বরফে পায়ের ছাপ (২০১২)
অর্জুন সমগ্র ৬ – সমরেশ মজুমদার

দুপুর দেড়টা বাজতেই মেজর চিৎকার করলেন, হল্ট!

অর্জুন সামনে হাঁটছিল, অবাক হয়ে ফিরে তাকাল, কী হয়েছে?

নো মোর ওয়াকিং। আজ এখানেই টেন্ট ফেলল। মেজর তার কঁচাপাকা দাড়িতে আঙুল ঢোকালেন। এখন এখানে ঠান্ডা প্রায় ছয় ডিগ্রিতে রয়েছে। তা সত্ত্বেও তার কপালে ঘাম জমেছে।

এ কী। এখানে কেন? সন্ধে নামতে ঘণ্টা তিনেক দেরি আছে। আমরা তো মাত্র সাড়ে চার ঘণ্টা ট্রেক করেছি। অর্জুন প্রতিবাদ করল।

মাই ডিয়ার অর্জুন, একটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন সাড়ে চার ঘণ্টায় যে দূরত্ব অতিক্রম করে একটা দ্রুত এক্সপ্রেস নিশ্চয়ই তার দ্বিগুণ পথ পেরিয়ে যায়। কথাটা হচ্ছে, কত ঘন্টা হেঁটে এলাম সেটা বড় কথা নয়, কতটা পথ পেরিয়ে এলাম সেটা জানতে হবে। মেজর দাড়ি থেকে আঙুল সরালেন, তা ছাড়া এখান থেকে আমি স্পষ্ট তিব্বত দেখতে পাচ্ছি।

হাওয়াটা টের পাচ্ছ? একদম টিবেটিয়ান হাওয়া। নাইনটিন এইট্টিফাইভে আমি যখন লাসায় গিয়েছিলাম তখন এই হাওয়ার স্বাদ পেয়েছিলাম। চারধারে তাকিয়ে দেখো, পাহাড় আর পাহাড়। ওই তিব্বতের দিকটাই ভোলা। এখানেই আজ রাত্রের মতো হল্ট করা যাক। কঁধ থেকে রুকস্যাকটা খুলে নীচে নামিয়ে রাখলেন তিনি।]

অর্জুন বুঝল বুঝিয়েও কোনও লাভ হবে না। মেজর স্বীকার করতে চান না যে তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন। আগের থেকে তার শরীর বেশ ভারী হয়েছে। বাধ্য হয়ে অর্জুন অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা মালবাহকদের বলল, সাহেব চাইছেন যখন তখন আজ এখানেই বিশ্রাম নাও।

মালবাহক তিনজন। তাদের মধ্যে যে বয়স্ক সে বলল, এখনও তো। অনেকক্ষণ আলো থাকবে, আমরা যদি ওই পাহাড়টা পেরিয়ে গিয়ে বিশ্রাম করি তা হলে ভাল হয়।

লোকটা হাত তুলে একটা খাড়া শৃঙ্গ দেখাল। আরও ঘণ্টাখানেক হাঁটলে ওটার নীচে পৌঁছানো যাবে। তারপর উঠতে হবে ওপরে। একদিনে অত পরিশ্রম করার চেয়ে মেজর বোধহয় মরে যেতে রাজি হবেন।

লোকটা বলল, এই জায়গাটা ভাল নয়, ওপারে গেলে চিন্তা থাকত না।

ভাল নয় কেন?

মাঝে মাঝেই ঝড় বৃষ্টি আসে। তা ছাড়া এক ধরনের পাহাড়ি শুয়োর এদিকে থাকে। খাবারের গন্ধ পেলে আক্রমণ করবেই। লোকটি জানাল।

একটু দূরে বসে চুরুট বের করে ধরাবার জন্যে দেশলাই খুঁজছিলেন মেজর; চেঁচিয়ে বললেন, কী বলছে ওরা? মালপত্র নামাচ্ছে না কেন?

এদিকে পাহাড়ি শুয়োর আছে যারা বেশ ভয়ানক।

হো হো শব্দটা যে হাসির তা মেজরের হুঁড়ির কম্পনে বোঝা গেল, মাই ডিয়ার মধ্য পাণ্ডব, মাসাইমারার নাম শুনেছ? ওই জঙ্গলের বাঘ পর্যন্ত শুয়োর দেখলে সামনে এগোয় না। এক-একটার সাইজ গাধার মতো। নাকের ওপর শিংটা দেখতেই আমার সহযাত্রী আন… পিটারসন ভিরমি খেয়ে গিয়েছিল।

কোন সালে? অর্জুন জিজ্ঞাসা না করে পারল না।

নাইনটিন এইট্টি। সামারে। আমার হাতে ছিল একটা ল্যাসো। সেটা ছুঁড়ে শুয়োরটার গলায় ঢুকিয়ে দিতে ব্যাটা গেল খেপে। যত খেপছে তত ল্যাসো চেপে বসছিল ওর গলায়। শেষে স্রেফ দমবন্ধ হয়ে মরে গেল ওটা। বাঁ হাত আকাশে তুললেন মেজর, আমাকে আর যাই হোক শুয়োর দেখিয়ো না।

অর্জুন ঠিক বুঝতে পারছিল না মাসাইমারায় মেজর ল্যাসো পেলেন কী করে। কিন্তু প্রশ্ন করলেই মেজর নিশ্চয়ই আরও একটি কাহিনি শোনাবেন।

শেষ পাহাড়ি গ্রাম ওরা পেছনে ফেলে এসেছিল দুঘন্টা আগে। এখন এখানে হাওয়ার শব্দ ছাড়া কোনও আওয়াজ নেই। মেজর বলেছেন তিব্বতি হাওয়া। অর্জুন কখনও তিব্বতে যায়নি। কিন্তু এই হাওয়াকে মোটেই অচেনা মনে হচ্ছে না।

মালবাহকরা পায়ে চলা রাস্তা ছেড়ে পাহাড়ের একটা খাঁজে তাবু টাঙাতে লাগল। অর্জুন দেখল ওরা এত দক্ষ যে তাবু খাড়া করতে বেশি সময় লাগল না। জায়গাটা ওরা বেছে নিল কারণ একটা দিকে পাহাড়ের আড়াল থাকছে, মাথার ওপরেও খানিকটা পাহাড়ের ঢাল।

অর্জুন আর মেজর একটি তাবুতে ঝোলানো দুটো হ্যামকে শোবে। দ্বিতীয়টিতে মালবাহকেরা, তৃতীয়টিতে জিনিসপত্র রেখে রান্না করা হবে।

অর্জুন খোলা দিকটার দিকে তাকিয়েছিল। মেজর বলেছেন ওই দিকে তিব্বত রয়েছে। কিন্তু পাহাড় আর পাহাড় ছাড়া কোনও কিছুই তার চোখে পড়ছে না। মাঝে মাঝে তার মনে হয় মেজরের অন্তর্দৃষ্টি রয়েছে। সে মুখ ফিরিয়ে মেজরকে দেখতে পেল না। কোথায় গেলেন। সে একজন মালবাহককে জিজ্ঞাসা করলে সে জানাল, বুড়া সাহেব তাঁবুর ভেতরে গিয়ে শুয়ে পড়েছেন।

হেসে ফেলল অর্জুন। সে অনেকবার নিষেধ করেছিল কিন্তু তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন। ভদ্রলোক মানতেই চান না যে তার বয়স হয়েছে। তার গুরু অমল সোম, যিনি মেজরের বন্ধু, এখন আধ্যাত্মিক জীবনযাপন করছেন। গতকালই দুপুরে মেজর বাগডোগরায় নেমেছেন। অর্জুন সেখান থেকে তাকে তুলে নিয়ে পাহাড়ে উঠেছে। কার্শিয়াং হয়ে ঘুমে এসে সোজা গাড়িতে চলে এসেছে। মানেভঞ্জনে। মোটামুটি একটা চলনসই হোটেলে রাত কাটানোর আগে মালবাহকদের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছে। ওরাই তাঁবু, রান্নার সরঞ্জাম ভাড়া করে এনেছে, টাকা নিয়ে গিয়ে বাজার করেছে। মেজর ঘুমিয়ে পড়েছিলেন সন্ধের মধ্যেই। দীর্ঘযাত্রা তাঁকে কাহিল করেছিল। আলাদা ঘরে একা ঘুমিয়েছিলেন তিনি। সমস্ত আয়োজন শেষ করতে করতে রাত হয়ে গিয়েছিল অর্জুনের।

মানেভঞ্জন থেকে এখন সান্দাকফু আর হেঁটে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। সরাসরি জিপ যায়। সুমো বা সাফারিও দিব্যি চলে যাচ্ছে। তবু কিছু মানুষ যাঁরা ট্রেকিং করতে পছন্দ করেন তারা টংলুতে রাত কাটিয়ে পৌঁছে যান কিন্তু টংলুতে পৌঁছাবার অনেক আগেই তাদের অন্য পাহাড়ি পথ ধরতে হয়েছিল। এই পথে কোনও গাড়িই যেতে পারে না। ম্যাপ দেখে অর্জুন জেনেছে তাদের অন্তত চল্লিশ কিলোমিটার পাহাড় ডিঙোতে হবে। মেজর যদি এরকম যাত্রাভঙ্গ করেন তা হলে খুব মুশকিলে পড়তে হবে।

হঠাৎ রোদ্র সরে গেল। সমস্ত পাহাড়ে ছায়া ছড়িয়ে পড়ল। বয়স্ক মালবাহক তার কাছে এসে বলল, সাব, আপনি তাবুতে চলে যান। চা তৈরি হচ্ছে।

এখানেই দাও।

না সাব। এখানে দাঁড়াতে পারবেন না, ওই দেখুন মেঘ জমছে।

অর্জুন দেখল। মেজর যেদিকে তিব্বত দেখিয়েছিলেন সেদিকের আকাশের কোণে কালো মেঘ দেখা দিয়েছে। সে বলল, অতদূরে মেঘ দেখে তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? মাথার ওপর তো কোনও মেঘ নেই।

সাব, ওই মেঘ খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে ছুটে আসবে। আমি তাই এখান থেকে সরে যেতে বলেছিলাম। লোকটি রান্নার তাবুর দিকে চলে গেল।

অর্জুন দেখল মেঘটা খুব দ্রুত বড় হচ্ছে। তার পরেই কেঁপে উঠল সে। এখন তার পরনে জিনস এবং পুলওভার। একটু আগে হাঁটার সময়ে বেশ গরম লাগছিল। এখন মনে হল শরীরের সব হাড় কেঁপে উঠল। আচমকা প্রচণ্ড ঠান্ডা ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীতে। অথচ এই মুহূর্তে মাত্র ছয় হাজার ফুট উঁচুতে দাঁড়িয়ে আছে সে। এই ঠান্ডা সহ্য করা মুশকিল। অর্জুন দৌড়ে চলে এল টেন্টের ভেতরে। দরজার পরদাটা ফেলে দিয়ে দেখল মেজর মোটা কম্বলে শরীর ঢেকে হ্যামকে দুলছেন। তাকে দেখে বললেন, পাহাড়ে দৌড়ানো ঠিক নয়। এমনিতে অক্সিজেন কমে যায়, দৌড়োলে অসুবিধায় পড়বে।

অর্জুন দেখল তার জন্যে টাঙানো হ্যামকের ওপর কম্বল ভাঁজ করে রাখা আছে। দুটো হ্যামকের মাঝখানে ফোল্ডিং টেবিল এবং দুটো প্লাস্টিকের চেয়ার। সে কম্বলে শরীর মুড়ে চেয়ারে বসল। ঠান্ডাটা কমতে না কমতে ঝড় উঠল। শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। তাঁবুর একটি দিক ভয়ংকরভাবে নড়ছে। বুদ্ধি করে পাহাড়ের খাঁজে তবু না টাঙালে নির্ঘাত উড়ে যেত এতক্ষণে। অর্জুন বলল, ঝড়ে তাবু না উড়ে যায়।

তুমি এটাকে ঝড় বলছ? হাওয়ার গতিবেগ কত হবে? ম্যাক্সিমাম পঁচাশি!

তা বলতে পারব না। শব্দটা শুনতে পাচ্ছেন? তাবুর দড়ি না ছিঁড়ে যায়।

যাবে না। তুমি নিশ্চয়ই আলাস্কায় যাওনি?

আলাস্কা? না।

ইন দি ইয়ার নাইনটিন নাইনটি, আলাস্কা শহর থেকে মাত্র কুড়ি মাইল দূরে আমাদের লঞ্চ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। চারপাশে শুধু বরফ আর বরফ। টেম্পারেচার জিরোর অনেক নীচে। মেরুর বরফ কী বস্তু না দেখলে কল্পনা করতে পারবে না। যে জল দিয়ে লঞ্চটা চলেছিল তা জমতে শুরু করেছে। কিছু করার নেই দেখে আমি শুয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ মনে হল হাজারটা সিংহ একসঙ্গে ডাকছে। প্রচণ্ড নড়ছে লঞ্চটা। তাড়াতাড়ি নীচে নামতেই মনে হল আমি উড়ে যাচ্ছি। তার পরেই বুঝতে পারলাম, আমি উড়ছি না, আমাকে নিয়ে লঞ্চটাই উড়ছে। কয়েক সেকেন্ড যেতে না যেতেই নরম তুষারের মধ্যে পড়ায় আছাড় খেতে খেতে বেঁচে গেল লঞ্চটা। চারধার থেকে চিৎকার ভেসে এল। আমি ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দেখতে পেলাম লঞ্চের তিনভাগের একভাগ বরফের তলায় ঢুকে গেছে। আশপাশে কোথাও জল নেই। একটা স্নো বিয়ার চিৎকার করছে বরফের ওপর চিত হয়ে। বেচারাকে হয়তো লঞ্চের ধাক্কা খেতে হয়েছে। ক্যাপ্টেন পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ভগবানকে ধন্যবাদ, আমরা বেঁচে গেছি। এরকম ভয়ংকর ঝড় আমি জীবনে দেখিনি। মেজর কথা শেষ করতেই বাইরে ভয়ংকর শব্দ শুরু হল। বাতাস যেন তাবুর ওপর আড়ছে পড়ছে। মালবাহকরা যদি বাঁধন আলগা রাখত তা হলে আর দেখতে হত না। তাঁবুর ভেতরটা অন্ধকারে ভরে যেতেই মেজর ইমার্জেন্সি লাইট জ্বাললেন। হ্যামক থেকে বললেন, এই সময়ে এরকম ওয়েদার অবশ্যই অস্বাভাবিক।

আপনার ঠান্ডা লাগছে না?

ঠান্ডা? ইন দি ইয়ার নাইনটিন–।

মেজর, গল্পটা পরে শুনলে হয় না? ঠকঠক করে কাঁপছিল অর্জুন।

গল্প? হোয়াট ডু ইউ মিন? বানিয়ে বলছি? তোমার কাকা শ্রীযুক্ত অমল সোম কখনও অবিশ্বাস করেননি আমাকে! চেঁচিয়ে বললেন মেজর। রাগে তার আঙুল পড়ল ইমার্জেন্সি লাইটের সুইচে। তবু অন্ধকার হয়ে গেল।

আমি মোটেই অবিশ্বাস করিনি। ঝড়ে লঞ্চ উড়ে যাওয়াও না। আপনি প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না।

ঠিক তখনই একটা কুকুরের আর্তনাদ শোনা গেল। অত্যন্ত বিপদে না পড়লে এভাবে কোনও প্রাণী কাঁদে না। মেজরের চাপা গলা অন্ধকারে ভেসে। এল, উফ! মাউন্টেন উলফ। তোমার কী মনে হয়? এদিকের পাহাড়ে কুকুর কী করে আসবে? তাই?

একদম ঠিক। কাছাকাছি কোনও লোকালয় নেই। তা ছাড়া ঝড়বৃষ্টিতে কুকুর লোকালয় ছেড়ে এরকম জায়গায় আসবে না। কিন্তু এদিকে নেকড়ে আছে বলে শুনিনি। অর্জুন বলল।

এদিকে নয়, আরও হাজার আড়াই ফুট ওপরে যেখানে সারা বছর বরফ জমে থাকে সেখানে এক ধরনের উল থাকে যাদের স্নো-উলফ বলা হয়। কোথায় যেন পড়েছিলাম, ওই স্নো-উলদের ইয়েতিরা পুষে থাকে। আমি অবশ্য দেখিনি। মেজর বললেন।

ধীরে ধীরে তাবুর অন্ধকার পাতলা হয়ে গেল। ঝড়ের দাপটও আচমকা কমে গেল। মেজর মাথা থেকে পা পর্যন্ত নিজেকে মুড়ে নিয়ে বললেন, চলো, একটু হাঁটা যাক।

আজ বোধহয় হাঁটা ঠিক হবে না। কালকের জন্যে এনার্জি জমুক না। কথাগুলো বলতেই মালবাহকদের একজন তাবুর দরজা খুলে ভেতরে এসে দুটো কাপ টেবিলের ওপর রেখে চা ঢেলে দিল কেটলি থেকে।

মেজর চিৎকার করলেন, গ্রেট! এইসময় চা চা করছিল মনটা।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। চারপাশ ঝকঝক করছে। আকাশে এক ফোঁটাও মেঘ নেই। পাহাড় আর পাহাড় গায়ে গায়ে বসে আছে চুপচাপ। সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমে।

মালবাহকদের মধ্যে যে বয়স্ক সে রান্নার তাবু থেকে বেরিয়ে এগিয়ে এল, চা ঠিক হয়েছে সাহেব?

অর্জুন কিছু বলার আগেই মেজর চেঁচিয়ে বললেন, গ্র্যান্ডি। কিন্তু কী যেন নাম তোমার? আমি কি একবারও নাম জিজ্ঞাসা করেছি?

আমার নাম পূরণ, পূরণ বাহাদুর।

ওয়েল, এরপর যখন চা বানাবে তখন একদম চিনি দেবে না। আন্ডারস্ট্যান্ড?

হ্যাঁ, সাহেব। পূরণ বাহাদুর মাথা নাড়ল।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, তুমি বলেছিলে মাঝে মাঝেই এদিকে বৃষ্টি হয়। এখন যেরকম হয়ে গেল তারপর আর চিন্তার কিছু নেই, তাই না?

না সাহেব। আবার ঝড়বৃষ্টি হতে পারে। ওই দেখুন, আকাশের কোণে একটু মেঘ আটকে আছে। কিন্তু বিশ্বাস নেই। পূরণ বাহাদুর বলল।

আর পাহাড়ি শুয়োরগুলো থাকে কোথায়?

এই পাহাড়েই থাকে সাহেব। ওরা দিনের বেলায় সাধারণত বের হয়।

চা শেষ করলেন মেজর। তারপর বললেন, অর্জুন, কাল যখন তুমি বাজার করছিলে তখন ভেবেছিলাম এই রেশনে আমাদের কতদিন চলবে? যদি প্রয়োজনে বেশিদিন থাকতে হয় তা হলে বিপদে পড়ব না তো! এখন মনে হচ্ছে ভুল ভেবেছিলাম?

হঠাৎ মত পালটালেন? অর্জুন হাসল।

দেখো, লাস্ট রেডমিট কবে খেয়েছি মনে পড়ছে না। সম্ভবত, বছর পনেরো আগে, মাসাইমারার জঙ্গলে। তারপর তো মাছ ছাড়া কোনও আমিষ খাই না। এখন কয়েকদিন রেডমিট খেলে শরীর নিশ্চয়ই খারাপ হবে না, কী বলো?

রেডমিট তো আনিনি। মুরগি আছে—।

ছ্যাঃ, মুরগি তো রুগির পথ্য। খেতে হয় চাই খাওয়া।

তা হলে এখানে রেড মিট পাবেন কী করে?

আশ্চর্য? তোমার কী হল বলো তো? একটু আগে পাহাড়ি শুয়োরের কথা বললে না?

অর্জুন অবাক হয়ে মেজরের দিকে তাকাল।

মেজর বললেন, ওদের একটাকে মারলে কয়েকদিন দিব্যি চলে যাবে। মেজর হাসলেন।

আপনি শুয়োরের মাংস খান?

শেষ বার খেয়েছিলাম ওই মাসাইমারায়। বললাম না, এখন রেড মিট একদম বন্ধ। দারুণ খেতে। আমাদের ভারতীয় পূর্বপুরুষেরা খেতেন। শুয়োরের আর এক নাম বরাহ। তখন বরা-র মাংস লোকে চেটেপুটে খেত।

কিন্তু পাহাড়ি শুয়োরকে মারবেন কী করে?

ওটা আমার ওপর ছেড়ে দাও। আজকের রাতটা পর্যবেক্ষণ করি। ওরা ক’জন আসে, কী ওদের সাইজ, এসে কী করে জানার পর মারার প্ল্যান নেব।

পূরণ বাহাদুর শুনছিল। পাহাড়ি মানুষ হলেও সে বাংলা কিছুটা বোঝে। বলল, কিন্তু সাহেব, পাহাড়ি শুয়োর মারা সরকার আইন করে বন্ধ করে দিয়েছে। তা ছাড়া ওদের একজনকে মারলে বাকিরা প্রতিশোধ নেবেই।

মেজর বিরক্ত হয়ে বেশ কয়েক পা এগিয়ে গেলেন, তার হাতে তখনও চা শেষ হওয়া গ্লাস ধরা আছে। তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে চারপাশে পাহাড় দেখতে লাগলেন।

পূরণ বাহাদুর বলল, সাহেব, আপনি পাঁচটা টাকা দিন।

পাঁচ টাকায় এখানে কী করবে?

পুজো দেব সাহেব। টাকায় চালডাল রেখে পাহাড়কে পুজো দিয়ে আমরা কেউ বিপদে পড়ব না। আপনাকে বলেছিলাম এই জায়গা ছেড়ে এগিয়ে যেতে গেলে পুজো না দিলেও চলত। পূরণ বাহাদুর বলল।

কেন? এখানে বিপদের কথা ভাবছ কেন?

মুখে বলব না। জায়গাটা ভাল নয়। আপনারা রাত্রে তাঁবুর বাইরে আসবেন না। আমরা এখনই রান্না শেষ করে ফেলছি যাতে সন্ধের মধ্যেই সবাই খেয়ে নিতে পারে। আপনি যদি টাকাটা দেন–?

অর্জুন দেখল তার কাছে পাঁচ টাকার নোট নেই কিন্তু পাঁচ টাকার কয়েন রয়েছে। সেটা পেয়ে পূরণ বাহাদুর বেশি খুশি হল।

একটু বাদেই একজন সঙ্গীকে নিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেল। অর্জুন মাথা নাড়ল, পাহাড়ের মানুষদের কিছু বিশ্বাস তৈরি হয়ে যায় ভয় থেকে। সেটা আদিবাসীদের মানতে হয়। যুক্তি দিয়ে তাদের বোঝানো যাবে না। এই পুজো দিয়ে এসে পূরণ বাহাদুররা মনে জোর পাবে। সেটা কম কাম্য নয়।

সন্ধের মুখের রাতের খাওয়া শেষ হয়ে গেল। জম্পেশ ঠান্ডা নেমেছিল সূর্যাস্তের পরে। ধীরে ধীরে তীব্রতা বাড়ছে। তাঁবুর ভেতরে ইমার্জেন্সি আলো জ্বলছিল। ওটা সৌরবিদ্যুতে চলে। মেজর ঘড়ি দেখলেন। জাস্ট ছ’টা পঁচিশ। এবার আর ভুল করিনি। আমার রুকস্যাকে প্রচুর টিনড়ফুড আর ড্রাইফুড আছে। মাঝরাতে খিদে পেলে লজ্জা না করে বোলো।

তাঁবুর দরজার একটা কোণে ফাঁক ছিল। সেটা ঠিক করতে গিয়ে অর্জুন দেখল বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে পৃথিবীটাকে কালো পরদায় মুড়ে দেওয়া হয়েছে।

খাওয়ার পর মেজর এবার পাইপ ধরালেন মৌজ করে।

আপনি এখনও ওটা ছাড়েননি? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

চব্বিশ ঘণ্টায় দু’বার। দুটো মেজর ফুডের পর। ডাক্তার আমাকে অ্যালাউ করেছে। কিছু বলবে?

তা হলে কিছু বলার নেই।

কয়েকটা টানের পর পাইপ নিভিয়ে মেজর জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার গুরুদেবের খবর কী?

অমলদা এখন যোশীমঠে থাকেন। আপনার সঙ্গে তো যোগাযোগ ছিল।

যতক্ষণ তিনি হৃষীকেশে ছিলেন। তারপর তার ফোন আউট আ রিচ।

হ্যাঁ। তবে উনি ফোন করলে কথা হয়।

আমাদের এই অভিযানের কথা তার জানা আছে?

অবশ্যই। তিন দিন আগে ফোন করেছিলেন যখন তখন বলেছি।

কী বললেন মিস্টার অমল সোম?

বললেন, দেখো!

ব্যস? আমি ভেবে পাই না ওঁর মতো বুদ্ধিমান একজন সত্যসন্ধানী কেন সব ছেড়ে ঈশ্বর চিন্তায় জীবন কাটাবেন! যাক গে!

দুটো হ্যামকের দূরত্ব বেশি নয়। ইমার্জেন্সি লাইটটা নেভাবার আগে মেজর তাঁর হ্যামকে শরীর তুলে দিলেন। এবার স্লিপিং ব্যাগের ভেতর ঢুকে গেলেন তিনি। ওই ব্যাগটির গল্প অর্জুন শুনেছে। আলাস্কা শহর থেকে তিরিশ মাইল উত্তরে একটি পরিত্যক্ত ইগলুতে মাইনাস তিরিশ ডিগ্রিতে রাত কাটিয়েছিলেন ওই স্লিপিং ব্যাগে শুয়ে। এখন স্লিপিং ব্যাগের ওপর কম্বল বিছিয়ে নিয়েছেন। এইসময় ঠান্ডা আট ডিগ্রির নীচে নয়। হ্যামকে শুয়ে অন্ধকার টেন্টের মধ্যে চোখ ভোলা রাখতে রাখতে ধাতস্থ হল অর্জুন! বাইরে কোনও শব্দ নেই। অকস্মাৎ তাঁবুর ভেতর বাঘের গর্জন শুরু হল। দুই হাতে কান চাপল সে। সুইচ টিপে আলো নেভানোর চেয়ে বেশি সময় লাগে না মেজরের ঘুমিয়ে পড়তে। পড়লেই নাসিকা গর্জন শুরু হয়ে যায়। কিছু করার নেই, দু’জনের জন্যে দুটো আলাদা তাবুর ব্যবস্থা করা বিলাসিতা হয়ে যাবে। কয়েক মিনিটের মধ্যে পূরণ বাহাদুরের গলা ভেসে এল বাইরে থেকে, সাহেব, কী হয়েছে সাহেব?

অর্জুন চেঁচিয়ে বলল, কিছু হয়নি। বড়সাহেব ঘুমিয়ে পড়লে এইরকম শব্দ করেন। তোমরা শুতে চলে যাও।

অর্জুনের চিৎকারে ঘুমের ব্যাঘাত হল মেজরের। নাক ডাকা থেমে গেল। দু’-তিনবার উঃ, আঃ শব্দ করে শেষপর্যন্ত বললেন, ভোর হয়ে গেছে নাকি। চিৎকার কীসের!

অর্জুন জবাব না দেওয়ায় আবার গর্জন শুরু হল। হঠাৎ অর্জুনের মনে হল এই গর্জন একটা ব্যাপারে সাহায্য করবে। পাহাড়ি শুয়োরগুলো ভয়ে এদিকে আসবে না। ওরা যদি কোনওকালে বাঘের গর্জন না শুনে থাকে তা হলে আরও ভয়ংকর কিছুর কথা ভাববে। মেজর আজ রাত্রে পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছিলেন, কখন করবেন?

দিন পনেরো আগে নিউইয়র্ক থেকে মেজর টেলিফোন করেছিলেন। উনি যখন যেমন কথা বলেন তখন কোনও ভণিতা করেন না। দু’বছর কথা না হলেও শুরু করেন এমনভাবে যাতে মনে হবে গতকালই কথা হয়েছে। বললেন, ওহে তৃতীয় পাণ্ডব। আমি আসছি।

খুশি হয়েছিল অর্জুন, বাঃ! কবে আসছেন?

কয়েকটা দিন লাগবে। বিশাল ব্যাপার? দু’জন মানুষকে খুঁজে বের করতে হবে। আজ প্রায় মাসখানেক হল তাদের কোনও খোঁজখবর পাওয়া যাচ্ছে না। মুশকিল হল। ওদের একজন আমার ভাল বন্ধু ছিলেন কোনও একসময়ে।

মেজরের কথা বলার ধরনই এইরকম? শুনলে মানেটা স্পষ্ট হয় না। টেলিফোনে যা বললেন তা হল দু’জন মানুষকে মাসখানেক হল পাওয়া যাচ্ছে না, তাদের খুঁজে বের করতে হবে। প্রশ্ন উঠবেই কোথায় হারিয়েছেন তারা? পৃথিবীর কোন জায়গায় যেতে হবে তাদের খুঁজতে? একটু স্পষ্ট করেননি। মেজর। যখন তিনি এদেশে আসছেন তখন ধরে নেওয়া যেতে পারে ওরা ভারতবর্ষেই হারিয়ে গেছেন। ভারতবর্ষ কোনও গ্রামের নাম নয়।

দ্বিতীয়ত মেজরের কথা অনুয়াযী ওই দু’জনের একজন কোনও এক সময়ে তার ভাল বন্ধু ছিলেন। তা হলে ধরে নিতে হবে এখন আর ওঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব নেই। সমবয়সি বন্ধু হলে সেই মানুষটিকে আর যুবক বলা যাচ্ছে না। বন্ধুত্ব চলে গেল কেন? আর যে এখন বন্ধু নয় তার খোঁজে মেজর আসবেন কেন?

তৃতীয়ত, মেজর বলেছিলেন, বিশাল ব্যাপার। কোনটা বিশাল? ওই দু’জনের হারিয়ে যাওয়া? সেটা বিশাল হবে কী করে?

আসলে মেজরের কথা বিশ্লেষণ করলে, বিশেষ করে ফোনের কথা, কোথাও পৌঁছানো যায় না। অর্জুন ব্যাপারটা নিয়ে আর কিছু ভাবেনি।

কিন্তু মেজরের ফোন এল কয়েকদিন আগে, কী হে! ঘুমাচ্ছ নাকি?

তখন সকাল এগারোটা। অর্জুন হাসল, কেমন আছেন?

আরে! আমি আজ দিল্লিতে নেমেছি আর তুমি গুরুত্বই দিচ্ছ না?

ওহো! আপনি যে এদেশে চলে এসেছেন তা বুঝব কী করে। সেই যে ফোন করলেন তারপর তো আর কিছু জানাননি। অর্জুন বলল।

জানানোর দায় শুধু আমারই? তুমি ফোন করোনি কেন?

অর্জুন উত্তর দিল না। এর আগে একবার মেজরকে ফোন করেছিল, প্রায় চল্লিশ মিনিট কথা বলার পর ফোন রেখেছিলেন তিনি। মোটা বিল এসেছিল।

শোনো। আমি একটু পরেই বাগডোগরার ফ্লাইট ধরছি।

ঠিক আছে, আমি এয়ারপোর্টে থাকব।

নো। নট অ্যাট অল। জলপাইগুড়ি শহর থেকে বাগডোগরার দূরত্ব আমি জানি। পয়সা এবং সময় খরচ করে তোমাকে আসতে হবে না। এয়ারপোর্টে নেমে একটা ট্যাক্সি নিয়ে জলপাইগুড়িতে যাওয়ার মতো সাবালক আমি এখনও আছি। মেজর বললেন।

আপনি জলপাইগুড়িতে আসছেন? অবাক হল অর্জুন।

কেন? তোমার কী অসুবিধে হচ্ছে?

এই শহরে কয়েকটা হোটেল নতুন হয়েছে বটে কিন্তু থাকার ব্যাপারে শিলিগুড়িই তো বেশি সুবিধেজনক ছিল। অর্জুন কথাগুলো বলতেই লাইন কেটে গিয়েছিল। কয়েকবার চেষ্টা করেছিল সে, কিন্তু যোগাযোগ হয়নি।

ফাঁপরে পড়ল অর্জুন।

জলপাইগুড়ির কদমতলা ছাড়াও পিডি কলেজের কাছে নতুন হোটেল হয়েছে। তাদের যেটা সবচেয়ে ভাল সেখানে মেজরের জন্যে ঘর বুক করে রাখা দরকার।

অর্জুনের মা ঘরে ঢুকে ছেলেকে চিন্তিত দেখে কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে ব্যাপারটা জানিয়েছিল। মা বললেন, উনি হোটেলে থাকবেন কেন? এর আগে যখনই এসেছেন তখনই তো অমলবাবুর বাড়িতেই উঠেছেন।

অর্জুন মাথা নাড়ল, তখন অমলদা ছিলেন। এখন হাবুর বয়স হয়েছে। এখন ওই বাড়িতে গিয়ে থাকলে প্রায় না খেয়ে থাকতে হবে।

তা হলে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আয়। ওপাশের ঘরটা তো পরিষ্কার করে রাখা আছে।

তুমি বুঝতে পারছ না। আমেরিকায় থাকা মানুষ। ওরা যেসব ব্যাপারে অভ্যস্ত তা আমাদের বাড়িতে পাবেন না। এসি ছাড়া রাত্রে ঘুমাতেই পারবেন না।

তা হলে এক কাজ কর। তুই এখনই হাকিমপাড়ায় গিয়ে হাবুকে বল যে ঘরে আগে উনি থাকতেন তা পরিষ্কার করে রাখতে। আমি তিনবেলা খাবার পাঠিয়ে দেব। ভদ্রলোক বিদেশে থাকতে থাকতে বাঙালি রান্নার স্বাদ নিশ্চয়ই ভুলে গেছেন। ওখানে আগে এসি ছাড়াই তো ছিলেন। খাবার ঠিকমতো পেলে বোধহয় হোটেলে থাকতে চাইবেন না।

মায়ের পরামর্শ মনে ধরল অর্জুনের। সে তখনই বাইক নিয়ে রওনা হয়ে গিয়েছিল। অমল সোমের বাড়ির সামনের বাগানটা বেশ সুন্দর। হাবু যে এখনও যত্ন নিচ্ছে তা দেখেই বোঝা যায়।

দরজায় বেশ কয়েকবার শব্দ করার পর হাবু দরজা খুলে তাকে দেখে। হেসেছিল। সত্যি বুড়ো হয়ে গেছে মানুষটা। মুখে কঁচাপাকা দাড়ি। অমল সোম যখন এখানে থাকতেন তখন রোজ দাড়ি কামাত হাবু। পরনে সেই খাকি হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি। বহু বছর আগে কীভাবে যে লোকটা অমল সোমের সঙ্গে জুটে গিয়েছিল, এখনও অনুগত হয়ে আছে। হাবু কথা বলতে পারে না, কানেও শুনতে পায় না। পেলেও তা ক্ষীণ। তিন কুলে ওর কেউ নেই। অমল সোম ওর খরচের জন্যে পোস্ট অফিসে টাকার ব্যবস্থা করে গিয়েছেন। প্রত্যেক মাসে টিপসই দিয়ে সেই টাকা তোলে হাবু।

অর্জুন ইশারায় বোঝাল মেজর আসছেন। বহুদিন ধরে ইশারায় কথা বলে ওদের মধ্যে বেশ সমঝোতা হয়ে আছে। মেজর বোঝাতে তাঁর আকৃতি, দাড়ি, টাক আর আকাশ থেকে নেমে আসা ইশারায় বোঝাতে হল।

বোঝার পর হাবুর মুখে হাসি ফুটল। একটা কাক প্রবল চিৎকার করছিল। হাবু বারান্দা থেকে নেমে চারপাশে তাকাতে লাগল। তার কানে কাকের চিৎকার যাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু পাখিটা যে এই সময় এখানে থাকে তা তার জানা। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেটাকে দেখতে পেয়ে সে আঙুল তুলে অর্জুনকে দেখাল।

দাঁড়কাকের চেয়েও বড় কাকের চেহারাটা। লালচে চোখ। হঠাৎ কর্কশ গলায় ডেকে উঠল। এই কাকটাকে হাবু দেখাল কেন?

হাবু চলে গেল ভেতরে। অর্জুন কাকটাকে দেখছিল। এত বড় এবং হিংস্র দেখতে কাক সচরাচর উত্তরবাংলায় দেখা যায় না। কাকটা তাকে দেখল ঘাড় ঘুরিয়ে। তারপর যেন ভয়ংকর ধমক দিল। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল। এর আগে একবার এখানে এসে মেজর গাছের ডালে বসে চিৎকার করে একটি কাকের সঙ্গে ঝগড়া করেছিলেন। সেটাও এখন সেখানে ছিল। তিনি বলেছিলেন ওটা তিব্বতি কাক। হাবু নিশ্চয়ই তাকে ঝগড়া করতে দেখেছিল। মেজরকে বোঝাতে সে এই কাকটিকে চিহ্নিত করেছে। অর্জুন হেসেছিল, হাবু সত্যি বুদ্ধিমান।

মেজরের ঘর হাবুকে দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে বাড়ি ফিরে এল সে।

দুপুরের শেষদিকে থানা থেকে ফোন এল। বড়বাবু অনুরোধ করলেন। একবার দেখা করার জন্যে। অর্জুন গিয়ে দেখল হাতকাটা পাঁচু দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল সে। বড়বাবুর ধমক খেয়ে কান্না থামালে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ব্যাপারটা কী?

আজ সকালে দেবী চৌধুরানি কালীবাড়ির সামনে একটা জিপ একজন সাইকেল আরোহীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে ডুয়ার্সের দিকে পালিয়ে গিয়েছে। আহত লোকটা এখন হাসপাতালে। এই হাতকাটা পাঁচু কালীবাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা দেখেছে। কিন্তু কিছুতেই মুখ খুলতে চাইছে না। আমার ধারণা ও গাড়ির নাম্বার দেখেছে। বড়বাবু বললেন।

অর্জুন তাকাল হাতকাটা পাঁচুর দিকে। নেপালের চোরাই মাল ধুলনমারি বর্ডার দিয়ে শিলিগুড়িতে ঢুকলে তা দেশের বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে যায়। এই পৌঁছে দেওয়ার কাজ যারা করত তাদের একজন ছিল হাতকাটা পাঁচু। ওর বাঁহাত কাটা বলে পুলিশ প্রথমদিকে সন্দেহ করত না। হাতকাটা পাঁচুর মা ছেলের এই কাজ সমর্থন করত না। অর্জুনদের বাড়িতে যে কাজের মহিলা আছে তার পরিচিত ছিল ওই মহিলা। সেই সূত্রে বাড়িতে এসে হাতকাটা পাঁচুর মা অর্জুনকে অনুরোধ করেছিল ওকে পাপের পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে। অর্জুন লোকটাকে ডেকে নরমে গরমে বোঝানোর পর সে বলেছিল কাজ ছেড়ে দিলে খাওয়ার পয়সা পাবে কোত্থেকে? অর্জুন তখন একটি বিখ্যাত কুরিয়ার কোম্পানির মালিকের সঙ্গে কথা বলে ওর চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সেই থেকে বদলে গিয়েছিল হাতকাটা পাঁচু।

তুমি গাড়িটার নাম্বার দেখেছ? অর্জুন জিজ্ঞাসা করেছিল।

না বাবু। ঝড়ের মতো ওটা চলে গেল সাইকেলটাকে ধাক্কা মেরে। লোকটা বলল।

বড়বাবু বললেন, দ্যাখো, নাম্বারটা জানলে আমরা গাড়িটাকে ধরতে পারি। ওইখানে সাইকেলটাকে ধাক্কা দেওয়ার আগে ফাটাপুকুরে একটা ভ্যানরিকশাকে ভেঙে ফেলেছে গাড়িটা। ভাগ্যিস ভ্যানরিকশায় কেউ ছিল না। মনে হচ্ছে কোনও অন্যায় করে দ্রুত পালাতে চেষ্টা করেছে গাড়িটা। নাম্বার মনে পড়ছে।

না বাবু, বিশ্বাস করুন।

হাতকাটা পাঁচুকে ছেড়ে দেওয়া হল। বড়বাবু দুঃখ প্রকাশ করলেন অর্জুনকে কষ্ট দেওয়ার জন্যে।

অর্জুন বাড়িতে ফিরছিল। গলির মুখে গাড়িটা দাঁড়িয়েছিল। দূর থেকেই সে মেজরকে দেখতে পেল, গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তার বিশাল চেহারা, একমুখ দাড়ি মাথায় টাক আর গ্যালিস দেওয়া প্যান্ট দূর থেকেই চেনা যায়। এরকম দ্বিতীয় ব্যক্তি এই শহরে থাকেন না। কাছে আসতেই মেজর হাত বাড়ালেন, গুড আফটারনুন। শুনলাম তুমি বাড়িতে নেই, তাই এখানেই অপেক্ষা করছিলাম।

কোথায় শুনলেন। করমর্দন শেষ করল অর্জুন।

আরে তোমার বাড়িটা গুলিয়ে ফেলেছিলাম। তাই একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই সে বলল একটু আগে তুমি বাইরে বেরিয়ে গেছ! চলো! মেজর বললেন।

কোথায়? অর্জুনের কৌতূহল হল।

আমার পুরনো জায়গায় আদি বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি।

না, যেমন ছিল তেমনই আছে।

*

হাবুকে দেখে মেজর মহাখুশি। দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করলেন যে ভাষায় সেটা অর্জুনের জানা নেই। হাবুর তখন ছেড়ে দে মা গোছের অবস্থা। ছাড়া পেয়ে মালপত্র নিয়ে সে ভেতরে চলে গেলে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, কী ভাষায় কথাগুলো বললেন?

স্প্যানিশ। আমেরিকার অর্ধেক মানুষই এখন এই ভাষায় কথা বলে। তুমিও ভাষাটাকে শিখে ফেলো।

ঘর পছন্দ হল। টয়লেটটাকে দেখে খুশি। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, কিছু খাবেন?

নো। একেবারে ডিনার। এখানে বসো। দার্জিলিং নয়, ঘুম থেকে যে দিকটা সান্দাকফু চলে গিয়েছে সেই দিকটা সম্পর্কে তোমার কোনও আইডিয়া আছে?

হ্যাঁ। আমি সান্দাকফু অবধি হেঁটে গিয়েছি। অর্জুন বলল।

গুড। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে হবে। শোনো, তোমাকে এখনই দুটো কাজ আমার জন্যে করতে হবে। এক, আমরা যেখানে যাব তার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য আমি গুল্ল থেকে সংগ্রহ করেছি। তোমাকে দেব, তুমি পড়বে। কিন্তু ওই এলাকা, অর্থাৎ ঘুম থেকে দার্জিলিং না গিয়ে মানেভঞ্জন নামে যে জায়গা রয়েছে সেখান থেকে একশো কিলোমিটারের মধ্যে যত পাহাড়ি গ্রাম বা মানুষ আছে তাদের সম্পর্কে আরও তথ্য দরকার। এখানে এখন কেউ আছেন যিনি ওসবের খবর রাখেন?

একটু খোঁজখবর করতে হবে। অর্জুন বলল।

কুইক। এর জন্যে বড়জোর দু’দিন সময় পাচ্ছ। দুই, ওসব জায়গায় যেতে কি সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হয়? হলে এই দু’দিনের মধ্যে সেটা নিতে হবে। চোখ বন্ধ করে ভাবলেন মেজর। তারপর বললেন, তিন আমার খুব খিদে পেয়েছে। হাবু কি কিছু করে দিতে পারবে?

হাবু ভালো ওমলেট বানাতে পারে।

মাই গড। ওই ওমলেট, বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেয়ে খেয়ে পেটে চড়া পড়ে গেছে। দেশে ফিরেছি, তার ওপর পশ্চিমবাংলায়, ধরো গোটা কয়েক ফুলকো লুচি আর বেগুন ভাজা কি এখানকার দোকানে কিনতে পাওয়া যাবে না? একটু ভাল দোকান যাতে ভেজাল ঘি তেল না দেয়!

মেজরের মুখের সবটাই দাড়িতে ঢাকা সত্ত্বেও অর্জুন তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। কী ছেলেমানুষ দেখাচ্ছে মেজরকে। সে বলল, এখন বিকেল, লুচি পাব না। পুরি পেতে পারি।

ওঃ। পুরি মানে আটার তৈরি। নোঃ! তার চেয়ে ওমলেটই ভাল।

দাঁড়ান। অর্জুন পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে ডায়াল করল। একটু পরে গলা কানে এলে সে বলল, অমলদার বাড়িতে আছি। মেজর এসে গেছেন। উনি এখানেই থাকবেন। কিন্তু এখন কি লুচি-বেগুনভাজা করে দেওয়া সম্ভব হবে? ওঁর তাই খেতে ইচ্ছে। ওপাশের উত্তর শুনে অর্জুন। বলল, ঠিক আছে।

সে ফোন বন্ধ করলে মেজর জিজ্ঞাসা করলেন, অর্ডার অ্যাকসেপ্ট করল?

অর্ডার নয়, আবদার। আপনার লুচি আধঘণ্টার মধ্যে রেডি হয়ে যাবে। আপনি জামাকাপড় চেঞ্জ করে ফ্রেশ হন, আমি নিয়ে আসছি। অর্জুন বলল।

কোত্থেকে আসবে?

আমাদের বাড়ি থেকে। মা কুড়ি মিনিটের মধ্যে বানিয়ে দেবেন।

যাচ্চলে! তুমি এসময় ভদ্রমহিলাকে আবার কিচেনে ঢোকালে?

আপনি ওসব খেতে চেয়েছেন শুনে মা খুব খুশি হয়েছেন।

কী যে বলি! দ্যাখো, নিউইয়র্কে আমি নিজেই রান্না করি। ওই যে, বাংলায় একটা কথা আছে, শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর গড়া তাই হয়! তবে প্রচুর বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে ভাত মাছ মাংস পাওয়া যায়। ওদের অনেক বলেছি কিন্তু সুক্তো বানাতে পারেনি। পৃথিবীর অন্য কোনও দেশ সুক্তো বানাতে পারে কিনা জানি না?

.

গোটা দশেক ফুলকো ঘিয়ে ভাজা লুচি, বেগুন ভাজা, আলু ফুলকপির চচ্চড়ি এবং একটু ক্ষীর খেয়ে চেঁকুর তুলে মেজর বললে, অনেকদিন বাদে নিজেকে বাঙালি বাঙালি মনে হচ্ছে হে।

হাবু চা দিয়ে গেল দু’জনের জন্যে। কাপে চুমুক দিয়ে অর্জুন বলল, এবার কাজের কথায় আসুন। কাদের সন্ধানে এসেছেন আপনি?

দাড়িতে আঙুল বুলিয়ে পাইপ ধরালেন মেজর। বাইরে তখন সন্ধের আঁধার নেমে গেছে। চায়ের কাপ রেখে চলে যাওয়ার সময় হাবু আলো জ্বেলে দিয়ে গিয়েছিল।

তৃপ্তির ধোঁয়া ছেড়ে মেজর বললেন, পৃথিবীটা এখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে কম্পিউটারের সৌজন্যে। যে-কোনও বিষয়ে জানতে হলে সার্চ করলেই সব তথ্য পেয়ে যাবে। কিন্তু কোনও কোনও তথ্য গুগল দিতে পারবে না। যেমন কম্পিউটার তোমাকে আর একটা ওল্ড ম্যান ল্যান্ড কিনে দিতে পারবে না। রাইট?

মাথা নাড়ল অর্জুন। ভূমিকা ছেড়ে মেজর কখন ভূমিতে নামবেন তার জন্যে সে তৈরি।

মেজর বললেন, জনের সঙ্গে আমার আলাপ প্রায় বাইশ বছর আগে। আমি তখন ইন্টারন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির সদস্য হিসেবে কাজ করছি। দানিকেন যেসব তথ্য দিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন সেগুলো নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছিল। সত্যি মহাকাশের অন্য কোনও গ্রহ থেকে পৃথিবীতে আরও উন্নত প্রাণীরা নিয়মিত আসা-যাওয়া করেছিল কি না, করলে সেটা এখন বন্ধ হয়ে গেছে কেন? জন আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। লোকটা আমারই বয়সি। চিবুকের ছাগলদাড়ি একদম সাদা, রোগা কিন্তু শরীরে শক্তি আছে। লোকটা একসময় অধ্যাপনা করত। আমার সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গেল। মাঝে মাঝে, নিউইয়র্কে থাকলে, আমার ফ্ল্যাটে আসত। ওর বউ মেয়ে থাকত ক্যালিফোর্নিয়ায়। ওদেশে এরকম অনেক পরিবার আছে যাদের দাম্পত্য জীবন বলতে কিছু নেই।

বছর বারো আগে আমি খবর পেলাম দক্ষিণ আমেরিকায় একটি গ্রামের লোকজন যারা এখন সভ্যতার কাছে ঘেঁষতে চায় না, তারা আকাশে প্লেন দেখলে বা আওয়াজ শুনলে মাটিতে শুয়ে পড়ে প্রার্থনা করতে থাকে।

ব্যাপারটা আমার কাছে রহস্যজনক বলে মনে হল। সোসাইটি থেকে আমরা তিনজন রওনা হলাম। বহু কষ্টে সেই গ্রামে পৌঁছে জানলাম ওরা ওদের পূর্বপুরুষদের মতো আকাশে শব্দ করা পাখি দেখলেই মাটিতে শুয়ে পড়ে প্রণাম জানায়। এসব নিয়ে আমরা অনেক তথ্য সংগ্রহ করে ফিরে আসার কিছুদিন পরে নিউইয়র্কের একটা কাগজে জনের লেখা আর্টিকেল বের হল। আমাদের তিনজনের যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা সে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছে। সেই থেকে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিন্ন হয়ে গেল। সোসাইটিও তাকে সাসপেন্ড করল।

মাস চারেক আগে হঠাৎ জন আমাকে ফোন করে তেইশ বছর আগেকার কাজের জন্যে দুঃখ প্রকাশ করল। সময় মানুষকে অনেক ক্ষত ভুলিয়ে দেয়। আমি তার সঙ্গে ভদ্রভাবে কথা বললাম। তখন সে আমাকে ওয়েস্টবেঙ্গলের বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে দার্জিলিং জেলায় যাওয়ার কী ব্যবস্থা আছে তা জানতে চাইল। আমি যেটুকু জানি বললাম তাকে। তার বেশ কিছু পরে সে আবার ফোন করে জানাল যে তার মেয়েকে নিয়ে ওই অঞ্চলে কিছু কাজে যাচ্ছে। যদি কোনও অসুবিধেয় পড়ে তা হলে এমন কেউ আমার জানাশোনা আছে কি যার সঙ্গে সে যোগাযোগ করতে পারে? আমি স্বচ্ছন্দে তোমার বা অমলবাবুর টেলিফোন নাম্বার দিতে পারতাম। কিন্তু লোকটার সততা সম্পর্কে আমার সন্দেহ ছিল বলে আমি অক্ষমতা জানালাম।

নিভে যাওয়া পাইপ আবার ধরালেন মেজর। তারপর বললেন, জন ওর মেয়ে ক্রিশ্চিনাকে নিয়ে চলে এসেছিল। ওর আসার কথা আমি জানলাম সোসাইটি থেকে। ওর স্ত্রী পুলিশকে জানিয়েছে যে, তার স্বামী বা মেয়ের কোনও খোঁজখবর পাচ্ছে না। আমাদের ইন্টারন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির কাছেও সে আবেদন করেছে স্বামীর খবরের জন্যে। ইউ এস এ সরকার ভারত সরকারের কাছে সাহায্য চেয়েছিল, ভারত সরকার জানিয়েছেন কোনও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, কী কাজে এসেছেন উনি?

লোকটা অত্যন্ত ধুরন্ধর। টেলিফোনে আমাকে বলেছিল কিছু কাজের জন্যে যাচ্ছে। কী সেই কাজ তা ভেঙে বলেনি। আমি শুনতে চাইনি। কিন্তু ওরা নিরুদ্দিষ্ট হওয়ার পর সোসাইটি ভদ্রতা করে আমাকে বলে খোঁজ নিতে। আমি ক্যালিফোর্নিয়াতে গিয়ে ওর স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করি। দেখলাম ভদ্রমহিলা অত্যন্ত আটপৌরে, স্বামী বা মেয়ের অভিযান নিয়ে মাথা ঘামায়নি, কোনও তথ্য তার জানা নেই। শুধু জানে ইন্ডিয়ার একটা স্টেটের নাম ওয়েস্টবেঙ্গল। তার নর্থে হিমালয় পাহাড়ে ওরা কোনও কিছুর সন্ধানে গিয়েছে। যদি ওরা না ফেরে, যদি মারা গিয়ে থাকে তা হলে সেই খবরটাও তার জানা দরকার। আমি জন-এর স্ত্রীকে অনুরোধ করলাম তার স্বামীর স্টাডিরুমে নিয়ে যেতে। গিয়ে কিছুই পেলাম না।

নিউইয়র্কে ফিরে এসে সোসাইটি জানালাম। তারপর পুলিশের সাহায্য নিয়ে আমি ওর নিউইয়র্কের ফ্ল্যাটে ঢুকলাম। খুব অগোছালো ফ্ল্যাট। যে ঘরে ওর বই, লেখার টেবিল রয়েছে সেখানে গিয়ে দেখলাম দার্জিলিং এবং হিমালয় বিষয়ক প্রচুর বই, ম্যাগাজিনের ছাপা খবরের অংশ কেটে ফাইল করে রাখা আছে। একটা ম্যাপও পেয়ে গেলাম। তার কয়েকটা জায়গায় গোল দাগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওইসব জায়গায় জন কীসের খোঁজে গিয়েছে, কী তার কাজ তা বুঝতে পারলাম না। একটা কাগজের প্রবন্ধে দেখলাম লাল দাগ দিয়েছে জন। পাহাড়ের যেদিকটায় এখনও কোনও যাতায়াতের পথ তৈরি হয়নি, বছরের অর্ধেক সময় যেসব অঞ্চলে তুষারে ঢাকা থাকে সেখানে কিছু প্রাণীকে অদ্ভুতভাবে হাঁটতে দেখেছেন ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমানের পাইলটরা। প্রায় কুড়ি হাজার ফুট উঁচুতে সেইসব বিমান ওড়া সত্ত্বেও আওয়াজ শুনতে পেয়ে প্রাণীগুলো দ্রুত লুকিয়ে পড়েছে। পাইলটরা বলেছেন, হাঁটার ভঙ্গি দেখে মানুষ বলেই মনে হয়েছে তাঁদের। ওই জায়গা ছাড়িয়ে আরও কিছুটা এগোলে উনিশশো সত্তর সালে একটি বিমান দুর্ঘটনা হয়েছিল। জায়গাটা এত দুর্গম যে উদ্ধারবাহিনী পৌঁছেছিল কয়েক মাস পরে কিন্তু কোনও জীবিত মানুষ দূরের কথা, মৃত মানুষের শরীরও দেখতে পায়নি!

