রাত তখন তিনটে। অদৃশ্য দোলা থেকে শিবানী দেখলেন মণ্ডপটি। ইতিমধ্যে চার পাশে এত আলো জ্বলছে যে, চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। সেই আলোয় চার পাশ আলোকিত। শিবানী এবং তাঁর ছেলেমেয়েরা দেখতে পেল, তাঁরা সাহারা মরুভূমির একটি মরূদ্যানের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন। অথচ এটা কলকাতা শহর। শিবানী হাসলেন। ওরা চব্বিশ ঘণ্টা জল পায় বলে মরুভূমির স্বাদ পেতে চাইছে।
তিনি কার্ত্তিকের দিকে তাকালেন। কার্ত্তিক তখন ভাবছিল আশেপাশে কোনও সুন্দরী নেই। সেই সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। শিবানী সেটা বুঝতে পেরে বিরক্ত হলেন। মহিষাসুর ছটফট করছে। মুশকিল হল, পৃথিবীর আকাশে ঘুরতে থাকা স্যাটেলাইটগুলোর পাশ কাটানোর সময় তাঁরা প্রত্যেকেই বাক্‌শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। প্রত্যেকে প্রত্যেকের মন কী ভাবছে, বুঝতে পারছেন, কিন্তু কেউ কথা বলতে পারছেন না। শিবানী দেখলেন, মণ্ডপের সামনে মোটা কাপড়ের আড়াল রাখা হয়েছে। বোধহয় আগে কাউকে প্রতিমা দেখতে দেওয়া হবে না। কিন্তু অন্তর্দৃষ্টি সক্রিয় থাকায় শিবানী নিজের মূর্তি দেখতে পেলেন। দেখতে পেল বাকিরাও। একটু ক্ষুণ্ণ হলেন শিবানী। তাঁর গায়ের রং বিস্কুটের, চুল কাঁধ পর্যন্ত। ফিগার, বলতে নেই, ঠিকই রেখেছে। বরং সরস্বতীকে তাঁর চেয়ে বয়স্কা মনে হচ্ছে। সেটা দেখে সরস্বতী ক্ষেপে গেল। এম্মা! আমার মুখে অত বেশি ফ্যাট আছে নাকি! ওর মনের কথা বুঝে লক্ষ্মী মনে মনে বলল, ‘থাকলে খুশি হতাম। আমার স্বামী দেবতাটি মুখ ঘুরিয়ে নিত।’ সময় নেই, ওঁরা যে যার মূর্তির ভেতর প্রবেশ করলেন। সবাই জানেন এই যে, ঢোকা হলে দশমীর সকালের আগে মুক্তি নেই। এ বার মহিষাসুর বেশ খুশি। তার মুখে লাদেনের দাড়ি, পরনে আলখাল্লা। বেশ চেঞ্জ সব এ বছর।
এই পুজো কমিটির সেক্রেটারি, ট্রেজারার আর কনভেনর গত পাঁচ মাস ধরে প্রচুর খেটেছেন। থিম যাতে সুপারহিট হয় তার জন্য মরিয়া হয়েছেন। শেষ তক কলকাতার পুজোয় প্রথম বার সাহারার মরূদ্যান এনে ফেলে ভাবছেন, এ বার সব ক’টা পুরস্কার তাঁদের ভাগ্যে নাচছে। কাল বিকেলে করিনা কপূর এবং ধোনি। মার মার কাট কাট ব্যাপার হবে। কাজকর্ম সেরে তিন জনে একটু আহ্নিকে বসেছিলেন। তিরিশ লাখ টাকার পুজো বলে আজ একটু স্কচের ব্যবস্থা হয়েছিল। এখন শুয়ে পড়তে হবে। কালকের জন্যে চাঙ্গা রাখতে হবে শরীর। ওঁরা অফিসরুম থেকে বেরিয়ে বাড়ি যাওয়ার আগে মণ্ডপের দিকে তাকালেন। সেক্রেটারি বললেন, ‘চল, মাকে বলে যাই যেন ফার্স্ট প্রাইজটা ম্যানেজ করে দেন।’ কনভেনর বললেন, ‘একটু নিরিবিলিতে মন দিয়ে প্রণাম করতে হবে। পরে চান্স পাব না।’ ট্রেজারার বললেন, ‘অডিটর একটু ঝামেলা করতে পারে, মাকে বলা দরকার।’
তিন জনই হাঁটতে গিয়ে বুঝতে পারলেন শরীরগুলো ঠিকঠাক নেই। স্কচ খাওয়ার অভ্যেস না থাকাটাই এর কারণ। যারা পাহারায় ছিল তারা বড় কর্তাদের দেখে সরে গেল। তারা বাংলা খেয়েছিল। নিয়মিত অভ্যেস থাকায় ওরা স্বচ্ছন্দ ছিল। তিন জনে পর্দার ফাঁক দিয়ে প্রতিমার সামনে পৌঁছে গিয়ে মুখ তুলে তাকালেন। কনভেনর মাথায় দু’হাত তুলে বললেন, ‘মা, আমার প্রণাম নাও। মা গো।’ ক্যাশিয়ার হাসলেন। কথা বললেন না। শিবানীকে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে ভাবলেন, ‘বুক একটু ভারী হলে ভাল হত। পা দুটো বেশ সেক্সি হয়েছে।’
শিবানী চমকে উঠলেন। তাঁর সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছিল। মনে হল ত্রিশূলটা লোকটার বুকে ঢুকিয়ে দিই। ও দিকে সরস্বতী ফিক করে মনে মনে হাসল। পৃথিবীতে এসে এই বার তারও অন্তর্দৃষ্টি এসে গিয়েছে। ঠিক হয়েছে। এত বড় বড় ছেলেমেয়ের মা হয়েও যদি ফিগার কনশাস হয়, তা হলে তো এ সব কথা শুনতেই হবে। লক্ষ্মী ভাবল, মায়ের উচিত কুচি না দেওয়া শাড়ি পরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে আসা। কার্ত্তিক আর গণেশ ভাবল, এটা মায়ের ব্যাপার। তাদের বলার কিছু নেই। মা তো একাই অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করে। তাদের সাহায্য করার নিয়ম নেই।
সেক্রেটারি বললেন, ‘কার্ত্তিকটাকে ঠিক হাতকাটা দিলীপের মুখ দিয়েছে। হে হে।’
হাতকাটা দিলীপটা কে? ভাবল কার্ত্তিক। সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্দৃষ্টির জোরে জেলখানায় বসে সেলফোনে কথা বলা একটা মুখ দেখতে পেল। রেগে কাঁই হয়ে গেল সে। এরা তাকে জেলখানায় পাঠাতে চাইছে। কার্ত্তিক চেষ্টা করল এগিয়ে যেতে, কিন্তু শরীর নড়ল না।
ট্রেজারার অনেক ক্ষণ মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে শেষ পর্যন্ত চোখ খুলে লক্ষ্মীর দিকে তাকালেন, ‘অডিটরটাকে ম্যানেজ করে দিও মা। তা হলে সামনের বার এ রকম জবুথবু হয়ে বসিয়ে রাখব না। সামনের বার গ্রিস হচ্ছে আমাদের থিম। তোমার ফিগার ক্লিওপেট্রার মতো করতে বলব। কথা দিলাম।’
লক্ষ্মী খুশি হলেন। ছেলেবেলা থেকেই তিনি গোলগাল। ক্লিওপেট্রার ফিগার হলে বোনের জামাইবাবু পায়ের কাছ থেকে তুলে পাশে বসাবে। সরস্বতী সেটা বুঝতে পেরে মনে মনে দাঁতে দাঁত চাপল, ছিঃ। ম্যাগো।
এগারো তলার ফ্ল্যাটে ঢাকের আওয়াজ যখন পৌঁছয়, তখন টিকটিকির ডাক তার চেয়ে বেশি জোরালো হয়ে যায়। এই এগারো তলার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ফ্ল্যাটে টিকটিকি কী করে আসে কে জানে। কিন্তু আজ ওই টিকটিকির ডাকে ঘুম ভাঙল সপ্তর্ষির। ঘড়ির দিকে চোখ গেল। এখন ক’টা বাজে? সর্বনাশ! অপ্সরার উচিত ছিল তাকে ডেকে দেওয়া। ঠিক তখনই সে মনের পর্দায় অপ্সরাকে দেখতে পেল। নব্বই কেজি চর্বি পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি শরীরে ছড়িয়ে শাওয়ারের নীচে চোখ বন্ধ করে ভিজছে। বাথরুমের দরজা বন্ধ, কিন্তু নাইটিটা খোলেনি। ভাগ্যিস খোলেনি। সপ্তর্ষি স্পষ্ট বুঝতে পারল উর্বশীর ভাবনা। উর্বশী ভাবছে, টেকো বুড়োটাকে বললেই ই এম আইর দোহাই দেবে। অথচ টুবলুকে কথা দিয়েছি একটা আইপড এই পুজোয় কিনে দেব। কত আর দাম? বড় জোর দশ হাজার। টেকোটার লকারের ডুপ্লিকেট চাবি আমার কাছে আছে। ও অফিসে বেরিয়ে গেলে লকার খুলে ব্ল্যাক টাকার বাণ্ডিল থেকে একটা সরিয়ে নিলে টের পাবে বলে মনে হয় না। পেলে পাবে। জিজ্ঞাসা করলে বলব, আমি কী জানি!
তড়াক করে লাফিয়ে নিঃশব্দে আলমারির দরজা খুলল সপ্তর্ষি। দু’দুটো বড় লকার। একটায় উর্বশী তার গয়না রাখে। দ্বিতীয়টা খুলে সব ক’টা টাকার বাণ্ডিল বের করে লকার বন্ধ করে আলমারির দরজা ভেজিয়ে চার পাশে তাকাল। তার পর জ্যাকেটের ভেতর বাইরের চারটে পকেটে বাণ্ডিলগুলো ঠেসে ঢুকিয়ে শুয়ে পড়ল চোখ বন্ধ করে। তার পরেই খেয়াল হল কাল রাত্রে উর্বশীর মনের কথা সে যেমন বুঝতে পারছিল তার অনুচ্চারিত কথাও উর্বশী বুঝে গিয়েছিল। এটা কী করে যে সম্ভব হচ্ছে, কে জানে! এই যে সে কাজটা করল তা আবার উর্বশী বুঝে ফেলেনি তো! সঙ্গে সঙ্গে সে ভাবতে লাগল, উর্বশীর মতো মেয়ে হয় না। ওকে আরও আদর আরও যত্নে রাখা দরকার। পাঁচ দশটা নয়, একটাই তো বউ, তাও আবার উর্বশীর মতো হরিণ চোখের মেয়ে, নাঃ, আজ বোধনের দিনে অফিসে যাওয়ার সময় একটু আদর করে যেতে হবে।
তোয়ালেতে মাথা মুছতে মুছতে নিজেকে আয়নায় দেখে বিশ্রী লাগছিল উর্বশীর। যেই ভাবল ওই টেকোটার জন্যে সুন্দরী হওয়ার দরকার নেই, অমনি সে স্পষ্ট সপ্তর্ষির কথাগুলো শুনতে পেল। প্রথমে বিশ্বাসই হল না। সে কি ঠিক শুনেছে? এই কথাগুলো জিন্দেগিতে বলেনি সপ্তর্ষি। আয়নায় নিজের চোখ দেখল, একটু মিল আছে বলে মনে হল হরিণের সঙ্গে। তার শরীরে কদম্ব ফুল ফুটল। পোশাক পরে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে সপ্তর্ষি। কাছে এসে অনেক চেষ্টা করে নরম গলায় বলল, ‘ডার্লিং, ওঠো, অফিসে যেতে হবে না? অষ্টমীর দিন যত ইচ্ছে ঘুমিও।’
চোখ খুলল সপ্তর্ষি, উঠে বসে বলল, ‘মাই গড। এত বেলা হয়ে গেছে, ডাকোনি কেন?’
‘ডাকতে মায়া হল। ঘুমালে তোমাকে কী দারুণ দেখায়।’
‘নটি গার্ল।’
বাথরুমে ঢুকে গান গাইতে লাগল সপ্তর্ষি। গান গাইলে ভাবা যায় না। বা ভাবলে উর্বশী কিছুই টের পাবে না। ব্রেকফাস্ট টেবিলে যত্ন করে খাওয়াচ্ছিল উর্বশী। সপ্তর্ষি বলল, ‘মা গো, আর পারব না। ও হ্যাঁ, আজ তো পুজো শুরু হয়ে গেল। টুবলুদের গিফ্‌ট দিয়েছ তো?’
‘ও নিয়ে তুমি চিন্তা করো না ডার্লিং।’
জ্যাকেট পরে টাই বেঁধে বাই বলে দরজার দিকে এগোচ্ছিল সপ্তর্ষি, পেছন থেকে উর্বশী বলল, ‘উঁহু!’
সপ্তর্ষি তাকিয়ে দেখল অনেক রহস্য মুখে ছড়িয়ে উর্বশী হাসছে। যদি কিছু হুট করে মাথায় এসে যায় তাই সে লতা মঙ্গেশকরের গান মনে মনে গাইতে লাগল, ‘না যেও না, রজনী এখনও বাকি।’ সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এল উর্বশী। সাগরিকা ছবির শেষ দৃশ্যে সুচিত্রা সেন এত জোরে ছুটে উত্তমকুমারের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেননি। ধাক্কাটা কোনও মতে সামলাতে সামলাতে সপ্তর্ষি শুনল, ‘তুমি আমাকে একটু আদর করে যাবে বলে ভেবেছিলে, বলো, ঠিক কি না!’
‘তুমি যে আমারই ওগো, জীবনে মরণে’ গাইতে গাইতে সপ্তর্ষি উর্বশীর মাথায় চিবুক লাগিয়ে দেখেও না দেখার ভান করল। সিঁথিটা একটু চওড়া হয়েছে। তা ভাল। কে না জানে কলকাতার সবচেয়ে ভাল রাস্তার নাম রেড রোড!
সপ্তর্ষি বেরিয়ে গেলে চেয়ারে বসল উর্বশী। জীবনে এ রকম সকাল তার আসেনি। কিন্তু তিনটে ব্যাপার তার বোধগম্য হচ্ছিল না। সে কী করে সপ্তর্ষির ভাবনাগুলো বুঝে ফেলছে? গত কাল সন্ধ্যায় তো এ রকম হয়নি। এটা কি মা দুর্গা এসেছেন বলে? তা তিনি তো প্রতি বছরই আসেন, কোনও বার হয় না। দ্বিতীয়ত, আজ সকাল থেকে সপ্তর্ষি এত গান মনে মনে গাইছে কেন? ওর গলায় যে কোনও দিন গান শোনেনি। তৃতীয়ত, তার মাথায় চিবুক রেখে রেড রোড বলল কেন? সবচেয়ে ভাল রাস্তা। এটা কি কমপ্লিমেন্ট? ফোন বাজল। রিসিভার তুলতেই টুবলুর গলা, ‘ও মাসিমণি, প্রমিস রাখবে না?’
‘রাখব রাখব।’ হাসল উর্বশী।
‘কবে রাখবে? পুজো তো শুরু হয়ে গেল।’ টুবলুর কথা শুনে একটু ভাবল উর্বশী, ‘সপ্তমীর আগেই।’
টুবলু তার বোনের ছেলে। বছর বারো বয়স। উর্বশী ঠিক করল সে আইপড কিনে সোজা ওদের বাড়িতে গিয়ে টুবলুর হাতে দিয়ে দেবে। আলমারির দিকে তাকাল উর্বশী। এখনও অফিসে পৌঁছয়নি সপ্তর্ষি। সপ্তর্ষির মুখ মনে এল, কিন্তু ও এখন কী ভাবছে, বুঝতে পারল না। এটা কী হল? আউট অব সাইট হলে কি, আউট অব মাইণ্ড হয়ে যায়?
পোশাক বদলে নিয়ে সেজেগুজে আলমারি খুলল উর্বশী। তার পর ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে সপ্তর্ষির লকার খুলে ডান হাতটা গর্তে ঢোকাল। এ কী! ভেতরটা একদম ফাঁকা কেন? এক টুকরো কাগজও পড়ে নেই। অথচ কাল বিকেলে অফিসের পর বাড়ি এসে বাণ্ডিলগুলোকে ঢোকাতে দেখেছে সে সপ্তর্ষিকে। তার পর আর আলমারি খোলেনি সপ্তর্ষি। সে সব সময় ওর সঙ্গে ছিল। আজ ঘুম থেকে তোলার পরও সে এই ঘরের বাইরে একা যায়নি। কেঁদে ফেলল উর্বশী। এখন টুবলুকে কী করে মুখ দেখাবে। হঠাৎ ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ, সে যখন স্নান করতে করতে প্ল্যানটা ভাবছিল তখন সেই ভাবনা কি ও বুঝে ফেলেছিল? ফলে টাকা সরিয়ে বিছানায় ঘাপটি মেরে পড়েছিল? টেকো, ডায়েবেটিক, ভুঁড়িদাস, ভাড় মে যাওয়া ঘুষখোরটার সঙ্গে বাকি জীবনটা কাটাতে হবে! নিজের ব্যাঙ্ক থেকে দশ হাজার টাকা তোলার জন্যে চেক বই বের করল উর্বশী।
অফিসের লিফ্‌টে জনা আটেক মানুষ। হন্তদন্ত হয়ে সপ্তর্ষি ঢোকামাত্র দরজা বন্ধ হয়ে লিফ্‌ট উঠতে লাগল ওপরে। হঠাৎ পাশের মহিলা ঘুরে দাঁড়িয়ে সপাটে চড় মারলেন এক প্রৌঢ়কে, ‘আপনি আপনি আমার সম্পর্কে…, ছি ছি।’
‘মানে, মানে… আমাকে চড় মারলেন কেন? জানেন আমি কে?’
‘একশো বার মারব। আপনি আমার বুক নিয়ে অশ্লীল কথা ভাবেননি?’ মহিলা চিৎকার করলেন, ‘দেখুন, এই আধবুড়ো আমার সম্পর্কে অশ্লীল ভাবনা ভাবছে।’
তুমুল চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হতেই সপ্তর্ষি মনে মনে জনগণমন গাইতে শুরু করল। পৃথিবীতে প্রথম গান আবিষ্কার করেছিল কে? গান গাইলে মনে ভাবনা আসে না।
লিফ্‌ট ছ’তলায় উঠলে ছেঁড়া জামা নিয়ে প্রৌঢ় নেমে গেলেন সুড়ুৎ করে। মহিলা চিৎকার করলেন, ‘সকাল থেকে এটা আরম্ভ হয়েছে। প্রত্যেকটা মানুষ এত দিন মুখোশ পরে বসেছিল। অ্যাই, লিফ্‌ট চলছে না কেন?’
লিফ্‌টম্যান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সপ্তর্ষিকে দেখিয়ে বলল, ‘কী করব ম্যাডাম, সাহেব জাতীয় সংগীত গাইছেন।’
সঙ্গে সঙ্গে সবাই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
সকাল সকাল পুজো শুরু না হলেও প্রতিমা দর্শন করে আসা কলকাতার অনেক মানুষের অভ্যাস। যাঁরা ভিড় এড়াতে চান, শান্তিতে ঠাকুর দেখতে চান তাঁরা পঞ্চমী ষষ্ঠীতেই কাজটা সেরে ফেলেন!
ভোর ছ’টায় একটি গাড়ি এসে দাঁড়াল যে মণ্ডপের সামনে, তাদের থিম হল মুরগি। মণ্ডপে ডিমের প্রতিমা। এত সকালে দর্শক নেই। পুজোর উদ্বোধন সন্ধ্যায়, তাই মাইকে গান বাজছিল: হাট্টিমা টিম টিম তারা মাঠে পাড়ে ডিম। গাড়ি থেকে নামল যে পরিবার, তারা এই সকালে নতুন জামা পরে এসেছে। বাবা মা যুবতী মেয়ে তরুণ ছেলে।
ডেকরেশন দেখে ছেলেটি বলল, ‘আঃ, ফ্যান্টা।’
মা বলল, ‘দুগ্গা ঠাকুরের কাছে এসে ইংরেজি বলো না ববি।’
ছেলে বলল, ‘বাট মা, চার পাশে মুরগি আর মুরগি। আচ্ছা এগুলো কি দিশি, না বয়লার?’
মা জবাব দিল না। এগোতে এগোতে ভাবল, তোমার বাবা জানে।
বাবা উদাসীন হল, ওগুলো আমি। আমাকে তোমরা মুরগি করেছ।
মেয়ে বলল, ‘বাবা, টু মাচ। মন নিচু করো না।’
তখনও মণ্ডপের সামনে পর্দার আড়াল। এক জন স্বেচ্ছাসেবক বলল, ‘সরি। আমাদের পুজো উদ্বোধন করবেন সুস্মিতা সেন। তার আগে পর্দা সরানো যাবে না।’ অনেক অনুরোধেও কাজ হল না। এই সময় স্বেচ্ছাসেবকদের নেতা এগিয়ে এসে সব শুনে বললেন, ‘পর্দা উঠবে না। তবে আপনাদের এক জনকে আমি সাইড দিয়ে ঢুকিয়ে দিচ্ছি। দর্শন করে আসুন।’
দিদি বলল, ‘ভাই, আমি এটা দেখে আসি। তুই পরেরটা দেখিস। চলুন।’
পর্দার প্রান্তে নিয়ে গিয়ে নেতা বলল, ‘পাশ দিয়ে বসে যান।’
যুবতী প্রতিমার সামনে পৌঁছে গেল। ডিম কোথায়? একটু অবশ্য শরীরের মধ্যে উঁচু উঁচু হয়ে আছে। যদি ডিমগুলো ফেটে যায়? সে কার্ত্তিকের দিকে তাকাতেই শুনতে পেল, ‘কী জিনিস। যাকে বলে খাই খাই।’
মেয়েটি ভয় পেয়ে চার পাশে তাকাল। কেউ নেই। তার পরেই সে বুঝতে পারল কথাটা কার্ত্তিক ভেবেছে। সঙ্গে সঙ্গে পা থেকে হিলওয়ালা জুতো বের করে চিৎকার করল সে, ‘কী বললে? আবার বল, মুখ ভেঙে দেব।’
সঙ্গে সঙ্গে কার্ত্তিক গান ভাবল, ‘যা দেবী সর্বভূতেষু…।’ উদ্যোক্তারা ছুটে এসে যুবতীকে বের করে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘জুতো ছুড়ে মারছিল ঠাকুরকে। পাবলিক জানতে পারলে কী হবে বুঝতে পারছেন? তাড়াতাড়ি কেটে পড়ুন।’ ও দিকে শিবানী স্থির হয়ে পুত্রকে ভর্ৎসনা করছেন, ‘ছিঃ। কত বার বলেছি কলকাতার ভাষায় কথা বলিস না। অবাধ্য বাঁদর কোথাকার।’

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার