সকাল সাড়ে সাতটায় ওরা রওনা হল। বারোজন মানুষ এত লটবহর নিয়ে অবলীলায় হেঁটে চলেছে অথচ চড়াই ভাঙতে তাদের বেশ কষ্ট হচ্ছিল। মেজর তো প্রায়ই থেমে যাচ্ছিলেন। যাতে বাধ্য হয়ে অর্জুনকেও তার পাশে দাঁড়াতে হচ্ছিল। আধঘণ্টা হাঁটার পর একটাই লাভ হল, ঠান্ডা আর তেমন মারাত্মক বলে মনে হচ্ছিল না। উলটে একটু একটু ঘাম বের হচ্ছিল। মেজর চেঁচিয়ে পূরণ বাহাদুরকে ডাকলেন, মালবাহকরা এগিয়ে গিয়েছিল, পূরণ বাহাদুর ফিরে দাঁড়াল। মেজর বললেন, ওদের বলো একসঙ্গে যেতে।

পূরণ বাহাদুর বলল, না সাব। পাহাড়ের নিয়ম হল যতটা সম্ভব এগিয়ে যাওয়া। কেউ না পারলে সে থেকে যাবে কিন্তু তার জন্যে অন্যেরা এগোনো বন্ধ করবে না। তবে কেউ যদি খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে তা হলে অন্য কথা। বলে সে আবার হাঁটতে লাগল।

মেজর বিরক্ত হলেন। বললেন, কারেক্ট। এটাই নিয়ম। তাই বলে কি নিয়ম ভাঙা যায় না?

অর্জুন বলল, আপনার রুকস্যাকটা আমাকে দিন।

নো। নেভার। আমার জিনিস আমি নিজেই বইতে চাই। ইন দি ইয়ার নাইটিন–।

মেজর, হাঁটার সময় কথা বলা উচিত নয়।

হ্যাঁ? ওকে। লেটস গো।

যত ওপরে উঠছে তত সবুজ কমে আসছে। এখনকার গাছগুলো কেমন শুকনো শুকনো। দুরে যে পাহাড়ের চুড়ো বরফে মোড়া ছিল সেগুলো একটু একটু করে কাছে এগিয়ে আসছে। আকাশ পরিষ্কার। এত নীল আকাশ আগে দেখেনি অর্জুন। মনে হচ্ছিল পৃথিবীর কোথাও কোনও মালিন্য নেই। একটা বাঁক ঘুরতেই দলটাকে দেখা গেল। জনাসাতেক মানুষ যাদের চেহারা এখন। বেশ বিধ্বস্ত নীচে নেমে আসছে। দেখেই বোঝা যায় ওরা কোনও পাহাড়ের চুড়োয় উঠতে গিয়েছিল। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কেউ কোনও শব্দ উচ্চারণ করল না। অর্জুন দেখল, পূরণ বাহাদুর দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে দলটাকে দেখছে। তার কাছে গিয়ে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল কী হয়েছে?

সাব এরা মানেভঞ্জন থেকে এই পথে আসেনি। পূরণ বাহাদুর জানাল।

কী করে বুঝলে?

ওখান থেকে যেসব সাবরা কোনও অভিযানে যায় তাদের খবর তো আমাদের রাখতেই হয়। ওদের মাল যারা বইছে তাদের কাউকে আমি চিনি না। নিয়ম হল মানেভঞ্জন থেকেই লোক নিতে হবে। ওরা বেআইনি কাজ করেছে।

কিন্তু ওরা এসেছে কোন পথে?

মনে হচ্ছে ঘুম থেকে ডাইরেক্ট গাড়িতে চেপে সান্দাকফু যাওয়ার পথে বিকেভঞ্জনে নেমেছে। বিকেভঞ্জন থেকে চোরাই পথে রিয়াচক ভ্যালিতে এই পথে গিয়েছিল। আবার একইভাবে ওরা বিকেভঞ্জন ফিরে গেলে মানেভঞ্জনের কেউ জানতেই পারবে না। লোকগুলো একদম ভাল না।

ওরা যদি কোনও অভিযানে গিয়ে থাকে তা হলে এই লুকোচুরি কেন করবে?

কার মাথায় কী আছে তা ভগবান জানেন। কিন্তু ওরা খারাপ লোক।

দশটা নাগাদ ব্রেকফাস্টের জন্যে বিশ্রাম নেওয়া হল। রুটি, সবজি আর ডিম সেদ্ধ নিয়ে এসেছিল পূরণ বাহাদুররা। পাথরের ওপর বসে সামনে পা ছড়িয়ে মেজর নিমেষে সেটা শেষ করে বললেন, দেখো তো, আর একটা ডিম পাওয়া যাবে কি না। আজ একটাতে ঠিক–!

আপনার এই বয়সে দুটো খাওয়া কি ঠিক হবে? অর্জুন আপত্তি করল।

উটপাখির ডিম খেয়েছ কখনও?

না। সেই সৌভাগ্য আমার হয়নি।

আমি খেয়েছি। ইয়া বড় বড় ডিম। তিন তিনটে যখন সাবাড় করে দিলাম তখন আমাদের অভিযানের ডাক্তারের চোখ কপালে। আমার নাকি পেট খারাপ হবেই, কোথায় কী! দিব্যি হজম করে ফেলেছিলাম।

কিন্তু পূরণ বাহাদুর জানাল আজ প্রত্যেকের জন্যে একটাই ডিম সেদ্ধ করে আনা হয়েছে। সাহেব যদি চান তা হলে কাল থেকে দুটো দেওয়া হবে। ব্রেকফাস্টের পরে ওরা আবার ম্যাপ নিয়ে বসল। যে জায়গায় জনকে পাওয়া যেতে পারে বলে মেজরের ধারণা সেখানে পৌঁছাতে এখনও অনেকটা পথ বাকি।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, এবার বলুন, মেয়েকে নিয়ে জন কীসের খোঁজে এসেছিলেন।

সেটা আমরা কেউ স্পষ্ট জানি না। তবে এটা বুঝেছি সে কিছুর সন্ধানে এসেছিল। এইসব জায়গা সে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে জানার চেষ্টা করত। হয়তো কোনও পাহাড়ি জন্তু যাকে মানুষ কখনও দেখেনি, তার একটাকে ধরে নিয়ে গেলে গোটা পৃথিবীতে হইচই পড়ে যাবে, তার সন্ধানে এসেছিল। কিংবা এখানকার মাটির নীচে এমন কিছু মূল্যবান জিনিস আছে যা বের করতে পারলে সে কয়েকশো কোটি টাকা রোজগার করবে বলে ভেবেছিল। একা ওর পক্ষে সম্ভব নয় বলে বাইরের কাউকে সঙ্গে না এনে নিজের মেয়েকে এনেছিল। আমাদের ইন্টারন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির কিছু সদস্য মনে করছেন, এতদিন পাহাড়ে নিখোঁজ থাকা মানে মরে যাওয়া। কিন্তু দুটো মানুষই মরে যাবে এখনও ভাবা যাচ্ছে না। মেজর বললেন।

পূরণ বাহাদুর তাগাদা দিলে মেজর বললেন, এবার আমাদের উচিত ঠান্ডার হাত থেকে বাঁচার জন্যে পোশাক চাপানো।

ওই পোশাক জুতো পরে জোরে হাঁটতেই পারবেন না। ঠান্ডা কত?

মেজর পকেট থেকে যন্ত্র বের করে দেখলেন, তিন ডিগ্রি। এখনও অবশ্য তেমন অসুবিধে হচ্ছে না।

হাঁটা শুরু হল। বেলা সাড়ে বারোটায় একটা বারোজনের দলের মুখোমুখি হল ওরা যার দুই মালবাহকই পূরণ বাহাদুরের পরিচিত। দুই অভিযাত্রীর সঙ্গে আলাপ করল অর্জুন। একজন ইতালিয়ান অন্যজন ফরাসি। ওঁরা অ্যাডভান্স পার্টির হয়ে সার্ভে করতে এসেছেন। সামনের বছর মূল অভিযান হবে। কাঞ্চনজঙ্ঘায় এদিক দিয়ে ওঠা সম্ভব কি না তাই দেখার জন্যে এ বছর আসা।

ইতালিয়ান ভদ্রলোক বললেন, স্যার, আপনি এত ভারী শরীর নিয়ে পাহাড়ে হাঁটছেন, অসুবিধে হচ্ছে না?

মেজর গম্ভীর গলায় বললেন, তুমি যখন তোমার মায়ের পেটে আট মাস ছিলে তখন কি তার হাঁটতে অসুবিধে হত?

হত, তেমন বেশি নয়।

সেম টু মি।

আপনাদের এখানে আসার উদ্দেশ্য কী? ফরাসি জিজ্ঞাসা করল।

মেজর উত্তর দিলেন, কোনও উদ্দেশ্য নেই। বেড়াতে এসেছি।

ফরাসি ভদ্রলোকের মুখ দেখে বোঝা গেল তিনি কথাটা বিশ্বাস করলেন । অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, রিয়াচক ভ্যালিতে কোনও গ্রাম পেয়েছেন?

না। শেষ গ্রাম দেখলাম এখান থেকে এক ঘণ্টা দূরে, কিন্তু গ্রামে খুব অল্প মানুষ থাকে। ইতালিয়ান বললেন।

শুনেছি দু’জন আমেরিকান অভিযাত্রী, যাঁদের একজন মহিলা কিছুদিন আগে এদিকে এসেছেন। আপনাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল। দু’জনেই মাথা নেড়ে না বললেন। ইতালিয়ান বললেন, আমরা রিয়াচক ভ্যালির দক্ষিণ দিকটা ভাল করে দেখেছি, সেখানে কেউ নেই। উত্তর দিকটায় যাওয়ার দরকার হয়নি। সেদিকে ওঁরা থাকতে পারেন।

ওঁরা বিদায় নেওয়ার পর মেজর বললেন, কাজটা একটু হালকা হল।

কীরকম? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

আমরা দক্ষিণদিকে না গিয়ে উত্তরদিকে যাব। মেজর ঘোষণা করলেন।

অর্জুনেরও মনে হল মেজরের সিদ্ধান্তটা ঠিক। কিন্তু পূরণ বাহাদুর আপত্তি জানাল, না সাব। উত্তরদিকটায় যেতে আপনাদের খুব অসুবিধে হবে। আর ঘণ্টা দুয়েক হাঁটলে বরফ শুরু হয়ে যাবে ওইদিকে। দক্ষিণদিকে বরফ অনেক দূরে।

সো হোয়াট? বরফে হাঁটার অভিজ্ঞতা আমার নেই জানি। অর্জুন তুমি পারবে? মেজর খোলা মেজাজে প্রশ্ন করলেন।

অর্জুন বলল, পূরণ বাহাদুর, আমাদের উত্তরদিকেই যেতে হবে। দক্ষিণদিকে গেলে মনে হচ্ছে কোনও কাজ হবে না।

মালবাহকরা তাড়াতাড়ি উঠে যাচ্ছিল কিন্তু মেজর তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছিলেন না, সামনেই একটা খাড়া পাহাড়। সেটা কোনওমতে পার হতেই কিছু একতলা ঘরবাড়ি দেখা গেল। কাঠের দেওয়াল, ছাতও কাঠের। পাহাড়ের ওপর দিকে যেমন হয়। মেজরের মুখ থেকে বাষ্প বের হচ্ছিল, বললেন, আজকের মতো এখানেই বিশ্রাম।

পূরণ বাহাদুর আপত্তি জানাল, সাব, আরও একঘণ্টা এগিয়ে গেলে ভাল হবে।

শাট আপ! মেজর চেঁচিয়ে উঠলেন, আমরা কি ট্রেন ধরার জন্যে ছুটছি? কোনও তাড়া নেই আমাদের। ধীরে সুস্থে চলো, যত দিন বাড়বে ততই তো তোমাদের লাভ। আজ এখানেই বিশ্রাম। কী বলল অর্জুন?

তাই হোক।

ওরা গ্রামের গায়ে পৌঁছে যেতে দেখল বেশ কিছু পাহাড়ি গোরু, ছাগল ঘুরছে সেইসঙ্গে মুরগির দলও। ওদের সাড়া পেয়ে গ্রামের লোকজন বেরিয়ে এল। অর্জুন আন্দাজ করল, গোটা কুড়ি-বাইশ নারী এবং বৃদ্ধ, কিশোর, বালক। যুবক চোখে পড়ছে না। পূরণ বাহাদুর এগিয়ে গিয়ে তাদের সঙ্গে আলাপ করল, কিছুক্ষণ পরে সে ফিরে এসে বলল, লোকগুলো ভাল। এখানে দুটো ঘর খালি আছে। আমাদের টেন্ট টাঙাতে হবে না। কিন্তু ওরা। অনেকদিন ভাত খায়নি, আমরা যদি খেতে দিই তা হলে খুশি হবে।

ভাত খায়নি? কী খেয়ে থাকে?

মকাই। এখানে ভাল মকাই হয়। তাই সারা বছর জমিয়ে রাখে।

কিন্তু অতলোককে ভাত খাওয়ালে আমাদের স্টক তো এখানেই ফুরিয়ে যাবে। তার চেয়ে টাকা দিচ্ছি, তাতে আমাদের সুবিধে। মেজর বললেন।

সাব। টাকা নিয়ে ওরা এখন এখানে কী করবে? আমাদের সঙ্গে যা চাল আছে তার কিছুটা খেলে কোনও সমস্যা হবে না। পূরণ বাহাদুর বলল।

গ্রামটা সমতল। আশপাশের জমিতে ভুট্টা গাছ দোল খাচ্ছে? পাশের একটা ঝরনায় তিরতিরিয়ে জল বইছে।

অর্জুনদের যে ঘরটা দেওয়া হল সেটি পরিষ্কার। কিন্তু মেঝেতে কাঠ পাতা। কোনও জানলা নেই। মালবাহকরা হ্যামক টাঙিয়ে দিলে মেজর জুতো খুলে তাতে উঠে বসে বললেন, যদিও আমেরিকাতে আমি চিকেন দু চোখে দেখতে পারতাম না কিন্তু বাইরের পাহাড়ি মুরগিগুলো মনে লোভ তৈরি করছে হে!

অর্জুন বাইরে বেরিয়ে এসে একজন মালবাহককে বলল, গ্রামের যিনি প্রধান তাঁকে ডেকে নিয়ে এসো তো।

লোকটা একটি বৃদ্ধকে নিয়ে ফিরে এলে অর্জুন তাঁকে হাতজোড় করে নমস্কার করল। বৃদ্ধ খুশি হয়ে কপালে হাত ঠেকাল, অর্জুন হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করল, আপনি নিশ্চয়ই হিন্দি বুঝতে পারেন?

বৃদ্ধ মাথা নাড়ল, একটু একটু। অর্জুন বলল, আপনারা আমাদের দুটো মুরগি বিক্রি করবেন? বৃদ্ধ ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, এখন তো আমরা পোষা পাখি বিক্রি করতে পারব না। কারণ আমাদের একটি ছেলে তিনদিন আগে ওই বরফের পাহাড়ে গিয়ে এখনও ফিরে আসেনি। সে না ফেরা পর্যন্ত আর একটা ঘরের প্রাণকে মারতে পারব না। আপনি কিছু মনে করবেন না।

অর্জুন একটু অবাক হল, ছেলেটি ওই বরফের পাহাড়ে কেন গিয়েছে?

টাকার লোভে। কয়েকজন লোক এসে ওকে বলল পথ চিনিয়ে নিয়ে গেলে অনেক টাকা দেবে তাই ও চলে গেল। বৃদ্ধ বলল।

লোকগুলো কি ফিরে এসেছে?

না। এদিক দিয়ে যায়নি। অন্য পথে নেমে গেলে জানতে পারব না।

নিশ্চয়ই তার কাজ শেষ হয়নি, হলেই তো ফিরে আসবে।

আমাদের নিয়ম হল কেউ বাইরে গেলে তারা না ফিরে আসা পর্যন্ত কোনও জীবন্ত প্রাণীকে মারা নিষেধ। আপনারা তো মুরগি মেরেই খাবেন।

ঠিক আছে। আপনাকে আর জোর করব না।

দুপুরের খাবার খেতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। মেজর হুকুম করলেন, নো ডিনার টু নাইট। এত অবেলায় খাওয়ার পর রাত্রে না খাওয়াই ভাল। বুঝলে অর্জুন, এদের নিয়মটা যদি বাঙালিরা চালু করত তা হলে নিরামিষ খাওয়ার চল বেড়ে যেত। মাছও তো প্রাণী।

খাওয়ার পরেও আকাশে আলো ছিল। অর্জুন চারপাশটা দেখার জন্য হাঁটতে বের হল। কাঞ্জনজঙ্ঘা যেন হাতের নাগালে চলে এসেছে। চারধার ঝকমক করছে। গ্রামের বাড়িগুলোর একপাশে পাহাড়ের আড়াল থাকায় উত্তরের বাতাসের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছে। ওদিক থেকে শোঁ শো আওয়াজ ভেসে আসছে। বাতাসে ধাক্কা খাচ্ছে গাছ, পাহাড়। ভুট্টা খেতে যেন ঢেউ বইছে। খানিকটা হাঁটার পর গ্রামের বাইরে চলে এসে সে দুটি রমণীকে দেখতে পেল। একজন মধ্যবয়সিনী অন্যজন তরুণী। দু’জনেই পাথরের মূর্তির মতো ওপাশে তাকিয়ে আছে? অর্জুন কাছে যেতে যেন ওদের চৈতন্য ফিরল। অর্জুন হাসল। এইসময় একজন বৃদ্ধ লাঠি হাতে পাশের গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে অর্জুনকে দেখে কপালে হাত ছোঁয়াল।

অর্জুন হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করল, আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

বৃদ্ধ মাথা নাড়ল। তারপর ভাঙা হিন্দিতে জানাল ওই তরুণীর জন্যে আসতে হয়েছে। ওর স্বামী কাজ নিয়ে বরফের পাহাড়ে গিয়ে এখনও ফিরে আসেনি। স্বামীর কিছু হয়েছে বলে ও ভয় পাচ্ছে। কথাগুলো বলে বৃদ্ধ মেয়েদের ধমক দিয়ে প্রায় তাড়িয়ে গ্রামের দিকে ফিরে গেল।

এখানে রাত নামলে পৃথিবীটা কালো হয়ে যায়। ঘরের দরজা বন্ধ করে ইমার্জেন্সি লাইট জ্বেলে হ্যামকে বসে ধাতব কৌটো বের করে ছিপি খুলে কিছুটা গলায় ঢেলে মেজর বললেন, ফ্যান্টাস্টিক।

অর্জুন তখন ঘরের তক্তার ফাঁকগুলো কাপড় দিয়ে আড়াল করছিল, উত্তর দিল না। মেজর একটু অপেক্ষা করে বললেন, তোমার মুশকিল কী জানো, তুমি অ্যাপ্রিসিয়েট করতে পারো না। এই যে হাড়কাঁপানো শীত, এই যে পলিউশন ফ্রি বাতাস, এই যে সীমাহীন নিস্তব্ধতা জীবনে খুব কমই পাওয়া যায়। আমি তার প্রশংসা করলাম আর তুমি চুপ করে থাকলে।

কী করব বলুন! রাত্রে যাতে সাপ না ঢোকে তার চেষ্টা করছি। অর্জুন বলল।

সাপ? এখানে সাপ আছে নাকি?

অস্বাভাবিক নয়। একটু বড় জাতের সাপ তো মুরগি খেতে ভালবাসে? অজগর তো বটেই বড় সাইজের কিং কোবরা একটা মুরগি গিলে ফেলে? এখানে তো অনেক মুরগি দেখলাম। অর্জুন ফাঁকগুলো বন্ধ করে ফিরে এল হ্যামকের কাছে?

মাই গড, এখানে কিং কোবরা আছে নাকি? দেখো, ওই একটা সাপকেই যা ভয় পাই, অজগর তো শিশু, আমি অ্যানাকোন্ডাকেও মিট করেছি। কিন্তু দাঁড়াও দাঁড়াও এই জিরো ডিগ্রির কাছাকাছি টেম্পারেচারে তো কিং কোবরার থাকার তথা নয়। সাপ ঠান্ডা এড়িয়ে চলে। তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ। আবার গলায় তরল পদার্থ ঢাললেন মেজর।

পূরণ বাহাদুর ঘরের বাইরে থেকে ডাকল, সাব।

এসো। অর্জুন বলল।

চায়ের কেটলি আর দুটো গ্লাস নিয়ে ঘরে ঢুকে চা ঢালল পূরণ বাহাদুর, অর্জুন মেজরকে বলল, আপনি নিশ্চয়ই এখন চা খাবেন না?

ইউ আর রাইট।

অর্জুন বলল, সাহেব চা খাবেন না। একটা গ্লাসেই ঢালো।

চায়ের গ্লাস অর্জুনের হাতে দিয়ে পূরণ বাহাদুর বলল, আমরা তখন এখানে না থেমে একটু এগিয়ে গেলে ভাল করতাম সাব।

কতটা ভাল হত? মেজর হ্যামকে বসে প্রশ্ন করলেন।

এই গ্রামের একটি ছেলে শহরের লোকদের সঙ্গে বরফের পাহাড়ে গিয়েছে। গাইড হয়ে। ওদের আজই ফেরার কথা ছিল কিন্তু ফেরেনি। ওদের মনে হচ্ছে যে লোকগুলো টাকার লোভ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছে তারা ভালমানুষ নয়। যেহেতু লোকগুলো শহরের মানুষ তাই শহরের মানুষ মাত্রই খারাপ বলে ওদের মনে হচ্ছে। কাল সকালের মধ্যে ছেলেটা যদি না ফেরে তা হলে। আমরা বিপদে পড়ে যেতে পারি সাব।

কেন? তোমরা তো শহরের মানুষ নও। মেজর বললেন।

আমাদের কথা বলছি না সাব। আপনারা তো শহরের মানুষ।

মাই গড। তুমি মিছিমিছি ভয় পাচ্ছ। এরা খুব সরল। মেজর বললেন।

হ্যাঁ সাব। কিন্তু সরল লোকরা খেপে গেলে ভয়ংকর হয়ে যায়।

আরে যাবে কোথায়? কাল ঠিক ফিরে আসবে।

বোধহয় আসবে না। মাথা নাড়ল পূরণ বাহাদুর।

একথা কেন বলছ? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

ওদের কাছে শুনলাম যারা ছেলেটাকে গাইড বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তারা সংখ্যায় সাতজন ছিল। আজ সকালে আমরা সাতজনের দলটাকে ফিরে যেতে দেখেছি। অত নীচে ওদের সঙ্গে যখন আমাদের দেখা হয়েছে তখন ছেলেটার তো অনেক আগেই এখানে চলে আসা উচিত ছিল। আমি এদের কিছু বলিনি। কিন্তু রাতের অন্ধকার থাকতে থাকতেই আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিত। আপনারা তৈরি থাকবেন। আমি এখান থেকে অনেকটা এগিয়ে গিয়ে আপনাদের চা দেব।

পূরণ বাহাদুর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে মেজর চাপা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, এই লোকটিকে কি বিশ্বাস করা উচিত? আমাদের ভয় দেখাচ্ছে না তো!

ভয় দেখিয়ে ওর কী লাভ হবে? তা ছাড়া ওকে তো মানেভঞ্জন থানার ওসি আমাদের জন্যে ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। লোকটা ভাল না হলে নিশ্চয়ই দিতেন না। অর্জুন বলল।

কিন্তু তুমি ভাবো, এখানকার একটি ছেলে শহরের লোকদের গাইড হয়ে পাহাড়ে গিয়ে আর না ফিরে এলে এরা আমাদের ওপর রেগে যাবে কেন?

আপনাদের আমেরিকায় কী হয় জানি না কিন্তু এই দেশের রাস্তায় কোনও গাড়ি যদি অ্যাকসিডেন্ট করে পালিয়ে যায় তা হলে পাবলিক এমন খেপে যায় যে নিরপরাধ গাড়িগুলোকেও সামনে পেলেই ভেঙে চুরমার করে দেয়, বাসে আগুন লাগায়। অর্জুন বলল।

ভেরি ব্যাড।

তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ুন, অন্ধকার থাকতে থাকতেই উঠতে হবে।

আমাকে ওই ভয় দেখিয়ো না অর্জুন। এক টোক গলায় ঢেলে মেজর বললেন, আজ ঠান্ডা বেশ জমিয়ে পড়েছে হে। একটু গলায় ঢেলে দেখো। ধাতব পাত্রটি উঁচুতে তুলে দেখালেন মেজর।

আমার যে অভ্যেস নেই তা আপনি জানেন। তা ছাড়া এই অলটিচুডে ওসব খাওয়া উচিত হচ্ছে না।

আমাকে অলটিচুড দেখিয়ো না। ইন দি ইয়ার নাইনটিন–

মেজর কথা শেষ করে পারলেন না। দূর থেকে অদ্ভুত গলায় কান্না ভেসে এল, তারপর একাধিক গলায় কান্নাটা জোরালো হল।

মেজর জিজ্ঞাসা করলেন, দরজাটা ভাল করে বন্ধ করেছ? চটপট করে দাও।

অর্জুন দরজায় ছিটকিনি তুলে দিলে মেজর বললেন, কান্না বলে মনে হচ্ছে তো? কান্না নয়, ডাকছে। এরা মাউন্টেন উলফ। সন্ধের পর খাবার খুঁজতে বের হয়। সবসময় একটা দল হয়ে আক্রমণ করে। এই যে ওরা চেঁচাচ্ছে, কেন জানো? ওই দলটা জানতে চাইছে কাছাকাছি ওদের প্রজাতি কোনও প্রাণী আছে কি না? রিপ্লাই পেল না, এবার থেমে যাবে। নিশ্চিন্তে শিকার করবে।

ইমার্জেন্সি লাইট নিভিয়ে টর্চ নিয়ে হ্যামকে উঠে পড়ল অর্জুন। স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞাসা করল, নেকড়েগুলো কি খুব হিংস্র?

অফ কোর্স। বলা হয়েছে ওদের শরীরে হায়নার রক্ত আছে? নিশ্চয়ই পূর্বপুরুষেরা ওই রক্ত পেয়েছিল। তুমি নিশ্চয়ই জানো, হায়নাদের বাঘ সিংহ এড়িয়ে চলে। ঈশ্বরের সবচেয়ে খারাপ সৃষ্টি! মেজর জিভে শব্দ করলেন। কিন্তু তুমি আলোটা নিভিয়ে দিলে কেন?

ওটা বেশিক্ষণ জ্বেলে রাখলে পরে বিপদে পড়ব আমরা।

তা ঠিক। কিন্তু গতকাল সাপ ঢুকেছিল, আজ নেকড়ের ডাক শুনছি, তাই ঘরে একটু আলো জ্বললে স্বস্তিতে থাকতাম।

সঙ্গে টর্চ আছে, মাঝে মাঝে জ্বেলে দেখবেন।

*

হাঁটার পরিশ্রম তো ছিলই, পেটে খাবার যতটা দরকার ততটা যায়নি, কিন্তু ক্লান্তি ঘুমটা এনে দিল। সেই ঘুম ভাঙালেন মেজর, কী তখন থেকে মড়ার মতো ঘুমোচ্ছ, আমি যে আর পারছি না!

ক’টা বাজে? অর্জুন দেখল ইমার্জেন্সি লাইট আবার জ্বলছে।

আটটা তেত্রিশ।

স্লিপিং ব্যাগ থেকে বেরিয়ে এল অর্জুন। বাইরে যে এক ফোঁটাও আলো নেই তা এই বন্ধ ঘরে থেকেও বোঝা যাচ্ছে। তার মানে এখন সন্ধে পার হওয়া রাত। অথচ মনে হচ্ছে অনেকটা সময় ঘুমিয়েছে সে।

একটু উঠতে হবে ভাই। মেজরের গলায় মিনতি।

আঃ! আবার কী হল!’ অর্জুন বিড়বিড় করল।

পান করে শুয়ে পড়েছিলাম তুমি আলো নিভিয়ে দিয়েছিলে বলে। ঘুমোবার আগে ছোট করা আমার দীর্ঘদিনের অভ্যেস। ওটা আজ হয়নি। আর পারছি না। কিন্তু দরজা খুলে একা বাইরে যাওয়া কি ঠিক হবে? মেজর বললেন, তুমি টর্চ জ্বেলে দরজায় দাঁড়াও, আমি হালকা হয়ে আসি।

অর্জুন হেসে ফেলল। মেজর সবরকম শীতবস্ত্র শরীরে চাপিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। অতএব অর্জুনকেও পোশাক চাপাতে হল। টর্চ নিয়ে দরজা খুলতেই কেঁপে উঠল সে। ধারালো ছুরির মতো বাতাস বইছে। তার ধাক্কায় কেঁপে উঠল শরীর। দাতে দাঁত বাজনা বাজাল, অর্জুন বলল, চটপট যান। খুব ঠান্ডা।

মেজর যখন তাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলেন তখন অর্জুনের মনে হল ওঁকে বিশাল গরিলার মতো দেখাচ্ছে। এই ঘরটি গ্রামের শেষ প্রান্তে। তাই বাঁদিকে কারও ঘর নেই। তাই উন্মুক্ত প্রান্তরে জলবিয়োগ করতে বিন্দুমাত্র অস্বস্তি হচ্ছিল না মেজরের। সেটা শেষ করে ফিরে এসে মেজর বললেন, ওয়ান্ডারফুল সাইট।

মানে?

ওই দেখো চাঁদ উঠছে। আচ্ছা, তোমার উচিত আমাকে ফলো করা। জঙ্গলে মাঝরাতে উঠতে হলে আর ফিরে যেতে পারবে না। মেজর বললেন।

এই কথাটা ভুল বলেননি মেজর। টর্চ মেজরের হাতে দিয়ে সে এগিয়ে গেল। সে যখন মধ্য পর্যায়ে তখন অন্ধকারে দুটো চোখ দেখতে পেল। দূরের তারার মতো। তারপর আরও আরও অনেকগুলো। চোখগুলো তার দিকে খুব ধীরে এগিয়ে আসছে। কোনওমতে ছোট শেষ করে দৌড়ে দরজায় পৌঁছে সে মেজরের হাত ধরে টেনে চিৎকার করল, ভেতরে ঢুকে পড়ুন। কুইক!’

বাট হোয়াই!’ বলে মেজর টর্চের আলো বাইরে ফেলতেই ও মাই গড’ বলে দরজার এপাশে চলে এসে ছিটকিনি তুলে দিলেন। তখনই দরজার বাইরে তীব্র আঘাত শুরু হল।

আর এক সেকেন্ড থাকলে ওরা আমাকে, উঃ! ধাতব পাত্র বের করে গলায় ঢাললেন মেজর, দরজা ভেঙে পড়বে না তো?

শব্দটা হয়েই চলেছিল, অর্জুন দেখল খিল লাগাবার ব্যবস্থা আছে কিন্তু খিলটাই নেই। সে ঘরের কোণে রাখা একটা তক্তা তুলে খিলের ভেতর ঢুকিয়ে দিল।

পেটে তরল পদার্থ যাওয়ায় মেজর স্বমেজাজে ফিরে এলেন, কী আরম্ভ হয়েছে বলো তো! এখন তো বাইরে যাওয়া অসম্ভব।

বাইরে যাওয়ার কী দরকার?

না। সাড়ে আটটাতেই মনে হচ্ছে এগারোটা নাগাদ পেটে আগুন জ্বলবে। তখন খাবারের সন্ধানে পূরণ বাহাদুরের কাছে যেতে চাইলে নিজেই ওদের খাবার হয়ে যাব। মেজর নাক দিয়ে বিদঘুঁটে একটা শব্দ বের করলেন।

আশ্চর্য! আপনিই তো তখন বলেছিলেন, নো ডিনার টু নাইট!

তুমি লেনিন পড়োনি, না?

অর্জুন অবাক হল। এই ভয়ংকর ঠান্ডায়, এত উঁচু পাহাড়ে রাত প্রায় ন’টায় মেজরের মনে লেনিন চলে এলেন। একজন আমেরিকান নাগরিক হিসেবে লেনিনকে মনে করা কি সঠিক কাজ?

মেজর বললেন, লেনিন বলেছিলেন, যে কোনও ভদ্রলোকের ভুল হতে পারে কিন্তু সে-ই প্রকৃত ভদ্রলোক যে ওই ভুল সংশোধন করে নেয়।

অর্জুন হেসে ফেলল, বলল, শুয়ে পড়ুন।

.

আকাশে তখন অজস্র তারার ভিড়, চাঁদ বড় হয়েছে কিছুটা, পৃথিবীর অন্ধকার পাতলা হতে চলছে। ওরা নিঃশব্দে গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে এল। পূরণ বাহাদুর দু’জনকে দুটো শক্ত লাঠি জোগাড় করে দিয়েছে। মেজরের মনে তখনও নেকড়ের ভয়। কিন্তু কিছুই ঘটল না, ঘণ্টাখানেক চলার পর পৃথিবী পরিষ্কার হয়ে গেল যদিও সূর্য দেখা দেয়নি।

এদিকে কোনও রাস্তা নেই। পূরণ বাহাদুর একটা জায়গায় এসে দাঁড়াল, সাব, আপনারা সত্যি উত্তরদিকে যেতে চাইছেন?

মেজর মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ। আর কতবার বলব।

ঠিক আছে। ওইদিকটায় দক্ষিণে যাওয়া যায়, এদিকে উত্তর।

আবার চলা শুরু হল। ক্রমশ পায়ের তলায় খচম শব্দ শুরু হল। অর্জুন দেখল পাতলা তুষার ঢেকে রেখেছে পৃথিবীর মাটি, পাথর। চাপ পড়ামাত্র সেগুলো ভেঙে শব্দ করছে। পূরণ বাহাদুর সতর্ক করে দিল, কেউ যেন জোরে না হাঁটে, যে কোনও মুহূর্তে পা পিছলে হাড় ভাঙতে পারে।

মেজর বললেন, এঃ! খুব খারাপ রাস্তা।

অর্জুন বলল, রাস্তা কোথায় দেখছেন? পূরণ বাহাদুররা নিয়ে যাচ্ছে বলে আমরা যেতে পারছি? চারপাশ তো একইরকম দেখতে লাগছে।

পূরণ বাহাদুর বলল, দক্ষিণদিকে গেলে এত কষ্ট হত না আপনাদের। ওদিকে আজও জল জমেনি?

আচ্ছা মুশকিল! তখন থেকে দক্ষিণ দক্ষিণ করছে। আমার দরকার উত্তরে যাওয়া আমি দক্ষিণে যাব কেন? মেজর খিঁচিয়ে উঠলেন।

হাঁটার গতি একটুও বাড়েনি, বরং কমে যাচ্ছিল, কিন্তু মালবাহকরা স্বচ্ছন্দে চলে গেল দৃষ্টিসীমার বাইরে।

মেজর জিজ্ঞাসা করলেন, একী! ওরা আগে কোথায় গেল?

সাব। ওরা এগিয়ে গিয়ে দুপুরের খাবার বানিয়ে রাখবে। আপনারা তো কাল রাত্রে কিছু খাননি। একসঙ্গে গিয়ে খাবার বানালে খেতে অনেক দেরি হয়ে যাবে? পূরণ বাহাদুর বিনীত গলায় জানাল।

গুড। খুব ভাল সিদ্ধান্ত। আমার তো এখনই খিদে পেয়ে গেছে।

একটু ড্রাই ফুট খাবেন সাব?

ঠিক হ্যায়। দাও খানিকটা। হাত বাড়ালেন মেজর।

*

এখন রিয়াচক ভ্যালি তুষারে সাদা হয়ে রয়েছে। পাহাড়ের যেসব অংশের নাগাল তুষার পায়নি সেগুলো কালচে দেখাচ্ছে। সূর্য ওঠার পর বাতাস আচমকা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গোড়ালি পর্যন্ত ঢাকা তুষারে হাঁটতে মেজর বেদম হয়ে পড়েছিলেন। মাথা থেকে পা পর্যন্ত অভিযাত্রীর পোশাক পরে অনভ্যস্ত অর্জুনের মনে হচ্ছিল এইভাবে বেশি সময় হাঁটা যাবে না। শেষপর্যন্ত মেজরকে পূরণ বাহাদুরের সাহায্য নিতে হল? অর্জুন অবাক হয়ে দেখল লোকটা তিরিশ কিলোর ওপর জিনিসপত্রের ওজন পিঠে নিয়েও মেজরের হাত ধরে কী অবলীলায় ওপরে উঠছে।

বেলা সাড়ে দশটায় দূরের একজন মালবাহককে দেখা গেল হাত নেড়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। তার কাছে পৌঁছোতে আরও আধঘণ্টা লেগে গেল। পূরণ বাহাদুর এগিয়ে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলে জানাল, ওরা এখানে দুটো জায়গা পেয়ে গেছে। অনেকটা গুহার মতো। রান্নাও শুরু হয়ে গেছে।

থ্যাঙ্ক ইউ। এসব কী অর্জুন? ও বলেছিল রাস্তায় চা খাওয়াবে, খাওয়ায়নি। নো ব্রেকফাস্ট। আমি কি এখানে অনাহারে মরতে এসেছি? মেজর জিজ্ঞাসা করলেন।

এখনই সব পেয়ে যাবেন। পূরণ বাহাদুর, তোমার লোকদের বলো আগে চা আর কিছু বিস্কুট বা কেক দিতে। অর্জুন জানিয়ে দিল।

যে পাহাড়ি গহ্বরে ওরা জায়গা নিল সেটা অবশ্যই কোনও গুহা নয়। পাহাড়ের নীচে অনেকটা মাটি না থাকায় গুহার মতো দেখাচ্ছে। মালবাহকরা জায়গাটাকে একটু পরিষ্কার করে দিয়েছে। ওদের মালপত্র সেখানে রেখে বসার জায়গা করে দিয়ে ওরা দ্বিতীয় গহ্বরে চলে গেল।

পা ছড়িয়ে বসে মেজর বললেন, আহ, এর চেয়ে আরাম আর নেই।

আপনি কিন্তু অনেকটা হাঁটলেন। অর্জুন বলল।

আমি একাই হাঁটলাম নাকি! আমাকে এসব একদম বলবে না!’ মেজর বললেন, তুমি কেক বিস্কুট আনতে বললে কেন? আমাদের সঙ্গে তো প্রচুর খাবার আছে, সেগুলো কে খাবে?

আমরা তো একটু পরেই লাঞ্চ করে বের হব।

বের হব? কে বের হচ্ছে? মেজর চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

আজ আর হাঁটবেন না?

ওঃ! আজ কতটা সময় হাঁটলাম বলো তো? সেই ভোর পাঁচটা থেকে এগারোটা। সিক্স আওয়ার্স! এনাফ ফর এ ডে। মেজর বললেন, আমরা এখানে কি শুধু হাঁটাহাঁটি করতে এসেছি?

নিশ্চয়ই না।

একটু রেস্ট নিয়ে ওদের খুঁজতে বের হতে হবে।

কোথায় খুঁজবেন। চারধারে তো তুষার আর তুষার।

মাথা খাটাও। এই যে আমরা তুষারের বাইরে পাহাড়ের গুহা পেয়ে গেলাম ওরাও তো এরকম জায়গা পেতে পারে।

পারে। কিন্তু থাকবে কী করে?

কেন?

ওদের সঙ্গে কত খাবার আছে যে এতদিন এখানে পড়ে থাকবে? এই ব্যাপারটা আমার কাছে অস্পষ্ট তাই ওরা এখানে আছে বলে মনে হচ্ছে না।

মেজর মাথা নাড়লেন, ওদের খাওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চয়ই রয়েছে। নইলে ওরা এতদিনে ফিরে যেত। ফিরে গেলে ওই পূরণ বাহাদুররাই সেকথা বলত।

মেজর ম্যাপটা বের করলেন, এই দেখো, আমরা রিয়াচক ভ্যালির মুখে পৌঁছে গিয়েছি। উঃ! সভ্যতা থেকে অনেক দূরে। জন তার মেয়েকে নিয়ে পৌঁছেছিল এই রিয়াচক ভ্যালির এইখানে। আঙুল রাখলেন মেজর বোঝাতে। তারপর হাসলেন, সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। দক্ষিণে না গিয়ে উত্তরে এসেছি। চেয়ে দেখো, জনের জায়গাটা উত্তরেই।

অর্জুন ভাল করে ম্যাপটা দেখল। রিয়াচক ভ্যালির আয়তন বিশাল। জন এবং তার মেয়ে ওই বরফের রাজ্যে কোথায় রয়েছেন তা খোঁজা প্রায় অসম্ভব। অর্জুনের মনে হল, এমন হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে ওঁরা বেঁচে নেই। মৃত মানুষেরা ফিরে আসতে পারে না। তাই ওঁরা ফেরেননি।

সন্দেহের কথা খুব বিনীতভাবে জানাল অর্জুন।

মেজর এবার তার ধাতব পাত্র বের করে কিছুটা গলায় ঢাললেন, হতে পারে। অসম্ভব নয়। কিন্তু দু’জনের কারও মৃতদেহ পাওয়া যাবে না তা হলে?

মৃতদেহ দেখে আপনি কী করবেন?

রিপোর্ট করব। তা হলেও এই আসাটার একটা মানে হবে।

দুপুরের খাওয়া আজ ঠিক সময়েই হয়ে গেল। পূরণ বাহাদুর চাইছিল এগিয়ে যেতে। এখন ঘণ্টা আড়াই আলো পাওয়া যাবে। কিন্তু মেজর রাজি হলেন না। খাওয়ার পরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আপাদমস্তক এখানকার শীতের উপযোগী পোশাকে মুড়ে অর্জুন সেই লাঠিটা হাতে নিয়ে বের হল। মেজর তখন তার ইমার্জেন্সি নিয়ে পড়েছেন। ব্যাটারি ডাউন হয়ে গিয়েছে। সোলার বিদ্যুতের সাহায্যে সেটাকে জীবন্ত করা যায় কিনা তা দেখতে চাইছেন।

এখনও পায়ের তলায় শক্ত মাটি। যে কাঁচের মতো তুষার সকালে হয়েছিল তা সূর্যের উত্তাপে অনেকক্ষণ আগেই গলে গিয়েছে। ধীরে ধীরে সে সামান্য চড়াই ভেঙে ওপরে উঠতেই মুগ্ধ হয়ে গেল। আদিগন্ত শুধু বরফ আর বরফ। বরফের শেষে কাঞ্চনজঙ্ঘা। যেন ঢিল ছুড়লেই ওর গায়ে লাগবে। এমন ভয়ংকর সুন্দর সে আগে কখনও দেখেনি। হঠাৎ চোখে অস্বস্তি হল। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল সে। বরফের ওপর রোদ পড়ে যে আলো ঠিকরে উঠছে তা চোখ সহ্য করতে পারছে না। এখন থেকে বরফের ওপর হাঁটতে হলে কালো। চশমা ব্যবহার করতে হবে।

অর্জুন কাঞ্চনজঙ্ঘার দিক থেকে মুখ সরিয়ে বরফের ওপর পা রাখল। বেশ শক্ত বরফ। হাতে লাঠি থাকায় সুবিধে হচ্ছে। হঠাৎ একটা বিশ্রী চিৎকার কানে আসতেই সে আকাশের দিকে তাকাল। দুটো বিশাল পাখি ডানা মেলে পাক খাচ্ছে। প্রথমে মনে হয়েছে চিল অথবা বাজপাখি, পরে অনুমান করল ওরা শকুন। কিন্তু এতবড় শকুন জলপাইগুড়িতে কখনওই দেখা যায় না। এরা বোধহয় পাহাড়ি শকুন বলেই আকৃতিতে এত বড়। মেজর দেখলে হয়তো বলতেন, এরা নির্ঘাত টিবেটিয়ান শকুন। শকুন দুটো ধীরে ধীরে নেমে এল বরফের ওপর। তারপর অর্জুনকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে বেশ ধমক দিল। জায়গাটা অর্জুনের পঞ্চাশ মিটার দূরে। একটু অপেক্ষা করার পরে একটি শকুন বরফের ওপর পায়ে হেঁটে এগিয়ে গেল খানিকটা। তারপর দ্রুত বরফ সরাতে লাগল। তার কাজ দেখে দ্বিতীয়টিও সাহসী হল। ইতিমধ্যে আরও কিছু শকুন এসে গেছে আড়ালে। ধীরে ধীরে পাক খেয়ে নেমে আসছে নীচে।

অর্জুন কৌতূহলী হল। সে এগিয়ে যেতে শকুন দুটো ডানাঝাঁপটে তীব্র প্রতিবাদ করল। অর্জুন কবজি উঁচিয়ে ওদের ভয় দেখাল কিন্তু আট-দশ ফুট ওপাশে সরে গেল ওরা। যে জায়গাটায় ওরা বরফ খুঁজছিল সেখানে পৌঁছেই চমকে গেল সে। জুতোসমেত দুটো পায়ের কিছুটা বরফের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে।

একটু দ্বিধা করে অর্জুন মুখের দিকের বরফ সরাতে লাগল। মুখটা যখন দেখা গেল তখন অন্য শকুনগুলো নেমে এসেছে। না, এই মৃতদেহ কোনও আমেরিকান সাহেব বা তার মেয়ের নয়। মাথার পাশ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে জমাট বেঁধে রয়েছে। অর্থাৎ লোকটাকে খুন করে এখানে বরফ চাপা দেওয়া হয়েছে। যদিও চাপা দেওয়ার সময় পরিশ্রম করেনি বলে বেশি গর্ত খোড়েনি, অর্জুনের মনে হল লোকটাকে খুন করা হয়েছে দু’-একদিনের মধ্যে।

অর্জুন আবার দেখল। বেশি বয়স নয়। তিরিশের নীচে নিশ্চয়ই, মুখ বলছে ছেলেটি পাহাড়ের মানুষ। গলার মাফলার এবং ছেঁড়া শীতবস্ত্র বলছে ও খুব গরিব ঘরের ছেলে। ঝট করে গতকালের দেখা মেয়েটির মুখ মনে পড়ল যে গ্রামের বাইরে গিয়ে স্বামীর অপেক্ষায় বসেছিল। এই ছেলেটি সেই স্বামী নয় তো! ওই গ্রামের খবরটা পৌঁছে দেওয়া দরকার। দিনের আলো ফুরিয়ে যেতে দেরি নেই। অতটা পথ যেতেই রাত নেমে আসবে। অথচ ওকে এই অবস্থায় এখানে ফেলে গেলে শকুনগুলো ছিন্নভিন্ন করে দেবে।

একবার মনে হল তাদের ক্যাম্প তো বেশি দূরে নয়। পূরণ বাহাদুরদের নিয়ে এসে একটা ব্যবস্থা করলে কেমন হয়? কিন্তু শকুনগুলোর দিকে তাকিয়ে ভরসা পেল না সে। ভয়ংকর রাগী চোখে ওরা এখন অর্জুনকে দেখছে। শেষ পর্যন্ত বরফ খুঁড়তে লাগল অর্জুন। ওপরের নরম আস্তরণ সরাবার পর নীচের বরফ খুঁড়তে আঙুল ব্যথা হয়ে গেল। লাঠির সাহায্যে যেটুকু লম্বা গর্ত করতে পারল তাতেই শুইয়ে দিল ছেলেটিকে। তখন আলো প্রায় মরে এসেছে। বরফ চাপা দিয়ে সে শকুনগুলোকে তাড়াবার চেষ্টা করল কিছু সময়। তারপর দ্রুত ফিরতে লাগল ক্যাম্পের দিকে। মিনিট দশেক যেতেই সে পূরণ বাহাদুর আর একটা মালবাহককে দেখতে পেল, বালতিতে জল ভরে নিয়ে আসছে। কাছাকাছি কোনও ঝোরা থেকে।

উত্তেজিত অর্জুন পূরণ বাহাদুরকে মৃতদেহের কথাটা জানালে সে বালতি নীচে রেখে বলল, সর্বনাশ! ওকে নিশ্চয়ই ওরা খুন করে গেছে। কিন্তু খবরটা আজ কোনওভাবেই দেওয়া যাবে না।

আমি বরফ দিয়ে ঢেকে এসেছি কিন্তু শকুনগুলো যদি কোনওভাবে সরিয়ে দেয় তা হলে কিছুই পাওয়া যাবে না। অর্জুন বলল।

রাত্রে বোধহয় শকুন খাওয়ার চেষ্টা করবে না। ঠিক আছে। আপনি গিয়ে বিশ্রাম করুন আমরা দেখছি কী করা যায়। পূরণ বাহাদুর বলল।

অর্জুন ফিরে এসে দেখল পাহাড়ের সেই গহ্বরের ভেতরেই টেন্ট টাঙিয়ে দিয়েছে মালবাহকেরা। হ্যামকের ওপর বসে গান গাইছেন মেজর! কবে আছি কবে নেই, জীবনের এই খেলাঘরে!

টেন্টের ভেতর একটাই প্লাস্টিকের ফোল্ডিং চেয়ার ছিল। সেটায় বসে অর্জুন বলল, বেশ ভাল মুডে আছেন মনে হচ্ছে। এদিকে একটা খারাপ খবর আছে।

গান থামিয়ে মেজর বললেন, তুমি আজ অবধি কোনও খবর দাওনি।

একটা ডেডবডি পাওয়া গিয়েছে। মাথায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।

অ্যাঁ? মেজর সোজা হলেন ছয় ফুট লম্বা, মাথায় টাক আছে?

না’

তা হলে জন নয়।

না। কাল রাত্রে যে গ্রামে ছিলাম সেই গ্রামের ছেলে যে গাইড হয়ে বেরিয়ে আর ফিরে যায়নি।

সর্বনাশ! খবরটা পেলে তো ওরা আমাদের ওপর আরও খেপে যাবে।

একশোবার। কিন্তু ওকে খুন করল কে?

সিম্পল ব্যাপার। ওকে যারা হায়ার করেছিল তারা। পূরণ বাহাদুর বলেছে লোকগুলো খুব সন্দেহজনক। মেজর বললেন।

দ্রুত রাত নেমে এল এখানে। সন্ধের রাত। সেইসঙ্গে আচমকা চড়ে গেল ঠান্ডা। হঠাৎ পাখির চিৎকার কানে এল। বীভৎস, কর্কশ। তারপরেই পূরণ বাহাদুররা বয়ে নিয়ে এল মৃতদেহ। তাবুতে ঢুকে সেকথা জানাল সে।

অর্জুন বলল, একে তুমি কখনও দেখোনি?

না সাব। ওই গ্রামেরই ছেলে! আমাদের ওখানে জায়গা খুব কম। আপনারা যদি কিছু মনে না করেন তাবুর বাইরে ওই কোণে ওকে রেখে দেব? ভাল করে চাপা দিয়ে রাখব। পূরণ বাহাদুর বলল।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, তুমি কী করতে চাও?

ভোরবেলায় আমাদের একজন ওই গ্রামে খবর দিয়ে আসবে। আমরা রওনা হয়ে গেলে ও ঠিক আমাদের ধরে নেবে। না হলে এই বেচারার সৎকার হবে না।

যা ভাল বোঝো তাই করো। অর্জুন বলল।

ওকে মাথায় আঘাত করে মেরেছে? মেজর জিজ্ঞাসা করলেন।

মাথা থেকে রক্ত বেরিয়েছে কিন্তু ওর ঘাড় ভেঙে গিয়েছে।

মাথায় আঘাত লাগলে ঘাড় ভাঙবে কী করে?

সাব, অত আমি জানি না, কিন্তু ঘাড় ভেঙে গিয়েছে ওর। মনে হচ্ছে কেউ ওর ঘাড় ভেঙেছে পেছন থেকে। তার জন্যে খুব শক্তি থাকা দরকার।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ওর শরীরের পাশে কিছু পড়েছিল?

না সাব। তবে ওর শরীরের রক্ত বরফের ওপর পড়েনি। কিন্তু পড়া উচিত ছিল। রক্ত বেরিয়ে তখনই তো জমে যাবে না। সেলাম করে পূরণ বাহাদুর চলে গেল। একটু পরে বারোজন মৃতদেহ বয়ে নিয়ে এসে তাবুর পেছনে এক কোণে রেখে ভাল করে চাপা দিয়ে চলে গেল।

মেজর ধাতবপাত্র থেকে আর এক ঢোক পান করে বললেন, অর্জুন কখনও কোনও মৃতদেহের সঙ্গে রাত কাটিয়েছ?

অর্জুন মাথা নাড়ল, না।

ওটা যদি সারারাত মৃতদেহ হয়ে পড়ে থাকে তা হলে আমি খুশি হব। পূরণ বাহাদুর প্রস্তাবটা যখন দিল তখন আমি মানবিকতার খাতিরে না বলতে পারলাম না। অবশ্য মৃতদেহের সঙ্গে মানবিকতা করা উচিত কিনা তা জানি না। কী ভাবছ?

অর্জুন বলল, পূরণ বাহাদুর যা বলল তা শোনার পর আমার খটকা লাগছে। ওর মাথা থেকে রক্ত যে বেরিয়েছে তা আমি দেখেছি। কিন্তু সেটা কানের নীচে এসে থেমে গেছে। কেউ মাথায় আঘাত করে হত্যা করলে তো প্রচুর রক্ত বের হওয়ার কথা। সেই রক্ত কোথায় গেল? দ্বিতীয়ত, ওর মাথায় আঘাত করলে যে ঘাড় ভাঙবেই, সচরাচর এমন হয় না। ঘাড় ভাঙলে ধস্তাধস্তির চিহ্ন থাকবেই। সেটা আমার চোখে পড়েনি।

তুমি কী বলতে চাইছ? ওর মাথা থেকে বের হওয়া রক্ত কেউ মাটিতে পড়তে দেয়নি? দুই, যে ঘাড় মটকেছে তার শরীরে প্রচণ্ড শক্তি থাকায় ছেলেটা ধস্তাধস্তি করার সুযোগ পায়নি।

আমি বুঝতে পারছি না। অর্জুন বলল।

মেজর বললেন, যে লোকগুলোর সঙ্গে ছেলেটি এসেছিল তারা ওখানে ওসব করতে যাবে কেন? তা ছাড়া তাদের তো খুন করার কোনও কারণ নেই। যাক গে, আমার মনে হয় আমরা আগামীকাল যেখানে পৌঁছাব তার ধারেকাছেই জনকে পাওয়া যাবে। পূরণ বাহাদুরকে বলো, খাবার দিতে, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমালে দুশ্চিন্তা থাকবে না।

অর্জুন তাবু থেকে বেরোতেই দেখল আকাশের এককোণে চঁদ উঁকি মারছে। আর তখনই আচমকা জোরে বাতাস বইতে লাগল। অস্পষ্ট চারধার, ক্রমশ কুয়াশারা দল বেঁধে গড়িয়ে আসছে। অর্জুন দ্বিতীয় তাঁবুর কাছে যেতেই গলা শুনতে পেল। একজন মালবাহক বলছে, আমাদের আর এগিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। ওই মৃতদেহ দেখিয়ে ভগবান ফিরে যেতে বলছে।

দ্বিতীয়জন বলল, চলো, কাল সকালেই ফিরে যাই।

পূরণ বাহাদুরের গলা বলল, না। সেটা করলে বেইমানি করা হবে। সাহেবরা যে কাজ করতে এসেছেন তাতে মদত করব বলে কথা দিয়েছি, ভাল টাকা দেবেন, তোরা মিছিমিছি ভয় পাচ্ছিস।

চতুর্থজন কথা বলল, ঘাড় ভেঙেছে বলে আমি ভয় পাইনি। কিন্তু ওর শরীর থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত কোথায় গেল? যে মেরেছে সে খেয়ে নেয়নি তো? ব্যাপারটা ভাবো তোমরা?

পূরণ বাহাদুর জিজ্ঞাসা করল, কে খাবে?

কেউ জবাব দিল না। অর্জুন কিছুটা সরে গিয়ে ডাকল, পূরণ বাহাদুর?

জি সাব।

খাবার হয়ে গেলেই দিয়ে দিয়ো।

জি সাব।

আধা অন্ধকারে কুয়াশার মধ্যে দাঁড়িয়ে অর্জুন কেঁপে উঠল। প্রায় শিশুর কান্নার মতো শব্দ ভেসে এল কানে। সে টর্চের আলো ফেলল। কুয়াশার মধ্যে সেই আলো অচল। তারপরেই কর্কশ পাখির ডাক কানে এল। অর্জুন মাথা নাড়ল, নিশ্চয়ই কাছাকাছি শকুনের বাসা আছে। শকুনের ছানাদের কান্না প্রায় মানুষের শিশুর মতো শোনায়। তাবুতে ফিরে এসে অর্জুন দেখল মেজর হ্যামকে নেই। সে তাঁবুর দরজায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করল, মেজর, আপনি কোথায়?

চিৎকার শেষ হওয়ামাত্র প্রতিধ্বনি কানে এল। পাহাড়ে ধাক্কা লেগে গড়িয়ে পড়ে মিলিয়ে গেল। কিন্তু মেজরের কোনও সাড়াশব্দ নেই। অর্জুন চিন্তিত হল। গেলেন কোথায় ভদ্রলোক। তাকে কিছু না জানিয়ে এই ঠান্ডার মধ্যে কোথায় যেতে পারেন?

অর্জুন আরও একটু এগিয়ে চারপাশ লক্ষ করল। বাঁক আরও ওপরে উঠে এসেছে। এখন তেমন অন্ধকার নেই। সে মেজর’ বলে চিৎকার করতে গিয়েই থেমে গেল। দুরে কিছু একটা পড়ে আছে পাথরের ওপরে। সে দৌড়াল, পাহাড় উঁচু নিচু পথে যতটা দৌড়ানো যায়।

পাথরের পাশে পৌঁছে সে উত্তেজিত গলায় ডাকল, মেজর!

আঃ, আমার মনোসংযোগ নষ্ট করে দিলে যে! প্রায় পৌঁছেছি।

আপনি ওভাবে পাথরের ওপর রাত্রিবেলা শুয়ে আছেন?

অসুবিধে কোথায়?

আশ্চর্য! এখন কত ঠান্ডা জানেন? আপনার নিমোনিয়া হয়ে যেতে পারে।

বাঃ! তুমি এই ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে থাকলে তোমার কিছু হবে না আর আমি এত চওড়া পাথরের ওপর শুয়ে থাকলে নিমোনিয়া হয়ে যাবে? তোমাকে কে বলে যে দাঁড়িয়ে থাকলে ঠান্ডা কম লাগে? এই নাক আর ঠোঁট ছাড়া আমার শরীরের একটা অংশ দেখাও যেখান দিয়ে ঠান্ডা ঢুকতে পারে! ঠান্ডা কেন, তার প্রপিতামহও ঢুকতে পারবে না। উঠে বসলেন মেজর।

ঠান্ডার প্রপিতামহের নাম কী জানতে চাইল না অর্জুন।

কিন্তু এখানে এ সময় শুয়েছিলেন কেন?

তোমার উচিত ছিল, প্রথমেই এই প্রশ্ন করা। তা না করে ঠান্ডার নামে সময় নষ্ট করলে। দেখো, আকাশ এখন পরিষ্কার। এক কোণে যে মেঘ উঁকি দিয়েছিল সেটাও উধাও হয়ে গিয়েছে। এইসময় স্যাটেলাইট দারুণ কাজ করে। এই পাহাড়, তুষার তো বটেই কোনও কোনও সাটেলাইটে এমন যন্ত্র আছে যা মাটির নীচে কী কী আছে তাও জানিয়ে দিতে পারে। মেঘ জমলেই তার ক্ষমতা কমে যায়। পৃথিবীর আকাশ বা মহাকাশে পাক খাওয়া স্যাটেলাইট যদি নীচের পৃথিবীর খবর জানার ক্ষমতা রাখে তা হলে নীচ থেকে মনোসংযোগ করলে মহাকাশকে জানা যাবে না কেন? তুমি নিশ্চয়ই জানো, আলো বা শব্দের চেয়ে মন অনেক বেশি দ্রুতগামী! মেজর পাথর থেকে নেমে দাঁড়ালেন, পুরাকালের যোগী ঋষিরা চোখ বন্ধ করলেই বলে দিতে পারত হাজার হাজার মাইল দূরে কী হচ্ছে? কী ঠিক তো?

সেটা ঠিক। কিন্তু এদিকের সমস্যাটা বেশ জটিল হয়েছে। অর্জুন বলল, তাবুর ভেতরে চলুন, একটু আলোচনা করা দরকার।

তাঁবুর ভেতর আর বাইরের তাপমাত্রার ব্যবধান বুঝতে যন্ত্রের দরকার পড়ে না। মেজর বাঁদুরে টুপি খুলে ধাতবপাত্র থেকে খানিকটা ব্র্যান্ডি মুখে ঢাললেন, এবার বলো।

অর্জুন একটু আগে শোনা মালবাহকদের সংবাদগুলো মেজরকে জানাতেই তিনি খেপে গেলেন। চাপা গলায় গর্জন করলেন, কাল সকালে ফিরে যাওয়াচ্ছি। আমি ওদের বিরুদ্ধে মামলা করব। চুক্তি ভঙ্গের জন্যে জেলে পাঠাব, নইলে মেরে ঠ্যাং ভেঙে দেব যাতে আর ফিরে যেতে না পারে।

অর্জুন হাত তুলল, এসব নিশ্চয়ই করতে পারেন কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হবে না। ওদের ভোলা প্রশ্নটা আমাদের ভাবাচ্ছে। ছেলেটার মৃত্যু হল কী করে? ওর ঘাড় ভাঙল কে? মালবাহকরা বলেছিল ঘাড় মটকে দেওয়া হয়েছে।

ছেলেটার পেছন থেকে বড় পাথর তুলে মারলে ঘাড় ভেঙে যাবে, মাথাও ফাটবে।

কেন ওরা ওকে মারতে গেল?

নিশ্চয়ই ওদের কোনও অন্যায় কাজ ছেলেটা জেনে ফেলেছিল।

গুড। মাথা যেভাবে ফেটেছে তাতে প্রচুর রক্ত পড়া উচিত। ছেলেটাকে যেখানে বরফ চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল সেখানে রক্তের হদিশ নেই কেন? অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

এটা আমার মাথায় আসেনি। মাথা ফেটে মারা গেলে প্রচুর রক্তপাত হওয়া উচিত। নিশ্চয়ই ওর রক্ত ওখানকার বরফের তলায় চাপা পড়ে আছে। মেজর বললেন।

বোধহয় না। ওরা মৃতদেহ তুলে আসার সময় ভাল করে দেখেছে।

এইসময় পূরণ বাহাদুর খাবার নিয়ে এল। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, তোমার লোকজন ভয় পায়নি তো?

একটু দ্বিধা কাটিয়ে পূরণ বাহাদুর বলল, পাহাড়ে কাউকে খুন হতে দেখতে সবাই ভয় পায়। কিন্তু আমি ওদের সামলে নিয়েছি। ও হ্যাঁ, আমরা ঠিক করলাম এখনই ওর গ্রামে খবর দেওয়া ঠিক হবে না, খবর পেলেই সবাই ছুটে আসবে। বাইরের লোক ওকে খুন করেছে ধরে নিয়ে আমাদের ওপর হামলা করতে পারে।

তা হলে ওই মৃতদেহ নিয়ে কী করবে?

কাল ভোরবেলায় অনেকটা বরফ খুঁড়ে তার নীচে রেখে দেব যাতে না পচে যায় শরীরটা। শকুনগুলোও পৌঁছাতে পারবে না। আপনাদের খাওয়া হয়ে গেলে তাবুর বাইরে থালা-গ্লাস রেখে দেবেন। কাল ভোরে চা খেয়েই বেরুতে হবে।

পূরণ বাহাদুর চলে গেলে বাইরে একটা অদ্ভুত আওয়াজ হল। ওটা নিশ্চয়ই পাখির ডাক। কিন্তু এত ওপরে এবং ঠান্ডায় শকুন, চিল বা বাজপাখি ছাড়া আর কোন পাখি আসতে পারে!

অর্জুন বলল, ছেড়ে দিন। আমরা তো ওই খুনের কিনারা করার জন্যে আসিনি। খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ুন। সন্ধে পেরিয়ে যাচ্ছে।

দাঁড়াও। আবার এক টোক খেয়ে মেজর বললেন, আমার খুব কৌতূহল হচ্ছে।

কী ব্যাপারে?

আমি আর একবার মৃতদেহটি দেখতে চাই। মেজর বললেন।

সেকী! কেন?

চলো, আগে দেখি। তারপর বলব।

এই ঠান্ডায় বাইরে গিয়ে মৃত মানুষকে দেখার ইচ্ছে অর্জুনের হচ্ছিল না। মেজরের জন্যে কিছু শীতবস্ত্র শরীরে চাপিয়ে তাঁবুর বাইরে পা রাখল। সঙ্গে সঙ্গে মেজর বলে উঠলেন, আজ, মিল্কশেকের কথা মনে পড়ছে জ্যোৎস্না দেখে।

কোথাও কোনও শব্দ নেই, বরফের ঘন ঠান্ডায় জমে আছে। ওরা টর্চ জ্বালিয়ে তাবুর পেছনে চলে এল। মৃতদেহটিকে পূরণ বাহাদুররা কাপড়ে মুড়ে রেখেছে ভালভাবে। অর্জুনের টর্চের আলোয় মেজর মাথার দিকের কাপড়ের আড়াল সরালেন সন্তর্পণে। মুখ দেখা গেল। মাথার একটা দিকে অনেকটা থেঁতলে গিয়েছে। কিন্তু রক্তের শুকনো দাগ নেই। মেজর বললেন, গলার ওপর ফোকাস করো। অর্জুন মৃতদেহ গলা আলোকিত করল।

মেজর ঝুঁকে গলার এপাশ ওপাশ পরীক্ষা করলেন। তারপর গম্ভীর মুখে আবার কাপড় দিয়ে যেভাবে ঢাকা ছিল সেইভাবে ঢেকে বললেন, চলো।

তাঁবুর ভেতরে এসে আবার গলায় তরল পদার্থ ঢেলে মেজর বললেন, খেয়ে দেয়ে তুমি শুয়ে পড়ো। ঘণ্টা চারেক পরে আমি তোমাকে ডেকে দেব। কারণ আমি যদি আগে ঘুমাই তা হলে তুমি মাঝরাতে আমাকে ডেকে দিলেও জেগে থাকতে পারব না।

হঠাৎ জেগে থাকার কথা ভাবছেন কেন?

এই জায়গাটা ভাল নয়। একজনকে পাহারায় থাকতেই হবে।

আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না। পাহারা কীসের জন্য?

ওঃ। তুমি কি বুঝতে পারছ না ওই ছেলেটিকে কোনও মানুষ খুন করেনি।

মানুষ ছাড়া তাকে আর কে খুন করতে পারে?

প্রশ্নটার মধ্যেই উত্তরটা রয়ে গেছে। মাথা স্ম্যাশড হয়েছে, ঘাড় মটকে গিয়েছে অথচ রক্তের ঠিক চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে না। কোনও মানুষ ওকে করলে সেটা পাওয়া যেতই।

মেজরের কথায় সন্ধেবেলায় শোনা মালবাহকের সংবাদ মনে পড়ল অর্জুনের, যে মেরেছে সে খেয়ে নেয়নি তো! অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ওর রক্ত কি হত্যাকারী খেয়ে নিয়েছে?

অসম্ভব নয়। আমি যেটা সন্দেহ করছিলাম সেটা নয়। ওর গলায় কেউ দাঁত বসায়নি। কোনও দাঁতের দাগ নেই। অর্থাৎ ড্রাকুলা ওকে হত্যা করেনি।

আপনি আবার এখানে ড্রাকুলার কথা ভেবে বসে আছেন? আপনি নিশ্চয়ই জানেন না জিরো ডিগ্রিতে ড্রাকুলা উড়তে পারে না।

থ্যাঙ্ক ইউ ফর দিস ইনফরমেশন। তাতে রক্ত কোথায় গেল?

অর্জুন বলল, ছেলেটিকে খুন করা যে হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। যেখানে ওকে বরফ চাপা দেওয়া হয়েছিল নিশ্চয়ই সেখানে খুন করা হয়নি। যেখানে হয়েছিল সেখানেই রক্তপাত হয়েছিল। অনেক পরে সেখান থেকে ওকে তুলে নিয়ে এসে বরফচাপা দেওয়া হয়েছে। যদি ওরা রক্তের অস্তিত্ব নষ্ট না করে গিয়ে থাকে তা হলে একশো পনেরোর মধ্যে খুঁজলে শুকিয়ে থাকা রক্ত পাওয়া যাবে। অর্জুন বলল।

অতএব আজ রাত জাগার প্রয়োজন নেই বলছ?

অর্জুন হেসে বলল, বলব, খেয়ে নিন।

<

Samaresh Majumdar ।। সমরেশ মজুমদার