বলছে বারবার করে। কিন্তু!

কিন্তু?

আপনাকে ফেলে আমি যাব কী করে? কেঁদে ফেলল নাতবউ।

বড়মা বললেন, আতর, আমার বুকের ওষুধটা দে। শিগগির!

.

একটু আগে সদানন্দ রওনা হয়েছে শিয়ালদা স্টেশনের পথে। জানলা দিয়ে তার যাওয়া দেখছিলেন নন্দিনী। সায়নের জন্যে নতুন সোয়েটার আর নারকোলের নাড়ু-র শিশি প্যাক করে দিয়েছেন সদানন্দকে। এই সময় হেনা এল।

নন্দিনী জিজ্ঞাসা করলেন, কী ব্যাপার? এ সময়?

আমার আর সময় আর অসময়। কাল বাপের বাড়ি যাচ্ছি।

হঠাৎ।

তিনি চিঠি লিখেছেন ফিরতে আরও দিন দশেক দেরি হবে। শিমলের পাহাড় থেকে কুলু-মানালি যাবেন। ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ। অতদিন আমি এই বন্দীশালায় থাকতে পারো না। হেনা বলল।

বলেছিস!

না বলার কী আছে। শুনে মুখ হাঁড়ি করে ফেলল। হেনা খুব শীতল গলায় বলল, আমার স্বামীর মা যদি না হত তাহলে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতাম। অদ্ভুত মেয়েমানুষ।

নন্দিনী হেনার হাত ধরল, তোর কষ্ট আমি বুঝি। কিন্তু এই রকম মন নিয়ে তো একসঙ্গে থাকা যায় না। তুই উপেক্ষা কর।

হেনা বলল, সে কী? থাকা যায় না মানে? এ বাড়ির কত বউ এর চেয়ে অনেক বেশি অত্যাচার সহ্য করে আমাদের আগে মুখ বুজে থেকে গেছে। যায়নি? এবার ও ফিরে আসুক, আমি হেস্তনেস্ত করব। হয় মাতৃভক্ত কোলের ছেলে হয়ে থাকুক নয় প্রতিবাদ করুক। আর নয়।

যদি প্রথমটাই চায়? নন্দিনী বললেন, কী করবি তুই? আমাদের না আছে পড়াশুনা না আছে নিজে কিছু করার ক্ষমতা। বাপের বাড়িতে গেলে দু-দশদিন আদর জুটবে। কিন্তু যেই বুঝবে দায় হয়ে গেছি তখন? তাই মাথা গরম না করে বুদ্ধি খরচ করে ম্যানেজ কর।

মরতে তো বাধা নেই!

পাগল! এই বয়সে মরবিই যদি তো বাঁচলি কেন? আর তুই মরলে কারও কিছু হবে? শাশুড়ি আবার তার ছেলেকে বিয়ের পিঁড়িতে বসাবে। পৃথিবীর সব কিছু ঠিকঠাক চলবে। কিন্তু আজ কী হয়েছে বল তো?

যা হয়। শ্বশুর বাবার মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছিল। মাইগ্রেন আছে। যন্ত্রণা যখন শুরু হয় তখন কোনও ওষুধে কাজ দেয় না। ছটফট করেন। ওর ছেলে একটা চাইনিজ বাম এনে দিয়েছিল। সেটা কপালে মালিশ করলে একটু যন্ত্রণা কমে। আমি তাই ভদ্রমহিলাকে বললাম, বাবা খুব যন্ত্রণা পাচ্ছেন, একটু মলমটা মালিশ করে দিলে হয়। উনি চোখ উল্টে বললেন, কেন তার নিজের আঙ্গুল কি ক্ষয়ে গেছে! নাকি তোমার ইচ্ছে হচ্ছে ব্যাটাছেলের কপালে হাত বোলাবার? বোঝ! মুখের উপর বলে দিয়েছি, আপনার মনে এত ময়লা, বাবা যে কী করে এতকাল আপনার সঙ্গে আছেন ভেবে পাই না।

নন্দিনীর চোখ বিস্ফারিত হল, সর্বনাশ!

আমি এখন আর ওঁকে ভয় করি না। হেনা স্পষ্ট গলায় বলল।

এই সময় ঊর্মিলা এল। তাকে দেখে নন্দিনী বলে উঠল, আরে! হলটা কী! আজ দেখছি তোমরা সবাই বিদ্রোহে নেমে পড়েছ!

ঊর্মিলা জিজ্ঞাসা করল, তার মানে?

 এই ভর সন্ধেতে বেরিয়ে এসেছ!

বাঃ, আমার পাহারাওয়ালা বলতে তিনি। একটু আগে আমার সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেছে, কথা বন্ধ। তাই চলে এলাম। ঊর্মিলা বলল।

হেনার এসব কথা ভাল লাগছিল। স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করার সুযোগ যার আছে সে তো গর্ব করে বলবেই। তিনি এখন কুলুমানালিতে।

নন্দিনী বললেন, পারো বটে।

তোমরা শোনোনি। বাগানের পরীদের বিক্রি করে দেবেন এঁরা। টাকা তুলে তাই দিয়ে বাড়ি সারাবেন! অথচ আমার উনি দিবারাত্র সাহিত্য পড়ছেন, আকাদেমিতে নাটক দেখতে যান, ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের টিকিট কাটেন। আমি বললাম, তোমরা তো এরপর টাকার জন্যে বাড়ির বউদেরও বিক্রি করে দেবে। তুমি আর শিল্পের বড়াই কোরো না। ঊর্মিলা বলল।

হেনা জানত না ব্যাপারটা। সবিস্ময়ে বলল, মূর্তি বিক্রি করবে?

ঊর্মিলা জিজ্ঞাসা করল, তুমি শোনোনি? তোমার শ্বশুরমশাই তো মিটিং-এ গিয়েছিলেন। শুনলাম খবরটা জানার পর পাঁড়েজি খুব ভেঙে পড়েছে।

হেনা সুযোগ পেল, শ্বশুরমশাই-এর দোষ নেই। খবরটা আমাকে বলতে চাইলেও বউ-এর ভয়ে পারবেন না। কিন্তু পরীগুলো বিক্রি হয়ে যাবে! আচ্ছা, বড়মা অনুমতি দিয়েছেন?

ঊর্মিলা বলল, প্রথমে নাকি খুব আপত্তি করেছিলেন। তারপর হঠাৎই নাকি নিমরাজি হয়েছেন।

নন্দিনী বললেন, শুনলে প্রথমে খারাপ লাগে। কিন্তু এই বাড়িটাকে বাঁচানো যে বেশি দরকার। এত টাকা খরচ করার সামর্থ্য আর কজনের আছে বল। আর মূর্তিগুলোকে কেউ যত্ন করে না। চুরি হয়ে গেলেও কিছু করার নেই।

কথাটা মনঃপুত হল না ঊর্মিলার। কথা ঘোরাতে সে জিজ্ঞাসা করল, তুমি দার্জিলিং-এ গেলে না?

নাঃ। যাওয়া হল না। ওঁর পক্ষে এখনই যাওয়া অসম্ভব। ছেলেটাকে চিঠি দিয়েছিলাম যাচ্ছি বলে, এত মন খারাপ লাগছে। আজ সদানন্দ গেল, ওর হাতে অনেক বুঝিয়ে চিঠি পাঠিয়েছি। নন্দিনী বলল।

হেনা জিজ্ঞাসা করল, যাওয়া অসম্ভব কেন?

উনি ওঁর ব্যবসা নিয়ে খুব ব্যস্ত। মুখ গম্ভীর হল নন্দিনীর।

তাহলে চলো না, আমরাই যাই। হেনা উৎসাহে বলল।

আমরা? চমকে উঠলেন নন্দিনী।

হ্যাঁ। কী, তুমি যাবে? হেনা জিজ্ঞাসা করল ঊর্মিলাকে।

ঊর্মিলার চোখমুখ ঝলমল করে উঠল, গেলে হয়!

নন্দিনী জিজ্ঞাসা করলেন, সঙ্গে কোনও পুরুষমানুষ থাকবে না?

হেনা বলল, দরকার কী। আমাদের স্যুটকেস ভারি না করলেই হল। আজ মেয়েরা সারা পৃথিবীতে একা ঘুরে বেড়াচ্ছে আর আমরা তিনজন দার্জিলিং-এ যেতে পারব না?

নন্দিনী চমকালেন, খুব তো সাহস দেখানো হচ্ছে। শাশুড়ি ছাড়বে?

সেটা আমার ওপর ছেড়ে দাও।

শোন, এটা এই বাড়ির কেউ সহ্য করতে পারবে না। একটা বিশ্রী কাণ্ড হয়ে যাবে। নন্দিনী সাবধান করলেন।

কী বিশ্রী কাণ্ড হবে? গায়ে হাত তুলবে? তেমন হলে ওকে জেলে যেতে হবে। আমার মায়ের কাছে দুটো চিঠি খামে বন্ধ করে দিয়ে এসেছি। বলেছি আমি আত্মহত্যা করেছি খবর পাওয়া মাত্র থানায় গিয়ে খামদুটো তুলে দেবে। হেনা সগর্বে বলল।

ঊর্মিলার মাথায় কথাটা ঢুকেছিল। সে বলল, আমরা যাব।

তুমিও রাজি? নন্দিনী একটু ধন্দে।

হ্যাঁ। আমরা অন্যায় করছি না। একটা অসুস্থ ছেলেকে দেখতে যাচ্ছি। তার জন্যে কে বিশ্রী কাণ্ড করবে, সহ্য করতে পারবে না তাতে আমার কিছু এসে যায় না। দ্যাখো, আমাদের কোনও ক্ষমতাও নেই। আর পাঁচটা শিক্ষিত রোজগেরে মেয়ে যা পারে তা আমরা পারব না। তাই বলে পড়ে পড়ে মার খাব কেন? সেই সাপের গল্প। না কামড়াতে পারি, ফোঁস করতে দোষ কোথায়! কবে টিকিট কাটাব বলো।

ঊর্মিলা দৃঢ় গলায় জানতে চাইলে নন্দিনী বুঝলেন ব্যাপারটা সত্যি হাসিঠাট্টার মধ্যে নেই। এই বাড়ির তিন বউ একা একা ট্রেনে চেপে বাইরে যাচ্ছে, খবরটা চাউর হলেই ঝড় উঠবে। সায়নের বাবার সঙ্গে কথা না বলে তিনি কী করে এদের হ্যাঁ বলেন। সায়ন তাঁর ছেলে, তাকে দেখতে যাওয়ার জন্যে তিনি ছটফট করছেন। কিন্তু এরা যেতে চাইছে প্রতিবাদ জানাতে। এ বাড়ির দেড়শো বছরের পাপ যা ওদের ওপর চেপে বসেছে তা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা নেই, তাই সায়নকে সামনে রেখে ওই একটু ফোঁস করে ওঠা। নন্দিনী বললেন, বেশ তো, সবাই একসঙ্গে গেলে হয়। একটু ওঁর সঙ্গে কথা বলি।

হেনা জিজ্ঞাসা করল, যদি তোমার উনি না বলেন?

ছেলেকে দেখতে যাচ্ছি, উনি না বলবেন কেন? নন্দিনী হাসলেন।

হেনা বলল, তুমি কাল বাদে পরশুর টিকিট কাটো। আমি আর একদম দেরি করতে চাই না।

সদানন্দের মা বিধবা হওয়ার পর আর চৌকাঠের বাইরে পা বাড়াননি। এ বাড়ির অন্য বউরা তাঁর কাছে আসা-যাওয়া করে না। তাই তিনি তাঁর নিজের সংসার এবং ঠাকুর নিয়ে পড়ে থাকে চুপচাপ। এ বাড়িতে ব্যাঘ্রবাহিনীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই যে-যার ঘরে পছন্দমত দেবদেবীর পূজা-আর্চা করে থাকেন।

আজ সদানন্দের মাকে আসতে হয়েছে তাঁর গণ্ডি পেরিয়ে। সঙ্গে আছে কাজের মেয়েটি। সাদা থান তাঁর কপাল ঢেকেছে। হাতে একটি বড় খাম।

আতরবালা দরজা খুলল, ওর শরীর খারাপ। কাগজটা আমাকেই দাও।

সদানন্দর মা ইতস্তত করছিলেন এবং তখনই ভেতর থেকে গলা ভেসে এল, থাক, ভেতরে নিয়ে আয়।

আতরবালা বিরক্ত হয়ে নিচু গলায় বলল, বেশি কথা বোলো না। এসো।

বড়মা শুয়েছিলেন ইজিচেয়ারে। বললেন, কে? সদুর মা?

আজ্ঞে হ্যাঁ। মাথার কাপড়টা আরও নীচে টানলেন প্রৌঢ়া।

তোমার ছেলেকে নিয়ে নানান কথা হচ্ছে। চাকরি না করে ব্যবসা করতে হবে বলে নীচে নামতে হবে কেন? তার ব্যবসার সঙ্গীসাথীদের সম্পর্কে এ বাড়ির অনেকেরই আপত্তি আছে। ছেলের স্বভাব চরিত্র কী রকম?

আপনার আশীর্বাদে কোনও অন্যায় করতে দেখিনি।

বাপ মরা ছেলে। যতদিন ডানা ওঠেনি ততদিন তোমার কাছে ছিল। তুমি তোমার মতো করে মানুষ করেছ। কিন্তু ডানা উঠলেই মাথার ওপর আকাশ দেখতে পেয়েছে। সেখানে কী করে বেড়াচ্ছে, তার খবর কী করে রাখবে?

আজ্ঞে, বোঝা যেত।

যেত? ওর বাপের বেলায় তুমি বুঝেছিলে?

সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠলেন সদানন্দর মা। তাঁর বিবাহিত জীবনে যা ছিল অপমানের, হেরে যাওয়ার, বৈধব্যে তাই হয়ে গেল কাদা-গোলা লজ্জা। সেই লজ্জার পাঁক থেকে এ-জন্মে মুক্তি পাবেন না তিনি।

বড়মা শুয়ে শুয়েই প্রৌঢ়ার মুখের পরিবর্তন লক্ষ করলেন, তুমি কেন কষ্ট পাচ্ছ? তুমি তো কোনও অন্যায় করনি। এ বাড়ির কিছু পুরুষ ঘরের বাইরে গিয়েছিল যৌবনের নানান স্বাদ নিতে। তবে তারা রাত পোহানোর আগেই নিজের বিছানায় ফিরে আসত। তোমার স্বামীর মতো নির্বোধ ছিল না তারা। আর যে নির্বোধ তার জন্যে দুঃখ করা যেমন বোকামি, তার জন্যে লজ্জা পাওয়ারও কোনও অর্থ নেই। বড়মা নিঃশ্বাস নিলেন, আমি বাপের কথা তুললাম যাতে ছেলের বেলায় এই একই ব্যাপার না ঘটে। ওকে এখন খুটিতে বাঁধতে হবে। পাথুরেঘাটার হরিমাধব সাহার নাতনি নাকি ডাগর হয়েছে। সুপাত্র পেলে দিতে তাদের আপত্তি নেই।

বিয়ে?

হ্যাঁ। আকাশ থেকে পড়লে যেন। কত বয়স হয়েছে ছেলের?

বাইশ।

তবে? এখনকার মেয়েরা অনেক বেশি বুদ্ধিমতি, সজাগ। তোমাদের মতো নয়। তারা ঠিক স্বামীকে গোয়ালে বেঁধে রাখবে। এখন এ বাড়ির কোনও স্বামী ভোরের আগে বাড়ি ফেরে? ফেরে না। সে-সাহসই হবে না। ঠিকুজি এনেছ?

খাম থেকে পুরনো কাগজটা বের করে চশমার নীচে নিয়ে এলেন বড়মা। অনেক কষ্টে পড়ে বললেন, সর্বনাশ!

প্রৌঢ়া অবাক হলেন, কেন?

সিংহ রাশি, রাক্ষস গণ। এরপর আর কী কী খারাপ আছে তা কে জানে। এমন ছেলেকে জামাই করতে কটা বাপ চাইবে। না না, এ ঠিকুজি চলবে না। আর তুমিও কীরকম মা, ছেলের ক্ষতি হবে জেনেও এমন ঠিকুজি বুকে ধরে বসে আছ? সদু কোথায়?

সে দার্জিলিং-এ গিয়েছে। প্রৌঢ়া যোগ করলেন, ব্যবসার কাজে।

সেখানে আবার তার কী ব্যবসা? শুনেছি তো গাড়ির দালালি করে।

আমি ঠিক জানি না।

 বড়মা ডাকলেন, আতর।

 পেছনে দাঁড়ানো আতরবালা সাড়া দিল, হ্যাঁ।

পাঁড়েজিকে বল, হাতিবাগানের নকড়ি ভটচাযকে খবর দিতে। সে যেন কালই আমার সঙ্গে দেখা করে। যা।

আতরবালা বেরিয়ে যেতেই বড়মা বললেন, এই ঠিকুজির কথা কেউ জানে?

না। আলমারিতেই এতদিন ছিল।

তাহলে কাউকে জানানোর দরকার নেই। সদুর একটা ভাল ঠিকুজি করিয়ে নিচ্ছি। নকড়ি আমার বিশ্বস্ত লোক। ওটা হয়ে গেলে তোমাকে খবর দেব। ঠিক আছে, এখন তুমি যেতে পারো। বড়মা চোখ বন্ধ করলেন।

.

কমলেন্দু অবাক। ঊর্মিলার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সে।

ঊর্মিলার ঠোঁটে হাসি, তোমার মুখের ছবি তুলে রাখব?

 কমলেন্দু শুয়ে বই পড়ছিল এতক্ষণ, এবার উঠে বসল, ব্যাপার কী বলো তো?

সায়নকে দেখতে আমরা তিনজন যাব, সেই সঙ্গে দার্জিলিং বেড়িয়ে আসব। এর মধ্যে অন্য কোনও ব্যাপার নেই। ঊর্মিলা বলল।

হঠাৎ?

হঠাৎ মানে?

তুমি জানো না, এবাড়ির মেয়েরা একা কোথাও যায় না।

একা তো যাচ্ছি না। তিনজনে একসঙ্গে থাকলে একা বলা যায়?

তুমি বুঝতে পারছ না। দার্জিলিং-এ যেতে ইচ্ছে করছে, বেশ তো আমার সঙ্গে চলো। কিন্তু তিনজন মহিলার যাওয়া ঠিক হবে না।

কেন?

প্রথমত আজকাল রাস্তাঘাটে কত কী হয়ে যাচ্ছে। তারওপর পাহাড়ে গিয়ে তিনজন মহিলা হোটেলে উঠেছে জানলে বদ লোকজন পেছনে লাগবেই।

তারপর?

তা ছাড়া, এবাড়ির পুরুষরা খবরটা হজম করতে পারবে না।

বদহজম হলে কী করবে?

 মিটিং হবে। বংশের, বাড়ির ঐতিহ্য নষ্ট হয়েছে বলে বিক্ষোভ করবে।

তারপর? আমাদের বাড়িতে ঢোকা বন্ধ করে দেবে নাকি?

কমলেন্দুকে অসহায় দেখাল এখন। সে বলল ঊর্মি, প্লিজ, একটু বুঝতে চেষ্টা করো। আমি মানছি এবাড়ির সমস্ত নিয়মকানুন আধুনিক নয়। মেনে নেওয়া মুশকিল। কিন্তু নিয়ম না ভাঙলে, যেখানে অসুবিধে নেই সেখানে সেটা ভাঙার কী দরকার?

ঊর্মিলা বলল, আমরা কোনও অন্যায় করছি না।

কমলেন্দু খাট থেকে নেমে দাঁড়াল, হেনার বাড়ির লোকজন জানেন?

না। যাকে জানানোর কথা তিনি সিমলা ছেড়ে কুনুমানালিতে গেছেন বেড়াতে। আশ্চর্য। তোমাদের পুরুষজাত এইরকমই হয়। নিজের স্বার্থ ছাড়া কিছু বোঝ না। স্ত্রীকে দজ্জাল মায়ের দাঁতের তলায় ফেলে তিনি গেছেন বন্ধুদের নিয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে ফুর্তি করতে।

তোমার শাশুড়ি নেই তাই জানো না, শাশুড়ি বউ-এর সম্পর্ক প্রথমে কখনওই ভাল থাকে না। একসঙ্গে থাকতে থাকতে একসময় ঠিক হয়ে যায়।

তাই? যে শাশুড়ি ছেলের বউকে সন্দেহ করে শ্বশুরের সঙ্গে প্রেম করছে বলে তাদের সম্পর্কও ঠিক হয়ে যায়?

কমলেন্দু কিছু বলতে পারল না। ঊর্মিলার কাছে এই কাহিনী সে আগেও শুনেছে। শুনে অবাক হয়েছে।

ঊর্মিলা বলল, শাশুড়িকে হেনা বলতে যাবে কেন? কোন দুঃখে? শ্বশুরকে বলতে পারে। তা তিনি তো শালগ্রাম শিলা, তাঁর কোনও ক্ষমতা নেই। আর যাকে বলতে পারত সে তো চিঠিতে তার ফুর্তির কথা জানিয়েই খালাস। হেনা কাল এখান থেকে বাপের বাড়ি চলে যাবে। আর সেখান থেকেই স্টেশনে আসবে। দয়া করে এটা চাউর কোরো না।

কমলেন্দু বলল, আর সায়নের মা?

 মা যদি অসুস্থ ছেলেকে দেখতে যেতে চায় তাহলে কোন বাবা তাকে বাধা দেবে? তিনি নাকি ব্যবসা নিয়ে এত ব্যস্ত যে কলকাতার বাইরে যাওয়ার সময় পাচ্ছেন না। যাক গে, তুমি আমাদের একটা উপকার করবে?

কমলেন্দু কিছু না বলে স্ত্রীর দিকে তাকাল।

ঊর্মিলা বলল, দার্জিলিং মেলে তিনটে টিকিট কেটে দেবে? পরশু যেতে চাই।

 কমলেন্দু কাছে এল। ঊর্মিলার কাঁধে সস্নেহে হাত রেখে বলল, ঊর্মি আমি যদি তোমাদের সঙ্গে যাই তাহলে কি খুব রাগ করবে?

ঊর্মিলা দুর্বল হল। সে মাথা নাড়ল, ভাল লাগত। খুব ভাল লাগত। তোমার সঙ্গে আমি কখনও পাহাড়ে যাইনি। তুমি সঙ্গে থাকলে।

তাহলে আমি যাই? কমলেন্দু মুখ নামাল।

না। মাথা নাড়ল ঊর্মিলা, তাহলে আমি হেরে যাব।

বেশ। কেউ জানবে না। তোমার সঙ্গে যারা যাচ্ছে তারাও না।

সেকী?

হ্যাঁ। আমি দূর থেকে তোমাকে দেখব। আর সুযোগ পেলে আমার সঙ্গে এসে দেখা করবে। এতে আপত্তি কোরো না, প্লিজ।

ঊর্মিলার মুখ চোখে খুশি উপছে পড়ল। তারপরই গম্ভীর হয়ে বলল, দুর। তাতে আমার আরও খারাপ লাগবে। একই শহরে থাকব অথচ তোমাকে কাছে পাব না ভাবলেই খুব কষ্ট হবে।

কমলেন্দু ঘড়ি দেখল। এখন বেশি রাত হয়নি। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ে নিয়ে বলল, একটু আসছি।

ঊর্মিলা স্বামীর এইরকম আচরণে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাচ্ছ?

এসে বলব। কমলেন্দু পা বাড়াল!

সায়নের বাবা দরজা খুললেন। কমলেন্দুকে দেখে একটু অবাক হয়ে বললেন, ও তুমি। এসো। কী ব্যাপার?

এই এলাম একটু।

সোফায় বসার পর সায়নের বাবা বললেন, বিকেলে যখন বাড়ি ফিরছিলাম তখন ন’বাবু বলছিলেন সদানন্দর ব্যবসা নিয়ে একটা মিটিং ডাকার কথা ছিল। সেটা আজ হচ্ছে না। আমি বললাম এই ব্যাপার নিয়ে এখনই জল ঘোলা করার দরকার কী। হ্যাঁ, কিছু সাবস্ট্যান্ডার্ড লোকজন এর কাছে আসে বটে কিন্তু তারা তো কোনও অশান্তি করেনি। দিনকাল বদলে যাচ্ছে দ্রুত। এই ব্যাপারটা যতক্ষণ পারা যায় ততক্ষণ উপেক্ষা করাই ভাল। তুমি কি ওই ব্যাপারে কথা বলতে এসেছ?

কমলেন্দু বলল, না-না। আমি আপনাদের সঙ্গে অন্য ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি। কাকিমা কোথায়?

নন্দিনী ভেতরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন।

 কমলেন্দু বলল, কাকিমা, আমি কালিম্পং-এর দিকে একটা কাজে যাচ্ছিলাম। তা আজ ঊর্মিলার কাছে শুনলাম আপনারা সায়নকে দেখতে যেতে পারেন। তাই বলছিলাম কি আমিও এই সুযোগ ছাড়ি কেন? ছেলেটাকে অনেকদিন দেখিনি।

সায়নের বাবা বললেন, এ তো খুব ভাল কথা। তোমার কাকিমা এই একটু আগে ওঁদের ইচ্ছের কথা বলছিলেন। আমি বেশ সমস্যায় পড়েছিলাম। তা তুমি যদি বউমাকে নিয়ে যাও তাহলে ওদের যেতে সুবিধে হবে।

নন্দিনী জিজ্ঞাসা করলেন, ঊর্মিলা জানে?

আমি বলেছি। কিন্তু সে বলল মেয়েরা একা যাবে বলে স্থির করেছেন। কোনও পুরুষমানুষ সঙ্গে থাকবে না। কমলেন্দু হাসল।

নন্দিনী বললেন, হ্যাঁ। খুব বিরক্ত হলে মেয়েরা এমন সিদ্ধান্ত নেয়।

 কমলেন্দু বলল, কথাটা ঠিক। কাকিমা, আমি ঊর্মিলার সঙ্গে কথা বলব। এখন বলুন, আমি সঙ্গে থাকলে আপনার কোনও অসুবিধে হবে কিনা। আপনাদের যেখানে যাওয়ার ইচ্ছে হবে যাবেন, আমি বাধা দেব না। সবার সব স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকবে।

নন্দিনী বলল ঊর্মিলার মত থাকলে আমার আপত্তি কী।

সায়নের বাবা বলল, আপত্তির কথা উঠতেই পারে না। তিনের বদলে চারজন গেলে অনেক সুবিধে। খরচ কম হবে, ভরসাও বাড়বে।

তা কোন ক্লাসের টিকিট কাটব?

সায়নের বাবা বললেন, চারজন যখন তখন ফার্স্ট ক্লাসের চার বার্থের কুপে নেওয়াই ভাল। কিন্তু টিকিটের যা ব্যাপার, পাওয়া যাবে?

আমি চেষ্টা করছি। শুধু যাওয়ার নয়, ফেরারটাও করে রাখতে হবে।

তাহলে টাকা পয়সা!

কমলেন্দু উঠে দাঁড়াল, দাঁড়ান, আগে টিকিট কাটি। আচ্ছা, চলি।

 নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এসে কমলেন্দু ঘোষণা করল, ডান। সায়নের মা রাজি হয়েছেন, আমি সঙ্গে গেলে তাঁর কোনও আপত্তি নেই।

ঊর্মিলা অবাক হয়ে তাকাল। তার মুখ গম্ভীর হল, ও। কিন্তু তোমাকে যে একবার বড়মার কাছে যেতে হবে। তাঁর অনুমতি ছাড়া কী করে যাবে?

কমলেন্দু স্ত্রীর দিকে এক পলক তাকিয়ে সজোরে দরজা বন্ধ করল।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার