দুদিন মাধবীলতা য়ুনিভার্সিটিতে আসেনি। না বলে-কয়ে হঠাৎ ডুব দেবার মেয়ে ও নয়। অনিমেষ অস্থির হয়ে পড়ল। নিমতার বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নেবার ইচ্ছা হলেও ঠিক সাহস হচ্ছিল না। সাহস না হবার কারণ ইদানিং ওদের বাড়িতে যে গরম হাওয়া বইছে তাতে ওর যাওয়াটা আগুনে আরও ঘি ঢালার মত না হয়ে যায়। মাধবীলতার সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা সহপাঠীরা ইতিমধ্যে জেনে গেছে। কিন্তু অনিমেষ কারো সঙ্গে যেচে মাধবীলতাকে নিয়ে কথা বলেনি। তাই এখন কী করা যায় তা আলোচনার মত কোন বন্ধুকে পেল না সে। পরমহংস থাকলে একরকম হতো কিন্তু সে এখন য়ুনিভার্সিটিতে শুধু নামটাই রেখেছে। ওর বাবা রিটায়ার্ড হবার সময় ছেলেকে নিজের ব্যাঙ্কে বসিয়ে গেছেন।

গতকাল একটা কাণ্ড হয়ে গিয়েছে। ক্লাস থেকে বেরিয়ে ও কফিহাউসের দিকে হাঁটছিল এমন সময় সুদীপ ওকে ডাকল, কি ব্যাপার অনিমেষ, তোমার পাত্তাই পাওয়া যাচ্ছে না। ভাবছিলাম তোমার খোঁজে হোস্টেলে কাউকে পাঠাবো। তুমি রোজ ক্লাস করছ?

শেষ প্রশ্নটার উত্তর দিল অনিমেষ হ্যাঁ।

সেকি! তাহলে আমাদের সঙ্গে দেখা করছ না কেন?

আজকাল আর সময় পাই না। পরীক্ষা আসছে। কথাটা বলেই অনিমেষের মনে হল এটা কোন যুক্তি নয়। বিমানরা এ-বছর পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের আশায় বসে আছে। ওদের তো পরীক্ষার জন্যে কাজকর্ম করতে কোন অসুবিধে হয়নি।

সুদীপ চুরুট বের করল, তুমি কি আর য়ুনিয়নের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চাইছ না?

কয়েক মুহূর্ত ভাবল অনিমেষ। না, আর মিথ্যে কথা বলে কি লাভ! সে স্পষ্ট বলল, না।

 কেন? সুদীপ চমকে উঠল।

আমার মনের সঙ্গে আপনাদের কাজকর্ম মিলছে না। যে-পথটাকে সমর্থন করতে পারছি না সে পথে হাঁটতে আমার বিবেকে বাধে।

তুমি কি ভেবেচিন্তে কথা বলছ?

না ভেবে বলছি এ ধারণা কেন হচ্ছে?

কারণ তোমার সম্পর্কে পার্টির নেতাদের কেউ কেউ ইন্টারেস্টেড। তোমার কি কারো সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল?

না তো। অনিমেষের মনে পড়ল সেই ভদ্রলোককে যিনি কাকার হোস্টেলে তাকে কৃতার্থ করতে চেয়েছিলেন।

সুদীপকে খুব হতভম্ব দেখাচ্ছিল, অনিমেষ, তুমি কি নেক্সট ইলেকশনে কনটেস্ট করছ না? তুমি নিশ্চয়ই জাননা এবার তোমাকে কি পোর্টফলিও দেওয়া হবে।

না সুদীপদা। আমাকে ছেড়ে দিন। আপনাদের পথ আমার জন্যে নয়।

সুদীপের মুখটা এখন ভেঙ্গেচুরে একাকার। সে যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

অনিমেষ হেসে বলল, চলি, যদি চান তো আমার রেজিগনেশন লেটার পাঠিয়ে দেব। কারণ। এখনও তো কমিটি মেম্বার আছি আমি।

সুদীপ হঠাৎ বলে উঠল, তোমার সঙ্গে কি সুবাস সেনের যোগাযোগ হয়েছে?

কেন বলুন তো?

আমার তো তাই মনে হচ্ছে।

আপনি বুদ্ধিমান। অনিমেষ আর দাঁড়াল না। রাস্তায় নেমে মন খুব হালকা হয়ে গেল। ব্যাপারটা আজ নয় কাল পরিষ্কার করতেই হতো। আজ সুদীপ নিজে এগিয়ে এসে সেটা সহজ করে দিল। সুদীপ নিশ্চয়ই এখন বিমানকে গিয়ে একথা জানাবে এবং তারপর বাম ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে অনিমেষের সম্পর্ক যে নেই একথা ঘোষণা করা হবে। অনিমেষের মনে হচ্ছিল, অনেকদিন জ্বর ভোগের পর যেন আজ তার শরীর নিরুত্তাপ।

কফিহাউসে ওদের ক্লাসের দুতিনজন ছেলে আড্ডা দিচ্ছিল, অনিমেষ ওদের টেবিলে গিয়ে বসল। একটু অন্যমনস্ক ছিল বলে প্রথমে টের পায়নি, খেয়াল হতে বুঝল ওরা যেন কথাবার্তায় আড়ষ্ট হয়ে গেছে। কিংবা এতক্ষণ ওরা যা আলোচনা করছিল সে এসে পড়ায় তা পালটেছে। অনিমেষ বলল, একজন যার নাম প্রশান্ত হাসল, না না, বসো।

কিন্তু আমার মনে হচ্ছে করলাম। তোমরা কি নিয়ে আলোচন করছিলে?

ও ছেড়ে দাও। তোমার ভাল লাগবে না।

ভাল লাগবে না কেন?

আমরা সাধারণ মানুষ আর তুমি রাজনৈতিক কর্মী তাই।

প্রথম কথা তুমি যেটি বললে আমি তা নই। আর একজন রাজনৈতিক কর্মী যদি সাধারণ মানুষ না হয় তাহলে তিনি ক্রিমিন্যাল। বল।

রোগা মতন একটি ছেলে, অনিমেষ তার নাম জানেনা, বলল, সব কথা তো সবার সঙ্গে আলোচনা করা যায় না। এটা আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।

অনিমেষ একটু হোঁচট খেল সে হাসবার চেষ্টা করে বলল, সরি। প্রশান্ত বলল, না, না, অনিমেষ, তোমার কিছু মনে করার কারণ নেই। আমরা স্ল্যাং নিয়ে আলোচনা করছিলাম তোমার মত সিরিয়াস ছেলের সামনে এসব কথা বলা ঠিক নয় তাই বলছি না।

স্ল্যাং? মানে অশ্লীল কথা? চোখ বড় বড় করল অনিমেষ। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হল আরো তিনজন নিজেরা যা আলোচনা করতে পারছে সহপাঠী হয়েও সে আলোচনায় তাকে জড়াতে দ্বিধা করছে। সামান্য য়ুনিয়ন করেই সে এভাবে দূরত্ব বাড়িয়ে ফেলেছে। এদের সঙ্গে মিশবার জেদ এল ওর। বলল, খুব ইন্টারেস্টিং সাবজেক্ট! আমি শুনতে পারি না?

প্রশান্ত বলল, কথ্যভাষায় যে অশ্লীল গালাগাল চলে আসছে তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেমন পালটে যাচ্ছে। যেমন ধরো এককালে কেউ শালা শব্দটা ব্যবহার করে মনের ঝাল মেটাতো। তখন গুরুজন বা মেয়েদের সামনে কথাটা ব্যবহার করতে সাহস হতো না। এই শব্দটা প্রয়োগ করলে মারামারি পর্যন্ত হয়ে যেত। কিন্তু এখন ওটা জলের মত সহজ, মেয়েরাও বলে। এবং এখনকার রকবাজ ছেলেরা শালা ব্যবহারই করে না। এরকম আরো আছে, ভোদা, উজবুক, বুদ্ধু এইসব শব্দ ব্যাকডেটেড হয়ে গেছে।

রোগা ছেলেটি বলল, এখন দু-অক্ষর চার অক্ষরের শব্দ এগুলোকে রিপ্লেস করেছে। মজার কথা হল এরা যখন ওই শব্দগুলোকে উচ্চারণ করে তখন তার অর্থ বা অশ্লীলতা সম্পর্কে কোন রকম সচেতন না হয়েই করে। জিভের ডগায় এত সহজে এসে যায় যে ওরা তা নিজেই জানে না। কোনদিন দেখল গল্প-উপন্যাসেও শালা শব্দের মত এগুলো খুব স্বছন্দে লেখা হচ্ছে।

অনিমেষের বেশ মজা লাগছিল বিষয়টা শুনতে। সত্যি কথাই, পথেঘাটে আজকাল কিছু ছেলে পুরুষাঙ্গের একটি প্রতিশব্দ বিকৃতভাবে শালার বিকল্প হিসেবে বাক্যে ব্যবহার করে। তা নিয়ে তাদের সত্যি কোন বিকার নেই। ট্রামে-বাসে প্রকাশ্যে ওরা বলে যায় এবং আমার সেগুলো নীরবে শুনে থাকি। একটা শব্দ শ্লীল কি অশ্লীল তা আমরাই ঠিক করে নিই, আমরাই তা পরিবর্তন করতে পারি। অনিমেষ বলল, কথাটা ঠিক। তবে শুধু বাংলা ভাষা কেন, পৃথিবীর সব ভাষাতেই এটা হচ্ছে। লেখাতেও আসবে বইকি।

রোগা ছেলেটি বলল, শব্দ থেকে যদি গল্প বের হয় তাহলে আমরা চিৎকার করি। কিন্তু কতগুলো নিরীহ শব্দ পাশাপাশি দাঁড়ালে নিরীহত্ব হারিয়ে অশ্লীল শব্দের চেয়ে তীব্রতর হয়ে উঠে। তখন?

অনিমেষ বলল, ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না।

ছেলেটি হাসল, এটা অবশ্য আমার আবিষ্কার। রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতার লাইন আছে সেগুলোকে আপাতচোখে খুব নিরীহ দেখায় কিন্তু একটু ভাবলেই তা থেকে অন্য মানে বেরিয়ে আসে।

ভুরু কোঁচকালো অনিমেষ, অন্য মানে মানে? কি যা তা বলছ?

ছেলেটির হাসি থামছিল না। সে হাত নেড়ে বলল, এটা তো যে ভাবছে তার ভাবনার ওপর নির্ভর করে। কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষ হো হো করে হেসে উঠল।

ছেলেটি ততক্ষণে খুব সিরিয়াস, বলল, তাহলে বুঝতেই পারছ যে শুনছে সে-ও কেমন করে শুনছে। তার ওপর শ্লীল অশ্লীল নির্ভর করে।

অনিমেষ কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার চোখ দরজার দিকে যেতেই সে চুপ করে গেল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি আসছি।

মাধবীলতা তখন হলঘরে ঢুকে এদিকে তাকাচ্ছিল। অনিমেষকে দেখতে পেয়ে কাছে এগিয়ে এল, তোমার এখন কোন কাজ আছে?

অনিমেষ মাথা নাড়ল, না।

তাহলে চল। ওকে খুব চঞ্চল দেখাচ্ছিল।

এখানে বসবে না? অনিমেষ ওকে বুঝতে পারছিল না।

না! বড্ড ভিড় এখানে কথা বলা যাবে না। মাধবীলতা হলের বাইরে বেরিয়ে আসতে অনিমেষ সঙ্গী হল। খুব চঞ্চল দেখাচ্ছে ওকে, মুখে ঘাম, কপালে খুচরো চুল এসে পড়েছে। দুদিন অনুপস্থিত এবং এইরকম চঞ্চলতার কারণ না জানা অবধি অনিমেষের স্বস্তি হচ্ছিল না। খুব গম্ভীর দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। জামাকাপড়ও আজ অন্যদিনের মত উজ্জ্বল নয়।

কলেজ স্ট্রিট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করল, কলেজ স্কোয়ারে বসবে?

একটু ভেবে মাধবীলতা জানাল, না, খিদেও পেয়েছে, বসন্তে চল। তারপর হেসে চিমটি কাটল, মানে?

এই দুপুর রোদে কলেজ স্কোয়ারে কারা বসে মশাই? ঠোঁট টেপা অবস্থায় গলা দিয়ে একরকম হাসির আওয়াজ তুলল মাধবীলতা।

বসন্তের বারান্দায় বসে দুটো মোগলাই পরোটার অর্ডার দিল মাধবীলতা। দিয়ে এক গ্লাস জল চকচক করে খেল। অনিমেষ দেখল ওর গলার নীলচে চামড়ার ভিতর দিয়ে জলটা যে নেমে যাচ্ছে। তা স্পষ্ট বোঝা গেল। রুমালে মুখ মুছে একটু শান্ত হলে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এবার বল তো কি হয়েছে? মাধবীলতা ওর চোখের দিকে তাকাল। কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা এবং শেষ পর্যন্ত দুষ্টমিমাখা হাসিতে মাধবীলতার চোখদুটোকে উজ্জ্বল দেখল অনিমেষ। কথা না বলে তাকিয়ে থাকা সময়টায় বড় অস্বস্থি হয়। সে পরিস্থিতিটাকে সহজ করার জন্য বলল, দুদিন এলে না কেন, শরীর খারাপ হয়েছিল?

মাধবীলতা মুখে কিছু না বলে মাথা নাড়ল, না।

তাহলে? বাড়িতে কোন গোলমাল হয়েছিল?

এবার একটু গম্ভীর হল মাধবীলতা, সে তো লেগেই আছে। দুদিন দ্যাখোনি, আমি ভাবলাম নিশ্চয়ই বাড়িতে গিয়ে হাজির হবে।

অনিমেষ বলল, হতাম যদি জানতাম আমি গেলে তুমি কোন অসুবিধের পড়বে না। তবে আর দুতিনদিন না এলে কি করতাম জানি না।

থাক, আর বীরত্ব দেখাতে হবে না। এই জানো, আমার চাকরিটা হয়ে গেছে। হাসতে হাসতে বলল মাধবীলতা। হঠাই।

খুব আনন্দ হল অনিমেষের। একটু জোরেই সে বলে উঠল, সত্যি?

নিঃশব্দে হাসতে হাসতে মাথা নাড়ল মাধবীলতা, হ্যাঁ!

পরক্ষণেই অনিমেষের মনে বিষণ্ণতা ছড়াল, কিন্তু, তুমি কি পরীক্ষা দেবে না?

মাধবীলতা বলল, কেন দেব না? ক্লাস তো প্রায় শেষ হয়ে এল, বাকিটা মাঝে মাঝে এসে ম্যানেজ করে যাবে। আর পড়াশুনার ব্যাপারে তুমি রইলে।

আমি?

বাঃ, একসময় আমি তোমার নোটস টুকেছি তুমি করবে আমার জন্যে। বলে হাসতে লাগল মাধবীলতা। তারপর মাথা নেড়ে বলল, তোমাকে আমার জন্যে মোটেই চিন্তা করতে হবে না মশাই। ও আমি ঠিক ম্যানেজ কর নেব।

অনিমেষ উজ্জ্বল হল, যাক, তোমার খুব ভাল কপাল। কেউ চাকরি পাচ্ছে এখবর সচরাচর শোনা যায় না।

মাধবীলতা বলল, কপাল যদি বল তাহলে সেটা আমার একার নয়। আমাদের।

অনিমেষ মাধবীলতা মুখের দিকে অপলকে তাকাল। ওর খুব ইচ্ছে করছিল এখনই ওকে নিয়ে সরিৎশেখর এবং হেমলতার কাছে নিয়ে যায়।

মাধবীলতা বলল, এই, ওভাবে তাকাবে না।

কিভাবে?

জান না। আমাদের এখনও অনেক কিছুর জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। ওভাবে তাকালে আমার সবকিছু গোলমাল হয়ে যায়।

অনিমেষ হঠাৎ বুকের মধ্যে এক ধরনের চাপ অনুভব করল। এ সময় অবধি তার যা কিছু ভাবনা চিন্তা তা সে একাই করেছে। ছেলেবেলা থেকেই একা একা থাকার জন্যে এটা হতে পারে। কিন্তু মাধবীলতার বন্ধুত্ব পাওয়ার পর নিজেকে নিশ্চিন্ত মনে হয়, যা এর আগে কখনও হয়নি।

পুরুষ মানুষ যদি কোন নারীর আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো ভালবাসা না পায় তাহলে তার বেঁচে থাকা অর্থহীন।

মাধবীলতা বলল, অনি, আবার কি ভাবছ?

অনিমেষ হেসে ফেলল, ডাকটা কত মিষ্টি লাগল ওর। এই প্রথম তাকে অনি বলে ডাকল মাধবীলতা। সেটা বুঝতে না দিয়ে বলল, আমি ভাবছি এবার থেকে তোমার দেখা পাব কি করে? তুমি রোজ কি আসবে?

কেন আসব না?

এতটা উজানে?

আসব। তোমাকে না দেখলে আমার ভাল লাগে না।

এই দুদিন তো দেখলাম!

 রাগ করতে গিয়েও করল না মাধবীলতা, অমন করে বলো না। দুদিন ধরে এই চাকরিটার জন্যে যা চরকিবাজি করেছি! আসতে পারিনি বলে আমারই খারাপ লেগেছে। ভেবেছি একবারে এসে তোমাকে সুখবরটা দেব। দিলাম।

খাওয়া হয়ে গেলে মাধবীলতা কব্জি ঘুরিয়ে সময় দেখল। তারপর বলল, চল!

অনিমেষ বলল, কোথায়?

আমি যদি বলি নরকে, তুমি যাবে না?

 চিন্তা করব। কারণ সেখানে নাকি বিশাল কড়াই-এ গরম তেল দিনরাত ফোটে, গেলেই চুবিয়ে দেয়।

ওঃ, কথায় তোমার সঙ্গে আমি পারব না। আমি শ্যামবাজার যাব। তুমি আমার সঙ্গে চল। প্লেট থেকে মৌরি তুলে দাঁতে কাটল মাধবীলতা।

কাজটা কি?

বাসস্থান খুঁজতে।

 বাসস্থান? অনিমেষ হতভম্ব হয়ে গেল।

আমার একটা থাকার জায়গা চাই না? দুটো লেডিস হোস্টেলের খবর পেয়েছি। চলো, গিয়ে দেখি সেখানে জায়গা আছে কি না। গম্ভীর গলায় জানাল মাধবীলতা। এতক্ষণে সব কথা মনে পড়ল অনিমেষের। চাকরি পেলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবে বলে জানিয়েছিল মাধবীলতা। সেটা যে এতটা স্থির সিদ্ধান্ত তা অনুমান করতে পারেনি। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে কিছু করে ফেললে সারাজীবন মেয়েটাকে এজন্যে আফসোস করতে হবে।

অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ব্যাপরটা কি এতই সিরিয়াস?

মানে? ভুরু কোঁচকাল মাধবীলতা।

এখনই হোস্টেলে থাকতে হবে এমন কিছু কি হয়েছে?

 তুমি কি বলতে চাইছ আমি বুঝতে পারছি না।

যদি অ্যাডজাস্ট করে বাড়িতে থাকা যায়—

অনি, একটা মেয়ে ঠিক কিরকম পরিস্থিতি হলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে হোস্টেলে উঠতে চায় তা তুমি বুঝবে না। তারপর নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করল, তোমার কি ভয় হচ্ছে?

ভয়? কি ব্যাপারে?

আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে তুমি জড়িয়ে পড়বে। মাধবীলতার গলা ভারী হয়ে আচমকা থেমে গেল।

সিসের বল যেন আচমকা কেউ অনিমেষের বুকের ভেতর গড়িয়ে দিল। সে দ্রুত মাধবীলতার হাত ধরে বলল, ছিঃ।

কিছুক্ষণ সময় লাগল সহজ হতে। মাধবীলতা বলল, বাবা বলেছেন যদি বিয়ের ব্যাপারে আমি স্বাধীনতা চাই তাহলে আর একমাসের মধ্যে যেন নিজের ব্যবস্থা করে বাড়ি থেকে চলে যাই। শর্ত দিয়েছেন। কোন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে ওঠা চলবে না। অনেক ভেবেছি। তোমাকে ভালবাসার পর আর অন্য কোন পুরুষকে স্বামী বলে মেনে নিতে পারব না। এই সময় স্কুলের চাকরিটা না পাওয়া গেলে যে কি করতাম জানি না। আমি তোমার কাছে তো কখনো কিছু চাইব না অনি, শুধু অনুরোধ কখনো আমাকে ভয় পাইয়ে দিও না।

অনিমেষ এতক্ষণ চুপচাপ কথাগুলো শুনছিল। শুনতে ওর মনে হচ্ছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে মাধবীলতার উপযুক্ত হতে হবে। এই মেয়েটির সামান্য অসম্মান মানেই তার বেঁচে থাকাটা লজ্জার। সে উঠে দাঁড়াল, চল।

মাধবীলতা মাথা নীচু করে হাঁটছিল। কিছুক্ষণ নীরবে চলতে চলতে অনিমেষের হঠাৎ মনে হল এই মেয়েটির সঙ্গে সেই মেয়েটির কোন মিল নেই। য়ুনিভার্সিটি থেকে প্রথম আলাপের দিন যে মেয়েটি ওর সঙ্গে শেয়ালদা অবধি হেঁটে গিয়েছিল সে ছিল ঝরণার মত তেজী, ছটফটে। আর এখন যে ওর সঙ্গে হাঁটছে সে নদীর মত গভীর, গভীর। প্রথমজনের সঙ্গে কথার খেলা করা যায়, এর মধ্যে সব কথা ডুবিয়ে দিতে হয়।

অনিমেষ মনে মনে বলল, আমাকে বিশ্বাস কর, বিশ্বাস কর।

কলেজ স্ট্রিটের ভিড়ের মধ্যে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মাধবীলতা ওর হাত স্পর্শ করল। হয়তো কাকতালীয় কিন্তু অনিমেষ শিহরিত হল। ওর মনে হল, মুখ ফুঠে না বললেও মাধবীলতা ওর কথা বুঝতে পেরেছে।

রাজবল্লভ পাড়ার কাছে একটা মেয়েদের হোটেল আছে, একটুকুই জানত মাধবীলতা। সেখানে পৌঁছাতে বিকেল প্রায় ফুরিয়ে এল। দু-একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই হদিস পাওয়া গেল। গিরিশ এভিন্যুতে ঢুকে একটা গলির মধ্যে হোস্টেলটা। মাধবীলতাই কথা বলল। অনিমেষ বাইরে দাঁড়িয়েছিল। কয়েক মিনিট বাদে বেরিয়ে এসে হাসল, হল না।

সিট নেই?

না। মাস কয়েক বাদে একটা খালি হতে পারে।

যাচ্চলে। মেয়েদের হোস্টেলেও এত ভিড়?

 কি কথা বলছ! মাধবীলতা কপালে ভাঁজ আনল, কলকাতায় মেয়েদের একা থাকার কটা জায়গা আছে মশাই! পাড়ায় পাড়ায় ছেলেদের হোস্টেল, কিন্তু কোন মেয়ে একা থাকবে এটাই তোমরা ভাবতে পার না। এবার দেশবন্ধু পার্কের কাছে যাব।

ওখানেও যদি না পাওয়া যায়!

অন্য কোথাও দেখতে হবে।

ধরো, কলকাতার কোথাও যদি পাওয়া না যায়!

না আমি ধরতে পারব না। আমার দরকার তাই পেতে হবে।

কিন্তু দেশবন্ধু পার্কেও জায়গা পাওয়া গেল না। হোটেলের পরিচালিকার কাছে জানা গেল আমহার্স্ট স্ট্রীটে আর একটি হোস্টেল আছে চাকুরীজীবী মহিলাদের জন্যে। এছাড়া আরো দুটো মেস আছে উত্তর কলকাতায় যা মেয়েরাই চালান। মাধবীলতা নাছোড়বান্দা হল, আজই সে সবগুলোর খোঁজ নেবে। কারণ একদিন দেরি হলে অন্য কেউ সুযোগটা নিয়ে নিতে পারে। কিন্তু অনিমেষ রাজী হচ্ছিল না। সন্ধ্যে হয়ে আসছে, নিমতায় ফিরতে রাত হয়ে যাবে মাধবীলতার। এখন বাড়িতে যে টেনশন চলছে তাতে বেশী রাত করে ফেরা উচিত নয়। মাধবীলতাকে বোঝাল, হোস্টেলগুলোতে গিয়ে আজই খোঁজ নেবে সে, মাধবীলতার যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। যদি খালি থাকে কোথাও তাহলে সে ব্যবস্থা করে ফেলবে। কথাটা শুনে মাধবীলতা ব্যাগ খুলে একশটাকার নোট বের করল, তাহলে এটা রাখো, ব্যবস্থা করতে হলে তো টাকা লাগবে।

অনিমেষ টাকাটার দিকে তাকাল। কথাটা সত্যি। ওই টাকাটা হাত পেতে নিতে সঙ্কোচ হচ্ছিল ওর। তার উচিত নিজেই ওটা দিয়ে দেওয়া। কিন্তু এখন তার পক্ষে সেটা অসম্ভব। মাধবীলতা বলল, এটা আমার জমানো টাকা। নাও।

টাকাটা নিলেও মন থেকে কুয়াশা দূর হল না। টাকা দরকার। নিজে উপার্জন না করলে পৃথিবীতে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা মাঝে মাঝে মুশকিল হয়। সঙ্গে সঙ্গে এর পালটা একটা যুক্তি মনে এলেও অনিমেষ স্বস্তি পেল না।

মোহনলাল স্ট্রীট ধরে ওঁরা হেঁটে আসছিল। হঠাৎ অনিমেষ নিজের নামটা শুনতে পেল। মহিলাকণ্ঠ, মাধবীলতাও শুনেছিল। পেছন ফিরে আবছা অন্ধকারে কাউকে দেখতে না পেয়ে অনিমেষ বলল, কেউ আমাকে ডাকল, না?

তাই তো শুনলাম।

এমন সময় একটি বাচ্চা মেয়ে ছুটতে ছুটতে পাশে গলি দিয়ে বেরিয়ে এল, আপনাকে ডাকছে।

কে?

বউদি।

অনিমেষ মাধবীলতার মুখের দিকে তাকাল। বউদিটি আবার কে সে জিজ্ঞাসা করল, ঠিক বলছ তো? অন্য কাউকে ডাকতে বলেনি তো তোমাকে?

মেয়েটি মাথা ঘুরিয়ে বেণী নাচাল, মোটেই না। ওপর থেকে তোমাদের দেখে বলল ওই লম্বা ভদ্রলোক আর হলুদ শাড়িপরা মেয়েটাকে ডেকে আন।

মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, তোমার বৌদির নাম কি?

জানি না। আমি অন্য বাড়িতে থাকি।

অনিমেষ মাধবীলতাকে জিজ্ঞাসা করল, কি করবে?

যাও একবার দেখে এসো। আমি দাঁড়াচ্ছি।

কিন্তু তোমার তো দেরী হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া কে না কে, অন্ধকারে ভুলও করতে পারে। চল, একসঙ্গে গিয়ে একটু দাঁড়িয়েই ফিরে আসি। অনিমেষের কথায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাধবীলতা গলিতে ঢুকল। একটু এঁকেবেঁকে একটা দোতলা বাড়ি সিঁড়ির কাছে গিয়ে মেয়েটি বলল, ওপরে চলে যান। অনিমেষ মাধবীলতাকে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠতেই ভূত দেখার মত চমকে উঠল। দরজায় দাঁড়িয়ে নীলা হাসছে।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার