বিপ্রদাস তৎক্ষণাৎ সায় দিয়া গম্ভীর হইয়া বলিল, সত্যিই সুস্থ হয়ে উঠবো মা, তোমরা ওকে আর বাধা দিও না, ওর সুবুদ্ধি হোক, আমাকে ওষুধ গেলানো বন্ধ করুক। আমি কায়মনে আশীর্বাদ করবো, বন্দনা রাজরানী হোক।
দয়াময়ী নীরবে চাহিয়া রহিলেন। তাঁহার দুই চক্ষু দিয়া যেন স্নেহ ও মমতা উছলিয়া পড়িতে লাগিল।
ঝি আসিয়া কহিল, মা, বৌদিদি বলছেন কলকাতা থেকে যে-সব জিনিসপত্র এখন এলো কোন্ ঘরে তুলবেন?
দয়াময়ী জবাব দিবার পূর্বেই বন্দনা বলিল, মা, আমি আপনার ম্লেচ্ছ মেয়ে বলে আপনার এতবড় কাজে কি কোন ভারই পাবো না, কেবল চুপ করে বসে থাকবো? এমন কত জিনিস ত আছে যা আমি ছুঁলেও ছোঁয়া যায় না।
দয়াময়ী তাহার হাত ধরিয়া একেবারে বুকের কাছে টানিয়া আনিলেন, আঁচল হইতে একটা চাবির গোছা খুলিয়া তাহার হাতে দিয়া বলিলেন, চুপ করে তোমাকে বসে থাকতেই বা দেব কেন মা? এই দিলুম তোমাকে আমার আপন ভাঁড়ারের চাবি, যা বৌমা ছাড়া আর কাউকে দিতে পারিনে। আজ থেকে এ ভার রইলো তোমার।
কি আছে মা এ ভাঁড়ারে?
এ চাবির গুচ্ছ অত্যন্ত পরিচিত, দ্বিজদাস কটাক্ষে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, আছে যা ছোঁয়াছুঁয়ির নাগালের বাইরে, আছে সোনা-রূপো, টাকাকড়ি, চেলি-গরদের জোড়। যা অতি বড় ধার্মিক ব্যক্তিরও মাথায় তুলে নিতে আপত্তি হবে না তুমি ছুঁলেও।
বন্দনা জিজ্ঞাসা করিল, কি করতে হবে মা আমাকে?
দয়াময়ী বলিলেন, অধ্যাপক-বিদায়, অতিথি-অভ্যাগতদের সম্মানরক্ষা, আত্মীয়স্বজনগণের পাথেয়র ব্যবস্থা,—আর ঐ সঙ্গে রাখবে এই ছেলেটাকে একটু কড়া শাসনে। এই বলিয়া তিনি দ্বিজদাসকে দেখাইয়া কহিলেন, আমি হিসেব বুঝিনে বলে ও ঠকিয়ে যে আমাকে কত টাকা নিয়ে অপব্যয় করচে তার ঠিকানা নেই মা। এইটি তোমাকে বন্ধ করতে হবে।
দ্বিজদাস বলিল, দাদার সামনে এমন কথা তুমি ব’লো না মা। উনি ভাববেন সত্যিই বা। খরচের খাতায় রীতিমত ব্যয়ের হিসেব লেখা হচ্চে, মিলিয়ে দেখলেই দেখতে পাবে।
দয়াময়ী বলিলেন, মেলাবো কোন্টা? ব্যয়ের হিসেব লেখা হচ্ছে মানি, কিন্তু অপব্যয়ের হিসেব কে লিখচে বল ত? আমি সেই কথাই বন্দনাকে জানাচ্ছিলুম।
বন্দনা বলিল, জেনেই বা কি করবো মা? ওঁর টাকা উনি অপব্যয় করলে আমি আটকাবো কি করে?
দয়াময়ী কহিলেন, সে আমি জানিনে। তুমি ভার নিতে চেয়েছিলে, আমি ভার দিয়ে নিশ্চিন্ত হলুম; কিন্তু একটা কথা বলি বন্দনা, তোমাকেও একদিন সংসার করতে হবে, তখন অপব্যয় বাঁচানোর দায় এসে যদি হাতে ঠেকে জানিনে বলেই ত নিস্তার পাবে না!
বন্দনা দ্বিজদাসের প্রতি চাহিয়া কহিল, শুনলেন ত মায়ের হুকুম?
দ্বিজদাস কহিল, শুনলুম বৈ কি! কিন্তু দাদা দিয়েছেন আমার ওপর খরচ করার ভার, মা দিলেন তোমাকে খরচ না–করার ভার। সুতরাং, খণ্ডযুদ্ধ বাধবেই, তখন দোষ দিলে চলবে না।
উপন্যাস : বিপ্রদাস Chapter : 22 Page: 109
- Details
- Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
- Category: বিপ্রদাস
- Read Time: 1 min
- Hits: 160