সন্ধ্যা প্রত্যুত্তরে শুধু একটু হাসিল। একমুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, পৃথিবীতে আশ্চর্যের আর অন্ত নেই। তারপরে কি একটা বলিতে গিয়া হঠাৎ থামিয়া গিয়া কহিল, অথচ আমার মান তুমি না রাখলে পৃথিবীতে আর কেউ রাখবার নেই। এ তোমার বিশ্বাস হয় অরুণদা?

অরুণ শুধু নিঃশব্দে চাহিয়া রহিল।

সন্ধ্যা কহিল, এককড়ি দুলের বিধবা স্ত্রীকে আর তার মেয়েকে এককড়ির বাপ তাড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু আমার বাবা তাদের ডেকে এনেচেন। আমি দিয়েছি তাদের আশ্রয়।

কোথায়?

আমাদের পুরানো গোয়ালঘরে। কিন্তু বামুনপাড়ার মধ্যে তারা থাকতে পাবে না।

অরুণ বিস্ময়াপন্ন হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কেন?

সন্ধ্যা বলিল, কেন কি? তারা যে দুলে! তারা আমাদের পুকুরঘাট থেকে খাবার জল নেয়, তারা পথের ওপর ছাগলকে ফ্যান খাওয়ায়—গোলোকঠাকুর্দা না জেনে পাছে মাড়িয়ে ফেলেন—মা প্রতিজ্ঞা করেছেন কাল সকালে তাদের ঝাঁটা মেরে বিদায় করে তবে স্নান করবেন। তুমি তাদের স্থান দাও অরুণদা—তাদের কিছু নেই—তারা একেবারে নিরাশ্রয়।

অরুণ কহিল, বেশ, কিন্তু কোথায় স্থান দেব?

সন্ধ্যা বলিল, তা আমি জানিনে—যেখানে হোক। তুমি ছাড়া আর আমি কাকে গিয়ে বলব?

অরুণ একটু ভাবিয়া বলিল, আমার উড়ে মালীটা বাড়ি চলে গেছে—তার ঘরটাতে কি তারা থাকতে পারবে? না হয় একটু-আধটু সারিয়ে দেব।

সন্ধ্যা মুখ তুলিয়া কথা কহিতে পারিল না, কেবল অধোমুখে মাথা নাড়িয়া তাহার সম্মতি জানাইল।

অরুণ কহিল, তা হলে তাদের পাঠিয়ে দাও গে। মালীটা ফিরে এলে তার অন্য ব্যবস্থা করে দেব।

সন্ধ্যা ইহারও জবাব দিতে পারিল না। তেমনি নতনেত্রে থাকিয়া বোধ হয় আপনাকে সামলাইতে লাগিল। তারপর আস্তে আস্তে বলিল, এখন আমার মুখেও পান নেই, গা ধুতেও এসেছিলাম। এই সময়ে তোমাকে একটু প্রণাম করে পায়ের ধুলো নিয়ে যাই। এই বলিয়া সে গড় হইয়া নমস্কার করিয়া তাহার পায়ের ধূলা মাথায় দিয়া দ্রুতপদে অদৃশ্য হইয়া গেল।

অরুণ তাহাকে ফিরিয়া ডাকিবার, বা আর কিছু জিজ্ঞাসা করিবার চেষ্টা করিল না, কেবল সেইদিকে চাহিয়া সে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল।



বোধ করি দিন-দুই পরে হইবে, জগদ্ধাত্রী তাঁহার পুষ্করিণী হইতে স্নান করিয়া বাড়ি ফিরিতেছিলেন, পথের মধ্যে রাসমণি দেখা দিলেন। তাঁহার সমস্ত চোখমুখ উত্তেজনা ও আগ্রহের আতিশয্যে কাঁদ-কাঁদ হইয়া উঠিয়াছে; কাছে আসিয়া অশ্রু-গদগদকণ্ঠে বলিয়া উঠিলেন, জাগো, মা আমার, তোর ঐ পাগলি মেয়েটা কি শেষে এমন তপিস্যেই করেছিল। অ্যাঁ, এ যে স্বপনের অতীত!

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়