অন্যমনস্ক হয়ে আংটিটা ঘোড়াচ্ছিল অনিমেষ। ঘোরাতে সচেতন হতেই সেটায় নজর গেল। আঙ্গুলের যে অংশটায় ওটা চেপে সাদা হয়ে গেছে কখন। ঘাসের ওপর কিছু চাপা থাকলে রঙ কিছু দিন পর যেরকম হয়। চট করে দেখলে জায়গাটা নিজের বলে মনে হয় না। দীর্ঘকার কোন কিছু আবদ্ধ থাকলে এমনি করে স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলে? হাতের অন্য অংশের চেয়ে এই জায়গাটা বেশ ফরসা ফরসা লাগছে, কিন্তু সেটা যে দৃষ্টিকটু তা মানতেই হয়। জীবনের সব ক্ষেত্রে বোধ হয় এইরকম বোধ কাজ করে। যা সহজ তা সব সময়েই শ্রেয়, যা চেপে বসে তার ফলশ্রুতি যতই মনোরম হোক তাকে মেনে নেওয়া যায় না। আংটির মাঝেখানে ছোট্ট অথচ নিটোল অক্ষরটাকে দেখলো সে। এত দিন ধরে আংটিটা আঙ্গুলে আছে কিন্তু এমন সতর্ক চেখে দেখা হয় না। অ অক্ষরটা সুন্দর করে লেখা। অ মানে না। সব কিছুতেই না? না মানে বিদ্রোহ। তবু সব কিছু মেনে নিতে হয়। ছোট মা পরিচয় দিয়েছিল এইটে। এখনও এতদিন পরে সেই দিনটার উত্তাপ অনুভব করতে পারল অনিমেষ। কেমন একটা সঙ্কোচ এবং আদরের সঙ্গে ছোট মা ওর আঙ্গুলে পরিয়ে দিয়েছিল আংটিটা। নিজের মায়ের মুখ এখন ঝাপসা হয়ে গেছে অনিমেষের কাছে, বুকের মধ্যে সেই টনটনানি ভাবটা কখন হারিয়ে গেছে। ছোটমা যখন এল তখনকার সব কিছু ওর স্পষ্ট মনে আছে। সৎমা বা ওই জাতীয় কোন মনোভাবের কথা ভাবলেই হাসি পায়। একটু একটু করে কখন ছোটমা মাছবাবু কি রোগা হয়ে গেছে! অনিমেষ মানে যেহেতু মাছ তাই মাছবাবু। ছোটমা ওকে ক্ষ্যাপায় তুমি তো মাছেরই মত, কোন কিছু তোমাকে স্পর্শ করে না। পাঁকাল মাছ।

পরে অনিমেষ ভেবেছে কথাটা একদম মিথ্যে নয়। ইদানিং তার মনের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্কগুলো খুব বড় হয়ে থাকছে না। এই যেমন দাদু সরিৎশেখরকে ও এত ভালবাসে, হেমলতার কাছে সেই ছেলেবেলা থেকে মানুষ হল, কলকাতায় থাকতে থাকতে এমনও হয়েছে দীর্ঘকাল ওঁদের কথা চিন্তায় আসেনি। দাদু তাকে নিয়মিত চিঠি দিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু উত্তর দেব দেব করে এত দেরি হয়ে যায় যে সেই আবেগের দিনটা ধরা পড়ে যায়। তার মানে এই নয় যে সে শ্রদ্ধা কম করে বা ভাল বাসে  না, ওই লেখা হয়ে ওঠে না এই মাত্র। ক্রমশ সব কিছু থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে আসছে একটু একটু করে। মাছেরই মত। আংটিটার দিকে তাকাতেই স্বৰ্গছেঁড়ার সেই মাঠ, মাঠে ছোটমার সঙ্গে হেঁটে আসা এবং তার পরই সীতার বিয়ে মনে পড়তেই হেসে ফেলল অনিমেষ। সীতার কথা ওর একদম মনে ছিল না। কেমন আছে, কোথায় আছে মেয়েটা? তার প্রথম প্রেম অথচ সে-কথা ওরা কেউ মুখে বলেনি। সেই বালক বয়সেই প্রথম না হয়েছিল, না মানে অ, অ থেকে অনিমেষ।

শুয়ে থাকলেই যত রাজ্যের গপ্পো মাথায় আসে। বিশেষ করে জানলাটা দিয়ে যদি আকাশ দেখা যায় আর ঘরে কেউ না থাকে। খাট থেকে উঠে চেয়ারে গিয়ে বসল অনিমেষ। বইপত্র তেমন কিছু কেনা হয়নি, এম এ-তে যে কটি নেহাত না কিনলে নয় তার বেশী কেউ কেনেও না। এখন থেকে লাইব্রেরীতে যাওয়া অভ্যাস করতে হবে। আজ রবিবার। ত্রিদিব সেই ভাত খেয়েই প্রিয়ায় ম্যাটিনি শো দেখতে গেছে। এই উত্তর থেকে সেই দক্ষিণে। ইদানিং ত্রিদিবের দক্ষিণমুখো মন, উত্তর কলকাতা ওর ঠিক বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না। প্রায়ই বলে, দক্ষিণের ছেলেমেয়েদের মনে অনেক ডেপথ আছে, কথাবার্তা বললে সুখ পাওয়া যায়। আর কিছু না হোক, গড়িয়াহাটার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকলেই সময়টা কখন টুপ করে চলে যায় যে টের পাবে না। তা ছাড়া ওদিকের বাবা-মারা অনেক বেশী উদারচেতা, মানিয়ে চলতে পারে।

অতএব দুপুরে একা একা কাটাচ্ছিল অনিমেষ। আর একা থাকলেই যত রাজ্যের চিন্তা মাথায় ভিড় করে। মানুষ যদি তার সব স্মৃতি, জ্ঞান হওয়া অবধি সে যা করেছে, যত লোকের সঙ্গে দেখা হয়েছে সব মনে রাখতে পারত, ভাবতেই হাসি পেল। জমতে জমতে একসময় পাত্র ফেটে যাবে, তাই আপনার থেকে প্রকৃতির নিয়মে বিস্মৃতি আসে, বাঁচিয়ে দেয়।

রোদ্দুরের রঙ দেখে অনিমেষের খেয়াল হল। আজ ঠিক চারটের সময় বি কে পাল এভিন্যুতে পৌঁছাতে হবে। অথচ নিজের সঙ্গে আড্ডা মারতে গিয়ে সে কথা খেয়ালই নেই। তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পালটে সে বেরিয়ে এল হোস্টেল থেকে। নীচের বাস্কেটবল লনে কয়েকটা ছেলে বল নিয়ে দাপাদাপি করছে। গেটে মোসাম্বার সঙ্গে দেখা। একটা ছোট্ট শর্টস পরে খালি গায়ে দারোয়ানকে টাকা দিয়ে কিছু আনতে বলেছে। এ অবস্থায় কিছুতেই অনিমেষ বাইরে আসতে পারত না। অথচ মোসাম্বার কোন প্রতিক্রিয়া নেই। অনিমেষকে দেখে মোসাম্বা চিৎকার করল, হাই।

অনিমেষ হাসল, হ্যালো। ভাগ্যিস সামনে গেটটা পুরো খেলা নেই, তাই রাস্তা থেকে কেউ এই উত্তম শরীর দর্শন করতে পারছে না।

হাত তুলে একটু দাঁড়াতে বলে ও দারোয়ানকে বুঝিয়ে দিয়ে কাছে এল। এসে চকচকে দাঁত বের করে মুসল, আজকাল তোমাকে দেখাই যায় না! সেদিনের ঘটনার পর তুমি কিন্তু আমার ঘরে আর আসোনি।

এ্যা। হো হো করে হেসে উঠল থোম্বোটোর বন্ধু, তোমরা বাঙ্গালীরা সব সময় কমপেয়ার না করে কথা বলতে পার না। ইউ নো শীলা, তারও এই এক হ্যাবিট।

মিসেস সেনের সঙ্গে দেখা হচ্ছে? অনিমেষ কৌতুক বোধ করল।

ও না থাকলে কলকাতায় থাকতে পারতাম? একটা চোখ ছোট করল ছেলেটা, সী ইজ মাই হেভেন অর হেল তার এনিথিং-এনিথিং অ্যান্ড ও এভরিথিং। সুর করে গেয়ে উঠল সে, বাট হোয়ার আর ইউ গোয়িং?

এক মুহূর্ত ভেবে সত্যি কথাটা বলল অনিমেষ, একটা টিউশনি পাব, সে ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে যাচ্ছি।

টিউশনি! হোয়াই ফর?

টাকার দরকার। আচ্ছা, চলি। অনিমেষ দেখল মোসাম্বার মুখ কেমন হতভম্ব দেখাচ্ছে। বি কে পাল এভিন্যু পর্যন্ত হেঁটে আসা কিছু নয়। কিন্তু সময় বাঁচাতে সেকেন্ড ক্লাস ট্রামে চেপে চলে এল সে। হাতিবাগান থেকে বাকী রাস্তাটুকু হেঁটে নির্দিষ্ট জায়গায় এসে দেখল বিরক্ত পরমহংস ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

শালা যার বিয়ে তার হুঁশ নেই আর পাড়াপড়শীর ঘুম নেই, না? সেই চারটে থেকে দাঁড়িয়ে আছি। সেইজন্য বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, কখনও কারও উপকার করো না। খেঁকিয়ে উঠল পরমহংস।

হেসে ফেলল অনিমেষ, সত্যি দেরি করে ফেলেছি। কিন্তু তুমি এরকম আংসাং কোটেশন দিও না। রেকর্ডেড হয়ে গেলে মুশকিল হবে।

মানে?

বিদ্যাসাগর ও কথা বলেননি। কেউ ওঁর নিন্দা করলে মন্তব্য করেছিলেন,–খোঁজ নিয়ে দেখ হয়তো কোন দিন ওর উপকার করেছিলাম।

তোমাদের ওই হল দোষ। মুখের কথাই শোন, অন্তরে ব্যথা বোঝ না। মুখে না বললেও বিদ্যাসাগর তাই মিন করেছিলেন। ঠিক আছে, এখন যা বলছি তা মন দিয়ে শোন। যে বাড়িতে আমরা যাচ্ছি সেটা খুব কনজারভেটিভ বাড়ি। বাইরের লোক বৈঠকখানা পার হয়ে কোন দিন ভেতরে ঢোকেনি। বুড়ো মনে করে পৃথিবীটা রসাতলে যাচ্ছে তাই তিনি নিজের ঘর সামলে রাখতে চান। মেয়েরা সিনেমায় যায় ঝি-এর সঙ্গে এবং ম্যাটিনি শো। আরও অনেক নিয়মকানুন আছে, সে গেলেই দেখতে পাবে। মোদ্দা কথা হল একদম উত্তর কলকাতার খাঁটি ঘটিদের বাড়ি।

তুমি এদের খবর পেলে কি করে? অনিমেষের অস্বস্তি হচ্ছিল।

আমার মাসীমার ননদের বিয়ে হয়েছে ওখানে। আগে একটা আশি বছরের বুড়ো পড়াত। সে ব্যাটা পটল তুলতে তিন মাস ভ্যাকান্ট আছে। এদিকে ক্লাস এগিয়ে গেছে, মেয়েটার ক্ষতি হচ্ছে।

মেয়ে? আমাকে ছাত্রী পড়াতে হবে নাকি?

আপত্তি থাকলে যেও না। তবে মেয়ে বলে গলেও যেও না। এইসব ঘটি মেয়েগুলো এক-একটা কাঁকড়া বিছে। বেচাল হলে থানা-পুলিশ করিয়ে ছাড়বে। প্রাইভেট টিউটার-ছাত্রী মার্কা প্রেমের ধান্দা একদম করো না, করলে বিপদে আমি থাকব না। পরমহংস জানাল।

পরমহংসের সঙ্গে তাল রেখে হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে অনিমেষের। বেঁটেখাটো শরীর অথচ হরিণের মত ছটফটিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আগে হলে অন্য কথা ছিল, এখন অস্বাভাবিক কিছু করলেই পায়ে টান লাগে, টনটন করতে থাকে থাই। কিন্তু অনিমেষ তাল দিতে চেস্টা করল।

শোভাবাজার/চিৎপুরের এই অঞ্চলটায় এর আগে কখনো আসা হয়নি। এখন ঠিক সন্ধ্যে নয়, তবে বিকেল শেষ হয়ে আসছে। দুপাশে দোকানপাট মানিকতা-শ্যামবাজারের তুলনায় অনেক কম। কেমন একটা আলস্য চারদিকে মাখানো। অনিমেষ নজর করল দু পাশের বাড়ির রকগুলোতে যারা গা এলিয়ে বসে আছে তারা বেশ বয়স্ক। বেশির ভাগই ধুতি এবং ফতুয়া টাইপের জামা পরে রয়েছে এবং ধুতি পরার ধরনটা কেমন আলাদা। একটা রকে আড্ডা দিচ্ছে যারা তাদের বয়স আশির কাছাকাছি তো বটেই। এ দৃশ্য কলকাতার অন্য কোন অঞ্চলে দেখা যাবে না। এটা একদম খাস ঘটিপাড়া ।

পরমহংস বলল, এসে গেছি। খুব বিনীত বিনীত মুখ করবে। বাড়িটার দিকে তাকালে বয়স ঠাওর করা অসম্ভব। বেশিরভাগ ইট মুখ বের করে রয়েছে। এবং এই বাড়ির বিশেষত্ব যে বাইরে কোন আড্ডা দেবার রক নেই। দরজায় ধাক্কা দিতে ভেতর থেকে ধমকের সুরে একটা চিৎকার ভেসে এল।

এবার একটু নরম শব্দ তুলতেই দরজাটা খুলে গেল। খুব রোগা, বেঁটে এবং কুৎসিত চেহারার একটি ছেলে জিজ্ঞাসা করল, কি চাই? দরজা ভাঙ্গবে না? কথাগুলো জড়ানো এবং অনিমেষ লক্ষ্য করল বলার সময় দুগাল বেয়ে লালা গড়িয়ে এল।

পরমহংস মিষ্টি গলায় জিজ্ঞাসা করল, তালুইমশাই আছেন? তুমি আমাইয় চিনতে পারছ না? আমি। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি ঘুরে দাঁড়াল, বাব্বা–বাব্বা তোমাকে ডাকছে, বাইরের নোক, কি করব? বসতে বলব, না দাঁড়িয়ে রাখব?

চট করে সাড়া পাওয়া গেল না। অনিমেষ দেখল সামনে একটা লম্বা প্যাসেজ এবং সেটা চমৎকার পরিষ্কার। সবে বোধ হয় ধোয়া হয়েছে। একটু বাদেই ওপর থেকে বাজখাই গলা ভেসে এল, কে?

শব্দ লক্ষ্য করে ওপরে তাকাতেই দেখা গেল এক ভদ্রলোক দোতলার রেলিং-এ ঝুঁকে ওদের দেখছেন। যেটুকু দেখা যায় তাতেই বোঝা গেল পঞ্চাশোর্ধ মানুষটি এখন খালি গায়ে একটা গামছা জড়িয়ে রয়েছেন।

পরমহংস মুখ তুলে বলল, আমি ঝুনু!

অ! তুমি এয়চো! সঙ্গে ওটি কি?

আমার সহপাঠী, ওই যে যার কথা বলেছিলাম!

অ! ঠিক আছে।

ভুলু, ওদের বাইরের ঘরে বসা। শরীরটি অন্তর্হিত হল।

জুতো খুলে এদিকে আসুন।

পরমহংসের দেখাদেখি সেই বাইরের দরজার পাশেই জুতো খুলে ভেজা প্যাসেজ থেকে দালানে উঠে এল অনিমেষ । ডাকদিকের প্রথম ঘরটার দরজা খুলে দিয়ে ভুলু নামে ছেলেটি বলল, আপনারা কি অনেকক্ষণ থাকবেন?

পরমহংস কিছু বলার আগেই অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কেন? প্রশ্নটার ধরনে ওর ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠেছিল । আচ্ছা অভদ্র তো!

তাড়াতাড়ি চলে গেলে বাইরের দরজা বন্ধ করব না। ছেলেটি লালা চাটল।

অনিমেষের গলার স্বরে সতর্ক হয়েছিল পরমহংস, সামাল দিতে সে বলে উঠল, কথাবার্তা শেষ হতে বোধ হয় সময় লাগবে, তুমি বরং বন্ধ করে দিয়ে যাও ভূলু।

ছেলেটি অদ্ভূতভাবে শরীর দুলিয়ে দরজা বন্ধ করতে গেল।

অনিমেষের মুখের দিকে তাকিয়ে পরমহংস বলল, দেখতেই পাচ্ছ ছেলেটা হাবাগোবা, কি কথা কিভাবে বলবে জানে না!

ঘরের জানলাগুলো বন্ধ। এবং এটা যদি বসার ঘর হয় তা হলে বলতে হবে অনেক কাল কেউ এখানে বসেনি। নীচে ধুলোটুলো নেই বটে, কিন্তু এমন অগোছালো জীর্ণ হয়ে আছে ঘরের জিনিসপত্র যে এদিকে নজর দেবার প্রয়োজন আছে বলে কেউ মনে করে না। গোটা চারেক লম্বা প্রাচীন আমলের কাঠের চেয়ার আর একটা গোল রঙচটা টেবিল, এক পাশে একটা তক্তাপোশের ওপর কালো মাদুর পাতা, ঘরের দেওয়ালে শেষ কবে রঙ বোলানো হয়েছিল বোঝা যাচ্ছে না।

চেয়ারে বসার কয়েক মিনিটের মধ্যেই অনিমেষ টের পেল তাকে ছারপোকা আক্রমণ করছে। ব্যাপারটা বলতে গিয়েও চুপ করে গেল সে। হাজার হোক এ বাড়ি পরমহংসের আত্মীয়দের বাড়ি । দরজার দিকে মুখোমুখি বসার অছিলায় চেয়ার পালটেও অবস্থার কোন পরিবর্তন হল না।

পরমহংস বলল, বাড়িটা একটু কনজারভেটিভ, কিন্তু তাতে কি হয়েছে। তোমার পড়ানো নিয়ে কথা, পড়িয়ে টাকা পেলেই হল, কি বল?

অনিমেষ বুঝতে পারল পরমহংস পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক করে তুলতে চাইছে। সে হাসল, তোমার ডাকনামটা জানা গেল আজ।

পরমহংস বলল, ওই আর কি! এরকম তো সবারই থাকে। আমরটা তবু ভাল, এ বাড়ির কর্তাদের কি রকম?

আমার মাসীমা ননদের বড় শ্বশুরের নাম ছিল বাঘ, মেজ শ্বশুর সিংহী, আর ছোটজনের নাম শিয়াল । মনে হয় ওদের বাবা খুব জীবজন্তু পছন্দ করতেন। খানিক দূরেই তো রাজেন মল্লিকের চিড়িয়াখানা।

হাঁ হয়ে গেল অনিমেষ। এরকম নাম কেউ রাখতে পারে! পাড়ার ছেলেরা খ্যাপাতো না? পেটের ভেতলে গুড়গুড় করছে, কোন রকমে সামাল দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, যিনি কথা বললেন তিনি কে?

শিয়াল। বাঘ-সিংহী দেহ রেখেছেন। আমরা আড়ালে শিয়ালতালুই বলি। অবিশ্যি ওঁর মা এখনও শিয়াল বলেই চেঁচান।

কথা শেষ হওয়ার পরেই শব্দ উঠল। শব্দটা জুতোর বোঝা গেল কাছাকাছি হাতেই, শিয়ালতালুই খড়ম পরে আসছেন। লম্বা, দাড়িরে মত পাকাটে চেহারা, গালের গলার চামড়া কোঁচকানো, নাক বেশ, সাজগোজ করে এসেছেন। কাছাকাছি হতেই একটা অম্বুরীতামাক মার্কা গন্ধ পাওয়া গেল ।

পরমহংসের দেখাদেখি উঠে প্রণাম করতে গিয়ে থমকে গেল অনিমেষ। লোকটা বয়স্ক কিন্তু চেনাশোনাজানা নেই, ফট করে প্রণাম করবে? হাত তুলে সে নমস্কার করতেই ভদ্রলোকের কপালে ভাঁজ পড়ল। গম্ভীর গলায় বললেন, বসো তোমরা। ওই শরীর থেকে অমন ভারী আওয়াজ বেরুতে পারে না শুনলে বিশ্বাস করা মুশকিল।

অনিমেষের ছেড়ে-আসা চেয়ারটায় বসলেন শিয়ালতালুই, বসে বললেন, ভর সন্ধ্যেতে কথা বলতে এলে, তা যাক এসে পড়েছ যখন তখন আর কি করা যাবে! তা ঝুনু, তোমার বাবা কেমন আছেন?

পরমহংস ঘাড় নাড়ল, ভাল, তালুই মশাই।

মা?

ভাল।

ঠাকুমা?

ভাল।

ভাইবোন?

প্রশ্নের ধরন দেখে অনিমেষ কোনরকমে হাসি চাপল। ভদ্রলোক খুব সিরিয়াস মুখ করে জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছেন আর বেচারা পরমহংসের অবস্থা খাঁচায় বন্ধ ইঁদুরের মত। শেয়াল তালুই শেষ করলেন, আজকাল যা যুগের অবস্তা, কেউ ভালো আছে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। তা তুমি যখন বলো ভালো তা হলে নিশ্চয়ই ভালো আছেন ওঁরা। আমার কথা জিজ্ঞাসা করলে ওঁদের বলো আমি ভাল নেই। কথার শেষে একটা বড় রকমের নিশ্বাস পড়ল।

কেন কি হয়েছে তালুই মশাই! পরমহংসকে উদগ্রীব দেখাল।

মামলা, বুঝলে, মামলাতে শেষ হয়ে গেলাম। আজকালকার ভাড়াটেরা তো এক একটা নবাবপুর, ভাড়া দেবেন না কিন্তু চোখ রাঙাবেন। আরে, তোরা ভাড়া না দিলে কি আমি না খেয়ে থাকব? জীবনে পরের গোলামি করিনি, বাড়িভাড়ার টাকায় খাই–দশটা মামলা একসঙ্গে চলচে। যদি জিততে পারি তবে আয় দশগুণ হয়ে যাবে। বেনেটোলা মত জায়গায় দশখানা ঘরের ভাড়া দেয় ত্রিশ টাকা, ভাবতে পারো? তাই-ই আদায় হয় না। বাড়িঘরদোর করে সুখ নেই, বুঝলে! কথা বলতে বলতে বা দিকের পকেট থেকে একটা টিনের ডিবে বের করে তা থেকে এক চিমটে নস্যি নিয়ে দুই নাকে খুঁজে চোখ বন্ধ করলেন শিয়ালতালুই। তারপর একটা নোংরা নস্যি রুমালে সন্তর্পণে নাক মুছলেন। অনিমেষ দেখছে যারা নস্যি নেয় তাদের গলার স্বরে একটু নাকী ভাব এসে যায়। এ ভদ্র লোকের বেলায় সেটা হয়নি। একটু ধাতস্ত হয়ে শিয়ালতালুই জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁ, এবার কাজের কথা বলি, এসেছো কেন?

ওই যে আপনি বলেছিলেন একজন ভাল মাস্টার চাই।

অ। তা এটি তো একদম ছোকরা–এ পড়াবে?

হা তালুইমশাই, খুব ভাল ছেলে, মেরিটোরিয়াস।

অ। কিন্তু এত ছোঁড়া মাস্টার রাখার কথা তো ভাবিনি। আগে যিনি পড়াতেন তার বয়স আশির ওপারে ছিলো, দিনকাল তো ভাল নয়, বুঝলে!

না, না, সেসব ব্যাপারে কোন চিন্তা করবেন না। আপনি আমার মত বিশ্বাস করতে পারেন ওকে। পরমহংস বোঝাবার চেষ্টা করল।

তোমার সহপাঠী বললে না?

হ্যাঁ।

কত বয়স?

একুশ-বাইশ, তাই না অনিমেষ? পরমহংসের প্রশ্নের নীরবে ঘাড় নাড়ল অনিমেষ।

 শিয়ালতালুই ওর দিকে এখন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। বোধ হয় ওর ভেতরটা পর্যন্ত পড়ে ফেলেছেন এর মধ্যে। এরকম অস্বস্তিতে এর আগে কখনো পড়েছে বলে মনে হয় না।

কি নাম তোমার? প্রশ্নটা এতক্ষণে সরাসরি করা হল।

অনিমেষ।

আঃ, নাম জিজ্ঞাসা করলে পদবীটাও বলতে হয়।

পরমহংস বলল, ওরা মিত্তির তালুইমশাই।

অ। মিত্তির!

কাদের বাড়ির ছেলে তুমি? শ্যামপুকুর, না ঝামাপুকুর?

আমাদের বাড়ি জলপাইগুড়িতে। অনিমেষ জানালো।

জলপাইগুড়ি! ওখানে–মানে, তোমরা কি বাঙাল? না, না, বাঙাল মাস্টার আমি রাখবো না। শিয়ালতালুই সোজা হয়ে বসলেন।

পরমহংস বলে উঠল, ওরা বাঙাল নয়, তালুইমশাই। তা ছাড়া জলপাইগুড়ি তো পশ্চিমবঙ্গেই।

শিয়ালতালুই ঘাড় নাড়লেন, আমাকে শেখাতে এসো না তুমি। রাজশাহী রংপুর জলপাইগুড়ি সব এক গোত্রের। আমাদের পশ্চিমবঙ্গীয় চালচলনের সঙ্গে কোন মিল নেই। ভাতের থালা খাটের ওপর তুলে খায় সব।

ইচ্ছে করছিল না, তবু অনিমেষ বলল, আমার ঠাকুর্দা নদীয়া জেলা থেকে ওখানে গিয়ে সেটল করেছিলেন।

অ। তাই বলো। তোমরা নদে জেলার লোক। এখানে থাকা হয় কোথায়?

হোস্টেলে।

টাকাপয়সার অভাব বুঝি?

হ্যাঁ।

কদ্দূর পড়েছ? ওহহ, তুমি তো আবার ঝুনুর সহপাঠী । তা অঙ্ক–টঙ্ক পড়াতে পারবে?

কোন ক্লাস?

সেভেন। যাদব চক্কোত্তি ভাল জানা না থাকলে পড়ানো কঠিন।

পারবো।

অ। মাইনে নেবে কত?

এবার অনিমেষ পরমহংসের দিকে তাকালো। আগে থেকে এ ব্যাপারে কিছু ঠিক করে আসেনি ওরা, খুব ভুল হয়ে গেছে। পরমহংস নির্বিকার মুখে বসে রয়েছে দেখে অনিমেষ বলল, আপনি কি ঠিক করেছেন?

শিয়ালতালুই বললেন, দেখ, আজকাল তো পড়াশুনা হয় না, শুধু টাকার শ্রাদ্ধ। আগের মাস্টারের সঙ্গে কড়ার ছিল যে তিনি অর্ধেকটা মাসকাবারে নেবেন, বাকী অর্ধেক একসঙ্গে রেজাল্ট বেরুলে পেয়ে যাবেন। তা তুমি তাও করতে পারো।

কাটা কাটা গলায় অনিমেষ বলল, আমার প্রতি মাসে পেলেই ভাল হয়।

অ। চা-জলখাবার সহ পড়ালে পনের টাকা পাবে, বাদ দিলে কুড়ি। কোনটা করবে? তা জলখাবার বলতে কোন দিন বিস্কুট, কোন দিন মুড়ি, মানে ঘরে যা হয় এইসব।

আমাকে চা দিতে হবে না।

তার মানে কুড়ি। বেশ, বেশ। ভালভাবে পড়াও, মন দিয়ে পড়াও, রেজাল্ট ভাল করুক, দেখবে চড়বড় করে মাউনে বাড়িয়ে দেব। জানো, হাতিবাগানের একটা চার ঘরওয়ালা বাড়ি থেকে আমি কুড়ি টাকা ভাড়া বাবদ পাই, কি দুরবস্থা! তা আজ হল গিয়ে ষোল তারিখ–বেশ, বেশ, তুমি আজ থেকেই শুরু করে দাও। এ মাসে অর্ধেক পাবে। আর একটা কথা, তুমি অল্প বয়সের ছেলে, দেখো, আমার মেয়েকে নিয়ে কোন গোলমাল করো না, বুঝলে?

পরমহংস বলল, সে ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, তালুইমশাই।

তা হলে তোমরা কথা বল, আমি একটু তোমার মাসীমার সঙ্গে শলা–পরামর্শ করে আসি। হাজার হোক, মেয়েছেলের ব্যাপার।

শিয়ালতালুই খড়মের শব্দ তুলে চলে যেতেই অনিমেষ উঠে দাঁড়াল।

পরমহংস জিজ্ঞাসা করল, কি হল?

ইম্পসিব্‌ল । আমার দ্বারা এখানে পড়ানো হবে না। চলো কাটি।

সে কি! সব ঠিক হয়ে গেল যখন।

কিস্যু ঠিক হয়নি। এরকম চশমখোর ব্যবসাদারের সঙ্গে আমার যে বনবে না তা বুঝতে পেরেছি। কবে যে ঠোকাঠুকি লেগে যাবে সামনাসামনি, মেজাজ সমালাতে পারবো না, তোমার বদনাম হয়ে যাবে।

ধ্যাত। পরমহংস ওকে হাত ধরে আবার বসাল, তোমার দ্বারা কিস্যু হবে না। যুদ্ধ কিংবা প্রেম, এ দুটো ব্যাপারে মাথা ঠাণ্ডা করে থাকলে আখেরে লাভ হয়। আরে, এ বাড়িতে তোমার এমন কিছু এক্সপিরিয়েন্স হয়েও যেতে পারে যা কল্পনা করতে পারনি। শেষটা দেখে যাও।এই সময় খড়মের শব্দ আবার ভেসে এল । শিয়ালতালুই ফিরে এসে দরজায় দাঁড়ালেন, বুঝলে ঝুনু, তোমার মাসীমার আপত্তি ছিলো, কিন্তু তোমার বন্ধু বলে শেষ পর্যন্ত রাজী হয়ে গেলেন! কিন্তু এ ঘরে পড়ালে তো চলবে না। আমাদের আত্মীয়স্বজনদের তো জানো, মুখে বদনাম ছড়িয়ে যাবে। তুমি বরং উঠে এসো–ভুলু, ওকে ভেতরের ঘরে নিয়ে যা। না, না ঝুনু, তুমি যাচ্ছ কোথায়? তুমি বসো, তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার