ভোজন-পর্ব সমাধা হইয়াছিল, সাহেব উঠি-উঠি করিতেছিলেন,—মাসী মনে মনে চঞ্চল হইয়া উঠিলেন। প্রস্তাব উত্থাপনের সপক্ষে যে অনুকূল আবহাওয়া সৃষ্টি করিয়া আনিয়াছেন, তাহা চক্ষুলজ্জায় ভ্রষ্ট হইতে দিলে ফিরাইয়া আনা হয়ত দুরূহ হইবে। সঙ্কোচ অতিক্রম করিয়া বলিলেন, মিস্টার রে, একটা কথা ছিল, যদি সময় না—
সাহেব তৎক্ষণাৎ বসিয়া পড়িয়া কহিলেন, না না, সময় আছে বৈ কি। বলুন কি কথা?
মাসী বলিলেন, আমি শুনেচি বন্দনার অমত নেই। অশোক অর্থশালী নয় সত্যি, কিন্তু সুশিক্ষা ও চরিত্রবলে struggle করে একদিন ও উঠবেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আপনি যদি ওকে আপনার মেয়ের অযোগ্য বিবেচনা না করেন ত—
সাহেব আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, কিন্তু সে কি করে হতে পারে মিসেস ঘোষাল? অশোক আপনার ভাইপো, সম্পর্কে সেও ত বন্দনার মামাতো ভাই।
মাসী বলিলেন, শুধু নামে, নইলে বহু দূরের সম্বন্ধ। আমার দিদিমা এবং বন্দনার মায়ের দিদিমা দুজনে বোন ছিলেন, সেই সম্পর্কেই বন্দনার আমি মাসী। এ বিবাহ নিষিদ্ধ হতে পারে না মিস্টার রে।
সাহেব কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, বোধ হয় মনে মনে কি একটা হিসাব করিলেন, তারপরে বলিলেন, অশোককে যতটুকু আমি নিজে দেখেছি এবং যতটুকু বন্দনার মুখে শুনেছি তাতে অযোগ্য মনে করিনে। মেয়ের বিয়ে একদিন আমাকে দিতেই হবে, কিন্তু তার নিজের অভিমত ত জানা দরকার।
মাসী স্নেহের কণ্ঠে উৎসাহ দিয়া কহিলেন, লজ্জা করো না মা, বল তোমার বাবাকে কি তোমার ইচ্ছে।
বন্দনার মুখ পলকের জন্য রাঙ্গা হইয়া উঠিল, কিন্তু পরক্ষণে সুস্পষ্ট স্বরে বলিল, আমার ইচ্ছেকে আমি বিসর্জন দিয়েছি মাসীমা। সে খোঁজ করার দরকার নেই।
সাহেব সভয়ে কহিলেন, এর মানে?
বন্দনা বলিল, মানে ঠিক তোমাদের আমি বুঝিয়ে বলতে পারবো না বাবা। কিন্তু তাই বলে ভেবো না যেন আমি বাধা দিচ্চি। একটু থামিয়া কহিল, আমার সতীদিদির বিয়ে হয়েছিল তাঁর ন’বছর বয়সে। বাপ-মা যাঁর হাতে তাঁকে সমর্পণ করলেন মেজদি তাঁকেই নিলেন, নিজের বুদ্ধিতে বেছে নেননি। তবু, ভাগ্যে যাঁকে পেলেন সে স্বামী জগতে দুর্লভ। আমি সেই ভাগ্যকেই বিশ্বাস করবো বাবা। বিপ্রদাসবাবু সাধুপুরুষ, আসবার আগে আমাকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন যেখানে আমার কল্যাণ ভগবান সেখানেই আমাকে দেবেন। তাঁর সেই কথা কখনো মিথ্যে হবে না। তুমি আমাকে যা আদেশ করবে আমি তাই পালন করবো। মনের মধ্যে কোন সংশয়, কোন ভয় রাখবো না।
সাহেব বিস্ময়ে স্থির হইয়া তাহার প্রতি চাহিয়া রহিলেন, মুখ দিয়া একটা কথাও বাহির হইল না।
মাসী বলিলেন, বিয়ের সময় তোমার মেজদি ছিলেন বালিকা, তাই তার মতামতের প্রশ্নই ওঠেনি। কিন্তু তুমি তা নও, বড় হয়েছো, নিজের ভাল-মন্দের দায়িত্ব তোমার নিজের। এমন চোখ বুজে ভাগ্যের খেলা ত তোমার সাজে না বন্দনা।
উপন্যাস : বিপ্রদাস Chapter : 25 Page: 137
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: বিপ্রদাস
- Read Time: 1 min
- Hits: 161