গোলোক কহিলেন, রাগ? না, রাগ-অভিমান আর কার ওপর করব বল? সে তোমার দিদির সঙ্গে সঙ্গেই গেছে। বলিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিয়া কহিলেন, না, এখন আর কিছু খাব না। আজ গোকুল ঠাকুরের তিরোভাবে—সেই সন্ধ্যার পরেই একবারে সন্ধ্যে-আহ্নিক সেরে একটু দুধ-গঙ্গাজল মুখে দেব। এমনি করে যে ক’টা দিন যায়। বলিয়া আর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া হুঁকার নলটা মুখে দিলেন।

যে মেয়েটি নেপথ্য হইতে কথা কহিতেছিল, সে দ্বারটা ঈষৎ উন্মুক্ত করিয়া, ঘরে আর কেহ আছে কিনা দেখিয়া লইয়া ধীরে ধীরে প্রবেশ করিল। মেয়েটি বিধবা। দেখিতে কুশ্রী নয়, বয়সেও বোধ করি চব্বিশ-পঁচিশের মধ্যেই। পরিধানে মিহি সাদা ধুতি, হাতে কোন অলঙ্কার নাই, কিন্তু গলায় ইষ্টকবচ-বাঁধা একছড়া মোটা সোনার হার। একটুখানি হাসিয়া কহিল, আপনি ওই-সব ঠাট্টা করেন, লোকে কি মনে করে বলুন ত? তা ছাড়া আমাকে কি ফিরে যেতে হবে না? বলিয়া পরক্ষণেই মুখখানি বিষণ্ণ করিয়া কহিল, যাঁকে সেবা করতে এলুম তিনি ত ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন, এখন ফিরে গিয়ে কি বুড়ো শ্বশুর-শাশুড়ীকে আবার দেখতে শুনতে হবে না? আপনিই বলুন।

গোলোক তামাক টানিতে টানিতে গম্ভীর হইয়া বলিলেন, সে তো বটেই। আমার সংসার অচল বলে ত আর কুটুম্বের মেয়েকে ধরে রাখা যায় না। আর তাই যদি না হবে ঘরের লক্ষ্মীই বা এ-বয়সে ছেড়ে যাবে কেন? মধুসূদন! বেশ, তাই যাও একটা ভাল দিন দেখিয়ে। বোনের সেবা করতে এসেছিলে, সেবা দেখিয়ে গেলে বটে! গ্রামে একটা দৃষ্টান্ত হয়ে রইল।

জ্ঞানদা মৌন হইয়া রহিল। গোলোক কোঁচার খুঁট দিয়া চক্ষু মার্জনা করিয়া মিনিটখানেক নিঃশব্দে তামাক খাইয়া গাঢ়স্বরে কহিলেন, সতী-লক্ষ্মী তাঁর দিন ফুরলো, চলে গেলেন। সেজন্য দুঃখ করিনে—কিন্তু সংসারটা বয়ে গেল। মেয়েরা সব বড় হয়েছে, যে যার স্বামী-পুত্র নিয়ে শ্বশুরঘর করচে, তাদের জন্যে ভাবিনে, কিন্তু ছোঁড়াটা এবার ভেসে যাবে।

জ্ঞানদা আর্দ্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, বালাই ষাট। আপনি ও-সব মুখে আনেন কেন?

গোলোক মুখ তুলিয়া একটু ম্লান হাস্য করিয়া কহিল, না আনাই উচিত বটে, কিন্তু সমস্তই চোখের ওপর স্পষ্ট দেখতে পাচ্চি কিনা! মধুসূদন! তুমিই সত্য! ঘর-সংসারেও মন নেই, বিষয়-কর্মও বিষের মত ঠেকচে। যে ক’টা দিন বাঁচি, ব্রত-উপোস করতে আর তাঁর নাম নিতেই কেটে যাবে। সেজন্যে চিন্তা নেই—একমুঠো একসন্ধ্যে জোটে ভালো, না জোটে ক্ষতি নেই—কিন্তু ওই ছোঁড়াটার আখের ভেবেইমধুসূদন! তুমিই ভরসা!

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়