দয়াময়ী বলিলেন, তোর এক কথা! ম্লেচ্ছ হতে যাবে কিসের জন্যে,—ওর মা একবার বিলেত গিয়েছিল বলেই লোকে মেমসাহেব বলে দুর্নাম রটালে। নইলে আমাদের মতই বাঙালী ঘরের মেয়ে। বন্দনা জুতো পরে—তা পরলেই বা! বিদেশে অমন সবাই পরে। লোকজনের সামনে বার হয়—তাতেই বা দোষ কি? বোম্বায়ে ত আর ঘোমটা দেওয়া নেই—ছেলেবেলা থেকে যা শিখেচে তাই করে। আমার যেমন বৌমা তেমনি ও। বাপের সঙ্গে চলে যাবে বলচে—শুনলে মন কেমন করে বাবা।

বিপ্রদাস কহিল, মন কেমন করলে চলবে কেন মা? বন্দনা থাকতে আসেনি,—দুদিন পরে ওকে যেতে ত হবেই।

দয়াময়ী কহিলেন, যাবে সত্যি, কিন্তু ছেড়ে দিতে মন চায় না,—ইচ্ছে করে চিরকাল ধরে রেখে দিই।

বিপ্রদাস ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া বলিল, সে ত আর সত্যিই হবার জো নেই মা—পরের মেয়েকে অত জড়িও না। দুদিনের জন্যে এসেছে সেই ভালো। এই বলিয়া সে কিছু অন্যমনস্কের মত বাহিরে চলিয়া গেল।

কথাটা দয়াময়ীর বেশ মনঃপূত হইল না। কিন্তু সে ক্ষণকালের ব্যাপার মাত্র। বলরামপুরে ফিরিবার কেহ নাম করেন না, তাঁহাদের দিনগুলা কাটিতে লাগিল যেন উৎসবের মত—হাসিয়া, গল্প করিয়া এবং চতুর্দিকে পরিভ্রমণ করিয়া। সকলের সঙ্গেই হাস্য-পরিহাসে এতটা হাল্কা হইতে দয়াময়ীকে ইতিপূর্বে কেহ কখনও দেখে নাই,— তাঁহার অন্তরে কোথায় যেন একটা আনন্দের উৎস নিরন্তর প্রবাহিত হইতেছিল, তাঁহার বয়স ও প্রকৃতিসিদ্ধ গাম্ভীর্যকে সেই স্রোতে মাঝে মাঝে যেন ভাসাইয়া দিতে চায়।

সতীর সঙ্গে আভাসে-ইঙ্গিতে প্রায়ই কি কথা হয়, তাহার অর্থ শুধু শাশুড়ী-বধূই বুঝে, আরও একজন হয়ত কিছু-একটা অনুমান করে সে অন্নদা। সস্ত্রীক পাঞ্জাবের ব্যারিস্টারসাহেব এতদিন থাকিয়া কাল বাড়ি গেছেন, তাঁহাদের উভয়ের নামই বসন্ত, এই লইয়া দয়াময়ী যাইবার সময়ে কৌতুক করিয়াছিলেন এবং প্রতিশ্রুতি করাইয়া লইয়াছেন যে, কর্মস্থলে ফিরিবার পূর্বে আবার দেখা দিয়া যাইতে হইবে। হয় কলিকাতায়, নয় বলরামপুরে। রায়সাহেবের পা ভাল হইয়াছে, আগামী সপ্তাহে তিনি বোম্বাই যাত্রা করিবেন, দয়াময়ী নিজে দরবার করিয়া বন্দনার কিছুদিনের ছুটি মঞ্জুর করাইয়া লইয়াছেন, সে যে বোম্বায়ের পরিবর্তে বলরামপুরে গিয়া অন্ততঃ আরও একটা মাস দিদির কাছে অবস্থান করিবে এ ব্যবস্থা পাকা হইয়াছে।

মুখুয্যেদের মামলা-মকদ্দমা হাইকোর্টে লাগিয়াই থাকে, একটা বড়রকম মামলার তারিখ নিকটবর্তী হইতেছিল, তাই বিপ্রদাস স্থির করিল আর বাড়ি না গিয়া এই দিনটা পার কারিয়া দিয়া সকলকে লইয়া দেশে ফিরিবে। নানা কাজে তাহাকে সর্বদাই বাহিরে থাকিতে হয়, আজ ছিল রবিবার, দয়াময়ী আসিয়া হাসিমুখে বলিলেন, একটা মজার কথা শুনেচিস বিপিন?

বিপ্রদাস আদালতের কাগজ দেখিতেছিল, চৌকি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, কহিল, কি কথা মা?

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়