০৯.

দুপুরে খাননি মেজর। কারণ জিজ্ঞেস করতে বললেন, চব্বিশ ঘণ্টায় একবার খেলেই যখন শরীরটা হেঁটে-চলে বেড়াবে, তখন বারংবার তার পেটে সাপ্লাই করার কোনও প্রয়োজন নেই। লোকে রসনার তৃপ্তি, শরীরের আরামের জন্যে দিনে চারবার খায়। আমার তো ওসব দরকার নেই। তবে তোমাদের জন্যে লাঞ্চ রেডি করে রেখেছি। বাসমতী চাল, মুগের ডাল, বেগুনভাজা, মৌরলামাছের ঝাল আর কচি খাসির মাংসের ঝোল। চটপট খেয়ে নাও।

হেসে ফেলল অর্জুন, আপনি এত রান্না করেছেন?

দুর! এ আর কী। ইন দ্য ইয়ার নাইনটিন…, থেমে গেলেন মেজর, না, আমি এখন অন্যলোক। নো স্মৃতিচারণ।

খেতে খেতে অর্জুনের মনে হল, সত্যি মেজর বদলে গিয়েছেন। আগের মতো রাগারাগী, চিৎকার করছেন না। সবচেয়ে যেটা লক্ষণীয়, অর্জুন কোনও অভিযানে যাচ্ছে আর মেজর সেখানে থেকেও সঙ্গী হচ্ছেন না, এটা ভাবাই যায় না। সে দূরে বসে থাকা মেজরের দিকে তাকাল। ওঁকে এখন গৌতম বুদ্ধের কাছাকাছি চেহারার মানুষ বলে মনে হচ্ছে।

.

খাওয়া শেষ করে ব্যালকনিতে দাঁড়াতেই কাণ্ডটা ঘটল। কোথা থেকে একটা কালো বিড়াল লাফিয়ে পড়ল গাছের নীচে। কাঠবিড়ালিগুলো দুদ্দাড় পালালেও একটা ধরা পড়ে গেল। তার কাঁধের কাছটা দাঁতে নিয়ে বিড়ালটা একটা ড্রামের উপর লাফিয়ে উঠল। অন্য কাঠবিড়ালিরা ততক্ষণে নিরাপদে দাঁড়িয়ে হল্লা শুরু করেছে। তাতে বেশ বিরক্ত হয়ে বিড়ালটা লাফিয়ে ব্যালকনিতে চলে আসতেই অর্জুন পা চালাল। আঘাত এড়াতে বিড়ালটা মুখের খাবার ফেলে দিয়ে উলটো দিকে লাফ দিয়ে উধাও হয়ে গেল।

আহত কাঠবিড়ালিটা নড়ছে, পা ছুড়ছে। ঝুঁকে দেখে অর্জুন বুঝল, এটা নেহাতই ছোট। সে ওটাকে হাতের তালুতে তুলে নিয়ে দেখল, ঘাড়ের উপর রক্তের ঈষৎ ছোপ, দাঁত বসেছিল ওখানে। এ ছাড়া অন্য কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই।

কাঠবিড়ালিটাকে নিয়ে সে মেজরের সামনে চলে এসে টেবিলের উপর রাখল। মেজরের কপালে ভাঁজ পড়তেই অর্জুন বলল, একটা কালো বিড়াল ওর কাঁধে দাঁত বসিয়েছে। কী করে এটাকে বাঁচানো যায়?

কালো বিড়াল? ভয়ংকর ধূর্ত ওটা। মেজর উঠে একটা আলমারি খুলে তুলল আর আয়োডিন গোছের তরল পদার্থ নিয়ে এসে যত্ন করে ক্ষতের উপর লাগিয়ে দিলেন, খুব ঘাবড়ে গিয়েছে বলে একে আধমরা দেখাচ্ছে। তবে দাঁত যদি বেশি বসে গিয়ে থাকে, তা হলে বাঁচবে না।

কোনও ডাক্তারকে দেখানো যায় না?

তারা গৃহপালিত জীবজন্তুর চিকিৎসা করে। কাঠবিড়ালিকে কি গৃহপালিত বলা যায়? ছোট্ট প্রাণীটিকে টেবিলের উপর শুইয়ে দিলেন মেজর। সেটা চোখ বন্ধ করে মড়ার মতো পড়ে রইল।

আজকের ঘটনাগুলো মেজরকে জানাল অর্জুন। সব শুনে মেজর বললেন, আমার মনে হয়, তোমার আর না এগোনোই ঠিক হবে। জিমের টাকা না নিয়ে ভাল করেছ। ভাবছি তোমাকে নিয়ে কাল নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে যাব। গাড়িতেই যাব। মার্টিন গাড়ি চালাবে। লোকে বাঘকে ভয়ংকর সুন্দর বলে, নায়াগ্রা দেখলে বুঝবে, প্রকৃতিও কত ভয়ংকর এবং সুন্দর হতে পারে।

অর্জুন বলল, আপনি আমাকে চিঠিতে লিখেছিলেন, নিউ ইয়র্কের মাটির নীচে একটা জগৎ আছে। তা টিউবট্রেন নয়। লিখেছিলেন, এখানে এলে সেটা দেখতে পাবে। ব্রঙ্কসে গিয়ে বুঝলাম, ওখানকার মাটির নীচে কিছু মানুষ থাকে। অনুমান করছি, তারা কেউ সাধারণ, স্বাভাবিক মানুষ নয়। সেখানে পুলিশও আঁটঘাট না বেঁধে ঢোকে না।

তুমি ঠিক বলছ। আসলে লেখার সময় আমি অত ভেবে লিখিনি। ভেবেছিলাম, এসব লিখলে তোমার মনের কৌতূহল বাড়বে। মেজর বললেন।

ঠিকই। এখন যখন সুযোগ এসেছে তখন আপত্তি করছেন কেন?

পুলিশ যেখানে যেতে চায় না, সেখানে তুমি গিয়ে কী করবে?

দেখাই যাক না।

তা হলে আমাকে তোমার সঙ্গে যেতে হয়। মেজর সোজা হয়ে বসলেন।

অর্জুন হাসল! বাঃ। দারুণ হবে। আবার আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারব!

.

১০.

বিকেলবেলা ডাইনিংরুমে ঢুকে অবাক হয়ে গেল অর্জুন। কাঠবিড়ালিটা উঠে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়, একটু একটু হাঁটার চেষ্টা করছে। অর্জুন কাছে যেতে সে ঘুরে দৌড়োবার চেষ্টা করতেই পড়ে গেল চিত হয়ে। অর্জুন ওকে তুলে নিল হাতে। তারপর চারপাশে তাকিয়ে একটা পিচবোর্ডের বাক্সে কাঠবিড়ালিকে ছেড়ে দিল। এর মধ্যে ঘুরুক ও।

মেজর বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। মার্টিন তার কাজে বেরিয়ে গিয়েছে। দরজার চাবি নিয়ে ওটাকে বন্ধ করে রাস্তায় নামল অর্জুন। কালকের রাস্তায় হেঁটে কফির দোকানে পৌঁছে সে দেখল, কয়েকটি অচেনা মুখ রয়েছে। অতএব জো-এর অফিসে এল অর্জুন। কম্পিউটারের সামনে বসে একমনে কাজ করছে জো। অর্জুন গিয়ে দাঁড়াতে জো মুখ ফেরাল, হাই!

হাই বলতে গিয়েও হ্যালো, বলল অর্জুন।

জাস্ট এ মিনিট, কাজ করতে করতে জো বলল।

মিনিট চারেক পর জো উঠে এল, লে গো ফর কফি।

দোকান খোলা রেখেই জো বেরিয়ে এল।

কফি খেতে খেতে জো জিজ্ঞেস করল, কাল কীরকম অভিজ্ঞতা হল?

দারুণ। সুযোগ পেলে আবার যেতে চাই। অর্জুন বলল।

আপনার মতলবটা কী বলুন তো?

মতলব?

ওসব জায়গায় যেতে বললে লোকের বুক হিম হয়ে যায়, আর আপনি আবার যেতে চাইছেন! ব্যাপারটা কী খুলে বলুন!

অর্জুন হাত তুলল, কাল এখানে কফি খেতে আসার আগে আমি কি আপনাকে চিনতাম? না। আপনি কী ব্যাবসা করেন তা কি জানতাম? না। আপনাকে যে ব্রঙ্কসে পার্সেল ডেলিভারি দিতে যেতে হবে সেটাও জানা ছিল? না। আমার যদি ওখানে যাওয়ার পিছনে কোনও মতলব থাকত তা হলে আমি কেন এখানে আসব? অন্য কোনওভাবে চেষ্টা করতাম। তাই না?

মাথা নাড়ল জো, তা অবশ্যই ঠিক। কিন্তু যেখানে গেলে প্রাণ হাতে নিয়ে চলতে হয় সেখানে আপনি যেতে চাইছেন কেন?

একজন অসুস্থ বৃদ্ধা এবং তার প্রৌঢ়া পুত্রবধূ যিনি সম্প্রতি ছুরিতে আহত হয়েছেন, তাদের অনুরোধ রাখতে আমার যাওয়া উচিত।

জো মাথা নাড়ল, আমি কিছুই বুঝলাম না।

ওই দু’জনের নাতি এবং ছেলে ব্রঙ্কসে আছে। তাকে অনুরোধ করতে হবে যাতে সে বাড়িতে ফিরে যায়। অর্জুন বলল।

আপনি একটি উন্মাদ। জো চেঁচিয়ে উঠল।

কী জন্যে মনে হচ্ছে?

ওখানে যারা স্বেচ্ছায় যায়, ওই জীবনে যারা অভ্যস্ত হয়ে থাকে, তারা কখনওই স্বাভাবিক ভদ্রজীবনে ফিরে আসবে না। জীবন নিয়ে জুয়ো খেলে ওরা। ছিনতাই, মস্তানি, খেলার ছলে কাউকে মেরে ফেলতে যে যত পারদর্শী হবে, তার ব্যাঙ্ক তত উপরে উঠবে। ছোট নেতা থেকে বড় নেতা হওয়ার রাস্তায় ওরা চেষ্টা করে আরও নির্মম হতে। এই নেশা থেকে আপনি সরাতে চাইলে আপনাকে ছাই করে দেবে ওরা। জো মাথা নাড়তে লাগল।

অর্জুন চুপ করে থাকল। সেটা দেখে জো জিজ্ঞেস করল, হাউ মাচ দে আর পেয়িং ইউ? কত ডলার দেবে?

যা দিতে চেয়েছিল তা আমি রিফিউজ করেছি। অর্জুন বলল।

তার মানে? আপনি যদিও কাজটা পারবেন না, তবু প্রফেশনাল ফি নেবেন না?

না। আমি এই দেশে এসেছি টুরিস্ট হিসেবে। প্রফেশনাল ফি নিতে পারি না।

অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জো বলল, আপনি তো ইন্ডিয়ার মানুষ?

হ্যাঁ। ইন্ডিয়ার সব মানুষ কি আপনার মতো?

হেসে ফেলল অর্জুন, সেখানে চোর, বদমাশ থেকে মাফিয়া ডন, কোনও কিছুর অভাব নেই। যাক গে, আপনি আমাকে আর-একবার ওখানে যেতে সাহায্য করবেন?

ছেলেটিকে আপনি খুঁজে বের করবেন কী করে?

ডি সিলভা ওকে চেনেন।

মাই গড! আপনি জানলেন কী করে?

আপনারা যখন কার্ভালোর কাছে গিয়েছিলেন তখন সে ডি সিলভার কাছে এসেছিল। যদিও আমার সঙ্গে কথা হয়নি।

আপনি কী করে বুঝলেন সেই ছেলেটি!

জো-কে থামিয়ে দিল অর্জুন, কথাবার্তা শুনে বুঝেছি।

জো কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, আমি একটু ভেবে দেখি। একটা রাস্তা পেলে কাল আপনাকে জানাব। বাড়িটা তো আমি দেখে এসেছি।

.

১১.

বাড়িতে এসে অর্জুন দেখল, মেজর খুব যত্ন করে কাঠবিড়ালিটাকে খাওয়াচ্ছেন। সে হেসে বলল, আপনি জীবন থেকে ছুটি নিয়ে বসে আছেন। আর দেখুন, বিড়ালের পঁাত ঘাড়ে বসে যাওয়া সত্ত্বেও ও জীবনে ফেরার জন্যে ব্যস্ত।

প্রসঙ্গে না গিয়ে মেজর জিজ্ঞেস করলেন, রাতে কী খাবে?

আপনি তো সারাদিন খাননি। আপনার মেনু?

আমি সাত্ত্বিক আহার করব। ফ্যানভাত, মাখন, আলুসেদ্ধ।

ফাটাফাটি।

মানে? মেজর অবাক।

ওটাই আমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার। অর্জুন নিজের ঘরে চলে গেল।

.

আজ একটু দেরিতে ঘুম ভাঙল অর্জুনের। তৈরি হয়ে ডাইনিং রুমে এসে দেখল, মেজর কারও সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলছেন। সে কিচেনে ঢুকে চা বানাতে গিয়ে দেখল, গ্যাসে জল ফুটছে। মার্টিন এসে দাঁড়াল দরজায়, লেট মি ডু দ্যাট।

এদেশে চা তৈরি করতে কোনও ঝামেলাই নেই। গরম জলে টি-ব্যাগ ফেলে দিয়ে নাড়াচাড়া করলেই লিকার তৈরি হয়ে যাবে। তারপর ইচ্ছেমতো দুধ-চিনি মিশিয়ে দিলেই চা হয়ে গেল। তবু মার্টিনকে দায়িত্ব দিয়ে অর্জুন ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। প্রথমেই তার মনে হল, সামনের পৃথিবীটা আজ অন্যরকম। একটাও কাঠবিড়ালি চোখে পড়ছে না। তাদের দৌড়োদৌড়ি, চেঁচামেচি আজ নেই। গাছটাও যেন থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। কী হল ওদের?

ফোন রেখে মেজর পাশে এসে দাঁড়ালেন, জিমের মাকে আজ হাসপাতালে ভরতি করা হবে। বেচারা জিম!

মার্টিন এসে দু’জনকে চা দিয়ে গেল।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কাঠবিড়ালিদের কী হয়েছে?

সকাল থেকেই দেখছি না। এই জায়গাটা বোধহয় ওদের আর পছন্দসই নয়। মেজর চায়ে চুমুক দিলেন, তোমার প্ল্যান কী?

ব্রঙ্কসের রাস্তায় ঝুঁকি নিয়ে হাঁটাচলা করা যায়, কিন্তু কোনও সোর্স ছাড়া মাটির নীচে যাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। মিস্টার ব্রাউনের ছেলের নাম কী?

টম। ভাল নাম আমি জানি না।

আমি একটু ঘুরে আসি।

কোথায় যাচ্ছ?

কাছেই। একটা লোকের কথা আপনাকে বলেছিলাম, জো। ওর দোকানে যাচ্ছি।

.

জো অর্জুনকে দেখে হাসল, আপনার কপাল ভাল না খারাপ তা জানি না।

কেন?

সেদিন কার্ভালোর দেওয়া এনভেলাপ টেক্সাসে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আজ ভোরে সেখান থেকে আর-একটা প্যাকেট এসেছে, যেটা ওকে দিতে হবে।

অর্জুন হাসল, বাঃ। ভাল খবর। তা হলে কপাল খারাপ বলছেন কেন?

জায়গাটার নাম ব্রঙ্কস। তাই!

আপনি কখন যাচ্ছেন?

এখন প্রচুর কাজ। দুপুরে যাব। এবং এই শেষবার। কার্ভালোকে বলে দেব, আর আমার পক্ষে ব্রঙ্কসে যাওয়া সম্ভব নয়। জো বলল।

একটু ইতস্তত করে অর্জুন বলল, একটা অনুরোধ করতে পারি?

জো তাকাল।

অর্জুন বলল, ব্রঙ্কসে গিয়ে ডি সিলভার কাছে পৌঁছেলে তো কার্ভালোর হদিশ পাওয়া যাবে। যদি আমি প্যাকেটটা এখন পৌঁছে দিই!

আপনি? জো হতভম্ব।

আমি পারব।

আপনি খুন হয়ে যেতে পারেন! জো মাথা নাড়ল।

সেটা আপনি গেলেও হতে পারে।

একটু ভাবল জো, প্যাকেটে কী আছে তা আমি জানি না। যদি নিষিদ্ধ কিছু থাকে তা হলে পথে পুলিশ আপনাকে ধরলে বিপদে পড়বেন।

নিষিদ্ধ কিছু মানে?

ড্রাগ থেকে শুরু করে মাদক। অথবা ডলারও থাকতে পারে।

কত বড় প্যাকেট?

আড়াইশো গ্রাম ওজন। বেশি বড় নয়।

আমি ঝুঁকি নিচ্ছি।

জো-কে রাজি করাতে কিছুটা সময় খরচ হল। চৌকো ব্রাউন পেপারের একটা বড় খাম দিল জো। খামের উপর একটা নাম্বার আর জো-এর দোকানের ঠিকানা লেখা। অর্থাৎ যার জন্যে ওটা এসেছে তার কোনও নামধামের বিবরণ খামের উপর নেই। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, এটা যে কার্ভালোর তা বুঝলেন কী করে?

জো হাসল, ওই নাম্বার কাভালোর।

অর্জুন একটু ভাবল। নাম-ঠিকানা নেই এমন একটা প্যাকেট মানে রহস্যজনক ব্যাপার, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু কোনও প্রমাণ যখন নেই তখন শুধু সন্দেহের কারণে টম ব্রাউনের কাছে পৌঁছোবার সুযোগটা হাতছাড়া করা ঠিক হবে না।

জো ছাড়ল না। অর্জুনকে যাতায়াতের ভাড়া নিতে বাধ্য করল। সেইসঙ্গে কার্ভালোকে দিয়ে সই করিয়ে আনার রসিদও দিয়ে দিল।

বেরোবার সময় অর্জুন হেসে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, আপনি আমাকে বিশ্বাস করে এই দায়িত্ব দিচ্ছেন, আমি তো ব্রঙ্কসে না গিয়ে এটার ভিতরে কোনও দামি জিনিস থাকলে নিয়ে হাওয়া হয়ে যেতে পারি?

জো হাসল। দু’বার মাথা নাড়ল। মুখে কিছু বলল না।

.

১২.

নিউ ইয়র্কের পাতালরেলের প্রতিটি কামরায় বেশ বড় আকারের ম্যাপ টাঙানো থাকে। প্রতিটি কামরার ভিতরে লাউডস্পিকার থাকায় কোন স্টেশন আসছে তা স্পষ্ট শোনা যায়। স্টেশনের নাম শুনে ম্যাপ দেখলেই বোঝা যায়, যেখানে নামতে হবে সেই স্টেশন কত দূরে। ট্রেনে উঠে অর্জুন ম্যাপ খুঁটিয়ে দেখে নিয়েছিল। অনেকটা সময়। নিশ্চিন্তে বসে থাকা যায়। আজ সেই গানের দল কামরায় নেই। অর্জুনের পাশে বসে একটি কালো ছেলে বই পড়ছে। ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে গল্পে ডুবে গিয়েছে সে। ট্রেন ছুটছে। উপরের পৃথিবীতে কত কী হয়তো ঘটে যাচ্ছে এই মুহূর্তে, পাতালে বসে তার বিন্দুবিসর্গ টের পাওয়া যাচ্ছে না।

কীভাবে টম ব্রাউনের সঙ্গে দেখা করবে, কী কথা বলে তাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে সে? অর্জুন মাথা নাড়ল। এসব নিয়ে আগে থেকে ভেবে কোনও লাভ নেই। কোনও পরিকল্পনাই কাজে লাগবে না। কারণ, সে ওখানে দ্বিতীয়বার যাচ্ছে।

.

স্টেশন থেকে বেরিয়ে গত দিনের চেনা পথ ধরে সে হাঁটতে লাগল। চারটে ছেলে মোটরবাইকে চেপে চিৎকার করতে করতে চলে গেল। তাদের ওইভাবে চলে যেতে দেখেও অন্য পথচারীদের ভাবভঙ্গির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হল না।

ডি সিলভার কাছে আজ স্বচ্ছন্দে পৌঁছে গেল অর্জুন। লোকটি চোখ ছোট করতেই অর্জুন বলল, আমি জো-এর কুরিয়ারে কাজ করছি।

এবার হাসি ফুটল মুখে। ডি সিলভা জিজ্ঞেস করল, আজও কি কার্ভালোর জন্যে এসেছেন? ওর উচিত হচ্ছে না জো-এর কুরিয়ার ব্যবহার করা।

অর্জুন চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে দেখে ডি সিলভা তাকে বসতে বলে জিজ্ঞেস করল, আপনার দেশ যেন কোথায়? কী যেন বলেছিলেন, ইন্ডিয়া?

হ্যাঁ ইন্ডিয়া।

দেশটা কোথায়? আফ্রিকায়?

না। এশিয়ায়।

ছেলেবেলায় ভাবতাম সারা পৃথিবীটা ঘুরে দেখব। তা আর হল না। তা আপনাকে এমন নাম কে দিল? অ-র! হা হা হা।

অর্জুন হাসল, কথা বলল না।

আসুন, বাইরে যাই। দেখি কাউকে পাই কিনা! ডি সিলভা বাইরে পা বাড়ালে অর্জুন তাকে অনুসরণ করল।

বাইরে বেরিয়ে অর্জুন অবাক। একটু আগে জমজমাট দেখেছিল রাস্তাটা। এখন একদম ফঁকা। কোনও লোক নেই ফুটপাতে। তখনই তিনটে পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়াল সামনে। ড্রাইভিং সিটে বসে একজন অফিসার চেঁচিয়ে বললেন, এটা হচ্ছে কী? তোমার ছেলেরা আমাদের কি একটু শান্তিতে থাকতে দেবে না।

আমার তো কোনও ছেলে নেই অফিসার? ডি সিলভা হাসল।

আঃ। রসিকতা ছাড়ো। হু ইজ বেন?

বেন? তোমার এলাকায় থাকে। কয়েকদিন আগে সে লং আইল্যান্ডে গিয়ে একজন মহিলাকে ছুরি মেরেছিল ডলারের জন্যে। তুমি জানো না?

ঈশ্বরের দিব্যি, আমি জানি না।

আমরা প্রথমে শুনেছিলাম, মহিলার ছেলের কাণ্ড ওটা। দু’-দু’বার খুব অল্পের জন্যে ওকে ধরতে পারিনি। এখন খবর এসেছে ছেলে নয়। ওই বেনের কাণ্ড এটা। তোমরা এখানে যা করছ তা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। কিন্তু এখান থেকে লং আইল্যান্ড অনেক দূর, তাই না?

নিশ্চয়ই।

ছেলেটিকে আমাদের হাতে তুলে দাও।

আমি দেখছি। তবে ও বোধহয় এখানে নেই।

ডি সিলভা, ইউ নো মি, আমার সঙ্গে চালাকির চেষ্টা কোরো না।

কোনও প্রশ্নই ওঠে না অফিসার। ডি সিলভা বলামাত্র পুলিশের গাড়িগুলো একটু এগিয়ে রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে পড়ল।

আই ডোন্ট লাইক ট্রাবল। কিন্তু এই ছেলেগুলো সেটাই ইনভাইট করছে। অ-র, ইউ কাম উইথ মি, কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি এখান থেকে বেরিয়ে যান। ডি সিলভা আবার ভিতরে ঢুকে পড়ল। যে ঘরে বেন জো-কে নিয়ে গিয়েছিল সেই ঘরে এসে একটা দরজা খুলল ডি সিলভা। দরজার বাইরে একটা চাতাল। সেখানে নানান রকমের বাতিল বাক্স তূপ করে রাখা আছে। বাক্স সরিয়ে ম্যানহোলের ঢাকনা খুলল ডি সিলভা, আমার পিছন পিছন চলে আসুন।

কুয়োর মতো একটা সুড়ঙ্গ। তার একটা দিকে আংটা লাগানো। ডি সিলভার মতো সেখানে পা রেখে রেখে নীচে নামতেই চোখের সামনে জমাট অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখতে পেল না অর্জুন। ডি সিলভার গলা কানে এল, আমার হাত ধরুন।

হাতড়ে হাতড়ে হাতের নাগাল পেল অর্জুন। অন্ধকারে একটা স্যাঁতসেঁতে প্যাসেজ দিয়ে ডি সিলভার হাত ধরে হাঁটতে হল কিছুক্ষণ। ধীরে ধীরে অন্ধকার পাতলা হয়ে এল। ওরা বেরিয়ে এল ছাইছাই রঙা আলোমাখা একটা রাস্তায়। মাথার অনেক উপরে ছাদ। পায়ের তলায় সিমেন্টের বদলে শুধুই মাটি। এই সুড়ঙ্গ ঠিক পাতালরেল যাওয়ার মতো চওড়া।

খানিকটা হাঁটার পর চিৎকার শোনা গেল। বাঁক ঘুরতেই অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেল অর্জুন। সুড়ঙ্গের দু’পাশে যেন সংসার পেতে বসে আছে লোকজন। খাঁটিয়া থেকে আরম্ভ করে রান্নার গ্যাস, কী নেই! বীভৎস চেহারার পুরুষদের পাশাপাশি মহিলাও আছে। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, সভ্যতার ধার ধারে না। চিৎকার করছে যে ছেলেটি তার হাতে একটা রিভলভার। তাকে ঘিরে যারা দাঁড়িয়ে তারা যেন বেশ মজা পেয়েছে। অর্জুন লক্ষ করল, পুরুষদের বেশিরভাগই দাড়িওয়ালা। ডি সিলভাকে দেখে ছেলেটি চিৎকার করতে করতে অদ্ভুত উচ্চারণে কিছু বলতে যেতেই সপাটে চড় খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল। ওর হাত থেকে রিভলভার কেড়ে নিয়ে ডি সিলভা বলল, এখানে যে অশান্তি করবে তার জিভ উপড়ে ফেলা হবে।

ছেলেটি কেঁদে ফেলল, আমার আড়াইশো ডলার চুরি হয়ে গিয়েছে।

ঠিক করে রাখিসনি কেন?

আমি ঘুমোচ্ছিলাম। এরা সবাই দেখেছে, কিন্তু কেউ বলছে না।

ছেলেটি কথাগুলো বলামাত্র লোকগুলো যেন কিছুই শোনেনি এমন ভঙ্গি করে যে-যার জায়গায় চলে গেল। রিভলভার থেকে গুলি বের করে পকেটে রেখে যন্ত্রটা ফেরত দিয়ে ডি সিলভা জিজ্ঞেস করল, কাকে সন্দেহ করছিস?

ছেলেটি কঁধ নাচাল।

অর্জুন বুঝতে পারছিল মাটির নীচে এই সুড়ঙ্গে ডি সিলভার কথার উপর কেউ কথা বলে না। অর্থাৎ উপরের তিনটি ব্লকের মধ্যে ওর কর্তৃত্ব। অন্য ব্লকগুলোয় নিশ্চয়ই ওর মতো অনেক ডন আছে। দেখলে মনে হবে, রাস্তার দু’পাশের ফুটপাতে ভিখিরিরা বাসা বেঁধেছে। কিন্তু সেখানে এত দামি টিভি চলছে যা অর্জুন কখনও দ্যাখেনি। খানিকটা যাওয়ার পর একটা লোক এগিয়ে এল, কী ব্যাপার? তুমি হঠাৎ?

বাধ্য হয়ে আসতে হল। বেন কোথায়? ডি সিলভা জিজ্ঞেস করল।

কোথাও লুকিয়ে আছে। টম ওকে খুন করবে বলে খুঁজে বেড়াচ্ছে। বেচারা বেন পুলিশের ভয়ে উপরেও যেতে পারছে না।

ডি সিলভা ওদের পরিচয় করিয়ে দিল, তোমার প্যাকেট এসেছে। ও জো-এর কর্মচারী। নিয়ে যাও।

সই করে প্যাকেট নিল কার্ভালো। এক টানে মুখ ছিঁড়ে ভিতর থেকে পলিথিনে মোড়া আর-একটা প্যাকেট বের করে পকেটে ঢোকাল।

আমার মনে হয় জো-এর কুরিয়ার এবার ছেড়ে দাও। পুলিশ নিশ্চয়ই নজর রাখছে। নেক্সট টাইম জো ধরা পড়ে যেতে পারে। ডি সিলভা বলল।

হ্যাঁ। আমিও ভাবছিলাম ওকে কিছুদিন ব্যবহার করব না।

টম কোথায়?

বাড়াবাড়ি করছে। আটকে রেখেছি।

চলো, দেখি।

নিঃশব্দে অর্জুন ওদের অনুসরণ করল। সুড়ঙ্গ থেকে আর-একটা সুড়ঙ্গ। তার দরজা বন্ধ। কার্ভালো সেটা খুলতেই টম ব্রাউন দৌড়ে এসে চিৎকার করল, আমাকে আটকে রেখেছ কেন? বেনকে আমি খুন করবই।

শান্ত গলায় ডি সিলভা জিজ্ঞেস করল, কেন?

ও আমার সঙ্গে বন্ধু হিসেবে মিশে সব কথা জেনেছিল। আমি বিশ্বাস করে সব বলেছিলাম। ও বলেছিল, আমার বাবাকে একটু শাসিয়ে দেবে। বাবাকে আমি পছন্দ করি না। কিন্তু ও আমার মায়ের কাছে টাকা চেয়ে না পেয়ে ছুরি মেরেছে। আই লাভ মাই মাদার। শুধু তাই নয়, হাসপাতালে ও জনকে নিয়ে গিয়েছিল জবানবন্দি দেওয়ার আগে কী করে মাকে খুন করা যায় তার প্ল্যান করতে। টম চিৎকার করে বলল।

ডি সিলভা কাভালোকে বলল, তোমার সঙ্গে একটু আলাদা কথা বলব।

নিশ্চয়ই, চলো।

অ-র, আপনি একটু এখানে অপেক্ষা করুন।

ডি সিলভাকে নিয়ে কার্ভালো চোখের আড়ালে চলে যাওয়ামাত্র অর্জুন বলল, হাই টম!

হু আর ইউ!

আমি তোমার ভাল চাই। তোমার ঠাকুরমা খুব অসুস্থ।

আমার ঠাকুরমাকে তুমি চিনলে কী করে?

প্রশ্ন কোরো না। তোমাকে দেখতে না পেলে তিনি মারা যাবেন। প্লিজ, তুমি গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করে এসো। অর্জুন বলল।

অসম্ভব। উপরে উঠলেই পুলিশ আমাকে ধরবে।

না। তোমার মা পুলিশকে বলেছেন বেন তাঁকে খুন করতে গিয়েছিল।

তুমি ঠিক বলছ? চোখ ছোট করল টম।

মিথ্যে বলছি না। তুমি বেনকে খুন করলে পুলিশ তোমাকে ছেড়ে দেবে না। কাজটা পুলিশকেই করতে দাও।

কিন্তু আমার বাবা?

মিস্টার ব্রাউন এখন খুব দুঃখিত। তিনিও চান তুমি ফিরে যাও।

কিন্তু এসব তুমি জানলে কী করে?

আমি মিস্টার মেজরের বাড়িতে আছি। তিনি তোমার বাবার বন্ধু।

মিস্টার মেজর? দ্যাট ফ্যাটি ইন্ডিয়ান উইথ অ্যালকোহল?

হ্যাঁ। তবে তিনি এখন ওসব ছেড়ে দিয়েছেন। আর হ্যাঁ, এসব কথা যেন কাউকে বোলো না। তা হলে আমি বিপদে পড়ব।

কার্ভালো এবং ডি সিলভা ফিরে আসছে দেখে অর্জুন মুখ বন্ধ করল। ডি সিলভা বলল, লুক টম, বেন অন্যায় করেছে। তার শাস্তি পুলিশ বা তুমি দিতে পারো না। ওটা আমরাই দেব। কথাটা ভুলে গেলে বিপদে পড়বে। তোমাকে ওখানে আটক থাকতে হবে না। ওয়েল অ-র, লেটস গো ব্যাক।

যে পথ দিয়ে ওরা সুড়ঙ্গে ঢুকেছিল সেই পথ দিয়ে উপরে উঠে এল। ডি সিলভা বলল, জো-কে বলবেন যদি এখানকার কারও নামে কোনও পার্সেল আসে তা হলে আমাকে ফোন করতে। আপনাদের আর এখানে আসা ঠিক হবে না।

.

১৩.

জো-কে রশিদ দিয়ে ডি সিলভার বক্তব্য জানিয়ে বাড়ি ফিরে এল অর্জুন। তাকে দেখামাত্র মেজর হাসলেন, আগে হলে আমি খুব রাগারাগী করতাম। এখন তো ওই জীবনে নেই, তাই কিছু বলছি না।

অর্জুন বলল, আমি জো-এর কাছে গিয়েছিলাম। জো আমাকে ব্রঙ্কসে পাঠাল প্যাকেট ডেলিভারি করতে।

আবার ব্রঙ্কসে গিয়েছিলে? আর আমি তৈরি হয়ে বসে আছি তোমার সঙ্গে অভিযানে যাব বলে। না হয় আমি বুড়ো হয়েছি, তাই বলে…!

এই সময় ফোন বেজে উঠতে মেজর কথা থামিয়ে উঠে গেলেন রিসিভার তুলতে, হ্যালো! মেজর বলছি! আঁ? সে কী! কী করে হল? তাই নাকি? তবে দ্যাখো, তুমি আমার উপর ভরসা করতে পারোনি ওকে দেখার পর। নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, যখন ইচ্ছে চলে এসো জিম। বাই।

রিসিভার রেখে ঘুরে দাঁড়ালেন মেজর। ঠিক আগের মতো চিৎকার করে উঠলেন, তুমি, তুমি একটা যাচ্ছেতাই, একদম যাচ্ছেতাই!

মানে? অর্জুন অবাক।

এগিয়ে এসে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলেন মেজর, থ্যাঙ্ক ইউ। টম এইমাত্র তার বাড়িতে পৌঁছেছে। দে আর সো হ্যাপি। হ্যাঁ, আজ আমি চিকেন রান্না করব আবার। জিম বলেছে কাল গালা লাঞ্চ খাওয়াবে।

চিকেন যখন খাবেন তখন দাড়িটাও রাখুন। হেসে অর্জুন বলল।

অ্যাঁ? অট্টহাস্যে ভেঙে পড়লেন মেজর, তুমি যাচ্ছেতাই রকমের ভাল!

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার