বন্দনা মিনিট দুই-তিন নীরবে থাকিয়া কহিল, দিদির চিঠি থেকে আপনাকে যা ভেবেছিলুম তা আপনি নয়। এখন তাঁকে ভরসা দিতে পারব, তাঁদের ভয় নেই। আপনার স্বদেশ-সেবার অভিনয়ে মুখুয্যেবংশের বিপুল সম্পদের এক কণাও কোনদিন লোকসান হবে না। দিদি নিশ্চিন্ত হতে পারেন।

দ্বিজদাস হাসিয়া বলিল, দিদির লোকসান হয় এই কি আপনি চান?

বন্দনা বিব্রত হইয়া কহিল, বাঃ—তা কেন চাইব! আমি চাই তাঁদের ভয় ঘুচুক, তাঁরা নির্ভয় হোন।

দ্বিজদাস কহিল, আপনার চিন্তা নেই, তাঁরা নির্ভয়েই আছেন। অন্ততঃ দাদার সম্বন্ধে এ কথা নিঃসঙ্কোচে বলতে পারি, ভয় বলে কোন বস্তু তিনি আজও জানেন না। ও তাঁর প্রকৃতি-বিরুদ্ধ।

বন্দনা হাসিয়া বলিল, তার মানে ভয় জিনিসটা সবটুকু বাড়ির সকলে মিলে আপনারাই ভাগ করে নিয়েচেন, তাঁর ভাগে আর কিছুই পড়েনি—এই ত!

শুনিয়া দ্বিজদাসও হাসিল, কহিল, অনেকটা তাই বটে। তবে আপনাকেও বঞ্চিত করা হবে না, সামান্য যা অবশিষ্ট আছে সেটুকু আপনিও পাবেন। তিনি-চারদিন একসঙ্গে আছেন, এখনও তাঁকে চিনতে পারেন নি?

বন্দনা কহিল, না। আপনার কাছ থেকে তাঁকে চিনতে শিখব আশা করে আছি।

দ্বিজদাস কহিল, তা হলে প্রথম পাঠ নিন। ঐ জুতোজোড়াটি খুলে ফেলুন।

চাকর আসিয়া বলিল, মা আপনাদের ওপরে ডাকচেন।

চলিতে চলিতে বন্দনা জিজ্ঞাসা করিল, হঠাৎ মা এসেছেন কেন?

দ্বিজদাস বলিল, প্রথম, কৈলাস-যাত্রা সম্বন্ধে মামীদের সঙ্গে পরামর্শ করা; দ্বিতীয়, আপনাকে বলরামপুরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া। দেখবেন, যেন না বলে বসবেন না।

বন্দনা বলিল, আচ্ছা, তাই হবে।

দ্বিজদাস কহিল, মার সামনে আপনাকে মিস রায় বলা চলবে না। আপনি আমার বয়সে ছোট—বৌদিদির ছোট বোন—অতএব নাম ধরেই ডাকব। যেন রাগ করে আবার একটা কাণ্ড বাধাবেন না।

বন্দনা হাসিয়া বলিল, না, রাগ করব কেন? আপনি আমার নাম ধরেই ডাকবেন। কিন্তু আপনাকে ডাকবো কি বলে?

দ্বিজদাস বলিল, আমাকে দ্বিজুবাবু বলেই ডাকবেন। কিন্তু দাদাকে মুখুয্যেমশাই বলা মানবে না। তাঁকে সবাই বলে বড়দাদাবাবু,—আপনাকেও ডাকতে হবে বড়দাদা বলে। এই হ’ল আপনার দ্বিতীয় পাঠ!

কেন?

দ্বিজদাস বলিল, তর্ক করলে শেখা যায় না, মেনে নিতে হয়। পাঠ মুখস্থ হলে এর কারণ প্রকাশ করব,— কিন্তু এখন নয়।

বন্দনা কহিল, মুখুয্যেমশাই কিন্তু নিজে আশ্চর্য হবেন।

দ্বিজদাস বলিল, হলেও ক্ষতি নেই, কিন্তু মা বৌদিদি এঁরা বড় খুশী হবেন। এটা সত্যিই দরকার।

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়