মৃত্যুঞ্জয় নীরব হইয়া রহিল।

গোলোকের হঠাৎ যেন একটা কথা মনে পড়িয়া গেল। বলিলেন, হাঁ দ্যাখো, তোমাকে যেজন্যে ডেকে পাঠিয়েচি, তাই এখনো বলা হয়নি। বলচি, মাসটা বড় টানাটানি চলচে, তোমার সুদের টাকাটা—

মৃত্যুঞ্জয় করুণসুরে বলিল, এ মাসটা যদি একটু দয়া করে—

গোলোক কহিলেন, আচ্ছা আচ্ছা, তাই হবে, তাই হবে। আমি কষ্ট দিয়ে এক পয়সাও নিতে চাইনে। কিন্তু বাবাজী, তোমাকেও আমার একটি কাজ করে দিতে হবে।

মৃত্যুঞ্জয় প্রফুল্ল হইয়া কহিল, যে আজ্ঞে। আজ্ঞা করুন।

গোলোক বলিলেন, সনাতন হিন্দুধর্মটি বাঁচিয়ে সমাজ রক্ষা করে চলা ত সোজা দায়িত্ব নয় মৃত্যুঞ্জয়! এ মহৎ ভার যার মাথার উপর, তার সকল দিকে চোখকান খুলে রাখতে হয়। শুনেছিলাম প্রিয় মুখুয্যের মায়ের সম্বন্ধে কি একটা নাকি গোল ছিল। এই খবরটি বাবা তোমাকে তাদের গ্রামে গিয়ে অতি গোপনে সংগ্রহ করে আনতে হবে। সে ছিলেন বটে তোমার পিতামহ শিরোমণি-মশায়, বিশ-ত্রিশখানা গ্রামের নাড়ীর খবর ছিল তাঁর কণ্ঠস্থ—ভূপতি চাটুয্যের যে দশটি বছর হুঁকো-নাপ্‌তে বন্ধ করে দিয়েছিলাম—ভায়াকে শেষে বাপ বাপ করে ছন্নভন্ন হয়ে গাঁ ছেড়ে পালাতে হলো, সে ত তোমার পিতামহের সাহায্যেই। কিন্তু তোমরা বাবা তাঁর কীর্তি বজায় রাখতে পারলে না, এ-কথা আমাকে বলতেই হবে।

মৃত্যুঞ্জয় তাহার পূর্বপুরুষের তুলনায় নিজের হীনতা উপলব্ধি করিয়া অত্যন্ত লজ্জিত হইল। কহিল, আপনি দেখবেন, চাটুয্যেমশায়, আমি একটি হপ্তার মধ্যেই তাদের পেটের খবর টেনে বার করে আনব।

গোলোক উৎসাহ দিয়া বলিলেন, তা তুমি পারবে, পারবে। কত বড় বংশের ছেলে। কিন্তু দেখ বাবাজী, এ নিয়ে এখন আর পাঁচ-কান করবার আবশ্যক নেই—কথাটা তোমার আমার মধ্যেই গোপনে থাক; সমাজের মান-মর্যাদা রক্ষা করতে হলে অনেক বিবেচনার প্রয়োজন। তা দ্যাখো, কেবল সুদ কেন, তোমার আসল টাকাটাও আমি বিবেচনা করে দেখব। কষ্টে পড়েচ, এ কথা যদি আগে জানাতে—

মৃত্যুঞ্জয় পুলকিত হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, যে আজ্ঞে, যে আজ্ঞে—আমরা আপনার চরণেই ত পড়ে আছি।আমি কালই এর সন্ধানে যাব—এই বলিয়া সে গমনোদ্যত হইল।

গোলোক জিভ কাটিয়া কহিলেন, অমন কথা মুখেও এনো না বাবাজী। আমি নিমিত্তমাত্র—তাঁর শ্রীচরণে কীটাণুকীটের ন্যায় পড়ে আছি। এই বলিয়া তিনি উপরের দিকে শিবনেত্র করিয়া হাতজোড় করিয়া নমস্কার করিলেন।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়