এই এতটা পথ আসর সময়ে তার মনে অনেকবার সন্দেহ এসেছে সোম দেখছিল মেয়েটাকে। কিন্তু ওদের সাহায্য ছাড়া তার পক্ষে শহরে ঢোকা সম্ভব হত না। প্ৰায় বাধ্য হয়েই সে এদের কথা মেনে চলেছে। কিন্তু শহরে ঢোকার পর তার মাথায় দ্বিতীয় চিন্তা এসেছিল। এদের সঙ্গে যদি আকাশলালদের সরাসরি যোগাযোগ থাকে, তাহলে এদের সূত্র ধরেই সে লোকটার কাছে পৌঁছে যেতে পারবে। আর একবার সেটা সম্ভব হলে ভার্গিসের ওপর চমৎকার টেক্কা দেওয়া যাবে। যদিও এর মধ্যে দু-দুবার হেনাকে বলেছে সে একাই চলে যেতে চায়। কিন্তু সেটা তার মনের ইচ্ছে নয়। না বললে এদের মনে প্রশ্ন জাগবে বলেই বলেছে। দূরে ফোয়ারার কাছে দাঁড়ানো লোকটার সঙ্গে হেনা যখন কথা বলছিল তখন সে চেনার চেষ্টা করেছে। লোকটার মুখে দাড়ি আছে। সে ঠিক চিনতে পারেনি। নিজে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকায় কিছুটা আশ্বস্ত আছে। এবার নিশ্চয়ই হেনা তাকে আকাশলালদের কাছে নিয়ে যাবে। দাড়িওয়ালা লোকটাকে চলে যেতে দেখল সোম।

কাছে এসে হেনা মিষ্টি হাসল, আজকের রাতটা কোথায় কাটানো যায় বলুন তো?

সোম বলল, থাকার জায়গা ঠিক না থাকলে এখন কোথাও পাবে না। এমনিতেই মানুষ রাস্তায় শয়ে আছে। আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?

হেনা বলল, দাঁড়ান, একটু ভেবে দেখি। তারপর দ্বিতীয় পুরুষকে ইশারায় খানিকটা সরিয়ে নিয়ে এসে বলল, আমরা কবরখানার দিকে যাচ্ছি, ওকে সরাতে হবে। তুমি এমন ভাবে ফলো করো যাতে ও সন্দেহ না করে।

লোকটা মাথা নেড়ে ভিড়ের মধ্যে মিশে যেতে হেনা ফিরে এল সোমের কাছে ওকে কাটিয়ে দিলাম। যত্ত ঝামেলা। ওর বলাম মধ্যে এমন একটা সুর ছিল যা সোমকে বিস্মিত এবং পুলকিত করল। মেয়েটা ন্যান্তানো সুন্দরী নয়, ধারালো রুক্ষতা ওর স্বভাবে। তার নিজের যথেষ্ট বয়স হওয়া সত্ত্বেও এমন মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে থাকা যায় না। ওর ভাবভঙ্গিতে এতক্ষণ পরে কিছুটা প্রশ্রয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

হেনা বলল, আমরা এখানে সারারাত দাঁড়িয়ে থাকব নাকি?

নিশ্চয়ই না, নিশ্চয়ই না। কিন্তু কোথায় যাওয়া যায়। সোম বিড় বিড় করল।

আচ্ছা, এখানকার কবরখানাটা কত দূরে?

কবরখানা। কেন বলো তো?

আমার এক মামা থাকে। ওখানে একলা মানুষ, বিরাট বাড়ি। গেলে খুশি হবে। যাবেন?

যাওয়া যেতে পারে। হেনার পেছন পেছন হাঁটা শুরু করল সোম। এই মামাটি আকাশলাল নয়, তো? সে কি করবে? আগে থেকে ভার্গিসকে খবর পাঠালে বোকা বনতে কতক্ষণ। আকাশলাল তাকে দেখলেই চিনতে পারবে। আর তখনই একটা হেস্তনেস্ত করতে হবে। এখন অনেক রাত। মেয়েটা কি এত রাত্রে আকাশলালকে জাগাবে? নাকি ভোর অবধি একসঙ্গে কাটিয়ে তারপর মামার কাছে নিয়ে যাবে। মামা! চমৎকার অভিনয় করেছে মেয়েটা। কিন্তু ফোয়ারার পাশে দাঁড়ানো লোকটার সঙ্গে দেখা করার পর থেকেই ওর স্বভাবটা বদলে গেল। এইটাই সন্দেহজনক। যেতে যেতে হেনা হাসল শব্দ করে, আপনার কি হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে?

না, কেন বলো তো?

পিছিয়ে পড়ছেন। দেখে তো মনে হয় এখনও যুবক আছেন।

ও তাই? এই দ্যাখো পাশে এসে গেছি। এবার বাঁ দিকে যেতে হবে।

পুলিশ ভ্যান আসছে, দাঁড়িয়ে পড়ুন থামটার আড়ালে।

সোম দেখল একটা ভ্যান খুব ধীরে ধীরে রাস্তা দিয়ে এগিয়ে আসছে। ওরা দেখলেই চিনতে পারবে এবং তাহলে রক্ষা নেই। সে থামিটার পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। হেনাও। হেনা বলল, যদি কিছু জিজ্ঞাসা করে আমি কথা বলব। বলব। আপনি আমার স্বামী বলতে পারি?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। সোম নিঃশ্বাস ফেলল।

অবশ্য আমার কোনও স্বামী নেই। মানে বিয়েই হয়নি। প্রেমিকও জোটেনি। এমন কপাল। আচ্ছা, আপনার কোনও প্রেমিকা আছে? চাপা হাসল হেনা।

গলা শুকিয়ে কাঠ। ভ্যানটা হাত কয়েক দূরে এসে পড়েছে। সোম নিঃশব্দে মাথা নেড়ে না বলল।

হেনা ফিসফস করল, আপনার বুকে আওয়াজ হচ্ছে কেন?

কই? না তো।

হ্যাঁ, আমি শুনতে পাচ্ছি। হেনা ঘনিষ্ঠ হল।

ভ্যানটা দাঁড়িয়ে পড়েছে খানিকটা গিয়ে। এখনও কেউ লাফিয়ে নামেনি ওটা থেকে। একদিন আগেও ভ্যানগুলো তার ইঙ্গিতে চলাফেরা করত। আর আজ-! সোম মাথা নাড়ল, এই তো জীবন। অন্ধকার ফুটপাতে থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে মেয়েটার শরীরের স্পর্শ পাচ্ছিল। কিন্তু আরামটা উপভোগের সময় এখন নয়।

হেনা বলল, আপনার বুকে ড্রাম বাজছে। দেখব? বলে একটা হাত সোমের জামার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল। গেঞ্জির ওপর দিয়ে সাপের মতো হাতটা বুকের কাছে উঠে আসছিল। হায়, এটা যদি রাজপথ না হত এবং ওই ভ্যানটা যদি ওখানে দাঁড়িয়ে না থাকত। সোমের সমস্ত শরীরে কাটা ফুটল। সে চোখ বন্ধ করল। এবং তখনই তার বাঁ  বুকের ওপরে পিপড়ে কামড়ানোর মত একটা যন্ত্রণা টের পেল। মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে হা সরিয়ে নিয়েছে। নিজের বুকটা চেপে ধরল সোম। যন্ত্রণটা আর পিপড়ের কামড়ের মতো নেই। তার বুক মুচড়ে উঠছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। মুখ থেকে একটা গোঙানি ছিঁটকে উঠতেই সে ঝাপসা চোখে দেখল হেনা সরে যাচ্ছে দ্রুত পায়ে। প্রচন্ড চিৎকার করে সোম চলতে চলতে রাস্তায় আছাড় খেয়ে পড়ল।

ভ্যানটা তখন আবার এগোতে যাচ্ছিল। সামনে বস একজন সর্জেন্ট চিৎকার শুনে পেছনে তাকল। তার নির্দেশে দুজন সেপাই দ্রুত মেনে গেল সোমের শরীরের দিকে। একজন ফিরে এল প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গেই, সাব, এ সি সাহেব-!

এ সি সাহেব? সার্জেন্ট লাফ দিয়ে নামল। কাছে গিয়ে সে টর্চের আলো ফেলতেই সোমের মুখটাকে চিনতে পারল। দিনরাত স্যালুট দিতে হত এই লোকটাকে। এখন তাদের ওপর হুকুম ছিল খুঁজে বের করার। লোকটাকে মোরল কে? আশেপাশে কাউকে সে দেখতে পাচ্ছিল না। শরীরে রক্তপাতের কোনও চিহ্ন নেই। নীচে, রাস্তায়, ফুটপাতে সার্জেন্ট টর্চের আলো ফেলল। এবং তখনই একটা কিছু চকচক করে উঠতেই সে বুকে পড়ল। ছোট্ট, আধা ইঞ্চি কাচের সিরিজ। মুখে আর ছোট সুচ লাগানো। রুমালে বস্তুটাকে তুলে নিয়ে সে ভ্যানের কাছে চলে এসে ওয়ারলেস চালু করল।

হেডকোয়ার্টার্স। ইয়েস। কলিং ফ্রম নাম্বার টোয়েন্টি ওয়ান। সি পি-র সঙ্গে কথা বলতে চাই। খুব জরুরি। আর্জেন্ট। সার্জেন্ট অধৈর্য হয়ে পড়েছিল। মিনিট খানেক বাদে সে সোজা হয়ে দাঁড়াল, ইয়েস স্যার। আই অ্যাম সরি স্যার। একটু আগে তিন নম্বর রাস্তায় আমাদের এক্স এ সি মিস্টার সোম মারা গিয়েছেন। মনে হচ্ছে ওঁর শরীরে বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। না স্যার, একটি সিরিঞ্জ- উনি অবশ্য আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন। অ্যাঁ। ও। ঠিক আছে স্যার। ও কে।

রিসিভার রেখে দিয়ে রুমাল থেকে সিরিঞ্জের অবশিষ্টাংশ রাস্তায় ফেলে খান খান করে গুলি করল মৃত সোমের শরীরে। শরীরটা একটু কাপল মাত্র। সে সেপাইকে হুকুম করল, ডেডবডি তুলে নিয়ে এসো। সি পি বলেছেন ওকে আকাশলালরা গুলি করে মেরেছে। মনে রেখো বন্ধুরা।

আজ রাতে আরও কয়েকজন মানুষ নির্ঘুম ছিল।

ধবধবে শ্বেতপাথরের এই ঘরটার একটা দিকে কাচের দেওয়াল যার ভেতর দিয়ে রাতের আকাশটাকে স্পষ্ট দেখা যায়। অনেক তারা সেখানে। ঘরে হালকা নীল আলো জ্বলছিল। পাশাপাশি বসে থাকা তিনজন মানুষের মুখ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। তাদের উল্টো দিকে সুবেশ এক প্রৌঢ়, কিছুটা নাৰ্ভাস ভঙ্গিতে কথা বলছিলেন। বলতে বলতে তিনি বুঝতে পারছিলেন, তারঁ সামনে বসা তিনজন স্রোতার কানে তেমনভাবে ঢুকছে না। এটা বোঝামাত্র তার গলার স্বর নিচুতে নামল।

দুটো প্রশ্নের জবাব, আপনার কাছে চাই মিনিস্টার। প্রৌঢ় কথা শেষ করা মাত্র শ্রোতাদের এ পরিষ্কার গলায় বললেন, বাবু বসন্তলালের হত্যাকারীকে এখনও কেন ধরা হয়নি?

মিনিস্টার অথবা প্রৌঢ় লোকটি জবাব দিলেন, সি পি বলেছেন বাবু বসন্তলালকে আকাশলালরাই খুন করেছে। এটা করে ও আমাদের শাসাতে চেয়েছে।

অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার সোমকে কে হত্যা করেছে?

এক্ষেত্রেও হত্যাকারী আকাশলাল।

আমরা প্ৰমাণ চাই।

স্যার, প্রমাণ খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। একজন বহুদূরে বাংলোয় কফিনে পড়েছিলেন আর একজনকে মাঝরাতে রাজপথে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে।

শ্রোতাদের দ্বিতীয়জন গলা পরিষ্কার করে নিলেন, আমরা কোন মুখদের নিয়ে বাস করছি। সোমকে খুঁজে বের করতে নির্দেশ দেওয়া হতে আপনি বুলেছিলেন প্রথম সুযোগেই সে শহরের বাইরে চলে গিয়েছে। শহরের কোথাও তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাহলে ওর শরীর শহরের রাস্তায় পাওয়া গেল কি করে?

এটা আমিও বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে কমিশনারের গোয়েন্দাবিভাগ ঠিকঠাক কাজ করছে না। আমাকে সময় দিন। মিনিস্টার অনুরোধ করলেন।

এবার তৃতীয়জন প্রশ্ন করলেন, একটা লোক নিজেকে ডাক্তার বলে পরিচয় দিয়ে একজন মহিলাকে সঙ্গে নিয়ে শহরে ঢুকেছিল। এই লোকটাই বাবু বসন্তলালের বাংলোতে গিয়েছিল। কমিশনার ওকে তুলে নেওয়ার পর ওর গাড়ি কে জ্বালাল? কমিশনার যে কারণে ওকে ছেড়ে দিয়েছিল তা কোনও কাজেই লাগেনি। ওরা টুরিস্ট লজ থেকে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছে তা কি জানা গেছে?

একজন পুলিশ অফিসার ওদের নিয়ে গেছে বলে রিপোর্ট হয়েছে।

বাজে কথা। আমাদের পুলিশবাহিনীতে যদি এমন কোনও বিশ্বাসঘাতক থাকে তাহলে তাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে। ডাক্তার এবং তার স্ত্রী শহরের বাইরে যেতে পারেনি। অথচ আপনারা ওদের খুঁজে বের করতে পারছেন না। ওয়ার্থলেশ!

স্যার। উৎসব উপলক্ষে শহরে একত মানুষ ঢুকে পড়েছে যে এই মুহুর্তে কাউকে খুঁজে বের করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আগামী পরশুর মধ্যে শহর খালি করে দিতে নির্দেশ দিয়েছি। আমি। তখন প্রতিটি লোককে খুঁটিয়ে দেখে ছাড়া হবে। ততক্ষণ-।

না। আগামীকাল বিকেলেই ভার্গিসকে গ্রেপ্তার করবেন। ওকে যে সময়সীমা দেওয়া হয়েছে তার বেশি আর দেওয়া সম্ভব নয়। ওর বিরুদ্ধে চার্জ আনবেন জনবিরোধী কাজকর্ম করার। শেষ অভিযোগটা হবে অপরাধীকে আড়াল করতে বাবু বসন্তলালের মৃতদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই সৎকার করতে দিয়েছে সে।

কিন্তু স্যার, কমিশনার রিপোর্ট দিয়েছে ম্যাডামের নির্দেশ মেনেই-।

আপনি এবার যেতে পারেন।

মিনিস্টার একটা অ্যাটাচি কেস তুলে ধীরে ধীরে দরজার বাইরে চলে এলেন। তার নিরাপত্তারক্ষীরা সোজা হয়ে দাঁড়াল। অনেকদিন হয়ে গেল। তিনি মন্ত্রিত্বে আছেন। বোর্ড চাইছে বলেই আছেন। কিন্তু এখন বাতাসে বিপদের গন্ধ পাচ্ছেন তিনি। যেভাবে আগামীকাল ভার্গিসকে গ্ৰাপ্তার করা হবে সেইভাবেই তাকেও সরিয়ে দেওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার।

মনে মনে প্রচন্ড খেপে গেলেন তিনি ভার্গিসের ওপর। লোকটা সত্যিকারের অপদাৰ্থ। যেসব পুরুষের মহিলাদের ওপর বিন্দুমাত্র আসক্তি থাকে না, তাদের মস্তিস্ক কখনই প্ৰাপ্তবয়স্ক হয় না। বোর্ড তাকে যেসব প্রশ্ন করেছে তার একটারও জবাব তিনি দিতে পারেননি এই অপদার্থটার জন্যে। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, বোর্ড। আজ তাকে আকাশলালকে নিয়ে কোনও প্রশ্ন করেনি। করলে তাকে বলতে হত। কমিশনার আশা করছেন। আগামীকালই সফল হবেন। মিনিস্টার তার সচিবকে জিজ্ঞাসা করলেন, কমিশনার এসেছে?

উনি নীচে অপেক্ষা করছেন।

চলে যেতে বল। ওর মুখ আমি দেখতে চাই না।

সঙ্গে সঙ্গে সচিব ছুটে গেল খবরটা জানাতে। ধীরে সুস্থে নামলেন মিনিস্টার। এই বাড়িতে সবসময় যুদ্ধকালীন তৎপরতা দেখা যায়। একটা মাছির পক্ষেও এখানে বিনা অনুমতিতে ঢোকা অসম্ভব। মিনিস্টার ঘড়ি দেখলেন।

মিনিট তিনিক বাদে তার গাড়ি একটা কনভয় নিয়ে রাজপথ দিয়ে ছুটে যাচ্ছিল। সাইরেন বাজিয়ে একজন সার্জেন্ট রাস্তা পরিষ্কার করে ছুটছিল আগে আগে। যদিও এত রাত্রে রাস্তায় মানুষ নেই। কিন্তু ফুটপাত উপচে পড়া আগন্তক ফ্যালফ্যাল চোখে দৃশ্যটা দেখল। বিশেষ একটা বাড়ির সামনে গাড়িগুলো পৌঁছে যাওয়া মাত্র নিরাপত্তারক্ষীরা পজিশন নিয়ে নিল। মিনিস্টার নামলেন। সিঁড়ির ওপরে যে মহিলাটি দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি বিনীত গলায় বললেন, আসুন স্যার। ম্যাডাম আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।

মিস্টিার হাসার চেষ্টা করলেন। মহিলার পেছন পেছন সিঁড়ি ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেলেন তিনি। বাইরে প্রহরীরা সজাগ হয়ে পাহারা দিতে লাগল।

দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে মহিলা দাঁড়িয়ে গেলে মিনিস্টার পর্দা সরিয়ে ভেতরে পা দিয়ে শুনতে পেলেন সুপ্ৰভাত!

প্ৰভাত! প্ৰভাতের তো এখনও অনেক দেরি!

ইংরেজি মতে প্ৰভাত শুরু হয়ে গেছে। জানোই তো, বিদেশে থাকায় আমার অনেক কিছু আলাদা।

মিনিস্টার এগিয়ে গেলেন। দুধের চেয়ে সাদা এক মিশরীয় পোশাক পরে ম্যাডাম আধাশোয়া হয়ে আছেন বালিসে হেলান দিয়ে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি। ওই মহিলার সঙ্গে তার আলাপ বিদেশে। এদেশের একজন ধনী ব্যবসায়ীর স্ত্রী হিসেবে যতটুকু বিদুষী হওয়া সম্ভব ততটুকুই। মন ভরানো সৌন্দর্য হয়তো এর নেই কিন্তু তাকালে চোখ ধাধিয়ে যায়। বারংবার তাকাতে হয়। এক শিরশিরে সৌন্দর্যের ফণা সবসময় ওঁর চোখ ঠোঁটের ভঙ্গিতে দুলে দুলে ছোবল মারতে চায়। বিদেশ থেকে স্বামীকে নিয়ে ফিরে আসার পর তার সঙ্গে ম্যাডামের ঘনিষ্ঠতা। এখানকার ওপরমহলের সঙ্গে তিনি ওঁদের আলাপ করিয়ে দেবার কিছুদিনের মধ্যে স্বামী মরা যান। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র দমে যাননি ভদ্রমহিলা। উঠতে উঠতে ও রাজ্যের অন্যতম মানুষের ভূমিকায় পৌঁছে গিয়েছেন। মিনিস্টার জানেন ম্যাডাম অকৃতজ্ঞ নন। তার আজকের যা কিছু উন্নতি তা এই ভদ্রমহিলার জন্যে।

এককালের ঘনিষ্ঠতা এখনও তাকে এই বাড়িতে আসার অধিকার দিচ্ছে । কিন্তু তিনি জানেন সম্পর্কটা আর সেই জায়গায় আটকে নেই। ম্যাডামকে তারঅনুগ্রহের ওপর নির্ভর করতে হয় না। এ রাজ্যের যাবতীয় ব্যবসাবাণিজ্য ম্যাডামের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া পরিচালিত হতে পারে না। অবশ্য সেসব ব্যবসা বিদেশকেন্দ্রিক এবং সরকারি অনুমতিসাপেক্ষ ব্যাপার। লোকে ম্যাডামকে আড়ালে ম্যাডাম টেন পার্সেন্ট বলে ডাকে। ওই ভেট না দিলে এই রাজ্যে থেকে কোন বৈদেশিক বাণিজ্য করা সম্ভব নয়। তার সঙ্গে এখন ওঁর সম্পর্ক কি ধরনের? মিনিস্টার নিজেই ঠিক বোঝেন না।

খুব সমস্যায় না পড়লে এতরাত্রে এখানে আসতে না।

হ্যাঁ। সমস্যা খুবই। ভার্গিস আমাকে ডোবাল।

যারা আমলা এবং পুলিশের ওপর নির্ভর করে প্রশাসন চালায় তাদের পরিণতি জানা।

মানলাম। কিন্তু এ ছাড়া আমার সামনে কোন পথ খোলা ছিল? তোমার কথামতো ভার্গিস বাবু বসন্তলালের দেহ মযনাতদন্ত করায়নি বলে বোর্ড খুশি নয়।

খুব স্বাভাবিক। ময়নাতদন্ত করাটা আইনসঙ্গত ব্যাপার। করলে জানা যেত ওকে গুলিবিদ্ধ করার আগে কড়া ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। ম্যাডাম স্বাভাবিক গলায় বললেন।

ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল? মিনিস্টার হতভম্ব, তুমি কি করে জানলে?

আমি তোমার মতো কান দিয়ে দেখি না?

তাই তুমি চাওনি পোস্টমর্টেম হোক। হলে ব্যাপারটা জানা যেত। খবরটা গোপন রেখে তোমার কি লাভ? আমি তোমাকে কিছুতেই বুঝতে পারি না।

ম্যাডাম হাসলেন, আমিও পারি না। তোমার সেই সমস্যাটা কি?

মিনিস্টার এক মুহুর্ত ভাবলেন। তাকে এখনও বসতে বলেননি ম্যাডাম। অথচ কয়েক বছর আগে তার অগাধ অধিকার ছিল ওই বিছানায়। তিনি বললেন, আমি তোমার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছি। তুমি আমাকে পথ বলে দাও।

কিসের পথ?

আমি মুক্তি পেতে চাই। সসম্মানে। আমাকে ছুঁড়ে ফেলার আগে আমি ঢলে যেতে চাই।

সে কী? এত ক্ষমতা তোমার! এ রাজ্যের শিশুরাও তোমার কথা ভয়ে ভয়ে শোনে-

প্লিজ! এই পুতুলের ভূমিকা আমার সহ্য হচ্ছে না। বোর্ডের কোনও কাজই আমি ঠিকঠাক করাতে পারছি না। আজ ভার্গিস আছে বলে সব দায় তার ওপর চাপছে। আগামীকাল বিকেলে ভার্গিস চলে গেলে বন্ধুকের নল আমার দিকে ঘুরে আসবে।

তোমার বদলে যতক্ষণ আর একটা ঠিকঠাক লোককে না পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ তুমি নিরাপদ। আর সেই সময়টুকু যখন হাতে পাচ্ছ তখন সৎব্যবহার করো।

অসম্ভব। প্রথম কথা, আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামো বলতে এখন কিছুই নেই। বাবু বসন্তলাল আমাক স্তোকবাক্য দিত। পুরো দেশটা বৈদেশিক ধারের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহুর্তে যদি আরবের দুই শেখ তাদের সব ডলার ফেরত চায় তাহলে আমরা কোথায় দাঁড়াবা? আর আমি যত ধার নেওয়া কমানোর প্রস্তাব দিচ্ছি তত বোর্ড সেটাকে বাতিল করছে। দেশের মানুষকে যদি অবাধ বাণিজ্য করার অধিকার না দেওয়া হয়, যদি ক্ষুদ্র শিল্পে উৎসাহ না দেওয়া হয় তাহলে রপ্তানি করার মতো কোনও জিনিসই থাকবে না। আমাদের হাতে। দ্বিতীয়ত, আকাশলাল। ক্রমশ আমার মনে একটা ধারণা তৈরি হচ্ছে যে আমাদের মধ্যে কেউ লোকটাকে শেল্টার দিচ্ছে। যে দিচ্ছে সোমাদের থেকেও শক্তিমান। এখনও পর্যন্ত আমি ওই লোকটাকে সব কাজকর্ম বন্ধ রাখতে বাধা করেছি। কিন্তু যে কোনও মুহুর্তেই তো বিস্ফোরণ হতে পারে।

আকাশলাল ধরা পড়লে তোমার এই চিন্তা দূর হবে?

ধরা পড়বে? হায়। আমিও এই আশার কথা বোর্ডকে বলে এলাম। আগামীকাল লোকটা নাকি ভার্গিসকে ফোন করবে। ভার্গিস বাহিনীকে অ্যালার্ট করেছে। ফোন করা মাত্র সেই টেলিফোনের কাছে যেন পৌঁছে যায় লোক। কিন্তু আকাশলাল কেন ফোন করবে তা মাথামোটাটা জানে না। আগামীকাল উৎসব। লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ের দিনটাকে কেন বেছে নিল ফোন করার জন্যে?

হ্যাঁ। এটা একটা পয়েন্ট। কিন্তু তুমি কি করতে চাও?

আগামীকাল বিকেলে আমি পদত্যাগপত্র দেব। তুমি বোর্ডকে দিয়ে সেটা অ্যাপ্রুভ করিয়ে নেবে। অবশ্য তার আগেই আমি—। মিনিস্টার থেমে গেলেন।

কোথাও পালিয়ে গিয়ে তুমি নিস্তার পাবে না। ম্যাডাম নেমে দাঁড়ালেন বিছানা থেকে, বোর্ড যা চাইছে। তাই মন নিয়ে করা ছাড়া তোমার কোনও উপায় নেই।

ম্যাডাম, আমি তোমার কাছে সাহায্য চাইছি।

ম্যাডাম হাসলেন, আমি দুঃখিত। এই সুন্দর ছোট্ট পাহাড়ি শহরটাকে আমি বড় ভালবেসে ফেলেছি। দেখছি না, ইউরোপ আমেরিকা ছেড়ে এখানে আমি পড়ে আছি। লোকে বলত আমি আমার স্বামীর টানে এসেছি। এখানে। কিন্তু তিনি তো চলেই গেলেন। বাবু বসন্তলালকে আমি পুরুষমানুষ হিসেবে খুব পছন্দ করতাম। টাকা ছিল বটে লোকটার, কিন্তু রুচিও ছিল। কিন্তু যেই তার মনে হল এই দেশটা থেকে তিনি কিছুই পাবেন না আমনি তাকেও চলে যেতে হল। তোমার সঙ্গেও আমি ঘনিষ্ঠ ছিলাম। কিন্তু এখন বোর্ড যা চাইছে সেটাই আমার ইচ্ছে।

তার মানে? মিনিস্টার চিৎকার করে উঠলেন।

এখনও পর্যন্ত সব কিছু তোমার অধিকারে আছে। রাত অনেক হয়েছে। এবার ফিরে গিয়ে বিশ্রাম নাও। ম্যাডাম ধীরে ধীরে পাশের দরজা দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন।

মিনিস্টার কয়েকমুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। সম্পর্ক পাল্টাতে পাল্টাতে যখন শীতল থেকে শীতলতর হয়ে যায়। তখন যে পক্ষ দুঃখ পায় সে কি মুখ?

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার