বাইশ

পরদিন সকালেই সকলে বলরামপুরের উদ্দেশে যাত্রা করিল। বাটীর কাছাকাছি আসিতে দেখা গেল দ্বিজদাস প্রায় রাজসূয়-যজ্ঞের ব্যাপার করিয়াছে। সম্মুখের মাঠে সারি সারি চালাঘর—কতক তৈরি হইয়াছে—কতক হইতেছে—ইতিমধ্যেই আহূত ও অনাহূতে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে, এখনো কত লোক যে আসিবে তাহার নির্দেশ পাওয়া কঠিন।

বিপ্রদাসকে দেখিয়া মা চমকিয়া গেলেন,—এ কি দেহ হয়েছে বাবা, একেবারে যে আধখানা হয়ে গেছিস।

বিপ্রদাস পায়ের ধূলা লইয়া বলিল, আর ভয় নেই মা, এবার সেরে উঠতে দেরি হবে না।

কিন্তু কলকাতায় ফিরে যেতেও আর দেবো না, তা যত কাজই তোর থাক। এখন থেকে নিজের চোখে চোখে রাখবো।

বিপ্রদাস হাসিমুখে চুপ করিয়া রহিল।

বন্দনা তাঁহাকে প্রণাম করিলে দয়াময়ী আশীর্বাদ করিয়া বলিলেন, এসো মা, এসো—বেঁচে থাকো।

কিন্তু কণ্ঠস্বরে তাঁহার উৎসাহ ছিল না, বুঝা গেল এ শুধু সাধারণ শিষ্টাচার, তার বেশি নয়। তাহাকে আসার নিমন্ত্রণ করা হয় নাই, সে স্বেচ্ছায় আসিয়াছে, মা এইটুকুই জানিলেন। তিনি মৈত্রেয়ীর কথা পাড়িলেন। মেয়েটির গুণের সীমা নাই, দয়াময়ীর দুঃখ এই যে এক-মুখে তাহার ফর্দ রচিয়া দাখিল করা সম্ভবপর নয়। বলিলেন, বাপ শেখায় নি এমন বিষয় নেই, মেয়েটা জানে না এমন কাজ নেই। বৌমার শরীরটা তেমন ভালো যাচ্চে না,—তাই ও একাই সমস্ত ভার যেন মাথায় তুলে নিয়েছে। ভাগ্যে ওকে আনা হয়েছিল বিপিন, নইলে কি যে হোতো আমার ভাবলে ভয় করে।

বিপ্রদাস বিস্ময় প্রকাশ করিয়া কহিল, বলো কি মা!

দয়াময়ী কহিলেন, সত্যি বাবা। মেয়েটার কাজকর্ম দেখে মনে হয় কর্তা যে বোঝা আমার ঘাড়ে ফেলে রেখে চলে গেছেন তার আর ভাবনা নেই। বৌমা ওকে সঙ্গী পেলে সকল ভার স্বচ্ছন্দে বইতে পারবেন, কোথাও ত্রুটি ঘটবে না। এ বছর ত আর হলো না, কিন্তু বেঁচে যদি থাকি আসচে বারে নিশ্চিন্ত মনে কৈলাস-দর্শনে আমি যাবোই যাবো।

বিপ্রদাস নীরব হইয়া রহিল। দয়াময়ীর কথা হয়ত মিথ্যা নয়, মৈত্রেয়ী হয়ত এমনি প্রশংসার যোগ্য, কিন্তু যশোগানেরও মাত্রা আছে, স্থান-কাল আছে। তাঁহার লক্ষ্য যাই হোক, উপলক্ষটাও কিন্তু চাপা রহিল না। একটা অকরুণ অসহিষ্ণু ক্ষুদ্রতা তাঁহার সুপরিচিত মর্যাদায় গিয়া যেন রূঢ় আঘাত করিল। হঠাৎ ছেলের মুখের পানে চাহিয়া দয়াময়ী নিজের এই ভুলটাই বুঝিতে পারিলেন, কিন্তু তখনি কি করিয়া যে প্রতিকার করিবেন তাহাও খুঁজিয়া পাইলেন না। দ্বিজদাস কাজের ভিড়ে অন্যত্র আবদ্ধ ছিল, খবর পাইয়া আসিয়া পৌঁছিল।

বিপ্রদাস কহিল, কি ভীষণ কাণ্ড করেছিস দ্বিজু, সামলাবি কি করে?

দ্বিজদাস বলিল, ভার ত আপনি নিজে নেননি দাদা, দিয়েছেন আমার ওপর। আপনার ভয়টা কিসের?

বন্দনা ইহার জবাব দিল, বলিল, ওঁর ভাবনা খরচের সব টাকাটা যদি প্রজাদের ঘাড়ে উসুল না হয় ত তবিলে হাত পড়বে। এতে ভয় হবে না দ্বিজুবাবু?

Sarat Chandra Chattopadhyay ।। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়