দ্বিজদাস বলিল, হাঁ।
মেঝের উপর ঠাঁই করিয়া মৈত্রেয়ী সযত্নে খাবার গুছাইয়া দিতেছিল, সেইদিকে চাহিয়া শশধর পুনশ্চ কহিল, তোমার ফিরতে এত দেরি হল যে! তাঁরা গেলেন ত সেই আড়াইটার গাড়িতে?
হাঁ।
শশধর একটুখানি হাসির ভান করিয়া বলিল, অথচ, কলকাতার বাড়িটা ত শুনেচি তোমার।
দ্বিজদাস কহিল, আমার বাড়িতে দাদার প্রবেশ নিষেধ নাকি?
শশধর কহিল, তা বলিনি। বরঞ্চ তিনিই যেন এই ভাবটা দেখিয়ে গেলেন। এ বাড়ি ছেড়েও ত তাঁর যাবার দরকার ছিল না, একটা মিটমাট করে নিলেই ত পারতেন।
দ্বিজদাস বলিল, মিটমাটের পথ যদি খোলা ছিল আপনি করে নিলেন না কেন?
আমি করে নেবো? শশধর অত্যন্ত বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিল, এ কিরকম প্রস্তাব? আমাকে অপমান করলেন তিনি আর মিটমাট করবো আমি? মন্দ যুক্তি নয়! এই বলিয়া সে টানিয়া টানিয়া হাসিতে লাগিল। হাসি থামিলে দ্বিজদাস বলিল, যুক্তি মন্দ দিইনি শশধরবাবু। মেয়েরা কথায় বলে পর্বতের আড়ালে থাকা। দাদা ছিলেন সেই পর্বত, আপনি ছিলেন তাঁর আড়ালে। এখন মুখোমুখি দাঁড়ালুম আমি আর আপনি। মান-অপমানের পালা সাঙ্গ হয়ে ত যায়নি,—মাত্র শুরু হলো।
তার মানে?
মানে এই যে, আমি আপনার বাল্যবন্ধু বিপ্রদাস নই,—আমি দ্বিজদাস।
শশধরের মুখের হাসি ধীরে ধীরে অন্তর্হিত হইল, ভয়ানক গম্ভীরকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, তোমার কথার অর্থ কি বেশ খুলে বল দিকি?
দাদার বন্ধু বলিয়া শশধর ‘তুমি’ বলিয়া ডাকিলেও দ্বিজদাস তাহাকে ‘আপনি’ বলিয়াই সম্বোধন করিত, বলিল, আপনার এ কথা মানি যে অর্থ আজ স্পষ্ট হওয়াই ভালো। আমার দাদা সেই জাতের মানুষ যারা সত্যরক্ষার জন্যে সর্বস্বান্ত হয়, আশ্রিতের জন্যে গায়ের মাংস কেটে দেয়, ওদের আদর্শ বলে কি এক অদ্ভুত বস্তু আছে যার জন্যে পারে না এমন কাজ নেই,— ওরা একধরনের পাগল,—তাই এই দুর্দশা। কিন্তু আমি নিতান্ত সাধারণ মানুষ, আপনার সঙ্গে বেশী প্রভেদ নেই। ঠিক আপনার মতই আমার হিংসে আছে, ঘৃণা আছে, প্রতিশোধ নেবার শয়তানি বুদ্ধি আছে, সুতরাং দাদাকে ঠকিয়ে থাকলে আপনাকেও ঠকাবো, তাঁর নাম জাল করে থাকলে স্বচ্ছন্দে আপনাকে জেলে পাঠাবো,—অন্ততঃ চেষ্টার ত্রুটি হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না দু পক্ষই একদিন পথের ভিখিরি হয়ে দাঁড়াই। বিজ্ঞজনের মুখে শুনি এমনিই নাকি এর পরিণতি। তাই হোক।
শশধর উচ্চৈঃস্বরে বলিয়া উঠিল, মা, শুনচেন আপনার দ্বিজুর কথা? ওর যা মুখে আসে বলতে ওকে বারণ করে দিন।
দ্বিজদাস বলিল, মাকে নালিশ জানিয়ে লাভ নেই শশধরবাবু। উনি জানেন আমি বিপিন নই,—মাতৃবাক্য দ্বিজুর বেদবাক্য নয়। দ্বিজু তাল ঠুকে স্পর্ধার অভিনয় করে না এ কথা মা বোঝেন।
কাহারো মুখে কথা নাই, উভয়ের অকস্মাৎ এইরূপ বাদ-প্রতিবাদ যেন সম্পূর্ণ অভাবিত। বিস্ময়ে ও ভয়ে সকলেই স্তব্ধ হইয়া গিয়াছিল। শশধর বুঝিল ইহা পরিহাস নয়,—অতিশয় কঠোর সঙ্কল্প। উত্তর দিতে গিয়া আর তাহার কণ্ঠস্বরে পূর্বের প্রবলতা ছিল না, তথাপি জোর দিয়াই বলিয়া উঠিল, এই শেষ। এখানে আর আমি জলগ্রহণ পর্যন্ত করবো না।
উপন্যাস : বিপ্রদাস Chapter : 24 Page: 126
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: বিপ্রদাস
- Read Time: 1 min
- Hits: 201