পরদিন বিকালে সতী আসিয়া পৌঁছিল, বন্দনা কলরবে অভ্যর্থনা করিতে গিয়া থমকিয়া দাঁড়াইয়া দেখিল মোটর হইতে অবতরণ করিতেছে শুধু মেজদি নয়, সঙ্গে আছেন শাশুড়ী—দয়াময়ী। উচ্ছ্বসিত আনন্দকলরোল নিবিয়া গেল, বন্দনা আড়ষ্টভাবে কোনমতে একটা প্রণাম সারিয়া লইয়া একধারে সরিয়া দাঁড়াইতেছিল; কিন্তু দয়াময়ী কাছে আসিয়া আজ তাহার চিবুক স্পর্শ করিয়া চুম্বন করিলেন, হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ভাল আছ ত মা?

বন্দনা মাথা নাড়িয়া সায় দিল,—ভাল আছি। মা, হঠাৎ, আপনি এসে পড়লেন যে?

দয়াময়ী বলিলেন, না এসে কি করি বল ত? আমার একটি পাগলী মেয়ে রাগ করে না খেয়ে চলে এসেচে, তাকে শান্ত করে বাড়ি ফিরিয়ে না নিয়ে গেলে নিজে শান্তি পাই কৈ মা?

বন্দনা কুণ্ঠিত হাস্যে কহিল, কি করে জানলেন আমি রাগ করে এসেচি?

দয়াময়ী বলিলেন, আগে ছেলেমেয়ে হোক, আমার মত তাদের মানুষ করে বড় করে তোল, তখন আপনিই বুঝবে মেয়ে রাগ করলে কি করে মায়ে জানতে পারে।

কথাগুলি তিনি এমন মিষ্টি করিয়া বলিলেন যে বন্দনা আর কোন জবাব না দিয়া হেঁট হইয়া এবার তাঁহার পা ছুঁইয়া প্রণাম করিল। উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল, বাবা বড় অসুস্থ মা।

অসুস্থ? কি হয়েচে তাঁর?


পায়ে আঘাত লেগে কাল থেকে শয্যাগত, উঠতে পারেন না। এই বলিয়া সে দুর্ঘটনার হেতু বিবৃত করিল।

দয়াময়ী ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন,—চিকিৎসার কোন ত্রুটি হয়নি ত? চল ত কোন্‌ ঘরে তোমার বাবা আছেন আমাকে নিয়ে যাবে। আগে তাঁকে দেখে আসি গে, তারপরে অন্য কাজ। এই বলিয়া তিনি সতীকে সঙ্গে করিয়া বন্দনার পিছনে পিছনে উপরে উঠিয়া রায়সাহেবের ঘরে প্রবেশ করিলেন। আজ তাঁহার পায়ের বেদনা বিশেষ ছিল না, ইঁহাদের দেখিয়া বিছানায় উঠিয়া বসিয়া নমস্কার করিলেন। দয়াময়ী হাত তুলিয়া প্রতিনমস্কার করিয়া সহাস্যে কহিলেন, বেইমশাই, পা ভাঙলো কি করে, কোথায় ঢুকেছিলেন?

সতী ও বন্দনা উভয়েই অন্যদিকে মুখ ফিরাইল, রায়সাহেব নিরীহ মানুষ, প্রতিবাদের সুরে বুঝাইতে লাগিলেন যে, কোথাও ঢুকিবার জন্য নয়, স্টেশন প্লাটফর্মে বিনাদোষে এই দুর্গতি ঘটিয়াছে।

দয়াময়ী হাসিয়া বলিলেন, যা হবার হয়েচে, এখন থাকুন দিন-কতক মেয়েদের জিম্মায় ঘরে বন্ধ। পাছে একটা মেয়েতে শাসন করে না উঠতে পারে তাই আর একটিকে টেনে আনলুম বেয়াই। দুজনে পালা করে দিন-কতক সেবা করুক।

রায়সাহেব তাহাই বিশ্বাস করিলেন এবং এই অনুগ্রহ ও সহানুভূতির জন্য বহু ধন্যবাদ দিলেন।

আবার দেখা হবে,—যাই এখন হাত-পা ধুই গে, এই বলিয়া বিদায় লইয়া দয়াময়ী নিজের ঘরে চলিয়া গেলেন।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়