জন তা হলে কীসের সন্ধানে ওখানে গিয়েছে? গিয়ে হারিয়ে গেল কোথায়? সঙ্গে সে মেয়েকে নিয়ে গিয়েছে। তার বয়স এখন উনিশ। ওরকম জায়গায় তো পার্কে বেড়াতে যাওয়ার মতো কেউ যায় না। সঙ্গে শেরপা না হোক, লোকজন সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়েছে। তারা কোথায় গেল? তা ছাড়া এরকম একটি অনিশ্চিত অভিযানে কেউ মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যায়? সোসাইটি আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে ঘটনাস্থলের যতটা সম্ভব কাছাকাছি গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে একটা রিপোর্ট তৈরি করতে। মেজর গম্ভীর হলেন।

কিন্তু এটা তো প্রায় অভিযানের মতো ব্যাপার। খরচ হবে প্রচুর।

ওটা তোমার ভাবার বিষয় নয়। ওখানে যেতে হলে যে প্রস্তুতি নেওয়া দরকার তার খরচ দিচ্ছে সোসাইটি। ক্যামেরাম্যানের কাজটা আমিই করব। আর এইজন্যে যে সময় দেবে এবং পরিশ্রম করবে তার পারিশ্রমিক তুমি পাবে। ওকে?

আপনার কি মনে হয় ওরকম জায়গায় ওঁরা বেঁচে আছেন?

অন্য কেউ হলে খারাপটাই ভাবতাম কিন্তু জন-এর মতো লোক অত সহজে মরার পাত্র নয়। এখন একজন এক্সপার্টকে বের করো যিনি এই ম্যাপ পড়তে পারবেন। তার কাছে অনেক কিছু জেনে নেওয়ার আছে। মেজর বলেছিলেন।

মেজরের নাক ডাকায় বৈচিত্র্য আছে। ঘুম যত গম্ভীর হয় তত তার আওয়াজ বদলায়। সন্ধের পরে হ্যামকে শুয়েই যখন ঘুমালেন তখন মনে হচ্ছিল বাঘ ডাকছে। এখন বাঘ ব্যাং হয়ে গিয়েছে। থেমে থেমে, বর্ষার রাত্রে যে ব্যাঙের ডাক শোনা যায়, অবিকল সেইরকম।

অনেকক্ষণ জেগেছিল অর্জুন। পাহাড়ে, বিশেষ করে বরফের ঠান্ডায় যেতে হলে যে পোশাক দরকার তা কিনতে চেয়েছিলেন মেজর। কিন্তু শিলিগুড়িতে যা পাওয়া গিয়েছে তা যেমন ভারী তেমনই ওই শীতে অচল। একরাত দার্জিলিং-এ থেকে টাকা জমা রেখে ভাড়া নিয়ে নিলেন মেজর। শুধু শীতের পোশাক নয়, জুতো মোজা গ্লাভস এবং টুপি। তারপর একটা কিউরিও শপে ঢুকে এটা ওটা দেখতে দেখতে লাঠিটাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন, বললেন, এই লাঠি আমি পানামায় দেখেছি। দ্যাখো, মাঝখানে এটা চামড়ার স্ট্র্যাপের খোপে আটকানো। স্ট্র্যাপটা কোমরে বেঁধে নিতে হবে।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করেছিল, কোমরে লাঠি বেঁধে ঘোরে ওরা?

মেজর বলেছিলেন, মিলিয়ন ডলার কোয়েশ্চেন। উত্তর দিতে পারেন এই দোকানের মালিক। তারপর দূরে দাঁড়ানো তিব্বতি পোশাক পরা বৃদ্ধ মালিককে ইশারায় কাছে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কোথাকার জিনিস।

সাংহাই।

অ্যাঁ? কোথায় পানামা আর কোথায় সাংহাই! একটু দেখতে পারি? ভদ্রলোক ওটা মেজরের হাতে তুলে দিয়ে বললেন, বি কেয়ারফুল? মেজর লাঠিটাকে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, নাঃ, আমার ভুল হয়নি। অর্জুন দেখল লাঠির দৈর্ঘ্য বেশি নয়। সে জিজ্ঞাসা করল। বিশেষত্ব কী?

মেজরকে খোঁজাখুঁজি করতে দেখে বৃদ্ধ মালিক তার হাত থেকে লাঠি ফেরত নিয়ে পেছনে চাপ দিতেই সেটা দ্রুত ছোট হয়ে প্রায় হ্যাঁন্ডেল হয়ে গেল এবং সেই হ্যাঁন্ডেল থেকে একটি দেড় ফুট ইস্পাতের সরু চকচকে ফলা দেখা দিল। মেজর মাথা নাড়লেন, ইয়েস। কারেক্ট। সেই জিনিস। তবে এটা একফলা, পানামাটায় তিনফলা।

বৃদ্ধ মালিকের হাত থেকে বস্তুটি নিয়ে দু’বার শূন্যে চালিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, বস্তুটির দাম কত?

এসব জিনিস এখন এখানে পাওয়া যায় না সাহেব। দু’মাস আগে একজন চিনে ট্যুরিস্টের খুব টাকার দরকার হওয়ায় বিক্রি করেছিল। আপনি পাঁচ হাজার দিন।

মাই গড! আমি পানামায় মাত্র একশো আমেরিকান ডলারে পেয়েছিলাম।

ঠিক আছে, আপনি পাঁচশো কম দিন, তা হলে একশো ডলারই হয়ে যাবে।

অ্যাঁ? চোখ ছোট হয়ে গেল মেজরের। তারপর বললেন, ও।

অর্জুন বলেছিল, চলুন, টাকা নষ্ট করবেন না!

বলছ? ঠিক আছে। মেজর কিউরিও শপ থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন।

কিন্তু দার্জিলিং থেকে ঘুম হয়ে মানেভঞ্জনে পৌঁছে যখন একটা রাত থাকার প্রয়োজন হয়ে গেল তখন মেজর তার সুটকেস থেকে লাঠিটাকে বের করে অর্জুনকে উপহার দিলেন, এটা তোমার জন্যে।

এ কী? আপনি আবার ওই দোকানে গিয়ে অত দাম দিয়ে কিনলেন?

রেয়ার জিনিস। কাছে রেখে দাও। অভিযানে যাচ্ছি, কখন কীভাবে কোন বিপদ আসবে তা তো জানো না। এলে এই হয়তো বাঁচাবে। যাই বলো, চিনে সভ্যতার সঙ্গে পানামা সভ্যতার নিশ্চয়ই এককালে যোগাযোগ ছিল। দাঁড়াও, এর ছবি তুলি।

মোবাইলে সময় দেখল অর্জুন। রাত সাড়ে নটা। জলপাইগুড়ির কদমতলায় এখন তুমুল আড্ডা চলছে। অথচ এখানে মনে হচ্ছে নিশুতি রাত। ঘুম যখন আসছে না তখন বাইরে গিয়ে দাঁড়ানো যাক। অর্জুন খানিকটা শীতবস্ত্র শরীরে চাপিয়ে তাঁবুর দরজা ঈষৎ খুলে বাইরে আসতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। পূরণ বাহাদুর বলেছিল, আবার ঝড়বৃষ্টি হবে। কোথায় বৃষ্টি! পৃথিবী যেন দুধসাদা জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। অথচ আজকের চাঁদের পূর্ণিমায় পৌঁছাতে দেরি আছে। কনকনে শীত মুখের খোলা অংশে দাঁত বসাচ্ছিল। টুপিটাকে নামিয়ে দিল সে খানিকটা। ওদিকে মালবাহকদের তাবু ঝুম মেরে রয়েছে। দিনের পরিশ্রম রাতের ঘুমকে গাঢ় করেছে। হঠাৎ মনে হল ওপাশের পাহাড় বেয়ে নেমে আসতে আসতে থেমে গেল কিছু। অর্জুন কয়েক পা পিছিয়ে তাবুর আড়ালে চলে এল।

একটা দুটো করে গোটা সাতেক তাগড়াই প্রাণীকে সন্তর্পণে নামতে দেখল অর্জুন। এগুলোই কি পাহাড়ি শুয়োর? তাঁবুর পঞ্চাশ গজের মধ্যে এসে ওরা দাঁড়িয়ে মুখ ওপরের দিকে তুলে যেন কিছু শোঁকার চেষ্টা করল। এই জ্যোৎস্নায় বোঝা যাচ্ছিস ওদের শরীর জুড়ে লম্বাটে লোম। দুটো দাঁত দু’দিক দিয়ে বেরিয়ে আছে। অর্জুনের মনে হল পূরণ বাহাদুরদের এখনই ডাকা উচিত। কিন্তু চিৎকার করতেই ওরা বুঝে যাবে, যদি রাগী হয় তা হলে সোজা আক্রমণ করবে।

অর্জুন দেখল হঠাৎ ওরা দৌড়ে গেল ডানদিকে। সাতটা শুয়োর ঝাঁপিয়ে পড়ল কোনও কিছুর ওপর। যারা ভাগ্যবান তারা চিবোতে লাগল কিছু। বাকিরা গোঁ গোঁ শব্দে রাগ জানাচ্ছিল। ওরা যখন ওদিকে মগ্ন তখন অর্জুন নিঃশব্দে ঢুকে পড়ল তাঁবুর ভেতরে। মেজর বোধহয় এইসময় নাক ডাকায় সাময়িক বিরতি নিয়েছেন।

চাপা গলায় তাকে ডাকল অর্জুন, মেজর! মেজর।

হু আর ইউ? বিরক্ত হলেন মেজর।

আমি অর্জুন। কথা বলবেন না। চুপচাপ উঠে পড়ুন।

অর্জুন দেখল প্রায় পুতুলের মতো উঠে বসলেন মেজর। অর্জুন বলল, সেই পাহাড়ি শুয়োরগুলো এসেছে। গর্জন শুনতে পাচ্ছেন?

মেজর কান খাড়া করলেন। তারপর হাত বাড়ালেন, গিভ মি দ্যাট স্টিক।

কী করবেন ওটা দিয়ে?

কিছুই করব না। তবে আত্মরক্ষার জন্যে সঙ্গে রাখব।

অর্জুন অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে ওটা পেয়ে মেজরকে দিল। ততক্ষণে মেজর আপাদমস্তক শীতবস্ত্রে নিজেকে মুড়ে নিয়েছেন। লাঠিটাকে হাতে নিয়ে তিনি বেশ সন্তর্পণে তাঁবুর বাইরে গিয়ে দাঁড়ালেন। ততক্ষণে শুয়োরগুলো আরও এগিয়ে এসেছে। তাদের সামনে মালবাহকদের তাবু। হঠাৎ প্রচণ্ড চিৎকার শুরু করলেন মেজর, আই শালা শুয়োরের বাচ্চা, অ্যাই বাচ্চা শুয়োর, স্কাউড্রেলদের দল, অ্যাই এগিয়ে আয়, তোদের আজ জ্যাম বানিয়ে রোস্ট করে খাব। আয়, আয়–!বলছেন আর হাতের লাঠি তুমুলবেগে। নাড়ছেন।

শুয়োরগুলো ঘাবড়ে গেল। এরকম অভ্যর্থনার সঙ্গে বোধহয় তারা পরিচিত ছিল না। দ্রুত পিছিয়ে গেল কিছুটা। তাতে আরও উৎসাহিত হলেন মেজর। লাঠির পেছনের বোতাম টিপে ইস্পাতের ফলা বের করে তিনি চেঁচালেন, অ্যাই ছুঁচোর দল। পালাচ্ছিস কেন? তো এগিয়ে আয়। বলতে বলতে নিজেই এগোতে লাগলেন মেজর।

অর্জুন পেছন থেকে চেঁচাল, আর এগোবেন না, চলে আসুন।

চুপ করো। ল্যাসো আছে? ল্যাসো?

এখানে ল্যাসো কোথায় পাব!’ অর্জুন হাসতে গিয়েও পারল না।

মেজরের চিৎকার শুনে মালবাহকরা হইচই শুরু করল। পূরণ বাহাদুর এবং একজন লম্বা লাঠি নিয়ে বেরিয়ে এল। শুয়োরগুলো পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করল। মেজর ততক্ষণে অনেকটা এগিয়ে গিয়েছেন। পূরণ বাহাদুর তাকে নিষেধ করছে, ফিরে আসতে বলছে।

মেজর সমানে চেঁচাচ্ছেন, ল্যাসো থাকলে বাপের নাম ভুলিয়ে দিতাম। আয়, কত সাহস আছে দেখি।

একটি শুয়োরের বোধহয় এত আস্ফালন সহ্য হল না। আচমকা সে ঘোঁত ঘোঁত করে তেড়ে গেল মেজরের দিকে। মুখ নিচু, দাঁত দিয়ে রাগ মেটাবে। অন্যরা দূরেই দাঁড়িয়ে থাকল। অর্জুন চিৎকার করল। মেজর দৌড়ে চলে আসুন।

মেজর নড়লেন না, এসো বাছা, এসো। চুক চুক চুক চুক।

জিভের শব্দ কানে যেতেই গতি কমিয়ে শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে গেল জন্তুটা। ওরকম বোকা জন্তু জীবনে দ্যাখেনি মনে করে হো হো করে হেসে উঠলেন মেজর। সেই হাসি কানে যেতে ঘাবড়ে গেল শুয়োর। আক্রমণ করার চেয়ে পিছু হঠাই শ্রেয় মনে করল সে। তাকে ঘুরতে দেখে মেজর প্রবল শক্তিতে ইস্পাতের ফলা চালালেন। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠে শুয়োরটা ছুটে গেল সঙ্গীদের কাছে। সঙ্গীরাও দৌড়াল চোখের আড়ালে। তাদের অনুসরণ করল আহত শুয়োর। কিন্তু তার কান্না থামছিল না। ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছিল তার কান্নার শব্দ।

মেজর একটু এগিয়ে উবু হয়ে মাটি দেখে আফশোসের গলায় বললেন, মাত্র আধ ইঞ্চির জন্যে ফসকে গেল হে!

ততক্ষণে অর্জুন এবং পূরণ বাহাদুররা চলে এসেছিল মেজরের কাছে। পূরণ বাহাদুর বলল, রক্ত পড়েছে। আপনি খুব ভুল করছিলেন।

ভুল? কেন? মেজর অবাক।

যদি ওর রক্ত না বের হত তা হলে আপনাকে মেরে ফেলত।

অত সোজা?

হ্যাঁ সাহেব। পাহাড়ি শুয়োরের দাতে মারা গিয়েছে অনেকে।

মেজর ইস্পাতের ফলায় রক্তের দাগ দেখলেন। তারপর অর্জুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, খুব জোর বেঁচে গেল শুয়োরটা, বুঝলে?

সেটা তো দেখতেই পেলাম। চলুন, শুয়ে পড়া যাক। অর্জুন বলল।

শোবে? এখন? ভোর হতে তো দেরি নেই!

এখনও মাঝরাত হয়নি এবং আমি একটুও ঘুমাইনি!

মাই গড!’

দূর থেকে তখনও শুয়োরের আর্তনাদ ভেসে আসছিল। যদিও শব্দটা খুবই ক্ষীণ। মেজর কান পেতে সেটা শুনে বললেন, চলো, দেখে আসা যাক।

পূরণ বাহাদুর তীব্র আপত্তি জানাল, না সাহেব। এখন ওখানে গেলে আর বেঁচে ফিরতে পারবেন না। আহত জন্তু খুব ভয়ংকর হয়।

ওকে!’

এইসময় হাওয়া জোরালো হল। গরম পোশাক থাকা সত্ত্বেও বেশ কেঁপে উঠল অর্জুন। সে দ্রুত তাঁবুর ভেতরে ঢুকে গেলে মেজর অনুসরণ করলেন।

স্বচ্ছন্দে। মেজর এতক্ষণে তার তির বের করলেন। চ্যাপটা ছোট মেটাল পাত্রে ব্র্যান্ডি ভরা আছে। সেটা খুলে একটু ঢাললেন। এবার জলপাইগুড়িতে আসা অবধি মেজরকে ওটা বের করতে দ্যাখেনি অর্জুন। বোঝায় যাচ্ছে এখন বেশ নার্ভাস হয়ে পড়েছেন।

অর্জুন বলল, আপনি পাঁচমিনিট বাদে হ্যামকে উঠলে ভাল হয়। ততক্ষণে আমি ঘুমিয়ে পড়ব।

বেশ বেশ। ঘুমিয়ে পড়ো।

*

জলপাইগুড়ি শহরে কোনও পর্বত বিশেষজ্ঞ আছেন কিনা তা অর্জুনের জানা ছিল না। অথচ মেজর নেটের তথ্য ছাড়াও অভিজ্ঞতা আছে এমন লোকের কাছ থেকে বিশদে জানতে বলেছেন। হাবু গিয়ে মায়ের কাছ থেকে মেজরের রাতের খাবার নিয়ে আসার পর বাড়িতে ফিরছিল অর্জুন। গলির মুখে এসে দেখল হাতকাটা পাঁচু দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে দ্রুত ছুটে এসে ভাল হাতটা কপালে ছুঁয়ে কঁদোকাঁদো গলায় বলল সে, আমাকে মাপ করে দিন।

কেন? আবার কী করেছ?

আমি তখন আপনার সামনে বড়বাবুকে মিথ্যে কথা বলেছি।

তার মানে তুমি গাড়ির নাম্বার দেখা সত্ত্বেও বলতে চাওনি?

হ্যাঁ বাবু। শুধু নাম্বার কেন, ওই গাড়ি, গাড়ির মালিক, সবাইকে চিনি।

তা হলে বললে না কেন?

বললে আমার লাশ পড়ে যেত বাবু। শয়তানের চেয়েও ভয়ংকর ওই লোকটা!

আমাকে এত রাত্রে সেটা বলার জন্যে দাঁড়িয়ে আছ?

আমি নিমকহারাম নই। আপনি আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। থানা থেকে বেরিয়েই মনে হল এটা কী করলাম? বড়বাবুকে বললে অন্য পুলিশরা জানতে পারত। তারা জানলেই খবর পৌঁছে যেত। তাই ভাবলাম, আপনাকে সত্যি কথাটা বলা দরকার। হাতকাটা পাঁচুর গলার স্বর বেশ করুণ।

লোকটা কে?

বাঙালি নয়। ওকে প্রথম দেখি ধুলামারিতে। পাহাড়ে ওর অনেক ক্ষমতা। ওই যেসব জিনিস নেপাল হয়ে আসে সেগুলোর ব্যাবসা উনিই করেন। হাতকাটা পাঁচু বলল।

তুমি জানলে কী করে?

আজ্ঞে, আমি তো তখন ওদের কাছে কাজ করতাম।

লোকটার নাম কী?

সবাই ওকে পাণ্ডেজি বলত।

তা এই লোকটা ফাটাপুকুর হয়ে দেবী চৌধুরানির কালীবাড়ির সামনে গিয়ে কোথায় যাচ্ছিল তা তুমি অনুমান করতে পারো?

হাতকাটা পাঁচু প্রথমে মাথা নেড়ে না বলল। তারপর একটু ভেবে বলল, শুনেছি চালসার কাছে মুক্তি নদীর গায়ে ওর একটা বাংলো আছে।

ঠিক আছে। যাও।

হাতকাটা পাঁচুর মুখে হাসি ফুটল।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার