খবর পেয়ে কুলদীপ এসে গেল জলপাইগুড়িতে। অমল সোমের বাড়িটাই এখন ওদের বেসক্যাম্প। ঠিক হল তিনজন মালবাহক নেওয়া হবে চামুর্চি থেকে। তারা নেপালি। যদিও শেরপাদের দক্ষতা তাদের নেই কিন্তু মালপত্র পিঠে নিয়ে পাহাড়ে চড়তে ওস্তাদ। শিলিগুড়ি থেকে অর্জুনের পরিচিত ব্যক্তির সাহায্যে চারটে তাবু ভাড়া করা হল। পাতলা কিন্তু অতি আধুনিক তাঁবু। বইতে কষ্ট হবে না। শিলিগুড়িতেই বিস্তর টিনফুড পাওয়া গেল। মেজরের ইচ্ছায় টুনা মাছের কৌটো নেওয়া হল অনেকগুলো। চাল, ডাল আলু, পেঁয়াজ, মশলা আর কয়েক ডজন ডিমের সঙ্গে কম্বল এবং স্লিপিং ব্যাগের জোগাড়ও হয়ে গেল। ঠিক হল কুলদীপ মালবাহকদের নিয়ে গয়েরকাটায় ওদের জন্যে অপেক্ষা করবে। অর্জুনরা একটা ছোট ট্রাকে মালপত্র চাপিয়ে সেখানে পৌঁছে যাবে।

খবরটা মাকে বলেনি অর্জুন। ছেলে শহর বা গ্রামে গোয়েন্দাগিরি করে এটা তিনি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এসব করে যা রোজগার হয় তা তাকে দেয় অর্জুন। কিন্তু সেই ভুটানের জনমানবহীন পাহাড়ে, যেখানে সভ্যতা পৌঁছোয়নি সেখানে ছেলে যাচ্ছে একটা গুহার সন্ধানে এটা তিনি মেনে নিতে পারবেন না। কাজটা করার জন্যে কেউ তাকে বরাদ্দ দেয়নি। মৃত্যুর আশঙ্কা আছে পায়ে পায়ে, এ কথা জানলে তো আরও বেঁকে বসবেন। তাই যাওয়ার আগের রাতে অর্জুন যখন বলল, মেজর তাকে নিয়ে ভুটানে যাচ্ছেন ছবি তুলতে তখন আপত্তি করতে পারলেন না। মেজর মানুষটিকে তার ভাল লাগে। ওই বড়সড় চেহারার প্রবীণ মানুষটির মধ্যে মিষ্টি ছেলেমানুষি আছে। শুধু বললেন, উনি যে ছবি তোলেন তা তো কখনও শুনিনি।

ছাড়পত্র পেয়ে অর্জুন ভেবেছিল জলপাইগুড়ির পুলিশ সুপার সাহেবের সঙ্গে কথা বলবে কি না। যদি কোনও সাহায্যের দরকার হয় কিন্তু ব্যাপারটা বেশি জানাজানি করা ঠিক হবে না বলে সে দেখা করতে গেল না। তা ছাড়া এসপি সাহেবের যাবতীয় ক্ষমতা এই জলপাইগুড়ি জেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ভুটানে গেলে তিনি কিছুই করতে পারবেন না।

দুপুরের পর ওরা জলপাইগুড়ি থেকে রওনা হল। মেজর এখনই অভিযাত্রীর পোশাক পরে ফেলেছেন। তার শার্ট-প্যান্টে এখনও গোটা আটেক বড় প্যাকেট, মাথায় টেক্সাস হ্যাট। গাড়িতে উঠে বসেই পকেট থেকে ধাতব পাত্র বের করে এক চুমুক খেয়ে নিয়ে বললেন, ডোন্ট লুক ব্যাক। সামনে তাকাও। তারপরেই তার গলায় বিরক্তি ফুটল, পৃথিবীর এত পরিবর্তন হচ্ছে অথচ তোমাদের দেশের এই ট্রাকগুলো বাবরের আমলে পড়ে আছে। প্রায় কাঠের উপর বসতে হচ্ছে, একটু নরম গদির ব্যবস্থা করতে পারে না?

এইটুকুই তো রাস্তা, এখনই শেষ হয়ে যাবে। অর্জুন বলল।

তার মানেটা কী? এরপরে তুমি ভুটানের জঙ্গলে আমার জন্যে রোলস রয়েসের ব্যবস্থা করে রেখেছ? হুঁঃ।

কুলদীপকে বলা হয়েছিল গয়েরকাটার চৌমাথায় না দাঁড়িয়ে ওদের জন্যে মেছুয়াপুলের কাছে অপেক্ষা করতে। জায়গাটায় কোনও জনবসতি নেই, দূরে একটি রিসর্ট তৈরি হয়েছে কিন্তু চালু হয়নি। ওখানে অপেক্ষা করতে বলার কারণ সাধারণ মানুষের কৌতূহল এড়ানো। মালপত্র নিয়ে একটা ট্রাক যাচ্ছে দেখলে কেউ কেউ প্রশ্ন করতেই পারত।

মেছুয়াপুলে ওরা পৌঁছেই কুলদীপদের দেখতে পেল। প্রত্যেকের হাতে একটা করে ব্যাগ। ট্রাকের পাশে এসে কুলদীপ বলল, খারাপ খবর। একটা হাতির দল জঙ্গলের মাঝখানে রাস্তাজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওদিক থেকে কোনও গাড়ি যাচ্ছে না, এদিকের গাড়িও ফিরে এসেছে। মেজর নেমে এলেন ট্রাক থেকে, এটা কোনও খারাপ খবরই নয়। বরং খবরটা ভাল। রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গেল আমাদের জন্যে।

হ্যাঁ স্যর, তবে সেটা কতক্ষণে হবে তা বলা যাচ্ছে না। কুলদীপ বলল, ওদের তো বিশ্বাস নেই। অর্জুন আকাশের দিকে তাকাল। সূর্য ঢলে পড়ছে। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সন্ধে নেমে যাবে। সে বলল, কুলদীপ, হাতিরা আমাদের উপকারই করল। আমরা একটু তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। ওরা না থাকলে আমরা দিনের আলোয় নাথুয়াতে পৌঁছে যেতাম। এই ট্রাক থেকে মালপত্র নামাতে দেখত ওখানকার মানুষেরা। রাত নামলে স্যরের বাড়ির দিকে কেউ যায় না। তখন আমাদের কাজ করতে সুবিধা হবে।

দ্যাটস রাইট। কিন্তু অর্জুন, তোমার ওই স্যরের বাড়িতে যারা থাকে–!

স্যর একাই থাকেন।

বাঃ। তা হলে তো ওঁর ওখানেই ডিনার করতে পারি আমরা।

অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করতে হবে। আপনি আমাদের নেতা, যা বলবেন তাই করব। অর্জুন বলল।

থ্যাঙ্কু। যতক্ষণ ইন্ডিয়াতে আছি আমি দলের লিডার কিন্তু যেই ভুটানের মাটিতে পা রাখব অমনি তোমাকে দায়িত্বটা নিতে হবে।

মেজর বললেন, আমার মনে হয় মাঝরাতে যাত্রা শুরু না করে চতুর্থ প্রহরে, আই মিন, ভোরের আগেই আমাদের স্টার্ট করা উচিত।

ঘণ্টাখানেক পরে ট্রাক জঙ্গলে ঢুকল। অন্ধকার এখনও পাতলা। দু’পাশের জঙ্গল থেকে তীব্র ঝিঁঝির ডাক ভেসে আসছে। হেডলাইটের আলোয় দুটো হরিণকে দৌড়ে রাস্তা পার হতে দেখা গেল। হঠাৎ কুলদীপ বলল, দাদা, এই জায়গা, ওঃ, মাই গড, আপনি না এলে মরে যেতাম।

মেজর বললেন, শাট আপ। একদম চুপ। আমি হাতির গন্ধ পাচ্ছি। বুঝলে অর্জুন, ধূমপান ছাড়ার পর থেকে আমার ঘ্রাণশক্তি বেড়ে গেছে।

এতক্ষণে অর্জুনের খেয়াল হল। এবার মেজর ধূমপান করছেন না।

.

দিবাকর স্যরের বাড়িতে ওরা যখন পৌঁছোল তখন পৃথিবী অন্ধকারে ঢাকা। নাথুয়ার বাজারেও আলো দেখেনি। বোঝা যাচ্ছিল লোডশেডিং চলছে। ট্রাকের ড্রাইভার হাতজোড় করল। আজ রাতে এখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিন।

মেজর জিজ্ঞাসা করলেন, হোয়াই?

স্যর, ওই জঙ্গলের রাস্তায় একা ট্রাক চালিয়ে যেতে পারব না। হাতির সামনে পড়লে আমার বউ বিধবা হবে। ড্রাইভার বলল।

সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে অর্জুন দেখল দরজা বন্ধ। কিন্তু তালা দেওয়া নেই। সে চেঁচিয়ে ডাকল, স্যার! আপনি কোথায়? আমি অর্জুন।

এইসময় অন্ধকার থেকে দিবাকর স্যারের কথা ভেসে এল, আসছি, তুমি হঠাৎ চলে এলে! একটু দাঁড়াও।

অন্ধকারে স্যারকে স্পষ্ট বোঝা গেল না। কিন্তু তিনি ওপরে উঠে হারিকেন জ্বালার পর তাঁকে দেখল অর্জুন। হাফপ্যান্ট আর শার্ট পরা। উপরে উঠে বারান্দায় যে বস্তুটি রেখেছিলেন সেটি একটা ছিপ এবং তার পাশে একটা সরু কাঠিতে কান বিঁধিয়ে রাখা আছে গোটা দশেক ইঞ্চি ছয়েক মাছ। অর্জুন অবাক গলায় বলল, স্যর, আপনি মাছ ধরতে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। এই শখটা এখানে এসে আমার হয়েছে। এসো, আসুন আপনারা।

অর্জুন বুঝল স্যার একটু লজ্জা পেয়েছেন। সেই বাল্যকাল থেকে সে স্যারকে দেখে আসছে কিন্তু কখনও হাফপ্যান্ট পরা অবস্থায় দেখেনি। তার মনে হল, একমাত্র মানুষই অতিদ্রুত নিজেকে বদলে ফেলতে পারে।

পোশাক পালটে স্যর পরিচিত বেশে ফিরে এলে অর্জুন পরিচয় করিয়ে দিল, ইনি মেজর। অমলদার বন্ধু। নিউ ইয়র্কে থাকেন।

নমস্কার করে স্যার বললেন, বিলক্ষণ জানি। আপনাকে ছাড়া অর্জুনকে ভাবা যায় না। অভিযানে তো আপনারা পরস্পরের সঙ্গী।

মাই গড! আপনি দেখছি অনেক খবর রাখেন। মেজর বললেন, অর্জুনের কাছে আপনার কথা শুনলাম। ও তো আপনার খুব ভক্ত।

অর্জুন কথা ঘোরাল, স্যার। এর নাম কুলদীপ। চামুৰ্চিতে থাকে। যদিও ওর মাতৃভাষা পঞ্জাবি কিন্তু চমৎকার বাংলা বলে এবং ভুটানি পড়তে এবং বলতে পারে।

কুলদীপ স্যারের পা ছুঁয়ে প্রণাম করল।

স্যার বললেন, মনে হচ্ছে তোমরা তৈরি হয়ে এসেছ।

অর্জুন বলল, হ্যাঁ স্যার। আমরা স্টিফেন অ্যালফোর্ডের ডায়েরিটা কুলদীপের মুখ থেকে শুনেছি। উনি আপনাকে যে ম্যাপ দিয়ে গিয়েছেন সেটা অনুসরণ করেই পৌঁছোতে চাইছি।

দেখো, এই চ্যালেঞ্জ তোমরা নিয়েছ বলে আনন্দিত হচ্ছি কিন্তু ভয়ও পাচ্ছি। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করছি যেন তোমরা সফল হও। স্যার বললেন।

ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই। ভয় করলেই ভয়, নইলে কিছু নয়। মেজর বললেন, আমি মেরু থেকে মরুভূমি, আফ্রিকার গভীর জঙ্গল থেকে দক্ষিণ আমেরিকার ভয়ংকর নদীতে বহুদিন কাটিয়েছি। ভুটান তো তার কাছে কিছুই নয়।

স্যার হাসলেন, আপনাকে একটুও অশ্রদ্ধা না করে বলি, ভুটানকে বলা হয় অনাবিষ্কৃত দেশ, কারণ ভুটানিরা চান না বাইরের মানুষ এসে তাদের দেশটাকে জেনে যাক। অর্জুন, তোমরা কোন পথে ভুটানে প্রবেশ করবে?

আমরা ভেবেছি যেহেতু স্টিফেন অ্যালফোর্ড ভুটান থেকে ওই নদী পার হয়ে আপনার কাছে এসেছিলেন তাই এখান থেকে নদী পার হয়ে ভুটানে ঢুকে পড়ব। আমরা রাত আড়াইটে নাগাদ রওনা হব যাতে অন্ধকারের আড়াল পাওয়া যায়। অর্জুন বলল।

একটু ভুল হবে। আমি আজ মাছ ধরতে গিয়ে দেখি ওপারের জঙ্গলে মানুষের আনাগোনা হয়েছে। জঙ্গলের ভিতর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। চিৎকারও কানে এসেছিল। স্টিফেন এই পথে পালিয়ে এসেছে বলে হয়তো পুলিশ ক্যাম্প করেছে ওখানে। ওদের মুখোমুখি হলে সমস্যায় পড়বে। স্যার বললেন।

অর্জুনের কপালে ভাঁজ পড়ল। মেজর বললেন, ঠিক কথা, কুমিরের জিভে হাত বোলালে সে ত চুমু খেয়ে ছেড়ে দেবে না।

কুলদীপ এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল। এবার কথা বলল, স্যার, আমরা যদি আরও মাইল পাঁচেক এগিয়ে নদী পার হই? ওইদিকে কখনও মানুষকে দেখা গিয়েছে বলে শুনিনি।

স্যার জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু আপনাদের সঙ্গে তো মালপত্র রয়েছে। ওদিকের নদীর ধারে গাড়ি যাওয়ার মতো রাস্তা আছে কিনা আমি জানি না।

কুলদীপ বলল, নদী অবধি না যাওয়া গেলেও কাছাকাছি যেতে পারব।

স্যার বললেন, তা হলে তোমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা এখনই করা যাক।

অর্জুন বলল, আপনাকে কিছু করতে হবে না। আমাদের সঙ্গে লোক আছে। আমরাই করে নেব। আপনিও তাই খাবেন।

.

রাত একটা নাগাদ ওরা রওনা হল। ট্রাক ড্রাইভার কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। অত রাতে জঙ্গলের রাস্তায় গাড়ি চালাতে সে সাহস পাচ্ছিল না। মেজর বললেন, ওয়েল, তোমার ভয়ের কারণ কী ব্রাদার?

ড্রাইভার বলেছিল, আপনারা তো নেমে চলে যাবেন। তারপর আমাকে তো একা ট্রাক চালিয়ে ফিরতে হবে। তখন?

খুব সিম্পল। তুমি ফিরবে না। মেজর বললেন।

মানে? ড্রাইভার অবাক।

জঙ্গলের মধ্যে ট্রাক ঢুকিয়ে রেখে তুমি আমাদের সঙ্গে ভুটানে যাবে।

ভুটানে?

হ্যাঁ। তা হলে তোমাকে একা ফিরতে হবে না।

ক’দিনের জন্যে যাবেন?

যাওয়ার পর বলতে পারব।

লোকটা কিছু ভাবল। তারপর রাজি হল।

স্যরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওরা রওনা হল। নাথুয়া থেকে বেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ভয়ে ভয়ে ট্রাক চালিয়ে একসময় থেমে গেল ড্রাইভার।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, কী হল?

সামনে গাছ পড়ে আছে, ট্রাক যাবে না।

মেজর জানতে চাইলেন, এখান থেকে নদী কতদূরে?

খুব কাছে।

হেডলাইটের আলোয় গাছটাকে দেখা গেল। এটা যে হাতিদের কীর্তি তাতে সন্দেহ নেই। এখন জঙ্গলের মাথায় দশমীর চাঁদ। হালকা জ্যোৎস্নার চারধার কীরকম রহস্যময়। মালবাহকরা মালপত্র সরিয়ে নিল ট্রাক থেকে। মেজর বললেন, ওহে ড্রাইভার, ট্রাকটাকে কোথায় লুকোবে?

সাহেব, ভুটানে যে কদিন থাকবেন পার ডে দুশো টাকা দেবেন তো?

কেন? মেজর চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

না হলে আমার হেভি লস হয়ে যাবে।

ঠিক আছে দেব। তোমাকে ওদের সঙ্গে মাল বইতে হবে। রান্না করতে হবে। সাতদিন, দশদিন যা লাগে তুমি পার ডে দুশো পাবে। মেজর যেন আচমকা উদার হয়ে গেলেন।

এক মুহূর্ত দাঁড়াল না ড্রাইভার। সোজা এগিয়ে গিয়ে ট্রাকে উঠে বসল। তারপর কোনওরকমে ট্রাক ঘুরিয়ে ফেরার পথ ধরল।

মেজর অর্জুনকে বললেন, দেখলে? ভয় উধাও হয়ে গিয়েছে।

অর্জুন বলল, এখন আমরা কী করব?

মানে?

আপনি অর্ডার না দিলে।

ইয়েস। মাথা নাড়লেন মেজর, লেটস গো। নদী পার হওয়া যাক।

প্রায় মিনিট কুড়ি হাঁটার পর নদীটাকে দেখা গেল। চওড়া নদী, ছোট পাথর আর বোল্ডারে নদীর বুক ঠাসা। জল বইছে ঠিক মাঝখান দিয়ে আর ওই প্রান্তের জঙ্গল ঘেঁষে। জঙ্গল ভুটানের।

জোছনায় বেশি দূরে দৃষ্টি যাচ্ছে না। কিন্তু হটতে সুবিধে হচ্ছে। প্রথমে কুলদীপ, মেজর, অর্জুন পিছনে মালবাহকরা শুকনো পাথরে পা দিল। হাঁটার সময় নুড়িগুলো বালিতে বসে যাচ্ছিল। কয়েক মিনিট পরে ওরা নদীর মাঝখানে এসে জলের ধারার পাশে দাঁড়াল।

মেজর বললেন, হুম। এটা নদী নয়, স্রেফ ঝরনা। লেটস গো।

হাঁটুর উপর প্যান্ট গুটিয়ে ওরা একে একে জলে নামল। মেজরকে মনে মনে ধন্যবাদ দিল অর্জুন। ভাগ্যিস তিনি সবাইকে রবারের জুতো পরতে বলেছিলেন। জল হাঁটুর নীচে হলেও স্রোত তীব্র। শরীর নাড়িয়ে দিচ্ছে। মেজর তো একবার পড়ে যেতে যেতে বাঁচলেন, হরি হরি।

অর্জুন বলল, আপনি কি হরিবোল বললেন?

অ্যাঁ। দুটো একই কথা। তবে একটা জ্যান্ত মানুষ বলে আর একটা মরা মানুষ শোনে।

জল পেরিয়ে আবার কিছুটা শুকনো বালির উপর দিয়ে হেঁটে নদীর দ্বিতীয় ধারার সামনে এল ওরা। এখানে স্রোত কম কিন্তু মনে হচ্ছিল জল কিছুটা গভীর। নদী পার হতে জল কোমরে পৌঁছোল। প্যান্ট ভিজে শরীরে লেপটে গিয়েছে। মেজর বললেন, আমরা এখন ভুটানে। এবার তুমি অর্ডার করো।

অর্জুন হেসে ফেলল, প্রথমে তো প্যান্ট পালটে নেওয়া দরকার।

ফুলপ্যান্ট ছেড়ে ওরা তিনজন বারমুডা পরে নিল। কুলিরা কিন্তু হাফপ্যান্ট পালটাল না। বলল, কুছ নেহি হোগা।

ওরা দাঁড়িয়ে ছিল তিনদিকে জঙ্গল ঘেরা একটা বালি বালি জায়গায়। অর্জুন চারপাশে তাকিয়ে বলল, আমরা ঠিক কোথায় আছি জানি না। এখনও ভোর হতে ঘণ্টা দুয়েক বাকি। তার আগে জঙ্গলে ঢোকা ঠিক হবে না। কুলদীপ, আপনি কী বলেন?

কুলদীপ চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবছিল। প্রশ্ন শুনে চোখ খুলে বলল, ঠিক বলেছ দাদা। রাতের জঙ্গলে বিপদ হতেই পারে। কিছুই তো দেখা যাবে না। আমাদের ঠিক করে নিতে হবে কোন দিকে হাঁটলে ম্যাপ যেখানে শুরু হয়েছে সেখানে পৌঁছোতে পারব।

অর্জুন সবাইকে দু’ঘণ্টা বিশ্রামের কথা বলতেই অবাক হয়ে দেখল মালবাহকরা মালপত্তর ঠেস দিয়ে আধশোয়া হয়ে চোখ বন্ধ করল। কুলদীপ হেসে বলল, এইভাবেই ওরা দু’ঘণ্টা আরামে ঘুমাবে।

বুনো ঝোঁপের আড়ালে বালির উপর ওরা বসে ছিল। অর্জুন মুখ তুলে দেখল চাঁদের গায়ে ময়লাটে মেঘ জড়াচ্ছে। স্টিফেন সাহেব তার ডায়েরিতে লিখে যাননি ঠিক কোনখান থেকে ম্যাপের পথ শুরু হয়েছে। কিন্তু যে গ্রামে তিনি আশ্রয় নিয়ে থেকেছেন, যে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তাকে ডায়েরি ম্যাপ দিয়েছিলেন সেই গ্রাম থেকে খানিকটা এগিয়ে ওই পথটাকে পেয়েছিলেন। স্টিফেন লিখেছেন সেই গ্রামের নাম টুংচি। অর্জুন জলপাইগুড়িতে ফিরে গিয়ে ভুটানের এই অঞ্চলের ম্যাপে টুংচির খোঁজ করেও পায়নি। গ্রামটি এত গুরুত্বহীন যে ম্যাপে দেখানো হয়নি। স্টিফেনের পালিয়ে আসার পথ অনুমান করলে টুংচি গ্রামটা নাথুয়া থেকে নদী পার হয়ে ভুটানের সীমানার কুড়ি থেকে তিরিশ মাইল উত্তরে বলেই মনে হয়েছে অর্জুনের। ওই গ্রামে পৌঁছোতে পারলে ম্যাপের পথ পেতে অসুবিধে হবে না।

স্টিফেন লিখেছেন ওই টুংচি গ্রাম থেকে কিছুটা গেলে তিনটে ঝরনা যেখানে একত্রিত হয়েছে সেখান থেকেই ম্যাপপথের শুরু। অতএব প্রথমে ওই গ্রামেই পৌঁছোতে হবে। কিন্তু কীভাবে? সে ভেবেছিল ভুটানে ঢোকার পর যে-কোনও মানুষকে পেলে তাকে জিজ্ঞাসা করলে টুংচি গ্রামের হদিশ পেয়ে যাবে।

হঠাৎ মেজরের চিৎকার কানে এল। অর্জুন আর কুলদীপ তাকিয়ে দেখল মেজরের হাতে একটা যন্ত্র এবং তিনি সেদিকে তাকিয়ে বলে যাচ্ছেন, বাঃ, ব্রাভো! ভাগ্যিস এটাকে নিয়ে এসেছিলাম।

অর্জুন এগিয়ে গেল মেজরের কাছে, কী ব্যাপার?

তোমার ম্যাপ যদি ঠিক হয় তা হলে আমার কম্পাস বলছে আমাদের উত্তরদিকে যেতে হবে। মেজর বললেন।

উঃ। খুব ভাল হল। অর্জুন স্বস্তি পেল।

.

ভোরের মুখে চা-বানাল মালবাহকরা। চা-বিস্কুট খেয়ে ওরা উত্তরদিকে রওনা । হল। প্রথমদিকে জঙ্গল গভীর ছিল না কিন্তু কাটার জঙ্গল থাকায় পথ তৈরি। করতে অসুবিধা হচ্ছিল। কিন্তু তারপরেই আকাশছোঁয়া গাছ, মাটিতে শ্যাওলা পাথর, মাটি, মাঝে মাঝে বেতগাছের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ওরা হাঁটছিল। টানা চারঘণ্টা হাঁটার পর অর্জুন বিশ্রাম করার কথা বলল।

পাখি ডাকছিল, হঠাৎ থেমে গেল তারা। তারপরেই দুরে গাছ ভাঙার। আওয়াজ হল। মালবাহকদের একজন চাপা গলায় বলল, হাতি।

সঙ্গে সঙ্গে নার্ভাস হয়ে গেল কুলদীপ, এখান থেকে চলুন দাদা।

মেজর আরাম করে বসে ছিলেন একটা গুঁড়ির উপর। বললেন, এত ভয় পাওয়ার কী আছে। ওরা ওদের মতো আছে, আমরা আমাদের মতো থাকি।

অর্জুন মাথা নাড়ল, না। আমাদের আর একটু এগিয়ে যাওয়া উচিত।

মেজর বললেন, তুমি ভেবো না, চার ঘণ্টা হাঁটার ফলে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। কালাহারি মরুভূমিতে আমি একটানা দশঘণ্টা হেঁটেছিলাম। আমি হাতির চরিত্র জানি বলেই বলছি, ওদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

কিন্তু কুলদীপ মাথা নেড়ে বলল, স্যার, আপনি বোধহয় আফ্রিকার হাতিদের দেখে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিন্তু ভারত-ভুটানের হাতির চরিত্র অন্যরকম। আমার অভিজ্ঞতা আছে। তাই আমরা যদি একটু এগিয়ে গিয়ে বিশ্রাম করি তা হলে মনে হয় ভাল হবে।

মেজর অর্জুনের দিকে তাকালেন। তারপর অত্যন্ত অনিচ্ছা নিয়ে ওঠার চেষ্টা করতেই অর্জুন তার হাত ধরল। সঙ্গে সঙ্গে মেজর বললেন, না না, হাত ধরতে হবে না। আমি একটুও ক্লান্ত নই। লেটস গো।

প্রায় আধঘণ্টা ওরা হাঁটল। জঙ্গল আরও দুর্গম হয়ে উঠছে। উপর থেকে নেমে আসা ঝুরি, বেতের জঙ্গল সরিয়ে হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। এর মধ্যে টিপটিপে বৃষ্টি হয়ে যেতেই অর্জুন একটা বড় পাথরের আড়ালে বিশ্রাম করতে নির্দেশ দিল সবাইকে।

তৎক্ষণাৎ মেজর পা ছড়িয়ে বসে পড়লেন। তারপর কুলদীপের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এই জঙ্গলে কী কী জন্তু আছে?

স্যার, হরিণ, খরগোশ, শেয়াল আর বড় বড় ইঁদুর এখানে প্রচুর আছে।

আঃ। আক্রমণ করতে পারে এমন প্রাণীদের কথা জিজ্ঞাসা করছি।

ও। হাতি, নেকড়ে, বুনো শুয়োর, অনেকরকম সাপ, লেপার্ড দুই একটা–।

রয়েল বেঙ্গল টাইগার?

না স্যর। ওরা সুন্দরবনেই থাকে। নর্থ বেঙ্গলে আসে না, ভুটানে তো নয়ই। গন্ডার নীচে আছে, এই পাহাড়ে ওঠা ওরা পছন্দ করে না। আর আছে। বাইসন। রেগে গেলে ওরা ভয়ানক হয়ে যায়। কুলদীপ জানাল।

মালবাহকদের দু’জন রান্না চাপিয়ে দিয়েছিল। একজন গেল জলের সন্ধানে। কিছুক্ষণ পরে তার চিৎকার কানে আসতেই মেজর ছাড়া সবাই ছুটল সেদিকে। গিয়ে দেখল একটা বিশাল অজগর গাছের ডাল থেকে ঝুলছে। তার মুখের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে কোনও প্রাণীর দুটো পা। বিশাল হাঁ-মুখ বন্ধ হচ্ছে না কারণ যে প্রাণীটিকে গিলতে চেয়েছিল তার শিং গলার কাছে আটকে গিয়েছে। প্রাণীটিকে উগরে দিতে না পেরে মাঝে মাঝে ঝুলন্ত শরীর দোলাচ্ছে অজগর। অর্জুন কিছু বলার আগেই অন্য মালবাহকেরা ধারালো দা দিয়ে অজগরের গলা কাটার চেষ্টা করল। কয়েকবার আঘাত করতেই অজগর প্রচণ্ড আওয়াজ করে গাছ থেকে নীচে আছড়ে পড়ল। পড়ার চাপেই সম্ভবত, তার হাঁ-মুখ বন্ধ হয়ে পেট বিকট ফুলে উঠল। মালবাহকেরা প্রবল। শক্তিতে আঘাত করে যাচ্ছিল। এবার অজগর তার লেজ ঘুরিয়ে নিয়ে এসে। ওদের ধরার চেষ্টা করল। লেজ যেই এগিয়ে আসছিল অমনি মালবাহকেরা দ্রুত নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছিল। প্রায় আধঘণ্টার চেষ্টায় অজগর দ্বিখণ্ডিত হলে মালবাহকরা উল্লসিত হল।

দেখা গেল সাপটা যে হরিণকে গিলেছিল, তার মাথার দুটো শিং চারভাগে ভাগ করা। যদিও শেষ সময়ে সেগুলো ভেঙে গেছে কিন্তু হরিণটাকে মৃত অথচ অক্ষত অবস্থায় বের করে আনা গেল।

মালবাহকেরা কুলদীপকে জানাল ওই হরিণ এবং অজগরের মাংস তারা সানন্দে খেতে পারবে। অর্জুন শুনেছিল সাপের মাংস পৃথিবীর অনেক মানুষ খেয়ে থাকে। যেহেতু অজগরের শরীরে বিষ নেই তাই খেলে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু অজগরের লালায় ভেজা হরিণটির মাংস খাওয়াকে সে সমর্থন করছিল না। কিন্তু কুলদীপ বলল, চামড়া ছাড়িয়ে নিলে ওরা খেতেই পারে। কোনও ভয় নেই।

প্রথমে হরিণটিকে কেটে টুকরো করে নিল মালবাহকেরা। তাদের বোঝা আরও বাড়ল। অজগরটাকে দড়ি বেঁধে নিল যাতে টেনে নিয়ে যাওয়া যায়। আজ জলপাইগুড়ি থেকে যা আনা হয়েছে তাই দিয়ে লাঞ্চ সেরে আবার হাঁটা শুরু হল। মেজর এখন একটু চাঙ্গা হয়েছেন। অজগর দেখে মাথা নেড়ে বললেন, এমন কিছু বড় নয়।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, এর চেয়ে বড় সাপ আপনি দেখেছেন?

অফ কোর্স। দক্ষিণ আমেরিকায়। আনাকোন্ডার নাম শুনেছ?

হ্যাঁ। ওই নামের একটা সিনেমাও দেখেছি।

মোস্ট ফেরোশাস সাপ। আমি প্রাণীহত্যা করা একদম পছন্দ করি না। কিন্তু ব্যাটা এমন করে ল্যাজ দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল যে নিজের প্রাণ বাঁচাতে ঠিক ওর জিভের ভিতর গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছিলাম। মেজর চোখ বন্ধ করলেন। যেন সেই ছবিটাকে দেখতে পেলেন।

আপনি খুব ভাগ্যবান। অর্জুন বলল।

ভাগ্য সবসময় সাহসীদের সঙ্গেই থাকে হে। মেজর বললেন। একটু একটু করে উপরে উঠছিল ওরা। এখন জঙ্গল অত ঘন নয়। কিন্তু মেঘ ঝুলে রয়েছে আকাশে। হঠাৎ বাঁদরদের তীব্র চিৎকার শুরু হয়ে গেল। এই গাছ থেকে ওই গাছে লাফিয়ে যাচ্ছে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে।

মেজর হাত তুলে থামতে বললেন সবাইকে। তারপর নিচু গলায় অর্জুনকে বললেন, সাধারণত বাঘ বা সিংহ এলাকায় ঢুকলে ওরা এইভাবে চিৎকার করে। কিন্তু কুলদীপ বলল, এই জঙ্গলে ওরা নেই। তা হলে?

আপনারা দাঁড়ান, আমি এগিয়ে গিয়ে দেখি। অর্জুন বলল।

তোমার কাছে অস্ত্র আছে?

না। এই লাঠিটাই আমার অস্ত্র। অর্জুন নিঃশব্দে জঙ্গলের আড়ালে চলে গেল। যে জায়গা থেকে চিৎকার ভেসে আসছিল সেখানে পৌঁছে সে অবাক হয়ে গেল। বাঘের মতো বড় চেহারার একটি প্রাণী যার চোখ টকটকে লাল কিন্তু চামড়ার রং কুচকুচে কালো। একটা গাছের নীচের ডালে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই এত চিৎকার তা এখন বুঝতে পারল অর্জুন। অর্জুন গিয়ে দাঁড়ানোমাত্র জন্তুটা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল। সে যে পছন্দ করছে না তা। বোঝানোর জন্য দাঁত দেখাল। অর্জুন লাঠিটাকে শক্ত করে ধরে মাথার উপর তুলতেই জন্তুটা উলটোদিকে লাফ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বাঁদরগুলো শান্ত হয়ে গেল। ওখানে আর দাঁড়াতে ভরসা পেল না অর্জুন। অ্যানিম্যাল ওয়ার্ল্ড চ্যানেলে এই জন্তু সে দেখেছে। এরা থাকে দক্ষিণ আমেরিকায়। কিন্তু ভুটানের পাহাড়ের এদিকে ওদের অস্তিত্বের কথা কারও মুখে শোনা যায়নি। এই কালো বাঘগুলো খুব হিংস্র হয়। অ্যানিম্যাল ওয়ার্ল্ডে তো সেরকমই বলেছে।

ফিরে গিয়ে মেজর এবং কুলদীপকে কালো বাঘের কথা বলল অর্জুন। মেজর মাথা নাড়লেন, ভুল দেখেছ। হয়তো ছায়া পড়েছিল তাই ওটাকে কালো বাঘ বলে মনে হয়েছে তোমার।

কুলদীপও সায় দিল, দাদা, জঙ্গলের বেড়াল খুব বড় হয়। ওখানে হয়তো কালো বেড়াল ছিল।

অর্জুন কথা বাড়াল না কিন্তু তার মন থেকে অস্বস্তি গেল না।

.

মালবাহকেরা এগিয়ে যাচ্ছিল। অজগরকে টানছে দু’জন, পিঠে আঁটা বোঝা নিয়েও। হঠাৎ মেজর লাফিয়ে উঠলেন। তার গলা দিয়ে গোঙানি বের হল।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, কী হল?

লুক। লুক অ্যাট মাই প্যান্ট।

অর্জুন দেখল বেশ বড় বড় লালচে জোঁক মেজরের পায়ে ঝুলছে। সে জিজ্ঞাসা করল, এতক্ষণ টের পাননি? সে নিচু হয়ে একটা কাঠি দিয়ে জোঁক ছাড়াতে চেষ্টা করছিল। কয়েকটা ফুলে ঢোল হয়ে গিয়েছে। তাদের দেখে মেজর বললেন, ভগবানকে ধন্যবাদ, বুঝলে অর্জুন।

মানে? অর্জুন শেষ জোঁকটাকে নামিয়ে উঠে দাঁড়াল।

ব্লাডপ্রেশার এখন নর্মাল হয়ে গেল। এই পদ্ধতিটা বহু আগে চালু ছিল। আফ্রিকার কিছু উপজাতি আজও রক্তচাপ বেড়ে গেলে জোঁক দিয়ে রক্ত বের করে নেয়। মেজর পায়ে হাত বোলালেন।

এবার থেকে সতর্ক হয়ে হাঁটুন। অর্জুন বলল।

দুপুরের একটু পরে অর্জুন দেখল, মালবাহকেরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ওরা এগিয়ে গিয়েছিল খানিকটা, কাছে গিয়ে দাঁড়াবার কারণ জিজ্ঞাসা করল কুলদীপ। একজন মালবাহক নিচু গলায় বলল, সামনে একটা গ্রাম আছে। মানুষের গলা শুনতে পেলাম আমরা।

কুলদীপ অর্জুনকে বললে সে সবাইকে সেখানেই অপেক্ষা করতে বলে। এগিয়ে গেল। জঙ্গল পেরিয়ে ন্যাড়া জমিতে পা রাখতেই সে ছোটখাটো খড়ের ঘর দেখতে পেল। দুটো ঘর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। কয়েকটা অর্ধনগ্ন শিশু একপাশে খেলছিল। খেলা থামিয়ে অবাক চোখে তাকে দেখতে লাগল।

অর্জুন হিন্দিতে তাদের কাছে ডাকতেই ওরা দুদ্দাড় করে পালাল। খড়ের ঘরের ভিতর থেকে কচি গলায় চেঁচামেচি হল এবং তারপরে পিলপিল করে বড়রা বেরিয়ে এসে অর্জুনকে দেখল।

দু’হাত উপরে তুলে অর্জুন হিন্দিতে বলল, আমি তোমাদের বন্ধু। তোমাদের গ্রামে এসেছি।

লোকগুলো নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করল। ওদের দলের যে। প্রধান সে এক পা এগিয়ে যে প্রশ্ন করল তার বিন্দুমাত্র বুঝতে পারল না অর্জুন। তিনবার প্রশ্ন করে উত্তর না পেয়ে লোকটা হাত নেড়ে চলে যেতে বলল। বাধ্য হয়ে অর্জুন পিছন ফিরে চিৎকার করে বলল, কুলদীপ, আপনি একা চলে আসুন। অন্য সবাই ওখানেই থাকুন।

কুলদীপ বেরিয়ে আসতেই লোকগুলো দ্রুত ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ল। চারধার নিঃশব্দ, এমনকী শিশুরাও আওয়াজ করছে না। বিদেশি দেখে ওরা এরকম ভয় পাবে তা আন্দাজ করতে পারেনি অর্জুন। সে কুলদীপকে বলল, ওরা আমার হিন্দি বুঝতে না পেরে চলে যেতে বলছিল। আপনাকে দেখে তো দেখলাম ভয় পেয়ে গেছে। আপনি ভুটানি ভাষায় কথা বলুন, যদি ওরা বুঝতে পারে।

কুলদীপ দুটো হাত মুখের দু’পাশে এনে চেঁচিয়ে যা বলতে লাগল তার বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারল না অর্জুন। প্রথমবারে কোনও প্রতিক্রিয়া হল না। তিনবার কুলদীপ চেঁচিয়ে বলার পরে একজন একজন করে মানুষ বেরিয়ে এল ঘর ছেড়ে। তখন কুলদীপ অনেকটা স্বাভাবিক গলায় কথা বলতে লাগল। অর্জুন দেখল এবার লোকগুলো মাথা নাড়তে লাগল। ওদের মুখ থেকে ভয়ের ভাবটাও কমে আসছিল।

কুলদীপ অর্জুনের দিকে তাকিয়ে বলল, নতুন মানুষদের ওরা চট করে অ্যাকসেপ্ট করে না। আমরা কি অজগর সাপটাকে উপহার হিসাবে ওদের দিতে পারি?

অর্জুন মাথা নাড়ল, নিশ্চয়ই।

কুলদীপ এবার মানুষগুলোকে যা বলল তা শুনে সবাই একসঙ্গে অদ্ভুত আওয়াজ করল। অর্জুনের মনে হল এই আওয়াজটায় বিস্ময় ও আনন্দ মিশে আছে। কুলদীপ আবার পেছনে জঙ্গলের কাছে চলে গিয়ে মেজরের উদ্দেশে বলল, স্যার। ওদের নিয়ে বেরিয়ে আসুন। আর কোনও সমস্যা নেই।

প্রথমে মেজর, পরে মালবাহকেরা খোলা জায়গায় এলে অর্জুন বলল, তোমরা মালপত্র মাটিতে নামিয়ে রাখো। আর সাপটাকে নিয়ে কুলদীপ সাহেবের সঙ্গে ওদের কাছে যাও।

ততক্ষণে বিশাল অজগরটাকে দেখতে পেয়েছে গ্রামবাসীরা। এবার তাদের গলা থেকে উল্লাস ছিটকে উঠল। মালবাহকদের সঙ্গে সাপটাকে বয়ে নিয়ে গেল কুলদীপ। তারপর মালবাহকদের ফিরে যেতে বলল।

ওরা ফিরে গেলে দু’বার মাথা ঝুঁকিয়ে নমস্কার করে সাপটাকে দেখিয়ে সে কিছু কথা বলতেই কয়েকটি যুবক দৌড়ে এসে সাপের শরীর উপরে তোলার চেষ্টা করল। ওজন তাদের পক্ষে বেশি হয়ে গেছে দেখে আরও কয়েকজন এসে হাত লাগাল। এবার হাতে হাতে সাপটা চলে গেল ওদের বসতির এক প্রান্তে। আর তার সঙ্গে চলল বেশিরভাগ মানুষ যাদের মধ্যে মেয়েরাও রয়েছে।

তিনজন মানুষ সেদিকে না গিয়ে কুলদীপের সঙ্গে কথা বলছিল। এরাই বোধহয় এখানকার প্রধান। কুলদীপের কথা শুনে লোকগুলো এবার হাসল। তারপর হাত তুলে আর এক প্রান্তের একটা চালাঘর দেখিয়ে দিল। অর্জুন দেখল ওই ঘরে তিনদিকে দেওয়াল নেই, পেছনের দিকটা ছাড়া। মাথার উপর খড় জাতীয় কিছুর ছাউনি। কুলদীপ দু’বার মাথা নুইয়ে নমস্কার জানিয়ে কাছে ফিরে এসে অর্জুনকে বলল, ওরা আমাদের আজকের রাতের জন্যে এখানে আশ্রয় দিয়েছে। ভালই হল, কী বলেন?

খুব ভাল হল। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। অর্জুন বলল।

ভাগ্যিস সাপটা আত্মহত্যা করেছিল। মেজর গম্ভীর গলায় বললেন।

অর্জুন অবাক হল, তার মানে?

আরে, তুই যখন গিলতে পারবি না, তখন অত বড় শিংওয়ালা হরিণটাকে মুখে পোরা আর আত্মহত্যা করা যে সমান তা বুঝলি না? সাপটাকে বলছি।

অর্জুন এবং কুলদীপ হেসে উঠল। চালাঘরে আশ্রয় নিল ওরা। অর্জুন বলল, আজ আর তাবু খাটাতে হবে না। সন্ধের মধ্যে রান্না শেষ করলে ভাল হয়। আমাদের স্লিপিং ব্যাগগুলো বের করে দিলেই চলবে। কুলদীপ, আপনি ওদের জিজ্ঞাসা করবেন কোথায় জল পাওয়া যায়? দু’জন গিয়ে জল নিয়ে আসুক।

তিনজন শুতে পারে এমন একটা প্লাস্টিকের ভাঁজ করা শিট বের করে একজন মালবাহক পেতে দিল মাটির উপর। তিনটি স্লিপিং ব্যাগ রাখা হল একপাশে। দুটো বালতি নিয়ে দু’জন চলে গেল কুলদীপের সঙ্গে। প্লাস্টিক শিটে বসে পড়ে মেজর বললেন, আগে এই হতচ্ছাড়া জুতো খুলে ফেলা যাক। আঃ, কী আরাম। কিন্তু এই গ্রামের নামই কি টুংচি? ওই স্টিফেন লোকটা কি এই গ্রামেই ছিল?

অর্জুন বসে বলল, মনে হয় না। স্টিফেনকে দেখা থাকলে ওরা আমাদের দেখে অত ভয় পেত না। এখন প্রশ্ন হল, আমরা যেখানে এসেছি সেখান থেকে ওই তিন ঝরনার সঙ্গম কতদূরে? এইরকম পাহাড়ে একবার ভুল পথে গেলে একেবারে গোলকধাঁধায় পড়তে হবে।

যে দু’জন লোক চালাঘরে ছিল তারা নিজেদের মধ্যে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে কথা বলছিল। মেজর সেদিকে তাকালেন, কী হয়েছে তোমাদের?

সাহেব একটা কথা বলি। একজন এগিয়ে এল, আমরা সাপটাকে মারলাম, এতদুরে বয়ে নিয়ে এলাম কষ্ট করে আর আপনারা ওটাকে ওই লোকগুলোকে দিয়ে দিলেন। অজগরের মাংস খেলে আয়ু বেড়ে যায়। আর দেওয়ার আগে আমাদের একবারও জিজ্ঞাসা করলেন না?

অর্জুন মাথা নাড়ল, সত্যি কথা। তোমাদের জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল। কিন্তু আমাদের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে তখনই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। ওদের সাপটাকে না দিলে আমাদের শেষ করে দিত ওরা। যতই অজগরের মাংস খাও কোনও লাভ হত না। মন খারাপ কোরো না। জঙ্গলে যখন এসেছি তখন আবার আমরা অজগর পাব, তখন তার মাংস খেয়ে আয়ু বাড়িয়ে নিয়ো।

লোকদুটো মাথা নেড়ে মেনে নিচ্ছে দেখে মেজর বললেন, তা ছাড়া তোমরা যে একেবারেই অজগরের কিছু খেতে পাবে না তা তো নয়।

লোকদুটো অবাক। একজন বলল, আমরা কী করে খাব। খাবে তো ওরা।

শোনো, অজগরটা হরিণকে গিলেছিল। তাই হরিণের শরীরের ভিতরে অজগরের লালা, পেটের রস ঢুকে গিয়েছে। সেই হরিণের মাংস তোমরা নিয়ে এসেছ। ওই মাংস যখন তোমরা খাবে তখন অজগরের কিছুটাও তোমাদের পেটে যাবে। মেজর সুন্দর করে বুঝিয়ে বললেন।

এবার লোকগুলোর মুখে হাসি ফুটল। একজন বলল, আজ আমরা হরিণের মাংস রান্না করব। মাংস আর ভাত।

অর্জুন মেজরকে জিজ্ঞাসা করল, আপনি হরিণের মাংস খাবেন তো?

আমি রাতে ননভেজ খাই না। অমল সোমের বাড়িতে হাবু তাই নিরামিষ রান্না করে দিত। সত্যি কথা বলতে কী, যা খাওয়ার তা সন্ধে হওয়ার আগেই খেয়ে নিতে হয়। আমি কিছু মনে করব না ওরা যদি নিরামিষ রান্না করে দেয়। বেশ উদাস গলায় বললেন মেজর।

.

রাত নামল। অর্জুন লক্ষ করল, এখানে ঘরে ঘরে আলো জ্বালার রীতি নেই। সেটা অবশ্যই অভাবের কারণে। যেদিকটায় ওরা সাপটাকে নিয়ে গিয়েছিল, সেইদিকে খোলা আকাশের নীচে শুকনো কাঠে আগুন জ্বেলেছে ওরা। গ্রামের সব মানুষই জড়ো হয়েছে সেখানে। মাংস-পোড়া গন্ধ বাতাসে পাক খাচ্ছে।

চালাঘরে মালবাহকরা হারিকেন জ্বেলে রান্না চাপিয়েছিল। কুলদীপ বলল, এখান থেকে দশ মিনিট হাঁটলে যে ঝরনা আছে সেটা গিয়ে নিশ্চয়ই আরও দুটোর সঙ্গে মেশেনি। কারণ এই ঝরনাটা বয়ে যাচ্ছে নীচের দিকে আর জলও খুব কম।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, চওড়ায় কতটা?

বড়জোর দশ-বারো ফুট।

অর্জুন একটু ভাবল। এমন হতে পারে, তিন ঝরনার মিলিত ধারা থেকে একটা শাখা বেরিয়ে এসেছে এদিকে। তারপরেই খেয়াল হল তার। ওই ম্যাপ যখন তৈরি হয়েছিল, তখন নিশ্চয়ই তিনটে ঝরনা একত্রিত ছিল। কিন্তু তারপরে এতগুলো বছর গিয়েছে, ওরা যে সেই একই অবস্থায় থেকে যাবে তার তো কোনও নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু কুলদীপ যখন বলছে যেখান থেকে ওরা জল নিয়ে এসেছে সেটা নীচের দিকে বয়ে গেছে তা হলে ওটাকে অনুসরণ করে উপরে উঠে গেলে হয়তো কোনও তথ্য পাওয়া যেতে পারে।

অর্জুন সামনে তাকাল। দূরের আগুনে মানুষগুলোকে অস্পষ্ট দেখাচ্ছে। ওরা স্রেফ পুড়িয়ে নিয়ে সাপটাকে খাচ্ছে। এইসময় ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল। বেশ শীত শীত করছিল অর্জুনের। ইতিমধ্যে মেজর স্লিপিং ব্যাগের ভিতর পা ঢুকিয়ে নিয়েছেন। অর্জুন বুঝল ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সেখানকার আবহাওয়া আরও শীতল হবে।

এইসময় অন্ধকার কুঁড়ে দুটো লোক চালাঘরের কাছে চলে এল। একজন ভুটানি ভাষায় কিছু বলে কুলদীপের সামনে পাতার পুটলি রাখল। কুলদীপ বেশ খুশি খুশি গলায় জবাব দিলে লোকদুটো হেসে ফিরে যাচ্ছিল যখন তখন

অর্জুন বলল, ওদের জিজ্ঞাসা করুন তো এই গ্রামের নাম কী?

কুলদীপ ভুটানি ভাষায় প্রশ্ন করতেই একজন উত্তর দিল, সুংচি। লোকদুটো চলে গেলে কুলদীপ বলল, স্টিফেন সাহেব গিয়েছিলেন টুংচি গ্রামে। আমরা এসেছি সুংচিতে। নামের মিল আছে। তাই মনে হচ্ছে ওই টুংচি গ্রাম এখান থেকে খুব বেশি দূরে হবে না। কিন্তু ওরা ভালবেসে অজগরের মাংস দিয়ে গেল। বলল রান্না করে নুন মাখিয়ে দিয়েছে। আপনি নিশ্চয়ই টেস্ট করবেন না। স্যার কি করবেন?

অর্জুন মাথা নাড়ল, উনি রাতে নিরামিষ খান। ওদের জিজ্ঞাসা করুন। কুলদীপ মালবাহকদের বলল, ওরা অজগরের মাংস দিয়ে গিয়েছে। যদি কেউ খেতে চাও তা হলে খেতে পারো।

যে লোকটা অর্জুনের কাছে অভিযোগ করেছিল, সে প্রায় লাফিয়ে এসে পাতার পুঁটলি তুলে নিল। পাতার আড়াল সরিয়ে পোড়া মাংস নাকের কাছে তুলতেই সে অদ্ভুত শব্দ করে পুরোটা মাটিতে রেখে দিয়ে চালাঘরের বাইরে গিয়ে ওয়াক ওয়াক করতে লাগল। ওর সঙ্গীরা খুব হাসছিল অবস্থা দেখে। কোনওমতে নিজেকে সামলে ফিরে এসে জল খেয়ে ধাতস্থ হয়ে লোকটা বেশ জোরে জোরে বলল, কী দুর্গন্ধ। আমার পেটের মধ্যে ঢুকে গেছে। এই ব্যাটারা রাঁধতে জানে না, কিন্তু ওগুলো খাচ্ছে কী করে তা ভগবান জানেন।

কুলদীপ জিজ্ঞাসা করল, বাকিরা কি টেস্ট করবে?

না। একসঙ্গে শব্দটা উচ্চারিত হল।

তা হলে দয়া করে পিছনের মাটিতে গর্ত করে ওটাকে পুঁতে ফেলো। ওরা যেন পরে জানতে না পারে যে আমরা মাংস খাইনি। কুলদীপ বলল।

.

রাত ন’টাতেই মনে হচ্ছিল কোনও আদিম পৃথিবীতে চলে গিয়েছে ওরা। মাঠের শেষে যে আগুন গ্রামের মানুষ জ্বেলেছিল, তা ছাই হয়ে গিয়েছে। আকাশে মেঘ থাকায় আজ চাঁদের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে চারদিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। ঘরে ঘরে মানুষগুলো নিঃশব্দে ঘুমোচ্ছে। একমাত্র মেজর নাক ডেকে চলেছেন স্লিপিং ব্যাগের ভিতর শুয়ে। মালবাহকরা কম্বল মুড়ে ঘুমের অতলে। হারিকেন নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভাত, ডাল আর আলুর তরকারিতে পেট ভরিয়ে কুলদীপও এখন ঘুমাচ্ছে। এই ছেলেটা সঙ্গী হিসাবে খুব ভাল। ট্রাকের তলা থেকে বের করার সময় ওকে যেরকম নার্ভাস দেখেছিল অর্জুন, এখন তার সম্পূর্ণ বিপরীত।

অর্জুনের ঘুম আসছিল না। তিন ঝরনার সঙ্গমে না যাওয়া পর্যন্ত সব কিছু অনিশ্চিত থেকে যাচ্ছে। তারপর তো ম্যাপ ধরে এগিয়ে যাওয়া। ওরা ঠিক পথে এগোচ্ছে তো? কুলদীপকে বলতে হবে কাল সকালে গ্রামের লোকদের জিজ্ঞাসা করতে। ওদের কেউ না কেউ নিশ্চয়ই সঙ্গমস্থলের কথা জানে।

জঙ্গল থেকে মাঝে মাঝেই অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসছে। অচেনা শব্দ। একটা রাতপাখি কর্কশ গলায় ডাক শুরু করল। এখানে সম্ভবত হাতিরা হানা দেয় না। দিলে গ্রামের ঘরগুলো আস্ত থাকত না। স্লিপিং ব্যাগে আশি ভাগ শরীর ডুবিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অন্ধকার একসময় যেন পাতলা হয়ে আসছিল। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন শব্দ ভেসে আসছে যে চমকে চমকে উঠছিল অর্জুন।

অর্জুনের মনে হল এইভাবে সবাই মিলে ঘুমিয়ে পড়া ঠিক হবে না। একটা ব্যাপারে সে অবাক হয়েছিল। মালবাহকরা যখন হরিণের মাংস রাঁধছিল, তখন তার গন্ধ বাতাসে ছড়িয়েছিল। মেজর পর্যন্ত বলেছিলেন, বেড়ে গন্ধ ছাড়ছে হে।

অর্জুন হেসে জিজ্ঞাসা করেছিল, একটু টেস্ট করবেন নাকি?

নাঃ। আমি এক কথার মানুষ। বলে মেজর উলটোদিকে মুখ করে শুয়েছিলেন। কিন্তু অর্জুন অবাক হয়েছিল, কারণ এই গন্ধ নিশ্চয়ই গ্রামবাসীরাও পেয়েছিল। কিন্তু তারা একটুও কৌতূহল দেখায়নি। এটা স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। মালবাহকেরা যেসব জিনিস বয়ে নিয়ে এসেছে তা ওরা কখনও চোখে দেখেনি। পাহাড়ি গ্রামের মানুষ সাধারণত সৎ হয়ে থাকে কিন্তু ব্যতিক্রম থাকবে না এটা বলা যায় না। ভোরে যদি দেখা যায় অনেক কিছু উধাও হয়ে গেছে তা হলে কিছুই করার থাকবে না। চুরির অভিযোগ করলে এদের সঙ্গে ঝামেলা বাধবে। তার চেয়ে সতর্ক থাকাই উচিত। তা ছাড়া এরকম খোলা চালাঘরে, যার পিছনে গভীর জঙ্গল, সবাই ঘুমিয়ে থাকাও তো নিরাপদ নয়। অর্জুন কুলদীপের ঘুম ভাঙাল। বলল, সবাই ঘুমিয়ে পড়লে সমস্যা হতে পারে। আমাদের উচিত রাত জেগে পাহারায় থাকা। এখন থেকে রাত দেড়টা আবার দেড়টা থেকে ভোর, আপনি কখন জাগতে পারবেন?

জেগে থাকার দরকার আছে কি? কুলদীপের গলায় ঘুম।

নিশ্চয়ই আছে। মেজরের বয়স হয়েছে তাই ওঁকে ডিস্টার্ব করছি না।

তা হলে আমাকে দেড়টার সময় ডেকে দেবেন। কুলদীপ পাশ ফিরল।

এখন বাইরে বেশ শীত। চালাঘরের ভিতরেও শীতের দাঁত বোঝা যাচ্ছে। যদিও স্লিপিং ব্যাগের ভিতরে ঢোকানো শরীর সেটা টের পাচ্ছে না। খাওয়া দাওয়ার পর ফুলহাতা সোয়েটার বের করে রেখেছিল অর্জুন, এখন সেটা পরে নিল।

টিপটিপিয়ে বৃষ্টি পড়ামাত্র ঠান্ডা আরও বেড়ে গেল। চেয়ে থাকতে থাকতে ঝিমুনিও আসছিল। ওঃ, এইসময় একটা সিগারেট ধরালে কী ভাল হত। মাঝেমধ্যে যে সে ধূমপান করে না তা নয়, কিন্তু সেটা অত্যন্ত অনিয়মিত। আর মেজর সঙ্গে থাকবেন জেনে সিগারেট সঙ্গে আনেনি অর্জুন। আশ্চর্য ব্যাপার, মেজর এবার একদম ধূমপান করছেন না।

হঠাৎ জঙ্গলে শব্দ শুরু হয়ে গেল। ওরা যে পথে এই গ্রামে এসেছিল সেদিকের জঙ্গলে। যেন কেউ বা কারা গাছের ডাল নির্মমভাবে ভেঙে চলেছে। কান খাড়া করে অর্জুন বুঝল ওটা হাতিদের কাজ নয়।

আওয়াজটা এগিয়ে এলে হঠাৎই গ্রামটা জেগে উঠল। ঘরে ঘরে মানুষগুলো চিৎকার শুরু করে দিল। তারপর অন্ধকারেই তারা বাইরে বেরিয়ে এসে যে যেমন পারে শব্দ করতে লাগল। একটা ফেঁসে যাওয়া ঢাকের আওয়াজও শোনা গেল। এই সম্মিলিত চিৎকারে চালাঘরের সবার ঘুম ভেঙে গেল। মেজর বিরক্ত হয়ে বললেন, হোয়াট ননসেন্স। এ ব্যাটাদের কী হল?

অর্জুন চাপা স্বরে বলল, কোনও বন্য জন্তু গাছ ভেঙে এগিয়ে এসেছে গ্রামের দিকে। আস্তে কথা বলুন।

মেজর এবার সোজা হয়ে বসলেন, কী জন্তু?

বোঝা যাচ্ছে না। তবে হাতি বলে মনে হচ্ছে না। আর জন্তুটা বোধহয় প্রায়ই হামলা করতে এখানে আসে। অর্জুন বলল।

সেটা কী করে বুঝলে? মেজরের গলার স্বর খাদে।

গ্রামের লোক যেভাবে চেঁচিয়ে উঠে বাইরে বেরিয়ে এসে শব্দ করছে, তা দেখে মনে হচ্ছে এই কাজটা এরা আগেও করেছে, আজ নতুন নয়। বলতে বলতে অর্জুন শুনল গাছ ভাঙার আওয়াজ কমে যাচ্ছে আর মানুষগুলো যেন সাহস পেয়ে আরও একটু এগিয়ে গেল। তারপর জয়ের উল্লাস শোনা গেল তাদের গলায়। যাদের আগমনে ওরা ভয় পেয়েছিল, তারা পালিয়েছে।

মেজর বললেন, যাই বলো, ওরা হাতিদেরই তাড়াল। তিনি আবার স্লিপিং ব্যাগের ভিতরে ঢুকে গেলেন।

.

রোদ ওঠার আগেই আকাশ আঁধারমুক্ত হয়। ওরা উঠে পড়ল। চা খেয়ে রওনা হবে। কুলদীপ গেল গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে। যদি ঝরনার সঙ্গম কোথায় তা জানা যায়।

মেজর জিজ্ঞাসা করলেন, অর্জুন তুমি নিশ্চয়ই ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করো না?

সাতসকাল হওয়ার আগেই এমন প্রশ্নে হেসে ফেলল অর্জুন, একবার তাদের না দেখলে মনে কী করে বিশ্বাস জন্মাবে বলুন?

হুম। চা খেয়ে আমি আজ পাইপ ধরাব। মেজর বললেন।

আপনাকে তো এবার ধূমপান করতে দেখিনি।

আমরা যা দেখি না সেটাই শেষ কথা নয়। এই পাহাড়-জঙ্গলের আমি আর শহরের আমি কি এক মানুষ? নো, নেভার। একটু চুপ করে থেকে বললেন, ধরা যাক, ওই ম্যাপ ফলো করে শেষপর্যন্ত আমরা গুহাটার মুখে পৌঁছোলাম। স্টিফেন লিখে গিয়েছে ওই গুহা পাহারা দেয় যেসব প্রেতাত্মারা তারা কোনও বিধর্মীকে ভিতরে ঢুকতে দেবে না। ধরে নিচ্ছি ভুটানিরা বৌদ্ধ। তা হলে তুমি বা আমি বিধর্মী। কিন্তু বৌদ্ধরা তো খুব শান্ত প্রকৃতির মানুষ। বুদ্ধ তো শান্তির উপাসক। মরে যাওয়ার পর সেই ধর্মাবলম্বীরা কেন অন্য ধর্মের মানুষদের উপর ক্ষিপ্ত হবে। তা ছাড়া আমার কী ধর্ম তা তারা জানবে কী করে? আমি তো বুদ্ধের অনেক বাণী, অনেক বৌদ্ধস্তোত্র জানি। ইন্টারেস্টিং।

আপনি ধরে নিচ্ছেন ওই গুহায় প্রেতাত্মা বাস করছে।

আমরা তো গিয়ে দেখিনি। মেজর বললেন।

অর্জুন বুঝতে পারল কেন মেজর তাকে পাইপ খাওয়ার ব্যাপারে বললেন, আমরা যা দেখিনি সেটাই শেষ কথা নয়। অর্জুন মাথা নাড়ল। মনে মনে বলল, দুটো এক ব্যাপার নয়। তুলনাটা জমল না।

কুলদীপ ফিরে এল উত্তেজিত হয়ে। চায়ের মগ তুলে নিয়ে বলল, ওরা যা বলল, তাতে মনে হচ্ছে আমাদের উত্তরদিকের পাহাড় ধরে উঠতে হবে। সূর্য যখন মাথার উপর আসবে তখন যে ঝরনাটার দেখা পাব তাকে অনুসরণ করলেই তিন ঝরনার মিলনস্থলে পৌঁছোনোনা যাবে। যে লোকদুটো এই কথা বলল তারা গিয়েছিল বহুদিন আগে। ওরা তিনজন ছিল। একজনকে সাপ গিলে নেয় বলে বাকিরা পালিয়ে এসেছে। আর যায়নি। চায়ে চুমুক দিল কুলদীপ।

অর্জুন খুশি হল, যাক। একটা হদিশ পাওয়া গেল।

মেজর জিজ্ঞাসা করলেন, আমার ধারণা ওরা কনফার্ম করেছে?

না স্যর। মাথা নাড়ল কুলদীপ। কাল রাতে হাতি আসেনি।

তা হলে? মেজর চোখ ছোট করলেন।

ওরা নাম বলতে পারল না। বলল, মানুষের মতো লম্বা ভয়ংকর জন্তু। কালো লোমশ শরীর। দু’বার এই গ্রামে হানা দিয়েছে ওদের দু’জন। ওদের কথা গ্রামের মানুষ আগে কখনও শোনেনি। জঙ্গল ভাঙতে ভাঙতে আসে। প্রথম দু’বারে ওরা ভেবেছিল নীচের হাতির দল এসেছে। প্রথম দু’বারে কৌতূহলী হয়ে দেখতে যাওয়ায় কয়েকজনের মধ্যে থেকে দু’জনকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ওরা। আর তাদের খোঁজ পাওয়া যায়নি। তারপর থেকে গাছ ভাঙার শব্দ পেলেই ওরা সবাই মিলে চিৎকার করে। যে যেমন পারে শব্দ করে। তাতে দেখা গেছে জন্তু দুটো এদিকে আসতে সাহস না পেয়ে পালিয়ে যায়। দিনের বেলায় কখনওই ওদের দেখা যায়নি। রাতের অন্ধকারে খাবারের অভাব হলেই এদিকে চলে আসে।

চুপচাপ না এসে গাছের ডাল ভাঙে কেন ওরা? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল। কুলদীপ মাথা নাড়ল, তার কারণ গ্রামবাসীরা জানে না।

মেজর দুশ্চিন্তায় পড়লেন। সবাই যখন যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে তখনও তিনি চিন্তামগ্ন। তারপর পাইপ বের করে পাউচ থেকে তামাক বের করে আগুন জ্বালিয়ে দু’বার ধোঁয়া ছেড়েই চেঁচিয়ে বললেন, মনে পড়েছে, মনে পড়েছে।

কী মনে পড়ল আপনার? অর্জুন উত্তেজনার কারণ বুঝতে পারল না।

বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া পড়তেই মেমরি পরিষ্কার হয়ে গেল। ইন দ্য ইয়ার নাইনটিন এইট্রি এইটে বিখ্যাত অভিযাত্রী মাইকেল নর্টনের নেতৃত্বে আমরা নায়রোবি থেকে মাসাইমারা হয়ে যখন একটা পাহাড়ি গ্রামে পৌঁছেছিলাম, তখন দেখেছিলাম বিকেল হতেই সব ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ। শুধু গ্রামের দু’পাশে অনেক উঁচু মাচার উপর ঝোলানো দুটো বিশাল ঘণ্টা বেজে চলেছে। চারজন লোক পালা করে দড়ি টেনে ঘণ্টা বাজাচ্ছে। আমি ওদের ভাষা একটু জানতাম বলে নর্টন সাহেব আমাকেই পাঠালেন ব্যাপারটা কী জানতে। ওই। উঁচু মাচায় বসে থাকা লোকদের মুখে আমি এইরকম জন্তুর কথা শুনেছিলাম। কালো লোমশ শরীর। গরিলা নয় কিন্তু তাদের মতো ঝুঁকে হাঁটে। মানুষের মাংস খেতে ওদের খুব ভাল লাগে। ওরা শুধু শব্দ শুনলে ভয় পায়। নইলে দশটা মানুষ ওদের একটার সঙ্গে পেরে উঠবে না। হা হা হা। কোথায় আফ্রিকা আর কোথায় ভুটান। বুঝলে অর্জুন, পৃথিবীটা বড় ছোট জায়গা। মেজর আবার ধোঁয়া ছাড়লেন।

কুলদীপ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, আপনি আফ্রিকায় অভিযানে গিয়েছিলেন?

দু’সেকেন্ড কুলদীপের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মেজর বললেন, আমি প্রথমবার অভিযানে যাই আলাস্কায়। কুকুরে টানা স্লেজ গাড়িতে বসে টানা তিনদিন। ওঃ, কী ভয়ংকর ঠান্ডা সেখানে। শক্ত বরফ খুঁড়ে গর্ত করতেই দু’হাত ভিজে জল। মাইনাস পঞ্চাশ হবে সেই জলের তাপ। মোটা সুতোয় বঁড়শি বেঁধে তাতে টুনা মাছের টোপে দশ মিনিটের মধ্যে যে বড় মাছটাকে টেনে উপরে তুলেছিলাম তা আমাদের তিনদিনের খাবারের অভাব মিটিয়েছিল। লেটস গো।

অর্জুন লক্ষ করল তারা গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে দেখেও কেউ এদিকে এগিয়ে এল না। অর্থাৎ বিদায় জানাবার সৌজন্য জানানো এদের জানা নেই। কিন্তু যখন ঘরগুলোর পিছন দিক দিয়ে ওরা পাহাড়ে উঠছে তখন মহিলা কণ্ঠের সম্মিলিত কান্না শোনা গেল। মহিলারা খুব আন্তরিকভাবে চেঁচিয়ে কাঁদছেন। অর্জুন দাঁড়িয়ে কুলদীপের দিকে তাকাল। নিশ্চয়ই এইমাত্র ওদের কেউ মারা গিয়েছে। তার জন্যে ব্যস্ত ছিল বলে ওরা আমাদের বিদায় জানাতে আসেনি। ওরা আমাদের রাতে থাকতে দিয়েছিল তাই আমাদের উচিত ওদের সমবেদনা জানানো।

কুলদীপ মাথা নেড়ে চলে গেল নীচে। মহিলাদের কান্না থেমে গেল একটু পরে। মেজর দার্শনিকের গলায় বললেন, জন্মালেই মরতে হবে ভাই। জন্মমাত্রই জার্নি টুওয়ার্ডস ডেথ শুরু হয়ে যায়।

কুলদীপ ফিরে এল হাসতে হাসতে বলল, দারুণ খবর।

মেজর বললেন, কারও কান্নার মধ্যে দারুণ খবর কী করে থাকে জানি না।

স্যার। ওই মহিলারা আমাদের কথা ভেবে কাঁদছেন। কুলদীপ হাসল।

আমাদের কথা ভেবে কেন কান্না আসছে? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

ওদের ধারণা আমরা আর ফিরে আসব না। ওদের একজন সঙ্গমের কাছাকাছি গিয়েই মারা গিয়েছিল। সঙ্গমে পৌঁছোলে বাকি দুজনই মারা যেত। আর যেহেতু আমাদের মরণ সেখানে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাই আমাদের ফিরে আসা অসম্ভব। সেই শোকে কাঁদছেন এঁরা কারণ মরার পর তো সেখানে কেউ ভাল করে কান্নার জন্যে থাকবে না। চলুন। কুলদীপ চলা শুরু করল।

কিছুক্ষণ বাদে জঙ্গল কমে গেল। ন্যাড়া পাহাড়ে ওঠার সময় গতি কমে গেল ওদের। অর্জুন দলটার আগে যাচ্ছিল। কিছুটা যাওয়ার পর মেজর কম্পাসে চোখ রেখে বললেন, উত্তরে যেতে হলে আমাদের ডানদিকের পাহাড় পেরোতে হবে।

অর্জুন তাকিয়ে দেখল, ডানদিকে একেবারে খাড়া পাহাড়। এত মালপত্র নিয়ে ওই পাহাড়ে ওঠা সম্ভব নয়। সে এগিয়ে গেল দলটাকে ওইখানে অপেক্ষা করতে বলে। হঠাৎ কোত্থেকে একদল হনুমান লাফিয়ে নামল সামনে। মুখ বিকৃত করে ভয় দেখাতে লাগল অর্জুনকে। অর্জুন লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে যেতেই ওরা দুদ্দাড় করে পাহাড়ের ভিতরে ঢুকে গেল। যেন আচমকা মিলিয়ে গেল হনুমানগুলো।

অর্জুন একটু ভাবল। চোখের সামনে থেকে এভাবে উধাও হয়ে যাওয়া শুধু ম্যাজিকেই সম্ভব। সে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল যেখান থেকে খাড়া উঠে গেছে পাহাড়। একটু খোঁজাখুঁজি করতেই তার চোখে পড়ল ফাটলটা। ফাটলের মুখ ছোট, দুটো মানুষ ঢুকতেই পারে। কিন্তু তার ভেতরটা বড় এবং অন্ধকার হলেও দূরে যেন সেটা ঘোলাটে দেখাচ্ছে।

সবাইকে ডেকে নিয়ে এসে ফাটলটা দেখাল অর্জুন। হনুমানগুলো এই পথ দিয়েই চোখের আড়ালে চলে গেছে। নিশ্চয়ই এই গুহার অন্য প্রান্তে গেলে সূর্য। দেখা যাবে। ব্যাপারটা সে বুঝিয়ে বলতেই মেজর মাথা নাড়লেন, আমাদের সঙ্গে তো মাস্ক নেই।

কেন? মাস্কের কী দরকার?

হনুমানগুলো ভিতরে আছে। ওরা যখন মুখের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে তখন আমাদের কী দুরবস্থা হবে ভেবে দেখো। না না, তার চেয়ে অন্য কোনও পথ আছে কি না খুঁজে দেখা যাক। মেজর বললেন।

অর্জুন চারপাশে তাকাল। বলল, চেয়ে দেখুন। আমাদের উত্তর দিকে যেতে হলে হয় ওই উঁচু পাহাড় ডিঙোতে হবে নয়তো বেশ কয়েক মাইল হেঁটে পাহাড়টাকে ঘুরে ওপাশে যাওয়ার রাস্তা খুঁজতে হবে। আমাদের কারও রক ক্লাইম্বিং ট্রেনিং নেওয়া নেই।

আমার আছে। ইন দ্য ইয়ার নাইনটিন এইট্টি ফোরে আমি আল্পসে গিয়ে তিনমাসের কোর্স করেছিলাম। মেজর বললেন।

আঠাশ বছর আগে আপনার শরীর যেরকম ছিল এখন কি সেরকম আছে?

তখন ওজন ষাট কেজি ছিল।

এখন অন্তত একশো দশ।

বাড়িয়ে বলছ। জাস্ট একশো।

ঠিক আছে। কিন্তু মালবাহকরা কী করে ওজন নিয়ে খাড়া পাহাড়ে উঠবে। অর্জুন বলল, কুলদীপ, এই সুড়ঙ্গের মুখটাকে বড় করে দিলে ভিতরে ঢুকে দেখা যেতে পারে ওটা কোথায় শেষ হয়েছে। পাহাড় ঘুরে যদি যেতে হয় তা এটা দেখার পর যাব।

কুলদীপের সঙ্গে মালবাহকেরা হাত লাগাল। ওরা কিছুক্ষণ চেষ্টার পর মুখটা বড় হল। ভিতরে পা দেওয়ামাত্র অর্জুনের কানে হনুমানদের চিৎকার ভেসে এল। এই সুড়ঙ্গে অর্জুনদের ঢোকা পছন্দ করছে না। মেজর বললেন, অর্জুন, তুমি আর আমি আগে রেকি করে আসি তারপর বাকিরা যাবে কি না ঠিক হবে।

কুলদীপ মাথা নাড়ল, আমি ওদের সঙ্গে এখানে থাকছি। দরকার হলে মোবাইলে যোগাযোগ করবেন।

অর্জুন মোবাইল বের করে দেখল ওটা অকেজো হয়ে গেছে। সে জিজ্ঞাসা করল, আপনার মোবাইল কি চালু আছে?

নিজের মোবাইল দেখে হতাশ হল কুলদীপ। নাঃ টাওয়ার নেই। এই ভুটানের ভিতর ইন্ডিয়ান সিমকার্ড বোধহয় অচল। অথচ আমাদের ওখানে সামচিতে এরকম হয় না। ঠিক আছে, গুড লাক।

পিঠের ব্যাগ থেকে টর্চ বের করে এগোল অর্জুন, সঙ্গে মেজর। গুহার নীচের দিকটা স্যাঁতস্যাতো বোঝা যাচ্ছে মাঝে মাঝে জল গুহায় পড়ে এখান দিয়ে। বড়জোর হাত দুয়েক চওড়া কিন্তু ক্রমশ নিচু হতে হচ্ছিল উচ্চতা কমে যাওয়ায়। যত ওরা এগোচ্ছিল তত হনুমানরা জোরে চেঁচাচ্ছিল, হঠাৎ তারা চুপচাপ হয়ে গেল। টর্চের আলোয় তাদের দেখতে পাচ্ছিল না অর্জুন। প্রায় পনেরো মিনিট মাথা নিচু করে হাঁটার পর অর্জুন দাঁড়িয়ে গেল। তার টর্চের আলোয় সাপটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কুচকুচে কালো সাপটা ফণা তুলে দাঁড়িয়ে বারংবার জিভ বের করছে তাদের দিকে তাকিয়ে। অর্জুন লক্ষ করল সাপটা যেখানে খাড়া হয়েছে সেখানে আরও অনেকগুলো বাচ্চা কিলবিল করছে।

অর্জুন চাপা গলায় বলল, কী করা যায়? এগোনো উচিত হবে না। এইরকম প্রায় মাজা-ভাঙা অবস্থায় ওটাকে মারাও যাবে না।

মেজর বললেন, লাঠিটা আমাকে দাও।

অর্জুনের হাত থেকে লম্বা লাঠিটা নিয়ে মেজর তার পাইপটা লাঠির ডগায় রুমাল দিয়ে শক্ত করে বাঁধলেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন, ওর মুখে টর্চের আলোটা রাখো, সরাবে না।

মেজর মাথা নিচু করে কয়েক পা এগিয়ে গেলেন লাঠি উঁচিয়ে ধরে। নাগালের মধ্যে পেয়ে সাপটা তীব্র গতিতে ছোবল মারল লাঠির ডগায়। তার মুখ থেকে ফোঁস ফোঁস শব্দ ঘনঘন বের হচ্ছিল। মেজর আর এক পা। এগোলেন। সাপটা পিছনের দিকে হেলে গিয়ে ছোবল মারতে উদ্যত হতেই মেজর লাঠি ও পাইপের মাঝখান দিয়ে ওর গলায় চেপে ধরতেই সাপটা দ্রুত মেঝের উপর মাথা নামাল। মেজর ততক্ষণে লাঠি ও পাইপের ত্রিকোণে চেপে ধরলেন সাপের মাথাটা মেঝের উপর। তারপর দ্রুত নিচু হয়ে সাপের মাথার নীচটা মুঠোতে ধরে উপরে তুললেন।

অর্জুন বলল, দারুণ। দারুণ কাজ করলেন আপনি।

সাপটাকে মুঠোয় ধরতেই সেটা লেজ দিয়ে মেজরকে জড়াতে চাইছিল। মেজর বললেন, এখন এটাকে নিয়ে কী করবে? নীচেরগুলোকে একেবারে নিরীহ ভেবো না।

ওটাকে নিয়ে ফিরে যাই চলুন।

ফিরে যাব।

ওটাকে বাইরে ছেড়ে দিয়ে অন্যদের নিয়ে আসা যাক।

.

সাপ দেখে কুলদীপ চোখ বড় করল। মালবাহকেরা উল্লসিত। কিন্তু মেজর তাদের হতাশ করে সাপটাকে দূরের খাদে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। বললেন, ওর তো কোনও দোষ নেই। মিছিমিছি মেরে ফেলে কী হবে?

কুলদীপ বলল, আপনি কী করে ওই বিষাক্ত সাপটাকে ধরলেন স্যার?

মেজর কাধ নাচালেন, এ আর কী। র‍্যাটল স্নেক ধরেছিলাম মরুভূমিতে গিয়ে। ভয়ংকর র‍্যাটল স্নেক।

অর্জুন এবার মালবাহকদের বুঝিয়ে দিল সুড়ঙ্গে কীভাবে চলতে হবে। মালপত্র মাথায় বা পিঠে নিয়ে যাওয়া চলবে না। দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যেতে হবে। অর্জুনের কথায় কয়েকটা মশাল জ্বালিয়ে নেওয়া হল। মেজরের পরামর্শে মশালগুলো নিয়ে আসা হয়েছিল। অনেকটা সময় ধরে মালপত্রগুলো নিয়ে পর পর ওরা সেইখানে উপস্থিত হল যেখানে সাপটা উঠে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, বাচ্চাগুলো আর নীচে পড়ে নেই। অর্জুন টর্চের আলো চারপাশে বুলিয়ে হঠাৎ উপরের একটা খাঁজের উপর ফেলতেই অবাক হল। কয়েকটা সাপ সেখানে ঝুলছিল। তারপরে লোমশ হাতগুলো বেরিয়ে এসে ওদের চোখের আড়ালে নিয়ে গেল।

অর্জুন মেজরকে জিজ্ঞাসা করল, হনুমান সাপের মাংস খায়?

এ দেশের হনুমান খায় কি না জানি না, আফ্রিকার বেবুনরা মাংস খেতে পছন্দ করে। হনুমান তত বেবুনের তুতো ভাই। মেজর বললেন।

আরও খানিকটা সুড়ঙ্গের ভিতর ঘুরে ঘুরে একসময় দেখা গেল আর এগোনো যাবে না। সুড়ঙ্গ শেষ হয়ে গেছে পাহাড়ের মধ্যে। মেজর বললেন, মাই গড!

অর্জুন কান পাতল পাহাড়ের দেওয়ালে। অনেকক্ষণ কান চেপে থাকার পর সে বলল, একটা আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। কীসের আওয়াজ জানি না। কিন্তু শব্দ যখন শোনা যাচ্ছে তখন মনে হচ্ছে সামনের পাহাড় বেশি চওড়া নয়।

এবার কুলদীপ কান রাখল। তারপর সে মালবাহকদের ডাকল। সবই মিলে হাত লাগিয়ে খুঁড়তে হবে পাহাড়ের দেওয়াল। তারও বিশ্বাস, এটা মোটেই বেশি চওড়া নয়। অর্জুন নীচের দিকে আলো ফেলে একটা ছোট গর্ত দেখতে পেল। অর্থাৎ সুড়ঙ্গের মুখ দিয়ে যে জল ঢোকে তা ওই গর্তের ভিতর চলে গিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। তা হলে যদি ওখান থেকে খোঁড়া শুরু করা হয় তা হলে কিছুটা সুবিধা হবে।

ঘণ্টা দুয়েক চেষ্টার পর ওরা আচমকা আকাশ দেখতে পেল। সঙ্গে ছিল বাতাস। আলো প্রায় মরে এসেছে, কারণ আকাশ ভরতি মেঘ। খানিকটা এগিয়ে যেতেই ওরা ঝরনার শব্দ স্পষ্ট শুনল। বেশ জোরে নীচের দিকে বয়ে যাচ্ছে। পনেরো ফুট চওড়া জলের ধারা। তীব্র স্রোত পাথরে শব্দ তুলছে যা সুড়ঙ্গের ভিতরে পাহাড়ে কান চেপে অর্জুন এবং কুলদীপ শুনতে পেয়েছিল। এই ঝরনা ধরে চললেই তিন ঝরনার সঙ্গমস্থলে পৌঁছোনো যাবে।

কিন্তু অর্জুন ঘোষণা করল, আজকের মতো বিশ্রাম। শুনে মেজর খুশি হলেন, আজ একটু বেশি খাঁটিয়েছ হে। বড্ড খিদে পেয়ে গেছে।

তাঁবু খাটানো হল। মালবাহকেরা লেগে গেল রান্না করতে। ঝরনার জলে হাত দিয়ে মেজর বললেন, উঃ, এই জল বোধহয় নর্থ পোল থেকে আসছে। কী ঠান্ডা!

অর্জুন হেসে বলল, আপনিও এই কথা বলছেন!

মেজর উষ্ণ হলেন, ঠাট্টা করছ। করো।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার