ইতিপূর্বে মৈত্রেয়ীর সহিত দ্বিজদাস কম কথাই কহিয়াছে। প্রয়োজনও হয় নাই, ইচ্ছাও করে নাই। এখন আলাপটা কিভাবে চালাইবে ভাবিতে ভাবিতে ফিরিয়া আসিয়া দেখে, না আছে খাবারের পাত্র, না আছে মৈত্রেয়ী নিজে। ব্যাপারটা ইতিমধ্যে কি ঘটিল অনুমান করিবার পূর্বেই কিন্তু সে ফিরিয়া আসিয়া দাঁড়াইল। বলিল, ঢাকা খুলে দেখি সমস্ত শুকিয়ে শক্ত হয়ে উঠেছে, তাই আবার আনতে গিয়েছিলুম। বসুন।
দ্বিজদাস কহিল, ধূঁয়া উঠছে দেখচি। এতরাত্রে ও-সব আবার পেলেন কোথায়?
মৈত্রেয়ী বলিল, ঠিক করে রেখে এসেছিলুম। যখনি বললেন খেতে দেরি হবে তখনি জানি এ-সব না রাখলে হয়ত খাওয়াই হবে না।
দ্বিজদাস ভোজনে বসিয়া প্রথমে রন্ধন-নৈপুণ্যের প্রশংসা করিয়া জানিল ইহার কতকগুলি মৈত্রেয়ীর স্বহস্তের তৈরি। সেগুলি বারংবার অনুরোধ করিয়া সে দ্বিজদাসকে বেশি করিয়া খাওয়াইল। এ বিদ্যায় সে ব্যুৎপন্ন,—জানে কি করিয়া খাওয়াইতে হয়।
দ্বিজদাস হাসিয়া কহিল, বেশি খেলে অসুখ করবে যে।
না, করবে না। কাল থেকে উপোস করে আছেন, একে বেশি খাওয়া বলে না।
কিন্তু আমিই ত কেবল না খেয়ে নেই, এ বাড়িতে বোধ করি অনেকেই আছেন।
মৈত্রেয়ী বলিল, অনেকের কথা জানিনে, কিন্তু মাকে যে কি করে দুটো খাওয়াতে পেরেচি সে শুধু আমিই জানি। আমি না থাকলে কতদিন যে তিনি দোর বন্ধ করে অনাহারে থাকতেন আমার ভাবলে ভয় হয়। কিন্তু আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না, শুনলে বড় লজ্জা করে। আমি কত ছোট।
দ্বিজদাস কহিল, সেই ভালো, তোমাকে আর ‘আপনি’ বলবো না। কিন্তু তুমি অন্নদাদিদির খবর নিয়েছিলে?
মৈত্রেয়ী কহিল, তার আবার কি হলো? সেও কি না খেয়ে আছে নাকি?
এতক্ষণ মৈত্রেয়ীর কথাগুলি তাহার বেশ লাগিতেছিল, একটা প্রসন্নতার বাতাস এই দুঃখের মধ্যেও যেন তাহার মনটাকে মাঝে মাঝে স্পর্শ করিয়া যাইতেছিল, কিন্তু এই শেষ কথাটায় চিত্ত তাহার মুহূর্তে বিরূপ হইয়া উঠিল, কহিল, অনুদির সম্বন্ধে এভাবে কথা বলতে নেই। হয়ত শুনেচো সে আমাদের দাসী, কিন্তু এ বাড়িতে তাঁর চেয়ে বড় আমার কেউ নেই। আমাদের মানুষ করেচেন।
মৈত্রেয়ী বলিল, তা শুনেচি। কিন্তু কত বাড়িতেই ত পুরনো দাস-দাসী ছেলেপুলে মানুষ করে। তাতে নতুন কি আছে? আচ্ছা, আপনার খাওয়া হয়ে গেলে তাঁর খবর নেবো।
দ্বিজদাস নিরুত্তরে ক্ষণকাল তাহার দিকে চাহিয়া রহিল। হঠাৎ মনে হইল, সত্যিই ত, এমন কত পরিবারেই ঘটিয়া থাকে, যে ভিতরের কথা জানে না, তাহার কাছে শুধু বাহিরের ঘটনায় একান্ত বিস্ময়কর ইহাতে কি আছে! কঠোর বিচার হালকা হইয়া আসিল, কহিল, অনুদি না খেয়ে থাকলেও এত রাত্রে আর খাবেন না। তাঁর জন্যে আজকে ব্যস্ত হবার দরকার নেই।
আবার কয়েক মিনিট নিঃশব্দে কাটিলে দ্বিজদাস জিজ্ঞাসা করিল, মৈত্রেয়ী, পরকে এমন সেবা করতে শিখলে তুমি কার কাছে? তোমার মার কাছে কি?
উপন্যাস : বিপ্রদাস Chapter : 24 Page: 128
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: বিপ্রদাস
- Read Time: 1 min
- Hits: 175