উৎসাহ পাইয়া তিনি গরম হইয়া উঠিলেন, বলিলেন, এই ডিমোক্র্যাসির যুগে সবাই সমান, কেউ কারো ছোট নয়, এবং চাই প্রত্যেকেরই নিজের অধিকার জোর করে assert করা,—consequence তার যা-ই কেন না হোক। আমার টাকা থাকলে আপনার জমিদারির প্রত্যেক প্রজাকে আমি নিজের খরচে ইয়োরোপ ঘুরিয়ে আনতাম। নিজের right কাকে বলে, এ কথা তারা তখন নিজেরাই বুঝত।

বন্দনার বোধ করি ভারী খারাপ লাগিল, সে আস্তে আস্তে কহিল, জামাইবাবু তাঁর প্রজাদের উপর অত্যাচার করেন এ-খবর আপনাকে কে দিলে? আশা করি আপনার মামা-শ্বশুরের ওপর কোন জুলুম হয়নি?

ও—উনি বুঝি আপনার ভগিনীপতি? Thanks. না, তিনি কোন অভিযোগ করেন নি। নিজের স্ত্রীকে উদ্দেশ করিয়া সহাস্যে কহিলেন, তোমার বোনেরা যদি এইরকম হত! আপনি বোধ করি বিলেত ঘুরে এসেছেন? যাননি? যান, যান। Freedom, সাহস, শক্তি কাকে বলে, সে দেশের মেয়েরা সত্যি কি, একবার স্বচক্ষে দেখে আসুন। আমি next time যাবার সময় ওঁকে সঙ্গে নিয়ে যাব স্থির করেচি।

কেহ কোন কথা কহিবার পূর্বেই স্টেশনের সেই রিলিভিং হ্যান্ডটি মুখ বাড়াইয়া জানাইল যে ট্রেন distance signal পার হইয়াছে, আসিয়া পড়িল বলিয়া।

সকলে ব্যস্ত হইয়া প্লাটফর্মে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

গাড়ি দাঁড়াইলে দেখা গেল ছুটির বাজারে যাত্রী-সংখ্যার সীমা নাই। কোথাও তিল-ধারণের জায়গা পাওয়া কঠিন। মাত্র একখানি ফার্স্ট ক্লাস ও আর একখানি সেকেন্ড ক্লাস। সেকেন্ড ক্লাস ভরতি করিয়া একদল ফিরিঙ্গী রেলওয়ে-সারভ্যাণ্ট কলিকাতায় কি একটা খেলার উপলক্ষে চলিয়াছে, এবং বোধ হয় তাহাদেরই কয়েকজন স্থানাভাবে ফার্স্ট ক্লাসে চড়িয়া বসিয়াছে। অপর্যাপ্ত মদ ও বিয়ার খাইয়া লোকগুলার চেহারাও যেমন ভয়ঙ্কর, ব্যবহারও তেমনি বেপরোয়া। গাড়ির দরজা আটকাইয়া সকলে সমস্বরে চীৎকার করিয়া উঠিল,—go —যাও—যাও!

স্টেশনমাস্টার আসিল, গার্ডসাহেব আসিল, তাহারা গ্রাহ্যই করিল না।

ছোকরা সাহেব কহিলেন, উপায়?

বন্দনা ভয়ে ভয়ে কহিল, চলুন, আজ বাড়ি ফিরে যাই।

বিপ্রদাস বলিল, না।

না ত কি? না হয় রাত্রির ট্রেনে—

ছোকরা সাহেব বলিলেন, সে ছাড়া আর উপায় কি? কষ্ট হবে, তা হোক।

বিপ্রদাস ঘাড় নাড়িয়া কহিল, না। গাড়িতে চার-পাঁচজন আছে, আর চার-পাঁচজনের জায়গা হওয়া চাই।

বন্দনার পিতা ব্যাকুল হইয়া বলিলেন, চাই ত জানি, কিন্তু ওরা সব মাতাল যে!

বিপ্রদাসের সমস্ত দেহ যেন কঠিন লোহার মত ঋজু হইয়া উঠিল, কহিল, সে ওদের শখ,—আমাদের অপরাধ নয়। উঠুন, আমি সঙ্গে যাব। এবং পরক্ষণেই গাড়ির হাতল ধরিয়া সজোরে ধাক্কা দিয়া দরজা খুলিয়া ফেলিল। বন্দনার হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া কহিল, এসো। ছোকরা সাহেবকে ডাকিয়া কহিল, right assert করবেন ত স্ত্রী নিয়ে উঠে পড়ুন। অত্যাচারী জমিদার সঙ্গে থাকতে ভয় নেই।

মাতাল সাহেবগুলা এই লোকটির মুখের পানে একমুহূর্ত চাহিয়া থাকিয়া নিঃশব্দে গিয়া ও-দিকের বেঞ্চে বসিয়া পড়িল।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়