শুনিয়া বন্দনা হাসিয়া ফেলিল, কিন্তু জবাব দিল না।

বিপ্রদাস কহিল, সে দেশে শুনেচি বেলা বারোটা পর্যন্ত লোককে ঘুমুতে হয়। কঠিন-সাধনা। তোমাকে কিন্তু কষ্ট করে সাধতে হবে না, এদেশ থেকেই আয়ত্ত হয়ে রইল।

বন্দনা এবারও হাসিল, কিন্তু তেমনিই চুপ করিয়া বিপ্রদাসের মুখের পানে চাহিয়া রহিল। নিতান্তই সাদাসিধে সাধারণ ভদ্র চেহারা। হাস্য-পরিহাসে স্নেহশীল, তাহাদেরই একজন। অথচ কাল রাত্রির নীরবতায়, নির্জন গৃহের মধ্যে স্তব্ধ-মৌন এই মূর্তিটিকে কি যে রহস্যাবৃত মনে হইয়াছিল, এই দিবালোকে সেই কথা স্মরণ করিয়া তাহার কৌতুকের সীমা রহিল না।

মুখুয্যেমশাই, এঁরা কোথায়? কাউকে ত দেখচি নে?

বিপ্রদাস কহিল, তার মানে তাঁরা নেই। অর্থাৎ শ্বশুর মশাই এবং সস্ত্রীক ব্যারিস্টারমশাই—তিনজনেই গেছেন হাওড়ায় রেলওয়ে স্টেশনে—গাড়ি রিজার্ভ করতে।

বন্দনা সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, সস্ত্রীক ব্যারিস্টারমশাই করতে পারেন, কিন্তু বাবা করতে যাবেন কেন? তাঁর ছুটি শেষ হতে এখনো ত আট-দশ দিন বাকী আছে। তা ছাড়া আমাকে না বলে?

বিপ্রদাস কহিল, বলবার সময় পাননি, বোধ করি ফিরে এসেই বলবেন। সকালে বোম্বাইয়ের অফিস থেকে জরুরী তার এসেচে—মুখের ভাব দেখে সন্দেহ রইল না যে না গেলেই নয়।

কিন্তু আমি? এত শিগগির আমি যেতে যাব কেন?

বিপ্রদাসও সেই সুরে সুর মিলাইয়া কহিল, নিশ্চয়ই, যেতে যাবে কেন? আমিও ত ঠিক তাই বলি।

বন্দনা বুঝিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসু-মুখে চাহিয়া রহিল।

বিপ্রদাস কহিল, বোনটিকে একটা তার করে দাও না,—দেওরটিকে সঙ্গে করে এসে পড়ুন। তোমাদের মিলবেও ভাল, অতিথি-সৎকারের দায় থেকে আমিও অব্যাহতি পেয়ে বাঁচব।

বন্দনা সভয়ে ব্যগ্রস্বরে জিজ্ঞাসা করিয়া উঠিল, সে কি সম্ভব হতে পারে মুখুয্যেমশাই? মা কি কখনো এ প্রস্তাবে রাজী হবেন? আমাকে তিনি ত দেখতে পারেন না।

বিপ্রদাস কহিল, একবার চেষ্টা করেই দেখো না। বল ত তার করার একটা ফরম পাঠিয়ে দিই,—কি বল?

বন্দনা উৎসুক-চক্ষে ক্ষণকাল নিঃশব্দে চাহিয়া থাকিয়া শেষে কি ভাবিয়া বলিল, থাক গে মুখুয্যেমশাই, এ আমি পারব না।

তবে থাক।

আমি বরঞ্চ বাবার সঙ্গে না হয় চলেই যাই।

সেই ভাল, এই বলিয়া বিপ্রদাস চলিয়া গেল।

খাবার টেবিলের উপর পিতার টেলিগ্রামটা পড়িয়াছিল, বন্দনা খুলিয়া দেখিল সত্যই বোম্বাই অফিসের তার। অত্যন্ত জরুরী,—বিলম্ব করিবার জো নাই।

বন্দনা ঘরে গিয়া আরেকবার তোরঙ্গ গুছাইতে প্রবৃত্ত হইল।

বাবা তখনও ফিরেন নাই, ঘণ্টা-কয়েক পরে অন্নদা ঘরে ঢুকিয়া কহিল, আপনার নামে একটা টেলিগ্রাম এসেছে দিদি, এই নিন।

আমার টেলিগ্রাম? সবিস্ময়ে হাতে লইয়া বন্দনা খুলিয়া দেখিল বলরামপুর হইতে মা তাহাকেই তার করিয়াছেন। সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাইয়াছেন পিতার সহিত সে যেন কোনমতে ফিরিয়া না যায়। বৌমা দ্বিজুকে লইয়া রাত্রের গাড়িতে যাত্রা করিতেছে।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়